0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত




॥১৫॥


তুমি কি জানো আমারও ছিলো লক্ষ্যভেদী ধনুকে টান টান গুন পরানো তীক্ষ্ণ শর



মেজর জেনারেল সৌমজিত দাস

তাঁবুর বাইরে চার কোণায় চারজন রক্ষাকর্মী এ কে ফরটিসেভেন কাঁধে মোতায়েন। ভিতরে এমারজেন্সি মিটিং। রোজকার মতো প্রহরায় একজন নায়েব সুবেদার ও দশজন লেন্স নায়েক সিপাহী সশস্ত্র বাইরে দাঁড়িয়ে। পুরো মিলিটারী প্ল্যাটুন জানে এই জায়গাটা যুদ্ধক্ষেত্র নয়। আর আজ দিনভর সিডিউল মাফিক একের পর এক পুরো এরিয়া জুড়ে নানান যুদ্ধের মারণ অনুশীলন চলছে। তাও আবার দুই শক্তিশালী দেশের পদাতিক বাহিনী। দুই দেশের নিজের নিজের অস্ত্র পরীক্ষায় পুরো জায়গাটার প্রকৃতি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। সেই শব্দের তালে তালে অনধিকৃত তামাখনির ডিনামাইট চার্জএর কান ফাটা শব্দ। এই নির্বাধ পরিবেশে যেখানে একতরফা হিংস্রতাই মুখ্য, সেখানে মেজর জেনারেলের নিজের রক্ষার জন্যে এত রক্ষী কেন? স্বভাবতই মেজর জেনারেল সৌমজিতের অধীনস্থ অফিসার ও কয়েকজন ডিউটিফুল দেশপ্রেমী মিলিটারি ফোর্সের মনে চাপা অসন্তোষ। কেন এই অহেতুক এত রক্ষী? এ যেন ফাঁকা মাঠে নিজের পজিশন স্ট্যাটাস দেখানো। এমনিতেই এখানে রাশিয়া ও ইন্ডিয়ার যে যুগ্ম অভ্যাসের মেনু ঠিক করা হয়েছে সেটা এখানে না হয়ে কাশ্মীর কিংবা দেশের অন্যকোনো বর্ডারে হতে পারত। যেখানে উগ্রবাদীর আসল মানে আমরা সবাই জানি, দেশদ্রোহীতা। এই মহড়ার যে নাম রাখা হয়েছে অসুর নিধন। এইখানে অসুর আসলে কে? এই প্ল্যাটুনের সবাই জানে এখানে যত দুনম্বরী সুবিধাবাদী মাইন্সওনার, পোচার, টিম্বার মার্চেন্ট কিংবা ফার্মাসিউটিক্যাল্সদের শোষণের নজর। রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই এই ব্যবস্থা হয়েছে। প্র্যাকটিসের বাহানায় ওদের সাথে ফিক্সিং চলছে সবসময়। যে সময় মেজর জেনারেল স্নাইপার ও স্পটার টিম পাঠিয়ে ছিলেন দূর দূর জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী গ্রামে উগ্রবাদীর খোঁজে সেই সময় তারা খনিজ আকর সমৃদ্ধ অঞ্চলে আদিবাসীদের উপর অত্যাচার দেখে এসেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রাতদিন তামার খনিজ আকর খুঁড়ে তুলে নিয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এসেছে তারা। কিন্তু কিছু বলার নেই। এখন এমন ব্যবস্থা খনিতে প্রতিটি ডিনামাইট বিস্ফোরণের আওয়াজ ঢাকতে একটি করে মর্টার দাগার আদেশ। এ তো ওপেন সিক্রেট! আজ সকালে একটা শর্ট লেংথড মিসাইল দিয়ে দু কিলোমিটার জুড়ে কুষ্ঠ রোগের প্রতিষেধক ভেষজের জঙ্গলকে নষ্ট করে দিতে পারা গেছে। স্যাটেলাইট মাধ্যমে সমস্ত এরিয়া তন্নতন্ন করে সার্চ করে মোট দশটা বস্তি চিহ্নিত করা হয়েছে। আজই দুপুরে মর্টার ছুঁড়ে আর কামান দেগে ওগুলোকে শেষ করতেই হবে। খুব সতর্ক হয়ে, সাবধানে। কারণ, ওই লতাগুল্মভরা জঙ্গল এরিয়া আগুনে নষ্ট হওয়ার খবর ওরা বিদেশদপ্তরে সরকারিভাবে রিপোর্ট করে দিবেই।

ঘণ্টা দুই হলো ভিতরে এখন জোর মিটিং। বাইরে এখন তিনজন সুবেদার ও দশজন সিপাহী আদেশের অপেক্ষায়। এমনিতেই রক্ষাবাহিনীকে ধৈর্য রাখার ও শান্ত থাকার তালিম দেওয়া হয়। কিন্তু আজ যেন অসহিষ্ণুতার চুড়ান্ত। ফীল্ড মার্শাল লেফ্টন্যাণ্ট ও কয়েকজন সুবেদারদের ভিতর এই নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। কিন্তু সব ঘরোয়া। উনি হচ্ছেন চীফ অফ আর্মি স্টাফ। হুকুম তামিল ছাড়া প্রতিবাদ মানেই মিলিটারী জাস্টিসের ইউনিফর্ম কোড উল্লঙ্ঘন করা। তার মানেই সিধা কোর্ট মার্শাল। তাঁর নিয়ে কোনও কথাই বলা চলবেনা। কিন্তু উনি যে এখানে উগ্রবাদী মারার চিরুনি তল্লাশির ব্যবস্থা করেছেন। এখানের উগ্রবাদী মানে তো কিছু ভীতু আদিম মানুষ। যারা নানারকম রোগ অভাব দারিদ্রতা ও অপুষ্টিজনিত কষ্টে জর্জরিত। তারা এমনিই মরে আছে। তাদের মারার ব্যবস্থা?

বাইরে সুবেদার ও লেন্স নায়েকদের সাথে বিগ্রেডিয়ার এসে জয়েন করলেন। সবাই অবাক হোলো ওনার এখানে বাইরে থাকাতে। ওনার তো ভিতরে থাকার কথা। বিগ্রেডিয়ার সাহেব একটু উসখুস করে বলেই ফেললেন,

- আজই দুপুর থেকে লং রেঞ্জড মর্টার ও কামান দেগে জঙ্গলের মধ্যে দশটা বস্তি উড়িয়ে দিতে হবে। এটা কিন্তু রাশিয়ান আর্মিদের নলেজে নেই। মেজর জেনারেলের আদেশ, এটা করতে হবে খুব সতর্ক হয়ে, গোপনে। কারণ, যদি ওই লতাগুল্মভরা জঙ্গল এরিয়া আগুনে নষ্ট করে দেওয়ার খবর ওরা পায় তো সরাসরি বিদেশদপ্তরে সরকারিভাবে রিপোর্ট করে দিবেই। কোনমতে আগে জানতে পারলে আমাদের সবারই বিপদ। আমাদের সবার নাম ইন্টারন্যাশন্যাল ট্রাইবুনালে চলে যাবে। এখন তো সকাল দশটা বেজেই গিয়েছে। এখন তো ক্যামোফ্লেজড রকেটের টার্গেট রেঞ্জ ফিক্স করার কথা। লোকেশনটার প্রিসিসন করতে হবে। নিখুঁত টার্গেট না হলে চীফ রেগে যাবেন। কিন্তু এখনো মেজরের কোনো কমান্ড নেই কেন? ভিতরে এখন জোর মিটিং চলছে মনেহয়?

বিগ্রেডিয়ার সাহেব অন্য আর্মি পার্সন্যালদের খুব কাছে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, 

-দ্যাখো, আমি তোমাদের অফ দি ট্র্যাক বলছি। না না আমার এই কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়। আমি জানতে চাই, উনি যা করছেন, সেটা কী মানবিকতার সহায়ক? আমাদের কোড অফ আর্মি কণ্ডাক্ট এই কাজ কি সাপোর্ট করে? ওই নিরপরাধ অতি সরল অসহায় আদিম মানুষগুলোর উপরে কি অন্যায় হচ্ছে না? যেখানে কামানের গোলা পড়বে সে জায়গাতে নাকি মৃতসঞ্জিবনী ভেষজ আছে মানে এমন প্রতিষেধক ওষুধ যেটা খেলে সংক্রামক রোগ ঘেঁষে না আর যেকোনো ক্ষত চট করে সেরে যায়। তাছাড়া তোমরা তো জানো এখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে লেপ্রসি আর টিবির ওষুধ। জানো তো? রাশিয়ান ট্রুপ এখানে আসার আগে ওরা জিয়লোজিক্যাল আর বোটনিক্যাল সার্ভে করার জন্য এক্সপার্ট পাঠিয়ে ছিল? ওরাও এই অপারেশনটা চায় না। আমাদের জাতীয় সম্পত্তি এই ভেষজ গাছ গাছড়া। অন্য কোনো কান্ট্রিতে চট করে পাবেনা। এখানে এই ধ্বংসলীলায় আমরাও প্রত্যক্ষ দায়ী। এটাতেকি আমাদের ভালো হবে?

বিগ্রেডিয়ার থামলেন। একজন সুবেদার মুখ খুললেন। 

-আমরা কি করতে পারি? এই অপারেশন সরকার অনুমোদিত। মিলিটারি কোর্ট অফ ল অনুসারে আমরা ভায়লেট করতে পারি না। করলে কোর্ট মার্শাল হয়ে যাবে।

-আমরা মেমরেণ্ডাম তো দিতে পারি, কি না?

–আমরা এখানে মাত্র ক’জন কি করতে পারে স্যার? আমাদের ব্যাটেলিয়নে মোট তিনশ ফৌজী আছে। আর বুঝুন স্যার সিক্রেট মিটিং এ আপনি নেই। ওখানে যে এক বিগ্রেডিয়ার মিটিং কন্ডাক্ট করছেন তিনি কি তা আপনিও জানেন। স্যার এই অপারেশন সাকসেসফুল হবেই। আপনি আমি দেশের ভালো চাইলে কি হবে। ওরা খুব স্ট্র্ং।

পরিবেশ মৌন। ভিতরে মিটিং জোরদার। সবাই এখন যেন মেজর জেনারেল সৌমজিতের কথা না ভেবে ভিতরে সক্রিয় ভূমিকায় আর এক বিগ্রেডিয়ার সাহেবের চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে আছে। নাম ইকবাল কায়েফ। জন্ম পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। দিল্লীতেই মানুষ হয়েছেন। একবার বর্ডারে কোনো ব্যাপারে কোর্ট মার্শাল হতে গিয়ে খুব জোর বেঁচে গিয়েছেন। ব্যাটালিয়নের কেউই তাঁর উপর সন্তুষ্ট নয়। মিটিং প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেছে। অবশ্য এমনিতেই ব্যবস্থা সব রেডি। অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট বেসড লঞ্চার কয়েক মিনিটেই টার্গেট ফিক্স করে দেবে।

প্রত্যেকে বিষণ্ণ হয়ে মুখ নিচু করে এইসব কথাই ভাবছিল। হঠাৎ খুব অস্পষ্ট একটা ধামসার ডিম ডিম শব্দ কানে এল। সবাই হতচকিত হয়ে এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো। মিটিং তখনও ক্লোজড ডোর। মিনিট পাঁচ পর থেমে গেল। আবার নিস্তব্ধতা। আরও দশ মিনিটটেক পরে চতুর্দিকে বহু দূর থেকে থেমে থেমে ঢাকের আওয়াজ ভেসে এল। ডিম ডিম ড্ডিম ডিম ডিম.... 



0 comments: