1

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়



পুজোর আর একমাসও বাকি নেই। আগমনীর সুর লেগেছে বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে। বারো মাসে তের (এখন বোধহয় তেইশও হতে পারে, কেউ আর বিশেষ গুনছেন না) পার্ব্বণে জর্জরিত বাঙালীর কাছে কিন্তু ‘পুজো’ মানে এককথায় দুর্গাপুজোই। সারা বছরের অপেক্ষা। খুব মনে পড়ে যাচ্ছে বছর কুড়ি আগের কথা। কাঁচা বয়স – নতুন জামা – বাড়ির পুজো – অনেক ভাইবোন – নতুন নতুন বন্ধুত্ব... এই শেষেরটার আকর্ষণই আলাদা। বেশিরভাগেরই মেয়াদ এক পুজো থেকে পরের পুজো – বয়সটাই তো তেমন ছিলো। 

এখন পুজোর মানেটা বদলে গেছে। এখন পুজো মানে পুজো সংখ্যা, পুজোর লেখা – আর তার ফাঁকে ফাঁকে এই আশ্চর্য সুন্দর সংস্কারগুলির উৎস খোঁজা। আর ভারতবর্ষের এই অপৌরুষেয় আবহমান সংস্কৃতির উৎস সন্ধানই যে ঋতবাক-এর সুদূরপ্রসারী অভিক্ষেপের মূল উপজীব্য বিষয়াভিলাস হয়ে উঠছে ক্রমশ, তা প্রায় স্পষ্ট। বর্তমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে বোধ হয় সেটা জরুরীও। ধর্ম যখন সংস্কৃতির কন্ঠ চেপে ধরে, তখনই সত্যের দায়িত্ব প্রকট হয়ে পড়ে ধর্মকে তার উৎস এবং উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার। সে উৎস সমাজ মানসের শুভ চেতনায় এবং তার সার্থকতা সেই সৌহার্দ্যের সার্বিক ব্যপ্তির পথ ধরে ব্যক্তি মানসে এক দ্বন্দ্বহীন ঔচিত্যবোধের উন্মেষে। অন্তত ভারতবর্ষের চিরন্তন সংস্কৃতি তাইই বলে।

এই লক্ষ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যার কাজ প্রায় শেষের পথে। প্রকাশক, মুদ্রক, প্রচ্ছদ প্রস্তুত চূড়ান্ত পর্যায়ে। জোর কদমে চলছে প্রুফ চেকিং। অজস্র অযাচিত সাহায্যের প্রস্তাব আসছে অহরহ। আমরা কৃতজ্ঞ। 

বিগত কয়েক সংখ্যা ধরে এবং বিশেষ করে মুদ্রণের কাজে অসীম ধৈর্য্য এবং একনিষ্ঠ একাগ্রতায় নীরবে সাহায্য করে চলেছেন ঋতবাক-এর পরম সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সংখ্যায় তার স্বীকৃতি দেওয়া গেল। এখন থেকে কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসাবে সৌম্য ঋতবাক-এর অনেক খানি দায়িত্ব ভার নিলেন। আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা সার্থকতা লাভ করুক। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন, সৌম্য। 

আপনাদের নিরন্তর সাহচর্যে ঋতবাক-এর যাত্রাপথ মসৃণ ও সুগম হোক। 


শুভেচ্ছান্তে



সুস্মিতা বসু সিং

1 comments:

4

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



শতবর্ষ পেরিয়ে.....
                         ফিরে দেখা : বিকাশ রায়
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



এই প্রজন্মের কাছে বিস্মৃতপ্রায় এক অভিনেতা বিকাশ রায়। এবছর পূর্ণ করছেন তাঁর জন্মের একশ’বছর। শুধু অভিনেতাই বা বলি কেন, বিকাশ রায় ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্রাভিনেতা, সিনেমার প্রযোজক ও বহু সফল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। বিকাশ রায়ের শিল্পীজীবনের শুরু রেডিওর ঘোষক রূপে, তারপর চলচ্চিত্রজীবন শুরু হল ১৯৪৬এ। অভিনয়জীবনেরশেষ পর্বে মঞ্চ নাটকে যোগ দিয়ে ছিলেন১৯৭২এ।

রেডিওর অনুষ্ঠান সঞ্চালনা থেকে চলচ্চিত্রের নায়ক,খলনায়ক ও নানা দুরুহ চরিত্রে অভিনয়, চলচ্চিত্রের প্রযোজনা, চিত্রনাট্য রচনা, পরিচালনা ও মঞ্চের নাট্যাভিনয় – এই বিরাট পরিধি জুড়ে বিকাশ রায়ের শিল্পীজীবন। সিনেমার কাহিনীও লিখেছেন। ১৯৬০এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজা সাজা’র কাহিনীকার ছিলেন তিনি।

জন্ম ১৬ই মে, ১৯১৬, কলকাতার ভবানীপুরে। পিতা যুগোলকিশোর রায়।কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৩২এ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ১৯৩৬এ। সিনেমা-থিয়েটারের প্রতি কোন ঝোঁক ছিল না, বরং ঝোঁক ছিল সাহিত্যে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতেন। ‘বেদুইন’নামে একটা সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন সেই সময়ে। আইন বিদ্যা বা এল এল বি পাশ করেন ১৯৪১এ, কিন্তু স্থায়ীভাবে ওকালতি পেশা গ্রহণ করেননি।আইন বিদ্যা পাশ করার পর তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় এক ব্যারিস্টারী ফার্মের জুনিয়র হিসাবে। আইন ব্যবসা তাঁর জন্য নয়মনেকরে ছেড়ে দিয়ে চাকরী নিলেন সরকারী সিভিল ডিফেন্স বিভাগে, হেড ক্লার্কের। সেখানেও থাকলেন না। অনেক কম বেতনে, আশিটাকার মাস মাইনেতে চাকুরী নিলেন রেডিওর ঘোষকের। রেডিওর অনিশ্চিত চাকুরী ছেড়ে আবার অন্যত্র। এবার এক বাল্যবন্ধুর সহায়তায় যোগ দিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি যে কিমার’এ। সত্যজিৎ রায় তখন সবে মাত্র ওখানে যোগ দিয়েছেন। সত্যজিৎ রায় অবশ্য পরবর্তী সময়ে বিকাশ রায়কে তাঁর ছবিতে অভিনয়ের জন্য আহ্বান জানান নি।‘ডি জে কীমার’এর তিনশো টাকা মাইনের চাকুরী ছেড়ে আবার ফিরে এসেছিলেন রেডিওতে।

বিকাশ রায়ের সম্পদ ছিল তাঁর কন্ঠস্বর আর বাচনভঙ্গি ও স্বর প্রক্ষেপন।খলনায়ক বা অ্যানটি-হিরোর চরিত্রে ইষৎ চিবিয়ে সংলাপ বলতেন কিন্তু নিখুঁত স্পষ্ট উচ্চারণ কেটে কেটে। উত্তমকুমার প্রমুখ তাঁর সহ-আভিনেতারা নানান লেখায় বিকাশ রায়ের স্পষ্ট উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির কথা উল্লেখ করে গেছেন।নিশ্চিতভাবেই রেডিওতে কাজ করার সময় মাইক্রোফোনের সঠিক ব্যবহার করার কৌশল আর স্পষ্ট উচ্চারণের অনুশীলন করতে হয়েছিল তাঁকে।আর সেই শিক্ষাই তিনি প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর অভিনয়ে।

১৯৪৪এ বিমল রায় পরিচালিত ‘উদয়ের পথে’চলচ্চিত্রটি বাংলা ছায়াছবির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ‘উদয়ের পথে’র কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন জ্যোতির্ময় রায়। জ্যোতির্ময় রায় ছিলেন রেডিওতে বিকাশ রায়ের সহকর্মী। জ্যোতির্ময় রায়ের হাত ধরেই বিকাশের চলচ্চিত্রে প্রবেশ। জ্যোতির্ময় বিকাশকে পরিচালক হেমেন গুপ্তর কাছে নিয়ে যান। হেমেন গুপ্তর ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে বিকাশ রায়ের প্রথম অভিনয়। ১৯৪৭এর ৭ই ফেব্রুয়ারি ছবিটি মুক্তি পায়। এই ‘অভিযাত্রী’ ছবিতেই ছায়াছবির সুরকার রূপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অভিষেক ঘটেছিল। অর্থাৎ বাংলা সিনেমা ও সিনেমা সঙ্গীতের দুই কিংবদন্তী শিল্পী – বিকাশ রায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অভিষেক ঘটলো একই সঙ্গে। উল্লেখ করা যায় যে বিকাশ রায় পরিচালিত বেশিরভাগ ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালিক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় ছবি দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ‘রত্নদীপ’এওপ্রভূত খ্যাতি পেলেন বিকাশ।হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘ভুলিনাই’ বিকাশ রায়ের পরের ছায়াছবি।মনোজ বসুর কাহিনী নিয়ে হেমেন গুপ্ত পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পাবার পর তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ‘ভুলিনাই’ হয়ে গেল স্বাধীনতা সংগ্রামের দলিল।বিকাশের চরিত্র ছল ‘মহানন্দ’ – যে প্রথম জীবনে বিপ্লবী পরে বিশ্বাসঘাতক। ‘ভুলিনাই’তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিল।তারপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। পরিচালক হেমেন গুপ্তর‘ভুলিনাই’ ছবিতেঅভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে বিকাশ চাইলেন তাঁকে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হোক। সিনেমার কাজ শেখার তাগিদেই তিনি হেমেন গুপ্তর প্রোডাকশন ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে যা তাঁর কাজে লেগেছিল স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায়। হেমেন গুপ্ত রাজি হয়েছিলেন।

বিকাশ রায়ের স্মরনীয়তম কাজ হেমেন গুপ্তর ‘বিয়াল্লিশ’ (ছবির নামটি লেখা হয়েছিল ‘৪২’)। এ ছবির সহকারী পরিচালকও তিনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অধ্যায় নিয়ে নির্মিত বিয়াল্লিশ জনমানসে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। বিকাশের চরিত্র ছিল অত্যাচারি সামরিক অফিসার মেজর ত্রিবেদী’র, সাড়া জাগানো অভিনয় করেছিলেন বিকাশ রায়। অন্যান্য অভিনেতারা ছিলেন শম্ভু মিত্র, মঞ্জু দে, প্রমুখ।

আমরা যারা মধ্য পঞ্চাশ অর্থাৎ ১৯৫৩/৫৪ থেকে সিনেমা দেখা শুরু করেছি তাদের কাছে অভিনেতা বিকাশ রায়ের পরিচয় ছিল ভিলেন বা খলনায়কের। তারপর ১৯৬০এর দশক থেকে তাঁর চরিত্রাভিনয় সদ্য আঠেরো পেরনোআমার কিশোর মনকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল ১৯৬১তে মুক্তি প্রাপ্ত ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’ ছবিতে রামরাম বসুর চরিত্রটি। বিকাশ রায় তখন চিত্র পরিচালক। প্রমথনাথ বিশির বৃহৎ এই উপন্যাসটি নিয়ে যে ছায়াছবি করা যায়, এটাই অভাবনীয় ছিল।আসলে, বিকাশ রায় অভিনয়ের মধ্যে নিজেকে কোন ইমেজ বন্দী করে রাখেন নি। ‘ভুলিনাই’, ‘বিয়াল্লিশ’এ অভিনয়ে ক্রুরতার চরম প্রকাশ, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’, ‘কাঁচকাটা হীরে’তে নায়ক, ‘কাঁচের স্বর্গ’ ‘শাপমোচন’এ অ্যান্টি হিরো, ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে প্রেমিক ও স্নেহময় পিতা। আবার ‘ছেলে কার’, ‘ছদ্মবেশী’তেকমেডি।নানান ধরনের চরিত্রে দাপটে অভিনয় করেছেন।সাঁইত্রিশ বছরের চলচ্চিত্রজীবনে আড়াইশোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আর শুধু অভিনয়ই তো নয়, বহু স্মরনীয় বাংলা ছায়াছবির পরিচালকও তো তিনি। এবং পরিচালক রূপে নানা চ্যালেঞ্জিং কাজ করেছিলেন। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ তে ইতিহাসকে ধরতে চেয়েছিলেন। আমার আজও মনে আছে, ছবির টাইটেল শট – গঙ্গার বুকে একটা বজরা চলেছে আর ভেসে আসছে শ্যামল মিত্রর নেপথ্যকন্ঠে একটা গান ‘কিহ’ল রে জানো, পলাশীর ময়দানে ওড়ে কোম্পানীর নিশানো’...। ছবির মেজাজ স্পষ্ট হয়ে যায় দর্শকের কাছে। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ করেছিলেন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোন মেক-আপ ছাড়াই। আর ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলিকে দিয়ে প্লেব্যাক করিয়েছিলেন। বড়ে গোলাম আলি সেই একমাত্র ছবিতে প্লেব্যাক করেছিলেন।বাংলা সিনেমার বহু স্মরণীয় ছবির পরিচালক ছিলেন, তবুও মনে হয় অভিনেতা বিকাশ রায় ছাপিয়ে গিয়েছিলেন পরিচালক বিকাশ রায়কে। সুচিত্রা সেনের বিপরীতে নায়ক হিসাবে উত্তমকুমার ভিন্ন অন্য কাউকে ভাবতে পারতেন না বাংলা ছায়াছবির দর্শকরা। তেমন ছবি বক্স অফিসের দাক্ষিন্য পেতো না। কিন্তু বিপরীতে উত্তমকুমার নায়ক নন, সুচিত্রার এমন সফলতম তিনটি ছবিরই – ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ ও ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে নায়ক ছিলেন বিকাশ রায়। দীর্ঘ ৩৭ বছরের অভিনয় জীবনে বহু স্মণীয় চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’ চলচ্চিত্রে (১৯৬১) তাঁর ‘জীবন মশাই’ চরিত্রের অসামান্য অভিনয় আজ পঞ্চান্ন বছর পরেও কারো মন থেকে মুছে যাবার নয়। ‘জীবন মশাই’ চরিত্রের অভিনয় তাঁর নিজের কাছেও ছিল সবচেয়ে প্রিয়।সেই বিকাশ রায় ১৯৮৫তে রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে চলচ্চিত্রে অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল, এসেছিল ক্লান্তি।

ব্যক্তিজীবনে কেমন মানুষ ছিলেন বিকাশ রায়? সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে নানা গালগল্প, গসিপ, সিনেমা পত্র-পত্রিকার খুব মুখরোচক খাদ্য চিরকালই। কিন্তু বিকাশ রায়কে নিয়ে ‘গসিপ’ বা গাল-গল্প কেউ শোনেন নি।বিকাশ রায়ের কাছে যখন সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব এসেছিল, তখন তাঁর মা তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। স্ত্রীও শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন।তাঁর পুত্র আমেরিকা প্রবাসী সুমিত রায়ের বয়ানে - “বিকাশবাবু সারাজীবন তাঁর এক এবং অনন্যার কছে কথা রাখার চেষ্টা করে গেছেন, বিফল হয়েছিলেন বলে খবর পাইনি।” পিতার সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন থেকে আরও একটু উদ্ধার করি। লিখেছেন “সাঁইত্রিশ বছরে বিকাশবাবু আন্দাজ প্রায় তিনশোর কাছাকাছি ছবি করেছেন। তার কিছু খুব ভালো, কিছু খুব খারাপ, বাকী হয়তো মাঝামাঝি -- এর মধ্যে আহামরির কিছু নেই। আমি জানি যে বিকাশবাবুর আগে এবং পরে বাংলা ছবির অভিনয়ে নতুন পথের দিশারী অনেকে এসেছেন। কিন্তু আমি এবিষয়েও নিঃসন্দেহ যে হেমেন গুপ্ত, জ্যোতির্ময় রায়, রাধামোহন ভট্টাচার্য আদি পথিকৃত্দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে নিছক পৌরাণিক বা স্বাদহীন সামাজিক ছবির মামুলিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া, নতুন পথ দেখানো, নতুন লোকদের আনার ব্যাপারে বিকাশবাবুর অংশ বেশ বড়ো।ছোটো নয় তাঁর অবদান। আমার এও বিশ্বাস, যে বাঙালী চট্ করে সে কথা ভুলে যায়নি, যাবেও না”।

ছেলে সুমিত ১৯৬৪ থেকে আমেরিকা প্রবাসী। ১৯৭২এ আমেরিকায় ছেলের কাছে গিয়েছিলেন, এবং জেনেছিলেন ছেলে আর দেশে ফিরবেন না। ১৯৭২এ যোগ দিলেন মঞ্চে।বিশ্বরূপা মঞ্চে চৌরঙ্গী নাটকে ‘স্যাটা বোস’এর চরিত্র তাঁর মঞ্চের সেরা অভিনয়। বিশ্বরূপা থিয়েটারে ৫০০ রাত্রি্রও বেশি চলেছিল ‘চৌরঙ্গী’।বিশ্বরূপায় তাঁর অভিনীত পরের নাটক ‘আসামী হাজির’ও দীর্ঘদিন চলেছিল। বিশ্বরূপা ছেড়ে যোগ দিলেন তপন থিয়েটারে ‘নহবত’ নাটকে।‘নহবত’ চলেছিল একহাজার রাত্রিরও বেশি। বিকাশ রায় আদতে থিয়েটারের লোক ছিলেন না। পেশাদারী থিয়েটারে এলেন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ৫৬বছর বয়সে। সিনেমা ও থিয়েটারের অভিনয়ের পার্থক্য সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। সেই থিয়েটারের অভিনয়েও একঘেয়েমি এসে গেলো,থিয়েটারের অভিনয় ছেড়ে দিলেন। সিনেমাতেও একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল। একই ধরনের চরিত্র। জুলাই ১৯৮০ তে উত্তমকুমার চলে যাওয়ায় বাংলা সিনেমায় তখন বিরাট শূন্যতা। একা অভিনয়ে টানার মত কেউ নেই। ক্লান্ত বিকাশ রায় ১৯৮৫তে সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁর অভিনয়জীবনের সমাপ্তি ঘষণা করে দিলেন। কেন অন্তরালে চলে গেলেন? এরকম নজির তো আর নেই! এই প্রসঙ্গে ২৬শে জুলাই ২০১৪’র আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা মাধবী মুখার্জীর বয়ান উদ্ধার করি।মাধবী লিখেছেন - “আমি চলে যাচ্ছি, আমায় মনে রাখবেন।

তাঁর বাঁ হাতে ধরা কালো ছড়িটি কেঁপে উঠল।

—এ ভাবেই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বিকাশদা।

অনেকেরই মনে হয়েছিল, বহু স্বপ্নভঙ্গের অভিমান এবং ব্যথা থেকে বিকাশ রায় রেডিয়ো, টিভি, মঞ্চ, মাস মিডিয়ার রাজপথ থেকে সরে দাঁড়ালেন।

কারও কারও ধারণা হয়েছিল, বিকাশ রায় বয়সের জন্য সরে গেলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমি জানতাম মুখে কোনও নালিশ না জানালেও টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়া আর তার লোকজনকে ঘিরে ওঁর দুঃখবোধ, অভিমান যথেষ্টই ছিল।

আমায় বারবার বলতেন, “আমি চাই না আমার কোনও সন্তান এই অভিনয় জগতে আসুক। আমাদের পরিবারে আমাকে দিয়ে যা শুরু তার শেষও যেন আমাকে দিয়েই হয়।”

এরপর বাংলা চলচ্চিত্র থেকে চরিত্রাভিনয়ের একটা স্টাইলই যেন হারিয়ে গেলো। এর দুবছর পর ১৬ই এপ্রিল ১৯৮৭ তে চিরদিনের মত চলে গেলেন বিকাশ রায় একাত্তর বছর বয়সে।





[ তথ্যসূত্র – (১) ‘সোনার দাগ’ / গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (২) ‘বিকাশবাবু’- সুমিত রায়/ অবসর.নেট(৩) ‘ঘোষণা করে অভিনয় ছেড়ে দেন’/ সম্রাট মুখোপাধ্যায়, ‘আজকাল’ পত্রিকা ]

4 comments:

2

প্রবন্ধঃ কেয়া মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



হে স্বাধীনতা
কেয়া মুখোপাধ্যায়



আমাদের স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন শিখাদি। তখন ক্লাস ফোর। শিখাদি ক্লাস-টিচার। খুব সমীহ করার মত ব্যক্তিত্ব। ইংরেজি ক্লাসে একটাও বাংলা কথা নয়, উচ্চারণ ঠিক হওয়া চাই, ছোটদের ইংরেজি ক্লাসিক পড়ে ক্লাসে এসে গল্প বলতে হবে- এরকম হরেক নিয়ম। অনেকেই একটু ভয় পেত। আবার গানের ক্লসে তিনি অন্যরকম। রবীন্দ্রনাথের গান করেন আত্মস্থ হয়ে। সে বছর ১৫ই অগাস্ট সকালে স্কুলে গেছি। পতাকা উত্তোলনের পর ছোট অনুষ্ঠান। পরাধীনতার সেইসব দিনগুলি নিয়ে বললেন শিখাদি। বললেন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কথা। মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা। মাস্টারদার নেতৃত্বে অসমসাহসী ৬৫ জন তরুণের এক বিপ্লবী বাহিনী, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার কথা। 

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অস্ত্রাগার দখলের পর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সূর্য সেন। ঘোষণা করেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের। ক’দিন পরেকয়েক হাজার ইংরেজ সৈন্য ঘিরে ফেলল জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া বিপ্লবীদের। ব্রিটিশ সৈন্য তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করল। সম্মুখযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের রীতিমত পর্যুদস্ত করলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অসম যুদ্ধে শহীদ হলেন ১২ জন বিপ্লবী। তাঁদের একজন শিখাদির কাকা, হরিগোপাল বল। টেগরা নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি। আরো এগারো জন বিপ্লবীর সঙ্গে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হল তাঁর বাবার। বিপ্লবী লোকনাথ বল। তারপর ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬- চোদ্দ বছরের বন্দীদশা সেলুলার জেলে। সেদিন শিখাদি বলেছিলেন তাঁর ঠাকুমার কথা। দেশের জন্যে বিপ্লব করতে গিয়ে জীবন-সংশয় হতে পারে বুঝেও যিনি কখনো পিছিয়ে আসতে বলেননি ছেলেদের। ইতিহাসের পাতায় আমরা জন্মভূমিকে ভালবেসে, দেশকে স্বাধীন করার জন্যে এমন লক্ষ লক্ষ তরুণের জীবন উৎসর্গের কথা পড়েছি। কিন্তু এই যে স্বাধীন দেশে আমরা জন্মেছি, বড় হয়েছি – সে স্বাধীনতা যে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে এসেছে, সে কি সত্যিই আমরা মনে রাখি? রেখেছি?

ঊনিশ বছরও বয়স হয়নি, ফাঁসি হল ক্ষুদিরামের। অনেক বছর পরে, তাঁর দিদি, অপরূপা দেবী নিজের মনের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন:

“দেশের লোক হায় হায় ক’রে উঠল। দেশের লোক গান বাঁধল আমার ক্ষুদিরামকে নিয়ে। আমি সামনাসামনি কাঁদতে পারিনি, লুকিয়ে কাঁদতে হয়েছে। আর পাঁচটা বাঙ্গালীর মতোই চাকুরীসম্বল আমার স্বামী, তাও আবার ব্রিটিশরাজের ঘরেই চাকরী। প্রকাশ্যে কাঁদবার কি জো ছিলো? বছরের পর বছর গেছে, একের পর এক ক্ষুদিরামের নাম নিয়ে এগিয়ে গেছে দেশের ছেলেরা। যে যেমন বুঝেছে তেমনি করে এগিয়ে গেছে। তিনমুঠো খুদ দিয়ে ক্ষুদিরামকে কিনেছিলাম আমি- মনে মনে লোভ ছিল ক্ষুদিরামকে একা ভোগদখল করব। কিন্তু কখন যে আমার অগোচরে সে দেশের লোকের কাছে বিকিয়ে গেছে, জানতেও পারিনি। তিনমুঠো খুদ দিয়ে আমি কিনেছিলাম। দেশের ছেলেরা তাকে কিনলো আঁজলা আঁজলা রক্ত দিয়ে...।”

কখনো কি আমরা ভাবি, যে পরিবারের একটি তরুণ হারিয়ে গেল দেশের জন্যে তাদের জীবন কীভাবে চলে? সত্যি চলে কি? সেদিন হয়তো অত বুঝিনি। শুধু দেখেছি কথা বলতে বলতে চিকচিক করছিল অমন রাশভারি শিখাদির চোখের কোল। আবেগে ধরে গিয়েছিল গলা। পরে ভেবেছি, যে মায়ের একটি ছেলে ওভাবে সম্মুখ সংগ্রামে প্রাণ দিল, আর একটি ছেলে চলে গেল দ্বীপান্তরে- কেমন থাকেন সেই মা? কেমন থাকেন বিপ্লবীদের মায়েরা? দিদিরা? স্ত্রীরা? এঁদের আত্মত্যাগের জন্যেই তো স্বাধীন দেশের নাগরিক আমরা।

জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি স্তরে জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তি স্বাধীনতার নিরিখেই স্বাধীনতার বোধ-এর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। স্বাধীনতা তখনই মূল্যবান, যখন তা থাকে না। আমরা যারা স্বাধীন দেশে জন্মেছি, পরাধীনতার গ্লানিময় জীবন, বিদেশি শাসকের অসহনীয় অত্যাচারের দিনগুলো যারা দেখিনি, তাদের পক্ষে সামাজিক নানা প্রত্যাশা-পূরণের ব্যর্থতা দেখে নিজেদের ক্ষোভ, দুঃখ, অভিযোগ, অসহায়তার অনায়াস প্রকাশ আজ সম্ভব দেশটা স্বাধীন বলেই।

পরাধীন জীবন একরকম। সে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তিটুকু চায়। কিন্তু স্বাধীন হবার পরে আসে অধিকারের কথা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলকে কী কী অধিকার দেবে স্বাধীনতা? কোন্ কোন্ স্বপ্নপূরণ হবে? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রাথমিক নিরাপত্তাটুকু তখন আর যথেষ্ট নয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, পরিশ্রুত পানীয় জল, সকলের জন্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান- এই সব স্বপ্ন আর লক্ষ্য পূরণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার সার্থকতা। সেই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে ফাঁক থেকে গেছে অনেকখানি। আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নীচে ধুঁকছে বিশাল জনগোষ্ঠী।গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি এখনো। পরিষ্কার পানীয় জলের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন মানুষ। জলে আর্সেনিকের বিষ। খাদ্যে, এমনকি শিশুখাদ্যেও ভেজাল। শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পারিনি ঘরে ঘরে। বিনা চিকিৎসায় মারা যান অসহায় রোগী। ধর্মের নামে হানাহানি, খুনোখুনি অব্যাহত।বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথাচাড়া দেয় নানাদিকে। বর্ষায় বানভাসি হয় অগুন্তি মানুষ। অকপট সামাজিক বিশ্লেষণের জন্যে হাতে কলম তুলে নিয়েছেন যে মানুষটি- প্রতি মুহূর্তে প্রাণের ঝুঁকি তারও। নারীর নিরাপত্তা আজও সুনিশ্চিত নয়। একটি কিশোরী, তরুণী কি গৃহবধূ বাড়ি থেকে বেরোনোর পর না ফেরা অবধি দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকে তার বাড়ির লোকজন। সকালের খবরের কাগজ-জোড়া ভয়ের খবর, জয়ের নয়। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এ কেমন স্বাধীনতা!।

কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউতে আমার এক বন্ধুকে পরীক্ষক বলেছিলেন, “একটা ডায়েট চার্ট বানাতে পারবেন, আমলাশোলের জন্যে?” থমকে গিয়েছিল সে। স্বাধীন ভারতের সেই আমলাশোল, সেখানে কোন এক অনাগত ভবিষ্যতে পেটভরে দু’বেলার গরম ভাত খাওয়ার সুখস্বপ্নটুকুই বুঝি স্বাধীনতা। বেলপাহাড়ি হয়ে কাকরাঝোড় গিয়েছিলেন এক বন্ধু। নিঝুম এক গ্রামের একটি কুটিরের আগল নাড়িয়ে জল চেয়েছিলেন দুপুরবেলা তেষ্টা মেটাতে। কুটিরের দরজা ফাঁক করে, একটি বৃদ্ধ আর তার মেয়ে, জল চাওয়ার কথা শুনে, ম্লান হেসে বলেছিল, “আপনাদের কাছে জলের পাত্র আছে?” ওদের খাবার জল আছে ঝরণায়। কিন্তু শহুরে ভদ্রলোককে সে জল পান করতে দেবার মত কোন পাত্র নেই ঘরে। বটপাতা মুড়ে তাতে জল ভরে পান করে ওরা। জলের একটি পাত্রই কি ওদের কাছে স্বাধীনতার অন্য নাম! স্কুলছুট্ না হয়ে, জঙ্গল মহলের মেয়ে-বিটিরাও একদিন নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার স্বপ্ন দেখবে- সেখানেও লেগে থাকে স্বাধীনতার গন্ধ। বৃহত্তর ভারতের কাছে এই ভারত অপরিচিত। পরমাণু শক্তি, মঙ্গল অভিযান, সামাজিক নেটওয়ার্ক, হার-জিতের ক্রিকেট সিরিজ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই এই ভারতের। তবু এই ভারতের কাছেও স্বাধীনতার গুরুত্ব কম নয়। স্বাধীনতা তাদের এইটুকু মর্যাদা দিয়েছে যে তাদের সন্তান আর উত্তরপুরুষও অন্তত পরাধীনতার গ্লানিহীন একটা স্বাধীন দেশে বাস করবে, অনেকখানি আশা আর স্বপ্ন বুকে নিয়ে।

অন্যদিকে, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের কাছে স্বাধীনতা দিবস এখন শুধু আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতই। আলাদা কোন অনুভব নেই একে ঘিরে। শুক্রবার বা সোমবার দিনটা পড়লে লং উইকএন্ডে স্বজন-বন্ধু নিয়ে হুল্লোড়। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া। লং ড্রাইভে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। মাল্টিপ্লেক্সে নতুন ছবি দেখা, তারপর ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে উপলক্ষ্যে বিশেষ ছাড়ে শপিং মলে কেনাকাটা। ব্যতিক্রম শুধু স্কুলে ছোটদের পতাকা তোলা, রেডিও আর টিভির পর্দা থেকে ভেসে আসা স্বদেশি গানের সুর। এই চেনা ছকের বাইরে কোন অন্যরকম ভাবনার আলো, আশার আলো চোখে পড়ে না বড় একটা আজকাল।

আমাদের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে রীতিমত সচেতন আমরা। কিন্তু সচেতন নাগরিক হয়ে উঠে নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্বগুলো পালন করার কথা ভাবি কি? বোধহয় না। স্বাধীন দেশে অনেক অপ্রাপ্তি নিয়ে শুধু ক্ষোভটুকু উগরে না দিয়ে, নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্বগুলো ঠিকঠাক পালন করার চেষ্টা করতে পারি তো! বছরের নির্দিষ্ট দিনে ‘ও আমার দেশের মাটি’ কি ‘সার্থক জন্ম আমার’ গানে দেশপ্রেমকে আটকে না রেখে দেশের জন্যে, আশেপাশের মানুষের জন্যে কিছু করার কথা ভাবতে পারি তো! 

এই দেশ আমাদের জন্মভূমি। পরাধীনতার গ্লানি মুছিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করায় আমরা অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে কিছু করিনি। কিন্তু যে সুসন্তানরা আত্মত্যাগ করেছেন, যে মায়েরা আঁচলের আড়াল থেকে আত্মজদের দেশের কাজে এগিয়ে দিয়েছেন- তাঁদের প্রতি আমাদের অপার কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা। স্বাধীন দেশে আজও বিপুল সংখ্যক মানুষ ন্যূনতম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই মনে হয়, স্বাধীনতার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে আজও! তবু অনেকদিকে পিছিয়ে থেকেও, স্বাধীনতার ধারণাটিকে তুচ্ছ করা, অবজ্ঞা করা “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়”-এর স্লোগান বড় অর্থহীন মনে হয়। স্বাধীনতা নিয়ে অহঙ্কার না থাক, ভরসাটুকু থাকুক অন্তত।



দেশ মানে শুধু ইঁট, কাঠ, পাথর, মাটি নয়। দেশ মানে দেশের মানুষ, তাদের সবটুকু ভালো-মন্দ নিয়ে। পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতি হলে তবেই দেশের উন্নতি। এই দেশকে, এই দেশের সংস্কৃতিকে, এই দেশের মানুষকে ভালোবেসে নিজেদের প্রাপ্তির খানিকটাও যদি আমরা দেশকে ফিরিয়ে দিয়ে চেষ্টা করি- তাহলে কোনও একদিন হয়তো আকাশ ছুঁতে পারব! তখন আমাদের সকলের কাছে, হে স্বাধীনতা, প্রতিটিদিনই স্বাধীনতা দিবস। প্রতিদিনই মুক্তির দিন।

2 comments:

0

প্রবন্ধঃ আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



হিন্দুধর্ম ও নানা সংস্কার
আইভি চট্টোপাধ্যায় 



আজকের একবিংশ শতাব্দীতেও ধর্ম নিয়ে প্রবল উন্মাদনা। অযোধ্যায় করসেবকদের উন্মাদনা, পুরীতে রথের সময় জগন্নাথভক্তদের উন্মাদনা, প্রয়াগে কুম্ভমেলায় পুণ্যস্নানের উন্মাদনা, বাবার টানে কাঁধে বাঁক নিয়ে তারকেশ্বরে ছুটে চলার উন্মাদনা। তালিকা দীর্ঘতর হয়ে উঠবে অচিরেই। 

আর ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক মারদাঙ্গা? সেই কোনকালে শঙ্করপন্থী ও রামানুজপন্থীদের রক্তারক্তি দ্বন্দ্বের সাক্ষী ইতিহাস। সেই পরম্পরা প্রবহমান সাম্প্রতিককালেও। 

এখনও অসংখ্য মানুষ স্বর্গনরক, জন্মান্তরবাদ, দেবদেবীর পুজো, অবতারতত্ত্ব, চতুর্বর্ণভেদ, দৈবশক্তিতে বিশ্বাস, আংটি-তাবিজ-কবচ ধারণ, চন্দ্র-সূর্যগ্রহণে রাহুকেতুর ভুমিকা, শনি-মঙ্গলবার দেবতার নামে উপবাসে.. যুক্তির বদলে ভক্তিতে বিশ্বাস করেন।

বিভিন্ন শাস্ত্র, লোককাহিনী, পৌরাণিককাহিনী, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, মানুষের কল্পনা ও ভক্তির পথ ধরে আজকের ধর্ম যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখানে আচার-বিচার-সংস্কারই প্রধান। শাশ্বত ধর্মের বৃহত্তর মান্যতায় এই সংস্কার ও আচার-বিচারের সঙ্গে চিত্তশুদ্ধির কোন যোগ নেই। 

সমস্ত ধর্মের মধ্যে মিল একজায়গায়। ক্ষমা, করুণা। হৃদয়ের এক গভীর অনুভূতি যা মুক্ত স্বচ্ছ নির্মল ও প্রসাদিত। অধ্যাত্মবোধ ধর্মের মূলকথা। নাস্তিকতা বা ঈশ্বরবাদ ধর্মের সারবস্তু নয়। যথার্থ অধ্যাত্মবোধ মানুষকে আনন্দ দেয়, ক্ষুদ্রতা ভুলিয়ে দেয়, দেহবদ্ধতা দূর করে। মানুষের চেতনাতেই ধরা পড়ে অরূপের রূপ। সেই পরম সত্য।

যে সংস্কার আজকের মানুষের ধর্মবোধ ও অধ্যাত্মবোধের সঙ্গে জড়িত, তার প্রকৃত স্বরূপ খুঁজে বার করা আজকের মানুষের অতি আবশ্যক কর্তব্য। 



সাধারণভাবে 'সংস্কার' শব্দটি বলতে বোঝায় সমাজ বা কালের সঙ্গে অসংলগ্ন কোন বিষয়ের পুনর্নবীকরণ। সম-পূর্বক কৃ ধাতুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রত্যয়যোগে 'সংস্কৃত', 'সংস্কৃতি', 'সংস্কার' ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি, তৎসত্ত্বেও অর্থগত দিক দিয়ে প্রতিটি শব্দ ভিন্ন। 

ঋগ্বেদিক যুগের মন্ত্রে 'সংস্কৃত' শব্দটির ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, বৈদিক মন্ত্রপাঠ করে কোনও বস্তুকে বৈদিক কর্মের জন্য সংস্কৃত করে তোলা হত। সোমরসে পূর্ণ পাত্র, যাকে 'ঘর্ম' বলা হত, সেটি যজ্ঞের আগে 'সংস্কৃত' করা অতি প্রয়োজনীয় ছিল। পূর্বমীমাংসা দর্শনের জৈমিনি-সূত্রে 'সংস্কার' শব্দের ব্যাখ্যায় 'সম্মার্জন-সংস্কার' একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সেইসময় যজ্ঞপাত্রগুলি, যেমন 'গ্রহ', 'চমস' ইত্যাদি পরিস্কার করে ধুয়ে-মুছে নেবার ক্রিয়াকে 'সংস্কার' বলা হয়েছে।



সংস্কার বলতে ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গ এসে পড়ে। 'জন্মজন্মান্তরের সংস্কার' কথাটি হামেশাই ব্যবহার হয়। দার্শনিক দৃষ্টিতে স্থূল শরীর আমাদের অস্তিত্বের মাত্র দশ শতাংশ। অশরীরী সূক্ষ শরীর ('Aura' শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত) মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংবোধ দিয়ে তৈরী বাকী নব্বই শতাংশ। 

এই সূক্ষদেহী সংস্কার পুনর্জন্মকালে সঞ্চারিত হয় মানবশরীরে, ভারতীয় দার্শনিকদের এমন বিশ্বাস। এই সংস্কারের জন্য জ্ঞানের পরিভাষা মীমাংসা-দর্শনের প্রবক্তারা এবং শঙ্করাচার্য দিয়েছিলেন এইভাবে, ‘সংস্কারের মাধ্যমে একটি বস্তু বৃহত্তর প্রয়োজনের যোগ্য হয়ে ওঠে।’

দুর্ভাগ্য আমাদের, যজ্ঞ ও ধার্মিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে সংস্কারের যে তাৎপর্য বৈদিক যুগে প্রচলিত হয়, সেই তাৎপর্য সম্পূর্ণ অন্য অর্থে প্রবাহিত হতে থাকল একটি গোটা সমাজজীবনে। আজও যতই যুক্তিবোধ ও সচেতনতা থাকুক, অন্নপ্রাশন-বিবাহ-শ্রাদ্ধ এইরকম কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার মেনে চলা হয়। 

সংস্কার। সংস্কৃতি নয়। ভাবনার ভিতটাই নড়বড়ে। মূল ভাবনাটা হারিয়ে অর্থহীন কিছু সংস্কার আশ্রয় করে বাঁচা। 

ধর্মীয় তাৎপর্য যদি কেউ না-ও মানেন, সামাজিক উৎসবের মত পালন করতে কেউই আপত্তি করেন না। কিন্তু আদিকালের সমাজের ভাবনা, আচার ও রীতিনীতিপদ্ধতি পালন করলেও সংস্কারগত তাৎপর্য আমরা যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রশ্ন তুলি না। 



জন্মসূত্রে আমরা একটি ধর্মের উত্তরাধিকারী হই। শিশুমনের অবোধ সময় থেকে সেই বিশেষ ধর্ম নিয়ে আমাদের সচেতন হবার শিক্ষা দেওয়া হয়। কি সেই শিক্ষা? ভগবান কিংবা গড বা আল্লাহ। উপবাস, অঞ্জলি, পুজো, ধর্ম, আচার-বিচার-সংস্কার। মন্দির মসজিদ চার্চ গুরুদোয়ারা। বহুবিধ সামগ্রী, আয়োজন, অনুষ্ঠান, মন্ত্র-পাঠ। পুজো করার চেয়েও পুজো করতেই হবে – এই আবেগ শিক্ষা। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যে মানুষের মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ হইয়াছে, যে মানুষের মধ্যে আত্মচৈতন্য জাগ্রত হইয়াছে, সে-ই সংস্কৃতিবান।’



যিশু বলেছিলেন, ‘আমি ও আমার পরমপিতা একই।’হিন্দুধর্মে মূল কথা তাই। ‘সোহহম’। ইসলামের মূল কথাটাও তাই। ‘আমি ও আমার ঈশ্বর।’সেই একই কথা। ‘সোহহম’। বড্ড গভীর কথা। 

বিবিধ ধর্ম, বিবিধ মত। উদ্দেশ্য একটাই। মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখা, চেতনাকে জাগিয়ে রাখা। কিন্তু ধর্ম ও সংস্কৃতির কোন প্রবহমান রূপকে দেখি আমরা? 



হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক অনন্য সভ্যতা, যা ভারতের গৌরবময় উজ্জ্বল অতীতকে তুলে ধরে। ব্যাপকভাবে গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনীয়ারিং-এর প্রয়োগ ভারতের প্রাক-আর্য গরিমা প্রচার করে। হরপ্পা-সংস্কৃতি আজও হিন্দুধর্ম ও সংস্কারে প্রবাহিত। 

ইতিহাস বলে সেই সময়ের কথা, যখন আর্য এবং অনার্য সংস্কৃতির অবস্থান বিপরীত মেরুতে। সেই সময়ের কথা, যখন প্রথমে জৈন এবং পরে বৌদ্ধধর্ম তৎকালীন হিন্দুধর্মকে প্রায় গ্রাস করেছে। উল্লেখ্য এই, যে বুদ্ধ ঈশ্বরবাদকে ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন না। প্রাচ্যে চার্বাকও ছিলেন নাস্তিক। 

এই উদারনীতি মানুষের ধর্ম হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। সেই সময় বিবর্তিত হিন্দুধর্ম এক সঙ্কর সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আর্য, অনার্য এবং দ্রাবিড় বিশ্বাসের ওপর স্থাপিত হল সেই নতুন ধর্ম।



চারটি বেদ -- ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ। ব্রাহ্মণ্য-আরণ্যক, উপনিষদ, ১৮টি পুরাণ, ৬টি বেদাঙ্গ, উপবেদ, সূত্র (ধর্মসূত্র, গৃহ্যসূত্র ইত্যাদি)। দুটি ধর্মগ্রন্থ -- রামায়ণ ও মহাভারত। পাণিনির অষ্টাধ্যায় এবং মনুস্মৃতি। এই হল ধর্ম ও সংস্কার সম্পর্কে আমাদের ঐতিহাসিক পাঠের সূত্র। 

বৈদিক যুগে সংস্কারের সংখ্যা ছিল চল্লিশ। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সংস্কারের সংখ্যা কমতে থাকে। মনু লিখেছেন এক ব্যক্তিজীবনে বারোটি সংস্কার : 

(১) গর্ভাধান (২) পুংসবন (৩) সীমন্তোন্নয়ন (৪) জাতকর্ম (৫) নামকরণ (৬) নিষ্ক্রমণ (৭) অন্নপ্রাশন (৮) চূড়াকরণ (৯) উপনয়ন (১০) সমাবর্তন (১১) বিবাহ (১২) শ্মশানক্রিয়া বা শ্রাদ্ধ



গর্ভাধান

বহিরাগত আর্যরা ছিলেন যুদ্ধপ্রিয়। যুদ্ধে প্রয়োজন প্রচুর পুরুষ। তাই ঋগ্বেদের অনেক মন্ত্রে পুত্রকামনা ব্যক্ত হয়েছে। পুত্রলাভের অভিলাষে গর্ভাধান সংস্কারে পরিণত হল। দৈবতত্ত্বে বিশ্বাসী হলেও আর্যরা বিজ্ঞানকে নস্যাৎ করেন নি। গর্ভাধানের ক্ষেত্রে শারীরিক মিলন, ঋতুচক্রের ষোলদিনের মধ্যে গর্ভাধানের অনুষ্ঠানের নিয়মের কথা ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ এবং বৃহদারণ্যকে পাওয়া যায়। 



পুংসবন

পুত্রসন্তান প্রসবের জন্য পালনীয় নিয়মবিধি। খুব ভাল করে এই বিধির মন্ত্রগুলো পড়লে বোঝা যায় যে, পুত্রসন্তান লাভের উদ্দেশ্যে এই সংস্কার হলেও আর একটি বিশেষ ভাবনা ছিল। কোনমতেই গর্ভপাত যেন না হয়। 



সীমন্তোন্নয়ন

প্রতিটি বিধানই গর্ভিণী নারীর উদ্দেশে, ধর্মীয় নির্দেশের মন্ত্রে। প্রাচীনকালেও মানুষ বিশ্বাস করতেন গর্ভিণীর শান্ত ও প্রসন্ন মনই উত্তম সন্তানের জন্ম দেয়।



জাতকর্ম

সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুখে ঘি দেওয়া ও তারপর মাতৃস্তন্যপানের সংস্কার। মাতাকে অভিনন্দন ও প্রশংসা জানানো এই মন্ত্রগুলির আর একটি দিক।



নামকরণ

সন্তানের জন্মক্ষণেই একটি গুপ্তনাম দেওয়া হত। তারপর দশ-এগারো দিনের মাথায় নামকরণের সংস্কার পালন হত।



নিষ্ক্রমণ

শিশুকে প্রথম বাইরে নিয়ে আসার সংস্কার। পিতা সেদিন শিশুকে কোলে করে সূর্য দেখাতেন। মাতার অশৌচবিধিও শেষ হত এই দিন।



অন্নপ্রাশন

বৈজ্ঞানিক কারণেই এই সংস্কার আজও প্রচলিত। অন্নের প্রকৃষ্ট ভোজন (প্রাশন)। এককথায় ভাত খাওয়ানোর সংস্কার। প্রাচীন বৈদ্য সুশ্রুত লিখেছেন, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য তার ছয় মাস বয়সে উপযুক্ত সহজপাচ্য অন্য খাবার দিতে হবে।



চুড়াকরণ

মাথার ওপর চূড়ার মত উঁচু করে চুল (টিকি) রাখার সংস্কার। মাথা ন্যাড়া করার শারীরিক প্রয়োজনীয়তা থেকে এর উৎপত্তি। সুশ্রুতের মতে, মাথার পেছনে এক জায়গায় কতগুলো শিরার মিলনস্থল আছে, নাম অধিপতি। এইখানে হঠাৎ আঘাত লাগলে মৃত্যু নিশ্চিত। তাই চূড়াকরণ বিধির ছলে এই নিয়ম।



উপনয়ন

উপনয়ন শব্দটির উৎপত্তি নী-ধাতু থেকে, অর্থ 'নিয়ে যাওয়া'। 'উপ' অর্থাৎ কাছে। গুরুর কাছে শিক্ষার জন্য নিয়ে যাবার প্রথাই উপনয়নের সংস্কার। এই সময় গায়ত্রীমন্ত্র পাঠ ব্রহ্মবিদ্যার মাহাত্ম্য বোঝাতে ব্যবহার হত। পরবর্তীকালে এই উপনয়নপ্রথা আচার-বিচারে পূর্ণ এক ধর্মীয় সংস্কারে পরিণত হয়েছে। ঊপনয়নের ফলে ব্রাহ্মণ জ্ঞানী হয়ে দ্বিতীয়বার জন্মলাভ করে। তাই 'দ্বিজ' বলা হয়। 

গুরু ব্রহ্মচারীর ডান হাত ধরে নিজ হৃদয়ে গর্ভের মত ধারণ করেন। তাই তার নতুন জন্ম। ব্রাহ্মণ জন্ম। তিনদিনের গৃহগর্ভবাস এখন ধর্মীয় প্রথা, আর কিছুই নয়। ছাত্রাবস্থায় কিছু নিয়ম ও শৃঙ্খলা পালনীয় ছিল। কৃচ্ছ্রসাধন, শৃঙ্খলা ও পরিশ্রম। এই তিনটি নিয়ম উপনয়নের সঙ্গে জড়িত ছিল। আজ শুভ দিনক্ষণ বিচার, গায়ত্রীমন্ত্রজপ, হোম, ব্রতপালন.. এগুলো-ই ব্রহ্মচারীর প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।



সমাবর্তন

উপনয়নের পর গুরুকুলবাসের সময় ছিল বারো বছর। আঠারো/কুড়ি বছর বয়স হলে স্নাতক। তখন তার সমাবর্তন হত। সমাবর্তনের পর গৃহে ফেরার অনুমতি পেতেন বিদ্যালব্ধ ব্যক্তি।



বিবাহ

সিন্ধুসভ্যতার সময় থেকেই বিবাহ সামাজিক প্রথা হলেও বৈদিক যুগে বিবাহপ্রথা সংস্কার হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহের অধিকার হত স্নাতক হবার পর। ঋগ্বেদের যুগে গার্হস্থ্য আশ্রমে যজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য স্ত্রীর উপস্থিতি অনিবার্য ছিল। 

আজ শুধু বিবাহের দিনে একত্রে হোম-যজ্ঞ সম্পন্ন করার ধর্মীয় সংস্কারে পরিণত এই বিধি। আদিকালে মনে করা হত যে বিবাহের অর্থ পুরুষের জীবনে সমস্ত কর্মের মধ্যে স্ত্রীর সহ-ভাব। ধর্মপালনে, সমস্ত কর্ম এবং সন্তান উৎপাদন ও পালনেও। আজ বিবাহের এই অর্থ কজন মনে রাখেন? 



শ্রাদ্ধ

পুরো বিধিটিই বৈজ্ঞানিক কারণে। অগ্নির ব্যবহার ও স্নান স্বাস্থ্যের কারণে। মাথা ন্যাড়া করা চুলের সংস্কার। অশৌচ সময়ে জীবিত মানুষের দেহ ও মনকে শুদ্ধ করে তোলাটাই উদ্দেশ্য ছিল।



কিন্তু সংস্কারের তাৎপর্য যদি তিনহাজার বছর আগের মন্ত্র পড়া, মন্ত্র-পুরোহিত যোগে অন্নপ্রাশন, দিনক্ষণ দেখে উপনয়ন, জাতপাত মিলিয়ে বিবাহ, মস্তক-মুন্ডন করে শ্রাদ্ধে এসে দাঁড়ায়, তবে সংস্কারের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়। একটি বিশেষ সমাজ-চেতনা নিয়ে সংস্কার তৈরী হয়েছিল। 

ইতিহাস প্রমাণ করে, যে দেশে শাসক শক্তির যেমন ধর্মবিশ্বাস, ধর্ম ও আচারবিধির তেমন তেমন রূপান্তর হয়েছে বারবার। প্রাচীন মানুষের প্রকৃতির নিয়মে ভয়, অস্তিত্বের সঙ্কট, বর্ণাশ্রমজনিত শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপালাভের ইচ্ছা, যাগযজ্ঞ থেকে ধর্মীয় যে সংস্কারের শুরু, প্রাদেশিকতার প্রশ্নে কিন্তু তাতেও পার্থক্য অনেক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সংস্কারের প্রচলন ও পালনের ভিন্ন রূপ। এর সঙ্গে ধর্ম ও আত্ম-উত্তরণের সংযোগ কোথায়?

এটাও সত্য যে, ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতা নষ্ট হয়। শীতলাপুজো, মনসাপুজো, অতি সম্প্রতি সন্তোষীমাতার পুজো -- এই তো সমাজের প্রথা এখন। প্রশ্ন এই যে, আজও তবে এই ধর্মীয় সংস্কারের মূল্য কতখানি?



আজ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসে মানবসভ্যতার মূলকথা হওয়া উচিত --- এই সুখদুঃখে মেশা আশ্চর্য জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, অহংকে মুক্ত করে মৈত্রী ও শান্তির অন্বেষণ এবং মূল্যবোধ ও আত্মদর্শনকে পাথেয় করে আত্ম-উত্তরণ। গভীর অনুভব, গভীরতর বিশ্লেষণ, ততোধিক গভীর সুশৃঙ্খল ভাবনা । ধর্ম নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে, সংস্কার নিয়ে নতুন আলোর বোধ। 

ধর্ম-সংস্কার কোনো আচার অনুষ্ঠান নয়। ধর্ম এক নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, যা আমাদের দেখতে শেখায়, ভাবতে শেখায় । অনেকখানি আত্মশক্তি, অনেকখানি আত্মবিশ্বাস, যথা-অর্থে শিক্ষার আলো। সমর্পণ। তবেই আত্মশুদ্ধি। তবেই আত্মনির্মাণ। ‘আত্মদীপো ভব।‘ বড্ড গভীর কথা।

আত্ম-স্বীকৃতি আর আত্ম-আসক্তি। এই দুই শব্দে একটা সূক্ষ পার্থক্য। একটা নিজেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে, আরেকটা নিজেকে দিশাহীন করে রাখার জন্যে। পরিণত বিশ্লেষণ, সহিষ্ণু ব্যতিক্রমী আলোচনা, জীবনকে দেখার মনোরম বোধ, যাপনের প্রতি নিষ্ঠা এক নতুন দর্শনকে সাবলীল করে। যে দর্শনের উত্তরাধিকার পেয়েছি আমরা, নানা লেখার মধ্যে। সাহিত্য, গান, বৌদ্ধিক চর্চায়। 

আচার-বিচার-সংস্কার মানুষের পক্ষে বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নয়। মানুষের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত মানবধর্ম, মানবপ্রেম যার মূলকথা। আত্মশক্তির বিকাশ আর মুক্ত অন্তঃকরণের এক পবিত্রতাবোধ। এই আজকের মানুষের সংস্কার হওয়া উচিত।

...........................

তথ্যসুত্রঃ 

১) স্কন্দপুরাণম ২) উপনিষদ ৩) Glimpses of History -- Mr. Xavier Pinto



৪) Indian History -- Dr. Sagarika Mukherjee ৫) আচার-বিচার-সংস্কার -- শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ৬) প্রবন্ধ সংগ্রহ -- শ্রী শিবনারায়ণ রায়

0 comments:

0

প্রবন্ধঃ অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি ও বাঙালিয়ানা
অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য



শার্লক হোমস অমনিবাস থেকে একটা গল্প মনে আসছে, যেখানে মাতা সন্তানের বুক থেকে রক্ত খেয়ে সন্তানের শরীরে বিষ ঢুকতে দিতেনা। আজকের বর্তমানে জ্বলন্ত নিউজ –মার হাতে মেয়ে খুন| আর সেই খুনের প্লট, নিউজ পেপার আর টিভিতে দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এরকম ভয়ঙ্কর থ্রিলার কোনো লেখক কোন দিন লিখেছেন কিনা। আধুনিক ফরেনসিক সাইন্স যেভাবে এই খুনের মামলা সলভ করলো তাতে সোনি টিভিতে CID ফেল করে যাবে। CID মুম্বাই ব্যুরো লাইভ। এই খুনের রহস্য দেখতে গিয়ে বার বার একজন বাঙালি সত্যান্বেষীর নাম মনে আসছে–ব্যোমকেশ বক্সী। আমার নিজের বিচারে ব্যোমকেশ একমাত্র ভারতীয় ডিটেকটিভ যিনি শার্লক হোমস বা এর কুল পোয়ারোর সাথে এক মঞ্চে দাঁড়াতে পারেন। বাংলায় ডিটেকটিভ গল্পের জনক বলা চলে পাঁচকড়ি দে’কে। শশধর দত্তের মোহন, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের জয়ন্ত ছাড়াও কিরীটি রায়, ফেলুদা, কাকাবাবু অথবা পান্ডব গোয়েন্দা বাংলা গোয়েন্দা গল্পের অসামান্য সৃষ্টি।

কিন্তু হঠাৎ আজ গোয়েন্দা গল্পের কথা বলছি কেন? কারণ, প্রতিদিন খবরের কাগজে ফুটে ওঠা ভয়ংকর সব খুনের খবর। খুনের যে সমস্ত প্লট আর মোটিভ প্রকাশ পাচ্ছে, আর তাতে যে নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠছে, তাতে অনেক হিসেব উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ব্যোমকেশ বা ফেলুদা যদি আজ থাকতেন তাহলে সত্যি কি পারতেন আজকের এই সব খুনের রহস্য সমাধান করতে? সেদিনের গল্পে খুনের মোটিভ আর আজকের বাস্তব, দু’য়ের মধ্যে কি কোনও মিল আছে? আজ ফরেনসিক সাইন্স, কম্পিউটার গ্রাফিক্স সব এক হয়েও খুনের সমাধান খুঁজতে পারছেনা। ব্যোমকেশের মাকড়সার রস গল্পের রহস্য কি আজকের এই ই-মেইল, ফেইসবুক যুগে সমাধান খুঁজে পেত? মনে হচ্ছে বিগত দশ পনের বছরে সমাজে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে, যেটা সমাজের চিরাচরিত প্রথা বা নিয়মকে একদম উল্টে পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু একটা মৌলিক প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনের সাথে বাঙালিয়ানার সম্পর্ক কি? অথবা বাঙালিয়ানা বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি ? 

গোপাল কৃষ্ণ গোখেল বলেছিলেন, "what Bengal thinks today, India thinks tomorrow." এটা থেকে বোঝা যায় বাঙালি আর বাঙালিয়ানা বাকি ভারতবর্ষ থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। বাঙালিয়ানা শব্দটার জন্ম মনে হয় এই বিশেষত্ব থেকেই। বাঙালি যেদিন বিধবা বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেদিন ভারতীয় সমাজে কেউ সেটা কল্পনাও করতে পারতেন না। বিলাস ব্যসনে বাঙালির বাবু সমাজ, কলকাতার হারকাটাগলি, সুরার নেশায় বাইজীর ঘুঙ্গুর, আবার এরই মাঝে ইয়ংবেঙ্গল, ডিরোজিও, নারীশিক্ষা... এই সবই বাঙালিয়ানার মৌলিকতা। বেদান্ত প্রচারে স্বামী বিবেকানন্দ অথবা আইনস্টাইন আর সত্যেন বসুর সংযোগে "বোসনকনা"... সবই এই বাঙালির বাঙালিয়ানা। একটা গান মনে পড়ছে - "বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ চিংড়ি মাছের লাউ"। সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ঝাঁঝ, লঙ্কার হল্কাতে চোখের জল। সবই সেই বাঙালিয়ানা। মেয়েদের পোশাকে স্বাধীনতা দিয়েছে সেই বাঙালি। ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা। নতুন কায়দায় শাড়ি পড়তে শিখিয়েছে। আজকের পথে খোলা পিঠের বিভাজিকা বা উন্মুক্ত নাভিতে মোহময়ী হয়ে ওঠার সাহসী পদক্ষেপ। একদম স্বছন্দ বিচরণ। জমিদার গিন্নির হুকা টানা। অভিজাত ঘরে সুরার গ্লাস। আজকের মধ্যবিত্ত মেয়েরাও বিয়ার বার-এ যাচ্ছে। হাতে সিগারেট। "চোখেরবালি" তে আছে বিধবা মেয়েদের গোপনে মিলনের কাহিনী। শরীরের তৃষ্ণা মেটানো। আজকের বাঙালি সেই গোপনীয়তা কাটিয়ে উঠেছে। বেড়েছে আবেদন। পরিবর্তন এসেছে প্রনয় নিবেদনের কৌশলে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আজ বাঙালিয়ানা কিছুটা তার স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ফেললেও, আজও সরস্বতী পূজা বাঙালির ভ্যালেনটাইন ডে। ভ্যালেনটাইন ডে’র পরের দিন কি ? ফেইসবুক-এ পোস্ট হয় আই পিল ডে। এটাও আজকের আধুনিক বাঙালিয়ানা। বাংলার একজন প্রিয় দৈনিক পত্রিকাতে পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন–বোল্ড রিলেশন, উষ্ণ বন্ধুত্বের আর বশীকরণ স্পেশালিস্ট জ্যোতিষীদের। হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে ডান্সবারের আধিক্য দেখে মনে হচ্ছিল মুম্বাই যেন কলকাতায় চলে এসেছে। যাই হোক, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, কোনটা শালীন, কোনটা অশালীন, কোনটা সংস্কৃতি আর কোনটা অপসংস্কৃতি, সেটা বিচার করতে বসিনি। আমি আশাবাদী মানুষ হিসেবে মনে করি সমাজে সময়ের সাথে এই পরিবর্তন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাঙালি ও বাঙালিয়ানা যে আগের মত নেই, সেটা পরিষ্কার। আর এটাই বোধহয় আধুনিক বাঙালিয়ানা।

বাঙালি, বাঙ্গালী বানানের বিচারে দু’টো বানানই শুদ্ধ। একটা দেশজ, তাই ‘ই’। আর একটা বঙ্গশব্দজ, তাই ‘ঈ’। কিন্তু বাঙালিয়ানা সবসময়ই অভিনব। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। স্বাতন্ত্র্য বহন করে। কিন্তু আজকের এই পরিবর্তনের সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতা আর অবাধ স্বাধীনতা, এই দুইয়ের দ্রবণ অসম্পৃক্ত থেকে গেছে। বাঙালিয়ানা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার আবর্তে। আপাত সীমারেখা আইনের লক্ষণরেখাকে বারবার অতিক্রম করে ফেলছে। আর তারই প্রতিফলন প্রতিদিনের খবরের কাগজে। ধর্ষণ, নির্যাতন, নৃশংসহত্যা, সাথে মনস্তত্ত্ববিদ্যার সমস্ত তত্ত্বকে বিফল করে নৈতিকতার পতন আর মানবতার স্খলন বিষাক্ত করে তুলছে সমাজকে। উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত সবাই। লেখক হিসেবে আমারও এক ক্ষুদ্র চেষ্টা।

ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রে একটা তত্ত্ব আছে সিস্টেম ডাইনামিক্স (System Dynamics) বলে। সেই তত্ত্ব মতে যে কোনো সিস্টেম সবসময় একটা পসিটিভ আর একটা নেগেটিভ লুপ দিয়ে সাম্যাবস্থায় থাকে। কিন্তু যখন সেই ব্যালান্স বিঘ্নিত হয়, তখনি অসমানুপাতিক উন্নতি বা অবনতি ঘটতে থাকে। এই সূত্র যদি আমরা সমাজে প্রয়োগ করি, তবে আমরা বিগত দশ-পনের বছরে এরকম কিছু অসমানুপাতিক পরিবর্তন দেখতে পাই। সেই পরিবর্তন টেকনোলজি, শিক্ষা, সামাজিক সম্পর্ক সবক্ষেত্রেই এসেছে। বেড়েছে অর্থনৈতিক অসাম্য। অবাধ মেলামেশার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক, বিশ্বাস। তাৎক্ষণিক আনন্দ বা চমক ঢেকে দিচ্ছে সুদূর পরিকল্পনা। সব মিলিয়ে বেড়েছে অসাম্য। অনেকটা তাপগতিবিদ্যার এনট্রপির মত। যেটা সবসময় বেড়েই চলে আর বাড়িয়ে দেয় অনিয়ম (disorderliness)। বস্তুজগতে, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নে, সমস্ত সিস্টেম একটা ধর্ম মেনে চলে। অস্থিরতা থেকে স্থিতাবস্থায় আসার চেষ্টা। সেখান থেকেই জন্ম রাসায়নিক বিক্রিয়ার। আমাদের সমাজও সেরকম, বর্তমান অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীল হবে। এটাই ধর্ম। এটাই চলার পথ।

0 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে - ৫ম পর্ব 
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়



উৎসবমুখর গো-বাথান প্রাঙ্গণ জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কেবলমাত্র রন্ধনশালার কাছে অয়স-নির্মিত বিশাল উদুখল-মুষলে একজন গোপালকের শুকনো মরিচ গুঁড়ো করারধাতব ঠং ঠং শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

দক্ষ লাঠিয়াল ধানুক সৈরিকদের নিয়ে বাথানের অনেকটা আগে দুর্বৃত্তদের আগমন পথের দুপাশে গোধূমক্ষেত্রের মধ্যে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে ঢুকে নিশ্চল কিন্তু সজাগ হয়ে আত্মগোপন করে আছে। শবর, কিরাত আর বাথানের অন্যান্য সমর্থ পুরুষদের একাংশ বাথান-প্রাঙ্গণের ঘন পত্রাচ্ছাদিতবৃক্ষশাখার অন্তরালে নিঃশব্দে আত্মগোপন করে আছে। হাতিয়ার বলতে শবরদের নিত্যসঙ্গী তির-ধনুক ও ধারালো অসিপুত্রী ছাড়া তারা যতটা সম্ভব প্রস্তরখণ্ড সঙ্গে রেখেছে। মাধ্বী বিতরণকারী বিশালদেহী কৃষ্ণকায় অনার্য বয়স্ক পুরুষটি মাংস ও অন্যান্য খাদ্য সম্ভারগুলির পাশে বসে নেশাতুরের মত ঝিমোচ্ছে; অথচ সে বিন্দুমাত্র মাধ্বী বা সীধু, পৈষ্টী কিছুইপান করেনি। তার আশেপাশে জনা দশেক বলবান পুরুষ সিধু বা পৈষ্টী পানরত মত্ত-র ভূমিকায় পাহারায় আছে।রন্ধনকার্যের ভান করে রাঁধুনিরা বিশাল বিশাল পাত্রে জল ভর্তি করে উনানে চাপিয়ে দিয়ে তাদের লোহার ভারি ভারি হাতা-খুন্তি ও জ্বালানির মোটা মোটা কাষ্ঠখণ্ডগুলিকে হাতের কাছে সাজিয়ে আসন্ন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সবার পুরোভাগে আচার্য চিত্রভানু একটি ঘন নিচুলের ঝোপে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছেন।

চিত্রভানু দেখলেন দূরাগত ধূসর ধূলিঝড়টি বাথানের একটু দূরে এসে থেমে গেল। এখান থেকে লোকগুলিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে; সংখ্যায় তারা শতাধিক। তাদের পরণে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের পোশাক, কাঁধে ধনুক আর পিঠে বাঁধা তূণীর ও ভল্লর ত্রিকোণ ফলকগুলি রৌদ্র চকচক করছে। এরা যে ধূমল প্রদেশের সামন্তরাজা দুর্জয়ের আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্ত ঘাতকবাহিনী সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আচার্যদেব লক্ষ্য করলেন আগন্তুকদের পুরোভাগে দৈত্যাকৃতি একজনপুরুষ, সম্ভবতঃ সেই দলপতি, হাতের ইঙ্গিতে পুরো দলটিকে কিছু নির্দেশ দিতেই তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে তিন জন নায়েকের নেতৃত্বে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে বাথানের সীমানার তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ল। 

সামনের দলটির প্রত্যেকের হাতে ভল্ল, কুঠার, তরবারি। দলপতির নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা মুখে হাড়হিম করা ভয়ঙ্কর হোওওও হোওওও শব্দ করে দ্রুতবেগে বাথানের দিকে এগিয়ে গেল। আচার্য চিত্রভানু এতক্ষণ নিচুল-ঝোপে হাঁটু গেড়ে বসে সব লক্ষ্য করছিলেন। দুর্বৃত্তদলটি তখন মাত্র তিনশত অরত্নি দূরে এসে গেলেও আচার্য চিত্রভানু মুহূর্তকাল অপচয় না করে নির্ভিকচিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর তপ্ত-কাঞ্চনবর্ণ দীর্ঘ শরীর, দুই পাশের স্কন্ধের উপর আজানু লুটিয়ে থাকা শুভ্র উত্তরীয়, পশ্চাদ্ভাগে পুরুষ্টু শিখাসমৃদ্ধ ক্ষৌরি-মস্তক দূর থেকেও স্পষ্ট দৃশ্যমান হল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তাঁর দক্ষিণহস্ত উত্তোলন করলেন। অদূরে গোধূমক্ষেত্রে সৈরিকদের নিয়ে সরীসৃপের মত শায়িত সজাগচক্ষু ধানুক আচার্যদেবের আন্দোলিত হস্তের ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র নিম্নকন্ঠে সহযোদ্ধা সৈরিকদের কিছু নির্দেশ দিল। 

চিত্রভানুকে নিরস্ত্র দেখে লুন্ঠক দলের দলপতি থমকে দাঁড়ালো। দলটিকে এগিয়ে যাবার ইশারা করে একাই একটি ধারালো কুঠার হাতে বন্য মহিষের মত গর্জন করে শষ্যক্ষেত্র মাড়িয়ে চিত্রভানুর দিকে ছুটে এলো। তিনি কাঁধ থেকে উত্তরীয়টি খুলে দুহাতে ধরে পিছনের পায়ে ভর রেখে লোকটির দিকে অকম্পিত চিত্তে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসলেন। এই অসম সংঘর্ষের প্রস্তুতি পর্বে তিনিই সঙ্গীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সাধারণ ভাবে যা অস্ত্র নয় তাকে অস্ত্রে পরিণত করে আত্মরক্ষা করতে। নিচুলের ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকার সময়টুকুতেই তিনি স্কন্ধের লম্বমান উত্তরীয়র দুই প্রান্তে বেশ কিছু প্রস্তরখণ্ড বেঁধে নিয়েছেন। দলপতি উন্মত্তের মত ছুটে তাঁর কাছাকাছি আসামাত্র তিনি ডান হাত ঘুরিয়ে উত্তরীয়র প্রস্তরখণ্ড বাঁধা প্রান্তটি দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন তার মুখে। এমন অকস্মাৎ আঘাতে লোকটির হাত থেকে কুঠার পড়ে গেল ও সে ভূমিসাৎ হল। প্রাথমিক আঘাত সামলে দলপতি উঠে দাঁড়তে গেলে চিত্রভানু উপর্যুপরি কয়েকবার একই ভাবে আঘাত করলেন। লোকটি ভীষণভাবে আহত ও হতচেতন হয়ে ভূমিশয্যা নিল। 

ওদিকে প্রথম দলটি গোধূমক্ষেত্রের আলপথ ধরে বিকট চীৎকার করতে করতে বাথানের দিকে এগিয়ে চলেছে। তারা কোনদিকে দৃকপাত না করে ধানুকদের কিছুটা দূর দিয়ে তাদের অতিক্রম করে যেতেই ধানুক তার সঙ্গীদের নিয়ে শস্যক্ষেত্রের মাঝে বংশ ও বেত্রদণ্ড হাতে উদ্ধতফণা আশীবিষের মতই মাথা তুলে দাঁড়ালো এবং নিমেষপাতের মধ্যে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই রকম আকস্মিক আঘাতের জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত না থাকায় বলশালী সৈরিকদের দণ্ডাঘাতে একে একে ধরাশায়ী হতে লাগলো। ধানুক একাই তার প্রিয় সঙ্গী তৈলচিক্কণ বেত্রদণ্ডটির সাহায্যে একসঙ্গে সাত-আট জন শত্রুর মহড়া নিচ্ছে। তার দণ্ডাঘাতে কয়েকজন আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় ভূমিসাৎ হল। বাকিরা “যঃ পলায়তি, সঃ জীবতি” উপায়ে উর্দ্ধশ্বাসে রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করল। যে কোন যুদ্ধেই ধাবমান সৈন্যবাহিনী পাশ ও পিছন থেকে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আচার্য চিত্রভানুর নির্দেশে ধানুক ও তার সহযোদ্ধারা এই পন্থাটি অবলম্বন করে সহজেই দুর্বৃত্তদের পর্যুদস্ত করে ফেলল। 

গোপালকদের দলপতি শ্রীনিবাসের উপর গোধন রক্ষার ভার ন্যস্ত। সে ও গোপালকরা বাথানের সব দুগ্ধবতী গাভী, ষণ্ড, বলদ, বকনা ও শিশু গোবৎসগুলিকে গোশালার ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে বাইরের প্রাঙ্গণে পাহারায় রত; প্রত্যেকের হাতেই যষ্টি ও মুদ্গর। তারা দূর থেকে সৈরিকদের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ লড়াই-এর দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত থাকায় কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক। ধানুক ও সৈরিকবাহিনীর লড়াই দেখে তারা এতই উচ্ছসিত হয়ে পড়েছিল যে ঘণায়মান বিপদের কথা জানতেই পারেনি। 

বাথানের গোশালার ঠিক পিছনে একটি ছোট তরাগ। তার চতুস্পার্শ্ব ঘিরে নানা পত্রবহুল বৃক্ষের মাঝখান দিয়ে গোপালক ও রাখালদের পায়ে চলা সংকীর্ণ পথ রেখা; ঘন পত্রচ্ছায়ায় স্থানটি দিনের বেলাতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেই পথ দিয়ে বৃক্ষান্তরালে নিজেদের প্রচ্ছন্ন রেখে কখন যে লুন্ঠকদের দ্বিতীয় দলটি চুপিসারে গোশালার কাছে পৌঁছে গিয়েছে কেউই তা বুঝতে পারেনি। যখন সম্বিৎ ফিরল তখন অস্ত্রসজ্জিত আগন্তুক দলটি নিঃশব্দে গোশালার আনাচে কানাচে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অপারঙ্গম নিরীহ গোপালকদের অর্ধচক্রাকারে ঘিরে ফেলেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা অস্ত্রমুখে গোপালক ও রাখালদের নিরস্ত্র করে তাদেরই লাঠি দিয়ে বিষম প্রহার করতে করতে বাথান-অঙ্গনের মাঝখানে পত্রাচ্ছাদিত বৃক্ষগুলির নীচে নিয়ে এল।

একই সময়ে তৃতীয় দলটি কোষমুক্ত তরবারি ও ধারালো ভল্ল হাতে সম্মুখের দীর্ঘিকার পাশ দিয়ে মূল প্রাঙ্গণে অনুপ্রবেশ করে একটু থমকে গেল। উৎসবের আঙ্গিনায় যে যার নিজের কাজে রত, সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক। তারা দু-তিন জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে অস্ত্র উদ্যত করে এগিয়ে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল কারো মুখে-চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, চতুর্দিকে এত কাণ্ড হয়ে চলেছে, কিন্তু তারা যেন একেবারেই নির্বিকার! 

সমস্ত উৎসবাঙ্গণটি এখন বহিঃশত্রু কবলিত, তারা নৃশংস, এবং অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ।

কিন্তু --- “অল্পানামপি বস্তুনাং সংহতিঃ কার্যসাধিকা।

তৃণৈর্গুণত্বমাপন্নৈ বর্ধ্যন্তে মত্তদন্তিনঃ।।”

(অল্প বা ক্ষুদ্র বস্তুও ঐক্যবদ্ধ হলে কার্যসাধনে সক্ষম হয়। ঘাসের তৈরি দড়ি দিয়ে মত্ত হাতিকেও বেঁধে রাখা যায়।)

এক্ষেত্রেও সেই আপ্তবাক্যটিরই প্রতিফলন ঘটল। 

আচার্য চিত্রভানু যখন দূর থেকে শত্রুদ্বারা আক্রান্ত হতে চলেছেন অনুমান করে একজন বিচক্ষণ গোষ্ঠীপতির মতই প্রীতিকূটের আবালবৃদ্ধ নরনারীর প্রতিরক্ষার জন্য ধানুক, শ্রীনিবাস প্রভৃতি ও তাঁর বয়স্যদের সঙ্গে রণকৌশলের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, তখন থেকেই তাঁর কিশোর পুত্র বান ও তার কয়েকজন সঙ্গীকে আর আশেপাশে কেঊ দেখেনি। বস্তুতঃ সেই পরিস্থিতে অনাগত বিপদের সম্ভাবনায় সকলে এতই চিন্তিত ও ব্যস্ত ছিল যে, কেউই বিশেষভাবে কারো খোঁজ রাখার মত মানসিক অবস্থায় ছিলনা। পিতার মুখে প্রীতিকূটের বাথান সামন্তরাজার প্রেরিত দুর্বৃত্তদের হাতে আক্রান্ত হতে চলেছে শুনে সে তার সঙ্গীদের নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ক্রীড়াকৌতুকের সময় তারা বাথান-প্রাঙ্গনের মাঝখানে একটি সুবৃহৎ রসাল বৃক্ষেরজ্জু ও কাষ্ঠখণ্ড দিয়েদোলনাঝুলিয়েছিল, সেই বৃক্ষে আরোহণ করে পত্রঘন শাখার অন্তরালে নিশ্চুপ হয়ে বসে নীচে ঘটমান দৃশ্যগুলি অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিল। বৃক্ষশাখায় চড়ার সময় বুদ্ধি করে ঝুলন্ত ঝুলনটিকেও উপরে টেনে নিয়েছিল। 

লুন্ঠক দলের এক নায়েক তার সঙ্গীদের অস্ত্রভয়ে ভীত নজরবন্দী গ্রামবাসীদের আর অত্যাচার বা বধ করার নির্দেশ দিতে যাচ্ছে, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত বানের পোক্ত কাষ্ঠের ঝুলনটি অন্তরীক্ষ হতে সজোরে তার মাথার পিছনে আঘাত হানল। বৃক্ষশাখায় এতক্ষণ অপেক্ষারত শবররা যেন এই ইঙ্গিতেরই প্রতীক্ষা করছিল! আচম্বিত আঘাতে নায়েককে লুটিয়ে পড়তে দেখে শত্রুসৈন্য হতচকিত হয়ে উর্দ্ধমুখে দৃষ্টিপাত করার আগেই পাদপশ্রেণীর ঘন পল্লবের আড়াল থেকে শবরদের নিক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ তির ও প্রস্তরখণ্ড উল্কাবৃষ্টির মত তাদের দিকে নির্ভুল লক্ষ্যে ধেয়ে আসতে লাগল। 

নীচে এতক্ষণ যারা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রন্ধন বা অন্যান্য কর্মে লিপ্ত থাকার ভান করে নির্বিকার ছিল, বা সিধু-পৈষ্টী পানরত মত্ত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে রন্ধনের ভারী ভারী হাতা-খুন্তি বা জ্বালানির মোটা মোটা কাষ্ঠখণ্ডগুলি হাতে তুলে নিয়ে প্রবল শক্তিতে শত্রুদলের মুখোমুখি হল। হঠাৎ লুন্ঠকদের গায়ে কটাহ ভর্তি ফুটন্ত জল এসে পড়ল, বা চোখে-মুখে উদুখল থেকে তীব্রঝাল মরিচের গুঁড়ো এসে পড়ল। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের কাছে থেকে এমন অতর্কিত ও দ্রুত প্রতিআক্রমণ আসতে পারে তা তাদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। ওদিকে শস্যক্ষেত্রে শত্রু বিধ্বস্ত করে ধানুকও তার দলবল নিয়ে বীরবিক্রমে ছুটে এল; দুর্বৃত্তরা নিজেদের অস্ত্র-শস্ত্রের সদ্ব্যবহার করার অবসরমাত্র পেল না।

আচার্য চিত্রভানু বৃক্ষতলের একোটি মৃন্ময় বেদীর উপর দাঁড়িয়ে চীৎকার করে কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করায় শত্রুদল সে যাত্রায় প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হল। 

কিন্তু, এত কিছুর পরেও শেষ রক্ষা হল না।

গো-বাথানের গোশালার পিছনে বিস্তীর্ণ ইক্ষুক্ষেত। এই শরতে গাছগুলি যথেষ্ট পুষ্ট ও লম্বা হয়েছে। চাষীরা শুকনো জমিতে দুই হস্ত পরিমাপ সমদূরত্বে বেশ উঁচু করে আল দিয়ে দশ-বারোটি গাছ একসঙ্গে গোছা গোছা করে ইক্ষুপত্রের রশিতে বেঁধে রেখেছে। ফলে বাইরে থেকে ক্ষেতটি ঘন দেখালেও ভিতরে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি সুষমভাবে সারিবদ্ধ ইক্ষুগুচ্ছের মাঝে গলিপথ রচিত হয়ে আছে। ক্ষেতের অনেকটা ভিতরে ঝুলন্ত পত্রান্তরালে বিনোদ ভট্ট ও আরও কয়েকজন অভিভাবক স্থানীয় পুরুষদের তত্বাবধানে প্রীতিকূটের স্ত্রীলোক ও শিশুরা আত্মগোপন করে আছে; আকস্মিক বিপদে তারা সন্ত্রস্ত, রোরুদ্যমান। একটু দূরে তাদের ঘিরে বিধু ও জনা দশেক বলশালী যুবক পাহারা দিচ্ছে। বাইরের কলরব অস্পষ্টভাবে কানে এলেও কি ঘটে চলেছে তা তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অতি কষ্টে কৌতূহল দমন করে তারা নিরুপায় হয়ে বসে আছে। 

সামন্তরাজা দুর্জয়ের কুবুদ্ধির অভাব নেই। বৎসরান্তিক বাথান উৎসবে সমৃদ্ধ জনপদ প্রীতিকুট যে জনশূন্য থাকবে তা তার অজানা নয়। দুর্জয় একদিকে যেমন বাথান উৎসবে অতর্কিতে নিষ্ঠুর নিসূদকবাহিনী পাঠিয়েছে , অন্যদিকে তেমনি প্রায় জনহীন প্রীতিকুটে তার নিজস্ব শতাধিক তুরগারোহী সৈনিককে পাঠিয়ে দিয়েছে। শান্ত জনপদটিতে সে সময় মাত্র কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং মুষ্ঠিমেয় ক্রীতদাস-দাসী ছাড়া বিশেষ কেউ ছিল না। ঘোড়সওয়ারেরা বিনা প্রতিরোধে গ্রামে ঢুকে যথেচ্ছভাবে তাদের পীড়ন ও ভয় প্রদর্শন করে অবাধে লুন্ঠনকার্য শেষ করে গো-বাথানের দিকে ছুটে এলো। 

গোশালার পশ্চিম প্রান্তে ইক্ষুক্ষেতটির কাছে এসে তুরঙ্গবাহিনীর দলনায়েক হাত তুলে ইশারায় থামতে বলল। দূর থেকেই তার চোখে পড়েছে বাথানপ্রাঙ্গণে তাদের পদাতিক বাহিনী গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে পর্যুদস্ত হয়ে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করছে। এই সময় সে স্থানে গেলে তাদের অবস্থাও তথৈবচ হতে পারে চিন্তা করে সে তার দলকে নিঃশব্দে ইক্ষুক্ষেতের পিছন দিকে যাবার নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য, কিছু সময় প্রচ্ছন্ন থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সময়োচিত পরিকল্পনা করবে। কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে ইক্ষুপত্রের মর্মরধ্বনির মাঝে তার কানে এল রমণীকন্ঠের রোদনধ্বনি। প্রীতিকূটের আসল সম্পদ যে এই স্থানেই লুক্কায়িত আছে তা বুঝতে তার বিলম্ব হল না। বিশেষ, এই রমণীরত্নের জন্যই সামন্ত প্রভু তাদের প্রেরণ করেছেন যে! 

অশ্ব থেকে অবতরন করে দলের একাংশকে চারিদিক ঘিরে ফেলার আদেশ দিয়ে অন্যদের নিয়ে ধূর্ত শৃগালের মত লঘু পদবিক্ষেপে উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে নিশ্চুপে ক্ষেতের ভিতর প্রবেশ করে বৃদ্ধ অভিভাবকদের করায়ত্ত করে যুবতীদের দিকে ছুটে গেল। প্রহরারত যুবকরা এগিয়ে এলেও তাদের দ্বিগুণ সংখ্যার অস্ত্রধারীর সঙ্গে সামান্য লাঠি হাতে সম্মুখসমর বাস্তবিকই অসম্ভব। দুর্জয়ের তুরগবাহিনী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় তিনটি যুবতীকে বলপূর্বক অপহরণ করে অশ্বপৃষ্ঠে ধূমল প্রদেশের রাজধানীর দিকে অশ্ব চালনা করল। তিন যুবতীর মধ্যে একজন আচার্য চিত্রভানুর ভগ্নী মালতি। 

দ্রুতধাবমান অশ্বের গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যে কোন মানুষের পক্ষেই দুষ্কর জেনেও কেউ কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জীবন বাজি রেখেও সেই কর্মে ব্রতী হয়। বিধু ও বিহান দুই অনার্য যুবক অশ্বখুরের উত্থিত ধূলির পশ্চাতে প্রাণপণ ছুটতে লাগল। 

ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ

বিশাল এই ভারতভূখণ্ড জুড়ে চলছে মাৎস্যন্যায়ের যুগ। অসংখ্য ছোট-বড় রাজ্যের রাজন্যবর্গ ও সামন্ত প্রভুরা নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহে ব্যাপৃত। প্রতিবেশী রাজ্যসম্পদের অধিকারের জন্য যুদ্ধ এবং নানা কূটকৌশল আর অবাধ লাম্পট্য ওসম্ভোগে জীবন কাটানোই ছিল বেশীরভাগ রাজা-মহারাজের একমাত্র কর্তব্য-কর্ম। প্রদেশের রাজা স্বভাবতঃই থাকতেন তাঁর রাজধানী-নগরে, আর তাঁর অধিকৃত রাজ্য ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত করে সামন্ত এবং জমিনদারদের দ্বারা শাসিত হত। রাজা শুধু তাদের সংগৃহীত করের অর্থসম্পদ ও উপঢৌকন পেয়েই খুশি থাকতেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের পালনকর্তা রাজার নামটুকু শোনা ছাড়া আর কোনোভাবেই তাঁর সাক্ষাৎ বা সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পেতো না। সামন্ত রাজারাই ছিল সাধারণ মানুষের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। দেশ জুড়ে এই সব সামন্তপ্রভু ও জমিনদাররা ছোট ছোট অঞ্চলের অধিকর্তা হয়ে যথেচ্ছভাবে প্রজাদের শাসন ও শোষণ করত। পুরুষানুক্রমে আজীবন তাদের হাতে নির্বিচারে শোষিত ও লাঞ্ছিত হওয়াই ছিল সাধারণ মানুষের নিয়তি-লিপি। এক শ্রেণীর রাজা ও সামন্তদের বিকৃত ভোগ-লালসার বলি হওয়াই ছিল রূপ-যৌবনবতী হতভাগিনী নারীর ললাট লিখন। 

সুরূপা কুমারী-কন্যার বিবাহের পর পতিগৃহে যাবার আগে সামন্ত বা জমিনদারের অঙ্কশায়িনী হওয়ার জন্য তার পিতাকে স্বহস্তে তাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হত। আর সেই পশুসদৃশ প্রভুরা তাদের বিকৃত কাম-লালসা পরিপূর্ণ করার পর উচ্ছিষ্ট কদলীপত্রের মত কয়েকদিন পরে কন্যাটিকে তার স্বামীর ঘরে প্রেরণ করত। আবার কখনো কোন বিশেষ রুপবতীর ঠাঁই হত অন্তঃপুরের অগণিত রক্ষিতাদের দলে। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে অনেক পিতা বা পতি কিছু রাজানুগ্রহ লাভ করে সম্পদশালী হয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে গর্বিতও হত। এতো ছিল তাদের বিলাস-ব্যসন! প্রজাদের দেয় করে তাদের বিলাস-সম্ভোগের লিপ্সা পরিপূর্ণ হত না। তাই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে তাদের বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ ছিল না। নিজেদের বা পার্শ্ববর্তী রাজ্যের নিরীহ শ্রেষ্ঠী, বনিক ছাড়াও কৃষক এবং শ্রমজীবিদের সম্পদ নির্বিচারে লুন্ঠন করা তাদের কাছে ছিল অতীব শ্লাঘার বিষয়। 

ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ

দ্রুত ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে অর্ধচেতন অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে মালতির সুকোমল তনুলতা। বন্ধুর পথে অশ্বটির গতির তালে তালে তার শরীর যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়ছে। অশ্বটির চালক তার দেহের সঙ্গে সামান্য দূরত্ব রেখে মনুষ্য-রূপ যন্ত্রের মতই চালনা করছে সেটিকে। মালতির হাতদুটি পিছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা, মুখ এবং চোখও একটা অত্যন্ত দুর্গন্ধ গাত্রমার্জনী দিয়ে ঢাকা। এমতাবস্থায়ও সে বুঝতে পারছে, এই অশ্বারোহী একা নয়, একাধিক অশ্ব পাশাপাশি ও সামনে-পিছনে ছুটে চলেছে একই গতিতে। ঘোড়সওয়ারদের বিজয়-উল্লাস এবং অশ্বখুরধ্বনির সঙ্গে কয়েকটি নারীকন্ঠের তীব্র আর্তনাদ অস্পষ্ট ভাবে তার কানে আসছে। সে বুঝতে পারল, তার মত আরো কয়েকজন সঙ্গিনীকেও এই দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে চলেছে; কিন্তু কোথায় যে এই দুঃসহ যন্ত্রনাময় যাত্রার সমাপ্তি সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। ----- (ক্রমশ প্রকাশ্য)

0 comments:

0

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক



আমার বারুদ-বেলা (৬)
স্বপন দেব



(দৃষ্টি জনিত অসুখে ভুগছি। ডাক্তারের নির্দেশে বিগত এক মাস ধরে পড়া এবং লেখা, দুটোই কার্যত একেবারে বন্ধ। তাই এবারের ঋতবাক এ আমার বারুদ-বেলার কিস্তি জমা দিতে আমার অক্ষমতার কথা জানিয়েছিলাম ঋতবাক-সম্পাদিকাকে। কিন্তু, সম্পাদিকা সুস্মিতা আর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সৌম্যর একান্ত অনুরোধ ও মিনতি যে, ধারাবাহিক-এর ধারাবাহিকতায় ছেদ পরলে চলবেনা। ‘এ মিনতি এড়ানো কঠিন বড়!’ তাই, অগত্যা……)



চারু মজুমদারের দলিল কে ভিত্তি করে কৃষি বিপ্লবকে সফল করার জন্যে কৃষকদের সশস্ত্র ইউনিট গঠনের আওয়াজ নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ও ফাঁসি দেওয়া এলাকায় কৃষকদের জঙ্গি লড়াই করার সাহস জোগাচ্ছিল। জোতদারের আক্রমণের সমবেত প্রতিরোধ, ধানের গোলা লুঠ, বন্দুক দখল প্রভৃতি কাজকর্ম শুরু হয়েছিল প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই। ‘গ্রামে আমরাই রাজত্ব করব’, ‘সব জমি দখল করে নেব’ ইত্যাদি মনোভাব কৃষকদের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছিল। ৬৬ সালে চা বাগানের ধর্মঘটের সময়েই পুলিশের বিরুদ্ধে তীর ধনুক নিয়ে লড়াইয়ের মেজাজ এসে গিয়েছিল। ৬৬ সালের অক্টোবর মাসে কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল গ্রেফতার হয়ে গেলে, কৃষকেরা নিজেরাই মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সমস্ত জমির ধান কেটে ঘরে তুলে নেব। এই সময় সম্পর্কে পরবর্তীতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম এক নেতা কানু সান্যাল তাঁর ‘More About Naxalbari’ প্রবন্ধে লিখেছেন নির্বাচনের সময়েই দার্জিলিং জেলায় চারু মজুমদারের উপদেশে সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রাজনীতি প্রচার করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে কানু সান্যাল তাঁর ‘More about Naxalbari’ দলিলে তাঁর পুরাতন বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে এই পরিস্থিতির সম্পর্কে লিখেছেন---‘ওই পর্য্যায়ে নকশালবাড়ি এলাকার ক্যাডাররা সংযুক্ত ফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তাতে চারু মজুমদার রাজি না হয়ে বলেন যে, সংযুক্ত ফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলার অর্থ সংশোধনবাদ’। উত্তাল তখন নকশালবাড়ি এলাকা। কোথাও কোথাও নেতৃত্ব পিছিয়ে পড়ছেন কৃষকদের উৎসাহের কাছে। ১৭ই মে চৌপুখুরিয়া অঞ্চলে একটি মিটিং ডাকা হল। চারু মজুমদার শারীরিক কারণে উপস্থিত থাকতে পারলেন না। কয়েকজন নেতৃত্ব প্রস্তাব রাখলেন, জমি দখল বা ধান দখলের সময় অল্প কিছু সংখ্যক কৃষকের কাছে কেবল তীর, বল্লম ইত্যাদি রাখার জন্যে। তৎক্ষণাৎ তার তীব্র বিরোধিতা করলেন এই অঞ্চলের কৃষক নেতা রোপনা রাজগোঁড়----সবার হাতেই অস্ত্র রাখতে হবে। ১৬ই মে শিলিগুড়ি আসলেন মন্ত্রী ও সি পি এম কৃষক সভার নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার। হরেকৃষ্ণ কোঙার একদিকে শুকনা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে কানু সান্যালের সঙ্গে আলোচনা করলেন আর অন্যদিকে নকশালবাড়ি ভূমিসংস্কার অফিসে জোতদারদের বললেন, ‘সত্যি সত্যি যদি খুব অন্যায় মনে করেন (জমি, ধান দখল) তবে নিজেরাই প্রতিরোধ করুন না’! স্থানীয় প্রশাসন ২২ মে, ১৯৬৭ একটি ঘোষণায় এলাকায় তীর ধনুক বহন ও পাঁচজনের জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ( Records of Naxalbari P.S )।

এরপর পরস্পর দুটি বিপরীত দিক থেকে ২৪ ও ২৫ মে ঘটনার ক্রান্তিকাল বিন্দুতে সময় এগোতে লাগল। সেই ক্রান্তিকালের একজন নায়ক রথখোলার ভীমরাম জোতের আদিবাসী কৃষক বিগল কিষানের কথায় --- ‘সমিতি ডাক দিল সব জমি দখলের, ধান দখলের। আমি চাষ করতাম স্থানীয় জোতদার ও বাংলা কংগ্রেসের নেতা ঈশ্বর তিরকির জমিতে। সমিতির ডাকে লাঙল নিয়ে গিয়েছিলাম জমির দখল নিতে। কিন্তু লহরী বুড়ার জমির উপরেই ঈশ্বর তিরকির লোকজন আমায় মারতে লাগল। ওরা মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিল। লাঙল বলদ সব কেড়ে নিল। এর প্রতিবাদে প্রহ্লাদ সিং ওর বউ সোনামতি সিং ও মুজিবরের সংগে কৃষক সমিতির লোকজন মিলে ঘেরাও করে ঈশ্বর তিরকির ঘর’। এইসব অভিযোগেই কৃষক নেতাদের গ্রেফতারের উদ্দেশে, ২৪ মে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের ইনস্পেক্টর সোনাম ওয়াংদিকে সংগে নিয়ে নকশাল্বাড়ি থানার অফিসার এস মুখার্জি, এস আই নারায়ণ চৌধুরী ও বি ভট্টাচার্য সহ সশস্ত্র পুলিশের একটি দল হাতিঘিষার বড়ঝাড়ু জোতে হাজির হয়। পুলিশ রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, প্রশাসনের ধারণা ছিল হরেকৃষ্ণ কোঙার ও কানু সান্যালের মধ্যে বোঝাপড়া অনুযায়ী কৃষক মিলিট্যান্ট রা পুলিশ কে কোনরকম আক্রমণ বা অসহযোগিতা না করে ধরা দেবে ( There would be no resistance as that was the agreement between Sanyal and Kongar )। [নকশালবাড়িতে কৃষক নেতা ও মন্ত্রিদের মধ্যে যে আত্মসমর্পণের চুক্তি হয়েছিল কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে এক জনসভায় (৪ জুন, ১৯৬৭) প্রমোদ দাশগুপ্ত তা জানিয়েছিলেন।] কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটল।বড়ঝাড়ু জোতে পুলিশ দল ঢোকামাত্র স্থানীয় মানুষের চেঁচামেচিতে বুড়াগঞ্জ, আজামাবাদ, সফদোল্লাজোত ও বিজয়নগর চা-বাগান থেকে হাজার খানেক মানুষ বেরিয়ে এসে পুলিশ দলকে ঘেরাও করে ফেলে। উত্তেজনা চলা কালীন হঠাৎ এক যুবকের ছোঁড়া তীর বেঁধে ওয়াংদির বুকে। সংগে সংগে শুরু হয় অন্যদের তীর বর্ষণ। তীরের আঘাতে অন্য দুজন পুলিশ অফিসার ও গুরুতর আহত হয়। পুলিশ তখনকার মত পিছু হটে। ফুসফুসে তিনটি তীর বিদ্ধ সোনাম ওয়াংদি পরেরদিন হাসপাতালে মারা যায়। এই দিনের ঘটনার সাক্ষী, নকশালবাড়ি সংগ্রামের এক নেতা খোকন মজুমদারের কথায়—‘এলাকার মানুষ পুলিশ দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। ভিড় ঠেলে ওয়াংদি অন্য পুলিশ অফিসারদের সংগে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সম্ভবত উদ্দেশ্য ছিল কৃষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলা। এর ই মধ্যে ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ একজন তীর চালিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর আসতে থাকে পুলিশদের লক্ষ্য করে। একজন সাব ইন্সপেক্টর পিছন ফিরে দৌড় লাগান আর একজন আমার পা জড়িয়ে ধরেন। আমি হাত দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করেছিলাম”। নকশালবাড়ি সংগ্রামের সমস্ত নেতাদের ই বক্তব্যে এই তথ্যের মিল থাকলেও ওই দিনের ঘটনার পুলিশ রিপোর্ট কিন্তু একটু অন্যরকম। সে যাই হোক, এই ঘটনার পর থেকেই কিন্তু সমস্ত অঞ্চল জুড়ে উত্তেজনার একটা টান টান ভাব। সশস্ত্র পুলিশ টহল চলতে থাকলো সমস্ত অঞ্চলে। বেঙ্গাইজোতের প্রহ্লাদ সিং আর তার স্ত্রী সোনামতি উদ্যোগ নিয়ে এক মহিলা সভা ডেকেছিলেন, নকশালবাড়ি বাজারের উত্তর পশ্চিম দিকে প্রসাদজোতে। ২৫ মে তারিখে সভা যখন চলছে, তখন হঠাৎ অসম-ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস এর একটা টহলদারি ভ্যান সভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটু দূরে গিয়েই ভ্যানটি দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সশস্ত্র পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে পাশের ঝোপঝাড়ে ‘পজিশন’ নিয়ে সভার দিকে তাক করে হঠাৎ গুলি চালাতে লাগলো। তৎক্ষণাৎ সেখানে ৭ জন মহিলা ও ২ জন শিশুসহ মোট ১১ জন শহিদ হয়ে গেলেন। সোনামতি সিং এর বুকের গুলি বিদ্ধ করল তার পিঠে বাঁধা ছোট্টো আট মাসের শিশুটিকেও। প্রসাদজোতের মাটি লাল হল শহীদের রক্তে। আর সেদিন থেকেই ইতিহাসের পাতায় রক্তের লাল অক্ষরে লেখা হল একটি নাম-----নকশালবাড়ি। এতদিনকার ছড়ানো ছিটানো বিক্ষোভ যেন একটা নতুন মাত্রা পেল। গুণগত পরিবর্তন এল ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের গতিমুখে। কলকাতার ছাত্র-যুবরা দেওয়াল লিখলেন,

‘তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি/ নকশালবাড়ি নকশালবাড়ি’।

সংস্কৃতির জগতেও পূর্ববর্ণিত পথে যে নান্দীমুখ হয়েছিল তার মৃদু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল। নকশালবাড়ির ঘটনার দিনই রাতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাসে বসে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক দিলীপ বাগচী লিখলেন, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষায়, তাঁদের ই কৃষ্টিবাহিত সুরে, ‘ও নকশাল নকশাল নকশালবাড়ির মা,/ ও মা তোর বুগোৎ অক্ত ঝরে,/ সেই অক্ত আঙ্গা নিশান লয়্যা/ বাংলার চাষী জয়ধ্বনি করে’। 

রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রাত্য বলে পরিগণিত ও চির অবহেলিত গ্রামবাংলা এক ঝটকায় চলে এল পাদপ্রদীপের আলোয়। উৎপল দত্ত নকশালবাড়ির পটভূমিতে রচিত তাঁর তীর নাটকের উপাদান সংগ্রহার্থে নকশালবাড়ি ঘোরার পথে এলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংলগ্ন মাঠের জনসভায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গীতে বললেন-----‘একদিকে নকশালবাড়ি আর একদিকে বেশ্যাবাড়ি। বুদ্ধিজীবীদের আজ বেছে নিতে হবে তারা কোন বাড়িতে উঠবেন’। গণসংগীত শিল্পী অজিত পাণ্ডে গাইলেন----‘তরাই কান্দে গো---কান্দে আমার হিয়া, নকশালবাড়ির মা কান্দে, সপ্তকন্যা লাগিয়া’। 

তেভাগা আন্দোলনের শহিদ চন্দনপিড়ি গ্রামের অহল্যা কিষাণী যেনি জীবন্ত হয়ে উঠলেন ২৫ শে মে নকশালবাড়ির মাটিতে। শহিদ হলেন ধনেশ্বরী দেবী, সামসরী শৈবানী, গাউদ্রোউ শৈবানী, সোনামতি সিং, ফুলমতি দেবী, সুরুবালা বর্মন, সীমাশ্বরী মল্লিক, নয়নশ্বরী মল্লিক, খরসিং মল্লিক আর দু’জন শিশু। (চলবে )

0 comments:

0

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক



বানরায়ণ – পর্ব দশ
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



অস্তমান সূর্যের রক্তরাগে রাঙানো এক আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্বোধন করলেন তারা। ‘‘কিষ্কিন্ধ্যার বীর যোদ্ধারা...’’

পুরো পরিস্থিতিটাই কেমন যেন অপার্থিব, অবাস্তব লাগছিলো। এই তো ক’দিন আগেও জঙ্গলে গিয়ে শিকার করতাম, বুড়ো সোমুককে ওষুধ বানাতে সাহায্য করতাম, বিন্ধ্যারণ্যের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে কোনও খোঁজ রাখতাম না... আর আজ নাকি আমিও কিষ্কিন্ধ্যার যোদ্ধা! এখানে, এই রাজকীয় পর্বতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি...

‘‘আমি, কিষ্কিন্ধ্যার মহারাণী তারা, তোমাদের স্বাগত আর অভিনন্দন জানাচ্ছি এই ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।’’ তারার কন্ঠস্বরে আমার চমক ভাঙলো। একটু ভারি আর ভীষণ গভীর স্বর। কেমন যেন সম্মোহক... রক্তে কিসের নেশা ধরিয়ে দেয়...

‘‘তোমরা জানো, অযোধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র রামচন্দ্রের বিবাহিতা পত্নী জনকতনয়া মৈথিলি সীতাকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে গেছেন লঙ্কার স্বেচ্ছাচারী রাজা রাবণ। রামচন্দ্র চলেছেন স্ত্রীকে পুনরুদ্ধার করতে। আমার বর্তমান স্বামী কিষ্কিন্ধ্যাপতি সুগ্রীব সসৈন্য তাঁকে সাহায্য করছেন। সমগ্র দাক্ষিণাত্য থেকে লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা এসেছেন এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। কুমারিকার উপকূলে সেতুবন্ধন আরম্ভ হয়েছে। অচিরেই কিষ্কিন্ধ্যার সেনাবাহিনী রামচন্দ্রের নেতৃত্বে সেই সেতু পেরিয়ে গিয়ে উপস্থিত হবে লঙ্কার সমুদ্রতটে। আমি নিশ্চিত, এই সব কিছু তোমরা জানো।’’

একটু বিরতি নিলেন তারা। সবাই সম্মোহিতের মতন চেয়ে আছে তাঁর দিকে। অস্তগামী সূর্যের রক্তরশ্মি পাহাড়ের মসৃণ গা বেয়ে যেন গড়িয়ে নেমে আসছে তাঁকে ছুঁয়ে।

‘‘আমি ততখনি নিশ্চিত নই তোমরা জানো কি না...’’ কন্ঠস্বর আরও এক পর্দা গভীরে নামিয়ে বললেন তারা... ‘‘আমার প্রাক্তন স্বামী, কিষ্কিন্ধ্যার পূর্ববর্তী রাজা বালী ছিলেন এই রাবণের ঘণিষ্ঠ বন্ধু।’’ আবার একটু থামলেন। কথাটা হৃদয়ঙ্গম হতে দিলেন সবার। আমার যদিও করন্দর দৌলতে এটা জানা ছিলো।

‘‘তবু যে আজ আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি রাবণের বিরূদ্ধে এই অভিযানে অংশগ্রহণ করার জন্য, অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছি নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করতে, তার কতগুলি কারণ আছে।’’ তারার কন্ঠস্বরে রহস্যের আভাস... 

‘‘কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন, কিষ্কিন্ধ্যার পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমাদের সম্পূর্ণ অবগত হওয়া। তোমরা জানো, আমার পূর্বতন স্বামী কিষ্কিন্ধ্যারাজ বালী মহাপরাক্রান্ত ছিলেন। তাঁর ভয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্য কম্পমান ছিলো। স্বয়ং রাবণ তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাধ্য হয়ে তাঁর বন্ধুত্ব স্বীকার করেন।’’

কয়েক মুহূর্তের বিরতি...

‘‘কিন্তু তোমরা সম্ভবত জানো না, বালী ছিলেন উদ্ধত, গর্বিতস্বভাব, চরম স্বেচ্ছাচারী। কিষ্কিন্ধ্যার জনসাধারণ থেকে আরম্ভ করে তাঁর মন্ত্রীরা... এমনকি আমি এবং তাঁর অন্যান্য স্ত্রীরাও তাঁর ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতাম। তাঁর সহোদর, বর্তমান রাজা সুগ্রীবও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

‘‘বালীর মতন ক্ষমতাশালী না হলেও, সুগ্রীবও কম বীর নন। কিন্তু তিনি দয়ালু, হৃদয়বান পুরুষ। চিরকাল তিনি অগ্রজ বালীর পরম বিশ্বস্ত ও অনুবর্তী ছিলেন। তোমরা হয়তো শুনেছো, ধুন্ধু নামক এক আরণ্যক তস্করের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে বালী প্রায় এক সপ্তাহ না ফেরাতে সুগ্রীব ধরে নেন, তিনি মারা গেছেন। মন্ত্রীদের উপরোধে বাধ্য হয়ে তিনি কিষ্কিন্ধ্যার শূন্য সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু তারপর বালী ফিরে আসেন, এবং সুগ্রীবের উপর পরিস্থিতির চাপ না বুঝে অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করেন। সুগ্রীবের বহু অনুনয়-বিনয়ে কর্ণপাত না করে শেষ পর্যন্ত বালী তাঁকে কিষ্কিন্ধ্যা থেকে বহিষ্কার করেন। স্ত্রী রুমাকে পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যেতে দেন না, নিজে তাঁকে অধিকার করবেন বলে। সুগ্রীবের অনুগামী হন শুধু মৈন্দ, দ্বিবিদ, প্রভৃতি তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধু, যাঁরা তাঁকে সিংহাসনে আরোহন করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, কিষ্কিন্ধ্যায় থাকলে বালীর হাতে তাঁদের প্রাণ অচিরেই বিপন্ন হবে।

‘‘কিষ্কিন্ধ্যা ত্যাগ করে সুগ্রীব ও তাঁর সঙ্গীরা চলে যান ঋষ্যমূক পর্বতের নিরাপদ আশ্রয়ে। নিরাপদ, কারণ সেখানে মতঙ্গ মুনির আশ্রম। বালী একবার সেখানে উপদ্রব করতে গিয়ে মুনির অভিশাপ কুড়িয়ে ছিলেন... পুনর্বার সেখানে পদার্পণ করলে তাঁর মৃত্যু ঘটবে! নিজের ক্ষমতায় অতিরিক্ত বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সে অভিশাপের সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাঁর ছিলো না। তাই সুগ্রীব ও তাঁর সঙ্গীরা সেখানে নিরাপদ ছিলেন।

‘‘সেখানেই সুগ্রীবের দেখা হয় রামচন্দ্রের সঙ্গে। অযোধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র রামও তখন স্ত্রীকে হারিয়ে বনে বনে দিশাহারা অবস্থায় ভ্রাম্যমান। দুই হতভাগ্য রাজপুত্রের বন্ধুত্ব হয়। সেই বন্ধুত্বের মধ্যস্থতা করেন আরেক বিদেশী, দাক্ষিণাত্যে আগন্তুক। তাঁর নাম হনুমান। তাঁকে আমি খুব ভালো চিনি না। তাঁর সঙ্গে বার দুয়েকের বেশি সাক্ষাৎও হয়নি আমার। তিনি কোথাকার মানুষ, কেন ঠিক এই সময়েই এখানে এসেছেন, এবং কেন নিঃস্বার্থ ভাবে সুগ্রীব ও রামকে সাহায্য করছেন, সে সব কথা আমি বিশদে জানি না। শুধু জানি, সেই অসামান্য পুরুষ যাঁর সহায়, তাঁর জয় নিশ্চিত!’’

কথাটা শুনে আমার গায়ে কেন যেন হঠাৎ কাঁটা দিলো...

‘‘তার পরবর্তী ঘটনা হয়তো তোমাদের জানা।’’ তারা বলে চললেন... ‘‘রামের বন্ধুত্ব ও আশ্বাস লাভ করে সুগ্রীব এসে বালীকে যুদ্ধে আহ্বান জানান। প্রথম দিনের যুদ্ধে সুগ্রীব পরাজিত হলেও, তার পরের দিন রামচন্দ্রের সাহায্যে তিনি বালীকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হন। সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন, প্রজারা বালীর স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্তি পান... এবং আমরা, বালীর পত্নীরা, পাই একজন হৃদয়বান, স্নেহশীল স্বামী।

‘‘রাজা হওয়ার পর সুগ্রীব নিজের প্রতিশ্রূতি অনুযায়ী সর্বশক্তি দিয়ে সীতার অনুসন্ধান আরম্ভ করেন। বহু প্রচেষ্টা, বহু অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর সংবাদ আনেন সেই আশ্চর্য পুরুষ, হনুমান। সীতা লঙ্কায় রাবণের অশোকবনে বন্দিনী। হনুমান স্বচক্ষে দেখে এসেছেন, কথা বলে এসেছেন তাঁর সঙ্গে। সাগর লঙ্ঘণ করে একাকী তিনি কিভাবে লঙ্কা গেলেন, সেই সুরক্ষিত পুরীতে প্রবেশ কিভাবে করলেন, কিভাবেই বা সেখানকার কঠোর প্রহরা এড়িয়ে ফিরেও এলেন, সে সব কথা আমি বিস্তারিত জানি না। শুধু জানি, এ একমাত্র হনুমানের পক্ষেই সম্ভব!

আবার কেন জানি না, আমার গা শিরশির করে উঠলো...

‘‘তারপর থেকে শুরু হয়েছে লঙ্কা অভিযানের প্রস্তুতি। প্রাথমিক ভাবে সমুদ্র লঙ্ঘণের জন্য জলযানের কথা ভাবা হয়েছিলো। কিন্তু গণনা করে দেখা গেছে, কিষ্কিন্ধ্যার বিপুল বাহিনীর সাগর পেরোতে প্রায় পাঁচ সহস্র বৃহৎ জলযান প্রয়োজন। অত জলযান নির্মাণ করতে যত অর্থ ও সময় ব্যয় হবে, তার অর্ধেক সময় ও তিন-চতুর্থাংশ অর্থব্যয়ে নির্মিত হবে সেতু।

‘‘বহু গণনা ও পর্যবেক্ষণের পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এক প্রসিদ্ধ স্থাপত্যশিল্পী। তাঁর নাম নল। আর্যাবর্তে তিনি দেবকারিগর বিশ্বকর্মার পুত্রের পরিচয়ে খ্যাত। সেতু নির্মাণের সম্পূর্ণ কাজটি তিনিই পরিচালনা করছেন। তিনিও কোথাকার মানুষ, আমার সঠিক জানা নেই। সম্ভবত হনুমান যেখানকার মানুষ, তিনিও সেখানকারই। তাঁর তত্ত্বাবধানে কুমারিকার উপকূলে আরম্ভ হয়েছে সেতুবন্ধনের কর্মকাণ্ড। তোমরা এখান থেকে দশ দিনের পথ অতিক্রম করে সেখানে যাবে, সেতুবন্ধনের কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করবে, এবং তারপর সেই সেতু পেরিয়ে লঙ্কায় গিয়ে ধ্বংস করবে রাবণের পাপপুরী।’’

থামলেন তারা। সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। আমার মনের ভিতরটা তোলপাড় হচ্ছে... 

‘‘রাবণ আমার পূর্বতন স্বামীর বন্ধু ছিলেন। মহারাণী মন্দোদরীর সঙ্গেও আমার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিলো। তবু আমি চাই, লঙ্কা ছারখার হয়ে যাক! চূর্ণ হোক রাবণের দর্প! কারণ, মনুষ্যত্বের যে অপমান রাবণ করেছেন, আজও করছেন, তার কোনও ক্ষমা নেই! বালীও করেছিলেন মনুষ্যত্বের অপমান। তার চূড়ান্ত শাস্তিও তিনি পেয়েছেন প্রভু রামচন্দ্রের হাতে। রাবণও পাবেন, আমি নিশ্চিত।

‘‘রাবণ মহাবীর। পরমজ্ঞানী। ধূরন্ধর রাজনীতিজ্ঞ। কিন্তু তিনি চরম স্বেচ্ছাচারী, চূড়ান্ত অহংকারী এবং অত্যাচারী। বালীর থেকেও অনেকগুণ বেশি। বালীর স্বেচ্ছাচার, অত্যাচার মূলত তাঁর নিজের রাজ্যের গণ্ডীর ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু রাবণের সব অনাচার, সব অত্যাচারই তাঁর নিজের রাজত্বের সীমানার বাইরে। লঙ্কাকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখে নারীলোলুপ, লম্পট রাবণ দাক্ষিণাত্যের মূল ভূখণ্ডে, এবং আর্যাবর্তেও, কত যে নারীর অবমাননা করেছেন, কত যুবতীর সর্বনাশ করেছেন, তা গুণে শেষ করা যায় না। অসংখ্য রমনীকে তিনি তাঁদের স্বামী, পিতা, পরিবারের কাছ থেকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে লঙ্কায় নিজের প্রমোদভবনে বন্দী করে রেখেছেন। বলপূর্বক নিজের অঙ্কশায়িনী করেছেন তাঁদের। কিষ্কিন্ধ্যার অতিথি হয়ে এসেছেন তিনি কয়েকবার, এবং প্রত্যেকবার আমি অনুভব করেছি, আমার উপরেও তাঁর লালসাসিক্ত দৃষ্টি পড়েছে। আমার সঙ্গে কোনও রকম অশালীন আচরণ করার দুঃসাহস যে তাঁর হয়নি... তা শুধুমাত্র বালীর ভয়ে।’’

কিছুক্ষণের নীরবতা। চারপাশ থেকে উত্তপ্ত শ্বাসের গভীর স্বর শোনা যাচ্ছে। কয়েকটা যেন অবরুদ্ধ গর্জনের শব্দও কানে এলো...

‘‘কিন্তু বালীর থেকেও বেশী ভয়ের কারণ এবার রাবণের জন্য ঘনিয়ে এসেছে। যেদিন, যে মুহূর্তে দণ্ডকারণ্যের কুটীর প্রাঙ্গনে সীতার শরীরে রাবণের কলুষ স্পর্শ লেগেছে, সেদিন সেই মুহূর্তে রাবণের ললাটলিপিতে ধ্বংস লেখা হয়ে গেছে। রামচন্দ্রকে তোমরা দেখোনি এখনও। খুব শিগগিরি দেখবে। দেখলে, এবং তাঁর পরিচয় পেলে বুঝবে কেন আমরা সবাই এ বিষয়ে নিশ্চিত। তাঁর মতন যোদ্ধা দেবলোকেও নেই। তাঁর মতন নেতাও নেই ত্রিভুবনে আর কোথাও। তাঁর নেতৃত্বে তোমরা, কিষ্কিন্ধ্যার যোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়বে লঙ্কার উপর, ধুলোয় মিশিয়ে দেবে রাবণের আকাশ-ছোঁয়া অহঙ্কার।

‘‘তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে লঙ্কার অতুল ঐশ্বর্য! সে ঐশ্বর্য নিশ্চিতভাবেই রামচন্দ্র তোমাদের যথাযথ ভাগ করে দেবেন লঙ্কাজয়ের পর। তোমাদের কাছে আমার শুধু একটাই অনুরোধ...’’

একটু নৈঃশব্দ। তারপর ভেসে এলো তারার অমোঘ স্বর... ‘‘কোনও নারীর অবমাননা কোরো না কখনও। আমি জানি, এ দীর্ঘ আর কষ্টসাধ্য যুদ্ধ জয় করার পর নিজেদের সংযত রাখা খুব কঠিন হবে তোমাদের জন্য। কিন্তু তবু, তোমাদের প্রত্যেকের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, যদি সত্যিকারের পুরুষ হও, কখনও কোনও নারীকে অপমান কোরো না। চরম শত্রুর স্ত্রী-কন্যা-ভগিনীকেও না। নারী শারীরিক ভাবে পুরুষের চাইতে দুর্বলতর। কিন্তু হৃদয়বৃত্তিতে কোনও অংশে কম নয়। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশি। অন্তত ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাই-ই... এবং হৃদয়বৃত্তিই মানবিকতার পরিচয়। শারীরিক শক্তি নয়।

‘‘তাই বলছি, কখনও কোনও নারীর উপর বলপ্রয়োগ কোরো না। যদি করো, সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসবে রাবণের স্তরে, অমানুষের পর্যায়ে, এবং সেই সঙ্গে পাওনা হবে চরম শাস্তি। সে শাস্তির পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে, তার নিদর্শন অদূর ভবিষ্যতে তোমরা দেখতে পাবে লঙ্কায়।’’

একটা দীর্ঘ, অর্থপূর্ণ বিরতি নিলেন তারা। যখন আবার কথা বলতে আরম্ভ করলেন, তাঁর কন্ঠস্বর কেমন অন্যরকম লাগলো... ‘‘তোমরা সাহসী, তোমরা বীর... তোমরা পুরুষের মতন পুরুষ। আমি জানি, তোমরা এমন কোনও কাজ করবে না, যা কিষ্কিন্ধ্যা বা প্রভু রামচন্দ্রের জন্য অসম্মানজনক হয়। আমি জানি, তোমরা রাবণের দর্পচূর্ণ করে, তাঁর পাপের রাজত্ব ধ্বংস করে সগৌরবে ফিরে আসবে। 

‘‘যাও, দাক্ষিণাত্যের বীর পুত্ররা, অতুল কীর্তি স্থাপন করে ফিরে এসো। কিষ্কিন্ধ্যা তোমাদের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করবে। তোমাদের জয় হোক!’’

তারা নীরব হলেন। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর উঠলো সমবেত সৈন্যদের গর্জন মেশানো প্রবল হর্ষধ্বনি। পাহাড়ের পিছনের পশ্চিম আকাশে তখন রাক্ষসী বেলার রক্তোৎসব...



0 comments: