0

ছোটগল্পঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প




আঁধার নক্ষত্রের নীচে
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


কবিসম্মেলন থেকে ফিরছিল পঞ্চানন বৈরাগী। সূর্য ডুবে গেছে ঘণ্টা দুই আগে। আকাশে চাঁদ নেই। ন্যূনতম আলোরেখাও নেই রাস্তায়। অসময়ে মেঘ এসে যাওয়ায় সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। ভাঙা সাইকেলটাই তার পথের সাথী, বন্ধু ও প্রেমিকা। একটা কবিতা উলুক ভুলুক করছিল মনের বারান্দায়। বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিল পঞ্চানন। সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে কবিতার ভেতর হেঁটে যাচ্ছিল পথ। চালানোর মত মিনিমাম আলো টুকুও নেই। টর্চ আনা হয়নি। আনলে সুবিধে হত। তবু ব্যাগে হাত ঢোকাল পঞ্চানন। না, ভুল করেও টর্চ রাখা হয়নি। যেহেতু এই রাস্তাতার আবাল্য পরিচিত তাই অন্ধকারেও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল না। এখনও একঘণ্টার পথ। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে কতক্ষণ লাগবে সে জানেনা। আর জেনেই বা কী হবে? বাড়িতে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে বসে নেই। বিয়ে থা হয়নি। মা গতবছর অবধি বেঁচেছিলেন। মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিতেন –পাঁচু, বাপ আমার। দেখছিস আমার এই দশা। কবে আছি কবে নেই। তোর একটা হিল্লে করে যেতে পারলে ভাল হত। জুনপুকির মত একটা বউ সারা ঘর আলা করবে। আঃ কি শান্তি! বউ ছাড়া কি ঘর মানায় বাপ?

পাঁচু অবশ্য সেসব কথা গেরাহ্যি করেনি। কবিতাই তার চিরসাথী, প্রেমিকা, বউ সবকিছু। খেতে খেতে কবিতা। ঘুমোতে ঘুমোতে কবিতা। এমনকি স্বপ্নেও কবিতা। কবিতা পাগল। তা এরকম একজন কবিকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে পারেনি প্রলাপ কাব্য সংস্থা। আহ্বান পাওয়ার পর ৫/৬ দিন ভালো করে ঘুম হয়নি পঞ্চাননের। জোরে জোরে গলা উঁচিয়ে আবৃত্তি করেছে নিজের লেখা নানা কবিতা।

সেরকমই একটি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে সাইকেল ঠেলছিল সে। অকস্মাৎ তেড়ে ফুঁড়ে বৃষ্টি আসায় মহা ফাঁপরে পড়ল। অনেকটা রাস্তা। প্রায় তিন বিড়ির পথ। সামনে নদী। অসময়ে গভীর রাত। ভয়ংকর মেঘ। লোকজন নেই। ডাকাবুকো মানুষ। তবু বুকটা ধক করে উঠল। এই অঝোর বাদলে কোথায় দাঁড়াবে? সামনে কোন গ্রাম বা বস্তি নেই। ফাঁকা ধু ধু নিরুদ্ভিদ এলাকা। একটা গাছতলা পেলেও দাঁড়ানো যেত। যদিও গাছ খুব নিরাপদ নয় এসময়। মহা দুর্ভাবনায় পড়ে গেল পঞ্চানন।

- কি ভাবছেন পাঁচুবাবু? রাতটা কোথায় থাকবেন?

- এদিক ওদিক তাকিয়েও কোনো মানুষের অস্তিত্ব নজরে এলনা। আবার কেউ ডাকল তার নাম ধরে। স্পষ্ট আওয়াজ। কিন্তু এবারেও লোকটাকে দেখা গেলনা। বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে। ঘন অন্ধকার। লোকটা হয়ত এর মধ্যেই মিলেমিশে রয়েছে তাই তাকে সনাক্ত করা যাচ্ছেনা। সামনের রাস্তাটা দ্রুত পেরিয়ে যেতে চাইল পঞ্চানন।

- আপনার কি ছাতার দরকার?

কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা, ছাতার তো খুবই দরকার, অন্তত মাথাটা বাঁচে। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলল – হ্যাঁ।

অমনি সাথে সাথে কোথা থেকে এক ছাতা এসে হাজির। কে বাড়িয়ে দিল এই ছাতা লোকটাকে দেখা গেলনা। দেশলাই জ্বালিয়ে চারপাশ জরিপ করতে গিয়ে দেখল ভিজে গেছে সবকিছু, কোন কাঠিই জ্বলল না। ছাতাটা হাতে পেয়ে বুকে সাহস অনুভব করল পঞ্চানন। আর স্বভাবতই অদৃশ্য মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মন। কিছুটা পথ হেঁটে এসেছে এমন সময় ভেসে এল খিল খিল হাসির আওয়াজ। নির্জন নদীতীর। শ্মশান। সব মিলিয়ে জায়গাটা সুবিধের নয় মোটেই। তার উপর জমাট বাঁধা অন্ধকার। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। অন্য কেউ হলে ভয়ে মিইয়ে যেত। পঞ্চানন বরাবরের ডাকাবুকো। বিদ্রোহী কবি হিসেবে এলাকায় সুনাম আছে। ছোট খাটো ব্যাপারে মুষড়ে পড়ার মত দুর্বল সে নয়। পিছনে তাকিয়ে দেখতে চাইলযদি কিছু দেখা যায়। একা একা হাঁটতে তার ভাল লাগছেনা। ভীষণ বোরিং, একঘেয়ে। অদৃশ্য লোকটিকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে বেশ খুশি।কিন্তু কাছে আসছেনা কেন? দেখাই বা দিচ্ছেনা কেন? দুজনে মিলে গল্প করতে করতে সারা রাস্তা তো বেশ আনন্দেই যাওয়া যায়। যতদূর মনে হচ্ছে লোকটি নিরীহ গোবেচারা ধরনের এবং অবশ্যই পরোপকারী। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাতেই পঞ্চানন দেখতে পেল একজন রোগাটে ধরণের লোক তার পিছনে দাঁড়িয়ে। গভীরভাবে লক্ষ্য না করলে বোঝাই যেত না। কঙ্কাল বলে বিভ্রম হত। সাদা সাদা হাড়ের উপর একখানা ময়লা জামা পরে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই তুমুল বৃষ্টিতেও তার জামায় জলের দাগ নেই। ক্লান্ত বিধ্বস্ত লাগছিল ওর অবয়ব। মাথাটা ঘুরে যাচ্ছিল পঞ্চাননের। অজ্ঞানই হয়ে যেত। কিন্তু হল না। কে যেন কানে কানে বলল – ভয়। ছিঃ ছিঃ তুমি এত ভীতু।

- কে?

- কই কেউ তো নেই, শুধু আমরা দুজন।

- দুজন!

- কখন থেকে আপনার পিছনে পিছনে আসছি।

- কেন?

- সামনের ঘরটায় চলুন, অনেককথা আছে।

আবার চমকে উঠল পঞ্চানন। এই রাস্তায় সে কতবার আসা যাওয়া করেছে। ঘর তো চোখে পড়েনি। ফাঁকা ধু ধু প্রান্তর। মাইল মাইল মাঠ। তবে অসম্ভব অবাস্তব বলে আজ আর কোন শব্দ নেই। যা ঘটে চলেছে, ঘর কেন রাজপ্রাসাদ হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। চার পাঁচ পা এগিয়ে যেতে সত্যিই একটা ঘর দেখতে পেল পঞ্চানন।

- আসুন আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

গলাটা পরিচিত শোনালেও এবার কিন্তু কঙ্কালটাকে দেখা গেলনা।

- কই, কাউকে তো দেখতে পাচ্ছিনা।

- ভেতরে আসুন। ঠিক দেখতে পাবেন।

গলাটা পরিস্কার শোনা গেলেও এবারও কিন্তু কাউকে দেখা গেলনা।

ভাগ্যে যা আছে অনিবার্য, ঘরে ঢুকেই দেখা যাক কি হয়। এই ভেবে ভেতরে পা রাখল পঞ্চানন। এবং স্বস্তি অনুভব করল। দেখল একটি মোমবাতি জ্বলছে। এই লোকটি সর্বার্থেই অন্যরকম। আচারে আচরণে ভদ্র বিনয়ী এবং পরোপকারী। আদৌ ক্ষতিকারক নয়।

- বসুন।

কোথায় বসব ভাবার আগেই শূন্যে ভাসমান একখানা চেয়ার দেখল।

- সারাদিন খাওয়া দাওয়া তো কিছুই জোটেনি দেখছি।

- না, না, তা কেন।

- লজ্জা করছেন কেন? মুখচোখ দেখে তো সবই বুঝতে পারছি।

- আমি এরকমই। শুকনো উদাস মুখ।

- আমরা কিন্তু ভেতরের সবকিছুই দেখতে পাই। ব্রাহ্মণকে গায়ত্রী লুকিয়ে কি লাভ?

এবার আর কোন শব্দ খুঁজে পেলনা পঞ্চানন। ধরাপড়া পকেটমারের মত দাঁত কেলিয়ে হাসতে গিয়েও পারল না।

- লুচি খাবেন তো?

- হ্যাঁ। মন্দ নয়।

- আসলে অন্য কিছুর আয়োজন করতে পারিনি।

খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছিল। স্থান কাল পাত্র ভুলে পঞ্চাননের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল – শুধু লুচি? সাথে কিছু নেই।

- আছে। মাংসের ঝোল।

‘আঃ’শব্দটি উচ্চারণ করার আগেই আসমানে ভাসতে ভাসতে চলে এল লুচির থালা। সঙ্গে মাংসের ঝোল। ধোঁয়া উঠছে তখনো। একদম টাটকা আর সুন্দর গন্ধ। সারা ঘর ভরে আছে এই সৌরভে। দারুণ সুস্বাদু। এরকম রান্না সে তার সারাজীবনে খায়নি। লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলল –আরও দুটো লুচি হবে?

- নিশ্চয়ই 

- দিন তাহলে 

- আমাকে আপনি বলার দরকার নেই। মরে গেলে মানুষের বয়স আর বাড়েনা।

পঞ্চানন কিন্তু ভয় পেলনা। বলল –ঠিক বলেছ। এসব কথাবার্তার মাঝেই একটি হাত ভাসতে ভাসতে চলে গেল বহুদূরে। পঞ্চানন দেখল – শুধু সাদা হাড়। তারপর ঝুপ করে দুটো লুচি পড়ল পাতে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আরামে একটা বিড়ি ধরাল পঞ্চানন।

- একা একা বিড়ি খাচ্ছেন যে।

- তোমারও যে এসব বদ নেশা আছে জানবো কিকরে?

- স্কুলে পড়তে পড়তে বন্ধু বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে যা হয়। আর ছাড়তে পারিনি ...

বাধ্য হয়ে বিড়ি দিতেই হল। বিড়িতে টান দিতে দিতে ভূতটা বলল – হিরামতি বিড়ি, এর স্বাদ কি ভুলবার ... আহা যেমন স্বাদ তেমন গন্ধ। তা কি করা হয় পাঁচু বাবু?

- সেরকম কিছু না। কবিতা টবিতা লিখি।

- বেশ ভালো। আমিও লিখতাম – ছেড়ে দিয়েছি।

- ছাড়লে কেন?

- আমাদের সমাজে ওসব অচল।

- কেন? রসিক সমঝদার মানুষ নেই?

- একদম ঠিক। আবেগ ব্যাপারটাই নেই।

- সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমাকে ধরে আনলে কেন?

- আপনাকে দেখেই মনে হয়েছিল কবি কবি মানুষ। রতনে রতন চেনে কি না।

- এখানেও কি কবিসভা চলবে ?

- তা নয়। আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আপনাকে লিখতে হবে।

- কি সমস্যা? বেশ তো আরামে আছো। দেখে শুনে আমারই তো মনে হচ্ছে তোমাদের সমাজে ভিড়ে যাই।

- বালাই ষাট। ওকথা মুখেও আনবেন না। একে কি থাকা বলে? ভূত হওয়ার যে কী জ্বালা আপনাকে বোঝাতে পারবোনা। তাও যদি হতাম কোন খানদানি ভূত।

- খানদানি ভূত তাও আবার হয় না কি?

- হয়। খুব হয়।

পঞ্চানন চুপচাপ শুনতে থাকে বিবরণ। ভূতটা বলে চলে – ওদের জন্য স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট। হাইফাই স্ট্যাটাস। আমরা যারা গেঁয়ো ভূত, গরীব নিচু তলার ভূত, তাদের কোন ইজ্জত নেই। ঘরবাড়ি নেই। আজ শ্যাওড়াতলা তো কাল বেলতলা। পরশু নদীর ধারে তো পরের দিন অশ্বত্থ গাছের মগডালে। এটাকোন লাইফ হল, বলুন? অথচ দিনের পর দিন এভাবেই বেঁচে থাকা। এভাবেই দিনযাপন। আমার আর ভাল্লাগেনা। একা একা নিঃসঙ্গ জীবন। চাল নেই চুলো নেই, ঘরদোর নেই।কেউ বিয়ে করতে চায়না, জানেন! বেঁচে থেকে যা পাইনিভেবেছিলাম মরে তা পাবো। সব ভুল। মাঝখান থেকে বেঘোরে প্রাণটাই চলে গেল।

- এত সুন্দর বাড়ি। তবু বলছ ঘরদোর নেই। পঞ্চানন আর চুপ করে থাকতে পারল না।

- আমার নয়। অন্যের। ফাঁকা পড়ে থাকে, তবু দেবে না থাকতে। বৃষ্টি থামার আগেই চলে যেতে হবে আমাদের।

- যে খাবারগুলো খেলাম?

- চুরি করে আনা। পান্তা জোটেনা লুচি কোথায় পাবো?

- আমাকে সব খাইয়ে দিলে কেন? নিজে তো খেতে পারতে।

- অভ্যেস খারাপ করে কি লাভ?

সমস্ত ভয় গা ছমছমানি কখন উধাও হয়ে গেছে। সারা বুকে সহানুভূতির হাওয়া বইছে সুর সুর করে। বিড়ি নিভে গেছে অজান্তে। বুকের ভেতর পঞ্চাননের বিদ্রোহী হৃৎপিণ্ড গর্জে উঠল – ভেঙে ফেলতে পারো না? তছনছ করে দিতে পারো না সবকিছু?

- পারিনা বলেই তো আপনাকে দরকার। আগুনের অক্ষরে কিছু লিখুন আমাদের জন্য।

- নিশ্চয়ই লিখব।

বৃষ্টি থেমে এল একসময়। তবু আকাশে চাঁদ উঠল না। বরং অন্ধকার আরও ঘনীভূত, আরও নিবিড়।

ভূতটাবলল –এবার হয়তো বাকি রাত কোনও শ্যাওড়া গাছে কাটাতে হবে। চলি। আর তো কোনদিন দেখা হবেনা। কথাগুলো মনে রাখবেন।

ভূতটা চলে যেতেই পঞ্চাননের অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল হু হু করে। নির্জন মাঠের মধ্যে সে একা, একেবারে একা। চারদিক অন্ধকার। ঘরটাও উধাও। আজকের রাতটা তাকে মাঠের মধ্যে একাই কাটাতে হবে। এরকম এলোমেলো কতরাত তার জীবনে এসেছে চলে গেছে। স্টেশনের প্লাটফর্মে, মাটির চালাহীন স্কুলঘরে শুয়ে, যাত্রা প্যান্ডেলের মধ্যে কোনদিন একবেলা খেয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। কখনো তাও মেলেনি। তবু কবিতা লিখেছে।

অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছিল। নৈঃশব্দের মধ্যে আপাদমস্তক ডুবে যাচ্ছে পৃথিবী। নির্জন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে পঞ্চানন চীৎকার করে ডাকল – শোন, শুনতে পাচ্ছ? কোন উত্তর এলনা।

- আমি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিনা।

এবারও কোন উত্তর এলনা বিপরীত দিক থেকে।

- তোমার নামটাই তো জানা হয়নি।

আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দটা ঘুরে বেড়াল। কোন উত্তর এলনা। শুধু এক অলৌকিক হাসির শব্দ খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল চরাচরে। নিস্তব্ধ নির্জন প্রান্তরের জলমগ্ন আয়নায় পঞ্চানন শুধু নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। আর কেউ নেই।

0 comments: