0

ছোটগল্পঃ অমলেন্দু চন্দ

Posted in

ছোটগল্প



বর্ডার
অমলেন্দু চন্দ



ভাদ্র মাসের একটু ঘোলাটে সকালটা তীখা নীলটাকে একটা পাতলা হিজাবের মত আবছায়ায় রেখে দিয়েছিল। বেরনোর তাড়া ছিল। আবার কথা বলার মত সময় দরকারী ছিল। এর মধ্যেই সেলফোনটা বার তিনেক বেজেছে। না ধরেও অর্ক জানে ওটা রোহিণীর ফোন। না ধরার একটা হাল্কা শিরশিরানি দাড়ি কামানো ভিজে গাল বেয়ে চিবুক ছুঁয়ে প্রতিবার নেমে যাচ্ছিল। টোস্টে মেয়োনীজ লাগিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে অর্ক রোহিণীর সেলটা বাজালো, ভয়েসমেইল – “হেই ইটস মি, ইফ ইউ হ্যাভ এনিথিং আর্জেন্ট, লিভ দ্য মেসেজ... শ্যাল কল ইউ ব্যাক...” 

আশুতোষ কলোনির ছিদাম ঘোষ লেনের জানালার বাইরে চিরাচরিত এভাবেই বৃষ্টি নামবে রোদ উঠবে, চৈতন্য ঘষটে ভাদ্র গিয়ে আশ্বিন, দুলকি চালের টইটম্বুর নয়নতারা শরৎশশীরা গলি দিয়ে সেই “কি রকম, কিসের মত, সে কি আর আমি বলে বোঝাতে পারি” গোছের অভাববোধের খোল মাদল বাজিয়ে দিয়ে যাবে। রোজকার গপ্পের নতুন করে পাওয়া নতুনদিদিমা মার্কা পুজোর চাঁদা তোলার হিড়িক। কয়েক দিনের জন্য হার্ট লাংস চিরকালীন জগৎ সংসারের চেনা হাটের সাবেক অ্যাড্রেসে ঘোরা ফেরা করবে – আরে বাবা এ তো সেই সিম্পল কেমিস্ট্রি – ব্যালান্সের রাজা উজির মারা প্রোডাক্টেরা হয়ত ভ্যাবাচ্যাকা খাবে, টেনশন, ইরিটেশন কপালে ওডিকলোন, ছোঁয়ায় এক্সট্রা আহ্লাদ, এক শীত কেটে আরেক আশ্বিনের দিকে গড়িয়ে যাওয়া সময় – এর মাঝে সেল ফোন আর ভয়েসমেইল!

জীবনের সঙ্গে এই সেল ফোন এমনভাবে জড়ানো যে সে না থাকলে দিনপঞ্জির ধারাই বদলে যায়। খাপ খাওয়াতে গিয়ে ফরাসীমার্কা বাঙালী মন - ইয়ে মানে যারা কঠোর যুক্তিবাদী বলে চলতি কথায় বিশাল গর্ব করে থাকেন - সেই তেনারাও যুক্তিসঙ্গত উপায় খুঁজতে থাকেন, ওটা নাকি পাকা বুদ্ধির লক্ষণ, যে লক্ষণটা একটা চেনা রোগ, আর সেটা নয়ণতারা শরৎশশী দের থেকে ভালো আর কারাই বা বোঝে!

অর্ক টোস্ট চিবোনোর স্পীড বাড়ালো, আর্লি ডে’তেই বসের ডাকা এমারজেন্সি মিটিং রয়েছে। অফিস ওর সল্ট লেকের ফ্ল্যাটের হাতের নাগালেই সেক্টর ফাইভে। কাল রাতে রোহিণীকে ওর অফিস থেকে তুলে নিয়ে ফিরতে পারে নি। এই বয়েসেই ও জেনে গেছে যে অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ পৃথিবীতে সবার থেকে পরে আসা বিভীষন বুদ্ধিমান প্রজাতিটার মনের সবচাইতে স্বাভাবিক বৃত্তি সন্দেহবাতিক। গ্রস্ত নয়ন শশীরা তখন হাওয়া বাতাসে বইয়ে দেয় নৈর্ব্যক্তিক-বলে-বোঝানো-যায়-না অথচ কিছুতেই-ধরতে-পারা-যায়-না এমন একটা ভাবের প্রবাহ। তারা তখন চিলের মত গা এলিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর অর্কদের দেখলেই সেই আচারের পাহারায় রত পিসিমার মত হুস হুস করে...। 

আহা এমন সব কাক চিল সম্ভাবনার দুঃসময়ে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন দু’চামচ নীল আকাশ, সৃষ্টি রহস্যের খোঁজে লেগে পড়া আকস্মিক আশা আকাঙ্খার আইনস্টাইনরা ফেল মারে। সে যে কি ভীষণ নির্মম অসঙ্গত শর্ত প্রকৃতির!

এই তো সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে মারুতিটা ওপিয়ামের সামনে যখন থামালো, পাশের ইনফিনিটি টাওয়ারটা অন্ধকারে অনেক উঁচু অবধি আলো আঁধার করে ঠায় দাঁড়িয়ে, রোহিণী নামতে নামতে চোখ নাচিয়ে ভ্রুভঙ্গে নীরব প্রশ্ন তুলল !!!???

অর্ক বুদ্ধদেব আওড়াল – এ আমাদের দিনান্তের নরম আলোয় প্রার্থিতকে দেখতে চাওয়া! ঘরে ফেরার আগে নতুন করে ফিরে ফিরে পাওয়া – দর্শনে, চোখে!

রোহিণীর মুচকি – বারের ভিড়ে!!

অর্ক তখনও ফরাসী মেজাজের বাঙালী প্রেমিক – আমাদের একান্তের আলোয় লুপ্ত হয়ে যাবে বারের কোলাহল, আমরাও হারাব নতুন করে...

রোহিণীর ইন্টারজেকশন – “কি খেয়ছিলি রে দুপুরে!” চোখের আঁচলে প্রাণিত কৌতুক।

অর্ক – শেরি মাই-শেরি! মিসেস মুঞ্জাল নিয়ে এসেছিলেন! বলেই বুঝল কেলো হয়ে গেল। মিসেস মুঞ্জাল অর্কর চল্লিশ ছোঁয়া বসের তিরিশ ছোঁয়া সুন্দরী বিদুষী বৈভবসম্পন্ন শ্বশুরের কন্যা তার গরবের সোস্যালাইট পত্নী যার ফর্সা নাভির আঁচল ঢাকা অনবদ্য আকর্ষণের সৈকতে চোখ রাখেনি এমন ক্যাথলিক অর্কদের অফিসের ছাব্বিশ থেকে চল্লিশ বা তদুর্ধে কেউ ছিল না, তিনি ছিলেন সবার মুন –

তরঙ্গিনী নয়নেরা যা শুনতে চায় তার মধ্যে এসব কোনওমতেই পড়ে না! শোনানোর মাশুল দিতে অর্ককে সেদিন ওপিয়ামের টেবিলে বসেই ছোটো একটা হীরের টপ ট্যাব থেকে বুক করে উপহার দিতে হয়েছিল। লাই ডিটেক্টরের মত একটা টেরিবল অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রোহিণীরা হীরের দ্যুতিতে আজও ভোলে। হয়ত এটাই চিরন্তন ধ্রুব অবিচল আসক্তির ধর্ম। রোহিণীর সেদিনের শেষ মেমোরেবল সংলাপ ওপিয়ামের হট্টগোলের মধ্যে – আবার... আমার জন্যে... এখন... এত খরচ করে...

অর্ক তখন যুক্তিবাদিতা আর ভাবাবেগশীলতার মত পরস্পরবিরোধী বৃত্তিকে পোষ মানাতে পারার আত্মহারা রিং মাস্টার, আরে ভাই টাকা হল মাটি আর মাটিতেই তো প্রেমের বাস। সেদিন বাকি সময়টুকুর ঝোঁকে ওরা ভেবে রাখল কলকাতা থেকে অনেক দূরে ওদের বাড়ির ঝুমকোলতা ঝোলানো গেটের পাথরে ওরা লিখবে বাড়ির নাম – দ্য নেস্ট। বাড়ির পেছনে একটা কুয়াশাঘেরা নদীতে বছরের তেরো মাস শুধু বালু থাকবে মাঝে মধ্যে বর্ষাকালে বান ডাকবে, একটা মহুয়াগাছ যার নীচে একটা ইঁদারা। কাছাকাছি সপ্তাহে দু’দিন অন্তত হাট বসবে, নদী পেরিয়ে জঙ্গলে সক্কাল সক্কাল ওরা ওদের ছেলের - হ্যাঁ দুজনেই এ ব্যপারে মতৈক্যে আসতে পেরেছিল – সেই ছেলের হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে চেনাবে রুদ্রজটা পিপুল, বাঁধুলি পাথরকুচি আর দধিপুষ্পর গাছ পাতা।

এখানে এসে রোহিণী হেসে ফেলেছিল, শেষ পর্যন্ত চিচিঙ্গে! তার ওপরে আবার ডিম পাড়ার সম্ভাবনা! অর্কর পিঠে চিমটি কেটে ও বলেছিল... কিন্তু তিনশো মাইল দুরের কগনিজ্যান্টের সেক্টর ফাইভের অফিসে লাঞ্চ আওয়ারে মিসেস মুঞ্জালের কি হবে! 

পনেরো হাজারি সংস্কৃতির স্থপতি মধ্যযুগের নাইটদের মত শিভ্যালরাস তখন, বলেছিল - “দেখো আমার চিরন্তন আস্থা যে আনন্দের কোনও বিনাশ হয় না, শুধু পাত্র বদলায়। নশ্বর জগতে এইটাই অবিনশ্বর – আলটপকা হোক, বিভ্রান্তি যেন না আসে। কেঁদোনা কাঁদিওনা, ভালবেসে ভালবাসার যোগ্য হয়ে ওঠাই তো কৃষ্ণচরিত্রের দুর্জ্ঞেয়তম সাধনা ছিল, আর আমার ভাবোন্মাদ আসক্তির জীবাত্মা পরমাত্মা ট্রিস্টান রাধা সব তুমি...”

রোহিণীর পুলকিত খিস্তি – শালা খালি ঝেড়ে ভচন মারা (ইংরিজি আবহে মানুষ রোহিণী ব’কে অনেক সময়েই ভ বলে ফেলে, বা হয়ত অমিতাভের নামের শেষটুকু বচনের বদলে ভচন বলতে ভাল লাগে তাই) সভ একসাথে ঝাড়ছিস! রোহিণীর স্লাভদের মত একটু ভারি শিশিরের মত ঘামে ভেজা শরীরের ছন্দে তখন পৃথিবী দুলে ওঠার সংক্ষিপ্ত মিথ। বিনিময়ের জংলা নির্জন তখন আখরোট আদরের উপাখ্যান। 

এমতাবস্থাতেও অর্কর শভিয়ান হিউমার অব্যাহত – পড়তে হয়, মাই-শেরি, নাহলে পিছিয়ে... বেমক্কা একটা পিঠে কিল বাকিটুকু “ওঁক” হয়ে বেরিয়েছিল।

আহা প্রেম, কে যেন বলেছিল ওইটাই নাকি মানুষের হৃদয়ের শেষ সার্থকতা – “ওঁক!” না, এই দ্বিতীয়টি অর্ক নয়, লেখক তুললেন বলাই ভাল। বুদ্ধদেব লিখেছিল “কিছুই নাকি প্রেমের মত নয়” আর লেখকের মনে হল ঠিক, কোনও কিছুই এই “ওঁক” এর কাছে লাগে না! এই “ওঁক” শব্দের নিভৃতিতে রয়েছে একটা প্রাঞ্জল (প্রাণ জল করা) সৌন্দর্যচেতনা। সেই চেতনার গভীরকে ছুঁতে শুরু করলেই সমস্ত বৃত্তান্ত কে শুধু কাহিনী বলে মনে হবে না। 

অফিসপাড়া স্কাইস্ক্র্যাপারের দেশ। লিফট খারাপ থাকলে উর্ধ্বতর লোকে পৌঁছনর জন্য পুণ্যের জোর চাই আর কে না জানে পুণ্য মানে হল যার যত কলজের জোর তার তত পুণ্যফল। অর্ক যেহেতু তার নিজের থাকে সবটুকু ধাপে ধাপে উঠে আসে নি, শুরুর লাফটা লম্বা ছিল, তাই লিফট খারাপ থাকাটা ওর কাছে একটা সামাজিক অপরাধ। লিফটদের অশিষ্টাচার ওর কাছে খুনের অপরাধের সামিল, সিঁড়ি ভেঙে ন’তলায় – কখনও কখনও তখন ওর মনে হয় এতটা ওপরে উঠতে না হলেই হয়ত ভাল ছিল। 

আজ লিফটগুলো ঠিক ছিল। লিফটে উঠে দেওয়ালে অল্প হেলান দিয়ে চোখ বোজা ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গী দেখলেই বোঝা যায় ও নিতান্ত মা-কালি-মার্কা-চায়ের-ব্র্যাণ্ড নয়, ওর একটা জাত রয়েছে। ওইটুকু সময়ের মধ্যে নমস্কার, গুড মর্নিং, ভালো ইত্যাদি আশ পাশ থেকে আসা শব্দগুলোর জন্য ওর বরাদ্দ কিছুটা ঘাড় নাড়া বা বাঁকিয়ে ঝাঁকানো, আর ও জানে কোন শব্দগুলো বাজলে চোখ মেলে উত্তর দিতে হয়। আজ সেরকম একটা শব্দ হল – ওর বসের পি এ। মর্নিং অর্ক, এসে গেছেন, স্যার বলেছেন মিনিট দশেক দেরি হবে! অর্ক যথারীতি একটু ঝুঁকে ওর চেনাপ্যাথির দখিনা বাতাস হাসিতে ছড়িয়ে বলল – ততক্ষণ তোমার সঙ্গটা আমার লাভ! অপ্রাপনিয়া ঝিনুক দিয়ে রুপোর বাটিতে শব্দ করার মত করে বাজলেন – “ভেক্যান্সি হলে বলবেন অর্ক!” 

এইসব ঘিরেই তো সভ্যতা। কোনও রকমের রোম্যান্টিক ইন্টারেস্ট নেই অথচ সভ্য ফ্লার্টিংয়ে এক ধরনের ফ্লেমিশ পেইন্টিং এর ফ্লেভার থাকে। সেই ‘আ স্টোরি উইদিন আ স্টোরি’, যার কোনও কোনও পরতে এক ধরনের স্যাটায়ার থাকে। আর সেটা এক্সপ্রেস করার ডিভাইস হল ইন্দ্রিয় – যা কখনও ঘন কখনও বিজন একধরনের উৎকৃষ্ট মানসিক কৃষ্টির ফসল। ঈর্ষাপরায়ণরা এ ব্যপারে সেই সব গোত্রের হয়ে যান যাদের হজমক্ষমতা কমে গেছে, কিন্তু ক্ষিদে রয়ে গেছে। 

সাত আট বছর হয়ে গেছে বোধহয়, অর্কর হঠাৎ মনে হল ওর ইন্টারভিউ’র কথা। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে বণ্ড সই করা চাকরিতে হাঁস ফাঁস করতে শুরু করেছিল। 

তখন এই ইণ্টারভিউ – ছাত্রত্বের গন্ধটা বেবাক ওর গায়ের থেকে যায় নি, বোর্ডে তিন চার জন ছিল বোধহয়, আর অর্ক অভিমন্যুর মত টেবিলের অন্য প্রান্তে যখন তৈরি হচ্ছিল এন্টারপ্রাইজ কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত ওর বিদ্যের জাহাজ কত বড় বোঝাতে, ঠিক তখন ও যেটা খুব বোঝে না সেই “ই আর পি” আর “সেলস অ্যাণ্ড মার্কেটিং” এর কনভারজেন্স এর জমিতে ওকে আছড়ে ফেললেন ইন্টারভিউ বোর্ডের মধ্যমণি বললেন – একজন প্রস্পেক্টকে, যিনি ই আর পি শুনেছেন কিন্তু বিশেষ জানেন না, তাকে ইঙ্কলুসিভ ডিজাইন এর বেনিফিট কি করে বোঝাবেন – তিনি আপনাকে একটি পনেরো মিনিটের উইন্ডো দিয়েছেন –

পুরো থতমত খাওয়ার অবস্থা যখন অর্ক’র দুম করে মনে পড়ে গিয়েছিল শরৎচন্দ্রের রোহিণীর সংলাপ – বলেছিল – রূপ একটা ভ্রম মাত্র, সে রূপের ভ্রম একটা ছায়ার আভাষ, যে ছায়া তাকে কৌতূহলী করবে আর সেই কৌতুহলটাই ক্যাপিটাল – সেটা ভাঙাবার চেষ্টা করব – আরও বলেছিল – আই উইল টেল হিম দ্যাট টেকনোলজি ইজ নট সামথিং অ্যাপার্ট ফ্রম আস, লাইক লাইফ, লাইক লাভ, ইট ইজ দ্য ওয়ে অ্যাণ্ড হাউ উই ডিল উইদ ইট মেকস আস ডিস্টিঙ্কটিভ - অ্যাজ অ্যান অরগ্যানাইজেশন!

সেই শুরু, এখন ও লিফটে উঠে স্বচ্ছন্দে চোখ বুজে দাঁড়ায় ওর সম্ভ্রম জাগানো ডিস্টিঙ্কটিভ ভঙ্গীতে। কফি হাউসে এই চাকরির খবর যখন দিয়েছিল, আধা আঁতেল কবিতা লেখার উন্নাসিকতায় ভোগা এক বন্ধু তার বাঁকানো নাকের ওপরে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল – শেষ পর্যন্ত ক্যাপিটালিজম এর তাঁবেদারি করতে চললে! ওই উন্নাসিক ভুলের দম্ভ দেখে অর্ক অবাক হয়েছিল। আরেক তাঁবেদারির অচলায়তন। 

সত্তর থেকে সাতাত্তর বলে যে সময়টায় কলকাতা তথা বাংলায় হারাবার পালাগান, যে ট্র্যাজেডির রাজনৈতিক অসহনীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে একমাত্র বার্গম্যানের ভারজিন স্পৃং এর মধ্যযুগীয় বর্বরতার তুলনা হতে পারে, অর্ক’র বাবা সে সময়ে খুব বেশী বয়েস না হলেও ভারে ক্লান্ত, হয়ত কিছুটা বিভ্রান্তও। ও পার বাংলার মানুষ, যেন আমৃত্যু যুদ্ধ করার নিয়তি নিয়েই জন্মেছিলেন। বৃদ্ধা মা, অর্কর মা আর এক প্রাচীন জ্যাঠা আর অর্ক কে নিয়ে এসে বাসা বেঁধেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার হালতু অঞ্চলে – আজকের কলকাতার ৭৮ যেটা পুরোপুরি উদ্বাস্তু অঞ্চল সেই আশুতোষ কলোনিতে। পুরোপুরি জবরদখল কলোনি, সে সময়ে জলা জঙ্গলে ভর্তি ছিল, আজ চেনা যায় না – অর্কর মা মারা গেছেন সেখানেই, দাদি – ঠাকুমা কে দাদি বলে ডাকবার খুব বেশী সুযোগ হয়নি অর্কর, তিনি যান ওর তখন স্কুলের বয়স, তার পর মা। অর্কর বাবা নাগরিক কমিটি, কলোনি কমিটির মধ্যে থেকেও পুকুর বোজানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন, বোজানো পুকুরের ওপরে পার্কের তালা খুলিয়ে শিশু উদ্যান বানানো এই সব নিয়েই কাটিয়ে দিলেন, আর হ্যাঁ, অর্ককে বড় করলেন।

সেই অর্ক আজ সল্ট লেকের সেক্টর থ্রী র নিজস্ব তিন কামরার ফ্ল্যাটে থাকে। চেষ্টা করেছিল কিন্তু বাবা দ্বিতীয়বার বাস্তুচ্যূত হতে চাননি, আজও বেঁচে আছেন, অর্কর এক দূর সম্পর্কের বিধবা দিদি তার এক ছেলে আশুতোষ কলোনির সেই বাড়িতে আশ্রিত। চোখ বোজা অর্কর হঠাৎ মনে পড়ল এক দিন ও তখনও স্কুল ডিঙোয় নি, বাবার সাথে বাজারের থলে হাতে ফিরছিল, এক রবিবার সকালে। বড় একটা পুকুরের পাশ দিয়ে বাড়ির দিকে আসতে হত, পুকুরটা আজ আর নেই, বড় আবাসন হয়ে গেছে, সেই পুকুরটার পাশের জমিতে দু’দিকে দু’জোড়া বাঁশের মাঝে টাঙানো দড়ির ওপর খেলা দেখাচ্ছে একটি অল্প বয়েসের কিশোরী, বুকের সামনে দু’হাতে একটা বাঁশ ধরে দড়ির ওপর লোহার একটা রিংকে সাইকেলের মত ব্যবহার করে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পৌঁছনোর ব্যালান্সের খেলা – নীচে ঢোল বাজাচ্ছে একজন। বাবা জিগ্যেস করেছিলেন – বলতো, এদের সঙ্গে আমাদের মিল কোথায়? অর্ক বলেছিল – আমরা গরীব, ওরা বেশী গরীব। বাবা হেসেছিলেন, তারপর বলেছিলেন – আমরা সবাই ব্যালান্সের খেলা খেলে চলেছি, কেউ আকাশে কেউ মাটিতে।

চমকে উঠল অর্ক। সেদিনের আত্মীয় স্বজন বাড়ি লাউ চালকুমড়ো চেনা তরকারির দোকান, বাজার করতে গিয়ে বাঁশের বাতায় বসে চায়ের দোকানে কাগজ পড়ে বাবার চা খাওয়া সেই দেশ ও ছেড়ে এসেছে, যেমন বাবা ছেড়ে এসেছিলেন তাঁদের নিজের বাড়ি, চেনা জানা মানুষজন, মনে পড়ে গেলে বুকে শেল বেঁধানো সেই তাদের দ্যাশ, তবু কি অদ্ভূতভাবে ব্যালান্সের খেলাটা রয়েই গেছে। 

তাই হয়ত সাহিত্য সিনেমা ফ্যাশন মল কালচার যুক্তিহীন নিষ্ঠুরতা অনবরত পুড়ে যাওয়া সিগারেট সমালোচনা উৎসাহ প্রাণশক্তি এ সবের মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ “দুচ্ছাই কিচ্ছু ভাল্লাগে না” র রিফ্রেইণটা যখন তখন এধার ও ধার থেকে সজোরে বেজে ওঠে। অন্য দুনিয়ার ঠাণ্ডা ঘর, মৃদু আলো, সুবেশ মানুষজন, শেরি হুইস্কির গেলাস, পকেটের পার্সে সাজানো থরে থরে নোটের সার্থকতার মধ্যেও অপ্রত্যাশিত বেজে ওঠে দুম করে সে একই রিফ্রেইণ!

অর্কর মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল – দুচ্ছাই...। বসের পি এ বলে উঠল “কিছু বলছেন অর্ক?” অর্ক বলল, সেই ব্যালান্স বজায় রেখে “দুচ্ছাই লিফট টা এত স্লো কেন?” বলতে বলতেই লিফট থামল ন’তলায়। বাইরে লবিতে ঘড়িটায় ন’টা বেজে এগারো মিনিট তখন, ন’টা নয় তে অর্ক লিফটে উঠেছিল। কথা না বাড়িয়ে অর্ক নিজের চেম্বারের দিকে পা চালালো।

0 comments: