0

প্রবন্ধঃ অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি ও বাঙালিয়ানা
অরূপজ্যোতি ভট্টাচার্য



শার্লক হোমস অমনিবাস থেকে একটা গল্প মনে আসছে, যেখানে মাতা সন্তানের বুক থেকে রক্ত খেয়ে সন্তানের শরীরে বিষ ঢুকতে দিতেনা। আজকের বর্তমানে জ্বলন্ত নিউজ –মার হাতে মেয়ে খুন| আর সেই খুনের প্লট, নিউজ পেপার আর টিভিতে দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এরকম ভয়ঙ্কর থ্রিলার কোনো লেখক কোন দিন লিখেছেন কিনা। আধুনিক ফরেনসিক সাইন্স যেভাবে এই খুনের মামলা সলভ করলো তাতে সোনি টিভিতে CID ফেল করে যাবে। CID মুম্বাই ব্যুরো লাইভ। এই খুনের রহস্য দেখতে গিয়ে বার বার একজন বাঙালি সত্যান্বেষীর নাম মনে আসছে–ব্যোমকেশ বক্সী। আমার নিজের বিচারে ব্যোমকেশ একমাত্র ভারতীয় ডিটেকটিভ যিনি শার্লক হোমস বা এর কুল পোয়ারোর সাথে এক মঞ্চে দাঁড়াতে পারেন। বাংলায় ডিটেকটিভ গল্পের জনক বলা চলে পাঁচকড়ি দে’কে। শশধর দত্তের মোহন, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের জয়ন্ত ছাড়াও কিরীটি রায়, ফেলুদা, কাকাবাবু অথবা পান্ডব গোয়েন্দা বাংলা গোয়েন্দা গল্পের অসামান্য সৃষ্টি।

কিন্তু হঠাৎ আজ গোয়েন্দা গল্পের কথা বলছি কেন? কারণ, প্রতিদিন খবরের কাগজে ফুটে ওঠা ভয়ংকর সব খুনের খবর। খুনের যে সমস্ত প্লট আর মোটিভ প্রকাশ পাচ্ছে, আর তাতে যে নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠছে, তাতে অনেক হিসেব উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ব্যোমকেশ বা ফেলুদা যদি আজ থাকতেন তাহলে সত্যি কি পারতেন আজকের এই সব খুনের রহস্য সমাধান করতে? সেদিনের গল্পে খুনের মোটিভ আর আজকের বাস্তব, দু’য়ের মধ্যে কি কোনও মিল আছে? আজ ফরেনসিক সাইন্স, কম্পিউটার গ্রাফিক্স সব এক হয়েও খুনের সমাধান খুঁজতে পারছেনা। ব্যোমকেশের মাকড়সার রস গল্পের রহস্য কি আজকের এই ই-মেইল, ফেইসবুক যুগে সমাধান খুঁজে পেত? মনে হচ্ছে বিগত দশ পনের বছরে সমাজে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে, যেটা সমাজের চিরাচরিত প্রথা বা নিয়মকে একদম উল্টে পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু একটা মৌলিক প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনের সাথে বাঙালিয়ানার সম্পর্ক কি? অথবা বাঙালিয়ানা বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি ? 

গোপাল কৃষ্ণ গোখেল বলেছিলেন, "what Bengal thinks today, India thinks tomorrow." এটা থেকে বোঝা যায় বাঙালি আর বাঙালিয়ানা বাকি ভারতবর্ষ থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। বাঙালিয়ানা শব্দটার জন্ম মনে হয় এই বিশেষত্ব থেকেই। বাঙালি যেদিন বিধবা বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেদিন ভারতীয় সমাজে কেউ সেটা কল্পনাও করতে পারতেন না। বিলাস ব্যসনে বাঙালির বাবু সমাজ, কলকাতার হারকাটাগলি, সুরার নেশায় বাইজীর ঘুঙ্গুর, আবার এরই মাঝে ইয়ংবেঙ্গল, ডিরোজিও, নারীশিক্ষা... এই সবই বাঙালিয়ানার মৌলিকতা। বেদান্ত প্রচারে স্বামী বিবেকানন্দ অথবা আইনস্টাইন আর সত্যেন বসুর সংযোগে "বোসনকনা"... সবই এই বাঙালির বাঙালিয়ানা। একটা গান মনে পড়ছে - "বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ চিংড়ি মাছের লাউ"। সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ঝাঁঝ, লঙ্কার হল্কাতে চোখের জল। সবই সেই বাঙালিয়ানা। মেয়েদের পোশাকে স্বাধীনতা দিয়েছে সেই বাঙালি। ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা। নতুন কায়দায় শাড়ি পড়তে শিখিয়েছে। আজকের পথে খোলা পিঠের বিভাজিকা বা উন্মুক্ত নাভিতে মোহময়ী হয়ে ওঠার সাহসী পদক্ষেপ। একদম স্বছন্দ বিচরণ। জমিদার গিন্নির হুকা টানা। অভিজাত ঘরে সুরার গ্লাস। আজকের মধ্যবিত্ত মেয়েরাও বিয়ার বার-এ যাচ্ছে। হাতে সিগারেট। "চোখেরবালি" তে আছে বিধবা মেয়েদের গোপনে মিলনের কাহিনী। শরীরের তৃষ্ণা মেটানো। আজকের বাঙালি সেই গোপনীয়তা কাটিয়ে উঠেছে। বেড়েছে আবেদন। পরিবর্তন এসেছে প্রনয় নিবেদনের কৌশলে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আজ বাঙালিয়ানা কিছুটা তার স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ফেললেও, আজও সরস্বতী পূজা বাঙালির ভ্যালেনটাইন ডে। ভ্যালেনটাইন ডে’র পরের দিন কি ? ফেইসবুক-এ পোস্ট হয় আই পিল ডে। এটাও আজকের আধুনিক বাঙালিয়ানা। বাংলার একজন প্রিয় দৈনিক পত্রিকাতে পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন–বোল্ড রিলেশন, উষ্ণ বন্ধুত্বের আর বশীকরণ স্পেশালিস্ট জ্যোতিষীদের। হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে ডান্সবারের আধিক্য দেখে মনে হচ্ছিল মুম্বাই যেন কলকাতায় চলে এসেছে। যাই হোক, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, কোনটা শালীন, কোনটা অশালীন, কোনটা সংস্কৃতি আর কোনটা অপসংস্কৃতি, সেটা বিচার করতে বসিনি। আমি আশাবাদী মানুষ হিসেবে মনে করি সমাজে সময়ের সাথে এই পরিবর্তন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাঙালি ও বাঙালিয়ানা যে আগের মত নেই, সেটা পরিষ্কার। আর এটাই বোধহয় আধুনিক বাঙালিয়ানা।

বাঙালি, বাঙ্গালী বানানের বিচারে দু’টো বানানই শুদ্ধ। একটা দেশজ, তাই ‘ই’। আর একটা বঙ্গশব্দজ, তাই ‘ঈ’। কিন্তু বাঙালিয়ানা সবসময়ই অভিনব। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। স্বাতন্ত্র্য বহন করে। কিন্তু আজকের এই পরিবর্তনের সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতা আর অবাধ স্বাধীনতা, এই দুইয়ের দ্রবণ অসম্পৃক্ত থেকে গেছে। বাঙালিয়ানা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার আবর্তে। আপাত সীমারেখা আইনের লক্ষণরেখাকে বারবার অতিক্রম করে ফেলছে। আর তারই প্রতিফলন প্রতিদিনের খবরের কাগজে। ধর্ষণ, নির্যাতন, নৃশংসহত্যা, সাথে মনস্তত্ত্ববিদ্যার সমস্ত তত্ত্বকে বিফল করে নৈতিকতার পতন আর মানবতার স্খলন বিষাক্ত করে তুলছে সমাজকে। উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত সবাই। লেখক হিসেবে আমারও এক ক্ষুদ্র চেষ্টা।

ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রে একটা তত্ত্ব আছে সিস্টেম ডাইনামিক্স (System Dynamics) বলে। সেই তত্ত্ব মতে যে কোনো সিস্টেম সবসময় একটা পসিটিভ আর একটা নেগেটিভ লুপ দিয়ে সাম্যাবস্থায় থাকে। কিন্তু যখন সেই ব্যালান্স বিঘ্নিত হয়, তখনি অসমানুপাতিক উন্নতি বা অবনতি ঘটতে থাকে। এই সূত্র যদি আমরা সমাজে প্রয়োগ করি, তবে আমরা বিগত দশ-পনের বছরে এরকম কিছু অসমানুপাতিক পরিবর্তন দেখতে পাই। সেই পরিবর্তন টেকনোলজি, শিক্ষা, সামাজিক সম্পর্ক সবক্ষেত্রেই এসেছে। বেড়েছে অর্থনৈতিক অসাম্য। অবাধ মেলামেশার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক, বিশ্বাস। তাৎক্ষণিক আনন্দ বা চমক ঢেকে দিচ্ছে সুদূর পরিকল্পনা। সব মিলিয়ে বেড়েছে অসাম্য। অনেকটা তাপগতিবিদ্যার এনট্রপির মত। যেটা সবসময় বেড়েই চলে আর বাড়িয়ে দেয় অনিয়ম (disorderliness)। বস্তুজগতে, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নে, সমস্ত সিস্টেম একটা ধর্ম মেনে চলে। অস্থিরতা থেকে স্থিতাবস্থায় আসার চেষ্টা। সেখান থেকেই জন্ম রাসায়নিক বিক্রিয়ার। আমাদের সমাজও সেরকম, বর্তমান অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীল হবে। এটাই ধর্ম। এটাই চলার পথ।

0 comments: