0

প্রবন্ধঃ আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



হিন্দুধর্ম ও নানা সংস্কার
আইভি চট্টোপাধ্যায় 



আজকের একবিংশ শতাব্দীতেও ধর্ম নিয়ে প্রবল উন্মাদনা। অযোধ্যায় করসেবকদের উন্মাদনা, পুরীতে রথের সময় জগন্নাথভক্তদের উন্মাদনা, প্রয়াগে কুম্ভমেলায় পুণ্যস্নানের উন্মাদনা, বাবার টানে কাঁধে বাঁক নিয়ে তারকেশ্বরে ছুটে চলার উন্মাদনা। তালিকা দীর্ঘতর হয়ে উঠবে অচিরেই। 

আর ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক মারদাঙ্গা? সেই কোনকালে শঙ্করপন্থী ও রামানুজপন্থীদের রক্তারক্তি দ্বন্দ্বের সাক্ষী ইতিহাস। সেই পরম্পরা প্রবহমান সাম্প্রতিককালেও। 

এখনও অসংখ্য মানুষ স্বর্গনরক, জন্মান্তরবাদ, দেবদেবীর পুজো, অবতারতত্ত্ব, চতুর্বর্ণভেদ, দৈবশক্তিতে বিশ্বাস, আংটি-তাবিজ-কবচ ধারণ, চন্দ্র-সূর্যগ্রহণে রাহুকেতুর ভুমিকা, শনি-মঙ্গলবার দেবতার নামে উপবাসে.. যুক্তির বদলে ভক্তিতে বিশ্বাস করেন।

বিভিন্ন শাস্ত্র, লোককাহিনী, পৌরাণিককাহিনী, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, মানুষের কল্পনা ও ভক্তির পথ ধরে আজকের ধর্ম যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখানে আচার-বিচার-সংস্কারই প্রধান। শাশ্বত ধর্মের বৃহত্তর মান্যতায় এই সংস্কার ও আচার-বিচারের সঙ্গে চিত্তশুদ্ধির কোন যোগ নেই। 

সমস্ত ধর্মের মধ্যে মিল একজায়গায়। ক্ষমা, করুণা। হৃদয়ের এক গভীর অনুভূতি যা মুক্ত স্বচ্ছ নির্মল ও প্রসাদিত। অধ্যাত্মবোধ ধর্মের মূলকথা। নাস্তিকতা বা ঈশ্বরবাদ ধর্মের সারবস্তু নয়। যথার্থ অধ্যাত্মবোধ মানুষকে আনন্দ দেয়, ক্ষুদ্রতা ভুলিয়ে দেয়, দেহবদ্ধতা দূর করে। মানুষের চেতনাতেই ধরা পড়ে অরূপের রূপ। সেই পরম সত্য।

যে সংস্কার আজকের মানুষের ধর্মবোধ ও অধ্যাত্মবোধের সঙ্গে জড়িত, তার প্রকৃত স্বরূপ খুঁজে বার করা আজকের মানুষের অতি আবশ্যক কর্তব্য। 



সাধারণভাবে 'সংস্কার' শব্দটি বলতে বোঝায় সমাজ বা কালের সঙ্গে অসংলগ্ন কোন বিষয়ের পুনর্নবীকরণ। সম-পূর্বক কৃ ধাতুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রত্যয়যোগে 'সংস্কৃত', 'সংস্কৃতি', 'সংস্কার' ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি, তৎসত্ত্বেও অর্থগত দিক দিয়ে প্রতিটি শব্দ ভিন্ন। 

ঋগ্বেদিক যুগের মন্ত্রে 'সংস্কৃত' শব্দটির ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, বৈদিক মন্ত্রপাঠ করে কোনও বস্তুকে বৈদিক কর্মের জন্য সংস্কৃত করে তোলা হত। সোমরসে পূর্ণ পাত্র, যাকে 'ঘর্ম' বলা হত, সেটি যজ্ঞের আগে 'সংস্কৃত' করা অতি প্রয়োজনীয় ছিল। পূর্বমীমাংসা দর্শনের জৈমিনি-সূত্রে 'সংস্কার' শব্দের ব্যাখ্যায় 'সম্মার্জন-সংস্কার' একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সেইসময় যজ্ঞপাত্রগুলি, যেমন 'গ্রহ', 'চমস' ইত্যাদি পরিস্কার করে ধুয়ে-মুছে নেবার ক্রিয়াকে 'সংস্কার' বলা হয়েছে।



সংস্কার বলতে ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গ এসে পড়ে। 'জন্মজন্মান্তরের সংস্কার' কথাটি হামেশাই ব্যবহার হয়। দার্শনিক দৃষ্টিতে স্থূল শরীর আমাদের অস্তিত্বের মাত্র দশ শতাংশ। অশরীরী সূক্ষ শরীর ('Aura' শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত) মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংবোধ দিয়ে তৈরী বাকী নব্বই শতাংশ। 

এই সূক্ষদেহী সংস্কার পুনর্জন্মকালে সঞ্চারিত হয় মানবশরীরে, ভারতীয় দার্শনিকদের এমন বিশ্বাস। এই সংস্কারের জন্য জ্ঞানের পরিভাষা মীমাংসা-দর্শনের প্রবক্তারা এবং শঙ্করাচার্য দিয়েছিলেন এইভাবে, ‘সংস্কারের মাধ্যমে একটি বস্তু বৃহত্তর প্রয়োজনের যোগ্য হয়ে ওঠে।’

দুর্ভাগ্য আমাদের, যজ্ঞ ও ধার্মিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে সংস্কারের যে তাৎপর্য বৈদিক যুগে প্রচলিত হয়, সেই তাৎপর্য সম্পূর্ণ অন্য অর্থে প্রবাহিত হতে থাকল একটি গোটা সমাজজীবনে। আজও যতই যুক্তিবোধ ও সচেতনতা থাকুক, অন্নপ্রাশন-বিবাহ-শ্রাদ্ধ এইরকম কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার মেনে চলা হয়। 

সংস্কার। সংস্কৃতি নয়। ভাবনার ভিতটাই নড়বড়ে। মূল ভাবনাটা হারিয়ে অর্থহীন কিছু সংস্কার আশ্রয় করে বাঁচা। 

ধর্মীয় তাৎপর্য যদি কেউ না-ও মানেন, সামাজিক উৎসবের মত পালন করতে কেউই আপত্তি করেন না। কিন্তু আদিকালের সমাজের ভাবনা, আচার ও রীতিনীতিপদ্ধতি পালন করলেও সংস্কারগত তাৎপর্য আমরা যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রশ্ন তুলি না। 



জন্মসূত্রে আমরা একটি ধর্মের উত্তরাধিকারী হই। শিশুমনের অবোধ সময় থেকে সেই বিশেষ ধর্ম নিয়ে আমাদের সচেতন হবার শিক্ষা দেওয়া হয়। কি সেই শিক্ষা? ভগবান কিংবা গড বা আল্লাহ। উপবাস, অঞ্জলি, পুজো, ধর্ম, আচার-বিচার-সংস্কার। মন্দির মসজিদ চার্চ গুরুদোয়ারা। বহুবিধ সামগ্রী, আয়োজন, অনুষ্ঠান, মন্ত্র-পাঠ। পুজো করার চেয়েও পুজো করতেই হবে – এই আবেগ শিক্ষা। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যে মানুষের মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ হইয়াছে, যে মানুষের মধ্যে আত্মচৈতন্য জাগ্রত হইয়াছে, সে-ই সংস্কৃতিবান।’



যিশু বলেছিলেন, ‘আমি ও আমার পরমপিতা একই।’হিন্দুধর্মে মূল কথা তাই। ‘সোহহম’। ইসলামের মূল কথাটাও তাই। ‘আমি ও আমার ঈশ্বর।’সেই একই কথা। ‘সোহহম’। বড্ড গভীর কথা। 

বিবিধ ধর্ম, বিবিধ মত। উদ্দেশ্য একটাই। মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখা, চেতনাকে জাগিয়ে রাখা। কিন্তু ধর্ম ও সংস্কৃতির কোন প্রবহমান রূপকে দেখি আমরা? 



হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক অনন্য সভ্যতা, যা ভারতের গৌরবময় উজ্জ্বল অতীতকে তুলে ধরে। ব্যাপকভাবে গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনীয়ারিং-এর প্রয়োগ ভারতের প্রাক-আর্য গরিমা প্রচার করে। হরপ্পা-সংস্কৃতি আজও হিন্দুধর্ম ও সংস্কারে প্রবাহিত। 

ইতিহাস বলে সেই সময়ের কথা, যখন আর্য এবং অনার্য সংস্কৃতির অবস্থান বিপরীত মেরুতে। সেই সময়ের কথা, যখন প্রথমে জৈন এবং পরে বৌদ্ধধর্ম তৎকালীন হিন্দুধর্মকে প্রায় গ্রাস করেছে। উল্লেখ্য এই, যে বুদ্ধ ঈশ্বরবাদকে ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন না। প্রাচ্যে চার্বাকও ছিলেন নাস্তিক। 

এই উদারনীতি মানুষের ধর্ম হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। সেই সময় বিবর্তিত হিন্দুধর্ম এক সঙ্কর সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আর্য, অনার্য এবং দ্রাবিড় বিশ্বাসের ওপর স্থাপিত হল সেই নতুন ধর্ম।



চারটি বেদ -- ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ। ব্রাহ্মণ্য-আরণ্যক, উপনিষদ, ১৮টি পুরাণ, ৬টি বেদাঙ্গ, উপবেদ, সূত্র (ধর্মসূত্র, গৃহ্যসূত্র ইত্যাদি)। দুটি ধর্মগ্রন্থ -- রামায়ণ ও মহাভারত। পাণিনির অষ্টাধ্যায় এবং মনুস্মৃতি। এই হল ধর্ম ও সংস্কার সম্পর্কে আমাদের ঐতিহাসিক পাঠের সূত্র। 

বৈদিক যুগে সংস্কারের সংখ্যা ছিল চল্লিশ। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সংস্কারের সংখ্যা কমতে থাকে। মনু লিখেছেন এক ব্যক্তিজীবনে বারোটি সংস্কার : 

(১) গর্ভাধান (২) পুংসবন (৩) সীমন্তোন্নয়ন (৪) জাতকর্ম (৫) নামকরণ (৬) নিষ্ক্রমণ (৭) অন্নপ্রাশন (৮) চূড়াকরণ (৯) উপনয়ন (১০) সমাবর্তন (১১) বিবাহ (১২) শ্মশানক্রিয়া বা শ্রাদ্ধ



গর্ভাধান

বহিরাগত আর্যরা ছিলেন যুদ্ধপ্রিয়। যুদ্ধে প্রয়োজন প্রচুর পুরুষ। তাই ঋগ্বেদের অনেক মন্ত্রে পুত্রকামনা ব্যক্ত হয়েছে। পুত্রলাভের অভিলাষে গর্ভাধান সংস্কারে পরিণত হল। দৈবতত্ত্বে বিশ্বাসী হলেও আর্যরা বিজ্ঞানকে নস্যাৎ করেন নি। গর্ভাধানের ক্ষেত্রে শারীরিক মিলন, ঋতুচক্রের ষোলদিনের মধ্যে গর্ভাধানের অনুষ্ঠানের নিয়মের কথা ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ এবং বৃহদারণ্যকে পাওয়া যায়। 



পুংসবন

পুত্রসন্তান প্রসবের জন্য পালনীয় নিয়মবিধি। খুব ভাল করে এই বিধির মন্ত্রগুলো পড়লে বোঝা যায় যে, পুত্রসন্তান লাভের উদ্দেশ্যে এই সংস্কার হলেও আর একটি বিশেষ ভাবনা ছিল। কোনমতেই গর্ভপাত যেন না হয়। 



সীমন্তোন্নয়ন

প্রতিটি বিধানই গর্ভিণী নারীর উদ্দেশে, ধর্মীয় নির্দেশের মন্ত্রে। প্রাচীনকালেও মানুষ বিশ্বাস করতেন গর্ভিণীর শান্ত ও প্রসন্ন মনই উত্তম সন্তানের জন্ম দেয়।



জাতকর্ম

সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুখে ঘি দেওয়া ও তারপর মাতৃস্তন্যপানের সংস্কার। মাতাকে অভিনন্দন ও প্রশংসা জানানো এই মন্ত্রগুলির আর একটি দিক।



নামকরণ

সন্তানের জন্মক্ষণেই একটি গুপ্তনাম দেওয়া হত। তারপর দশ-এগারো দিনের মাথায় নামকরণের সংস্কার পালন হত।



নিষ্ক্রমণ

শিশুকে প্রথম বাইরে নিয়ে আসার সংস্কার। পিতা সেদিন শিশুকে কোলে করে সূর্য দেখাতেন। মাতার অশৌচবিধিও শেষ হত এই দিন।



অন্নপ্রাশন

বৈজ্ঞানিক কারণেই এই সংস্কার আজও প্রচলিত। অন্নের প্রকৃষ্ট ভোজন (প্রাশন)। এককথায় ভাত খাওয়ানোর সংস্কার। প্রাচীন বৈদ্য সুশ্রুত লিখেছেন, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য তার ছয় মাস বয়সে উপযুক্ত সহজপাচ্য অন্য খাবার দিতে হবে।



চুড়াকরণ

মাথার ওপর চূড়ার মত উঁচু করে চুল (টিকি) রাখার সংস্কার। মাথা ন্যাড়া করার শারীরিক প্রয়োজনীয়তা থেকে এর উৎপত্তি। সুশ্রুতের মতে, মাথার পেছনে এক জায়গায় কতগুলো শিরার মিলনস্থল আছে, নাম অধিপতি। এইখানে হঠাৎ আঘাত লাগলে মৃত্যু নিশ্চিত। তাই চূড়াকরণ বিধির ছলে এই নিয়ম।



উপনয়ন

উপনয়ন শব্দটির উৎপত্তি নী-ধাতু থেকে, অর্থ 'নিয়ে যাওয়া'। 'উপ' অর্থাৎ কাছে। গুরুর কাছে শিক্ষার জন্য নিয়ে যাবার প্রথাই উপনয়নের সংস্কার। এই সময় গায়ত্রীমন্ত্র পাঠ ব্রহ্মবিদ্যার মাহাত্ম্য বোঝাতে ব্যবহার হত। পরবর্তীকালে এই উপনয়নপ্রথা আচার-বিচারে পূর্ণ এক ধর্মীয় সংস্কারে পরিণত হয়েছে। ঊপনয়নের ফলে ব্রাহ্মণ জ্ঞানী হয়ে দ্বিতীয়বার জন্মলাভ করে। তাই 'দ্বিজ' বলা হয়। 

গুরু ব্রহ্মচারীর ডান হাত ধরে নিজ হৃদয়ে গর্ভের মত ধারণ করেন। তাই তার নতুন জন্ম। ব্রাহ্মণ জন্ম। তিনদিনের গৃহগর্ভবাস এখন ধর্মীয় প্রথা, আর কিছুই নয়। ছাত্রাবস্থায় কিছু নিয়ম ও শৃঙ্খলা পালনীয় ছিল। কৃচ্ছ্রসাধন, শৃঙ্খলা ও পরিশ্রম। এই তিনটি নিয়ম উপনয়নের সঙ্গে জড়িত ছিল। আজ শুভ দিনক্ষণ বিচার, গায়ত্রীমন্ত্রজপ, হোম, ব্রতপালন.. এগুলো-ই ব্রহ্মচারীর প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।



সমাবর্তন

উপনয়নের পর গুরুকুলবাসের সময় ছিল বারো বছর। আঠারো/কুড়ি বছর বয়স হলে স্নাতক। তখন তার সমাবর্তন হত। সমাবর্তনের পর গৃহে ফেরার অনুমতি পেতেন বিদ্যালব্ধ ব্যক্তি।



বিবাহ

সিন্ধুসভ্যতার সময় থেকেই বিবাহ সামাজিক প্রথা হলেও বৈদিক যুগে বিবাহপ্রথা সংস্কার হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহের অধিকার হত স্নাতক হবার পর। ঋগ্বেদের যুগে গার্হস্থ্য আশ্রমে যজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য স্ত্রীর উপস্থিতি অনিবার্য ছিল। 

আজ শুধু বিবাহের দিনে একত্রে হোম-যজ্ঞ সম্পন্ন করার ধর্মীয় সংস্কারে পরিণত এই বিধি। আদিকালে মনে করা হত যে বিবাহের অর্থ পুরুষের জীবনে সমস্ত কর্মের মধ্যে স্ত্রীর সহ-ভাব। ধর্মপালনে, সমস্ত কর্ম এবং সন্তান উৎপাদন ও পালনেও। আজ বিবাহের এই অর্থ কজন মনে রাখেন? 



শ্রাদ্ধ

পুরো বিধিটিই বৈজ্ঞানিক কারণে। অগ্নির ব্যবহার ও স্নান স্বাস্থ্যের কারণে। মাথা ন্যাড়া করা চুলের সংস্কার। অশৌচ সময়ে জীবিত মানুষের দেহ ও মনকে শুদ্ধ করে তোলাটাই উদ্দেশ্য ছিল।



কিন্তু সংস্কারের তাৎপর্য যদি তিনহাজার বছর আগের মন্ত্র পড়া, মন্ত্র-পুরোহিত যোগে অন্নপ্রাশন, দিনক্ষণ দেখে উপনয়ন, জাতপাত মিলিয়ে বিবাহ, মস্তক-মুন্ডন করে শ্রাদ্ধে এসে দাঁড়ায়, তবে সংস্কারের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়। একটি বিশেষ সমাজ-চেতনা নিয়ে সংস্কার তৈরী হয়েছিল। 

ইতিহাস প্রমাণ করে, যে দেশে শাসক শক্তির যেমন ধর্মবিশ্বাস, ধর্ম ও আচারবিধির তেমন তেমন রূপান্তর হয়েছে বারবার। প্রাচীন মানুষের প্রকৃতির নিয়মে ভয়, অস্তিত্বের সঙ্কট, বর্ণাশ্রমজনিত শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপালাভের ইচ্ছা, যাগযজ্ঞ থেকে ধর্মীয় যে সংস্কারের শুরু, প্রাদেশিকতার প্রশ্নে কিন্তু তাতেও পার্থক্য অনেক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সংস্কারের প্রচলন ও পালনের ভিন্ন রূপ। এর সঙ্গে ধর্ম ও আত্ম-উত্তরণের সংযোগ কোথায়?

এটাও সত্য যে, ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতা নষ্ট হয়। শীতলাপুজো, মনসাপুজো, অতি সম্প্রতি সন্তোষীমাতার পুজো -- এই তো সমাজের প্রথা এখন। প্রশ্ন এই যে, আজও তবে এই ধর্মীয় সংস্কারের মূল্য কতখানি?



আজ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসে মানবসভ্যতার মূলকথা হওয়া উচিত --- এই সুখদুঃখে মেশা আশ্চর্য জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, অহংকে মুক্ত করে মৈত্রী ও শান্তির অন্বেষণ এবং মূল্যবোধ ও আত্মদর্শনকে পাথেয় করে আত্ম-উত্তরণ। গভীর অনুভব, গভীরতর বিশ্লেষণ, ততোধিক গভীর সুশৃঙ্খল ভাবনা । ধর্ম নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে, সংস্কার নিয়ে নতুন আলোর বোধ। 

ধর্ম-সংস্কার কোনো আচার অনুষ্ঠান নয়। ধর্ম এক নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, যা আমাদের দেখতে শেখায়, ভাবতে শেখায় । অনেকখানি আত্মশক্তি, অনেকখানি আত্মবিশ্বাস, যথা-অর্থে শিক্ষার আলো। সমর্পণ। তবেই আত্মশুদ্ধি। তবেই আত্মনির্মাণ। ‘আত্মদীপো ভব।‘ বড্ড গভীর কথা।

আত্ম-স্বীকৃতি আর আত্ম-আসক্তি। এই দুই শব্দে একটা সূক্ষ পার্থক্য। একটা নিজেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে, আরেকটা নিজেকে দিশাহীন করে রাখার জন্যে। পরিণত বিশ্লেষণ, সহিষ্ণু ব্যতিক্রমী আলোচনা, জীবনকে দেখার মনোরম বোধ, যাপনের প্রতি নিষ্ঠা এক নতুন দর্শনকে সাবলীল করে। যে দর্শনের উত্তরাধিকার পেয়েছি আমরা, নানা লেখার মধ্যে। সাহিত্য, গান, বৌদ্ধিক চর্চায়। 

আচার-বিচার-সংস্কার মানুষের পক্ষে বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নয়। মানুষের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত মানবধর্ম, মানবপ্রেম যার মূলকথা। আত্মশক্তির বিকাশ আর মুক্ত অন্তঃকরণের এক পবিত্রতাবোধ। এই আজকের মানুষের সংস্কার হওয়া উচিত।

...........................

তথ্যসুত্রঃ 

১) স্কন্দপুরাণম ২) উপনিষদ ৩) Glimpses of History -- Mr. Xavier Pinto



৪) Indian History -- Dr. Sagarika Mukherjee ৫) আচার-বিচার-সংস্কার -- শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ৬) প্রবন্ধ সংগ্রহ -- শ্রী শিবনারায়ণ রায়

0 comments: