প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
উত্তরাপথের পথে - ৫ম পর্ব
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
উৎসবমুখর গো-বাথান প্রাঙ্গণ জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কেবলমাত্র রন্ধনশালার কাছে অয়স-নির্মিত বিশাল উদুখল-মুষলে একজন গোপালকের শুকনো মরিচ গুঁড়ো করারধাতব ঠং ঠং শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
দক্ষ লাঠিয়াল ধানুক সৈরিকদের নিয়ে বাথানের অনেকটা আগে দুর্বৃত্তদের আগমন পথের দুপাশে গোধূমক্ষেত্রের মধ্যে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে ঢুকে নিশ্চল কিন্তু সজাগ হয়ে আত্মগোপন করে আছে। শবর, কিরাত আর বাথানের অন্যান্য সমর্থ পুরুষদের একাংশ বাথান-প্রাঙ্গণের ঘন পত্রাচ্ছাদিতবৃক্ষশাখার অন্তরালে নিঃশব্দে আত্মগোপন করে আছে। হাতিয়ার বলতে শবরদের নিত্যসঙ্গী তির-ধনুক ও ধারালো অসিপুত্রী ছাড়া তারা যতটা সম্ভব প্রস্তরখণ্ড সঙ্গে রেখেছে। মাধ্বী বিতরণকারী বিশালদেহী কৃষ্ণকায় অনার্য বয়স্ক পুরুষটি মাংস ও অন্যান্য খাদ্য সম্ভারগুলির পাশে বসে নেশাতুরের মত ঝিমোচ্ছে; অথচ সে বিন্দুমাত্র মাধ্বী বা সীধু, পৈষ্টী কিছুইপান করেনি। তার আশেপাশে জনা দশেক বলবান পুরুষ সিধু বা পৈষ্টী পানরত মত্ত-র ভূমিকায় পাহারায় আছে।রন্ধনকার্যের ভান করে রাঁধুনিরা বিশাল বিশাল পাত্রে জল ভর্তি করে উনানে চাপিয়ে দিয়ে তাদের লোহার ভারি ভারি হাতা-খুন্তি ও জ্বালানির মোটা মোটা কাষ্ঠখণ্ডগুলিকে হাতের কাছে সাজিয়ে আসন্ন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সবার পুরোভাগে আচার্য চিত্রভানু একটি ঘন নিচুলের ঝোপে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছেন।
চিত্রভানু দেখলেন দূরাগত ধূসর ধূলিঝড়টি বাথানের একটু দূরে এসে থেমে গেল। এখান থেকে লোকগুলিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে; সংখ্যায় তারা শতাধিক। তাদের পরণে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের পোশাক, কাঁধে ধনুক আর পিঠে বাঁধা তূণীর ও ভল্লর ত্রিকোণ ফলকগুলি রৌদ্র চকচক করছে। এরা যে ধূমল প্রদেশের সামন্তরাজা দুর্জয়ের আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্ত ঘাতকবাহিনী সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আচার্যদেব লক্ষ্য করলেন আগন্তুকদের পুরোভাগে দৈত্যাকৃতি একজনপুরুষ, সম্ভবতঃ সেই দলপতি, হাতের ইঙ্গিতে পুরো দলটিকে কিছু নির্দেশ দিতেই তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে তিন জন নায়েকের নেতৃত্বে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে বাথানের সীমানার তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সামনের দলটির প্রত্যেকের হাতে ভল্ল, কুঠার, তরবারি। দলপতির নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা মুখে হাড়হিম করা ভয়ঙ্কর হোওওও হোওওও শব্দ করে দ্রুতবেগে বাথানের দিকে এগিয়ে গেল। আচার্য চিত্রভানু এতক্ষণ নিচুল-ঝোপে হাঁটু গেড়ে বসে সব লক্ষ্য করছিলেন। দুর্বৃত্তদলটি তখন মাত্র তিনশত অরত্নি দূরে এসে গেলেও আচার্য চিত্রভানু মুহূর্তকাল অপচয় না করে নির্ভিকচিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর তপ্ত-কাঞ্চনবর্ণ দীর্ঘ শরীর, দুই পাশের স্কন্ধের উপর আজানু লুটিয়ে থাকা শুভ্র উত্তরীয়, পশ্চাদ্ভাগে পুরুষ্টু শিখাসমৃদ্ধ ক্ষৌরি-মস্তক দূর থেকেও স্পষ্ট দৃশ্যমান হল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তাঁর দক্ষিণহস্ত উত্তোলন করলেন। অদূরে গোধূমক্ষেত্রে সৈরিকদের নিয়ে সরীসৃপের মত শায়িত সজাগচক্ষু ধানুক আচার্যদেবের আন্দোলিত হস্তের ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র নিম্নকন্ঠে সহযোদ্ধা সৈরিকদের কিছু নির্দেশ দিল।
চিত্রভানুকে নিরস্ত্র দেখে লুন্ঠক দলের দলপতি থমকে দাঁড়ালো। দলটিকে এগিয়ে যাবার ইশারা করে একাই একটি ধারালো কুঠার হাতে বন্য মহিষের মত গর্জন করে শষ্যক্ষেত্র মাড়িয়ে চিত্রভানুর দিকে ছুটে এলো। তিনি কাঁধ থেকে উত্তরীয়টি খুলে দুহাতে ধরে পিছনের পায়ে ভর রেখে লোকটির দিকে অকম্পিত চিত্তে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসলেন। এই অসম সংঘর্ষের প্রস্তুতি পর্বে তিনিই সঙ্গীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সাধারণ ভাবে যা অস্ত্র নয় তাকে অস্ত্রে পরিণত করে আত্মরক্ষা করতে। নিচুলের ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকার সময়টুকুতেই তিনি স্কন্ধের লম্বমান উত্তরীয়র দুই প্রান্তে বেশ কিছু প্রস্তরখণ্ড বেঁধে নিয়েছেন। দলপতি উন্মত্তের মত ছুটে তাঁর কাছাকাছি আসামাত্র তিনি ডান হাত ঘুরিয়ে উত্তরীয়র প্রস্তরখণ্ড বাঁধা প্রান্তটি দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন তার মুখে। এমন অকস্মাৎ আঘাতে লোকটির হাত থেকে কুঠার পড়ে গেল ও সে ভূমিসাৎ হল। প্রাথমিক আঘাত সামলে দলপতি উঠে দাঁড়তে গেলে চিত্রভানু উপর্যুপরি কয়েকবার একই ভাবে আঘাত করলেন। লোকটি ভীষণভাবে আহত ও হতচেতন হয়ে ভূমিশয্যা নিল।
ওদিকে প্রথম দলটি গোধূমক্ষেত্রের আলপথ ধরে বিকট চীৎকার করতে করতে বাথানের দিকে এগিয়ে চলেছে। তারা কোনদিকে দৃকপাত না করে ধানুকদের কিছুটা দূর দিয়ে তাদের অতিক্রম করে যেতেই ধানুক তার সঙ্গীদের নিয়ে শস্যক্ষেত্রের মাঝে বংশ ও বেত্রদণ্ড হাতে উদ্ধতফণা আশীবিষের মতই মাথা তুলে দাঁড়ালো এবং নিমেষপাতের মধ্যে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই রকম আকস্মিক আঘাতের জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত না থাকায় বলশালী সৈরিকদের দণ্ডাঘাতে একে একে ধরাশায়ী হতে লাগলো। ধানুক একাই তার প্রিয় সঙ্গী তৈলচিক্কণ বেত্রদণ্ডটির সাহায্যে একসঙ্গে সাত-আট জন শত্রুর মহড়া নিচ্ছে। তার দণ্ডাঘাতে কয়েকজন আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় ভূমিসাৎ হল। বাকিরা “যঃ পলায়তি, সঃ জীবতি” উপায়ে উর্দ্ধশ্বাসে রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করল। যে কোন যুদ্ধেই ধাবমান সৈন্যবাহিনী পাশ ও পিছন থেকে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আচার্য চিত্রভানুর নির্দেশে ধানুক ও তার সহযোদ্ধারা এই পন্থাটি অবলম্বন করে সহজেই দুর্বৃত্তদের পর্যুদস্ত করে ফেলল।
গোপালকদের দলপতি শ্রীনিবাসের উপর গোধন রক্ষার ভার ন্যস্ত। সে ও গোপালকরা বাথানের সব দুগ্ধবতী গাভী, ষণ্ড, বলদ, বকনা ও শিশু গোবৎসগুলিকে গোশালার ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে বাইরের প্রাঙ্গণে পাহারায় রত; প্রত্যেকের হাতেই যষ্টি ও মুদ্গর। তারা দূর থেকে সৈরিকদের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ লড়াই-এর দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত থাকায় কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক। ধানুক ও সৈরিকবাহিনীর লড়াই দেখে তারা এতই উচ্ছসিত হয়ে পড়েছিল যে ঘণায়মান বিপদের কথা জানতেই পারেনি।
বাথানের গোশালার ঠিক পিছনে একটি ছোট তরাগ। তার চতুস্পার্শ্ব ঘিরে নানা পত্রবহুল বৃক্ষের মাঝখান দিয়ে গোপালক ও রাখালদের পায়ে চলা সংকীর্ণ পথ রেখা; ঘন পত্রচ্ছায়ায় স্থানটি দিনের বেলাতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেই পথ দিয়ে বৃক্ষান্তরালে নিজেদের প্রচ্ছন্ন রেখে কখন যে লুন্ঠকদের দ্বিতীয় দলটি চুপিসারে গোশালার কাছে পৌঁছে গিয়েছে কেউই তা বুঝতে পারেনি। যখন সম্বিৎ ফিরল তখন অস্ত্রসজ্জিত আগন্তুক দলটি নিঃশব্দে গোশালার আনাচে কানাচে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অপারঙ্গম নিরীহ গোপালকদের অর্ধচক্রাকারে ঘিরে ফেলেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা অস্ত্রমুখে গোপালক ও রাখালদের নিরস্ত্র করে তাদেরই লাঠি দিয়ে বিষম প্রহার করতে করতে বাথান-অঙ্গনের মাঝখানে পত্রাচ্ছাদিত বৃক্ষগুলির নীচে নিয়ে এল।
একই সময়ে তৃতীয় দলটি কোষমুক্ত তরবারি ও ধারালো ভল্ল হাতে সম্মুখের দীর্ঘিকার পাশ দিয়ে মূল প্রাঙ্গণে অনুপ্রবেশ করে একটু থমকে গেল। উৎসবের আঙ্গিনায় যে যার নিজের কাজে রত, সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক। তারা দু-তিন জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে অস্ত্র উদ্যত করে এগিয়ে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল কারো মুখে-চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, চতুর্দিকে এত কাণ্ড হয়ে চলেছে, কিন্তু তারা যেন একেবারেই নির্বিকার!
সমস্ত উৎসবাঙ্গণটি এখন বহিঃশত্রু কবলিত, তারা নৃশংস, এবং অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ।
কিন্তু --- “অল্পানামপি বস্তুনাং সংহতিঃ কার্যসাধিকা।
তৃণৈর্গুণত্বমাপন্নৈ বর্ধ্যন্তে মত্তদন্তিনঃ।।”
(অল্প বা ক্ষুদ্র বস্তুও ঐক্যবদ্ধ হলে কার্যসাধনে সক্ষম হয়। ঘাসের তৈরি দড়ি দিয়ে মত্ত হাতিকেও বেঁধে রাখা যায়।)
এক্ষেত্রেও সেই আপ্তবাক্যটিরই প্রতিফলন ঘটল।
আচার্য চিত্রভানু যখন দূর থেকে শত্রুদ্বারা আক্রান্ত হতে চলেছেন অনুমান করে একজন বিচক্ষণ গোষ্ঠীপতির মতই প্রীতিকূটের আবালবৃদ্ধ নরনারীর প্রতিরক্ষার জন্য ধানুক, শ্রীনিবাস প্রভৃতি ও তাঁর বয়স্যদের সঙ্গে রণকৌশলের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, তখন থেকেই তাঁর কিশোর পুত্র বান ও তার কয়েকজন সঙ্গীকে আর আশেপাশে কেঊ দেখেনি। বস্তুতঃ সেই পরিস্থিতে অনাগত বিপদের সম্ভাবনায় সকলে এতই চিন্তিত ও ব্যস্ত ছিল যে, কেউই বিশেষভাবে কারো খোঁজ রাখার মত মানসিক অবস্থায় ছিলনা। পিতার মুখে প্রীতিকূটের বাথান সামন্তরাজার প্রেরিত দুর্বৃত্তদের হাতে আক্রান্ত হতে চলেছে শুনে সে তার সঙ্গীদের নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ক্রীড়াকৌতুকের সময় তারা বাথান-প্রাঙ্গনের মাঝখানে একটি সুবৃহৎ রসাল বৃক্ষেরজ্জু ও কাষ্ঠখণ্ড দিয়েদোলনাঝুলিয়েছিল, সেই বৃক্ষে আরোহণ করে পত্রঘন শাখার অন্তরালে নিশ্চুপ হয়ে বসে নীচে ঘটমান দৃশ্যগুলি অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিল। বৃক্ষশাখায় চড়ার সময় বুদ্ধি করে ঝুলন্ত ঝুলনটিকেও উপরে টেনে নিয়েছিল।
লুন্ঠক দলের এক নায়েক তার সঙ্গীদের অস্ত্রভয়ে ভীত নজরবন্দী গ্রামবাসীদের আর অত্যাচার বা বধ করার নির্দেশ দিতে যাচ্ছে, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত বানের পোক্ত কাষ্ঠের ঝুলনটি অন্তরীক্ষ হতে সজোরে তার মাথার পিছনে আঘাত হানল। বৃক্ষশাখায় এতক্ষণ অপেক্ষারত শবররা যেন এই ইঙ্গিতেরই প্রতীক্ষা করছিল! আচম্বিত আঘাতে নায়েককে লুটিয়ে পড়তে দেখে শত্রুসৈন্য হতচকিত হয়ে উর্দ্ধমুখে দৃষ্টিপাত করার আগেই পাদপশ্রেণীর ঘন পল্লবের আড়াল থেকে শবরদের নিক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ তির ও প্রস্তরখণ্ড উল্কাবৃষ্টির মত তাদের দিকে নির্ভুল লক্ষ্যে ধেয়ে আসতে লাগল।
নীচে এতক্ষণ যারা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রন্ধন বা অন্যান্য কর্মে লিপ্ত থাকার ভান করে নির্বিকার ছিল, বা সিধু-পৈষ্টী পানরত মত্ত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে রন্ধনের ভারী ভারী হাতা-খুন্তি বা জ্বালানির মোটা মোটা কাষ্ঠখণ্ডগুলি হাতে তুলে নিয়ে প্রবল শক্তিতে শত্রুদলের মুখোমুখি হল। হঠাৎ লুন্ঠকদের গায়ে কটাহ ভর্তি ফুটন্ত জল এসে পড়ল, বা চোখে-মুখে উদুখল থেকে তীব্রঝাল মরিচের গুঁড়ো এসে পড়ল। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের কাছে থেকে এমন অতর্কিত ও দ্রুত প্রতিআক্রমণ আসতে পারে তা তাদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। ওদিকে শস্যক্ষেত্রে শত্রু বিধ্বস্ত করে ধানুকও তার দলবল নিয়ে বীরবিক্রমে ছুটে এল; দুর্বৃত্তরা নিজেদের অস্ত্র-শস্ত্রের সদ্ব্যবহার করার অবসরমাত্র পেল না।
আচার্য চিত্রভানু বৃক্ষতলের একোটি মৃন্ময় বেদীর উপর দাঁড়িয়ে চীৎকার করে কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করায় শত্রুদল সে যাত্রায় প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হল।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও শেষ রক্ষা হল না।
গো-বাথানের গোশালার পিছনে বিস্তীর্ণ ইক্ষুক্ষেত। এই শরতে গাছগুলি যথেষ্ট পুষ্ট ও লম্বা হয়েছে। চাষীরা শুকনো জমিতে দুই হস্ত পরিমাপ সমদূরত্বে বেশ উঁচু করে আল দিয়ে দশ-বারোটি গাছ একসঙ্গে গোছা গোছা করে ইক্ষুপত্রের রশিতে বেঁধে রেখেছে। ফলে বাইরে থেকে ক্ষেতটি ঘন দেখালেও ভিতরে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি সুষমভাবে সারিবদ্ধ ইক্ষুগুচ্ছের মাঝে গলিপথ রচিত হয়ে আছে। ক্ষেতের অনেকটা ভিতরে ঝুলন্ত পত্রান্তরালে বিনোদ ভট্ট ও আরও কয়েকজন অভিভাবক স্থানীয় পুরুষদের তত্বাবধানে প্রীতিকূটের স্ত্রীলোক ও শিশুরা আত্মগোপন করে আছে; আকস্মিক বিপদে তারা সন্ত্রস্ত, রোরুদ্যমান। একটু দূরে তাদের ঘিরে বিধু ও জনা দশেক বলশালী যুবক পাহারা দিচ্ছে। বাইরের কলরব অস্পষ্টভাবে কানে এলেও কি ঘটে চলেছে তা তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অতি কষ্টে কৌতূহল দমন করে তারা নিরুপায় হয়ে বসে আছে।
সামন্তরাজা দুর্জয়ের কুবুদ্ধির অভাব নেই। বৎসরান্তিক বাথান উৎসবে সমৃদ্ধ জনপদ প্রীতিকুট যে জনশূন্য থাকবে তা তার অজানা নয়। দুর্জয় একদিকে যেমন বাথান উৎসবে অতর্কিতে নিষ্ঠুর নিসূদকবাহিনী পাঠিয়েছে , অন্যদিকে তেমনি প্রায় জনহীন প্রীতিকুটে তার নিজস্ব শতাধিক তুরগারোহী সৈনিককে পাঠিয়ে দিয়েছে। শান্ত জনপদটিতে সে সময় মাত্র কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং মুষ্ঠিমেয় ক্রীতদাস-দাসী ছাড়া বিশেষ কেউ ছিল না। ঘোড়সওয়ারেরা বিনা প্রতিরোধে গ্রামে ঢুকে যথেচ্ছভাবে তাদের পীড়ন ও ভয় প্রদর্শন করে অবাধে লুন্ঠনকার্য শেষ করে গো-বাথানের দিকে ছুটে এলো।
গোশালার পশ্চিম প্রান্তে ইক্ষুক্ষেতটির কাছে এসে তুরঙ্গবাহিনীর দলনায়েক হাত তুলে ইশারায় থামতে বলল। দূর থেকেই তার চোখে পড়েছে বাথানপ্রাঙ্গণে তাদের পদাতিক বাহিনী গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে পর্যুদস্ত হয়ে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করছে। এই সময় সে স্থানে গেলে তাদের অবস্থাও তথৈবচ হতে পারে চিন্তা করে সে তার দলকে নিঃশব্দে ইক্ষুক্ষেতের পিছন দিকে যাবার নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য, কিছু সময় প্রচ্ছন্ন থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সময়োচিত পরিকল্পনা করবে। কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে ইক্ষুপত্রের মর্মরধ্বনির মাঝে তার কানে এল রমণীকন্ঠের রোদনধ্বনি। প্রীতিকূটের আসল সম্পদ যে এই স্থানেই লুক্কায়িত আছে তা বুঝতে তার বিলম্ব হল না। বিশেষ, এই রমণীরত্নের জন্যই সামন্ত প্রভু তাদের প্রেরণ করেছেন যে!
অশ্ব থেকে অবতরন করে দলের একাংশকে চারিদিক ঘিরে ফেলার আদেশ দিয়ে অন্যদের নিয়ে ধূর্ত শৃগালের মত লঘু পদবিক্ষেপে উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে নিশ্চুপে ক্ষেতের ভিতর প্রবেশ করে বৃদ্ধ অভিভাবকদের করায়ত্ত করে যুবতীদের দিকে ছুটে গেল। প্রহরারত যুবকরা এগিয়ে এলেও তাদের দ্বিগুণ সংখ্যার অস্ত্রধারীর সঙ্গে সামান্য লাঠি হাতে সম্মুখসমর বাস্তবিকই অসম্ভব। দুর্জয়ের তুরগবাহিনী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় তিনটি যুবতীকে বলপূর্বক অপহরণ করে অশ্বপৃষ্ঠে ধূমল প্রদেশের রাজধানীর দিকে অশ্ব চালনা করল। তিন যুবতীর মধ্যে একজন আচার্য চিত্রভানুর ভগ্নী মালতি।
দ্রুতধাবমান অশ্বের গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যে কোন মানুষের পক্ষেই দুষ্কর জেনেও কেউ কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জীবন বাজি রেখেও সেই কর্মে ব্রতী হয়। বিধু ও বিহান দুই অনার্য যুবক অশ্বখুরের উত্থিত ধূলির পশ্চাতে প্রাণপণ ছুটতে লাগল।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
বিশাল এই ভারতভূখণ্ড জুড়ে চলছে মাৎস্যন্যায়ের যুগ। অসংখ্য ছোট-বড় রাজ্যের রাজন্যবর্গ ও সামন্ত প্রভুরা নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহে ব্যাপৃত। প্রতিবেশী রাজ্যসম্পদের অধিকারের জন্য যুদ্ধ এবং নানা কূটকৌশল আর অবাধ লাম্পট্য ওসম্ভোগে জীবন কাটানোই ছিল বেশীরভাগ রাজা-মহারাজের একমাত্র কর্তব্য-কর্ম। প্রদেশের রাজা স্বভাবতঃই থাকতেন তাঁর রাজধানী-নগরে, আর তাঁর অধিকৃত রাজ্য ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত করে সামন্ত এবং জমিনদারদের দ্বারা শাসিত হত। রাজা শুধু তাদের সংগৃহীত করের অর্থসম্পদ ও উপঢৌকন পেয়েই খুশি থাকতেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের পালনকর্তা রাজার নামটুকু শোনা ছাড়া আর কোনোভাবেই তাঁর সাক্ষাৎ বা সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পেতো না। সামন্ত রাজারাই ছিল সাধারণ মানুষের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। দেশ জুড়ে এই সব সামন্তপ্রভু ও জমিনদাররা ছোট ছোট অঞ্চলের অধিকর্তা হয়ে যথেচ্ছভাবে প্রজাদের শাসন ও শোষণ করত। পুরুষানুক্রমে আজীবন তাদের হাতে নির্বিচারে শোষিত ও লাঞ্ছিত হওয়াই ছিল সাধারণ মানুষের নিয়তি-লিপি। এক শ্রেণীর রাজা ও সামন্তদের বিকৃত ভোগ-লালসার বলি হওয়াই ছিল রূপ-যৌবনবতী হতভাগিনী নারীর ললাট লিখন।
সুরূপা কুমারী-কন্যার বিবাহের পর পতিগৃহে যাবার আগে সামন্ত বা জমিনদারের অঙ্কশায়িনী হওয়ার জন্য তার পিতাকে স্বহস্তে তাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হত। আর সেই পশুসদৃশ প্রভুরা তাদের বিকৃত কাম-লালসা পরিপূর্ণ করার পর উচ্ছিষ্ট কদলীপত্রের মত কয়েকদিন পরে কন্যাটিকে তার স্বামীর ঘরে প্রেরণ করত। আবার কখনো কোন বিশেষ রুপবতীর ঠাঁই হত অন্তঃপুরের অগণিত রক্ষিতাদের দলে। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে অনেক পিতা বা পতি কিছু রাজানুগ্রহ লাভ করে সম্পদশালী হয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে গর্বিতও হত। এতো ছিল তাদের বিলাস-ব্যসন! প্রজাদের দেয় করে তাদের বিলাস-সম্ভোগের লিপ্সা পরিপূর্ণ হত না। তাই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে তাদের বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ ছিল না। নিজেদের বা পার্শ্ববর্তী রাজ্যের নিরীহ শ্রেষ্ঠী, বনিক ছাড়াও কৃষক এবং শ্রমজীবিদের সম্পদ নির্বিচারে লুন্ঠন করা তাদের কাছে ছিল অতীব শ্লাঘার বিষয়।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
দ্রুত ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে অর্ধচেতন অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে মালতির সুকোমল তনুলতা। বন্ধুর পথে অশ্বটির গতির তালে তালে তার শরীর যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়ছে। অশ্বটির চালক তার দেহের সঙ্গে সামান্য দূরত্ব রেখে মনুষ্য-রূপ যন্ত্রের মতই চালনা করছে সেটিকে। মালতির হাতদুটি পিছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা, মুখ এবং চোখও একটা অত্যন্ত দুর্গন্ধ গাত্রমার্জনী দিয়ে ঢাকা। এমতাবস্থায়ও সে বুঝতে পারছে, এই অশ্বারোহী একা নয়, একাধিক অশ্ব পাশাপাশি ও সামনে-পিছনে ছুটে চলেছে একই গতিতে। ঘোড়সওয়ারদের বিজয়-উল্লাস এবং অশ্বখুরধ্বনির সঙ্গে কয়েকটি নারীকন্ঠের তীব্র আর্তনাদ অস্পষ্ট ভাবে তার কানে আসছে। সে বুঝতে পারল, তার মত আরো কয়েকজন সঙ্গিনীকেও এই দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে চলেছে; কিন্তু কোথায় যে এই দুঃসহ যন্ত্রনাময় যাত্রার সমাপ্তি সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। ----- (ক্রমশ প্রকাশ্য)
0 comments: