ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আমার বারুদ-বেলা (৬)
স্বপন দেব
(দৃষ্টি জনিত অসুখে ভুগছি। ডাক্তারের নির্দেশে বিগত এক মাস ধরে পড়া এবং লেখা, দুটোই কার্যত একেবারে বন্ধ। তাই এবারের ঋতবাক এ আমার বারুদ-বেলার কিস্তি জমা দিতে আমার অক্ষমতার কথা জানিয়েছিলাম ঋতবাক-সম্পাদিকাকে। কিন্তু, সম্পাদিকা সুস্মিতা আর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সৌম্যর একান্ত অনুরোধ ও মিনতি যে, ধারাবাহিক-এর ধারাবাহিকতায় ছেদ পরলে চলবেনা। ‘এ মিনতি এড়ানো কঠিন বড়!’ তাই, অগত্যা……)
চারু মজুমদারের দলিল কে ভিত্তি করে কৃষি বিপ্লবকে সফল করার জন্যে কৃষকদের সশস্ত্র ইউনিট গঠনের আওয়াজ নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ও ফাঁসি দেওয়া এলাকায় কৃষকদের জঙ্গি লড়াই করার সাহস জোগাচ্ছিল। জোতদারের আক্রমণের সমবেত প্রতিরোধ, ধানের গোলা লুঠ, বন্দুক দখল প্রভৃতি কাজকর্ম শুরু হয়েছিল প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই। ‘গ্রামে আমরাই রাজত্ব করব’, ‘সব জমি দখল করে নেব’ ইত্যাদি মনোভাব কৃষকদের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছিল। ৬৬ সালে চা বাগানের ধর্মঘটের সময়েই পুলিশের বিরুদ্ধে তীর ধনুক নিয়ে লড়াইয়ের মেজাজ এসে গিয়েছিল। ৬৬ সালের অক্টোবর মাসে কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল গ্রেফতার হয়ে গেলে, কৃষকেরা নিজেরাই মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সমস্ত জমির ধান কেটে ঘরে তুলে নেব। এই সময় সম্পর্কে পরবর্তীতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম এক নেতা কানু সান্যাল তাঁর ‘More About Naxalbari’ প্রবন্ধে লিখেছেন নির্বাচনের সময়েই দার্জিলিং জেলায় চারু মজুমদারের উপদেশে সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রাজনীতি প্রচার করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে কানু সান্যাল তাঁর ‘More about Naxalbari’ দলিলে তাঁর পুরাতন বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে এই পরিস্থিতির সম্পর্কে লিখেছেন---‘ওই পর্য্যায়ে নকশালবাড়ি এলাকার ক্যাডাররা সংযুক্ত ফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তাতে চারু মজুমদার রাজি না হয়ে বলেন যে, সংযুক্ত ফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলার অর্থ সংশোধনবাদ’। উত্তাল তখন নকশালবাড়ি এলাকা। কোথাও কোথাও নেতৃত্ব পিছিয়ে পড়ছেন কৃষকদের উৎসাহের কাছে। ১৭ই মে চৌপুখুরিয়া অঞ্চলে একটি মিটিং ডাকা হল। চারু মজুমদার শারীরিক কারণে উপস্থিত থাকতে পারলেন না। কয়েকজন নেতৃত্ব প্রস্তাব রাখলেন, জমি দখল বা ধান দখলের সময় অল্প কিছু সংখ্যক কৃষকের কাছে কেবল তীর, বল্লম ইত্যাদি রাখার জন্যে। তৎক্ষণাৎ তার তীব্র বিরোধিতা করলেন এই অঞ্চলের কৃষক নেতা রোপনা রাজগোঁড়----সবার হাতেই অস্ত্র রাখতে হবে। ১৬ই মে শিলিগুড়ি আসলেন মন্ত্রী ও সি পি এম কৃষক সভার নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার। হরেকৃষ্ণ কোঙার একদিকে শুকনা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে কানু সান্যালের সঙ্গে আলোচনা করলেন আর অন্যদিকে নকশালবাড়ি ভূমিসংস্কার অফিসে জোতদারদের বললেন, ‘সত্যি সত্যি যদি খুব অন্যায় মনে করেন (জমি, ধান দখল) তবে নিজেরাই প্রতিরোধ করুন না’! স্থানীয় প্রশাসন ২২ মে, ১৯৬৭ একটি ঘোষণায় এলাকায় তীর ধনুক বহন ও পাঁচজনের জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ( Records of Naxalbari P.S )।
এরপর পরস্পর দুটি বিপরীত দিক থেকে ২৪ ও ২৫ মে ঘটনার ক্রান্তিকাল বিন্দুতে সময় এগোতে লাগল। সেই ক্রান্তিকালের একজন নায়ক রথখোলার ভীমরাম জোতের আদিবাসী কৃষক বিগল কিষানের কথায় --- ‘সমিতি ডাক দিল সব জমি দখলের, ধান দখলের। আমি চাষ করতাম স্থানীয় জোতদার ও বাংলা কংগ্রেসের নেতা ঈশ্বর তিরকির জমিতে। সমিতির ডাকে লাঙল নিয়ে গিয়েছিলাম জমির দখল নিতে। কিন্তু লহরী বুড়ার জমির উপরেই ঈশ্বর তিরকির লোকজন আমায় মারতে লাগল। ওরা মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিল। লাঙল বলদ সব কেড়ে নিল। এর প্রতিবাদে প্রহ্লাদ সিং ওর বউ সোনামতি সিং ও মুজিবরের সংগে কৃষক সমিতির লোকজন মিলে ঘেরাও করে ঈশ্বর তিরকির ঘর’। এইসব অভিযোগেই কৃষক নেতাদের গ্রেফতারের উদ্দেশে, ২৪ মে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের ইনস্পেক্টর সোনাম ওয়াংদিকে সংগে নিয়ে নকশাল্বাড়ি থানার অফিসার এস মুখার্জি, এস আই নারায়ণ চৌধুরী ও বি ভট্টাচার্য সহ সশস্ত্র পুলিশের একটি দল হাতিঘিষার বড়ঝাড়ু জোতে হাজির হয়। পুলিশ রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, প্রশাসনের ধারণা ছিল হরেকৃষ্ণ কোঙার ও কানু সান্যালের মধ্যে বোঝাপড়া অনুযায়ী কৃষক মিলিট্যান্ট রা পুলিশ কে কোনরকম আক্রমণ বা অসহযোগিতা না করে ধরা দেবে ( There would be no resistance as that was the agreement between Sanyal and Kongar )। [নকশালবাড়িতে কৃষক নেতা ও মন্ত্রিদের মধ্যে যে আত্মসমর্পণের চুক্তি হয়েছিল কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে এক জনসভায় (৪ জুন, ১৯৬৭) প্রমোদ দাশগুপ্ত তা জানিয়েছিলেন।] কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটল।বড়ঝাড়ু জোতে পুলিশ দল ঢোকামাত্র স্থানীয় মানুষের চেঁচামেচিতে বুড়াগঞ্জ, আজামাবাদ, সফদোল্লাজোত ও বিজয়নগর চা-বাগান থেকে হাজার খানেক মানুষ বেরিয়ে এসে পুলিশ দলকে ঘেরাও করে ফেলে। উত্তেজনা চলা কালীন হঠাৎ এক যুবকের ছোঁড়া তীর বেঁধে ওয়াংদির বুকে। সংগে সংগে শুরু হয় অন্যদের তীর বর্ষণ। তীরের আঘাতে অন্য দুজন পুলিশ অফিসার ও গুরুতর আহত হয়। পুলিশ তখনকার মত পিছু হটে। ফুসফুসে তিনটি তীর বিদ্ধ সোনাম ওয়াংদি পরেরদিন হাসপাতালে মারা যায়। এই দিনের ঘটনার সাক্ষী, নকশালবাড়ি সংগ্রামের এক নেতা খোকন মজুমদারের কথায়—‘এলাকার মানুষ পুলিশ দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। ভিড় ঠেলে ওয়াংদি অন্য পুলিশ অফিসারদের সংগে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সম্ভবত উদ্দেশ্য ছিল কৃষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলা। এর ই মধ্যে ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ একজন তীর চালিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর আসতে থাকে পুলিশদের লক্ষ্য করে। একজন সাব ইন্সপেক্টর পিছন ফিরে দৌড় লাগান আর একজন আমার পা জড়িয়ে ধরেন। আমি হাত দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করেছিলাম”। নকশালবাড়ি সংগ্রামের সমস্ত নেতাদের ই বক্তব্যে এই তথ্যের মিল থাকলেও ওই দিনের ঘটনার পুলিশ রিপোর্ট কিন্তু একটু অন্যরকম। সে যাই হোক, এই ঘটনার পর থেকেই কিন্তু সমস্ত অঞ্চল জুড়ে উত্তেজনার একটা টান টান ভাব। সশস্ত্র পুলিশ টহল চলতে থাকলো সমস্ত অঞ্চলে। বেঙ্গাইজোতের প্রহ্লাদ সিং আর তার স্ত্রী সোনামতি উদ্যোগ নিয়ে এক মহিলা সভা ডেকেছিলেন, নকশালবাড়ি বাজারের উত্তর পশ্চিম দিকে প্রসাদজোতে। ২৫ মে তারিখে সভা যখন চলছে, তখন হঠাৎ অসম-ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস এর একটা টহলদারি ভ্যান সভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটু দূরে গিয়েই ভ্যানটি দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সশস্ত্র পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে পাশের ঝোপঝাড়ে ‘পজিশন’ নিয়ে সভার দিকে তাক করে হঠাৎ গুলি চালাতে লাগলো। তৎক্ষণাৎ সেখানে ৭ জন মহিলা ও ২ জন শিশুসহ মোট ১১ জন শহিদ হয়ে গেলেন। সোনামতি সিং এর বুকের গুলি বিদ্ধ করল তার পিঠে বাঁধা ছোট্টো আট মাসের শিশুটিকেও। প্রসাদজোতের মাটি লাল হল শহীদের রক্তে। আর সেদিন থেকেই ইতিহাসের পাতায় রক্তের লাল অক্ষরে লেখা হল একটি নাম-----নকশালবাড়ি। এতদিনকার ছড়ানো ছিটানো বিক্ষোভ যেন একটা নতুন মাত্রা পেল। গুণগত পরিবর্তন এল ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের গতিমুখে। কলকাতার ছাত্র-যুবরা দেওয়াল লিখলেন,
‘তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি/ নকশালবাড়ি নকশালবাড়ি’।
সংস্কৃতির জগতেও পূর্ববর্ণিত পথে যে নান্দীমুখ হয়েছিল তার মৃদু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল। নকশালবাড়ির ঘটনার দিনই রাতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাসে বসে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক দিলীপ বাগচী লিখলেন, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষায়, তাঁদের ই কৃষ্টিবাহিত সুরে, ‘ও নকশাল নকশাল নকশালবাড়ির মা,/ ও মা তোর বুগোৎ অক্ত ঝরে,/ সেই অক্ত আঙ্গা নিশান লয়্যা/ বাংলার চাষী জয়ধ্বনি করে’।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রাত্য বলে পরিগণিত ও চির অবহেলিত গ্রামবাংলা এক ঝটকায় চলে এল পাদপ্রদীপের আলোয়। উৎপল দত্ত নকশালবাড়ির পটভূমিতে রচিত তাঁর তীর নাটকের উপাদান সংগ্রহার্থে নকশালবাড়ি ঘোরার পথে এলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংলগ্ন মাঠের জনসভায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গীতে বললেন-----‘একদিকে নকশালবাড়ি আর একদিকে বেশ্যাবাড়ি। বুদ্ধিজীবীদের আজ বেছে নিতে হবে তারা কোন বাড়িতে উঠবেন’। গণসংগীত শিল্পী অজিত পাণ্ডে গাইলেন----‘তরাই কান্দে গো---কান্দে আমার হিয়া, নকশালবাড়ির মা কান্দে, সপ্তকন্যা লাগিয়া’।
তেভাগা আন্দোলনের শহিদ চন্দনপিড়ি গ্রামের অহল্যা কিষাণী যেনি জীবন্ত হয়ে উঠলেন ২৫ শে মে নকশালবাড়ির মাটিতে। শহিদ হলেন ধনেশ্বরী দেবী, সামসরী শৈবানী, গাউদ্রোউ শৈবানী, সোনামতি সিং, ফুলমতি দেবী, সুরুবালা বর্মন, সীমাশ্বরী মল্লিক, নয়নশ্বরী মল্লিক, খরসিং মল্লিক আর দু’জন শিশু। (চলবে )
0 comments: