1

ছোটগল্পঃ ঝর্ণা চট্টোপধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প



সুরবালা
ঝর্ণা চট্টোপধ্যায়



সুরবালা তিনদিন হইল নিরুদ্দেশ। সুরবালার পুত্রগণ, স্বামী মণিভুষণ, দূর সম্পর্কের ভগিনী বিমলা কেহই তাহাকে খুঁজিতে বাকি রাখে নাই। কিন্তু অনেক খুঁজিয়াও সুরবালার সন্ধান কেহ পাইল না। 

সুরবালার নিকট আত্মীয় বলিতে এই ভগিনী ব্যতীত আর কেহ নাই। শিশুকালেই মা-বাপ মরিয়াছে। দূর সম্পর্কের কাকা মনোহর অনাথ শিশুটিকে প্রতিপালন করিয়াছিলেন। যৎকিঞ্চিৎ বিদ্যাদানও করিয়াছিলেন। পরে মণিভূষণের পিতা রেবতীভূষণের সহিত পরিচয় এবং ক্রমে বন্ধুত্বহইলে রেবতীর পুত্র মণিভূষণের সহিত সুরবালার বিবাহ দেন। সুরবালা কেশবতী, সুন্দরী কন্যা।

বিমলা সেই কাকা মনোহরেরই কন্যা। একমাত্র ভগিনীর সহিত সুরবালার বন্ধুত্বপূর্ণ ভালবাসা ছিল। 

গত চল্লিশ বৎসর যাবৎ কদাচিৎ সুরবালা মনোহরের গৃহে কার্য্যোপলক্ষে আসিয়াছেন। ইহা ব্যতীত আপন গৃহের বাইরে পদার্পণ করেন নাই বলিলেই চলে। কোন কোন সময় একটানা দুই বৎসরকাল পর্যন্ত গৃহের বাইরে আসেন নাই, এমন ঘটনাও ঘটিয়াছে। মণিভূষণ সর্বদা নিজেকে লইয়াই ব্যস্ত, অন্যের প্রতি নজর দিবার সময় তাঁহার নাই। স্ত্রীর নিকট সাংসারিক এবং শারীরিক সুখ-সুবিধা পাইতেই তিনি অভ্যস্ত। ইহার বাহিরে আরও কিছু যে আছে, তাঁহারসে বোধ নাই। মণিভূষণ মনে করিয়াছিলেন, স্ত্রীলোকের সংসারের প্রতিকর্তব্য, স্বামী-সন্তানের সুখ-সুবিধার প্রতি দৃষ্টিপাতই জীবনের একমাত্র লক্ষ। ইহাতেই শান্তি, ইহাতেই সুখ। সেই সুখ ও শান্তি থাকিলে গৃহের অভ্যন্তরে সূর্য্যালোক প্রবেশ না করিলেও চলিবে, কারণ স্বামী-সন্তানই স্ত্রীলোকের আলো। সুরবালার পুত্রগণও বাপের মতই হইয়া উঠিয়াছিল। ব্যক্তি বিশেষের জন্য চিন্তা না করিয়াই যদি তাহার নিকট হইতে সকল রকম সুখ-সুবিধা পাওয়া যায়, তবে চিন্তার আবশ্যক কি! 

সুরবালা ক্রমে ক্রমে এই জীবনে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। প্রথম প্রথম কষ্ট হইত। দুঃখ, অভিমান এসব কথা তখনও তাঁহার মনে আসিত। দ্বিপ্রহরে অন্ন ফেলিয়া তাহাতে জল ঢালিয়া উঠিয়া গিয়াছেন, এমন ঘটনাও যে ঘটে নাই,তাহা নয়। ক্রমশঃ মনকে শক্ত করিলেন। ক্রমে ক্রমে এমন এক নিঃস্পৃহতার জগতে প্রবেশ করিলেন, যে সেখান হইতে কেহ তাঁহার নাগাল পাইল না। বাপ এবং পুত্রগণ ইঁহাকে একগুঁয়ে, জেদী স্বভাবের স্ত্রীলোক বলিয়াই জানিল।সুরবালা কাহারও বিরুদ্ধে কোন কথা কহিতেন না, কাহাকেও কোন অভিযোগ করিতেন না। আপন কর্ম নিঃশব্দে করিয়া যাইতেন। স্বামী সন্তানেরাও তাহারা ব্যতীত আর কেহ যে এই পরিবারে বসবাস করেন, তাহা ভুলিল। সুরবালা এক নিঃস্পৃহ, উদাসীন যন্ত্রে পরিণত হইলেন।





(২)

সুরবালার নিখোঁজ হইবার পর প্রায় দশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। গৃহে কেহ আর তাঁহার খোঁজ করেনা। সুরবালা বিহীন সংসার যেমন তেমন করিয়া একপ্রকার চলিয়া আসিতেছিল। কিন্তু মণিভূষণের শারীরিক অবস্থার দিনদিন অবনতি হইতেছিল। পুত্রবধূগন সেবাযত্ন করিলেও তাহাদের নিজের জীবন সম্বন্ধে তাহারা উদাসীন নহে, মণিভূষণেরও তাহাদিগের ব্যবহার পছন্দ নয়। মণিভূষণের রাত্রিদিন অভিযোগ বধূগণের ভালো লাগিবার কথা নহে। ক্রমশঃ বৃদ্ধ মণিভূষণের ব্যবহারে বাটীস্থ সকলে বিরক্ত হইয়াউঠিল।

মণিভূষণ প্রথমে সুরবালার গৃহত্যাগকে পারিবারিক অসম্মান মনে করিয়াছিলেন। এতদিনে সুরবালার নামও উচ্চারণ করেন নাই। পরে ক্রোধান্বিত এবং আরও পরে নিঃসহায় অবস্থায় শয্যাশায়ী হইয়া ঈশ্বরের নিকট সুরবালার প্রত্যাবর্তন কামনা করিতে লাগিলেন। সুরবালা ভিন্ন আর কেহ যে সেইরূপ শুশ্রূষা করিবে না, তাহা বুঝিলেও সুরবালাও যেএতদিনে বৃদ্ধাহইয়াছেন, তাঁহারও বিশ্রাম এবং শুশ্রূষার প্রয়োজন, মণিভূষণের সেকথা একবারও মনে হইল না।

এমত সময়ে এক প্রতিবেশী আসিয়া সুরবালার সংবাদ দিলেন। প্রথমে তাহা কেহই বিশ্বাস করিল না। কিন্তু সুরবালা আসিলে তাঁহার সেবায় সুস্থ হইয়া মণিভূষণ আরো দীর্ঘদিন জীবিত থাকিতে পারিবেন, এই চিন্তা মণিভূষণকে বাধ্য করিল সুরবালার সংবাদ লইতে। প্রতিবেশীর নিকট জানিলেন, সুরবালাকে মণিভূষণের জ্যেষ্ঠ পুত্রের শ্বশুরালয়ের নিকটে মহিলাদের আশ্রমে দেখা গিয়াছে। সুরবালা এতদিন অন্যত্র বাস করিতেছিলেন, কিছুদিন হইল সেথায় তাঁহার আগমন ঘটিয়াছে। সংবাদদাতা যে বৃদ্ধার কথা বলিলেন, শুনিয়া তাঁহাকে সুরবালা বলিয়াই মনে হইতেছে। এক্ষণে মণিভূষণের পুত্রগণ ইচ্ছা করিলে মাতার সংবাদ লইতে পারে। মণিভূষণ সংবাদ পাইবামাত্র ব্যগ্র হইলেন। এতদিন তিনি একপ্রকার সুরবালাকে বিস্মৃত হইয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে তাঁহাকে গৃহে আনিবার জন্য ব্যাকুল হইলেন। পুত্র-পুত্রবধূগন তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইল এবং বৃদ্ধ বয়সে মণিভূষনের পত্নী প্রেম জাগিয়াছে ভাবিয়া ঈষৎ বক্রোক্তি করিল। 

যথাসময়ে মণিভূষণের তাড়নায়, প্রতিবেশীগণের আলোচনায় এবং কৌতূহলজনিত কারণে পুত্রেরা সুরবালার সংবাদ লইতে জ্যেষ্ঠের শ্বশুরালয়ে আসিল। খবর ততদিনে সেখানেও পৌঁছিয়াছে, তাঁহারাও সংবাদ লইয়াছেন। কিন্তু মহিলাটির নাম প্রিয়বালা, সুরবালা নহে। মণিভূষণের পুত্রগণ সেখানকার মহিলা আশ্রমে গিয়া সুরবালার বৃত্তান্ত জানিতে চেষ্টা করিল। আশ্রমের প্রধানার নিকট জানা গেল, যে মহিলাটি আসিয়াছেন, তাঁহার নাম প্রিয়বালাই বটে, কিন্তু পূর্ববৃত্তান্ত জানা নাই, আশ্রমে তাহা জানিবার নিয়মও নাই। ইনি আশ্রমের যাবতীয় সেলাইয়ের কাজকর্ম করেন, একপ্রকার নীরবেই থাকেন। নিজের কাজ ব্যতিরেকে তাঁহাকে বাহিরে বড় একটা দেখা যায় না। অনুসন্ধানকারীদ্বয় ইচ্ছা করিলে মহিলার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারেন। পুত্রেরা তাহা সমর্থন করিলে আশ্রম প্রধানা মহিলাটিকে ভদ্রমহোদয়দের সম্মুখে লইয়া আসিবার জন্য আশ্রমের দরোয়ানকে নির্দেশ দিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পর শুভ্রবসনা,অবগুন্ঠনবতী এক নারী তাহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার মুখ দেখাযায় না। মণিভূষণের পুত্রগণ অনুরোধ করিলেন অবগুন্ঠন সরাইবার জন্য। মহিলা নীরব রহিলেন। তখন পুত্রগণ তাঁহাকে এইরূপ প্রশ্ন করিল---

আপনার বাড়ি কোথায়?

গ্রামের নাম কি?

আপনার কয় পুত্র? 

আপনি কতদিন আগে গৃহত্যাগ করেছিলেন?

আপনার নাম কি?

আপনার সঙ্গে আর কেউ কি ছিলেন, আপনি বাড়ি ছাড়লেন কেন?

কোনদিন কারোর জন্যও কি মনকষ্ট হয়নি?

প্রশ্নগুলি একে একে করা হইল, কিন্তু অবগুন্ঠনবতী একটিও প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, নীরব রহিলেন। তখন মণিভূষণের পুত্রদ্বয় আশ্রম প্রধানাকে মহিলাটির অবগুন্ঠন সরাইয়া দেখাইতে বলিলেন। মুখ না দেখিলে তিনিই যে তাঁহাদের মাতা সুরবালা, তাহা কেমনে চিনিবেন?

যুক্তিযুক্ত কথা। প্রধানা মহিলাটিকে আদেশ করিলেন তাঁহার অবগুন্ঠন সরাইয়া সম্মুখে দাঁড়াইতে। মহিলার আবরণ খসিল। পুত্রদ্বয় শিহরিয়া উঠিল। মুন্ডিত মস্তক, ক্ষত-বিক্ষত মুখ, কেহ যেন ছুরি দিয়া তাহা কাটিয়া ফালা-ফালা করিয়াছে। তাহারা বিস্ময়ে হতবাক হইল। এই কি সুরবালা? ইনিই কি মণিভূষণের স্ত্রী, বিমলার ভগিনী? কেশবতী সুন্দরী সুরবালা কোথায় গেলেন?ইনিই যে সুরবালা, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু সুরবালা কিসের কারণে নিজের প্রতি এইরূপ আচরণ করিয়াছেন, নাকি কোন অসৎ ব্যক্তি এইরূপ করিল? অসৎ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসিলে তাহাকে গৃহে লইয়া যাওয়া সমীচীন নহে। 

দুই ভ্রাতা পরস্পর পরস্পরের প্রতি চাহিয়া আশ্রম প্রধানা কে জানাইল, ইনি তাহাদের মাতা সুরবালা নহেন। সেই নারী একবার তাঁহার স্মিত চক্ষু তাহাদের পানে চাহিয়া মাথা নত করিলেন। পুনরায় অবগুন্ঠনবতী হইয়া আশ্রম প্রধানার নির্দেশে ধীরে ধীরেঅন্দরে প্রবেশ করিলেন।



মণিভূষণের আর সুরবালার নিকট  সেবা পাওয়া হইল না...

1 comment: