0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



১৪২২ বঙ্গাব্দ। বছরের শুরুতেই প্রকাশিত হল আপনাদের স্বকীয় সাহিত্য ভাবনায় সমৃদ্ধ ঋতবাক – প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যা। 

পরম্পরাগত ভাবেই বাঙালী এক আত্মমগ্ন সৃষ্টিশীল জাতি। পিছন ফিরে তাকালেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের সারণি। আশেপাশেও সপ্রতিভ মুখচ্ছবি বিরল নয়। মাত্র ন’মাসে ঋতবাক ঠিক কতটা সফল, তা নির্ধারণের দায় সমালোচকের। কিন্তু দাবীর সঙ্গে একথা অবশ্যই বলা যায়, বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিন জগতে ঋতবাক এখন আর একেবারে অচেনা একটা নাম নয়। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লেখকদের পত্রিকায় লেখা পাঠানোর আগ্রহ এবং প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের লেখা পাঠানোয় উৎসাহের অভাব নেই দেখেই।

এই ক’দিনে ঋতবাক-এর একটি নির্দিষ্ট এবং নিজস্ব চরিত্র তৈরী হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী ভাবেই পাওয়া যায় ঋতবাক ওয়েব ম্যাগাজিন-এর ফেসবুক মুখপাত্র ঋতবাক গ্রুপের দেওয়ালেও। কত সুন্দর সুন্দর কবিতা, গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণকাহিনী প্রতিদিন পোস্ট হচ্ছে – দেখতে দেখতে মন ভরে যায়, পড়তে পড়তে একটা আত্মতৃপ্তি বোধ জাগে। প্রতিদিনই একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ পত্রিকা যেন প্রকাশিত হয় সেখানে। 

প্রসঙ্গত একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ঋতবাক-এর দেওয়ালে যে লেখা পোষ্ট হবে, তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা তর্ক বিতর্ক তুমুল চলুক। কিন্তু আপত্তি তখনই, যখন তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘণ করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, গ্রুপের দেওয়াল কারোর ব্যক্তিগত দেওয়াল নয় সেখানে ব্যক্তিগত রোষ বা ক্রোধবশতঃ বিশেষ কাউকে খোলা দেওয়ালে আক্রমণ করা অমার্জনীয় অপরাধ বলেই গণ্য হয়। ঋতবাক-এর মত একটি রুচিশীল সদস্য সমৃদ্ধ গ্রুপের দেওয়ালে এমনকি দৃশ্যতও তা নিতান্তই যুগপৎ বিসদৃশ এবং অনভিপ্রেত। 

ভবিষ্যতে ঋতবাক নিয়ে অনেক পরিকল্পনা। প্রায় প্রতিদিনই সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের অনুরোধ – ঋতবাক মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হোক। হবে। নিশ্চিত। কিন্তু তার আগে নিজেদেরও বোধ হয় একটু প্রস্তুত করে নেওয়া প্রয়োজন। আগেও বলেছি, ঋতবাক মূলত গদ্যধর্মী একটি মাসিক পত্র। কবিতার জন্য তো ‘এবং একুশ’ আছেই – শুধুমাত্র কবিতারই জন্য। একটি মূলত গদ্যধর্মী মাসিক পত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য লেখার গুণগত মান এবং বিষয় নির্বাচনে বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রাথমিক শর্ত। একটি মাসিক পত্র যতক্ষণ না তার বিষয় ভাবনায় এবং গুণগত মানে রীতিমতো সমৃদ্ধ এবং পরিণত হয়ে উঠছে, ততক্ষণ তার মুদ্রিত সংস্করণের কল্পনাও বাতুলতা। 

এই মাস থেকে শুরু হল – প্রাচীন কথা। একটি নতুন বিভাগ। লিখছেন অমৃত অধিকারী। এখনো পর্যন্ত তিনি একাই। এই বিভাগে আরো উৎসাহী লেখক চাই। বিভাগটিতে মূলত প্রাচীন কালকে ছুঁয়ে থাকার ইচ্ছে। 

ঋতবাক প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যায় আরো থাকছে প্রচ্ছদ নিবন্ধ, শতবর্ষের আলোয় কাননদেবীকে নিয়ে লেখা বিশেষ প্রবন্ধ, তিনটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, বিশেষ প্রতিবেদন, বিশেষ রচনা, তিনটি ভিন্ন স্বাদের ধারাবাহিক, দুটি মুক্তগদ্য, একটি ব্যক্তিগত গদ্য, তিনটি অণুগল্প, চারটি ছোটগল্প, দশটি কবিতা, পথে প্রান্তরে এবং অনুবাদ সাহিত্য বিভাগে একটি গল্প ও একটি কবিতা। 

আপনাদের নিরন্তর সাহচর্য ও স্বকীয় সাহিত্য ভাবনায় ঋদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে ঋতবাক-এর অশেষ সমৃদ্ধি একান্ত কাম্য।

শুভেচ্ছান্তে

সুস্মিতা বসু সিং




0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ কেয়া মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ 



নব আনন্দে জাগো...
কেয়া মুখোপাধ্যায়


মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলে পা। জানলা দিয়ে তাকালে বাইরের শূন্য ডালগুলোর কয়েকটাতে নরম কচি সবুজ পাতা। এখনো সকালে গরম জামা। কোনকোনদিন তাপমাত্রা অনেক নেমে গেলে ওভারকোট। তখন ওই শুকনো ডালগুলোতে আটকে থাকা হীরের কুচি বরফ। রোদ্দুর উঠলে হীরের কুচি চিকমিকিয়ে ওঠে। গলতে থাকে একটু একটু করে। মুক্তোদানার ঝালর তৈরি হয় ডাল জুড়ে। তারপর টুপ করে ঝরে যায় মুক্তোদানাগুলো।জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে তাকাতেই চোখ পড়ল ক্যালেন্ডারের পাতায়। এই দূর প্রবাসে ক্যালেন্ডার হঠাৎ মনে করিয়ে দিল, আর ক’দিনপরেই বাংলা নতুন বছর।

এক লহমায় নস্ট্যালজিয়ার আঁচল ধরে সোজা কলকাতায়। ছোটবেলায়। সেই ছোটবেলায়, যখন মনে মনে ভাবতাম, ‘ছাদের পাশে তুলসি গাছেরটব আছে যেইখানে’, সত্যি সেইখানে রাজার বাড়ি। দিনের বেলা, তার ওপর চারদিকে বড়রা। তাই দেখতে পাচ্ছি না। একদিন সবাই ঘুমিয়েপড়লে চুপি চুপি পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়াব আর অমনি জোছনা ধোয়া আলোয় দেখতে পাব রুপোর দেয়াল, সোনার ছাত, সাদা হাতির দাঁতসিঁড়িগুলো উঠে গেছে ওই ওপরে।

সেই ছোটবেলায় নতুন বছরের প্রথম দিন। বিছানা ছাড়ার আগেই ভেসে আসত গানের কলি। রেডিওতে ‘নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে...’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়। আর সেই গানের রেশ নিয়ে জীর্ণ পুরাতন সব ভাসিয়ে এসে পড়ত শুভ্র সুন্দর, প্রীতি-উজ্জ্বল একটা গোটা ছুটির দিন। কারোর কোন তাড়া নেই। আরেক রাউন্ড চায়ের সঙ্গে টিভিতে নববর্ষের বৈঠক। শুভ্র চুলে বৈঠকি গান নিয়ে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। গান শুনতে শুনতে দুপুরের মেনু ঠিক করায় ব্যস্ত বড়রা। রাস্তায় গান গেয়ে প্রভাতফেরী। রান্নাঘর থেকে ফুলকো লুচি আর ছোলার ডালের গন্ধ। আর আমার মনে লেগে থাকা নতুন জামার গন্ধ। ক’দিন আগে গেছে চৈত্র সেল। হাতিবাগান আর গড়িয়াহাট থেকে কেনাকাটা। ভাবছি কতক্ষণে পরব!

বাংলা নতুন বছর মানে হালখাতা। কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরে ভোররাত থেকে থই থই ভিড়। দোকানে গণেশ ঠাকুর আর বাড়িতে মা লক্ষ্মীর আসন পাতা। জোড়া আমপাতায় সিঁদুরের লাল টিপ। একটু বেলা গড়াতে হাওয়ায় ভাসা বড় বড় আলু দিয়ে কচি পাঁঠার ঝোলের সুঘ্রাণ আর কিসমিস ভাসা পায়েস। বিকেল থেকে সন্ধ্যে বড়দের হাত ধরে দোকান থেকে দোকানে ঘুরে মিষ্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডার সংগ্রহ করার অনাবিল আনন্দ। নব আনন্দের, নব রবি কিরণে ধোয়া এই দিনটায় কেউ অবাঞ্ছিত নয়, অপাঙক্তেয় নয়। সারা বছর দরাদরি করা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এদিন মিষ্টিমুখ আর শরবতের অমায়িক আমন্ত্রণ। আর এই সব টুকরো ছবির সঙ্গে, বৈশাখ আসা মানেই সেই লম্বা দাড়িওয়ালা, জোব্বাপরা, বাঙালিকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া মানুষটার জন্মদিনও এসে পড়া নববর্ষের পিছু পিছু।

ছোটবেলায় এই দিনটায় বড়দের কাছে শুনতাম আর এক নববর্ষের গল্প। আরও পুরনো কলকাতার। বড় বড় সম্পন্ন বাড়ির নহবতখানায় সেদিন ভোরবেলা বসত রোশনচৌকি। সানাইয়ের সুরে ঘুম ভাঙতো বাংলা বছর শুরুর প্রথম ভোরে। বাবু-কালচারের ঐতিহ্য-মেশা সেসব সানাইয়ের ভোর আস্তে আস্তে বেলায় গড়ালে বাবু-বাড়িতে শুরু হত হৈহৈ কান্ড। এলাহি আয়োজন। অন্দরমহলে পুজোপার্বণ। বারমহলে খানাপিনা। গোলাপ-বেলফুল- আতরের গন্ধে ভারি নাচঘরের ঝাড়বাতির ঠিকরোনো আলোয় জমে ওঠা মেহফিল। বিশাল ফটকের মাথায় বসানো ভাঙ্গা সিংহের মূর্তির মতই সেসব নহবতখানা আর নাচঘর আজ ভাঙ্গাচোরা, নোনাধরা। বর্ষবরণের সানাইয়ের সেই মিঠে সুর শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে মানুষের মনে কি বইয়ের পাতায়। 

ইতিহাসের পথ ধরে আরো কিছুটা পিছু হাঁটলে দেখি বাংলায় নববর্ষ উৎসব প্রথম শুরু হয়েছিল সেই আকবর বাদশার আমলে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও পালন করা হত নববর্ষ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সূচনা করেছিলেন। আর বছরের প্রথম দিনটাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নব-জাগরণের দিন বলে চিহ্নিত করে এই উৎসবে এক নতুনতর মাত্রা আনলেন রবীন্দ্রনাথ। পরাধীনতার দিনগুলোতে নববর্ষ উৎসব মানুষকে প্রাণিত করেছিল স্বদেশ চেতনায়। পয়লা বৈশাখের পরেই শান্তিনিকেতনে গরমের ছুটি। তাই শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর জন্মদিনও পালন করা হয়েছে এই নববর্ষের দিনটিতেই। ভারতে যে দিন প্রথম রেলগাড়ি চলেছিল, সেদিনও ছিল এক পয়লা বৈশাখ। আজকাল বইমেলাকে ঘিরে সাহিত্য প্রকাশনার রমরমা হলেও আগে নববর্ষের দিনটাই ছিল বাংলা সাহিত্য প্রকাশের প্রধান দিন। কলেজ স্ট্রীট পাড়া এখনও সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। এমনি করেই একটা নতুন বছরের শুরুতে দাঁড়িয়ে একটু পিছন ফিরে চাওয়া, জীবনের অঙ্ক খাতায় কিছু হিসেব নিকেশ, অনেকখানি আবেগ আর খানিকটা উদ্যম নিয়ে ভরা বাঙালির নতুন বছর।

সময় পাল্টায়। ছবি পাল্টায়। শৈশব থেকে কিশোরীবেলা কি তার পর থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার অনুভবে-চেতনায় মিশে থাকা আমার প্রথম সব কিছুর সাক্ষী সেই তিলোত্তমা শহরকে খুঁজে পাই না এখন। হাই-রাইজ,শপিং মল, ঝাঁ চকচকে গাড়িতে সাজানো ফেসবুক-টুইটারের কলকাতাএখন দ্রুতপায়ে এগোচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। মনের মধ্যে নানা রঙের আঁচড়ে আঁকা হয়ে যাওয়া ছোটবেলার নববর্ষের বেশ কিছু ছবি পাল্টে গেছে সময়ের হাত ধরে। আজ হাজারো চ্যানেলের ভিড়ে ফিকে হয়ে এসেছে টিভি পর্দায় নববর্ষের বৈঠকের আকর্ষণ। কিন্তু ভোর থেকে লক্ষ্মী-গণেশের নতুন মূর্তি আর খেরোর খাতা হাতে মন্দিরের লাইনে অপেক্ষামান মধ্যবিত্ত বাঙালির আবেগ আর সরল বিশ্বাসের জায়গাটা বোধহয় আজও এক। নতুন বছর শুরুর শুভ দিনে বাংলায় গুরুজন, প্রিয়জনকে যথাযোগ্য সম্ভাষণে লেখা চিঠির প্রজন্ম হারিয়েই গেছে। সেকেলে কালো ফোনের যুগ অনেক পিছনে ফেলে মুঠোফোনে নববর্ষের ঐতিহ্য মেনে শুভেচ্ছা বিনিময়টুকুর রেওয়াজ অক্ষুণ্ণ এখনও। ব্যস্ত জীবনের মধ্যে এও এক প্রাপ্তি।

এক্সপ্রেসওয়ের চলতি হাওয়ার পন্থী শহরটার আধুনিক নাগরিক জীবনযাপন, সংস্কৃতি, কি রাজনীতির হালচাল সময়ের সঙ্গে পাল্টালেও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরনো মায়াময় ছবিগুলো ভুলি কী করে? তাই এই একটা দিনে মাঝে মাঝে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে অতীতটাকে। বাংলার অতীত, বাঙালির ঐতিহ্য। কখনো কোনও ব্যক্তি, কখনো বা কোনও ঘটনা, কোনও জাগরণ কি বিশেষ কোনও প্রাপ্তি। ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে বঙ্গসন্তানদের কর্মকৃতি। বিশ্বপটের নিরিখে, দেশের পটেও। অনেক অহঙ্কারই হয়তো আজ স্মৃতি। অনেক গৌরবই হয়তো দ্রুত বিলীয়মান। তবু নতুন বছরের শুরুর দিনটাতে একবার ভাবতে ইচ্ছে করে, সব আলোর দিনগুলো কি নিছকই অতীত?

প্রথম নববর্ষ উৎসবের পর অনেক বসন্ত পেরিয়েছে। অগুন্তি নববর্ষের ভোরের নরম আলো ছুঁয়েছে আমার শহরকে, বাংলাকে। যত দূরেই থাকি, হৃদয়ের স্পন্দনে ধরা এ শহর, এ বাংলা। তার অতীতের দিকে চাই। টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভীড় করে আসে মনে। মনে সুর তোলে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান। আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। যে ভাষায় কথা বলি প্রিয়জনদের সঙ্গে, সে ভাষার সঙ্গে আমার আনন্দে-আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার ঘটিয়েছে বর্ণপরিচয়, সহজ পাঠ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত, পঞ্চকবির সুরের ধারায় আমার আনন্দ-স্নান। সেকাল থেকে একালে ভারতজোড়া সঙ্গীতসভায় বাংলার প্রতিনিধি অগুন্তি গুণীজন- শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী, পঙ্কজ মল্লিক, রাহুল দেববর্মন, কিংবা মান্না দে, হেমন্তকুমার, কিশোরকুমার, গীতা দত্ত, আরতি মুখোপাধ্যায় থেকে আজকের শ্রেয়া- উজ্জ্বল এক একটা নাম। রবীন্দ্রনাথের সুরের ঝর্ণাতলায় হাত ধরে নিয়ে যান রবীন্দ্রগানের এক সাধক- দেবব্রত বিশ্বাস। বিশ্বসভায় সেতারের ঝঙ্কারে মোহিত করেছেন রবিশঙ্কর, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ শতকের প্রথমভাগে কলকাতা আর শান্তিনিকেতনকে ঘিরে সূচনা শিল্পচর্চার এক সমান্তরাল নতুন ধারা। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী। এই ধারাই পরবর্তীতে হয়ে উঠল ভারতশিল্পের মূলস্রোত। আজও ঘরে বাইরে সমাদৃত বাংলার শিল্পীরা। গীতা পড়ার চেয়ে ফুটবল চর্চায় উত্সাহ দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। উদ্দীপিত একদল বাঙালি যুবক খালি পায়ে খেয়ে হারিয়ে দিলেন বিদেশী ফুটবলারদের। আন্তর্জাতিক আঙিনায় সাফল্যে উজ্জ্বল কিছুদিন আগের সৌরভ, আজও লিয়েন্ডার। অভিনয়ের প্রতিভায় সেকালের গিরিশচন্দ্র, নটী বিনোদিনী, শিশিরকুমার হয়ে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল-অজিতেশ হয়ে আজকের দেবশঙ্কর-সোহিনীরা মঞ্চে উজ্জ্বল। নায়ক থেকে মহানায়ক উত্তমকুমার হয়ে আজও অব্যর্থ সৌমিত্র। আন্তর্জাতিক মঞ্চে চলচ্চিত্র নির্দেশনায় সত্যজিৎ- মৃণাল- ঋত্বিক- তপন থেকে জাতীয় স্তরে কৌশিক-সৃজিতরা মুগ্ধ করেন বার বার। শিক্ষা আর বিজ্ঞানচর্চায় উজ্জ্বল বাঙালির অতীত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে উপাচার্য পদে অনন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহেন্দ্রলাল সরকারের স্বপ্ন সার্থক করে জনগণের টাকায় এ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার গবেষণাগার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণায় বিজ্ঞান সাধনার বিপ্লব। সমসাময়িক যুগের আর এক শিক্ষাবিদের কৃতিত্বে বিশ্বের দরবারে বাঙালি খ্যাতিমান, অমর্ত্য সেন।

নানা দিকে কি অপার ঐশ্বর্য! কি গৌরবময় ইতিহাস! কিন্তু তারপর? অগ্রগতির সেই ধারা কিছুটা কি স্তিমিত আজ? আরও বেশি প্রত্যাশা ছিল কি! 

স্বপ্ন দেখি, প্রতিদিনের টুকরো গ্লানি কি নিত্য নৈমিত্তিকতাকে দূরে ঠেলে, যাবতীয় হীনমন্যতাকে অতিক্রম করে নিজের গরিমামাখা উজ্জ্বল সভ্যতা-সংস্কৃতিতে আস্থা রেখে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমার বাংলা। এইদিন ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক.../ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ আমার শহর, আমার বাংলা জড়িয়ে আছে প্রাণে, অনুভূতিতে, ভালবাসায়। প্রতিটা নতুন ভোর নতুন সূর্যের সঙ্গে নিয়ে আসে নতুন আশা, উত্তরণের নতুন স্বপ্ন।

নতুন বছরে সেই স্বপ্ন ছুঁতে দিগন্তের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ুক আজকের নতুন বাঙালি।




1 comments:

2

বিশেষ প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ 




বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব
কানন দেবী : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়




দশ বছরের এক বালিকা আর তার মা । পিতা বলে যাকে আশৈশব জেনে এসেছে, মা তার বিবাহিত স্ত্রী নন, রক্ষিতা । দশ বছর বয়সে, সেই জন্মদাতার মৃত্যুতে অতল অন্ধকারে পড়ে গেলো সেই মেয়ে । বুঝে গেল শূন্য থেকে শুরু করতে হবে । মাথার ওপর একটুকরো ছাদের সন্ধান পেতে মাকে নিয়ে আশ্রিতা হ’ল এক আত্মীয়ের, দুজনের শ্রমের বিনিময়ে । মা পাচিকা, মেয়ে বাসন মাজার কাজ । সেখানে লাঞ্ছনা, অপমান, দৈহিক পীড়ন অসহনীয় হয়ে ওঠায় বাধ্য হ’ল মাকে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াতে । সেদিনের সেই বালিকা তেইশ বছর পরে টালিগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সমভ্রান্ত গুনিজনদের মধ্যে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করলেন আর উদবোধক রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কাটজুকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন । পীড়িত, নিঃসম্বল সেই কিশোরীই তার তন্ময় সাধনা, সততা আর সমাজ-মনস্কতায় হয়ে উঠলেন অতি সম্মানিত মহিয়সী নারী । অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ যাকে বলেছিলেন ‘ফার্স্ট লেডি অফ ইন্ডিয়ান স্ক্রীণ’ । এ এক বিস্ময়কর ঘটনাক্রম । অবহেলার অন্ধকার থেকে দীপ্তিময়ী ব্যক্তিত্বে উত্তরণ । তিনি কানন দেবী, বাংলা চলচ্চিত্রের নির্বাক ও সবাক যুগের সন্ধি লগ্নের সাধারণ অভিনেত্রী থেকে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিভাবিকা হয়ে ওঠা কানন দেবী । বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ‘সুপার স্টার’ কানন দেবী পা রাখলেন শত বর্ষে ।

কানন দেবীকে নিয়ে লেখা কম হয়নি, তাঁর জীবনকালে ও মৃত্যুর পরেও । যার বেশির ভাগই তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের নানান রঙ চড়ানো কাহিনী । তিনি ছিলেন ‘হার্টথ্রব’ নায়িকা, অপরূপ সুন্দরী কাননকে স্পর্শ করতে কোন এক যুবক নাকি সিনেমাগৃহের পর্দার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, কিভাবে কাননকে চিত্র পরিচালকেরা শরীর প্রদর্শন করাতেন তার নানান গল্প কথা, ইত্যাদি । এমনকি লন্ডনে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন কিংবা নজরুল ইশলামকে জড়িয়েও তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে । সেইসব গল্পকথায় রুচিশীল কারো আগ্রহ থাকার কথা নয়, আমারও নেই । আমি বুঝতে চেয়েছি একদা সমাজের চোখে অবাঞ্ছিত এক বালিকা কি অসীম নিষ্ঠা আর প্রত্যয় সম্বল করে অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ সম্ভব করেছিলেন । কি করে সম্ভব হয়েছিল ? জীবনকে চেনা, জানার আগ্রহই এটা সম্ভব করেছিল । আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে কানন সে কথা জানিয়েছেন । লিখেছেন “ চিত্রজগতের বাইরের বিরাট জগৎকে জানার,‌ দেখবার, বিভিন্ন চরিত্রের, অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসবার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছে । ভালো-মন্দ, সম্পূর্ণতা, অসম্পূর্ণতা, দোষগুণে মেশানো মানুষের সংস্পর্শ আমার জীবনে অন্তত সেটুকু প্রসারতা এনে দিয়েছে যেটুকু প্রসারতা থাকলে জীবনকে যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখবার আগ্রহ জন্মায়” । জীবনের আশ্চর্য বোধই একদা নিঃসহায় বালিকার  বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প ও সংস্কৃতিতে এক সম্ভ্রমযোগ্য ব্যক্তিত্বে উত্তরণ ঘটিয়েছিল । 

কাননবালা থেকে কাননদেবী । তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নিতান্তই শৈশব । কাননের জন্মের তিন বছর আগে সবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃত দাদা সাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’এর মুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯১৩তে । কলকাতায় পার্শি ব্যবসায়ী জে.এফ.ম্যাডান গঠন করেছেন চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক প্রদর্শনের পথিকৃত প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান থিয়েটার’ । এক সহৃদয় ব্যক্তির হাত ধরে দশ বছরের কিশোরী কানন পা রাখলেন ম্যাডান থিয়েটারের স্টুডিওতে, সংস্পর্শে এলেন পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যা-এর। সেটা ১৯২৬ সালের কথা, তখনো চলচ্চিত্র শব্দহীন। দশ বছরের কিশোরী কানন-এর প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’ এ ‘রাধা’ চরিত্রে । পারিশ্রমিক পেলেন পাঁচ টাকা । চলচ্চিত্রজীবনে কাননের প্রথম উপার্জন । এর পর ‘শঙ্করাচার্য’তে অভিনয় করলেন কানন, সেটিও নির্বাক ছবি । ১৯৩১এ বাংলা ছায়াছবি কথা বলতে শুরু করলো, ১৯৩১এ ১১ই এপ্রিল সবাক কাহিনিচিত্র অমর চৌধুরী পরিচালিত ‘জামাই ষষ্টি’ মুক্তি পেল । ঐ বছরেই কানন-এর প্রথম সবাক চিত্রে অভিনয় ম্যাডান থিয়েটারের ‘জোর বরাত’ ছবির নায়িকা চরিত্রে । মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩১এর ২৭শে জুন । ১৯৩৩এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রী গৌরাঙ্গ’ চলচ্চিত্রে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ চরিত্রে অভিনয় ও গানে কানন শিল্পীর সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পেলেন । ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ মুক্তি পাওয়ার পর কাননের গানের খ্যাতিও বিস্তৃত হল, ডাক পেলেন গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে । কাননদেবী তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন “ এই সময় স্টুডিও থেকে ক্রমশ গ্রামোফোন কোম্পানী অবধি কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হোল ...গান এসে আমার অভিনয়ের পাশে দাঁড়াতেই মনে হোল আমার জীবনের এক পরম পাওয়ার সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল । ...নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম”( ‘সবারে আমি নমি’) ।

তারপর কত ছবি, কত গান – কানন হয়ে উঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার – ‘মহা নায়িকা’ । চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাইরে গ্রামোফোন রেকর্ডে কানন দেবীর কন্ঠের কিছু গান তো ‘লিজেন্ড’ হয়ে আছে স্রোতাদের কাছে । ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে...’, ‘সাপুড়ে’ ছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’, ‘সাথী’ ছবিতে সায়গলের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়’ এখনও তন্ময় সঙ্গীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে । কাননের আর একটি গান ‘লিজেন্ডে’র মর্যাদা পেয়েছে । ১৯৪৭এর অগস্ট মাসে লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া হাউস’এ তাঁর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে । ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন তখন লন্ডনে ভারতের হাই কমিশনার । সেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কানন গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার’

১৯৩৬এ রবীন্দ্র-কাহিনী নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগ করলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে কানন দেবী গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং ‘আজ বিদায় বেলার মালাখানি’ । এই সুবাদে কানন হয়ে গেলেন শান্তিনিকেতন ঘরাণার বাইরে রবীন্দ্র-গানের প্রথম মহিলা-কন্ঠ । তারপর অজস্র ছায়াছবি ও গ্রামফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন কানন । সেকালে রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পঙ্কজকুমার মল্লিকের মত কানন দেবীরও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে । 

সংগীতপ্রধান ছবি ‘বিদ্যাপতি’(১৯৩৮)তে অভিনয় ও গায়িকা রূপে কানন খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন । চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কানন না সঙ্গীত শিল্পী কানন – কে বড় সে প্রশ্নের মীমাংশা হবার নয় । কাননের নিজের কথায় “আজ আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড় । কিন্তু আমার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশী দামী আমার গানের মহল ...” (‘সবারে আমি নমি’) । পন্ডিত আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন । গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে ।

তেইশের তরুণী কানন চেয়েছিলেন জীবনকে শুদ্ধ, সুন্দর করে গড়ে তুলতে । তখনকার সমাজ নিদারুণ আঘাত করেছিল কাননের প্রথম প্রেমকে । সেই পরম পাওয়ার আনন্দসুধা অঞ্জলি ভরে পান করতে পারেন নি তিনি । ১৯৩৯এ তেইশ বছরের তরুণী কানন বিবাহ করেন প্রখ্যাত ব্রাহ্মসমাজী শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রকে । কানন লিখেছেন “ সমাজ আমাদের মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে । কিন্তু সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ করেনি । ... আমাদের দুঃসাহসের সাক্ষী হয়েছে, কিন্তু উৎসবের আলো জ্বালিয়ে একে অভিনন্দিত করেনি ...। আজও মনে পড়ে, বারান্দায় দাঁড়াতে সাহস করতাম না, পাছে কারো কোন বিরূপ মন্তব্য কানে আসে । নানান কুরুচিপূর্ণ কদর্য ভাষার প্যামফ্লেট ছাপিয়ে উঁচু স্বরে হেঁকে বিক্রী হ’ত আমারই বাড়ির সামনে ...। নিঃসম্বল অসহায় একটা মেয়ে । কত ঝড় তুফান পেরিয়ে ছুটছে আর ছুটছে । কিন্তু তার সেই বিরামহীন চলা, গ্রন্থিহীন তপস্যার এতটুকু মূল্য কেউ কোনদিন দেয়নি । চেয়েছে তাকে ব্যর্থতার সমাধিতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে” (‘সবারে আমি নমি’) । সে বিবাহ স্থায়ী হয়নি । সেকালীন রক্ষণশীল সমাজ প্রবল নিন্দাবাদ করেছিল বংশগৌরবহীন একজন চিত্রাভিনেত্রীর সঙ্গে এক সমভ্রান্ত পরিবারের বিবাহে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁদের বিবাহে আশির্বাণী ও প্রীতি উপহার স্বরূপ একটি ছবি পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন । এক চিত্রভিনেত্রী রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরকরা ছবি পাবে কেন ! 

কাননের কাছে সর্ত ছিল বিবাহের পর চিত্রাভিনয় ত্যাগ করতে হবে । ব্যক্তিত্বময়ী কানন সম্মত হননি । ১৯৪৫এ কানন তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ নেন । বিবাহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সত্বেও প্রথম স্বামীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন, অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা তাঁকে প্রথম সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য । পরবর্তী কালে, অশোকের দিদি রানী মহলানবিশ, তাঁর স্বামী প্রখ্যাত প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কিংবা অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে কাননের অন্তরঙ্গতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলনা ।

ইতিমধ্যে দশটা বছর কেটে গেছে । ১৯৪৯এ ততকালীন রাজ্যপালের সঙ্গে আলাপের সূত্রে পরিচয় হয় রাজ্যপালের নেভাল এ.ডি.সি হরিদাস ভট্টাচার্যর সঙ্গে । পরিচয় থেকে প্রণয় এবং বিবাহ ঐ বছরেই । ১৯৪৯এই চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামেন কানন, গঠন করেন শ্রীমতী পিকচার্স । প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ । তারপর একের পর এক শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’, দর্পচূর্ণ’, নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘অন্নদা দিদি, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি, প্রযোজনা কানন দেবীর শ্রীমতী পিকচার্স আর পরিচালনায় স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য । অন্নদা দিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর কানন আর কোন ছায়াছবিতে অভিনয় করেননি । 

অভিনয় করেননি, কিন্তু সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আমৃত্যু । ১৯২৬ থেকে ১৯৯২ সুদীর্ঘ ছেষট্টি বছর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিজড়িত ছিল একটা নাম কানন দেবী । বলতে গেলে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণের একশো বছরের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা আছে তাঁর নাম । শুধু অভিনয় ও সঙ্গীত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এমন নয় প্রযোজনা, পরিচালনা, বিচারক মন্ডলী, ডিরেক্টর বোর্ড – সিনেমা শিল্পের প্রতিটি বিভাগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন সুদীর্ঘ সময় । দুঃস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে গঠন করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। যুক্ত ছিলেন সামাজিক নানান কল্যানকর সংগঠনের সঙ্গে ।

তার সময়ে পুরস্কারের ঘনঘটা ছিলনা এখনকার মত । ১৯৬৪তে ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধীতে সম্মানিত করেন। তারপর ১৯৭৬ পান চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার । ২০১১র ফেব্রুয়ারীতে ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে । আলোহীন জগৎ থেকে উঠে আসা এক নারী আপন প্রতিভা ও তন্ময় সাধনায়, অনেক অবহেলা, লাঞ্ছনা, চিত্র জগতের ক্লেদ, আর গ্লানি অতিক্রম করে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন । সে এক বিস্ময়কর আলোয় ফেরার কাহিনী । ১৯৯২এ কলকাতায় মৃত্যু হয় কানন দেবীর ছিয়াত্তর বছর বয়সে ।

আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে কানন দেবী লিখেছেন ‘মরণ পন করে যে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছি তাকে নিয়ে আর যাই হোক ছেলেখেলা করা যায় না । ... জীবনের কাছে আমি চেয়েছি মধুর শান্তিনিলয় । স্বপ্নভরা আরামকুঞ্জ, উদার আকাশ” । সংশয় নেই, জীবন বোধে উজ্বল ছিল তাঁর দীর্ঘ শিল্পী ও সামাজিক জীবন । কানন দেবীর শতবর্ষে আমাদের বিনম্র প্রণাম ।









2 comments:

0

প্রবন্ধঃ শ্রীশুভ্র

Posted in


প্রবন্ধ 



খোলামাঠের গল্প!
শ্রীশুভ্র



খুব বেশী দিন আগের কথাও নয়! আমাদেরই সেই ছেলেবেলার কথা, কত আর হবে- চারদশক আগের কথা মাত্র! মফস্বল শহরেই বেড়ে ওঠা। বাবার বদলির চাকুরির সূত্রে এশহর থেকে ওশহর। আর প্রায় হকে নকেই কলকাতার বাড়িতে ঘুরে যাওয়া! কিন্তু তখনও ছেলেবলার সেইসব দুরন্ত হাত পা ছোঁড়ার দিনগুলোতে খেলার মাঠের বিশেষ অভাব দেখিনি! যেখানেই যাই না কেন, বিকেল হলেই হুটোপুটি করার কিংবা বল নিয়ে দৌড়াবার একটা না একটা মাঠ জুটে যেত ধারে কাছেই। খাস কলকাতায় সেটা হয়তো অতো সহজলভ্য ছিল না, তবুও আমাদের মাঠের অভাবে হাত-পা বিষাদে মনের ভেতর গুটিয়ে আসেনি কোনদিনই! ছেলেবেলার অফুরন্ত উদ্যোমশক্তির বিকাশের একটা প্রশস্ত ক্ষেত্রই হল খেলার মাঠ! খোলা মাঠ! এই খেলার মাঠকে কেন্দ্র করেই শরীর মনের বৃদ্ধি প্রকৃতির সাথে কোলাকুলি করেই রসসঞ্চার করে ব্যক্তিত্বের পরতে! আমরা প্রাণবন্ত হয়ে উঠি! 

সেই খেলার মাঠ নিয়েই যে মুক্ত অর্থনীতির জামানায় নতুন এক খেলা জমে উঠবে, সেটা আঁচ করার বয়স ছিল না তখন! যখন হলো, তখন দেখি একে বারে পিসি সরকারের ম্যাজিক! খেয়ালও করতে পারিনি, হঠাৎ দেখি কচিকাঁচাদের সেই খেলার মাঠ জীবনের বাস্তবতায় একেবারে ভ্যানিশ! না ম্যজিক নয়! সত্যি সত্যি ভ্যনিশ! কোন জাদুকরই, সে তিনি যতবড়ই জননেতা হন না কেন, ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠ আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না! আজকের কিশোর কিশোরীদের হুটোপুটি করার ছোটাছুটি করার, দুরন্ত সেই হাত-পা গুলিকে সন্তুষ্ট করার আর কোনো উপায় নেই! সনাতন চীনে মেয়েদের লোহার জুতো পরিয়ে পায়ের পাতা ছোট করে রাখার মতোই আমরা আজকের ছেলেমেয়েদের কম্পিউটার দিয়ে চৌখুপী ফ্ল্যাটবাড়ির 2BHK/3BHK মাপে আটকিয়ে ফেলেছি! চীনের লোহার জুতো হয়ে উঠেছে কম্পিউটার আর গেমস সফ্টওয়ার!

কিন্তু কেন হলো এমন? সবটাই কি খোলাবাজার অর্থনীতি আর প্রযুক্তির রকেটগতির আস্ফালন? তাহলে তো বিশ্বের সবদেশের চিত্রই কম বেশি একরকম হওয়ার কথা! তাই হয়েছে কি? খুব ভালো করে খোঁজ না নিয়েও বলা যায়, না সব দেশের চিত্রই ঠিক আমাদের মতো নয়! এই চিত্র আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই বেশি প্রকট! তাহলে জনবিস্ফোরণই কি মূল কারণ! কারণ তো বটেই, কিন্তু সেটাই তো সব নয়! কারণ আরও হরেক রকম! শুধু জনবিস্ফোরণই যদি মূল কারণ ধরা যায়, তাহলেও বেশ অবাক হতে হয়! আমাদের প্রজণ্মও একাধিক ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে! কিন্তু এখন? এখন তো অধিকাংশ পরিবারেই ছেলেমেযেরা ভাইবোন বলতে খুড়তুতো জ্যাঠতুত মামাতো মাসতুত ভাইবোনই বোঝে! এই যে পরিবার ক্রমশ কৃশকায় হয়ে উঠছে দিনেদিনে, জনবিস্ফোরণে এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না কেন? গত চার দশকেই বাসে ট্রেনে ভীড় বাড়ছে তো বাড়ছেই! এবং একথাও মনে রাখা দরকার এই একই সময়সীমায় পথেঘাটে যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে বিপুল পরিমান। ট্রেনের সংখ্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে! তাহলে রহস্যটা কোথায়? 

রহস্য নয়, আসল ঘটনা হল, এই গত চারদশকে এরাজ্যে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের সংখ্যা বেড়ে গেছে বিপুল পরিমানে। এবং প্রায় প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক অবাঙালি এ রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হচ্ছেন। আর এর সাথে রয়েছে গ্রাম উজার করে শহরমুখী মানুষের ঢল। এই বিপুল পরিমানে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের ও শহরমুখী জনস্রোতের স্থায়ী আস্তানার জন্যে গড়ে ওঠা লাভজনক আবাসন শিল্পই গ্রাস করেছে চারদশক আগের ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠ! জনসংখ্যার এই বিপুল চাপ পশ্চিমবঙ্গের মতো এত ক্ষুদ্র একটি রাজ্যের পক্ষে সামলোনো কোন জাদুকরের পক্ষেই সম্ভব নয়! তাই কিশোরকিশোরীদের খেলার মাঠ থেকে কৃষকের বহুফসলী জমি কোনোটাই আর সুরক্ষিত নয়! ইটকাঠ পাথরের এক দুর্ভেদ্য জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক বিকাশের খোলামাঠ!

এই খোলামাঠ আর খোলাবাজার অর্থনীতির মধ্যেও কি একটা ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক নেই? আছে মনে হয়! বর্তমানের পরিবেশ সচেতন ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স সুরক্ষিত রাখার কার্যক্রমগুলি উন্নতবিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেরই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য! আর সেই লক্ষ্যেই খোলাবাজার অর্থনীতির বিশেষ ভুমিকা বর্তমান। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি তাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স সুরক্ষিত রাখার জন্যে এবং উৎপাদিত দ্রব্যের উৎপাদন ব্যায় কমানোর জন্যেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেই কলকারখানাগুলি সরিয়ে ফেলছে। তাতে আমাদের দেশে কিছুপরিমানে কর্মসংস্থান বাড়লেও আমাদের পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য! খোলাবাজার অর্থনীতির হাত ধরেই আমরা পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক এইসব কলকারখানা ও শিল্প বিস্তারে নিজেদের খোলা সবুজ প্রান্তরগুলি, বহুফসলী জমিগুলি খোলাবাজার অর্থনীতির গর্ভে বিসর্জন দিচ্ছি! আর এরই অনুসারী ফল হিসেবেও আবাসন শিল্পের জোয়ার এসে আছড়ে পড়েছে আমাদের রাজ্যেও। ফলে একদিকে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের স্থায়ী ভাবে বসবাস প্রবণতার দ্রুত বৃদ্ধি ও অন্যদিকে এই খোলাবাজার অর্থনীতির রমরমা, এই দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে ক্ষুদ্র এই রাজ্যের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে! 

এটাই সেই জাদু! যে জাদুতে হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছে দুরন্ত হাত-পা গুলির জন্যে অতি প্রয়োজনীয় সেই খোলামাঠ, ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠ! কিন্তু খোলামাঠের হারিয়ে যাওয়ার গল্প এখানেই শেষ নয়! এই সেদিনও বাড়িতে বাড়িতে পরিবারের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যেও আরও একটা খোলামাঠ ছিল বড়ো! বাবা-মা দের শাসন নজরদারীর বাইরে আপন ভাইবোনেদের নিত্য দৌরাত্ম খুনসুটি মানঅভিমান খেলাধুলার অনেক বড় প্রশস্ত একটা খোলামাঠ! যে খোলামাঠেই পারিবারিক দায়বদ্ধতা দায়িত্ব কর্তব্য আত্মীয়তার সবচেয়ে বড়ো ও অব্যর্থ পাঠ নিয়ে প্রত্যেকের বেড়ে ওঠার একটি সহজ সুন্দর স্বাভাবিক ছন্দ ছিল ঘরে ঘরে! আজকের শিশুর সেই খোলামাঠটাও হারিয়ে গিয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির চালচিত্রে। 

আর এই হারিয়ে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব ব্যক্তিত্বের কাঠামোয় পড়তে বাধ্য। পরিবারের সকলের জন্যে যে দায়বোধ ও আত্মিক বন্ধন মনের গভীরে বহমান থেকে আমাদের মানবিক বিকাশকে সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করতো এতদিন, এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির গণ্ডীতে বেড়ে ওঠা কিশোর কিশোরীদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগটাই আর নেই! ফলে প্রত্যেক মানুষের মনের নিজস্ব খোলামাঠটাও দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের পরিসরে! আমাদের, ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডীতে ঘুরপাক খাওয়ার এই এক অন্যতম বড়ো কারণ! হারিয়ে গেছে সেই খোলামাঠটাও! 







0 comments:

0

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ 



নতুন পথের সন্ধানে বাঙালীর নববর্ষ
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য



শ্রবনেন পথ দুঁহু লোচনেন লে ল। চলতি কোথায় আড় চোখে দেখা। আমাদের সবারই একটা বয়স আসে যখন চোখ আপনা থেকেই উঠে যায় বিপরীতের মেয়ে বা ছেলেটির দিকে। কেন যে ওঠে, কোন হরমোনের খেলা সেগুলো তখনো আমার জানা হয়নি। শুধু সামনে থেকে কোনো মেয়ে এলে তার দিকে তখন সদ্য চোখ চলে যায় আমার। আর একটা ভালো লাগা কাজ করে। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে যাচ্ছি ধর্মতলার দিকে ট্যাক্সি করে। শোভাবাজার এ বিডন স্ট্রিট ক্রসিং এর কাছে পেট্রল পাম্প-এর পাশ দিয়ে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একদল মেয়ে। যথারীতি আপনা থেকে চোখ ডানদিকে ঘুরে গেল। কিন্তু কোথাও যেন একটা অস্বস্তি রয়ে গেল। এদের বেশ-ভুষা যেন একটু আলাদা। লিপস্টিক এর কালার। রুজ। ঝকমকে তেলচিটে জামা। চলন চাওনি সবই যেন একটু আলাদা। আর মুখময় যেন লেখা বেদনার করুণ কাহিনী। এরা কারা ? কিছুটা যে অনুমান করতে পারলাম না তা নয়। একটা জিনিস বুঝলাম - এরা সমাজের মধ্যে থেকেও যেন সমাজের মধ্যে নয়। সেদিন GPS কল্প বিজ্ঞানের কল্পনাতেও বিরল। আজকের দিন হলে GPS বলে দিত সোনাগাছির রাস্তা এটা। শোভাবাজার-এর সাথে সেদিন আমার পরিচয়টা কিন্তু মনে একটা দাগ কেটে দিল। 

যব চার্নক যেদিন পা রাখলেন বাংলার মাটিতে সেদিন কলকাতা শহর মানচিত্রে ছিল না। সাবর্ণ চৌধুরী এগিয়ে এলেন স্বাগত জানাতে সেই ব্রিটিশ সাহেবকে। তৈরী হলো কলকাতা শহর। 1690 সাল। শোভাবাজার -সুতানটি সেদিন উঠে এলো বিশ্বের ইতিহাস়ের পাতায়। এরপর আসা যাক 1800 সালে । শোভাবাজার এর অনতিদূর এ জোড়াসাঁকোতে দ্বারকানাথ ঠাকুর-এর মন কে দোলা দিয়েছিল চার্লস ব্যাবেজ এর বানানো প্রথম কম্পিউটার। দ্বারকানাথ ঠাকুর এক বিরল বাঙালী প্রতিভা যিনি বানিজ্যে বসতে লক্ষ্মী-র সার্থক রূপকার। সেই সময় থেকে প্রায় পরবর্তী সত্তর বছরের ইতিহাস বাঙালীর জীবনে  ভীষণ বৈচিত্রময়। এক দিকে ছিল বাবু সম্প্রদায়। সুরা, নারী আর কবুতর -এই ছিল বাবু সমাজের পরিচয়। বাইজীর ঘুঙুরের ঝংকারে ছড়িয়ে পরেছে স্বর্ণ আর দর্পের বুদবুদ। বৌবাজারের রাতের রৌনকে জলসার জাজিমে বেশ্যার হাতে সুরা পান আর টাকার ফোয়ারা। - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ভাষায় ‘তখন একজন তার উত্তাল বক্ষদ্বয়ের ওপর এক হাত রেখে সুমধুর হাস্যে বলল, এই দেখো কেমন বুক কাঁপছে, দেখুক দেখুক নিজে হাত দিয়ে দেখুক|’ - এরই মধ্যে বাবুর বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ আজ ও বাঙালীর প্রাত-স্মরণীয়। আবার সেই সমাজ এই বিদ্যাসাগর রেড়ির তেলের প্রদীপে শাস্ত্রীয় পথে শুনিয়ে গেছেন নারী মুক্তির বার্তা। 

শোভাবাজারের সাথে আমার পরিচয় আরো বাড়লো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'সেই সময়' উপন্যাসের হাত ধরে। সাথে যুক্ত হলো বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ। তৎকালীন বঙ্গ সমাজের একটা ছবি ফুটে উঠলো। প্রবন্ধ আর উপন্যাসের তত্ত্বগত পার্থক্য এখানে বিচার্য বিষয় নয়। তবে উপন্যাসে সীতা রামের বোন হতে পারে, কিন্তু প্রবন্ধতে সীতা রামের বউই হয়। কিন্তু প্রবন্ধ বা উপন্যাস দুটোতেই ফুটে ওঠে সমাজের প্রতিচ্ছবি। প্রবন্ধ আর উপন্যাসের পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যাক খ্রীষ্টপূর্ব 500 বছর আগে। ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে এক নর্তকী, আম্রপালি। চৌষট্টি কলায় পারদর্শী। সমাযে গণিকার সম্মানের সাক্ষ্য। ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের আগে বেনারসে গনিকা সম্প্রদায় সযত্নে পালন করেছে নৃত্য আর সঙ্গীতের ঘরানাকে। ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনা কালে পর্তুগিজদের হাত ধরে গোয়াতে প্রথম ঢুকে পড়ে পণ্যবাহী সেনার যৌন লালসা মেটাতে কিশোরী নারী শরীরের নিলামি। বিক্রি হয়ে যায় কাশীর বিধবা নারী সুরাটের বন্দরে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে বাংলায় বাবু সম্প্রদায় গণিকা, বেশ্যা আর রেন্ডি -এই শব্দ গুলোকে সমার্থক করে ফেলে। বদলে যায় সমাজের চিত্র।

আজকের এই টেকনোলজি নির্ভর সমাজে বিপণন এখন ম্যানেজমেন্ট এ রিসার্চের বিষয় । কাস্টমারের শুধু চাহিদা মেটানো নয়, পূর্ণ তৃপ্তি মেটাতে এসেছে অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাতে কার্যকলাপ ভিত্তিক মূল্য নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে এসেছে ব্যবসা মূল্যায়নের নতুন মাপ কাঠি। কিন্তু এই সমস্ত তত্ত্বতে হার মানিয়ে দেয় এক বিশেষ পেশা যার অর্থনৈতিক অঙ্ক 30 বিলিয়ন ডলার কেও চাপিয়ে যায়। যেখানে বিনিময় প্রথা একটাই - অর্থের বিনিময় এ যৌন সুখ। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে এসেছে নতুন বৈচিত্র। এসেছে বিপণনের বিভিন্ন রঙ - বাহারি রকমারি। কিন্তু সেই আলোর নিচে জমে আছে আঁধার। কোনো মেয়ের কান্না। কত ব্যাথা। কত প্রবঞ্চনা। হিউম্যান ট্রাফিকিং নিয়ে বিশ্ব জুড়ে ILO র পরিসংখ্যান আর প্রতিনিয়ত প্রতিরোধের প্রয়াস। 

ইংরেজি 15th মার্চ 2015। বাংলার নববর্ষ। 'সূর্য সিদ্ধান্ত' কে অনুসরণ করে বাংলার নতুন বছর। পয়লা বৈশাখ। বাংলা ১৪২২ সাল। হিমের রাতে আকাশের দীপ গুলির দীপালিকা ম্লান হয়ে গেছে | বসন্তের ফুল তার জয়মাল্য গেঁথেছে। এখান মন্দ গতি ক্লান্ত তপ্ত বাতাসে বৈশাখকে স্বাগত জানাচ্ছে বাঙালী - এস হে বৈশাখ। কিছুদিন পর পঁচিশে বৈশাখ এ বাঙালী বরণ করবে জন্মের সেই প্রথম শুভক্ষণ কে, যখন কবি সার্বভৌম পেয়েছিলেন প্রথম সূর্যের আহবান। পয়লা বৈশাখে ঘুচে যায় পুরনো স্মৃতি, মুছে যায় অশ্রু মাখা গান। চির নূতনের ডাক ছুটে চলে বৈশাখের আকাশে বাতাসে। তাপস নিশ্বাসে মৌন মুখর আনন্দ ধ্বনি নিয়ে আসে নতুন উল্লাস। এই শুভ মুহুর্তে আমাদেরই এই সমাজে কিছু মুখ থেকেই যায়, যারা বুকের মাঝে বয়ে বেড়াচ্ছে শত শতাব্দীর বেদনার অব্যক্ত ভাষা। সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের দিকে আমরা কি বাড়িয়ে দিতে পারি না আমাদের সহানুভূতির হাত ? সামান্য সামাজিক স্বীকৃতি। পেশা গত সামান্য মান্যতা হয়ত ফুটিয়ে তুলতে পারে একটু হাসি সেই সব মুক মুখে। আমরা আশাবাদী। আমরা আশার দীপ জ্বেলে কাব্যের দীপিকায় বসে আছি। বসে থাকব। এক নর্তকীর গান যদি স্বামী বিবেকানদের মনে ভাবোদয় করতে পারে তাহলে আমরাই বা আজ কেন পেছনে রেখে দেব সেই মানুষ গুলোকে যাদের মাটিকে সমাজ লাল আলোর এলাকা বলে বন্দী রেখেছে। অথচ সেই মাটি ছাড়া শরতের অঞ্জলি মা দুর্গার পায়ে দেওয়া যায় না। 








0 comments:

0

প্রবন্ধঃ মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




প্রবন্ধ



অন্নদাশঙ্কর রায়ের রম্য ছন্দছড়া
মনোজিৎকুমার দাস



অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪----২০০২) বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, গল্প,উপন্যাস, ছড়া বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম ছড়াকার। তাঁকে ছন্দছড়ার রাজা বললে ভুল বলা হয় না। তাঁর লেখা ছড়ার সংখ্যা প্রায় ৬০০। ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য এবং সবার জন্য নানা আঙ্গিক, নানা ছন্দ ও নানা রীতিতে চিত্তাকর্ষক ছড়া তিনি রচনা করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, তিনি নিজেই একজন ছড়াকার। নিজের লেখা ছড়ায় তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর ছড়া লেখার অভিব্যক্তি।

এক কোণে আমি রচি ছড়া 
বিনা ভাগে ভোগ করি ধরা।’

অন্নদাশঙ্করের লেখা রাঙা ধানের খই’, ‘আতা গাছে তোতা পাখি’, ‘হৈরে বাবু হৈ’, ‘রাঙা মাথায় চিরুনি’, ‘ বিন্নি ধানের খই’, ‘ সাত ভাই চম্পা’, ‘দোলদোল দুলুনি’, শালিধানের চিড়ে’, ‘ যাদু এ তো বড় রঙ্গ’ ইত্যাদি ছড়ার বইগুলোর নামের মধ্যেই মজার গন্ধ ছড়িয়ে আছে।

তাঁর লেখা ছড়াগুলোর নামকরণ থেকে ছড়ার বিষয় বস্তু এবং শব্দ ও ছন্দের দোলা সহজেই অনুধাবন করা যায়। তিনি তাঁর লেখা ছড়ায় শব্দের খেলা দেখিয়েছেন। ছড়ার অন্তমিলের জন্য ব্যাকরণের নিয়মকে অগ্রাহ্য করে নতুন শব্দ সৃষ্টি করে মজার মজার ছড়া রচনা করেছেন, যাতে ছন্দ মাধুর্য কোনভাবেই নষ্ট হয় নি। ব্যাকরণের প্রথা না মেনেও অন্তমিল রক্ষা করেছেন অতি মুনশিয়ানার সঙ্গে। নিচের উদাহরণই তার প্রমাণ।

১) বৃষ্টি পড়ে টাপুর টাপ
বসে আছি চুপুর চাপ।’

২) মিউ মিউ 
এবার একটা বিড়াল ধরা 
কল এনে দিউ।

ছন্দ মিলের জন্য শব্দের যে অভিঘাত ঘটিয়ে তিনি যে সব ছড়া লিখেছেন তা যে কত মজার সেটাই উঠে এসেছে নিচের দুটো ছড়ার কিয়দাংশ থেকে।

১) বন্দে আলি খান ছিল
গাছের ডাল ভাঙছিল।

২) এক যে ছিল অসুর
রাবণ তার শ্বশুর।

অন্নদাশঙ্কর ছোটদেরকে আনন্দ দেবার জন্য মজার মজার ছড়া রচনা করেছেন নানা ছন্দে। তাঁর ছড়ায় শব্দ চয়ন এতই সুন্দর যা ছোটদের ছাড়াও বড়দেরও মন মাতিয়ে তোলে। আমরা তাঁর লেখা এমন একটা ছড়ার উদাহরণ দিতে পারি, যার প্রসঙ্গ জাপান হলেও তিনি কী সুন্দর সুন্দর শব্দে ছড়াটিকে শ্রুতিময় ও মজাদার করে সৃষ্টি করেছেন। 

হাসাহাসি তাকাতাকি
বাড়ী তার কিয়োতো।
জাপানেতে যাও যদি
খোঁজ তার নিয়োতো।
হয়তো বা ভুলে গেছি
বাড়ী তাঁর তোকিয়ো
তোকিয়েতে গেলে তুমি
বাড়ীটাকে রোকিয়ো। ’

তাঁর লেখা ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য বিশেষভাবে দেখবার মতো। শব্দে সামান্যতম বিকৃতি ঘটিয়েও ওপরের ছড়াটির পংক্তিতে পংক্তিতে বিষয়ান্তরে যাবার যে পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই অতুলনীয়। পংক্তিতে পংক্তিতে অন্তমিলের অসংখ্য মজার মজার ছড়া তিনি রচনা করেছেন। অন্তমিলের বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর এমন একটা ছড়া-----

‘বলছি শোন কী ব্যাপার
ডাকল আমার পদ্মাপার
আধা ঘন্টা আকাশ পাড়ি
তারি জন্যে ঝকমারি।’

বাংলা শব্দে কোন প্রকার হেরফের না ঘটিয়েও ছন্দের জাদু ছড়ানোর ভুরি ভুরি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। অন্তমিল ছাড়াও অসাধারণ আঙ্গিকের রকমারি ছড়া তিনি রচনা করেছেন। নিচের ছড়াটিতে প্রশ্নের উত্তরে অন্তমিল না থাকলেও অসাধারণ ছন্দের জাদু আছে, তা বোঝা যাবে আবৃত্তি করলে।

‘ যাও কোথা?
চিংড়ি পোতা
কিসের জন্যে?
নিমন্তন্ন।’

অন্নদাশঙ্কর ছড়াকার হিসাবে ছন্দের জাদুকর তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখা অসংখ্য ছড়ার পঙক্তি মালায়। আমরা তাঁর লেখা ছড়ায় ছন্দের জাদু উপভোগ করার চেষ্টা করবো। তবে এ কথা বলতে হয় যে তাঁর লেখা ছন্দছড়ায় ব্যঙ্গবিদ্রুপের আভাস আছে। নিছক আনন্দ দেবার মাঝে তিনি তাঁর লেখা ছড়াতে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

‘ হা হা,
সত্যভূষণ রাহা
যে কথা বললে তুমি
সত্য বটে তাহা!
চামচিকেরা ফুলকপি খায়
কেউ জানে না, আহা!” 

তাঁর লেখা নিচের ছড়াটির অর্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো। এ ছড়াটি ছোটদের খুব ভাল লাগবে এর শব্দের গাঁথুনি ও ছন্দ মিলের জন্য। ছড়াটিতে অবশ্যই একটা মর্মকথা আছে, যা বড়দেরকেও ভাবায়। দেখা যায় এ ছড়াটিতে ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর কি বলেছেন।

‘ আদুড় বাদুড় চালতা বাদুড়
বাদুড় দেখসে
ট্রামগাড়িতে ঝুলছে বাদুড় টিকিট না কেটে
রেলগাড়িতে ঝুলছে বাদুড় প্রাণটি পকেটে।’

বাংলা ভাষায় চিরায়ত ছড়ার প্রাচীনত্বের কথা না বলে শেষ করা যায় না। অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলার চিরায়ত ছড়ার সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন ছড়া। এমনই একটি ছড়া---

‘ উলু উলু মাদারের ফুল
বর এসেছে কত দূর?
বর নয় গো বিশ্ব কাপ
দিগি¦জয়ের শেষ ভাগ।’

তাঁর ‘বিন্নি ধানের খই’ ছড়ার বইতে এ ধরনের একাধিক ছড়া আছে। সে সব ছড়ায় তিনি বিষয় বৈচিত্র্যের জারিজুরি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ছোটদের মনে আনন্দ দেবার মতো ছড়া ছাড়াও তিনি রচনা করেছেন বড়দের জন্য বিখ্যাত বিখ্যাত ছড়া। পঙক্তিতে পঙক্তিতে যে মিল তিনি দেখিয়েছেন তা অপূর্ব। এবার যে ছড়াটির তুলে ধরবো তা বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত ছড়া হিসাবে বিশেষ স্থান লাভ করেছে।

‘ভুল হয়ে গেছে 
বিলকুল 
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয় নি
নজরুল।’

তিনি দেশভাগ পূর্ব থেকে দেশভাগ উত্তর কালপর্বে ব্রিটিশ ভারতের ও স্বাধীন ভারতের উচ্চপদে আসীন একজন সরকারী আমলা হয়েও সমাজ, সামাজিকতা, রাজনীতি ইত্যাদির নষ্টামিকে সাহসিকতার সঙ্গে তিনি তাঁর ছড়ার তুলে ধরেছেন। দেশভাগের উপর তার লেখা বিখ্যাত ছড়াটি এখানে তুলে না ধরলেই নয়। তিনি কখনোই ভাগাভাগিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তবুও ভাগাভাগির খেলা প্রত্যক্ষ করে মর্মবেদনার কথা ব্যক্ত করেছেন ‘ খুকু ও খোকা’ নামের ছড়াটিতে। এ ছড়াটি দেশভাগের পটভূমিকায় ১৯৪৭ সালে লেখা। এ ছড়াটি ছোটদের ছড়ার বই ‘ রাঙা ধানের খই’ এর অন্তর্গত হলেও এটি বড়দের উদ্দেশ্য করে লেখা। দেখা যাক এ ছড়াটিতে প্রশ্নের মাধ্যমে কী অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন।

‘ তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!
তার বেলা?
ভাঙছে প্রদেশ ভাঙছে জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ৎ ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ী!
তার বেলা?

এ ছড়াটি অন্নদাশঙ্করের লেখা ছড়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ছড়াটির শেষ স্তবকে তিনি তাঁর বিস্ময় ও ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে।

অন্নদাশঙ্কর রায় কর্মজীবনে কুষ্টিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। কুষ্টিয়ার স্মৃতি তিনি জীবন থেকে ভুলতে পারেন নি তাঁর লেখা ছড়া থেকে বোঝা যায়। কুষ্টিয়া শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই পেরিয়ে পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-- সেখানে তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্র --- সান্নিধ্য । সে সময় কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার একটা মহকুমা ছিল। কুমারকালী, মেহেরপুর, বীরনগর আর নবদ্বীপ--- সব মিলিয়ে নদীয়া জেলা। ১৯৬৩ সালে লেখা অন্নদাশঙ্করের এই সুন্দর ছড়াটিতে তাঁর যৌবনকালের স্মৃতি উঠে এসেছে কী সুন্দর ভাব মাধুর্যে!

কুমারখালী
এক হাতে বাজে না তালি।
মেহেরপুর
মিটমাট অনেক দূর।
বীরনগর
মনে রেখো না ডর।
নবদ্বীপ
জ্বেলে রেখো প্রেমের প্রদীপ। 

তাঁর লেখা ছড়ার বইগুলোর মধ্যে ‘যাদু এ তো বড় রঙ্গ’ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। তিনি এ বইয়ের ছড়ায় দেখিয়েছেন ছড়া শুধুমাত্র ছোটদেরই ভাল লাগায় না, বড়দেরকেও মনোরঞ্জন করে। এ ছড়ার বইয়ের কয়েকটি ছড়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যাতে আমরা দেখতে পাব বাস্তব সত্যকে রঙ্গরসিকতায় ভরা পঙক্তিমালা তিনি কী সুন্দর অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন। 

‘ কেউ বা ভোলে নগদ টাকায়
কেউ বা পায়ে তেল মাখায়।
কেউ বা ভোলে পদের মায়ায়
কেউ বা ভোলে রাজক্ষমতায়।
এই কথাটটি জেনো খাঁটি
বেড়াল খোঁজে নরম মাটি।’

তাঁর লেখা ব্যঙ্গরঙ্গমূলক ছড়াগুলোর মধ্যে ‘হচ্ছে হবের দেশ’ ছড়াটি থেকে কয়েক লাইন তুলে ধরা যেতে পারে বাস্তব অবস্থাকে তুলে ধরার জন্য।

‘ সব পেয়েছির দেশে নয়
হচ্ছে হবের দেশে
কাঁঠাল গাছে আম ধরেছে
খাবে সবাই শেষে।’ 

সমাজের দুষ্টচক্রের কেরামতির কথা তিনি ছন্দের মাধ্যমে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ভোটযুদ্ধ নিয়েও রঙ্গরসিকতাপূর্ণ ছড়া রচনা করেছেন। উদাহরণ দিলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ সব ছড়াগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক।

‘ জেলখানা যায় যে-ই
গাড়ীঘোড়া চড়ে সে-ই
সে-ই করে ভোট জয়
রাজপাট তারই হয়।’

অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা সব ধরনের ছন্দছড়ার উদাহরণ স্বল্পপরিসরে দেওয়া সম্ভব না হলেও এ কথা পরিশেষে বলতে হয় বাংলা ছড়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 





0 comments:

0

বিশেষ প্রতিবেদনঃ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

Posted in


বিশেষ প্রতিবেদন




শুভ নববর্ষ 
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী



১লা বৈশাখে বাঙালীদের শুভ নববর্ষের সূচনা । এই বৈশাখ মাসকে ধরেই বঙ্গাব্দের সূচনা । যদিও বঙ্গাব্দ কবে থেকে শুরু হয়েছিল এবং কোনটি গ্রহণযোগ্য এ নিয়ে দ্বিমত আছে । সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৫৫৬ খ্রীঃ ১১ এপ্রিল সোমবার ছিল ১লা বৈশাখ । ইতিহাসের একদিক বলছেন এইদিন থেকে বঙ্গাব্দ শুরু । কিন্তু কেন, এই আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসের নানান তথ্য উঠে আসছে । 

প্রাচীন কালে রাজা বাদশারা নিজ নিজ রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময়কালকে এক একটি অব্দ বা সাল গণনা করেছেন । যেমন শকাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ ইত্যাদি । সম্রাট আকবর যখন মোঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি তখন এই উপ-মহাদেশে শকাব্দ, হর্ষাব্দ, বঙ্গাব্দ, পালাব্দ ইত্যাদি প্রচলিত ছিল । সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীঃ ১৫ ফেব্রুয়ারি (হিজরি ৯৬৩) দিল্লীর সিংহাসনে বসেন । এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য আকবরের রাজসভার রাজজ্যোতিষী ও পণ্ডিত আমির সিরাজি ১৫৫৬ খ্রীঃ ১১ এপ্রিলকে নববর্ষ ধরে ৯৬৫ ফসলি সন গননা করার রীতি চালু করেন । আমির সিরাজির সিদ্ধান্ত মত সম্রাট আকবর তার রাজত্বকালে ১৫৫৬ খ্রীঃ থেকে রাজত্বের সর্বত্র এই ফসলি সনের প্রচলন করেন । পরবর্তীকালে এর নাম হয় বঙ্গাব্দ । 

সূর্য পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনা করা হয় তাকে বলে সৌর বর্ষ আর চন্দ্র পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনা করা হয় তাকে বলে চন্দ্র বর্ষ । এই দুই ধরণের মাসকে বলা হয়ে থাকে যথাক্রমে সৌর মাস এবং চন্দ্র মাস । বাংলা সন সৌর সন । খ্রীঃ ৭৮ সাল থেকে আর একটি সৌর সন গণনা করা হয় তার নাম শকাব্দ । এটি ভারতের জাতীয় সন । হিসাব অনুযায়ী ধরা যেতে পারে ২০১৫ সালে শকাব্দের বয়স ১৯৩৭ । শকাব্দের সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে খ্রীষ্টাব্দ পাওয়া যাবে কিংবা খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৮ বিয়োগ করলে শকাব্দ পাওয়া যাবে । শকাব্দ এবং বঙ্গাব্দ উভয়েই সৌর অব্দ তাই দুই অব্দের তেমন কোনো তারতম্য দেখা যায় না । এখন খ্রিষ্টাব্দ ২০১৫, শকাব্দ ১৯৩৭ বঙ্গাব্দ ১৪২১ । বঙ্গাব্দের সঙ্গে ৫১৬ যোগ করলে শকাব্দ পাওয়া যাবে । এটা আমরা সবাই জানি । সম্রাট আকবরের আমলে বঙ্গাব্দের যে বছর সৃষ্টি হয় দেখা যাচ্ছে সে বছরই তার বয়স ৯৬৩ বছর । সেই কারণে বলা যায় হিজরি সনের প্রথম থেকে ৯৬৩ বছর পর্যন্ত বঙ্গাব্দের প্রথম পর্যায় । কিন্তু বহু গবেষক এবং ইতিহাস বিদরা আবার ভিন্ন মত পোষণ করেছেন । কেউ কেউ মনে করেন সম্রাট আকবরের আমলে ৯৬৩ হিজরি ৯৬৩ বঙ্গাব্দ বলে যা শোনা যায় তা সম্ভবত ঠিক নয় । পাকিস্তানের বিশিষ্ট গবেষক ইতিহাসবিদ গোলাম মুরশিদ ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের এক পত্রিকায় লিখেছিলেন যার সারমর্ম ছিলো, “সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনের প্রবর্তন হয়নি । এমনকি কোনো মুসলমান কর্তৃক প্রবর্তিত হলে বাঙালি হিন্দুরা তা মেনে নিয়ে তাদের ধর্মকর্মের সংযোগ সাধন করবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয় ।” এই মন্তব্য বঙ্গাব্দ নিয়ে বিতর্ক উসকে দেয় । কারণ হিজরি চন্দ্র মাস অনুযায়ী গণনা করা হয় এবং বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় সৌর মাস অনুযায়ী । 

সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীঃ (৯৬৩ হিজরি) সিংহাসনে বসার পর পরই সারা দেশজুড়ে টানা দশবছর অবিরাম যুদ্ধ করেছিলেন । শোনা যায় যুদ্ধের জন্য সবসময় ঘোড়ায় চড়ে থাকার দরুন তার পা ধনুকের মত বেঁকে গিয়েছিল । যুদ্ধরত সম্রাটের পক্ষে সেসময় আশা করা যায় বঙ্গাব্দ নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল না । দেখা যায় ১৫৭৬ খ্রীঃ পাঠান দায়ুদের কাছ থেকে আকবর গৌড়বঙ্গের অধিকার কেড়ে নেন । তাই ২০ বছর আগে যে অখণ্ড বাংলাদেশ সম্রাটের অধিকারেই ছিল না সেই দেশে কিভাবে হিজরির পরিবর্তে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করলেন সেটিও ভেবে দেখার । কেউ কেউ মনে করেন সে যুগের রীতিনীতি অনুযায়ী হিন্দুদের ধর্ম সংস্কৃতি বিনষ্ট করে অন্য সম্প্রদায়ের বশীভূত করা অন্যতম কারণ হতে পারে ।

অধিকাংশ মানুষ মনে করেন রাজা শশাঙ্কের আমলেই বঙ্গাব্দের সুচনা হয় । খ্রীঃ সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে কিংবা তার কিছু পরে বাংলার স্বাধীন ও পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন শশাঙ্ক । ৫৯৩ খ্রীঃ তিনি গৌড়ের সিংহাসনে বসেন । এই সময় রাজা শশাঙ্কের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে । বাংলাদেশের প্রথম সার্বভৌম বাঙ্গালী রাজা শশাঙ্কের রাজত্বের সূচনাকাল থেকেই বঙ্গাব্দের সূচনা বলেই অধিকাংশেরই অভিমত । দেখা যাচ্ছে, ১লা বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ ছিল সোমবার । ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখটি হলো ৫৯৪ খ্রীঃ ১২ এপ্রিল । প্রথম মাস বৈশাখ । বঙ্গাব্দের সুচনা সোমবার । রাজা শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন । সোমবারটি ছিল শসাঙ্কের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন । শুরু বৈশাখে । এদিকে গুপ্ত যুগ থেকে বৈশাখ মাস হিসাব বর্ষ গণনার যে শুরু হয়েছিল সেই ধারা আজও বিস্ময়কর ভাবে অব্যাহত । গুপ্ত রাজ বংশের বহমান আদর্শ, সংস্কৃতি কৃষ্টির ধারাকে অনুসরণ করেই বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন । তাই বঙ্গাব্দ নিয়ে দুটি মত ধারাবাহিক ভাবে উঠে আসছে । প্রথম মত ১৫৫৬ খ্রীঃ ৯৬৩ হিজরি । অর্থাৎ ৯৬৩ কে ভিত্তি করেই বঙ্গাব্দের সূচনা । বঙ্গাব্দের বর্তমান বয়স হয় ( ১৪২১ – ৯৬৩ ) ৪৫৮ বছর । বঙ্গাব্দের বর্তমান বয়স ৪৫৮ বছর ।

দ্বিতীয় মতানুযায়ী বঙ্গাব্দের সূচনা হয় রাজা শশাঙ্কের আমলে । বঙ্গাব্দের সূচনা কাল ১ ধরা গেলে ১৪১৯ বঙ্গাব্দের বয়স হবে ১৪১৮ । অর্থাৎ (১৪১৮ – ৪৫৮ ) ৯৬০ বছর । বাংলা পঞ্জিকা তৈরী হয় সুর্য সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে । সূর্য সিদ্ধান্ত মতে ১ বছর হল ৩৬৫.২৫৮৭ দিন । কিন্তু ইংরাজি ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী ১ বছর হল ৩৬৫.২৪২২ দিন । এই হিসাব অনুযায়ী বাংলা ক্যালেন্ডার ১ বছর ০.০১৬৫৫৬ দিন বা ২৩ মিনিট ৮৪ সেকেন্ড বেশী । তাই বঙ্গাব্দ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল সূচিত হয়ে আসছে । 

অতি প্রাচীন কালে অগ্রহায়ণ ও পরে ফাল্গুন মাস থেকে নতুন বছর শুরু হতো । মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে খাজনার হিসেবের সুবিধার জন্যই বঙ্গাব্দ শুরু হয় । অথচ ‘পয়লা বৈশাখ’ উৎসবের উৎপত্তি ইংরেজ আমলে । তখন বাঙালি গ্রামসমাজ ছিলো মুখ্যত কৃষিজীবী । সেখানে চড়ক, পৌষ-পার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি ছিলো বড় উৎসব । ঔপনিবেশিক জমানায় দেখা গেল, ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিনটি ছুটি । অগত্যা বাঙালি ভাবলো, সাহেবদের থাকলে আমাদেরই বা নয় কেন ? নগর কলকাতায় তৈরি হলো নতুন এক ‘সেকুলার উৎসব’ । পয়লা বৈশাখ প্রথম থেকেই গ্রামবাংলার নবান্ন বা পৌষ-পার্বণের মতো জনপ্রিয় ছিলো না । আবার ব্রিটিশ শাসকদের ‘বড়দিন’ বা ‘নিয় ইয়ার্স ইভ’-এর গ্ল্যামারও ছিলো না । আজও বাংলার কিছু গ্রামে পয়লা বৈশাখকে ‘বাসি চড়ক’ বলে । 

দেশের সকল প্রান্তের বাঙালিদের মতোই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা একত্রে নববর্ষের উৎসব পালন করে । ত্রিপুরিদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসবকে যৌথভাবে বলা হয় ‘বৈসাবি’ । এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যময় বেশ কিছু মজার বর্ষবরণ উৎসব । ‘বৈসাবি’ অহিংসার, বন্ধুত্বের প্রতীক আর মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন । পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের আধিক্য বেশি । তাঁদের প্রধান উৎসব হলো বিজু । চাকমাদের ধারনা, চৈত্র মাসের শুরুতেই একটি পাখি (বিজু পেইক) এসে বিজু বলে ডাক দিয়ে যায় । এই বিজু পেইক সুমধুর কলতানে বিজু উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে । বাংলা বর্ষপঞ্জী হিসেবে বছরের শেষ দুই দিন, অর্থাৎ ২৯ চৈত্র ফুল বিজু আর ৩০ চৈত্র মূল বিজু পালিত হয় । ফুল বিজুর দিন নদীতে ফুল ভাসিয়ে উৎসবের সূচনা করে চাকমারা দল বেঁধে শিকারে বের হন । মূল বিজুর দিন চাকমারা ভোর উঠে দল বেঁধে ফুল তুলতে বেরোন এবং নদীতে স্নান করেন । তারপর সারা দিন পাড়া বেড়ানো, পিঠে তৈরি করা, ১৫-২০ পদের বিভিন্ন রকম তরকারী রান্নার ধুম পড়ে যায় । মারমাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম সাংগ্রাই । ভালো খাবার খাওয়া, বাড়ি বাড়ি ঘুরতে যাওয়া, সুন্দর কাপড় পরে, নৃত্য-গীতের আয়োজন ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী পানিখেলা বা জলকেলির উৎসব । মারমা যুবক-যুবতীরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে একে অন্যের গায়ে জল ছুঁড়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে । নববর্ষের দিন শুরু হয়ে তিন দিন ধরে চলে এই পানিখেলা । এছাড়াও পিঠে খাইয়ে অতিথি সদ্ব্যবহার, বৌদ্ধ মঠে গিয়ে বুদ্ধপ্রণাম, বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন উৎসবের আনন্দকে বৃদ্ধি করে । ত্রিপুরিদের উৎসব হলো বৈশুখ । খাগড়াছড়িইয়ে এই জনগোষ্ঠীর আধিক্য দেখা যায় । চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন ও বছরের প্রথম দিন এই উৎসব চলে । এই সময়ে সকলে নতুন কাপড় পড়েন এবং বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন । কিশোরীরা কলসি নিয়ে বড়দের খুঁজে খুঁজে স্নান করান । তরুণ – তরুণীরা একসঙ্গে রঙ খেলায় মেতে ওঠেন । রঙ খেলা শেষে সকলে একত্রে স্নান করতে যান । 

পয়লা বৈশাখ । নতুন বছরর প্রথম দিন । নতুন আনন্দ, নতুন সুখ, নতুন কিছু পাবার আশায় ভরা একটি দিন । দেশের সর্বত্র ধর্ষণকাণ্ডের ছড়াছড়ি, রাজনৈতিক হানাহানি, স্কুল-কলেজে ছাত্র রাজনীতির দাঙ্গা, ট্রেন দুর্ঘটনা, জ্বলন্ত ট্রেনে ঘুমন্ত যাত্রীর পুড়ে মরা । এমন আরও অনেক দুঃখ, কষ্টে ভরা যন্ত্রণাময় ঘটনার মোড়কে ঢাকা অভিশপ্ত ১৪২১ সালের বিদায় হয়েছে গত রাত্রে । এসেছে নতুন বছর ১৪২২ । পয়লা বৈশাখে নুতন কিছু অঙ্গীকার, ভালো হওয়ার-ভালো থাকার অঙ্গীকার । পৃথিবী আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে খুশির উৎসারণে । দিকে দিকে সবাই সেজে উঠেছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে । নতুন সাজে-পোষাকে । নতুন রূপে, নতুন মনে । কলকাতায় হালখাতার পূজোর সামগ্রী নিয়ে ভোর রাত থেকেই বিশাল লাইন পড়ে যায় কালীঘাটে মায়ের মন্দিরের সামনে । গ্রামে ও শহরাঞ্চলের দোকানে দোকানে হয় গনেশ ও লক্ষ্মীর পূজো । খোলা হয় লাল সালুতে মোড়া নতুন খাতা । সবাই একাত্ম হয়ে ওঠে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে । ক্রেতারা দোকানে দোকানে মিষ্টি মুখ করেন দলে দলে এসে । দেখা হলেই একমুখ হাসি নিয়ে ‘শুভ নববর্ষ’ বলে বুকে টেনে নেবার পালা চলে । সবাই যেন ভুলে যেতে চায় অতীতের সব মলিনতা । হয়ে উঠতে চায় প্রাণের বন্ধু, আত্মার আত্মীয় । মনে প্রাণে চায় মুছে যাক্‌ পারস্পরিক মতান্তর, বিভেদ, দ্বেষের আগুণ যাক্‌ নিভে । বয়ে যাক প্রেমভালোবাসার স্রোতস্বিনী নদী দেশ দেশান্তরে । মন চায় নববর্ষের এই দিনটিতে বাংলা গানে ভেসে যাই । বাংলা গানের স্বর্ণযুগের বিখ্যাত শিল্পীদের মন মাতানো গানগুলি আজও স্পর্শ করে – ছুঁয়ে যায় ।

অতএব আমরা বলতেই পারি – হে নববর্ষ, এবার এসো সুন্দরের পথ ধরে । শান্তি বিরাজ করুক প্রতি ঘরে ঘরে । হিংসা, দ্বেষ – যা কিছু সব মুছে ফেলে জন্ম নিক অন্য এক নতুন পৃথিবী ।





0 comments:

0

বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত

Posted in



বিশেষ রচনা 



ঈর্ষা নামে আবেগের ঢেউ... 
শৌনক দত্ত



সুস্মি প্রায়শঃ বলতো বাসুর ইগো নেই ভুতেও বিশ্বাস করবেনা। সুস্মি নেই এটা মানতে না পারাও কি ইগো? ঘরময় ছড়িয়ে সুস্মি। বাসু কফি বানাতে বানাতে আনমনেই বিড়বিড় করতে থাকে- 'বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি। নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুষ্পদল। নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহবল। বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার আত্মজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলঙ্কৃত করে ওষ্ঠতল। আমি একা ফুটতে পারি না আমি একা ফোটাতে পারি না রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও। আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।' [বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি,পূর্ণেন্দু পত্রী] আজ ছুটির দিন, কফি নিয়ে বসে বাসু সুস্মির ডাইরি মেলে পাতার পর পাতা উল্টায় একটি পাতায় চোখ আটকে যায় তার। যেখানে লেখা- 'O, beware my Lord of jealousy, It is green-eyed monster which doth mock The meat it feeds on. 'ওথেলো তে শেক্সপিয়র বলেছিলেন। কফিমগে চুমুক দেয় বাসু। সুস্মির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক তারপর বলে ওঠে সুস্মি আমি কি চিনি ঈর্ষা? সুস্মি ছবিতে মৃদু হাসে তারপর বলে ওঠে মানুষ যখন অন্যের চরিত্রে এমন কিছু দেখে, যেটা তার নেই, থাকলে ভালো হতো, তখনই তার ভেতর এই রিপু জেগে ওঠে।

কিছু হারানোর আশঙ্কায় অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষার জন্ম দেয়। আর এই প্রতিক্রিয়া যখন মনে অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তখন তা হয় ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বা হিংসা। তাছাড়া 'আমিত্ব'বড় হয়ে ওঠে যখন তখনই ঈর্ষা বাসা বাঁধে বুকের গহীনে। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা জন্মে না তাই প্রকৃত সন্ন্যাসীর ঈর্ষা আছে বলে শোনা যায় না। গৌরাঙ্গ শাস্ত্র গুলে খেয়ে যখন গঙ্গায় ভাসিয়ে চৈতন্য হলেন তখন তার আর কোন আকাঙ্ক্ষা ছিলো না তাই তার ঈর্ষাও ছিলো না। সেই জন্যই মাতালের কাছে আঘাত পেয়েও তিনি ঈর্ষা বা হিংসা না করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের তবে ঈর্ষা ছিলো? বাসু প্রশ্ন করে। সুস্মি হাসে আবার দশদিককে বেদিশা করে দিতে থাকে। বাসু কফি মগে চুমুক দেয়। 'মোরে আরো আরো দাও প্রাণ' মোবাইল বেজে ওঠে, ডাক্তার শিঞ্চনের কল। বাসু কলটা ধরে না। সে জানে শিঞ্চন বলবে, ওষুধ খেয়েছিস? বিশ্বাস করবে না সে সুস্মির সাথে কথা বলছে। মোবাইল বেজে যায়। বাসু মোবাইলের সুইচটা অফ করে দেয়। ডাইরির পাতা উল্টায়। পবিত্র কোরান শরীফের একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- 'এবং বেহেশতে তোমরা প্রবশে করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়।' এর সরল অর্থ দাঁড়ায় শুধু বেহেশতের মানুষ ঈর্ষামুক্ত, ধুলাবালির পৃথিবীতে নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি ঈর্ষা এক অর্থে আমাদের চালিকাশক্তি। সভ্যতার বিকাশে এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ? পৃথিবীর ধুলোবালিতে যখন তার প্রিয় সখী দ্রৌপদী লাঞ্চিত হলেন নোংরা পুরুষতন্ত্রের ঈর্ষায় তখন শ্রীকৃষ্ণ ঈর্ষা পরায়ণ হয়েছিলেন সভ্যতার কারণেই। এই মানবিক দুর্বলতামুক্ত হওয়া মহাপুরুষের পক্ষেও সম্ভব নয় হয়ত!

বাসু উঠে যাও কফির শেষ চুমুক ফেলে রেখে। সুস্মির ছবির পাশে রাখা মনোবিজ্ঞানের বইটি নেবার আগে ছবিতে পরশ বুলিয়ে বইটি তুলে আনে। তার বুকের ভেতর ঈর্ষার পরাণ টলমলো। সুস্মি হাসে, আমাকে নিয়ে তোমার ঈর্ষা ছিলো, মনে পড়ছে বাসু? তিনশ বার পাতাটি পড়ো বইটির। বাসু পাতা উল্টে পড়তে থাকে ঈর্ষা একজন স্বাভাবিক মানুষের অস্বাভাবিক প্রবৃত্তি বা আবেগ। এটি কখনো দৃশ্যমান, কখনো অপ্রকাশ্য। এই প্রবৃত্তির পরিধি কিন্তু খুব ছোট। মানুষের চেনাজানা গন্ডির ভেতর এর আবর্ত। আপনার বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী আপনাকে ঈর্ষা করে। কেন করে? যখন আপনি এমন কিছু করেন বা প্রাপ্ত হন, তখন অন্যের না পারার বা না পাবার বেদনাই সৃষ্টি করে ঈর্ষা বা হিংসা। পৃথিবীর সকল মানুষের সকল প্রাপ্তির পেছনেই আছে ঈষার বিষ। ঈর্ষার অপর পিঠেই খোদাই করা আছে ক্ষতি করার প্রবণতা। আপনি যখনই কিছু অর্জন করবেন, তখনই জানবেন আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে কিছু মানুষ, ঈর্ষানেশ্বীর লাইন। যারা এখন আপনার ক্ষতি বা অপপ্রচার করার জন্য প্রস্তুত। বাসু উঠে দাঁড়ায় আজ কি সে ঈর্ষাহীন চৈতন্য, হিংসাহীন লোক যার পেছনে কারো লাইন নেই কেবল হাহুতাস। জানালার ওপার থেকে ভেসে আসছে শবযাত্রার ধ্বনি হরি বোল, বোল হরি। পলকে ঘুরে দাঁড়ায় বাসু সুস্মির চোখে এক অলৌকিক সময় যেন ঈর্ষা মরে গেছে কিংবা ঈর্ষা করা শবের পেছনে ঈর্ষার যাত্রা যাত্রা যাত্রা কেবল...





0 comments:

1

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক 



আমার বারুদ বেলা
স্বপন দেব



আমার বারুদ বেলা আসলে আমার যৌবন বেলা। এবং সেটা সত্যিই ছিল বারুদের গন্ধে ভরা। সময়কালের ব্যপ্তি মোটামুটি ষাটের দশকের শুরু থেকে সত্তরের দশকের গোড়া অবধি। সেইসময় টা ছিল একেবারেই অন্যরকম। ৬২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সময়কাল টাই ছিল আমার বারুদ বেলা। এই দশ বছরের সীমাটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটা দলিল হিসেবে রেখে যেতে চাই। তাই অবশ্যই হবে এটা একটা ধারাবাহিক রচনা।

১৯৬২ সালে আমার বয়েস মাত্র ১৫ হলেও আমার এক দাদা রথীন্দ্র কৃষ্ণ দেব ছিলেন এক বিশিষ্ট বামপন্থী কমিউনিস্ট শিক্ষক নেতা। তাঁরই সুবাদে বাড়ীতে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের আসা-যাওয়া ছিলই এবং তখন থেকেই এঁদের দেখে, এঁদের সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন, আদর্শবাদ এবং এক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন এঁরা দেখিয়েছিলেন, তা আমার মনকে ভীষন ভাবে আলোড়িত করে ছিল। এই ১৯৬২ সালেই ১২ ই অক্টোবর ভারত সরকার ভারতীয় ফৌজ কে চীন সীমান্ত মুক্ত করার আদেশ দেয়। আর ২০ শে অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরু নির্দেশ দিলেন চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের। যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই চীনা গণ ফৌজের পাল্টা আক্রমণে, সেনা অফিসার সহ কম বেশি সাড়ে তিন হাজার ভারতীয় সৈন্যের প্রায় বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণের পর, চীনা গণফৌজ এক তরফা ভাবে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে- তথাকথিত ম্যাকমোহন লাইনের সাড়ে বারো কিলোমিটার উত্তরে সরে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে বিখ্যাত মনীষী বার্টাণ্ড রাসেল তাঁর, ‘Unarmed Victory’ গ্রন্থে বলেছেন ‘এক বিজয়ী বাহিনীর নিজ থেকেই পিছু হটে যুদ্ধের অবসান ঘোষণা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি’। এই যুদ্ধকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে পরবর্তীতে মন্তব্য করেন , এই যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা অফিসার টি এন কল তাঁর ‘The Untold Story’ গ্রন্থে এবং মেজর জেনারেল দলভি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Himalayan Blunder’-এ।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই সমস্ত ঘটনা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে গোষ্ঠীবিন্যাসের ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার করল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘চীনপন্থী’ আর ‘রুশপন্থী’ মেরুকরণ চলতে লাগল। ভারত সরকার এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ভারত রক্ষা আইনে ( D.I.R ) রুশপন্থীদের বাইরে রেখে বেছে বেছে চীনপন্থীদের জেলে ভরতে লাগল। সরকারি ও বেসরকারি বাজারি প্রচার মাধ্যমে ‘রুশপন্থী’ আর ‘চিনপন্থী’ অংশ চিহ্নিত হল ‘দেশপ্রেমিক’ আর ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে।

পশ্চিমবঙ্গে ছাত্রফ্রন্টের পার্টিসভ্যদের একাংশের মধ্যে অনেকদিন আগে থেকেই সংগঠনের কাজের গতানুগতিকতা বা স্থিতবস্থা সম্পর্কে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছিল। ছাত্রফ্রন্ট থেকে সেইসময়ে যে দু’জন সদস্য পার্টির রাজ্যপরিষদের সদস্য ছিলেন, তাঁদের দু’জনেই ছিলেন রুশপন্থী। এঁদের নাম গুরুদাস দাশগুপ্ত এবং নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। দীনেশ মজুমদার ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। তিনি ছিলেন চীনপন্থী। তিনি প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং জেলাস্তরের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নতুন ছাত্র-ফেডারেশন ( Bengal Provincial Students Federation ) তৈরি করলেন। এরই মধ্যে দিয়ে পার্টি ভাঙ্গনের আরও একটি ধাপ সম্পন্ন হল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গোষ্ঠী কোন্দল তখন তুঙ্গে। এই পটভূমিতে অন্ধ্র রাজ্যের তেনালীতে ১৯৬৪ সালের ১১ই জুলাই অনুষ্ঠিত হল তেনালী কনভেনশন। ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তেনালী কনভেনশন’ নামেই এই কনভেনশন খ্যাত। এইসময়ে এবং এর পরবর্তী কালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নামে সমান্তরাল দু’টি সংগঠন এর জন্ম হল।

এই ১৯৬৪ সালেই আমি হায়ার সেকন্ডারি পাশ করে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হলাম। শুরু হল, আমার বারুদ-বেলা। আমার বারুদবেলার গল্প শুরু করার আগে তাই সেই সময়কার রাজনৈতিক এবং সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকাটা সেরে রাখলাম। 

১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের সেশন শুরু হল। প্রথমদিন কলেজে গিয়ে পেলাম বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র-ফেডারেশনের একটা হলুদ রঙের কার্ড, যাতে লেখা “এসো উৎসুক চিত্ত, এসো আনন্দিত প্রাণ”। চিত্ত সেইসময়ে সত্যি ই উৎসুক। এর কয়েক দিন পরেই কলেজে ঢোকার মুখেই শুনলাম এক ছাত্র-নেতা জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। তাঁর বক্তৃতার একটা বাক্য-বন্ধ আমার গোটা জীবনটাই বদলে দিল !! “রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তি !” হ্যাঁ। ঠিক এই বাক্য-বন্ধটি ই তিনি ব্যবহার করেছিলেন। সেদিন বুঝিনি। তখন বুঝিনি। বেশ কিছুদিন বাদে যখন গা থেকে আনকোরা গন্ধটা কেটে গেছে, তখন একদিন কমনরুমে ঐ ছাত্রনেতাটিকে দেখলাম টেবিল টেনিস খেলতে। আমাদের বাড়িতে সেইসময়ে একটা খুব ভালো টেবিল টেনিস বোর্ড ছিল এবং আমি আমার অন্যান্য জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো ভাই বোনেদের সঙ্গে খুব খেলতাম। তাই খেলাটা ভালোই রপ্ত ছিল। সাহস করে আমি সেই দাদাটিকে বললাম, আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন ? উনি বললেন, আয় আয়, কোনদিন খেলেছিস ? আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই বললেন, আমার সঙ্গে খেল ! খেললাম, এবং অবলীলায় ওনাকে হারিয়ে দিলাম ! উনি এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই তো কলেজের গর্ব রে ! জানিস এই কলেজে আমিই চ্যাম্পিয়ন ? আলাপ হল। আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা আপনি সেদিন বক্তৃতায় “রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তি” কথাটা বলেছিলেন কেন ? ওটা তো খারাপ কথা। উনি মোটেও রাগ করলেন না। স-বিস্তারে আমাকে বোঝালেন ডাঙ্গে পন্থী অপর একটি ছাত্র-সংগঠন যাদেরও নাম বি পি এস এফ, তারা কিভাবে কংগ্রেসের লেজুড় বৃত্তি করছে। সেই শুরু হল। নেতাটি এখনও জীবিত। নরওয়েতে থাকেন। বছরে দু’বার কোলকাতায় আসেন এবং এলেই আমাকে ফোন করে ডেকে নেন। পরে আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে তুই করে ডাকতাম ও। সেই আমাকে আলাপ করিয়ে দিল। আমার থেকে মাত্র তিন বছরের সিনিয়র, মানে আমি কলেজে ঢুকেছি আর উনি কলেজ থেকে বেরিয়েছেন, সেই সময়ের দাপুটে ছাত্রনেতা শ্যামল চক্রবর্তির সাথে। শ্যামলদা’র সঙ্গে আমি প্রথম বউবাজারে বিপিএস এফ এর অফিসে গেলাম। সেখানে আলাপ হল সুভাষ চক্রবর্তি, দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস এবং আরো অনেকের সঙ্গে। এরপর থেকেই নিয়মিত বউবাজারের অফিসে যাওয়া শুরু হল আমার। সেখানে তখন রীতিমতো পার্টি ক্লাস হত। আমি জানলাম যে, একমাত্র সশস্ত্র-বিপ্লবের দ্বারাই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক এবং মধ্যবিত্তদের সংগঠিত করে লড়াই শুরু করতে হবে। ক্ষমতা দখলের লড়াই। শুরু হল এক নতুন জীবনের সন্ধানে আমার পথ চলা……আমার স্বপ্ন দেখা…( চলবে )।




1 comments: