ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ছুটি কথা ৮
নন্দিনী সেনগুপ্ত
আগেই বহুবার বলেছি যে আমাদের ছোটবেলায় পড়াশুনার বিশেষ চাপ ছিল না। ইস্কুল বাড়ির কাছেই, বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়; কিন্তু প্রাইমারী অবধি আমার মনে আছে আমি ইস্কুলে যেতে বিশেষ পছন্দ করতাম না। এর একটা বড় কারণ সম্ভবত আমার বয়সের তুলনায় বিজ্ঞ ভাবের জন্য আমি খুব বেশী বন্ধু বানাতে পারতাম না। সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম সপ্তাহের শেষে শনি আর রবিবার, এই দুটি ছুটির দিনের জন্য। ক্লাস ফোর অবধি প্রাইমারী আর ওয়ানের আগে এক বছর, সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছরে আমার সবচেয়ে পছন্দের সময় ছিল ওয়ানের আগে নার্সারির এক বছর। আজ যখন পিছন ফিরে দেখি, তখন দেখতে পাই যে- প্রিয় সময় বলেই হয়তো স্মৃতিপটে হুবহু আঁকা হয়ে রয়েছে সাড়ে তিন বছর বয়সের কিছু স্মৃতি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার মুহূর্তটাও মনে আছে। আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই মা মুখে মুখে শিখিয়েছিলেন কবিতা। না, কোনও শিশুভোলানো ছড়া ইত্যাদি দিয়ে আমার কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় নয়। স্পষ্ট মনে আছে, আত্মীয়স্বজন বা বাবার বন্ধুবান্ধব আমার শিশুবেলাতেই আমাকে দেখলে এরকম বলতেন না যে, ‘একটা ছড়া বল’, বরং বলতেন যে ‘একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও’। আমি দুহাত জোড় করে কাটা কাটা গলায় বলতাম, ‘নমস্কার’। তারপর হাল্কা একটা দম নিয়ে বলতাম, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের... ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। হ্যাঁ, পুরো কবিতাটা বলে তবেই থামতাম। বিশেষ জায়গায় বিশেষ ঝোঁক দিয়ে বলতাম কবিতাটা। ছন্দের ওঠাপড়া ঐ শিশুবয়সেই বেশ ভালো লাগতো। স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েও ঐ কবিতাটাই বলেছিলাম। হেডমিস্ট্রেস বীণা মুখোপাধ্যায় চমৎকৃত হয়ে ভেবেছিলেন কোন ক্লাসের ফর্ম দেওয়া যায়। ঐ আবৃত্তি শোনবার আগে বয়েস দেখে মাকে বলেছিলেন, ‘বড্ড ছোট তো, আর এক বছর পরে ভর্তি করলে হত না?’ তিনিই কবিতা শুনে বলেছিলেন, ‘ওরে বাবা, নার্সারি কেন? ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেও সব পারবে’। তারপর খাতায় লিখে দিয়েছিলেন পেন্সিল দিয়ে ‘অ-আ-ই-ঈ’। কাছে টেনে হাতে ঐ পেন্সিলটাই দিয়ে বলেছিলেন ‘একবার হাত বোলাও তো’! আমি হাত বোলাবো কি, মনোযোগ দিয়ে পেন্সিলটাই দেখতে লাগলাম; চকচকে হলুদ রঙের পেন্সিল, নিখুঁত করে কল দিয়ে কাটা, পেছনে একটা রূপালী রঙের আংটির মত লাগানো, সেই আংটির পিছনে হাল্কা গোলাপী রঙের ইরেজার। অত সুন্দর পেন্সিলে হাত দেওয়া বা তা দিয়ে লেখা তো দূরের কথা, আমি কখনও ঐ বয়সে চোখেও দেখিনি। যাই হোক, কোনও মতে নিজেকে সামলে নিয়ে অক্ষরগুলিতে বুলিয়ে দিলাম হাত; আহ, এই পেন্সিলে দেখলাম দাগগুলোও ভারী নরম আর স্পষ্ট হয়ে পড়ে। হাত বোলাবার পরে মনে হল যে অক্ষরগুলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্যস, ঐ হয়ে গেলো আমার এডমিশান টেস্ট। পরবর্তী সময়ে নিজের সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতেও আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। হয়তো এটা আমারি সৌভাগ্য বলা চলে। আজকাল যখন শুনি বড় বড় নামীদামী ইস্কুলে এমনকি আমার ইস্কুল, বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়েও শিশুভর্তির দীর্ঘায়িত এবং রুদ্ধশ্বাস টেনশানে ভরা প্রক্রিয়া, তখন নিজের শিশুবেলার ঐ দিনটিকে অলীক, অবিশ্বাস্য এক স্বপ্নের মত মনে হয়।
আমাদের শিশুকালে ইস্কুলের সেশন শুরু হত বছরের প্রথমে। আমার স্কুলের প্রথম দিন ছিল ২রা জানুয়ারি, সন ১৯৭৫। নার্সারি ক্লাসে কোনও ইউনিফর্ম ছিল না। যে যেমন খুশি পোশাক পরে ইস্কুলে যেতে পারতো। আমার একটা মেরুন রঙের কোট আর ফুলপ্যান্ট ছিল; খুবই শীতের সময়, তার ওপর ভোরবেলা। আমি ঐ পোশাক পরে ইস্কুলে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, খালিহাতেই, কোনও বইখাতা নিয়ে যাই নি প্রথমদিন। কাঁধে ঝোলানো ছিল একটা জলের বোতল। মা একটা কাগজে মুড়ে নলেনগুড়ের সন্দেশ ঢুকিয়ে দিয়েছিল কোটের বাঁদিকের পকেটে যেটা আমার প্রায় পেটের কাছেই ছিল। মা বারবার বলে দিয়েছিল, ‘মামনি, খেয়ো কিন্তু!’ আসলে হয়তো মায়ের সন্দেহ ছিল যে আমি খাবো কিনা যেটা খুব অমূলক নয়। বাবার হাত ধরে ইস্কুলে পৌঁছালাম। ওমা, গিয়ে দেখি, ঝুমা, যে কিনা আমার পাড়ার বন্ধু আর আত্মীয় দুইই, সেও আমার সঙ্গে একই ক্লাসে। ঝুমা দুদিকে দুটো ঝুঁটি বেঁধে এসেছে। আমার একটু একটু ইচ্ছে করছিল যে একটা টান মেরে ওর ঝুঁটি খুলে দিই, কিন্তু এটা নতুন জায়গা, এখানে এসব করা ঠিক হবে না ভেবে বোধ হয় একটু সংযম দেখিয়েছিলাম। তার ওপর ঝুমা যদি ভ্যাঁ করে কাঁদে, তাহলে ওকে কে সামলাবে? এখানে তো আমার বড়মাসিও নেই, যে আবার ঝুমার মামিমা হয় সম্পর্কে। আমি আর ঝুমা ঝগড়াঝাঁটি করলে তো বড়মাসি, যাকে আমি ডাকি ‘বলো’ বলে- সেই ‘বলো’ই সামলায়। যাই হোক, ঝুমা কিন্তু কাঁদে নি। আমার পাড়ার আরও বন্ধু পেয়ে গেলাম, মিলি, জয়ন্তী — না, ওরাও কেউ কাঁদে নি। কিন্তু কেউ কেউ বেজায় কেঁদেছিল। যারা কাঁদছিল, কান্না থামার পর তারা শাস্তি পাচ্ছিল, ওই- দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো আর কি! আমার মনে হল ঐ দেওয়ালে কি আছে? দেওয়ালে কতরকম এবড়োখেবড়ো আর ভাঙা চোরা রেখা দিয়ে কত মজার মজার ছবি, গাছ, পাহাড়, মানুষের মুখ, শরীর এমনকি রবীন্দ্রনাথও বেরিয়ে আসে; আমার বাড়িতে বারান্দার দেওয়ালে একটা টুপি মাথায়, মুখে চুরুট- সাহেব আছে। কিন্তু ক্লাসরুমের দেওয়ালটা খুঁটিয়ে দেখা হল না, কারণ আমি কাঁদি নি আর দেওয়ালে মুখ করে দাঁড়ানোর শাস্তিটাও পেলাম না। আমি যেখানে বসেছি সেখান থেকে দেওয়ালগুলো অনেক দূর, ব্ল্যাকবোর্ডটা বরং কাছে। ব্ল্যাকবোর্ডে ক্যাপিটাল এ বি সি ডি লেখা রয়েছে জেড পর্যন্ত। ওগুলো তো আমি সব জানি। বাবা ক-অ-বে শিখিয়েছে লাইন ভর্তি করে লিখতে। ক্যাপিটাল, স্মল, এমনকি বি-এ-টি ব্যাট, সি-এ-টি ক্যাট লিখতেও জানি। এইসব বসে বসে ব্ল্যাকবোর্ডে দেখবার চেয়ে বোধহয় ঢের ভালো হত শাস্তি পেয়ে দেওয়াল দেখা। একটু একটু আফসোস হল দেওয়ালগুলো দেখা হল না বলে, একবার ভাবলাম একটু চেষ্টা করে কাঁদলে কেমন হয়? তাহলে... কিন্তু না, কান্না এলো না। বরং আমাদের আবার অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল, একটা উঠোনে। যাহ্, আমার আর দেওয়াল দেখা হল না ঐদিন। আমাদের উঠোনের মাঝখানে গোল করে দাঁড় করিয়ে এই ক্লাসের যিনি দিদিমণি, গায়ত্রী দি, তিনি গান আর নাচ আমাদের সঙ্গেও করতে লাগলেন, ‘ইন্দি-বিন্দি-সিন্দির গান’, তারপর ‘হাটটীমা টীম টীম’, তারপর ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল’, তারপর ‘রো- রো- রো ইয়োর বোট’... এইরকম সব। সবই বাচ্চাদের ছড়া আর গান। আমি তদ্দিনে চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা এইসব নৃত্যনাট্যের নাচ-গান দেখে মুখস্ত করে ফেলেছি। এইসব ছড়ায় কি আর মন ওঠে? যাই হোক, না করলে সবার সঙ্গে, সে ভারী অভদ্রতা, তাই আমিও নাচ-গান করলাম। এইসব হতে হতেই তো ঢং ঢং করে ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেলো, আর সন্দেশটা খাবো কখন? সেই প্রথম স্কুলের দিনটা টিফিন না খাওয়ার জন্য মায়ের বকা খেয়েছিলাম। মায়ের বকা আজও খাই, তবে তফাতটা এই যে, সেটা এখন সন্দেশের থেকেও মিষ্টি লাগে।
0 comments: