প্রবন্ধঃ মনোজিৎকুমার দাস
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
অন্নদাশঙ্কর রায়ের রম্য ছন্দছড়া
মনোজিৎকুমার দাস
অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪----২০০২) বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, গল্প,উপন্যাস, ছড়া বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম ছড়াকার। তাঁকে ছন্দছড়ার রাজা বললে ভুল বলা হয় না। তাঁর লেখা ছড়ার সংখ্যা প্রায় ৬০০। ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য এবং সবার জন্য নানা আঙ্গিক, নানা ছন্দ ও নানা রীতিতে চিত্তাকর্ষক ছড়া তিনি রচনা করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, তিনি নিজেই একজন ছড়াকার। নিজের লেখা ছড়ায় তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর ছড়া লেখার অভিব্যক্তি।
এক কোণে আমি রচি ছড়া
বিনা ভাগে ভোগ করি ধরা।’
অন্নদাশঙ্করের লেখা রাঙা ধানের খই’, ‘আতা গাছে তোতা পাখি’, ‘হৈরে বাবু হৈ’, ‘রাঙা মাথায় চিরুনি’, ‘ বিন্নি ধানের খই’, ‘ সাত ভাই চম্পা’, ‘দোলদোল দুলুনি’, শালিধানের চিড়ে’, ‘ যাদু এ তো বড় রঙ্গ’ ইত্যাদি ছড়ার বইগুলোর নামের মধ্যেই মজার গন্ধ ছড়িয়ে আছে।
তাঁর লেখা ছড়াগুলোর নামকরণ থেকে ছড়ার বিষয় বস্তু এবং শব্দ ও ছন্দের দোলা সহজেই অনুধাবন করা যায়। তিনি তাঁর লেখা ছড়ায় শব্দের খেলা দেখিয়েছেন। ছড়ার অন্তমিলের জন্য ব্যাকরণের নিয়মকে অগ্রাহ্য করে নতুন শব্দ সৃষ্টি করে মজার মজার ছড়া রচনা করেছেন, যাতে ছন্দ মাধুর্য কোনভাবেই নষ্ট হয় নি। ব্যাকরণের প্রথা না মেনেও অন্তমিল রক্ষা করেছেন অতি মুনশিয়ানার সঙ্গে। নিচের উদাহরণই তার প্রমাণ।
১) বৃষ্টি পড়ে টাপুর টাপ
বসে আছি চুপুর চাপ।’
২) মিউ মিউ
এবার একটা বিড়াল ধরা
কল এনে দিউ।
ছন্দ মিলের জন্য শব্দের যে অভিঘাত ঘটিয়ে তিনি যে সব ছড়া লিখেছেন তা যে কত মজার সেটাই উঠে এসেছে নিচের দুটো ছড়ার কিয়দাংশ থেকে।
১) বন্দে আলি খান ছিল
গাছের ডাল ভাঙছিল।
২) এক যে ছিল অসুর
রাবণ তার শ্বশুর।
অন্নদাশঙ্কর ছোটদেরকে আনন্দ দেবার জন্য মজার মজার ছড়া রচনা করেছেন নানা ছন্দে। তাঁর ছড়ায় শব্দ চয়ন এতই সুন্দর যা ছোটদের ছাড়াও বড়দেরও মন মাতিয়ে তোলে। আমরা তাঁর লেখা এমন একটা ছড়ার উদাহরণ দিতে পারি, যার প্রসঙ্গ জাপান হলেও তিনি কী সুন্দর সুন্দর শব্দে ছড়াটিকে শ্রুতিময় ও মজাদার করে সৃষ্টি করেছেন।
হাসাহাসি তাকাতাকি
বাড়ী তার কিয়োতো।
জাপানেতে যাও যদি
খোঁজ তার নিয়োতো।
হয়তো বা ভুলে গেছি
বাড়ী তাঁর তোকিয়ো
তোকিয়েতে গেলে তুমি
বাড়ীটাকে রোকিয়ো। ’
তাঁর লেখা ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য বিশেষভাবে দেখবার মতো। শব্দে সামান্যতম বিকৃতি ঘটিয়েও ওপরের ছড়াটির পংক্তিতে পংক্তিতে বিষয়ান্তরে যাবার যে পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই অতুলনীয়। পংক্তিতে পংক্তিতে অন্তমিলের অসংখ্য মজার মজার ছড়া তিনি রচনা করেছেন। অন্তমিলের বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর এমন একটা ছড়া-----
‘বলছি শোন কী ব্যাপার
ডাকল আমার পদ্মাপার
আধা ঘন্টা আকাশ পাড়ি
তারি জন্যে ঝকমারি।’
বাংলা শব্দে কোন প্রকার হেরফের না ঘটিয়েও ছন্দের জাদু ছড়ানোর ভুরি ভুরি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। অন্তমিল ছাড়াও অসাধারণ আঙ্গিকের রকমারি ছড়া তিনি রচনা করেছেন। নিচের ছড়াটিতে প্রশ্নের উত্তরে অন্তমিল না থাকলেও অসাধারণ ছন্দের জাদু আছে, তা বোঝা যাবে আবৃত্তি করলে।
‘ যাও কোথা?
চিংড়ি পোতা
কিসের জন্যে?
নিমন্তন্ন।’
অন্নদাশঙ্কর ছড়াকার হিসাবে ছন্দের জাদুকর তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখা অসংখ্য ছড়ার পঙক্তি মালায়। আমরা তাঁর লেখা ছড়ায় ছন্দের জাদু উপভোগ করার চেষ্টা করবো। তবে এ কথা বলতে হয় যে তাঁর লেখা ছন্দছড়ায় ব্যঙ্গবিদ্রুপের আভাস আছে। নিছক আনন্দ দেবার মাঝে তিনি তাঁর লেখা ছড়াতে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
‘ হা হা,
সত্যভূষণ রাহা
যে কথা বললে তুমি
সত্য বটে তাহা!
চামচিকেরা ফুলকপি খায়
কেউ জানে না, আহা!”
তাঁর লেখা নিচের ছড়াটির অর্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো। এ ছড়াটি ছোটদের খুব ভাল লাগবে এর শব্দের গাঁথুনি ও ছন্দ মিলের জন্য। ছড়াটিতে অবশ্যই একটা মর্মকথা আছে, যা বড়দেরকেও ভাবায়। দেখা যায় এ ছড়াটিতে ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর কি বলেছেন।
‘ আদুড় বাদুড় চালতা বাদুড়
বাদুড় দেখসে
ট্রামগাড়িতে ঝুলছে বাদুড় টিকিট না কেটে
রেলগাড়িতে ঝুলছে বাদুড় প্রাণটি পকেটে।’
বাংলা ভাষায় চিরায়ত ছড়ার প্রাচীনত্বের কথা না বলে শেষ করা যায় না। অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলার চিরায়ত ছড়ার সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন ছড়া। এমনই একটি ছড়া---
‘ উলু উলু মাদারের ফুল
বর এসেছে কত দূর?
বর নয় গো বিশ্ব কাপ
দিগি¦জয়ের শেষ ভাগ।’
তাঁর ‘বিন্নি ধানের খই’ ছড়ার বইতে এ ধরনের একাধিক ছড়া আছে। সে সব ছড়ায় তিনি বিষয় বৈচিত্র্যের জারিজুরি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ছোটদের মনে আনন্দ দেবার মতো ছড়া ছাড়াও তিনি রচনা করেছেন বড়দের জন্য বিখ্যাত বিখ্যাত ছড়া। পঙক্তিতে পঙক্তিতে যে মিল তিনি দেখিয়েছেন তা অপূর্ব। এবার যে ছড়াটির তুলে ধরবো তা বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত ছড়া হিসাবে বিশেষ স্থান লাভ করেছে।
‘ভুল হয়ে গেছে
বিলকুল
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয় নি
নজরুল।’
তিনি দেশভাগ পূর্ব থেকে দেশভাগ উত্তর কালপর্বে ব্রিটিশ ভারতের ও স্বাধীন ভারতের উচ্চপদে আসীন একজন সরকারী আমলা হয়েও সমাজ, সামাজিকতা, রাজনীতি ইত্যাদির নষ্টামিকে সাহসিকতার সঙ্গে তিনি তাঁর ছড়ার তুলে ধরেছেন। দেশভাগের উপর তার লেখা বিখ্যাত ছড়াটি এখানে তুলে না ধরলেই নয়। তিনি কখনোই ভাগাভাগিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তবুও ভাগাভাগির খেলা প্রত্যক্ষ করে মর্মবেদনার কথা ব্যক্ত করেছেন ‘ খুকু ও খোকা’ নামের ছড়াটিতে। এ ছড়াটি দেশভাগের পটভূমিকায় ১৯৪৭ সালে লেখা। এ ছড়াটি ছোটদের ছড়ার বই ‘ রাঙা ধানের খই’ এর অন্তর্গত হলেও এটি বড়দের উদ্দেশ্য করে লেখা। দেখা যাক এ ছড়াটিতে প্রশ্নের মাধ্যমে কী অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন।
‘ তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!
তার বেলা?
ভাঙছে প্রদেশ ভাঙছে জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ৎ ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ী!
তার বেলা?’
এ ছড়াটি অন্নদাশঙ্করের লেখা ছড়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ছড়াটির শেষ স্তবকে তিনি তাঁর বিস্ময় ও ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে।
অন্নদাশঙ্কর রায় কর্মজীবনে কুষ্টিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। কুষ্টিয়ার স্মৃতি তিনি জীবন থেকে ভুলতে পারেন নি তাঁর লেখা ছড়া থেকে বোঝা যায়। কুষ্টিয়া শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই পেরিয়ে পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-- সেখানে তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্র --- সান্নিধ্য । সে সময় কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার একটা মহকুমা ছিল। কুমারকালী, মেহেরপুর, বীরনগর আর নবদ্বীপ--- সব মিলিয়ে নদীয়া জেলা। ১৯৬৩ সালে লেখা অন্নদাশঙ্করের এই সুন্দর ছড়াটিতে তাঁর যৌবনকালের স্মৃতি উঠে এসেছে কী সুন্দর ভাব মাধুর্যে!
কুমারখালী
এক হাতে বাজে না তালি।
মেহেরপুর
মিটমাট অনেক দূর।
বীরনগর
মনে রেখো না ডর।
নবদ্বীপ
জ্বেলে রেখো প্রেমের প্রদীপ।
তাঁর লেখা ছড়ার বইগুলোর মধ্যে ‘যাদু এ তো বড় রঙ্গ’ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। তিনি এ বইয়ের ছড়ায় দেখিয়েছেন ছড়া শুধুমাত্র ছোটদেরই ভাল লাগায় না, বড়দেরকেও মনোরঞ্জন করে। এ ছড়ার বইয়ের কয়েকটি ছড়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যাতে আমরা দেখতে পাব বাস্তব সত্যকে রঙ্গরসিকতায় ভরা পঙক্তিমালা তিনি কী সুন্দর অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন।
‘ কেউ বা ভোলে নগদ টাকায়
কেউ বা পায়ে তেল মাখায়।
কেউ বা ভোলে পদের মায়ায়
কেউ বা ভোলে রাজক্ষমতায়।
এই কথাটটি জেনো খাঁটি
বেড়াল খোঁজে নরম মাটি।’
তাঁর লেখা ব্যঙ্গরঙ্গমূলক ছড়াগুলোর মধ্যে ‘হচ্ছে হবের দেশ’ ছড়াটি থেকে কয়েক লাইন তুলে ধরা যেতে পারে বাস্তব অবস্থাকে তুলে ধরার জন্য।
‘ সব পেয়েছির দেশে নয়
হচ্ছে হবের দেশে
কাঁঠাল গাছে আম ধরেছে
খাবে সবাই শেষে।’
সমাজের দুষ্টচক্রের কেরামতির কথা তিনি ছন্দের মাধ্যমে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ভোটযুদ্ধ নিয়েও রঙ্গরসিকতাপূর্ণ ছড়া রচনা করেছেন। উদাহরণ দিলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ সব ছড়াগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক।
‘ জেলখানা যায় যে-ই
গাড়ীঘোড়া চড়ে সে-ই
সে-ই করে ভোট জয়
রাজপাট তারই হয়।’
অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা সব ধরনের ছন্দছড়ার উদাহরণ স্বল্পপরিসরে দেওয়া সম্ভব না হলেও এ কথা পরিশেষে বলতে হয় বাংলা ছড়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
0 comments: