প্রবন্ধঃ শ্রীশুভ্র
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
খোলামাঠের গল্প!
শ্রীশুভ্র
খুব বেশী দিন আগের কথাও নয়! আমাদেরই সেই ছেলেবেলার কথা, কত আর হবে- চারদশক আগের কথা মাত্র! মফস্বল শহরেই বেড়ে ওঠা। বাবার বদলির চাকুরির সূত্রে এশহর থেকে ওশহর। আর প্রায় হকে নকেই কলকাতার বাড়িতে ঘুরে যাওয়া! কিন্তু তখনও ছেলেবলার সেইসব দুরন্ত হাত পা ছোঁড়ার দিনগুলোতে খেলার মাঠের বিশেষ অভাব দেখিনি! যেখানেই যাই না কেন, বিকেল হলেই হুটোপুটি করার কিংবা বল নিয়ে দৌড়াবার একটা না একটা মাঠ জুটে যেত ধারে কাছেই। খাস কলকাতায় সেটা হয়তো অতো সহজলভ্য ছিল না, তবুও আমাদের মাঠের অভাবে হাত-পা বিষাদে মনের ভেতর গুটিয়ে আসেনি কোনদিনই! ছেলেবেলার অফুরন্ত উদ্যোমশক্তির বিকাশের একটা প্রশস্ত ক্ষেত্রই হল খেলার মাঠ! খোলা মাঠ! এই খেলার মাঠকে কেন্দ্র করেই শরীর মনের বৃদ্ধি প্রকৃতির সাথে কোলাকুলি করেই রসসঞ্চার করে ব্যক্তিত্বের পরতে! আমরা প্রাণবন্ত হয়ে উঠি!
সেই খেলার মাঠ নিয়েই যে মুক্ত অর্থনীতির জামানায় নতুন এক খেলা জমে উঠবে, সেটা আঁচ করার বয়স ছিল না তখন! যখন হলো, তখন দেখি একে বারে পিসি সরকারের ম্যাজিক! খেয়ালও করতে পারিনি, হঠাৎ দেখি কচিকাঁচাদের সেই খেলার মাঠ জীবনের বাস্তবতায় একেবারে ভ্যানিশ! না ম্যজিক নয়! সত্যি সত্যি ভ্যনিশ! কোন জাদুকরই, সে তিনি যতবড়ই জননেতা হন না কেন, ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠ আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না! আজকের কিশোর কিশোরীদের হুটোপুটি করার ছোটাছুটি করার, দুরন্ত সেই হাত-পা গুলিকে সন্তুষ্ট করার আর কোনো উপায় নেই! সনাতন চীনে মেয়েদের লোহার জুতো পরিয়ে পায়ের পাতা ছোট করে রাখার মতোই আমরা আজকের ছেলেমেয়েদের কম্পিউটার দিয়ে চৌখুপী ফ্ল্যাটবাড়ির 2BHK/3BHK মাপে আটকিয়ে ফেলেছি! চীনের লোহার জুতো হয়ে উঠেছে কম্পিউটার আর গেমস সফ্টওয়ার!
কিন্তু কেন হলো এমন? সবটাই কি খোলাবাজার অর্থনীতি আর প্রযুক্তির রকেটগতির আস্ফালন? তাহলে তো বিশ্বের সবদেশের চিত্রই কম বেশি একরকম হওয়ার কথা! তাই হয়েছে কি? খুব ভালো করে খোঁজ না নিয়েও বলা যায়, না সব দেশের চিত্রই ঠিক আমাদের মতো নয়! এই চিত্র আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই বেশি প্রকট! তাহলে জনবিস্ফোরণই কি মূল কারণ! কারণ তো বটেই, কিন্তু সেটাই তো সব নয়! কারণ আরও হরেক রকম! শুধু জনবিস্ফোরণই যদি মূল কারণ ধরা যায়, তাহলেও বেশ অবাক হতে হয়! আমাদের প্রজণ্মও একাধিক ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে! কিন্তু এখন? এখন তো অধিকাংশ পরিবারেই ছেলেমেযেরা ভাইবোন বলতে খুড়তুতো জ্যাঠতুত মামাতো মাসতুত ভাইবোনই বোঝে! এই যে পরিবার ক্রমশ কৃশকায় হয়ে উঠছে দিনেদিনে, জনবিস্ফোরণে এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না কেন? গত চার দশকেই বাসে ট্রেনে ভীড় বাড়ছে তো বাড়ছেই! এবং একথাও মনে রাখা দরকার এই একই সময়সীমায় পথেঘাটে যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে বিপুল পরিমান। ট্রেনের সংখ্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে! তাহলে রহস্যটা কোথায়?
রহস্য নয়, আসল ঘটনা হল, এই গত চারদশকে এরাজ্যে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের সংখ্যা বেড়ে গেছে বিপুল পরিমানে। এবং প্রায় প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক অবাঙালি এ রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হচ্ছেন। আর এর সাথে রয়েছে গ্রাম উজার করে শহরমুখী মানুষের ঢল। এই বিপুল পরিমানে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের ও শহরমুখী জনস্রোতের স্থায়ী আস্তানার জন্যে গড়ে ওঠা লাভজনক আবাসন শিল্পই গ্রাস করেছে চারদশক আগের ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠ! জনসংখ্যার এই বিপুল চাপ পশ্চিমবঙ্গের মতো এত ক্ষুদ্র একটি রাজ্যের পক্ষে সামলোনো কোন জাদুকরের পক্ষেই সম্ভব নয়! তাই কিশোরকিশোরীদের খেলার মাঠ থেকে কৃষকের বহুফসলী জমি কোনোটাই আর সুরক্ষিত নয়! ইটকাঠ পাথরের এক দুর্ভেদ্য জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক বিকাশের খোলামাঠ!
এই খোলামাঠ আর খোলাবাজার অর্থনীতির মধ্যেও কি একটা ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক নেই? আছে মনে হয়! বর্তমানের পরিবেশ সচেতন ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স সুরক্ষিত রাখার কার্যক্রমগুলি উন্নতবিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেরই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য! আর সেই লক্ষ্যেই খোলাবাজার অর্থনীতির বিশেষ ভুমিকা বর্তমান। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি তাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স সুরক্ষিত রাখার জন্যে এবং উৎপাদিত দ্রব্যের উৎপাদন ব্যায় কমানোর জন্যেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেই কলকারখানাগুলি সরিয়ে ফেলছে। তাতে আমাদের দেশে কিছুপরিমানে কর্মসংস্থান বাড়লেও আমাদের পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য! খোলাবাজার অর্থনীতির হাত ধরেই আমরা পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক এইসব কলকারখানা ও শিল্প বিস্তারে নিজেদের খোলা সবুজ প্রান্তরগুলি, বহুফসলী জমিগুলি খোলাবাজার অর্থনীতির গর্ভে বিসর্জন দিচ্ছি! আর এরই অনুসারী ফল হিসেবেও আবাসন শিল্পের জোয়ার এসে আছড়ে পড়েছে আমাদের রাজ্যেও। ফলে একদিকে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের স্থায়ী ভাবে বসবাস প্রবণতার দ্রুত বৃদ্ধি ও অন্যদিকে এই খোলাবাজার অর্থনীতির রমরমা, এই দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে ক্ষুদ্র এই রাজ্যের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে!
এটাই সেই জাদু! যে জাদুতে হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছে দুরন্ত হাত-পা গুলির জন্যে অতি প্রয়োজনীয় সেই খোলামাঠ, ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠ! কিন্তু খোলামাঠের হারিয়ে যাওয়ার গল্প এখানেই শেষ নয়! এই সেদিনও বাড়িতে বাড়িতে পরিবারের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যেও আরও একটা খোলামাঠ ছিল বড়ো! বাবা-মা দের শাসন নজরদারীর বাইরে আপন ভাইবোনেদের নিত্য দৌরাত্ম খুনসুটি মানঅভিমান খেলাধুলার অনেক বড় প্রশস্ত একটা খোলামাঠ! যে খোলামাঠেই পারিবারিক দায়বদ্ধতা দায়িত্ব কর্তব্য আত্মীয়তার সবচেয়ে বড়ো ও অব্যর্থ পাঠ নিয়ে প্রত্যেকের বেড়ে ওঠার একটি সহজ সুন্দর স্বাভাবিক ছন্দ ছিল ঘরে ঘরে! আজকের শিশুর সেই খোলামাঠটাও হারিয়ে গিয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির চালচিত্রে।
আর এই হারিয়ে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব ব্যক্তিত্বের কাঠামোয় পড়তে বাধ্য। পরিবারের সকলের জন্যে যে দায়বোধ ও আত্মিক বন্ধন মনের গভীরে বহমান থেকে আমাদের মানবিক বিকাশকে সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করতো এতদিন, এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির গণ্ডীতে বেড়ে ওঠা কিশোর কিশোরীদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগটাই আর নেই! ফলে প্রত্যেক মানুষের মনের নিজস্ব খোলামাঠটাও দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের পরিসরে! আমাদের, ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডীতে ঘুরপাক খাওয়ার এই এক অন্যতম বড়ো কারণ! হারিয়ে গেছে সেই খোলামাঠটাও!
0 comments: