বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
ঈর্ষা নামে আবেগের ঢেউ...
শৌনক দত্ত
সুস্মি প্রায়শঃ বলতো বাসুর ইগো নেই ভুতেও বিশ্বাস করবেনা। সুস্মি নেই এটা মানতে না পারাও কি ইগো? ঘরময় ছড়িয়ে সুস্মি। বাসু কফি বানাতে বানাতে আনমনেই বিড়বিড় করতে থাকে- 'বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি। নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুষ্পদল। নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহবল। বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার আত্মজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলঙ্কৃত করে ওষ্ঠতল। আমি একা ফুটতে পারি না আমি একা ফোটাতে পারি না রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও। আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।' [বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি,পূর্ণেন্দু পত্রী] আজ ছুটির দিন, কফি নিয়ে বসে বাসু সুস্মির ডাইরি মেলে পাতার পর পাতা উল্টায় একটি পাতায় চোখ আটকে যায় তার। যেখানে লেখা- 'O, beware my Lord of jealousy, It is green-eyed monster which doth mock The meat it feeds on. 'ওথেলো তে শেক্সপিয়র বলেছিলেন। কফিমগে চুমুক দেয় বাসু। সুস্মির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক তারপর বলে ওঠে সুস্মি আমি কি চিনি ঈর্ষা? সুস্মি ছবিতে মৃদু হাসে তারপর বলে ওঠে মানুষ যখন অন্যের চরিত্রে এমন কিছু দেখে, যেটা তার নেই, থাকলে ভালো হতো, তখনই তার ভেতর এই রিপু জেগে ওঠে।
কিছু হারানোর আশঙ্কায় অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষার জন্ম দেয়। আর এই প্রতিক্রিয়া যখন মনে অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তখন তা হয় ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বা হিংসা। তাছাড়া 'আমিত্ব'বড় হয়ে ওঠে যখন তখনই ঈর্ষা বাসা বাঁধে বুকের গহীনে। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা জন্মে না তাই প্রকৃত সন্ন্যাসীর ঈর্ষা আছে বলে শোনা যায় না। গৌরাঙ্গ শাস্ত্র গুলে খেয়ে যখন গঙ্গায় ভাসিয়ে চৈতন্য হলেন তখন তার আর কোন আকাঙ্ক্ষা ছিলো না তাই তার ঈর্ষাও ছিলো না। সেই জন্যই মাতালের কাছে আঘাত পেয়েও তিনি ঈর্ষা বা হিংসা না করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের তবে ঈর্ষা ছিলো? বাসু প্রশ্ন করে। সুস্মি হাসে আবার দশদিককে বেদিশা করে দিতে থাকে। বাসু কফি মগে চুমুক দেয়। 'মোরে আরো আরো দাও প্রাণ' মোবাইল বেজে ওঠে, ডাক্তার শিঞ্চনের কল। বাসু কলটা ধরে না। সে জানে শিঞ্চন বলবে, ওষুধ খেয়েছিস? বিশ্বাস করবে না সে সুস্মির সাথে কথা বলছে। মোবাইল বেজে যায়। বাসু মোবাইলের সুইচটা অফ করে দেয়। ডাইরির পাতা উল্টায়। পবিত্র কোরান শরীফের একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- 'এবং বেহেশতে তোমরা প্রবশে করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়।' এর সরল অর্থ দাঁড়ায় শুধু বেহেশতের মানুষ ঈর্ষামুক্ত, ধুলাবালির পৃথিবীতে নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি ঈর্ষা এক অর্থে আমাদের চালিকাশক্তি। সভ্যতার বিকাশে এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ? পৃথিবীর ধুলোবালিতে যখন তার প্রিয় সখী দ্রৌপদী লাঞ্চিত হলেন নোংরা পুরুষতন্ত্রের ঈর্ষায় তখন শ্রীকৃষ্ণ ঈর্ষা পরায়ণ হয়েছিলেন সভ্যতার কারণেই। এই মানবিক দুর্বলতামুক্ত হওয়া মহাপুরুষের পক্ষেও সম্ভব নয় হয়ত!
বাসু উঠে যাও কফির শেষ চুমুক ফেলে রেখে। সুস্মির ছবির পাশে রাখা মনোবিজ্ঞানের বইটি নেবার আগে ছবিতে পরশ বুলিয়ে বইটি তুলে আনে। তার বুকের ভেতর ঈর্ষার পরাণ টলমলো। সুস্মি হাসে, আমাকে নিয়ে তোমার ঈর্ষা ছিলো, মনে পড়ছে বাসু? তিনশ বার পাতাটি পড়ো বইটির। বাসু পাতা উল্টে পড়তে থাকে ঈর্ষা একজন স্বাভাবিক মানুষের অস্বাভাবিক প্রবৃত্তি বা আবেগ। এটি কখনো দৃশ্যমান, কখনো অপ্রকাশ্য। এই প্রবৃত্তির পরিধি কিন্তু খুব ছোট। মানুষের চেনাজানা গন্ডির ভেতর এর আবর্ত। আপনার বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী আপনাকে ঈর্ষা করে। কেন করে? যখন আপনি এমন কিছু করেন বা প্রাপ্ত হন, তখন অন্যের না পারার বা না পাবার বেদনাই সৃষ্টি করে ঈর্ষা বা হিংসা। পৃথিবীর সকল মানুষের সকল প্রাপ্তির পেছনেই আছে ঈষার বিষ। ঈর্ষার অপর পিঠেই খোদাই করা আছে ক্ষতি করার প্রবণতা। আপনি যখনই কিছু অর্জন করবেন, তখনই জানবেন আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে কিছু মানুষ, ঈর্ষানেশ্বীর লাইন। যারা এখন আপনার ক্ষতি বা অপপ্রচার করার জন্য প্রস্তুত। বাসু উঠে দাঁড়ায় আজ কি সে ঈর্ষাহীন চৈতন্য, হিংসাহীন লোক যার পেছনে কারো লাইন নেই কেবল হাহুতাস। জানালার ওপার থেকে ভেসে আসছে শবযাত্রার ধ্বনি হরি বোল, বোল হরি। পলকে ঘুরে দাঁড়ায় বাসু সুস্মির চোখে এক অলৌকিক সময় যেন ঈর্ষা মরে গেছে কিংবা ঈর্ষা করা শবের পেছনে ঈর্ষার যাত্রা যাত্রা যাত্রা কেবল...
0 comments: