ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আমার বারুদ বেলা
স্বপন দেব
আমার বারুদ বেলা আসলে আমার যৌবন বেলা। এবং সেটা সত্যিই ছিল বারুদের গন্ধে ভরা। সময়কালের ব্যপ্তি মোটামুটি ষাটের দশকের শুরু থেকে সত্তরের দশকের গোড়া অবধি। সেইসময় টা ছিল একেবারেই অন্যরকম। ৬২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সময়কাল টাই ছিল আমার বারুদ বেলা। এই দশ বছরের সীমাটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটা দলিল হিসেবে রেখে যেতে চাই। তাই অবশ্যই হবে এটা একটা ধারাবাহিক রচনা।
১৯৬২ সালে আমার বয়েস মাত্র ১৫ হলেও আমার এক দাদা রথীন্দ্র কৃষ্ণ দেব ছিলেন এক বিশিষ্ট বামপন্থী কমিউনিস্ট শিক্ষক নেতা। তাঁরই সুবাদে বাড়ীতে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের আসা-যাওয়া ছিলই এবং তখন থেকেই এঁদের দেখে, এঁদের সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন, আদর্শবাদ এবং এক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন এঁরা দেখিয়েছিলেন, তা আমার মনকে ভীষন ভাবে আলোড়িত করে ছিল। এই ১৯৬২ সালেই ১২ ই অক্টোবর ভারত সরকার ভারতীয় ফৌজ কে চীন সীমান্ত মুক্ত করার আদেশ দেয়। আর ২০ শে অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরু নির্দেশ দিলেন চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের। যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই চীনা গণ ফৌজের পাল্টা আক্রমণে, সেনা অফিসার সহ কম বেশি সাড়ে তিন হাজার ভারতীয় সৈন্যের প্রায় বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণের পর, চীনা গণফৌজ এক তরফা ভাবে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে- তথাকথিত ম্যাকমোহন লাইনের সাড়ে বারো কিলোমিটার উত্তরে সরে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে বিখ্যাত মনীষী বার্টাণ্ড রাসেল তাঁর, ‘Unarmed Victory’ গ্রন্থে বলেছেন ‘এক বিজয়ী বাহিনীর নিজ থেকেই পিছু হটে যুদ্ধের অবসান ঘোষণা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি’। এই যুদ্ধকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে পরবর্তীতে মন্তব্য করেন , এই যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা অফিসার টি এন কল তাঁর ‘The Untold Story’ গ্রন্থে এবং মেজর জেনারেল দলভি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Himalayan Blunder’-এ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই সমস্ত ঘটনা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে গোষ্ঠীবিন্যাসের ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার করল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘চীনপন্থী’ আর ‘রুশপন্থী’ মেরুকরণ চলতে লাগল। ভারত সরকার এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ভারত রক্ষা আইনে ( D.I.R ) রুশপন্থীদের বাইরে রেখে বেছে বেছে চীনপন্থীদের জেলে ভরতে লাগল। সরকারি ও বেসরকারি বাজারি প্রচার মাধ্যমে ‘রুশপন্থী’ আর ‘চিনপন্থী’ অংশ চিহ্নিত হল ‘দেশপ্রেমিক’ আর ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে।
পশ্চিমবঙ্গে ছাত্রফ্রন্টের পার্টিসভ্যদের একাংশের মধ্যে অনেকদিন আগে থেকেই সংগঠনের কাজের গতানুগতিকতা বা স্থিতবস্থা সম্পর্কে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছিল। ছাত্রফ্রন্ট থেকে সেইসময়ে যে দু’জন সদস্য পার্টির রাজ্যপরিষদের সদস্য ছিলেন, তাঁদের দু’জনেই ছিলেন রুশপন্থী। এঁদের নাম গুরুদাস দাশগুপ্ত এবং নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। দীনেশ মজুমদার ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। তিনি ছিলেন চীনপন্থী। তিনি প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং জেলাস্তরের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নতুন ছাত্র-ফেডারেশন ( Bengal Provincial Students Federation ) তৈরি করলেন। এরই মধ্যে দিয়ে পার্টি ভাঙ্গনের আরও একটি ধাপ সম্পন্ন হল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গোষ্ঠী কোন্দল তখন তুঙ্গে। এই পটভূমিতে অন্ধ্র রাজ্যের তেনালীতে ১৯৬৪ সালের ১১ই জুলাই অনুষ্ঠিত হল তেনালী কনভেনশন। ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তেনালী কনভেনশন’ নামেই এই কনভেনশন খ্যাত। এইসময়ে এবং এর পরবর্তী কালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নামে সমান্তরাল দু’টি সংগঠন এর জন্ম হল।
এই ১৯৬৪ সালেই আমি হায়ার সেকন্ডারি পাশ করে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হলাম। শুরু হল, আমার বারুদ-বেলা। আমার বারুদবেলার গল্প শুরু করার আগে তাই সেই সময়কার রাজনৈতিক এবং সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকাটা সেরে রাখলাম।
১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের সেশন শুরু হল। প্রথমদিন কলেজে গিয়ে পেলাম বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র-ফেডারেশনের একটা হলুদ রঙের কার্ড, যাতে লেখা “এসো উৎসুক চিত্ত, এসো আনন্দিত প্রাণ”। চিত্ত সেইসময়ে সত্যি ই উৎসুক। এর কয়েক দিন পরেই কলেজে ঢোকার মুখেই শুনলাম এক ছাত্র-নেতা জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। তাঁর বক্তৃতার একটা বাক্য-বন্ধ আমার গোটা জীবনটাই বদলে দিল !! “রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তি !” হ্যাঁ। ঠিক এই বাক্য-বন্ধটি ই তিনি ব্যবহার করেছিলেন। সেদিন বুঝিনি। তখন বুঝিনি। বেশ কিছুদিন বাদে যখন গা থেকে আনকোরা গন্ধটা কেটে গেছে, তখন একদিন কমনরুমে ঐ ছাত্রনেতাটিকে দেখলাম টেবিল টেনিস খেলতে। আমাদের বাড়িতে সেইসময়ে একটা খুব ভালো টেবিল টেনিস বোর্ড ছিল এবং আমি আমার অন্যান্য জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো ভাই বোনেদের সঙ্গে খুব খেলতাম। তাই খেলাটা ভালোই রপ্ত ছিল। সাহস করে আমি সেই দাদাটিকে বললাম, আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন ? উনি বললেন, আয় আয়, কোনদিন খেলেছিস ? আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই বললেন, আমার সঙ্গে খেল ! খেললাম, এবং অবলীলায় ওনাকে হারিয়ে দিলাম ! উনি এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই তো কলেজের গর্ব রে ! জানিস এই কলেজে আমিই চ্যাম্পিয়ন ? আলাপ হল। আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা আপনি সেদিন বক্তৃতায় “রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তি” কথাটা বলেছিলেন কেন ? ওটা তো খারাপ কথা। উনি মোটেও রাগ করলেন না। স-বিস্তারে আমাকে বোঝালেন ডাঙ্গে পন্থী অপর একটি ছাত্র-সংগঠন যাদেরও নাম বি পি এস এফ, তারা কিভাবে কংগ্রেসের লেজুড় বৃত্তি করছে। সেই শুরু হল। নেতাটি এখনও জীবিত। নরওয়েতে থাকেন। বছরে দু’বার কোলকাতায় আসেন এবং এলেই আমাকে ফোন করে ডেকে নেন। পরে আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে তুই করে ডাকতাম ও। সেই আমাকে আলাপ করিয়ে দিল। আমার থেকে মাত্র তিন বছরের সিনিয়র, মানে আমি কলেজে ঢুকেছি আর উনি কলেজ থেকে বেরিয়েছেন, সেই সময়ের দাপুটে ছাত্রনেতা শ্যামল চক্রবর্তির সাথে। শ্যামলদা’র সঙ্গে আমি প্রথম বউবাজারে বিপিএস এফ এর অফিসে গেলাম। সেখানে আলাপ হল সুভাষ চক্রবর্তি, দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস এবং আরো অনেকের সঙ্গে। এরপর থেকেই নিয়মিত বউবাজারের অফিসে যাওয়া শুরু হল আমার। সেখানে তখন রীতিমতো পার্টি ক্লাস হত। আমি জানলাম যে, একমাত্র সশস্ত্র-বিপ্লবের দ্বারাই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক এবং মধ্যবিত্তদের সংগঠিত করে লড়াই শুরু করতে হবে। ক্ষমতা দখলের লড়াই। শুরু হল এক নতুন জীবনের সন্ধানে আমার পথ চলা……আমার স্বপ্ন দেখা…( চলবে )।
👍👌 জানো জেঠু আমার পরিবার মনে প্রাণে communist !!! me too !!
ReplyDelete