0

বিশেষ প্রতিবেদনঃ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

Posted in


বিশেষ প্রতিবেদন




শুভ নববর্ষ 
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী



১লা বৈশাখে বাঙালীদের শুভ নববর্ষের সূচনা । এই বৈশাখ মাসকে ধরেই বঙ্গাব্দের সূচনা । যদিও বঙ্গাব্দ কবে থেকে শুরু হয়েছিল এবং কোনটি গ্রহণযোগ্য এ নিয়ে দ্বিমত আছে । সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৫৫৬ খ্রীঃ ১১ এপ্রিল সোমবার ছিল ১লা বৈশাখ । ইতিহাসের একদিক বলছেন এইদিন থেকে বঙ্গাব্দ শুরু । কিন্তু কেন, এই আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসের নানান তথ্য উঠে আসছে । 

প্রাচীন কালে রাজা বাদশারা নিজ নিজ রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময়কালকে এক একটি অব্দ বা সাল গণনা করেছেন । যেমন শকাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ ইত্যাদি । সম্রাট আকবর যখন মোঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি তখন এই উপ-মহাদেশে শকাব্দ, হর্ষাব্দ, বঙ্গাব্দ, পালাব্দ ইত্যাদি প্রচলিত ছিল । সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীঃ ১৫ ফেব্রুয়ারি (হিজরি ৯৬৩) দিল্লীর সিংহাসনে বসেন । এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য আকবরের রাজসভার রাজজ্যোতিষী ও পণ্ডিত আমির সিরাজি ১৫৫৬ খ্রীঃ ১১ এপ্রিলকে নববর্ষ ধরে ৯৬৫ ফসলি সন গননা করার রীতি চালু করেন । আমির সিরাজির সিদ্ধান্ত মত সম্রাট আকবর তার রাজত্বকালে ১৫৫৬ খ্রীঃ থেকে রাজত্বের সর্বত্র এই ফসলি সনের প্রচলন করেন । পরবর্তীকালে এর নাম হয় বঙ্গাব্দ । 

সূর্য পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনা করা হয় তাকে বলে সৌর বর্ষ আর চন্দ্র পরিক্রমার হিসাবে যে বর্ষ গণনা করা হয় তাকে বলে চন্দ্র বর্ষ । এই দুই ধরণের মাসকে বলা হয়ে থাকে যথাক্রমে সৌর মাস এবং চন্দ্র মাস । বাংলা সন সৌর সন । খ্রীঃ ৭৮ সাল থেকে আর একটি সৌর সন গণনা করা হয় তার নাম শকাব্দ । এটি ভারতের জাতীয় সন । হিসাব অনুযায়ী ধরা যেতে পারে ২০১৫ সালে শকাব্দের বয়স ১৯৩৭ । শকাব্দের সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে খ্রীষ্টাব্দ পাওয়া যাবে কিংবা খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৮ বিয়োগ করলে শকাব্দ পাওয়া যাবে । শকাব্দ এবং বঙ্গাব্দ উভয়েই সৌর অব্দ তাই দুই অব্দের তেমন কোনো তারতম্য দেখা যায় না । এখন খ্রিষ্টাব্দ ২০১৫, শকাব্দ ১৯৩৭ বঙ্গাব্দ ১৪২১ । বঙ্গাব্দের সঙ্গে ৫১৬ যোগ করলে শকাব্দ পাওয়া যাবে । এটা আমরা সবাই জানি । সম্রাট আকবরের আমলে বঙ্গাব্দের যে বছর সৃষ্টি হয় দেখা যাচ্ছে সে বছরই তার বয়স ৯৬৩ বছর । সেই কারণে বলা যায় হিজরি সনের প্রথম থেকে ৯৬৩ বছর পর্যন্ত বঙ্গাব্দের প্রথম পর্যায় । কিন্তু বহু গবেষক এবং ইতিহাস বিদরা আবার ভিন্ন মত পোষণ করেছেন । কেউ কেউ মনে করেন সম্রাট আকবরের আমলে ৯৬৩ হিজরি ৯৬৩ বঙ্গাব্দ বলে যা শোনা যায় তা সম্ভবত ঠিক নয় । পাকিস্তানের বিশিষ্ট গবেষক ইতিহাসবিদ গোলাম মুরশিদ ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের এক পত্রিকায় লিখেছিলেন যার সারমর্ম ছিলো, “সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনের প্রবর্তন হয়নি । এমনকি কোনো মুসলমান কর্তৃক প্রবর্তিত হলে বাঙালি হিন্দুরা তা মেনে নিয়ে তাদের ধর্মকর্মের সংযোগ সাধন করবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয় ।” এই মন্তব্য বঙ্গাব্দ নিয়ে বিতর্ক উসকে দেয় । কারণ হিজরি চন্দ্র মাস অনুযায়ী গণনা করা হয় এবং বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় সৌর মাস অনুযায়ী । 

সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীঃ (৯৬৩ হিজরি) সিংহাসনে বসার পর পরই সারা দেশজুড়ে টানা দশবছর অবিরাম যুদ্ধ করেছিলেন । শোনা যায় যুদ্ধের জন্য সবসময় ঘোড়ায় চড়ে থাকার দরুন তার পা ধনুকের মত বেঁকে গিয়েছিল । যুদ্ধরত সম্রাটের পক্ষে সেসময় আশা করা যায় বঙ্গাব্দ নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল না । দেখা যায় ১৫৭৬ খ্রীঃ পাঠান দায়ুদের কাছ থেকে আকবর গৌড়বঙ্গের অধিকার কেড়ে নেন । তাই ২০ বছর আগে যে অখণ্ড বাংলাদেশ সম্রাটের অধিকারেই ছিল না সেই দেশে কিভাবে হিজরির পরিবর্তে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করলেন সেটিও ভেবে দেখার । কেউ কেউ মনে করেন সে যুগের রীতিনীতি অনুযায়ী হিন্দুদের ধর্ম সংস্কৃতি বিনষ্ট করে অন্য সম্প্রদায়ের বশীভূত করা অন্যতম কারণ হতে পারে ।

অধিকাংশ মানুষ মনে করেন রাজা শশাঙ্কের আমলেই বঙ্গাব্দের সুচনা হয় । খ্রীঃ সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে কিংবা তার কিছু পরে বাংলার স্বাধীন ও পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন শশাঙ্ক । ৫৯৩ খ্রীঃ তিনি গৌড়ের সিংহাসনে বসেন । এই সময় রাজা শশাঙ্কের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে । বাংলাদেশের প্রথম সার্বভৌম বাঙ্গালী রাজা শশাঙ্কের রাজত্বের সূচনাকাল থেকেই বঙ্গাব্দের সূচনা বলেই অধিকাংশেরই অভিমত । দেখা যাচ্ছে, ১লা বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ ছিল সোমবার । ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখটি হলো ৫৯৪ খ্রীঃ ১২ এপ্রিল । প্রথম মাস বৈশাখ । বঙ্গাব্দের সুচনা সোমবার । রাজা শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন । সোমবারটি ছিল শসাঙ্কের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন । শুরু বৈশাখে । এদিকে গুপ্ত যুগ থেকে বৈশাখ মাস হিসাব বর্ষ গণনার যে শুরু হয়েছিল সেই ধারা আজও বিস্ময়কর ভাবে অব্যাহত । গুপ্ত রাজ বংশের বহমান আদর্শ, সংস্কৃতি কৃষ্টির ধারাকে অনুসরণ করেই বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন । তাই বঙ্গাব্দ নিয়ে দুটি মত ধারাবাহিক ভাবে উঠে আসছে । প্রথম মত ১৫৫৬ খ্রীঃ ৯৬৩ হিজরি । অর্থাৎ ৯৬৩ কে ভিত্তি করেই বঙ্গাব্দের সূচনা । বঙ্গাব্দের বর্তমান বয়স হয় ( ১৪২১ – ৯৬৩ ) ৪৫৮ বছর । বঙ্গাব্দের বর্তমান বয়স ৪৫৮ বছর ।

দ্বিতীয় মতানুযায়ী বঙ্গাব্দের সূচনা হয় রাজা শশাঙ্কের আমলে । বঙ্গাব্দের সূচনা কাল ১ ধরা গেলে ১৪১৯ বঙ্গাব্দের বয়স হবে ১৪১৮ । অর্থাৎ (১৪১৮ – ৪৫৮ ) ৯৬০ বছর । বাংলা পঞ্জিকা তৈরী হয় সুর্য সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে । সূর্য সিদ্ধান্ত মতে ১ বছর হল ৩৬৫.২৫৮৭ দিন । কিন্তু ইংরাজি ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী ১ বছর হল ৩৬৫.২৪২২ দিন । এই হিসাব অনুযায়ী বাংলা ক্যালেন্ডার ১ বছর ০.০১৬৫৫৬ দিন বা ২৩ মিনিট ৮৪ সেকেন্ড বেশী । তাই বঙ্গাব্দ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল সূচিত হয়ে আসছে । 

অতি প্রাচীন কালে অগ্রহায়ণ ও পরে ফাল্গুন মাস থেকে নতুন বছর শুরু হতো । মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে খাজনার হিসেবের সুবিধার জন্যই বঙ্গাব্দ শুরু হয় । অথচ ‘পয়লা বৈশাখ’ উৎসবের উৎপত্তি ইংরেজ আমলে । তখন বাঙালি গ্রামসমাজ ছিলো মুখ্যত কৃষিজীবী । সেখানে চড়ক, পৌষ-পার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি ছিলো বড় উৎসব । ঔপনিবেশিক জমানায় দেখা গেল, ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিনটি ছুটি । অগত্যা বাঙালি ভাবলো, সাহেবদের থাকলে আমাদেরই বা নয় কেন ? নগর কলকাতায় তৈরি হলো নতুন এক ‘সেকুলার উৎসব’ । পয়লা বৈশাখ প্রথম থেকেই গ্রামবাংলার নবান্ন বা পৌষ-পার্বণের মতো জনপ্রিয় ছিলো না । আবার ব্রিটিশ শাসকদের ‘বড়দিন’ বা ‘নিয় ইয়ার্স ইভ’-এর গ্ল্যামারও ছিলো না । আজও বাংলার কিছু গ্রামে পয়লা বৈশাখকে ‘বাসি চড়ক’ বলে । 

দেশের সকল প্রান্তের বাঙালিদের মতোই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা একত্রে নববর্ষের উৎসব পালন করে । ত্রিপুরিদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসবকে যৌথভাবে বলা হয় ‘বৈসাবি’ । এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যময় বেশ কিছু মজার বর্ষবরণ উৎসব । ‘বৈসাবি’ অহিংসার, বন্ধুত্বের প্রতীক আর মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন । পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের আধিক্য বেশি । তাঁদের প্রধান উৎসব হলো বিজু । চাকমাদের ধারনা, চৈত্র মাসের শুরুতেই একটি পাখি (বিজু পেইক) এসে বিজু বলে ডাক দিয়ে যায় । এই বিজু পেইক সুমধুর কলতানে বিজু উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে । বাংলা বর্ষপঞ্জী হিসেবে বছরের শেষ দুই দিন, অর্থাৎ ২৯ চৈত্র ফুল বিজু আর ৩০ চৈত্র মূল বিজু পালিত হয় । ফুল বিজুর দিন নদীতে ফুল ভাসিয়ে উৎসবের সূচনা করে চাকমারা দল বেঁধে শিকারে বের হন । মূল বিজুর দিন চাকমারা ভোর উঠে দল বেঁধে ফুল তুলতে বেরোন এবং নদীতে স্নান করেন । তারপর সারা দিন পাড়া বেড়ানো, পিঠে তৈরি করা, ১৫-২০ পদের বিভিন্ন রকম তরকারী রান্নার ধুম পড়ে যায় । মারমাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম সাংগ্রাই । ভালো খাবার খাওয়া, বাড়ি বাড়ি ঘুরতে যাওয়া, সুন্দর কাপড় পরে, নৃত্য-গীতের আয়োজন ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী পানিখেলা বা জলকেলির উৎসব । মারমা যুবক-যুবতীরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে একে অন্যের গায়ে জল ছুঁড়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে । নববর্ষের দিন শুরু হয়ে তিন দিন ধরে চলে এই পানিখেলা । এছাড়াও পিঠে খাইয়ে অতিথি সদ্ব্যবহার, বৌদ্ধ মঠে গিয়ে বুদ্ধপ্রণাম, বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন উৎসবের আনন্দকে বৃদ্ধি করে । ত্রিপুরিদের উৎসব হলো বৈশুখ । খাগড়াছড়িইয়ে এই জনগোষ্ঠীর আধিক্য দেখা যায় । চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন ও বছরের প্রথম দিন এই উৎসব চলে । এই সময়ে সকলে নতুন কাপড় পড়েন এবং বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন । কিশোরীরা কলসি নিয়ে বড়দের খুঁজে খুঁজে স্নান করান । তরুণ – তরুণীরা একসঙ্গে রঙ খেলায় মেতে ওঠেন । রঙ খেলা শেষে সকলে একত্রে স্নান করতে যান । 

পয়লা বৈশাখ । নতুন বছরর প্রথম দিন । নতুন আনন্দ, নতুন সুখ, নতুন কিছু পাবার আশায় ভরা একটি দিন । দেশের সর্বত্র ধর্ষণকাণ্ডের ছড়াছড়ি, রাজনৈতিক হানাহানি, স্কুল-কলেজে ছাত্র রাজনীতির দাঙ্গা, ট্রেন দুর্ঘটনা, জ্বলন্ত ট্রেনে ঘুমন্ত যাত্রীর পুড়ে মরা । এমন আরও অনেক দুঃখ, কষ্টে ভরা যন্ত্রণাময় ঘটনার মোড়কে ঢাকা অভিশপ্ত ১৪২১ সালের বিদায় হয়েছে গত রাত্রে । এসেছে নতুন বছর ১৪২২ । পয়লা বৈশাখে নুতন কিছু অঙ্গীকার, ভালো হওয়ার-ভালো থাকার অঙ্গীকার । পৃথিবী আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে খুশির উৎসারণে । দিকে দিকে সবাই সেজে উঠেছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে । নতুন সাজে-পোষাকে । নতুন রূপে, নতুন মনে । কলকাতায় হালখাতার পূজোর সামগ্রী নিয়ে ভোর রাত থেকেই বিশাল লাইন পড়ে যায় কালীঘাটে মায়ের মন্দিরের সামনে । গ্রামে ও শহরাঞ্চলের দোকানে দোকানে হয় গনেশ ও লক্ষ্মীর পূজো । খোলা হয় লাল সালুতে মোড়া নতুন খাতা । সবাই একাত্ম হয়ে ওঠে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে । ক্রেতারা দোকানে দোকানে মিষ্টি মুখ করেন দলে দলে এসে । দেখা হলেই একমুখ হাসি নিয়ে ‘শুভ নববর্ষ’ বলে বুকে টেনে নেবার পালা চলে । সবাই যেন ভুলে যেতে চায় অতীতের সব মলিনতা । হয়ে উঠতে চায় প্রাণের বন্ধু, আত্মার আত্মীয় । মনে প্রাণে চায় মুছে যাক্‌ পারস্পরিক মতান্তর, বিভেদ, দ্বেষের আগুণ যাক্‌ নিভে । বয়ে যাক প্রেমভালোবাসার স্রোতস্বিনী নদী দেশ দেশান্তরে । মন চায় নববর্ষের এই দিনটিতে বাংলা গানে ভেসে যাই । বাংলা গানের স্বর্ণযুগের বিখ্যাত শিল্পীদের মন মাতানো গানগুলি আজও স্পর্শ করে – ছুঁয়ে যায় ।

অতএব আমরা বলতেই পারি – হে নববর্ষ, এবার এসো সুন্দরের পথ ধরে । শান্তি বিরাজ করুক প্রতি ঘরে ঘরে । হিংসা, দ্বেষ – যা কিছু সব মুছে ফেলে জন্ম নিক অন্য এক নতুন পৃথিবী ।





0 comments: