প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ কেয়া মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
নব আনন্দে জাগো...
কেয়া মুখোপাধ্যায়
মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলে পা। জানলা দিয়ে তাকালে বাইরের শূন্য ডালগুলোর কয়েকটাতে নরম কচি সবুজ পাতা। এখনো সকালে গরম জামা। কোনকোনদিন তাপমাত্রা অনেক নেমে গেলে ওভারকোট। তখন ওই শুকনো ডালগুলোতে আটকে থাকা হীরের কুচি বরফ। রোদ্দুর উঠলে হীরের কুচি চিকমিকিয়ে ওঠে। গলতে থাকে একটু একটু করে। মুক্তোদানার ঝালর তৈরি হয় ডাল জুড়ে। তারপর টুপ করে ঝরে যায় মুক্তোদানাগুলো।জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে তাকাতেই চোখ পড়ল ক্যালেন্ডারের পাতায়। এই দূর প্রবাসে ক্যালেন্ডার হঠাৎ মনে করিয়ে দিল, আর ক’দিনপরেই বাংলা নতুন বছর।
এক লহমায় নস্ট্যালজিয়ার আঁচল ধরে সোজা কলকাতায়। ছোটবেলায়। সেই ছোটবেলায়, যখন মনে মনে ভাবতাম, ‘ছাদের পাশে তুলসি গাছেরটব আছে যেইখানে’, সত্যি সেইখানে রাজার বাড়ি। দিনের বেলা, তার ওপর চারদিকে বড়রা। তাই দেখতে পাচ্ছি না। একদিন সবাই ঘুমিয়েপড়লে চুপি চুপি পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়াব আর অমনি জোছনা ধোয়া আলোয় দেখতে পাব রুপোর দেয়াল, সোনার ছাত, সাদা হাতির দাঁতসিঁড়িগুলো উঠে গেছে ওই ওপরে।
সেই ছোটবেলায় নতুন বছরের প্রথম দিন। বিছানা ছাড়ার আগেই ভেসে আসত গানের কলি। রেডিওতে ‘নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে...’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়। আর সেই গানের রেশ নিয়ে জীর্ণ পুরাতন সব ভাসিয়ে এসে পড়ত শুভ্র সুন্দর, প্রীতি-উজ্জ্বল একটা গোটা ছুটির দিন। কারোর কোন তাড়া নেই। আরেক রাউন্ড চায়ের সঙ্গে টিভিতে নববর্ষের বৈঠক। শুভ্র চুলে বৈঠকি গান নিয়ে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। গান শুনতে শুনতে দুপুরের মেনু ঠিক করায় ব্যস্ত বড়রা। রাস্তায় গান গেয়ে প্রভাতফেরী। রান্নাঘর থেকে ফুলকো লুচি আর ছোলার ডালের গন্ধ। আর আমার মনে লেগে থাকা নতুন জামার গন্ধ। ক’দিন আগে গেছে চৈত্র সেল। হাতিবাগান আর গড়িয়াহাট থেকে কেনাকাটা। ভাবছি কতক্ষণে পরব!
বাংলা নতুন বছর মানে হালখাতা। কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরে ভোররাত থেকে থই থই ভিড়। দোকানে গণেশ ঠাকুর আর বাড়িতে মা লক্ষ্মীর আসন পাতা। জোড়া আমপাতায় সিঁদুরের লাল টিপ। একটু বেলা গড়াতে হাওয়ায় ভাসা বড় বড় আলু দিয়ে কচি পাঁঠার ঝোলের সুঘ্রাণ আর কিসমিস ভাসা পায়েস। বিকেল থেকে সন্ধ্যে বড়দের হাত ধরে দোকান থেকে দোকানে ঘুরে মিষ্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডার সংগ্রহ করার অনাবিল আনন্দ। নব আনন্দের, নব রবি কিরণে ধোয়া এই দিনটায় কেউ অবাঞ্ছিত নয়, অপাঙক্তেয় নয়। সারা বছর দরাদরি করা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এদিন মিষ্টিমুখ আর শরবতের অমায়িক আমন্ত্রণ। আর এই সব টুকরো ছবির সঙ্গে, বৈশাখ আসা মানেই সেই লম্বা দাড়িওয়ালা, জোব্বাপরা, বাঙালিকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া মানুষটার জন্মদিনও এসে পড়া নববর্ষের পিছু পিছু।
ছোটবেলায় এই দিনটায় বড়দের কাছে শুনতাম আর এক নববর্ষের গল্প। আরও পুরনো কলকাতার। বড় বড় সম্পন্ন বাড়ির নহবতখানায় সেদিন ভোরবেলা বসত রোশনচৌকি। সানাইয়ের সুরে ঘুম ভাঙতো বাংলা বছর শুরুর প্রথম ভোরে। বাবু-কালচারের ঐতিহ্য-মেশা সেসব সানাইয়ের ভোর আস্তে আস্তে বেলায় গড়ালে বাবু-বাড়িতে শুরু হত হৈহৈ কান্ড। এলাহি আয়োজন। অন্দরমহলে পুজোপার্বণ। বারমহলে খানাপিনা। গোলাপ-বেলফুল- আতরের গন্ধে ভারি নাচঘরের ঝাড়বাতির ঠিকরোনো আলোয় জমে ওঠা মেহফিল। বিশাল ফটকের মাথায় বসানো ভাঙ্গা সিংহের মূর্তির মতই সেসব নহবতখানা আর নাচঘর আজ ভাঙ্গাচোরা, নোনাধরা। বর্ষবরণের সানাইয়ের সেই মিঠে সুর শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে মানুষের মনে কি বইয়ের পাতায়।
ইতিহাসের পথ ধরে আরো কিছুটা পিছু হাঁটলে দেখি বাংলায় নববর্ষ উৎসব প্রথম শুরু হয়েছিল সেই আকবর বাদশার আমলে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও পালন করা হত নববর্ষ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সূচনা করেছিলেন। আর বছরের প্রথম দিনটাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নব-জাগরণের দিন বলে চিহ্নিত করে এই উৎসবে এক নতুনতর মাত্রা আনলেন রবীন্দ্রনাথ। পরাধীনতার দিনগুলোতে নববর্ষ উৎসব মানুষকে প্রাণিত করেছিল স্বদেশ চেতনায়। পয়লা বৈশাখের পরেই শান্তিনিকেতনে গরমের ছুটি। তাই শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর জন্মদিনও পালন করা হয়েছে এই নববর্ষের দিনটিতেই। ভারতে যে দিন প্রথম রেলগাড়ি চলেছিল, সেদিনও ছিল এক পয়লা বৈশাখ। আজকাল বইমেলাকে ঘিরে সাহিত্য প্রকাশনার রমরমা হলেও আগে নববর্ষের দিনটাই ছিল বাংলা সাহিত্য প্রকাশের প্রধান দিন। কলেজ স্ট্রীট পাড়া এখনও সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। এমনি করেই একটা নতুন বছরের শুরুতে দাঁড়িয়ে একটু পিছন ফিরে চাওয়া, জীবনের অঙ্ক খাতায় কিছু হিসেব নিকেশ, অনেকখানি আবেগ আর খানিকটা উদ্যম নিয়ে ভরা বাঙালির নতুন বছর।
সময় পাল্টায়। ছবি পাল্টায়। শৈশব থেকে কিশোরীবেলা কি তার পর থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার অনুভবে-চেতনায় মিশে থাকা আমার প্রথম সব কিছুর সাক্ষী সেই তিলোত্তমা শহরকে খুঁজে পাই না এখন। হাই-রাইজ,শপিং মল, ঝাঁ চকচকে গাড়িতে সাজানো ফেসবুক-টুইটারের কলকাতাএখন দ্রুতপায়ে এগোচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। মনের মধ্যে নানা রঙের আঁচড়ে আঁকা হয়ে যাওয়া ছোটবেলার নববর্ষের বেশ কিছু ছবি পাল্টে গেছে সময়ের হাত ধরে। আজ হাজারো চ্যানেলের ভিড়ে ফিকে হয়ে এসেছে টিভি পর্দায় নববর্ষের বৈঠকের আকর্ষণ। কিন্তু ভোর থেকে লক্ষ্মী-গণেশের নতুন মূর্তি আর খেরোর খাতা হাতে মন্দিরের লাইনে অপেক্ষামান মধ্যবিত্ত বাঙালির আবেগ আর সরল বিশ্বাসের জায়গাটা বোধহয় আজও এক। নতুন বছর শুরুর শুভ দিনে বাংলায় গুরুজন, প্রিয়জনকে যথাযোগ্য সম্ভাষণে লেখা চিঠির প্রজন্ম হারিয়েই গেছে। সেকেলে কালো ফোনের যুগ অনেক পিছনে ফেলে মুঠোফোনে নববর্ষের ঐতিহ্য মেনে শুভেচ্ছা বিনিময়টুকুর রেওয়াজ অক্ষুণ্ণ এখনও। ব্যস্ত জীবনের মধ্যে এও এক প্রাপ্তি।
এক্সপ্রেসওয়ের চলতি হাওয়ার পন্থী শহরটার আধুনিক নাগরিক জীবনযাপন, সংস্কৃতি, কি রাজনীতির হালচাল সময়ের সঙ্গে পাল্টালেও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরনো মায়াময় ছবিগুলো ভুলি কী করে? তাই এই একটা দিনে মাঝে মাঝে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে অতীতটাকে। বাংলার অতীত, বাঙালির ঐতিহ্য। কখনো কোনও ব্যক্তি, কখনো বা কোনও ঘটনা, কোনও জাগরণ কি বিশেষ কোনও প্রাপ্তি। ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে বঙ্গসন্তানদের কর্মকৃতি। বিশ্বপটের নিরিখে, দেশের পটেও। অনেক অহঙ্কারই হয়তো আজ স্মৃতি। অনেক গৌরবই হয়তো দ্রুত বিলীয়মান। তবু নতুন বছরের শুরুর দিনটাতে একবার ভাবতে ইচ্ছে করে, সব আলোর দিনগুলো কি নিছকই অতীত?
প্রথম নববর্ষ উৎসবের পর অনেক বসন্ত পেরিয়েছে। অগুন্তি নববর্ষের ভোরের নরম আলো ছুঁয়েছে আমার শহরকে, বাংলাকে। যত দূরেই থাকি, হৃদয়ের স্পন্দনে ধরা এ শহর, এ বাংলা। তার অতীতের দিকে চাই। টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভীড় করে আসে মনে। মনে সুর তোলে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান। আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। যে ভাষায় কথা বলি প্রিয়জনদের সঙ্গে, সে ভাষার সঙ্গে আমার আনন্দে-আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার ঘটিয়েছে বর্ণপরিচয়, সহজ পাঠ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত, পঞ্চকবির সুরের ধারায় আমার আনন্দ-স্নান। সেকাল থেকে একালে ভারতজোড়া সঙ্গীতসভায় বাংলার প্রতিনিধি অগুন্তি গুণীজন- শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী, পঙ্কজ মল্লিক, রাহুল দেববর্মন, কিংবা মান্না দে, হেমন্তকুমার, কিশোরকুমার, গীতা দত্ত, আরতি মুখোপাধ্যায় থেকে আজকের শ্রেয়া- উজ্জ্বল এক একটা নাম। রবীন্দ্রনাথের সুরের ঝর্ণাতলায় হাত ধরে নিয়ে যান রবীন্দ্রগানের এক সাধক- দেবব্রত বিশ্বাস। বিশ্বসভায় সেতারের ঝঙ্কারে মোহিত করেছেন রবিশঙ্কর, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ শতকের প্রথমভাগে কলকাতা আর শান্তিনিকেতনকে ঘিরে সূচনা শিল্পচর্চার এক সমান্তরাল নতুন ধারা। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী। এই ধারাই পরবর্তীতে হয়ে উঠল ভারতশিল্পের মূলস্রোত। আজও ঘরে বাইরে সমাদৃত বাংলার শিল্পীরা। গীতা পড়ার চেয়ে ফুটবল চর্চায় উত্সাহ দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। উদ্দীপিত একদল বাঙালি যুবক খালি পায়ে খেয়ে হারিয়ে দিলেন বিদেশী ফুটবলারদের। আন্তর্জাতিক আঙিনায় সাফল্যে উজ্জ্বল কিছুদিন আগের সৌরভ, আজও লিয়েন্ডার। অভিনয়ের প্রতিভায় সেকালের গিরিশচন্দ্র, নটী বিনোদিনী, শিশিরকুমার হয়ে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল-অজিতেশ হয়ে আজকের দেবশঙ্কর-সোহিনীরা মঞ্চে উজ্জ্বল। নায়ক থেকে মহানায়ক উত্তমকুমার হয়ে আজও অব্যর্থ সৌমিত্র। আন্তর্জাতিক মঞ্চে চলচ্চিত্র নির্দেশনায় সত্যজিৎ- মৃণাল- ঋত্বিক- তপন থেকে জাতীয় স্তরে কৌশিক-সৃজিতরা মুগ্ধ করেন বার বার। শিক্ষা আর বিজ্ঞানচর্চায় উজ্জ্বল বাঙালির অতীত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে উপাচার্য পদে অনন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহেন্দ্রলাল সরকারের স্বপ্ন সার্থক করে জনগণের টাকায় এ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার গবেষণাগার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণায় বিজ্ঞান সাধনার বিপ্লব। সমসাময়িক যুগের আর এক শিক্ষাবিদের কৃতিত্বে বিশ্বের দরবারে বাঙালি খ্যাতিমান, অমর্ত্য সেন।
নানা দিকে কি অপার ঐশ্বর্য! কি গৌরবময় ইতিহাস! কিন্তু তারপর? অগ্রগতির সেই ধারা কিছুটা কি স্তিমিত আজ? আরও বেশি প্রত্যাশা ছিল কি!
স্বপ্ন দেখি, প্রতিদিনের টুকরো গ্লানি কি নিত্য নৈমিত্তিকতাকে দূরে ঠেলে, যাবতীয় হীনমন্যতাকে অতিক্রম করে নিজের গরিমামাখা উজ্জ্বল সভ্যতা-সংস্কৃতিতে আস্থা রেখে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমার বাংলা। এইদিন ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক.../ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ আমার শহর, আমার বাংলা জড়িয়ে আছে প্রাণে, অনুভূতিতে, ভালবাসায়। প্রতিটা নতুন ভোর নতুন সূর্যের সঙ্গে নিয়ে আসে নতুন আশা, উত্তরণের নতুন স্বপ্ন।
নতুন বছরে সেই স্বপ্ন ছুঁতে দিগন্তের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ুক আজকের নতুন বাঙালি।
চমৎকার লেখার জন্যে ধন্যবাদ। বর্ষবরণ তো পাল্টাবেই, আমরা যে আগের থেকে অ...নে....ক বদলে গেছি। তবে সেই সময়টার জন্যে মন কেমন করে, একথাও ঠিক।
ReplyDelete