2

প্রাচীন কথাঃ অমৃত অধিকারী

Posted in


প্রাচীন কথা



কাব্যোত্তর
অমৃত অধিকারী



স্নান-তর্পণ সমাপনান্তে সশিষ্য শিবিরে প্রত্যাবর্তন করে ঋষি দেখলেন, প্রতিদিনের ন্যায় প্রাতঃরাশ প্রস্তুত। দধি, দুগ্ধ, মধু, শর্করা, চিপিটক, পুরোডাশ, অবদংশ, ভর্জিত ও সুসিদ্ধ পক্ষীডিম্ব, ঋতুসুলভফল, ফলাম্লরস এবং আরও বিবিধ আহার্য ও পানীয় সমন্বিত অতি উপাদেয় প্রাতঃরাশ। সুন্দরী সুসজ্জিতা সেবিকারা সতর্ক এবং অবহিত অবস্থায় কর্তব্যরত। সবকিছু সুষ্ঠু, সুনিয়ন্ত্রিত, সুবিন্যস্ত। কোথাও কোনও অভিযোগের অবকাশ নেই। রাজকীয় ব্যবস্থা প্রতিদিনের মতনই ত্রুটিহীন ও অপর্যাপ্ত।

মহর্ষির বলিরেখাঙ্কিত তপঃকৃশ কঠিন মুখমণ্ডলে একটু চিন্তার আভাস দেখা দিলো। গত দুই চান্দ্র মাস যাবৎ রাজকীয় আতিথেয়তায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি হয় নি। যখন যা চেয়েছেন, প্রায় ইন্দ্রজালের ন্যায় তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয়েছে। বিশেষত তাঁর প্রধানা সেবিকা চন্দ্রমালার কর্তব্যনিষ্ঠা, কর্মকৌশল ও পারম্পর্যবোধে বারবার বিস্মিত হয়েছেন ঋষি। আজ, আতিথ্যগ্রহণের অন্তিম দিনেও তার অন্যথা হবে না, তিনি জানেন। তাই তিনি ইষৎ বিচলিত। কারণ, আজ আতিথ্যের প্রতিদান দেওয়ার দিন। আর এমন সুব্যবস্থিত, আত্মনিবেদিত আতিথেয়তা যে রাজা অকারণে করছেন না, সেটুকু অনুধাবন করার মতন বুদ্ধি বরিষ্ঠ ঋষির আছে।

প্রাতঃরাশের পর ঋষি দুগ্ধধবল শয্যায় শরীর প্রসারিত করলেন। চন্দ্রমালা প্রতিদিনের মতন তাঁর পদসংবাহনে রত হলো। ঋষির চিরপরিব্রাজক পদযুগল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু দেশে বহু হস্ত দ্বারা সেবিত হয়েছে। কিন্তু এমন সুনিপুণ হস্তাবলেপ, এমন সুখস্পর্শ আর কোনওদিন অনুভব করেছেন বলে তাঁর স্মরণ হয় না। একমাত্র সেই ভোজরাজবংশীয় নৃপতির পালিতা কন্যা... সে কত কাল পূর্বের কথা! সে কন্যা এখন এই রাজবংশেরই বধূ না...? পরম দৈহিক প্রসাদে ঋষির চক্ষু মুদ্রিত হয়ে এলো... চিন্তাজাল অবচ্ছিন্ন হলো।

সুখনিদ্রার আবেশটুকু কাটতে কাটতে ঋষি অনুভব করলেন, কে যেন এক শালপ্রাংশু পুরুষ তাঁর শয্যাপার্শ্বে ভূমিতে উপবিষ্ট। চক্ষু উন্মীলণ করে দেখলেন, সে পুরুষ রাজা স্বয়ং। ঋষি ত্বরিতে উপবিষ্ট হলেন। রাজা সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর চরণবন্দনা করলেন। বৃদ্ধ ঋষি অনিন্দ্যকান্তি বিশালকায় পূর্ণযুবক রাজার স্কন্ধধারন করে তাঁকে উত্তোলিত করলেন। 

‘‘রাজন, আমি তোমার আতিথেয়তায় মুগ্ধ, আপ্লুত। গত দুই মাস ধরে যে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তুমি আমায় ও আমার শিষ্যদের আপ্যায়ন করেছো, তেমন সমাদর আমি ইন্দ্রসভায়ও পাইনি। ধন্য তুমি ও তোমার কুরুদেশ।’’ মহর্ষি দু্র্বাসার স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষ কন্ঠস্বর স্নেহে ও কৃতজ্ঞতায় আর্দ্র... ‘‘তোমাকে অদেয় আজ আমার কিছু নেই। প্রার্থনা করো।’’

‘‘আপনার তৃপ্তিই আমার পরম প্রাপ্তি, মহাত্মন। পরমেশ্বরের কৃপায় ও ঋষি-ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদে আমার আজ কোনও কিছুরই অভাব নেই।’’ কুরুরাজ দুর্যোধনের মন্দ্রকন্ঠে গভীর স্বর ধ্বনিত হলো। তাঁর দুই পেশীবহুল বাহু তখনও করাঞ্জলিবদ্ধ।

দুর্বাসার ওষ্ঠপ্রান্তে একটু অম্লরসসিক্ত হাসির উদ্ভাস হলো। সুদীর্ঘ জীবনে তিনি বহু নৃপতি দেখেছেন, তাঁদের আতিথ্যগ্রহণ করেছেন। কে নিষ্কাম ভাবে সেবা করছে আর কার কিছু প্রার্থনীয় আছে, বুঝতে তাঁর অধিক বিলম্ব হয় না।

‘‘দ্বিধা কোরো না, বৎস। আমি নিশ্চিত, তোমার কোনও মনস্কামনা আছে। যদি আমার বরে সে মনস্কামনা সফল হয়, আমি সে বর অবশ্যই প্রদান করবো তোমায়।’’ দুর্বাসার স্বরে প্রশ্রয় ও প্রতিশ্রূতি... ‘‘স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করো, কি তোমার অভীপ্ষা।’’

কিয়ৎকাল নীরবতার পর দুর্যোধন মন্থর কন্ঠে, কিঞ্চিৎ নিম্নস্বরে কথা বলতে আরম্ভ করলেন... ‘‘ভগবন, আপনি ত্রিকালজ্ঞ। অবশ্যই আমার জ্ঞাতি ভ্রাতাদের ভাগ্যবিপর্যয়ের সংবাদ আপনার অবগত।’’ মহর্ষির মুখাবলোকন করে তাঁর অবগতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলেন কুরুরাজ... ‘‘ক্ষাত্রোচিত দ্যূতক্রীড়ায় রাজ্যচ্যূত হয়ে প্রাক্তন সম্রাট যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের ও তাঁদের সকলের প্রিয়া পত্নী পাঞ্চালীর সহিত অধুনা বনবাসী। কাম্যকবনে গোমতী নদীর সন্নিকটে তাঁদের অস্থায়ী আবাস এক্ষণে বহু সূত, মাগধ, ব্রাহ্মণের আশ্রয়। ব্রাহ্মণপ্রিয় ন্যায়নিষ্ঠ যুধিষ্ঠির আপনার আতিথেয়তা করার সুযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করবেন। আমার একমাত্র প্রার্থনা, আপনি সশিষ্য কাম্যকবনে উপস্থিত হয়ে অজাতশত্রু যুধিষ্ঠিরের আতিথ্যগ্রহণ করুন।আপনার পদধূলি সম্পাতে সে স্থান ধন্য হবে। মহারাজ যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতাগণ আপনার সাহচর্য ও আশীর্বাদে পরম পুণ্য লাভ করবেন।’’

প্রার্থনা জানিয়ে দুর্যোধন করজোড়ে দীনচক্ষে চেয়ে রইলেন মহর্ষির দিকে। দুর্বাসার ভ্রূকুঞ্চিত। এঁদের পারিবারিক সংস্থা ও সংঘাতের বিষয়ে তিনি বিলক্ষ্মণ অবহিত। কিন্তু কুরুরাজের এই অভিনব যাচ্ঞার পশ্চাতে কি অভিপ্রায় থাকতে পারে, তিনি সঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না। যুধিষ্ঠিরের আতিথ্যগ্রহণের বাসনা তাঁর এমনিই ছিলো। তার জন্য জ্যেষ্ঠ ধার্তরাষ্ট্রের পৃথক বরপ্রার্থনার প্রয়োজন ছিলো না।

‘‘এই মাত্র প্রার্থনা তোমার?’’ সন্দিগ্ধ ঋষি জিজ্ঞাসা করলেন ভরতবংশীয় নৃপতিকে।

দুর্যোধনের দীনদৃষ্টির গভীর অভ্যন্তরে ইষৎ কৌতুক ক্রীড়া করে উঠলো যেন... ‘‘আর একটি ক্ষুদ্র, নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর যাচ্ঞা, ব্রহ্মণ...’’ রাজার কন্ঠে যেন বালকসুলভ তরলতা... ‘‘আপনার কাম্যকবন যাত্রার সংবাদ যেন যুধিষ্ঠির কোনওভাবেই পূর্বাহ্নে না পান।’’

এতক্ষণে দুর্যোধনের অভিপ্রায় ঋষির সম্পূর্ণ বোধগম্য হলো। তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তের হাসিটি আরও একটু তির্যক হলো। নিজের ক্রোধনস্বভাবের খ্যাতি চিরকাল উপভোগ করেছেন দুর্বাসা। ত্রিভুবনে এমন কেউ নেই যে তাঁর অভিশাপকে ভয় পায় না। অতি কূট চাল চেলেছেন কুরুরাজ! শতাধিক শিষ্যসহ সহসা গিয়ে উপস্থিত হলে বনবাসী যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা, যত বড় দিগ্বিজয়ী বীরই তাঁরা হ’ন না কেন, দুর্বাসার সন্তুষ্টিসাধন তাঁরা করতে পারবেন না। প্রদান করতে পারবেন না তাঁদের ক্ষুধানিবারনের পর্যাপ্ত অন্ন। ফলতঃ তাঁদের উপর বর্ষিত হবে ক্রুদ্ধ ব্রহ্মর্ষির অমোঘ অভিশাপ। পরিস্থিতিটি কল্পনা করে দুর্বাসা সাতিশয় আনন্দিত বোধ করলেন। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ঋত্বিক পদটি না পাওয়ার ক্রোধ তাঁর এখনও প্রশমিত হয়নি।

পদপ্রান্তে জোড়হস্তে উপবিষ্ট কুরুরাজের মস্তকে অভয়হস্ত স্থাপন করলেন দুর্বাসা। ‘‘তথাস্তু, রাজন। তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করবো আমি।’’

কুরুরাজের মুখমণ্ডল অভীষ্ট পূরণের হাসিতে উদ্ভাসিত হলো। তিনি আভূমি নত হয়ে দুর্বাসার চরণস্পর্শ করলেন।

দু’জনের কারওরই দৃষ্টিগোচর হলো না, শিবিরের এক কোণে দণ্ডায়মানা দাসী চন্দ্রমালার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

..................................................................


রাতের অন্ধকারে অস্থায়ী অতিথি শিবিরের বাইরে বনের ধারে এক প্রকাণ্ড অশ্বত্থ বৃক্ষের ছায়ায় প্রায় প্রচ্ছ্বন্নাবস্থায় দণ্ডায়মান এক ক্ষীণকায় পুরুষ। উষ্ণীষের বস্ত্রাংশে তার মুখমণ্ডল প্রায় সম্পূর্ন আচ্ছ্বাদিত। শুধু সতর্ক চক্ষু দু’টি ইতস্তত দৃষ্টিপাত করছে। এক সময় সে দৃষ্টি শিবিরের নিষ্কাশন পথের উপর নিবদ্ধ হলো। কে যেন আসছে... স্ত্রীলোক...

নিকটবর্তী হতে অস্বচ্ছ চন্দ্রালোকে চন্দ্রমালাকে চেনা গেলো। ত্বরিতপদে এসে সে সেই পুরুষটির সমুখে দাঁড়ালো। চতুর্পার্শ্বে সতর্ক দৃষ্টিক্ষেপ করে তারপর হ্রস্বকন্ঠে কি যেন বললো। পুরুষটি একবার তার দিকে চকিতনেত্রপাত করে সম্মতিসূচক শিরঃশ্চালনা করলো, তারপর দ্রূতপদে বনাভ্যন্তরে মিলিয়ে গেলো।

চন্দ্রমালা অলস মন্থর পদক্ষেপে শিবিরে ফিরে চললো। তার কার্য এতক্ষণে সম্পূর্ণ সমাধা হয়েছে।

..................................................................


সশিষ্য দুর্বাসা চলেছেন কাম্যকবন অভিমুখে। সম্মুখে আর সপ্তাহেকের পথ। দীর্ঘ, ক্লান্তিকর যাত্রা। কোপনস্বভাব মহর্ষি পথশ্রমে আরও বিরক্ত, আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছেন ক্রমশ। সেই সঙ্গে চেতন-অবচেতনের মধ্যবর্তী কোনও মননে অনুভব করছেন এক অদ্ভূত আনন্দ... অভিশাপ বর্ষনের সুযোগ পেলে প্রয়োজনে আত্মনিগ্রহের বিনিময়েও মানুষ চিরকাল যে বিকৃত আনন্দ অনুভব করে... সেই অবরুদ্ধ উল্লাস!

..................................................................


চন্দ্রমালার পরিচিত সেই ক্ষীণকায় গুঢ়পুরুষটি অশ্বপৃষ্ঠে বায়ুবেগে ধাবিত হচ্ছে। অশ্বের ফেনায়মান মুখ দর্শনে অনুভূত হয়, তার গতি বিগত বহু সময় অবধি রুদ্ধ হয়নি।

সমুদ্রতরঙ্গের উত্তাল ধ্বনি কর্নগোচর হচ্ছে অশ্বারোহীর। সুদূরে ফেনিল জলরাশির প্রেক্ষাপটে স্বর্ণনির্মিত উত্তুঙ্গ প্রাসাদশীর্ষ দৃশ্যমান। অস্তগামী সূর্যের রক্তিমাভায় স্নান করছে আর্যাবর্তের নবতম শক্তিকেন্দ্র... দ্বারকাপুরী।

..................................................................


কাম্যকবনের ছায়াসুনিবিড় অপরাহ্ন। বনের মধ্যবর্তী একটি বিস্তীর্ণ শষ্পাচ্ছ্বাদিত বৃক্ষশোভিত ভূমিতে পর্ণকুটীরের সারি। তার সম্মুখে মধ্যাহ্নভোজনতৃপ্ত সূত-ব্রাহ্মণের দল বিশ্রম্ভালাপরত। তাঁদের মধ্যমণি এক চম্পকবর্ণ দেবোপম পুরুষ। তাঁর পদ্মপলাশনেত্রে ত্রিভুবনের স্নেহ, করুনা, ভালোবাসা সঞ্জাত। রাজ্যচ্যূত সম্রাট যুধিষ্ঠির তাঁর প্রিয় ব্যসন ব্রাহ্মনাদির সঙ্গে আধ্যাত্মালোচনায় মগ্ন। তাঁর বামপার্শ্বে উপবিষ্ট আরেক দেবদুর্লভকান্তি অনিন্দ্য সুন্দর যুবাপুরুষ। গৌরবর্ণ বলিষ্ঠ দীর্ঘ দেহে শক্তি ও সৌকুমার্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ। চতুর্থ পাণ্ডব নকুল এই আলোচনা গুলিতে অংশগ্রহণ করতে ভালোবাসেন... মূলত শ্রোতারূপে।

অনতিদূরে একটি সুপরিসর কুটীরের সম্মুখস্থ ভূমিতে দাসী-সহচরী পরিবৃতাবস্থায় উপবিষ্টা যে আলোকসামান্যা সুন্দরীর পদকমলপত্রে দু’জন দাসী অলক্তকরাগ লেপনে ব্যাপৃত ও জলদসদৃশ কেশদামে একজন বেনীবন্ধনরত, তিনি পঞ্চপাণ্ডবের নয়নমণি যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী। এমন অপার্থিব সৌন্দর্য, এমন বৈদগ্ধ্য, এমন প্রভাবতী ব্যক্তিত্ব সম্ভবত সমগ্র নারীজাতির বিবর্তনে একত্রে সমবেত হয়নি ইতিপূর্বে... হয়তো আর হবেও না।

কুটীরের অন্দর হতে ভেসে আসা ব্যাঘ্রগর্জনের ন্যায় নাসিকাধ্বনি কর্ণগোচর হচ্ছে দ্রৌপদীর। মধ্যমপাণ্ডবের আজ ইষৎ গুরুভোজন হয়েছে। বরাহ ও মৃগমাংসের দু’টি পদ তিনি আজ স্বহস্তে প্রস্তুত করেছিলেন। আপন রন্ধনগুণে আপনি অভিভূত হয়ে মধ্যাহ্নে কিছু অধিক আহার করে ফেলেছেন। তাই এখন বিশ্রামগ্রহণ করে দেহযন্ত্রকে পরিপাকে সাহায্য করছেন। ভীমসেনের নাসিকাগর্জন মধ্যে মধ্যে দ্রৌপদীর ওষ্ঠে ইষৎ হাস্যসঞ্চার করছে।

কিন্তু তাঁর দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ। কুটীরের সারি যেখানে শেষ, বনানীর সেই প্রান্তে অস্ত্র পরিচর্যা করছেন দুই পুরুষ। একজন প্রায় নকুলের অনুরূপ... সুঠাম, সুকুমার, অতি সুদর্শন কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব। তিনি যাঁকে সাহায্য করছেন, তিনি শালপ্রাংশু মহাভুজ, বাকি পাণ্ডবভ্রাতাদের তুলনায় দেহবর্ণ শ্যাম। দুই কীণাঙ্কিত মহানাগসদৃশ বাহুদ্বারা এক একটি ধনুর গুণাকর্ষণ করে তাদের নমনীয়তা পরীক্ষা করছেন। সমগ্র চেতনা, সম্পূর্ণ মনন যেন তাঁর দুই আয়ত চক্ষে সংবদ্ধ... যেন সহসা বজ্রপাত হলেও গাণ্ডীবধন্বা সব্যসাচীর অস্ত্রপরিচর্যায় ব্যাঘাত হবে না। 

গুণের প্রবল আকর্ষণে একটি কাষ্ঠনির্মিত ধনু সহসা ভগ্ন হলো। অন্য কারও হস্তধৃত হলে তার বিক্ষিপ্ত ভগ্নাংশে আঘাতপ্রাপ্তির সমূহ সম্ভবনা ছিলো। কিন্তু অর্জুন অভ্যস্ত নিপুণতায় শরীর নমিত করে সে আঘাত পরিহার করলেন। তারপর সহদেবের দিকে চেয়ে মন্দ্রকন্ঠে বললেন, ‘‘শালকাষ্ঠ ধনুনির্মানের উপযুক্ত নয়। অনমনীয়, কঠিন... তাই ভঙ্গুর। গদা নির্মানের জন্য প্রকৃষ্ট...’’

তাঁর বাক্য সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই তৃণভূমির অপর প্রান্তে অরণ্য সমীপে জনসমাগম দৃশ্যমান হলো। অর্জুন, সহদেবের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলেরই দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হলো। যুধিষ্ঠির, নকুল ও অন্যান্য সূত-ব্রাহ্মণরা ত্বরিতে গাত্রোত্থান করে দণ্ডায়মান হলেন। অর্জুন, সহদেবও অস্ত্রগুলিকে ভূমিতে স্থাপন করে এদিকে অগ্রসর হলেন। দ্রৌপদী ও তাঁর সহচরীরাও কিঞ্চিৎ সন্ত্রস্ত হলেন।

আগন্তুকের দল অগ্রসর হচ্ছেন। যুধিষ্ঠির তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলেন সর্বাগ্রবর্তী শশ্রূগুম্ফসমন্বিত পক্ককেশ প্রৌঢ়কে। ক্রমশ তাঁর চক্ষু বিস্ফারিত হলো! শঙ্কায় অন্তরাত্মা কম্পিত হয়ে উঠলো! সর্বনাশ! এ যে সশিষ্য ঋষি দুর্বাসা!

..................................................................


চতুরাশ্ববাহিত একটি রথ উল্কাবেগে ধাবিত। অশ্বগুলি অত্যন্ত তেজী, বলিষ্ঠ ও দ্রূতগতি। সারথির হস্তধৃত কশা শূণ্যেই আস্ফালিত হচ্ছে শুধু, অশ্বপৃষ্ঠে পতিত হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রশিক্ষিত অশ্বেরা রথটিকে অসম্ভব দ্রূতগতিকে বহন করে নিয়ে চলেছে।

রথীর মুখ ইষৎ চিন্তান্বিত। কাম্যকবনের পাণ্ডব শিবির এখনও এক প্রহরের পথ। দুর্বাসা সম্ভবত ইতিমধ্যে উপনীত হয়েছেন সেখানে। পথে আভীরপল্লীতে বিলম্ব হলো...

..................................................................


শিষ্যপরিবৃত দুর্বাসা গোমতী নদীতে স্নানরত। সর্বপাপনাশী অঘমর্ষণ মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে দুর্বাসার অধরপ্রান্তে মধ্যে মধ্যে একটি তৃপ্তির হাস্য ক্রীড়া করছে। জগদ্বিখ্যাত সম্রাট যুধিষ্ঠির, তাঁর ইন্দ্রতুল্য বীর ভ্রাতাগণ ও তাঁদের বিশ্ববন্দিতা স্ত্রীর অসহায়, বিপন্ন মুখগুলি স্মরণে আসছে বারংবার... এবং আত্মপ্রসাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে মহর্ষির চিত্ত। যুধিষ্ঠির তাঁদের স্নানাদি সম্পন্ন করার নিমিত্ত নদীতীরে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু দুর্বাসা জানেন, সেই স্বল্পাবসরে পর্যাপ্ত আয়োজন করা এই নিবিড় অরণ্যের অভ্যন্তরে পাণ্ডবদের পক্ষে অসম্ভব। কুরুরাজের মনস্কামনা অচিরেই সিদ্ধ হবে।

তীরে উত্থিত হলেন দুর্বাসা। সিক্তবস্ত্র পরিবর্তনে উদ্যত হলেন। সহসা রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি কর্ণগোচর হলো তাঁর। এসময়ে এ অরণ্যে কোন রথীর আবির্ভাব হলো?

বনপথের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করলেন ব্রহ্মর্ষি। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে সে পথে সবেগে আবির্ভূত হলো রথটি। চকিত হলেন দুর্বাসা। রথটি তাঁর পরিচিত! সারথি দারুক পরিচালিত শৈব্য, সুগ্রীব, মেঘপুষ্প ও বলাহক নামক চতুরাশ্ববাহিত এ রথ সমগ্র আর্যাবর্তে প্রসিদ্ধ। 

রথ এসে নদীতীরে দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যগণের সমীপে স্তব্ধ হলো। অশ্বচতুষ্টয় নিমেষ মধ্যে চিত্রার্পিতবৎ স্থির হলো। রথী সহাস্যমুখে অবতরন করলেন। তাঁর পেশীবদ্ধ সুবিশাল শ্যামবর্ণ শরীর বৈদূর্যমনির ন্যায় উজ্জ্বল, মসৃণ। অপরাহ্নের সূর্যালোক সে শরীরে নদ্যোদকের ন্যায় প্রতিফলিত হয়ে যেন আভা বিচ্ছুরণ করছে। পরিমিত স্বর্ণ ও রত্নালঙ্কার শোভিত দেহে পীতবস্ত্রখানি যেন আলোকসঞ্চার করছে। কিন্তু সে দেহের অনুপম সৌন্দর্যও যেন দেহীর মুখমণ্ডলের তুলনায় নিষ্প্রভ। হাস্যবিম্বিত সে মুখে অনন্ত প্রজ্ঞা, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, অপরাজেয় বীরত্ব ও অপরিমেয় প্রেমের অপূর্ব সমাবেশ। চক্ষুদু’টিতে একবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলে সে দৃষ্টি যেন আর প্রত্যাহার করা যায় না...

‘‘মহাভাগ, এই সময়ে এই স্থানে আপনার দর্শনলাভ যতখানি বিস্ময়কর, ততখানিই আনন্দদায়ক।’’ করযুগল আবদ্ধ করে বললেন চতুরচূড়ামণি ভগবদ্প্রতিম যদুকুলকেশরী বাসুদেব কৃষ্ণ। তাঁর কন্ঠস্বরে দুন্দুভির গাম্ভীর্য ও বংশীর মিষ্টত্ব যেন সমানুপাতে মিশ্রিত। দুর্বাসার নিকটে এসে অবনত হয়ে তাঁর চরণস্পর্শ করলেন।

‘‘স্বস্তি!’’ ইষৎ কম্পমান দক্ষিণহস্ত উত্তোলন করে অভ্যস্ত আশীর্বচন করলেন দুর্বাসা।

‘‘সংবাদ কুশল তো?’’ দুচক্ষে কৌতুকের খদ্যোৎ প্রজ্বলিত করে প্রশ্ন করলেন কৃষ্ণ। তাঁর সুসজ্জিত বিশাল দেহ দুর্বাসা ও তাঁর ব্রতোপবাসক্লিষ্ট শিষ্যদের তপঃকৃশ শরীরগুলির প্রতিতুলনায় যেন মৃগযূথের সম্মুখে সিংহ যথা।

‘‘হ্যাঁ... কুশল। কিন্তু তুম... আপনি এই সময়ে এস্থানে?’’ দুর্বাসার কন্ঠস্বরে অস্বস্তি। বয়ঃকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সম্বোধনের এই সম্ভ্রমটুকু আর্যাবর্তের মানুষ নির্বিশেষে আদায় করে নিয়েছেন কৃষ্ণ তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তির বলে। জরাসন্ধবধ ও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পর থেকে সে প্রভাব ক্রমবর্ধমান।

‘‘ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যচ্যূত সম্রাট পাণ্ডব যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা যে আমার পরম মিত্র ও আত্মীয়, সে বিষয়ে আপনি সম্যক অবগত। অধুনা এই বনেই তাঁদের বাস। আমি প্রায়শই আসি তাঁদের সান্নিধ্যে কিয়ৎকাল যাপন করে যেতে। বড় বিড়ম্বিত, বড় দুঃখী তাঁরা... কিন্তু সে প্রসঙ্গ থাক। আপনি বলুন, আপনার এই কাম্যকবনে আগমনের হেতু কি?’’

‘‘আমিও যুধিষ্ঠিরের আতিথ্যগ্রহণ করতে এসেছি।’’ এতক্ষণে একটু স্বাভাবিক হয়েছেন দুর্বাসা। হতে পারেন ইনি আর্যাবর্তের সাম্প্রতিক রাজনীতির কর্ণধার, জরাসন্ধবধের ধুরন্ধর কাণ্ডারী। কিন্তু তিনিও মহাক্রোধী ব্রহ্মর্ষি দুর্বাসা! তাঁর অভিশাপের ভয়ে ত্রিভুবন কম্পমান...

‘‘অতি উত্তম! যুধিষ্ঠির নিশ্চয় আপনাদের আতিথেয়তা করার জন্য সর্বপ্রকার আয়োজন নিষ্পন্ন করেছেন?’’ কৃষ্ণের কন্ঠে আশ্বস্ত প্রশ্ন।

কিঞ্চিৎ ইতস্তত করলেন দুর্বাসা। এই মানুষটির উপস্থিতি যতখানি মনোমুগ্ধকর, ঠিক ততখানিই যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে প্রয়োজনে। ‘‘না... পরিস্থিতি অনুরূপ নয়।’’ কৃষ্ণ নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে। দুর্বাসা বললেন, ‘‘আমাদের আগমন সংবাদ যুধিষ্ঠিরাদি অবগত ছিলেন না।’’

‘‘সে কি কথা, ঋষিবর? সংবাদ পূর্ববিদিত না থাকলে এই নিঃসম্বল বিজনবাসে তাঁরা আপনাদের যথোপযুক্ত আতিথেয়তার আয়োজন করবেন কি উপায়ে?’’ কৃষ্ণের কন্ঠে অপার বিস্ময়...

অল্পকাল বিলম্বের পর দুর্বাসা কঠিন স্বরে প্রত্যুত্তর করলেন, ‘‘সে দায় যুধিষ্ঠিরের। প্রত্যেক ক্ষত্রিয় রাজার কর্তব্য ব্রাহ্মণকে অন্নদান করা, তার জন্য তিনি প্রস্তুত থাকুন বা না থাকুন।’’

‘‘পরন্তু যুধিষ্ঠির এক্ষণে রাজা নন, মহর্ষি।’’ কৃষ্ণের কন্ঠে আকুতি, চক্ষে অনুনয়। ‘‘আপনি সর্বজ্ঞ। তাঁর ভাগ্যবিড়ম্বনা ও অসহয়তার বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত। সে পীড়া বৃদ্ধি করা কি আপনার কর্তব্য? যুধিষ্ঠিরের ন্যায় ব্রাহ্মণ্যের পরম পৃষ্ঠপোষক যজ্ঞকারী রাজার কষ্ট লাঘবের প্রচেষ্টা করাই কি প্রত্যেক ব্রাহ্মণের উচিত নয়?’’

দুর্বাসার ক্রোধোদ্রেক হচ্ছে। তিনি তীব্রদৃষ্টিতে চাইলেন এই অর্বাচীণ যাদববংশীয়ের প্রতি। তাঁর রোষদৃষ্টির সম্মুখে স্বয়ং দেবরাজের হৃৎস্পন্দন বর্দ্ধিত হয়। তিনি পরুষকন্ঠে বললেন, ‘‘আমার কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে আমি সম্যক অবগত, বাসুদেব। কুরুরাজ দুর্যোধনের নির্বন্ধে আমি এসেছি তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতাদের অনুগ্রহ করতে। সে কর্মে আমি বিরত হবো না...’’

‘‘আপনি সম্ভবত আমার বক্তব্য অনুধাবন করতে পারছেন না, ঋষি।’’ দুর্বাসার বাক্য সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই ভেসে এলো বৃষ্ণিসিংহের কন্ঠস্বর। সে স্বরে মধু এখনও বহমান। কিন্তু তার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে তরল ইস্পাত। দুর্বাসা দেখলেন, কৃষ্ণের ওষ্ঠাধরে স্মিতহাস্যটি এখনও বিরাজমান। কিন্তু তাঁর চক্ষে আর অনুনয়, সৌহার্দ্য বা সম্প্রীতির লেশমাত্র নেই। তৎপরিবর্তে আছে এক হিমশীতল প্রতিজ্ঞা। তাঁর নির্দেশ লঙ্ঘণকারীর সম্মুখে এক অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ ভবিষ্যতের প্রতিজ্ঞা। ‘‘পাণ্ডবরা আমার অতি প্রিয় স্বজন... এবং এই সময়ে তাঁরা বিপন্ন। তাঁদের বিপন্নতা কোনও প্রকারে বৃদ্ধি পাক, তা আমার একান্তই অভিপ্রেত নয়... এবং সেই বিপন্নতার কোনওরূপ কারণ ঘটলে তার অপনোদনের দায়িত্ব আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছি।’’

কৃষ্ণ বিরতি নিলেন। অদূরপশ্চাত হতে দারুকের কশা আস্ফালনের ধ্বনি দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যদের কর্ণগোচর হলো। পরমুহূর্তে অশ্বচতুষ্টয় প্রবল হ্রেষাধ্বনিপূর্বক স্থান পরিবর্তন করলো, এবং ফলতঃ রথের অভ্যন্তর দৃশ্যমান হলো। রথ কৃষ্ণের অস্ত্রসম্ভারে পূর্ণ। ধনুঃশর, গদা, চক্র...

‘‘তাই আমি অনুরোধ করছি, আপনারা পাণ্ডবাশ্রমে প্রত্যাগমন করবেন না।’’ মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন চক্রায়ুধ। তাঁর মুক্তাঙ্গুরীয় শোভিত তর্জনী পশ্চিমদিকে নির্দেশ করলো। ‘‘অদূরে অরণ্যপ্রান্তে আভীরপল্লী। তারা আমার পরিচিত ও প্রীতিভাজন। সেস্থানে আপনাদের পানভোজনের পর্যাপ্ত আয়োজন করা হয়েছে। আপনাদের স্নানাহ্নিক সমাপ্ত, অনুমিত। আপনারা দয়াপূর্বক সেস্থানে গমন করুন, আহার ও বিশ্রাম করুন, অতঃপর সেই সরল আরণ্যক গ্রামবাসীদের আশীর্বাদ করে তৃপ্তচিত্তে বিদায়গ্রহণ করুন। এতঃদ্বারা আভীরদের, আপনাদের, পাণ্ডবদের এবং আমারও মঙ্গল সাধিত হবে।’’

দুর্বাসা কিয়ৎকাল শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কৃষ্ণের রথের দিকে। এ অনুরোধই হোক, বা নির্দেশ, একে অতিক্রম করার সাধ্য তাঁর নেই। অতঃপর তাঁর কন্ঠ হতে অনভ্যস্ত কম্পিত স্বরে ‘‘তথাস্তু’’ ব্যতিরেকে আর কোনও শব্দ নির্গত হলো না। কৃতাঞ্জলিপুটে মধুসূদন মধুর স্বরে বললেন, ‘‘ধন্য! আশির্বাদ করুন, যেন সদা সত্যে স্থিত থাকি।’’

বৃদ্ধ ব্রহ্মর্ষির বলিরেখাঙ্কিত দক্ষিণ হস্ত আশীর্বাদে উত্তোলিত হলো।

..................................................................


অপরাহ্নের মেদুর ছায়া যেন পাণ্ডবদের মুখেও সঞ্চারিত হয়েছে।যুধিষ্ঠির, নকুল ও অর্জুন চিন্তাক্লিষ্ট, বিষন্ন বদনে কুটীরের সমুখে উপবিষ্ট। দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যগণ এখনও প্রত্যাবর্তন করেননি। স্বাভাবিকের কিছু অধিক সময় ব্যতীত হয়েছে। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধা কিছু হচ্ছে না পাণ্ডবদের। ভাণ্ডারে যা তণ্ডুল, গোধূম ছিলো, তাই সম্বল করে রন্ধনে প্রবৃত্ত হয়েছেন দ্রৌপদী। দাসীদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সাহায্য করছেন ভীম ও সহদেব। মধ্যম পাণ্ডবের আনন ক্রোধে রক্তবর্ণ। তাঁদের হেনস্থার কি আর শেষ নেই? গর্ভস্রাব দুর্যোধন ও তার ভ্রাতাগুলিকে একবার এই বাহুঘেরে পেলে...

কৃষ্ণা পাঞ্চালীর চিত্ত শঙ্কায় আচ্ছ্বন্ন। ক্রুদ্ধ দুর্বাসার অভিশাপ যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে, ত্রিভুবনে কারও তা অবিদিত নয়। এই বিপদ হতে পরিত্রাণের উপায় কি? চিন্তার কূলকিনারা পাচ্ছেন না দ্রৌপদী... এবং বার বার তাঁর মনে প্রতিভাত হচ্ছে একটি পুরুষের মুখ। সে মুখে ভুবনমোহন হাসি, দু’চক্ষে নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের বরাভয়। তিনি যদি এই সময় থাকতেন এখানে...

বাহির হতে কিছু বিজাতীয় ধ্বনি ভেসে এলো। ওই বুঝি দুর্বাসা ফিরলেন! শঙ্কিতা দ্রৌপদীর মৃণাল ভুজযুগল সম্ভবত নিজের অজান্তেই তাঁর কপোলদেশে উত্থিত হলো... কিন্তু না! এ তো রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি! আবার কে এলেন এই সময়ে?

প্রাঙ্গণে এসে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন দ্রৌপদী। এও কি সম্ভব? ভীম ও সহদেব সবেগে অগ্রসর হলেন সেদিকে, যেদিকে দণ্ডায়মান বিস্ময়াপ্লুত যুধিষ্ঠির, অর্জুনাদি। তঁদের সম্মুখে অতিপরিচিত রথ হতে অবতরন করছেন জগত্তারন জনার্দন, দ্রৌপদী ও অর্জুনের প্রাণসখা, যুধিষ্ঠিরের অনুজপ্রতিম, এ বিপন্নকালে পাণ্ডবদের একমাত্র সহায় অচ্যূত কৃষ্ণ!

দ্রৌপদীর কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগলো... তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? না, কারণ সহাস্যবদনে তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে আসছেন মাধব। বলছেন, ‘‘আমি বড় ক্ষুধার্ত! আমায় দু’মুষ্টি অন্ন দিতে পারো, কৃষ্ণা?’’




2 comments:

  1. অপূর্ব !! অ-সা-ধা-র-ণ !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। এই বিভাগে আরও রচনা ঋতবাককে সমৃদ্ধতর করুক।

      Delete