0

সম্পাদকীয়

Posted in


আরও একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা হয়ে গেল প্রবীনা ধরিত্রির। আরও একটি বছর কালের অতলে তলিয়ে যাওয়া এখন শুধু আর কয়েকটি দিনের অপেক্ষা মাত্র। ঘটনাবহুল একটি বছর! আসলে প্রতিটি বছরই ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত, একেকটি মাস, দিন, ক্ষণ নিয়েই তৈরি। চক্রাবর্তহারে দিনাতিপাত। কখনও পথ মসৃণ, তো কখনও কিছুটা উপলবন্ধুর।

এদিকে গত মাসে ঘোষিত হয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২২ এর দিনপঞ্জি। প্রকাশকরাও নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী একরাশ আশায় ভর করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ওই পক্ষকালটির জন্য। অনিশ্চয়তার মেঘ যেন তবুও কাটতেই চাইছে না কিছুতেই। এইসময় মুদ্রণজগতে যে ব্যস্ততা প্রত্যাশিত, তা কিন্তু এখনও অনুপস্থিত। তবু তো মানুষ স্বপ্ন দেখে। তবু তো ছুঁতে চায় আকাশ!

প্রতি বৎসরান্তের মতোই প্রত্যাশা করি, নতুন বছর নতুন কিছু নিয়ে আসুক; নতুন কোনও উপলক্ষ্য, নতুন উদযাপন, নতুন পরিণতি, নতুন ফলাফল...

আনন্দে থাকুন সকলে। সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - কস্তুরী মুখোপাধ্যায়

Posted in



ঐতিহাসিক কারণে পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিঘাত যখন অনিবার্যভাবে আমাদের উপর এসে পড়ল, তখন সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে বাঙালি ব্যস্ত ব্যাপৃত ছিল গোটা উনিশ শতক জুড়েই। যুগের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে তাঁরা বুঝেছিলেন তাদের প্রথমত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির দাবী অনুধাবন করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এদেশীয় রক্ষণশীল সমাজপতিরা তাই স্থাপন করলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘হিন্দু কলেজ’ (১৮১৬)। ডিরোজিওর শিক্ষকতার সৌজন্যে হিন্দু কলেজের শ্রেণিকক্ষ থেকে উত্থিত ঝড় বাঙালির শান্ত বিশ্বাসনিষ্ঠ সমাজজীবনে নিয়ে এসেছিল প্রতিবাদ ও প্রতিঘাতের আবহ। তাই ইতিহাসকারদের চোখে ‘ইয়ংবেঙ্গল’ একটা আলাদা ‘phenomena’র মর্যাদা পেয়েছে।

ইয়ংবেঙ্গলরা মূলত যা করেছিল, তা হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতিকে তাদের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করা। কিন্তু একাজ করতে গিয়ে দেশীয় ভাষা-সংস্কৃতি তাদের অবজ্ঞার সামগ্রী হয়ে উঠেছিল —এধরনের একটা অতিসরলীকৃত ধারণার বশে যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তাতে গুরুতর ভ্রান্তি রয়ে গেছে। ইতিহাস তো বলে, অন্যতর ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা পরিণামে দেশি ভাষা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার কাজেই লাগে।

আলেকজান্ডার ডাফ বলেছেন, ইয়ংবেঙ্গল সূচিত নবযুগের বার্তা দুটি কার্যকরী পথে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এক, বিতর্কসভা- ‘The first appeared in the almost instantaneous formation of a great number of debating societies.’ আর দুই, পত্রপত্রিকা- ‘The second way in which the newly awakened sprit strongly manifest itself was through the medium of the press’.১ তারা সবাক হয়েছিল বিভিন্ন সভাসমিতিতে, আর পত্রপত্রিকায় তারা শানিয়েছিল তাদের কলম। এই নিবন্ধে আমরা আলোকপাত করব শুধুমাত্র তাদের কথন-সংস্কৃতির উপর। দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব ইয়ংবেঙ্গলরা মাতৃভাষাচর্চার সপক্ষে সভা-সমিতির ক্ষেত্রকে কীভাবে ব্যবহার করেছিল।

ইয়ংবেঙ্গলদের বাকচর্চার প্রথম সভা ছিল ১৮২৮ সালের ‘আকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’। প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মানিকতলার বাগানবাড়িতে বসত ‘আকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর বিতর্কের আসর। এর সভাপতি থাকতেন হিন্দু কলেজের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, প্রাচ্যবিদ ড. মিল প্রমুখের উপস্থিতিতেই সেখানে চলত নানাবিধ পূর্বনির্দিষ্ট প্রশ্নাত্মক বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক। ডিরোজিও পাঠদানে একতরফা লেকচার সিস্টেমের পরিবর্তে এনেছিলেন পারস্পরিক তর্ক ও বিতর্কের অবকাশ। আর সেই কারণেই আকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা। নিভৃত পঠন ও শিক্ষকের কাছে একান্ত শ্রবণের পরিবর্তে পূর্বনির্দিষ্ট একএকটি বিষয় নিয়ে সর্বসমক্ষে তর্ক। একটি বিষয়কে নিয়ে এক একজন এক এক রকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেতে উঠত। শ্রোতারাও অংশগ্রহণ করতে পারত তাতে। ইংরেজিতেই বলত তারা। কিরকম ছিল সেই বক্তৃতার আবহ, আলেকজান্ডার ডাফের সাক্ষে মেলে তার বিবরণ—
ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছে এমন একজন যদি দেখে সেখানকার সমুদ্রতীর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রাচ্যের ‘olive complexed and bronze coloured’ ছেলেরা স্বচ্ছন্দে ইংরেজিতে মহৎ সব বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক করছে তবে বিস্ময়ে হতবাক ও আকৃষ্ট না হয়ে পারা যায়না।… প্রকৃতপক্ষে যে ধরণের দৃঢ়তা ও নির্ভিকতার সঙ্গে তারা দেশীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য উপস্থাপিত করে এবং দুঃসাহসিক নির্দয়তায় দেশ-বিদেশের বিখ্যাত গ্রন্থকার বা শাস্ত্রকারদের সমালেচনা করে, সুখী দেশের (ইউরোপের) ছেলেরা তাকে অতিক্রম করা তো দূরের কথা তার ধারে কাছেও আসতে পারবে না।২

বিতর্কসভা শুধু একটা নয়, অনেক বিতর্কসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সারা কলকাতা জুড়ে। এটা করেছিলেন ইয়ংবেঙ্গলরাই। ডাফ লিখেছেন—
শহরের সমস্ত প্রান্তে এইসব সভা দ্রুত আত্মপ্রকাশ করল। এমন একটা সন্ধ্যাও ছিলনা যেদিন একটা, দুটো এমনকি ততোধিক সভা না হত। এক একজন অনেকগুলো সভায় তাদের নাম নথিভুক্ত করে রাখত। আলোচনা ও বিতর্ক তখন শুদ্ধ বাতিকের পর্যায়ে। তার ফলে ঘন ঘন অনুষ্ঠিত এইসব বিচিত্র প্রকারের সভা থেকে অল্পবয়সিদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিজনিত আতিশয্য দেখা দিত। আসলে এটা ছিল প্রথম খনিমুখ বিস্ফোরণের স্বাভাবিক ক্রিয়া।৩

ইয়ংবেঙ্গলরা কিভাবে বক্তৃতা দিতেন এইসব বক্তৃতাসভায়, শ্রোতাদের তা আম্দোলিতই বা করত কতখানি— সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসরণ করে তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যায়। ১৯৩৫ সালে টাউন হলে চার্টার অ্যাক্ট-এর একটি সমালোচনামুলক বক্তৃতা উপস্থাপিত করেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক—
‘I think a greater injustice could not have been committed’ (loud cheers)। এর সপক্ষে যাঁরা, তাঁদের কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই আছে কিন্তু এদেশের দরিদ্র জনগনের কাছ থেকে আদায়ীকৃত করের টাকায় কেন তা করা হবে? বিশেষ করে সেই জনগণ যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।, যাদের পোষাক-আহার কিছুই ভালো মত জোটে না, তাদের টাকায় কোম্পানির সিভিল ও মিলিটারি সারভেন্টদের পারমার্থিক সুখের জন্য এসব কেন বানানো হবে? (তুমুল হর্ষধ্বনি)৪

পরদিন ৬ই জানুয়ারি ‘বেঙ্গল হরকরা’-এর রিপোর্ট বলে তাঁর বক্তৃতার মাঝখানে হর্ষধ্বনি উঠেছিল ২২বার। বলে দিতে হয় না, বক্তা হিসেবে শ্রোতাদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কতখানি ছিল।

রামগোপাল ঘোষ এক বক্তৃতায় তিনজন খ্যাতনামা ইংরেজ ব্যারিষ্টারকে ধরাশায়ী করে দিয়েছিল। ‘জন বুল’ পত্রিকা তাঁকে ‘ডিমোস্থিনিস’ আখ্যা দিয়েছিল (১৮৪৭)—
A Demosthenes has appeared on the Indian platform. a Young Bengalee has floored three such Barristers as Turton. Dickens and Hume.৫

কিন্তু বক্তৃতার বিষয়ই হোক, উপস্থাপিত মতের সপক্ষে উদাহরণই হোক, আর বক্তৃতা উপস্থাপনের ভাষাই হোক— ইয়ংবেঙ্গলদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা মহল থেকে উঠেছিল অতি পাশ্চাত্যগামীতার অভিযোগ। সেইসব অভিযোগ খন্ডনে শেষ পর্যন্ত এগ্য়ে এসেছিল তারাই। ১৯৫৬ সালের ১লা জুন ডেভিড হেয়ারের স্মরণসভায় কৃষ্টদাস পাল ‘Young Bengal Vindicated’ শীর্ষক লিখিত ডিসকোর্সে বলেছিলেন—
Sometimes ago it was a fashion to cry down the language of our own country. /13/ Men ran so mad with English that they counted it a degradation and a waste of time to apply themselves to study of a Vernacular— to muse after they had conversed with the divine and genial sprit of Shakespeare and Milton, Burns and Young, over the unpleasant and rough beauties— unpleasant and rough to their then thinking of course— of a Bharut and Ramprosad. But happily those men are cherished their strange disposition, have now altered their creed of literature— reformed their tastes. The blood that boiled within them when in the May flush of youth, having become cool, they have sobered themselves down in their literary habits. They are now the zealous advocates of Bengali. will it be believed when I say that one, who, like Gibbon, completely ceased speaking in his own languages, has now, after the fit of mad youth being gone, diligently applied himself to its cultivation, and, what is strings, edits a paper!৬

এর অনতিপরেই বাংলা সাহিত্যে মাইকেল আসছেন তাঁর সৃজনসম্ভারে বাকসংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে মাতৃভাষার সপক্ষে ইয়ংবেঙ্গল উদ্যোগে স্থাপিত সভাগুলির দিকে আমরা আলোকপাত করব। এবং এপ্রসঙ্গে প্রথম নামটিই উঠে আসে ১৮৩২ সালে সিমলা স্কুলে প্রতিষ্ঠিত রামমোহন রায়ের ‘সর্ব্বতত্ত্বদীপিকা সভা’—
এর উদ্যোক্তারা ইয়ংবেঙ্গল না হলেও অনেকেই হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমাপ্রসাদ রায়। সভাটি আকারে ছোট হলেও গুরুত্বে ছোট নয়। এই সভা স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাভাষার বিশেষ অনুশীলন করা।৭

সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা

‘সর্ব্বতত্ত্বদীপিকা সভা’ স্থাপনের ছ-বছর পর, ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে মূলতঃ ইয়ংবেঙ্গলদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’ (Society for Acquisition of General Knowledge)। প্রায় তিন শতাধিক দেশীয় শিক্ষিত মানুষের উপস্থিতিতে সংস্কৃত কলেজের হলে ১৮৩৮ সালের ১২ মার্চ এই সভার প্রতিষ্ঠা।

এই সভা স্থাপিত হয়েছিল এদেশীয়দের জ্ঞানের উন্নতির জন্য। নানান ধরনের জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে পরস্পরের সহায়তা এবং পরস্পরের মধ্যে প্রীতিবর্ধন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, তারাচাঁদ চক্রবর্তী এবং রাজকৃষ্ণ দে-র স্বাক্ষরিত ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’র প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল—
Thought humiliating be the confession, yet we cannot for a moment deny the truth of the remark so often made by many able and intelligent Europeans, who are by no means inimical to the cause of native improvement, that is no one department of learning, are our acquirements otherwise than extremely superficial. We need only examine ourselves in order to be convinced of the justice of the remark. After the ground work of our mental improvement has been laid in the school, and the school seldom does more, we enter into the world and never think of building a solid super structure. The fate of our Debating Associations most of which are now extinct, while not once is in a flourishing condition, as well as the puerile character of the native productions that appear in the periodical publications are lamentable proofs of this sad neglect. If a tree is to be known by its fruits, where, with but one or two solitary exceptions, are the fruits to which we can point with pride and satisfactions, as manifesting any degree of intellectual energy or extent of learning? We have even sincerely regretted the want of an Institution which should be the means of promoting frequent mutual intercourse among the educated Hindoos, and of exciting an emulation for mental excellence…৮

প্রতি মাসের দ্বিতীয় বুধবার বসত ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’-এর বৈঠক। প্রতি বৈঠকেই নানাবিধ বিষয় নিয়ে চলত আলোচনা। একেকদিন একেকজন সভ্য কোনো একটি বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করতেন। পাঠ শেষ হলে অন্যান্য উপস্থিত ব্যক্তিরাও সে বিষয়ে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতেন এবং মতামত প্রকাশ করতেন। নির্দিষ্ট ও সমুচিত কারণ ছাড়া এই সভায় বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে বিচ্যুতির ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞা। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন—
যিনি বক্তৃতা দিব বলিয়া সমুচিত কারণ ভিন্ন বক্তৃতা না দিবেন, তাঁহাকে জরিমানা দিতে হইবে। এরূপ নিয়ম কোনো সভাতে পূর্ব্বে দেখা যায় নাই। ইহাতে বুঝা যাইতেছে তাঁহারা কিরূপ চিত্তের একাগ্রতার সহিত উক্ত কার্য্য আরম্ভ করিয়াছিলেন।৯

এ সভার অনুষ্ঠানপত্রে প্রদত্ত নিয়মাবলিতেও রয়েছে সভার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের একাগ্রতা ও কঠোরতার পরিচয়। সেই নিয়মাবলির কিয়দংশ এখানে উদ্ধার করা হল—
The following are the standing rules of the society.
1st. That is highly desirable that a society be established among the young natives with the object of promoting mutual improvement and this society for the Acquisition of General Knowledge.
2nd. That the purpose monthly meeting be held at which written or verbal discourses be delivered on subjects previously chosen by the Deliverers excluding religious discussion of all kinds.
7th. That at any meeting at least one member shall deliver a discourse and that the name of the member and the subject of all discourse shall be made known of the immediately proceeding meeting— the name having been ascertained previously by the standing committee.
8th. That after discourse has been delivered any other member shall be at liberty to express his sentiments on it.১০

এই ধরনের গোটা দশেক নিয়মাবলি শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’। যে লক্ষ্যে এ-সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা থেকে কোনভাবেই যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা।


পঠিত প্রবন্ধাবলি:

১৮৩৮ সাল থেকে ১৮৪২ সাল অবধি সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভায় পঠিত প্রবন্ধের সংখ্যা খুব কম নয়। বাংলা এবং ইংরাজি উভয় ভাষাতেই এখানে প্রবন্ধ পাঠ করা হত। ইংরেজি ভাষায় পঠিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
  • On the Nature and Importance of Historical Studies; by Rev. Krishnamohun Banerjea; Delivered on the 16th May, 1838
  • On Poetry; by Baboo Rajnarain Dutt; Delivered on the 13th July, 1838
  • A Topographical and Statistical Sketch of Bancoora; by Baboo Huro Chandra Ghose; Delivered on 12th September, 1838
  • Sketch of the Condition of Hindoo Women; by Baboo Mohesh Chunder Deb; Delivered on 14th September, 1839
  • State of Hindoostan under the Hindoos. No 1; by Baboo Peary Chand Mittra; read on the 14th September, 1839
  • Reform, Civil and Social among the Educated Hindoos; by Rev. Krishna Mohana Banerjea; read on the 18th May, 1840
  • Descriptive Notices of Chittagang— Part III. The Sitacoond Pilgrimage; by Baboo Gobindchunder Bysak; read on the 9th December, 1841
  • Plan for a New Spelling Book; by Baboo Gobindchunder Bysak; read on 11th November, 1840
  • Descriptive Notices of Tippera; by Baboo Gobindchunder Bysak; read on 14th July, 1841
  • A few desultory Remarks on the “Cursory Review of the Institutions of Hindooism offending the interest of the ‘Female Sex”, contained in the Rev. K.M. Banerjea’s Prize Essay on Native Female Education; by Baboo Peary Chand Mittra; read on the 12th January, 1842.
এই সভায় বাংলাভাষায় পঠিত প্রবন্ধগুলি ছিল এইরকম—
  • এতদ্দেশীয় লোকদিগের বাঙ্গালাভাষা উত্তমরূপে শিক্ষাকরণের আবশ্যকতা বিষয়ক প্রস্তাব; বাবু উদয়চন্দ্র আঢ্য কর্ত্তৃক ১৩ জুন, ১৮৩৮ তারিখে সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভায় পঠিত।
  • On Knowledge; বাবু গৌরমোহন দাস কর্ত্তৃক ১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৮ তারিখে পঠিত।
  • রাজবৃত্তান্ত; বাবু গোবিন্দচন্দ্র সেন কর্ত্তৃক ৯ জানুয়ারি, ১৮৩৯ তারিখে পঠিত।
  • ভারতবর্ষের সংক্ষেপ ইতিহাস; বাবু গোবিন্দচন্দ্র সেন কর্ত্তৃক পঠিত।
১৮৪৩ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ‘জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’য় দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ‘The state present of the Honorable East India Company’s Court of Judicature and Police under the Bengal Presidency’ শীর্ষক বক্তৃতায় সরকারী বিচারবিভাগ এবং পুলিশ বিভাগের দুর্নীতিকে সমালোচনা করে বলেন—
অস্ত্রশস্ত্র নয়, গোলাবারুদ নয়— জনগণের হৃদয় জয় করাই প্রকৃত শাসন।… বিচারালয় নামে যা রয়েছে তাকে বিচারালয় বলা ভাষার অপব্যবহার— পৃথিবীর কোনো দর্শনে এর অনুমোদন নেই।১১

এধরণের সরকারবিরোধী বক্তব্যে অধ্যাপক রিচার্ডসন উত্তেজিত হয়ে বাধা দিলে সভাপতি তারাচাঁদ চক্রবর্তী রুলিং জারি করে তাঁকে নিরস্ত করেন।

সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভায় পঠিত এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ তালিকার উপর চোখ বোলালেই বোঝা যায় কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে সেখানে প্রবন্ধ পাঠ করা হত। ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ, সমকালে স্ত্রীলোকদের অবস্থা, কাব্য, স্থানিক ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বিষয় সেখানে স্থান পেয়েছিল। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতে প্রবন্ধ পাঠের বিষয়টিও লক্ষণীয়। বাংলা ভাষার দিকে যে ইয়ংবেঙ্গলদের সংস্কৃতি ক্রমশ ঝুঁকছিল তার প্রমাণ ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’তে সুপরিস্ফুট।


বাংলা ভাষার সপক্ষে রচিত প্রস্তাব:

১৮৩৮ সালের ১৩ জুন ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’য় উদয়চাঁদ আঢ্য নামক এক ব্যক্তি মাতৃভাষার সপক্ষে একটি প্রস্তাব পাঠ করেন। প্রস্তাবটির নাম ছিল— ‘এতদ্দেশীয় লোকদিগের বাঙ্গালাভাষা উত্তমরূপে শিক্ষাকরণের আবশ্যকতা বিষয়ক প্রস্তাব’। এতে বলা হয়েছিল—
মনুষ্যের কম্মর্ দক্ষতাই প্রাধান্যের কারণ, তাহা যে ইংরাজী ভাষার দ্বারা না হইবে এমত আমার প্রস্তাবের ভাবে বুঝিবেন না, কিন্তু এমত জানিবেন যে দেশের মনুষ্য সেই দেশের ভাষায় কম্মর্দক্ষতা হইলে পরাধীন দাসত্বের কারণচ্যুত হইয়া স্ব২ প্রধান হইতে পারেন, তৎপ্রমাণ দেখুন যে এমত দেশও অদ্যপি কতিপয় আছে যে ততস্থের স্বীয়২ জাতীয় ভাষার জ্ঞান দ্বারা বৃহৎ কম্মর্ নিষ্পন্ন করিতেছেন, রাজার ভাষা বা কোন রাজার সহিত সংসৃষ্ট রাখেন না। এই কম্মর্ দক্ষতা নানা প্রকার আছে যথা বাণিজ্য কৃষিকম্মর্ ইত্যাদি। এসকল কম্মর্ লোকদিগের নিজ ভাষায় সুসংস্কার না থাকিলে কিরূপে স্ব২ প্রধানত্বে সম্পূণর্রূপে চলিতে পারে কেননা তাহার এই এক প্রমাণ, আমারদিগের দেশের লোকের স্বভাষায় প্রচুর আলোচনা না থাকাতে অনেকেই বাণিজ্য ঘটিত দ্রব্যের ভাব বা উৎপন্নের উপক্রম বুঝেন না, তাহাতে বাণিজ্য বা কৃষিকম্মর্ কিরূপে করিতে পারে।১২

ইয়ংবেঙ্গলদের উদ্যোগে স্থাপিত সভায় বাংলা ভাষার সপক্ষে এমন জোরালো সওয়াল নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।


বেথুন সোসাইটি

আক্ষরিক অর্থে ইয়ংবেঙ্গদের উদ্যোগে স্থাপিত না হলেও তাদের সক্রিয়তায় পরিচালিত সভাসমিতির ইতিহাসে কালানুক্রমিতার দিক থেকে ‘সাধারণ জ্ঞানোপাজ্জির্কা সভা’র পরই স্থান পায় বেথুন সোসাইটি। এবং এই সভার সঙ্গে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের নামের সংযোজনের বিষয়টিও গুরুত্বপূণর্। এর দুটি কারণ, প্রথমত বেথুন নিজে ছিলেন ‘শিক্ষাসমাজ’-এর (Council of Education) সভাপতি এবং সেই হিসেবে এদেশের শিক্ষার উন্নতি প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োজিত করেছিলেন, যার অন্যতম ফল বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা বিষয়ে উৎসাহদানকারী অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বেথুনের আকস্মিক মৃত্যুতে (১২ আগস্ট, ১৮৫১) চার মাস পর স্থাপিত হয় তাঁর নামাঙ্কিত সভা— বেথুন সোসাইটি।

বেথুন সোসাইটির আয়ুষ্কাল প্রায় চল্লিশ বছর। বেথুনের মৃত্যুকালে ‘শিক্ষাসমাজ’-এর সম্পাদক ছিলেন ডা. মৌএট। ১৮৫১ সালের ১১ ডিসেম্বর মৌএট-এর আহ্বানে মেডিকেল কলেজ থিয়েটারে বেথুন সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’র মতো এখানে কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যপত্র না থাকলেও এই সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য বিবৃত হয়েছিল মৌএট-এর পঠিত প্রস্তাবের মধ্যেই—
That a Society be established under the name of the Bethune Society, for the consideration and discussion of questions connect with Literature and Science.১৩

প্রতি মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার করে বসত বেথুন সোসাইটির অধিবেশন। এই সোসাইটির নিয়মাবলির মধ্যে লিখিত ছিল—
সোসাইটিতে ইংরেজী বাংলা এবং উর্দ্দু এই তিনটি ভাষায়ই প্রবন্ধ পাঠ, বক্তৃতা দান এবং আলোচনাদি করা চলিবে। সভার কার্য-পরিচালনার জন্য একজন সভাপতি, একজন সম্পাদক এবং একটি ‘কমিটি অফ পেপাসর্’ বা ‘গ্রন্থসভা’ থাকিবে। পঠিত প্রবন্ধ সভার সত্ত্ব হইবে। তবে গ্রন্থসভা যোগ্য বিবেচনা করিলে অন্যত্র উহা প্রকাশের অনুমতি প্রবন্ধকারকে দিতে পারিবেন।১৪

বেথুন সোসাইটির প্রথম অধিবেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যে একুশজনের নাম পাওয়া যায় (অন্য একটি তালিকায় চল্লিশ জন) তার মধ্যে অন্তত আট-নয় জনকে ইয়ংবেঙ্গল দলের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এঁদের মধ্যে আছেন রাধানাথ শিকদার, রামচন্দ্র মিত্র, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচরণ সরকার, রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ, কৈলাশচন্দ্র বসু, হরমোহন চট্টোপাধ্যায়, রসিকলাল সেন, প্রসন্নকুমার মিত্র প্রমুখ। পরবর্তীকালে বহু ইংরেজ ও শিক্ষিত বাঙালি এই সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও বেথুন সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এই সোসাইটির প্রথম বছরের কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছিল—
The Bethune Society was established to promote among the educated Natives of Bengal a taste for literary and scientific pursuits and encourage a freer intellectual intercourse that cannot be accomplished by other means in the existing state of the Native Society.১৫

এভাবেই সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল বেথুন সোসাইটি। এক বছরের মধ্যেই এর সদস্য সংখ্যা হয়ে উঠল ১৩১ জন, যার মধ্যে ১০৬ জনই ছিলেন ‘Educated Natives of Bengal’। চল্লিশ বছর আয়ুষ্কালসম্পন্ন বেথুন সোসাইটিতে পঠিত প্রবন্ধের সংখ্যা খুব কম নয়। ইংরেজিতে পঠিত কয়েকটি প্রবন্ধের নাম উল্লেখ করা হল—
  • On Sanskrit Poetry— By Rev. K.M. Banerjea (1852)
  • On the Bengali viewed with reference to his physical, social, intellectual and moral habits, past and present— By Baboo Issur Chunder Mitter (1852)
  • On the Tragedy of Macbeth— By Mr. Lewis, Principal of the Dacca College (1852)
  • On the Comparative view of the European and Hindu dramas— By Baboo Koylas Chunder Bose (1852)
  • On the Relation and Absolute Advantage of Science and Literature in a Collegiate Education— By Prosunna Koomer Surbedhikaree (1852)
  • On Poetic Composition— By J.B.Grisenthwaite (1853)
  • On the Women of Bengal— By Baboo Koylas Chunder Bose (1854)
  • On Hindoo Women as a wife and a widow— By Baboo Nobin Chunder Pandit (1855)
  • Reading from Shakespeare— By Mr. James hume (1856)
  • On the Moral Spirit of Early Greek Poetry— By Mr. G. Smith (1857)
  • On Astronomy— By Professor Burgess
  • Incident and Impression of Travel in Northern, Central and Western India— Rev. Lal Behari De (1860)
  • The Relation between the Hindoo and Budhistic systems of Philosophy and the Light which the History of the One throws on the Others— By Rev. K.M. Banerjea (1861).
আর বাংলা ভাষায় পঠিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, হরচম্দ্র দত্ত পঠিত ‘বাংলা কবিতা’ নামাঙ্কিত একটি প্রবন্ধের। ১৮৫২ সালের এপ্রিল মাসের সভায় এই প্রবন্ধটি পাঠ করা হয়েছিল। তবে বাংলা কবিতার নেতিবাচক দিকটিকেই তুলে ধরা হয়েছিল এতে। যোগেশচন্দ্র বাগল ‘বেঙ্গল হরকরা’-য় প্রকাশিত রিপোর্ট (The Bengal Hurkaru, 21st April 1852) উদ্ধৃত করে লিখেছেন—
আলোচ্য সভায় হরচন্দ্র দত্ত ‘বাংলা কবিতা’ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধ পাঠের পর মহেন্দ্রনাথ সোম প্রবন্ধোক্ত বিষয়ের উপর কিছু মন্তব্য করিলেন। এই বিষয় সম্পকর্ে নবীনচন্দ্র পালিতেরও একটি প্রবন্ধ পঠিত হয়। পাঠের পর আলোচনা সুরু হয়। কৈলাসচন্দ্র বসু প্রমুখ কয়েকজন এই আলোচনায় যোগ দিয়াছিলেন। বাংলা কবিতা অর্ব্বাচীন, অশ্লীল, অনুন্নত ও উচ্চভাব বিরহিত বলিয়া প্রবন্ধ পাঠক মন্তব্য করেন। জনৈক বক্তা এমনও বলেন যে, “বাঙ্গালীরা বহুকাল পর্য্যন্ত পরাধীনতা-শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকায় তাহাদিগের মধ্যে প্রকৃত কবি কেহই জন্মগ্রহণ করে নাই।” বক্তারা প্রায় সকলেই এই মতের সমর্থন করিলেন।১৬

এর পরবর্তী মাসিক অধিবেশনে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কবিতার উপর একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন, এবং এই প্রবন্ধে তিনি পূর্ববর্তী অভিযোগ খন্ডন করে বাংলা কবিতার গৌরব প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। এই কারণেই প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। প্রবন্ধটি পুস্তকাকারে প্রকাশের সময় লেখক স্বাক্ষরিত আখ্যাপত্রে লেখা ছিল—
এই প্রবন্ধ বীটন সভায় পঠিত হয়, সুতরাং বক্তৃতার নিয়মে লিখিত হইয়াছে। অপিচ বাঙ্গালা কবিতার প্রতি উক্ত সভার কতিপয় সভ্য অকারণ কটুক্তি করাতে তদুত্তরেই এতৎ প্রবন্ধের অধিকাংশ লিখিত হইয়াছে, অতএব বাঙ্গালা কবিতার স্বরূপ বর্ণন পুস্তকান্তরে প্রকাশ করিতে ইচ্ছা আছে।১৭

বিভিন্ন সংস্কৃত ও ইংরেজি কাব্য থেকে উদাহরণ তুলে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, যেসব কারণে বাংলা কবিতাকে ‘অর্ব্বাচীন’, ‘অশ্লীল’, ‘অনুন্নত’, ‘উচ্চভাব বিরহিত’ বলা হয়েছে, আসলে তার কোনোটিই ধোপে টেকে না। তিনি রীতিমতো তথ্য-প্রমাণ-উদাহরণ সহযোগে বাংলা কবিতার কৌলিন্য পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন এই ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’-এ।

বেথুন সোসাইটিতে পঠিত আরেকটি বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’। এটির রচয়িতা ও পাঠক ছিলেন তৎকালিন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। নানা কারণে এই প্রবন্ধটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে ১৮৫৩ সালের ১২ মার্চের ‘সংবাদ প্রভাকর’ মন্তব্য করেছিল—
বীটন সভার মাসিক বৈঠকে শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত বিদ্যার গৌরব প্রতিভা সন্দীপনমূলক বঙ্গভাষায় যে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছেন তাহা সর্ব্বাংশে উত্তম হইয়াছে, তাহাকে তিনি লিপিনৈপুণ্য ও সংস্কৃত বিদ্যার বিপুল ব্যুৎপন্ন প্রদর্শনে ত্রুটি করেন নাই, যে সকল মহাশয়েরা সভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁহারা সকলেই বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সাধুবাদ প্রদান করিয়াছিলেন।১৮

সংস্কৃতভাষা-গঠনতত্ত্ব, সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র-সংস্কৃত সাহিত্যের নানা ভাগ— তৎসম্বন্ধীয় উদাহরণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিদ্যাসাগরের সুবিস্তৃত অধ্যয়নজীবী প্রতিভার পরিচয় আছে এই ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’-এ। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যচর্চায় বাংলা ভাষার কী লাভ? এ প্রশ্নের যথার্থ জবাবও বিদ্যাসাগর দিয়েছেন তাঁর প্রস্তাবের উপসংহার অংশে—
সংস্কৃতভাষানুশীলনের এক অতি প্রধান ফল যে, ইদানীন্তনকালে ভারতবর্ষে হিন্দী, বাঙ্গালা প্রভৃতি যে সকল ভাষা কথোপকথনে ও লৌকিক ব্যবহারে প্রচলিত আছে, সে সমুদায় অতি হীন অবস্থায় রহিয়াছে। ইহা একপ্রকার বিধিনির্বন্ধস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে যে, ভূরি পরিমাণে সংস্কৃত কথা লইয়া ঐ সকল ভাষায় সন্নিবেশিত না করিলে তাহাদের সমৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি সম্পাদন করা যাইবেক না। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় সম্পূর্ণরূপ ব্যুৎপত্তি লাভ ব্যতিরেকে, তৎসম্পাদন কোনও মতে সম্ভাবিত নহে।১৯

বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনের জন্য সংস্কৃতচর্চার প্রয়োজনের বিষয়টি বিদ্যাসাগর এই প্রবন্ধেই প্রথম তুলে ধরলেন।

অতঃপর বেথুন সোসাইটিতে পঠিত আরেকটি বিখ্যাত বাংলা প্রবন্ধের নাম করা যায়। এই সোসাইটির দ্বাবিংশতি বর্ষে, ১৮৮১ সালের ২৯শে এপ্রিল মাসের সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঠিত ‘সংগীত ও ভাব’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে পঠিত এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে গবেষক লিখেছেন—
প্রবন্ধ পাঠের বৈশিষ্ট এই ছিল, যে সংগীত সম্বন্ধে আলোচনার মধ্যে মধ্যে দৃষ্টান্তস্বরূপ কন্ঠসংগীতের দ্বারাও তিনি সভাজনদের আনন্দ দান করিয়াছিলেন। এই প্রবন্ধটির আলোচনা অংশ ভারতীতে (জৈষ্ঠ্য, ১২৮৮) প্রকাশিত হয়।২০

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মননে যে চিন্তাচেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল বেথুন সোসাইটি তার উৎকর্ষ সাধনে অনেকখানিই সহায়ক হয়েছিল। আর বাংলা ভাষায় যেকটি প্রবন্ধ সেখানে পঠিত হয়েছিল, সেগুলির শৈল্পিক ও বৌদ্ধিক মানও ছিল উচ্চপর্যায়ের। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’ যেমন একদিকে সাহিত্যের ইতিহাস রচনার মুখপাত রচনা করেছে, অন্যদিকে বয়ঃসন্ধিযুগের বাংলা কাব্যের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার একে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—
ইংরেজি কাব্য ও কাব্য ইতিহাসের বিস্তৃত উদাহরণের ওপর নির্ভর করেই তিনি তাঁর শ্রদ্ধান্বিত বক্তব্য উপস্থিত করেন ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’-তে। সেই তথ্যভার সমৃদ্ধ আলোচনা বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার প্রতি মমতাশীল সকলের হৃদয় আকর্ষণ করেছিল। ফলে প্রবন্ধের সমর্থনযোগ্য কাব্য রচনার জন্য রঙ্গলাল নানাদিক থেকে অনুরুদ্ধ হতে থাকেন। ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ তারই ফল।২১

বিদ্যাসাগর পঠিত ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’-টি ছিল বাংলাভাষায় লিখিত সর্বপ্রথম সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস। এই প্রস্তাবের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুকুমার সেন বলেছেন—
এই পুস্তিকাটিতে বাঙ্গালা ভাষায় প্রথম সার্থক সাহিত্য সমালোচনা পাওয়া গেল। ইহাতে এবং মেঘদূতের ভূমিকায় ও পাঠবিচারে বিদ্যেসাগর যা গভীর পান্ডিত্য সহৃদয়তা ও রসজ্ঞতার পরিচয় দিয়াছেন তাহা অতিশয় বিরল।২২


আর বাংলা সাহিত্যের এই প্রথমযুগের সাহিত্য-সমালোচনা, শতধারায় স্ফুরিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথে এসে।

বাগ্মিতার এমন নিবিড় কর্ষণ ইতোপূর্বে অশ্রুত আর অদৃষ্ট ছিল বললেও কম বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে নবযুগের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে পথ দিয়ে পৌঁছেছিলেন তাঁর অবিস্মরণীয় সিদ্ধিতে, সে পথ ইয়ংবেঙ্গলদেরই পথ, তাতে সন্দেহ নেই।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গি ছিল পরোক্ষ। কথক ও শ্রোতার মধ্যে প্রত্যক্ষতা থাকলেও, কবি ও পাঠকের মধ্যে তা ছিল না। মহাভারতের কবি নিজেকে তৃতীয় পুরুষের আসনে সরিয়ে দিয়ে লিখেছিলেন—
মহাভারতের কথা অমৃত সমান
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।

ইয়ংবেঙ্গলীয় বাকসংস্কৃতির উত্তরাধিকারী মাইকেল এসে তাঁর কাব্যাদিতে নিজেকে তৃতীয় পুরুষের পরোক্ষতা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন পাঠক-শ্রোতার মুখোমুখি ভূমিতে—কথা বলে উঠলেন পাঠকের সঙ্গে—
দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!…২৩

এই প্রত্যক্ষ বাচনভঙ্গি হয়তো ইয়ংবেঙ্গলসূচিত বাকসংস্কৃতিরই ফসল। প্রাক্ উনিশ শতকীয় বাংলা সাহিত্যে এই প্রত্যক্ষতা-এই প্রাণ-এই তীক্ষ্ণতা ছিল্ না। লেখনীর উপর বাকসংস্কৃতির এই প্রভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘মেঘনাদবধ’এর মতো মহাকাব্য। যে বক্তৃতারীতি, যে শ্রবণাকাঙ্খা দেখা যেত একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনে, সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভার আসরে, বেথুন সোসাইটির সভাকক্ষে—সেই টানটান উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতার সংস্কৃতিকেই যেন মাইকেল পরিবেশন করলেন তাঁর নবনির্মিত মহাকাব্যে—
সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিত মেঘনাদে—অজেয় জগতে—
উর্ম্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?২৪

লিখিত রচনায় বাকসংস্কৃতির এই প্রভাব—এক অর্থে তো ইয়ংবেঙ্গলদেরই দান। এই বিতর্কময় মননশীল বাকসংস্কৃতির সজীবতা ও তীক্ষ্মতা এরপর দেখা গেল বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় (কৃষ্ণচরিত্র), দেখা গেল বিবেকানন্দের প্রত্যক্ষ ধর্মসভার বক্তৃতাতে, দেখা গেল সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর বৈদগ্ধ্যময় রাজনৈতিক বক্তব্যে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক রচনাকর্মে। রবীন্দ্রনাথের ‘পঞ্চভূত’-এর চরিত্ররা যে ভঙ্গিতে তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছে বা ‘গোরা’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র যে দৃঢ়তায় নিজস্ব আত্মদর্শন প্রতিষ্ঠায় রত হয়েছে তা এর আগে আর দেখা যায়নি। ইয়ংবেঙ্গলদের বক্তৃতাচর্চা এভাবেই প্রবাহিত হয়েছে বাংলার সাহিত্যজগতে, তাতেই পাল্টে গেছে এর রূপ ও রঙ।


তথ্যসূত্র

১. A.Duff, India and Indian Missions (1839), Delhi Edition (Appendix) p. 638; Derozio Remembered, S.S.M., D.C.C., 2008, p. 54
২. ibid, p. 638-639; শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, ‘ডিরোজিও রুটিন ভাঙা এক মাস্টার’, পুনশ্চ, ২০০৯, পৃ. ৩৬ (অনু. শ.মু.)
৩. শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, ‘ডিরোজিও রুটিন ভাঙা এক মাস্টার’, পুনশ্চ, ২০০৯, পৃ. ৩৮ (অনু. শ.মু.)
৪. G. Gangopadhyay(ed.) Bengal: Early Nineteenth Century (selected documents), Research India Publications, Calcutta, 1978, Town Hall Meeting on January 5, 1835, Criticising Chatter Act of 1933, A report published in a special supplement of ‘Bengal Harkaru’, 6 January 1835, and with was subsequently printed as a pamphlet by Samuel Smith and Co., Calcutta; শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, ‘ডিরোজিও রুটিন ভাঙা এক মাস্টার’, পুনশ্চ, ২০০৯, পৃ. ৫৯ (অনু. শ.মু.)
৫. বারিদবরণ ঘোষ, ‘রামগোপাল ঘোষ জীবন ও সাধনা’, প্রজ্ঞা পাবলিকেশনস, ১৯৮৫, পৃ. ৪৪
৬. Young Bengal Vindicated, A Discourse read at the Here anniversary Meeting held on June the 1st 1858 by Kristo Doss Paul, Calcutta, printed at Stan hope Press, 185 Bow Bazar, 1858, rot. Nineteenth Century Studies No. 4, ed Aloke Roy, October, 1873, pp. 445-479; Derozio Remembered, Henry Louis Vivian Derozio Birth bicentenary Celebration Commemoration Volume, Sources and Documents, vol.1 1830-1947, Compiled and edited by Saktisadhan Mukhopadhyay, D.C.C. in collaboration with School of Culture Texts and Records, J.U. 2008, Pg. 126
৭. ‘ইতিহাস অনুসন্ধান’, ১১শ (পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের দ্বাদশ বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত প্রবন্ধাবলি), সম্পা. গৌতম চট্টোপাধ্যায়, ফার্মা কে. এল. এম. প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৬, ‘মাতৃভাষা নবায়নে ইয়ংবেঙ্গলদের ভূমিকা’, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, পৃ. ৪৪২
৮. Selection of the Discourses Delivered in the meeting of the Society for the Acquisition of General Knowledge, vol. 1, Calcutta, Sungbad Poorno Chundrodoy Press, 1840, ‘Proposal for establishing in Calcutta an Institute to be called the Society for Acquisition of General Knowledge.’
৯. শিবনাথ শাস্ত্রী, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ (১৯০৪), সম্পা. বারিদবরণ ঘোষ, নিউ এজ, ২০০৩, পৃ. ১৫৫-১৫৬
১০. Selection of the Discourses Delivered in the meeting of the Society for the Acquisition of General Knowledge, vol. 1, Calcutta, Sungbad Poorno Chundrodoy Press, 1840, ‘Proposal for establishing in Calcutta an Institute to be called the Society for Acquisition of General Knowledge.’
১১. ‘Bengal Harkaru’ , 2nd & 3rd March, 1843
১২. Ibid, ‘শ্রী উদয় চন্দ্র আঢ্য কর্ত্তৃক এতদ্দেশীয় লোকদিগের বাঙ্গালাভাষা উত্তমরূপে শিক্ষাকরণের অবশ্যকতা বিষয়ক প্রস্তাব ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’তে পঠিত হয়। [১৩ জুন, ১৮৩৮] পৃ. ২১-৩০
১৩. যোগেশচন্দ্র বাগল, ‘বেথুন সোসাইটি’, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৭, পৃ. ৮
১৪. তদেব
১৫. তদেব, পৃ. ১৩
১৬. তদেব, পৃ. ১১
১৭. ‘রঙ্গলাল রচনাবলী’, সম্পাদনা- ড. শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও শ্রীহরিবন্ধু মুখটি, দত্ত চৌধুরী এন্ড সন্স, ১৩৮১, ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ ৬৯
১৮. যোগেশচন্দ্র বাগল, ‘বেথুন সোসাইটি’, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৭, পৃ. ১৭
১৯. ‘বিদ্যাসাগর রচনাবলী’, সম্পাদনা- তীর্থপতি দত্ত, তুলিকলম, ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’, বিদ্যাসাগর, পৃ. ১২০
২০. যোগেশচন্দ্র বাগল, ‘বেথুন সোসাইটি’, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৭, পৃ. ১২০
২১. ভূদেব চৌধুরী, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’ ২য় পর্যায়, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮৪, ‘বাংলাকাব্যে বয়ঃসন্ধি’, পৃ. ১৯৮
২২. সুকুমার সেন, ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’ (১৮৩৪), আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৮, পৃ. ৫০
২৩. ‘মধুসূদন রচনাবলী’, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সাহিত্য সংসদ, পঞ্চম সং, ১৯৯৯, পৃ. ১৯৬
২৪. ‘মধুসূদন রচনাবলী’, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সাহিত্য সংসদ, পঞ্চম সং, ১৯৯৯, পৃ. ৩৫

0 comments:

0

প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in



সম্প্রতি শেষ হয়ে গেল কৃষক আন্দোলন। দীর্ঘ একবছরের বেশি সময় ধরে চলার পর সরকার মেনে নিলেন আন্দোলনকারীদের প্রায় সমস্ত দাবী। ইতিপূর্বে এমন ব্যাপক, শান্তিপূর্ণ এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলা আন্দোলন আমরা আর দেখিনি! যদিও এমন বেশ কিছু আন্দোলন আগে আমারা দেখেছি যা বিষয়ের দিক থেকে কৃষক আন্দোলনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বিষয়টাকে জাতি, ধর্মের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন নি। হয়তো সেটাই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার একটা মূল কারণ। আমি কথা বলছি NRC ও CAA নিয়ে। বিষয়টা শুরু হয়েছিল ভারত সরকারের করা এক আইন সংশোধনের ভিত্তিতে। কে ভারতের নাগরিক আর কে নাগরিক নয় এই নিয়েই যত আলোচনা। এই আইন কিভাবে এবং কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে অনেকেই নিশ্চিত হতে পারেন নি। অনেকের মতে, একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে বিপদে ফেলার জন্যে সরকার উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এই আইন এনেছে। অঙ্গরাজ্য আসামে আইনটি কার্যকর করার পরে দেখা গেছে, প্রায় তিন কোটি মানুষ নানান ভাবে বিপদে পড়েছেন। এরপরেই সরকার এই আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছনে সরে এসেছেন। এজন্যে বেশ কিছুদিন ধরে NRC ও CAA নিয়ে আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তবে প্রশ্ন হল, ২০২৪ এর নির্বাচনের পরে নতুন সরকার এসে যদি এমন কোন আইন আনেন তখন কি হবে? যে সব নাগরিকরা ভোট দিয়ে সরকারকে নির্বাচিত করছেন, জয়ের পর সরকার যদি তাদের আর নাগরিক হিসাবে মেনে নিতে রাজি না হয়, তাহলে কি হবে?


ধরা যাক আইনের কারণে কোন মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব হারালেন! তবে তিনি কোন দেশের নাগরিক হবেন? যেমন, কয়েক বছর আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা মানুষ ঢুকে পড়েছিলেন শরণার্থী হয়ে। বর্তমানে এই রোহিঙ্গারা না বাংলাদেশের নাগরিক না মায়ানমারের নাগরিক। আক্ষরিক অর্থে এই উদ্বাস্তু মানুষ গুলো দেশ হীন। সমস্ত পৃথিবীর নিরিখে সংখ্যাটা কিন্তু খুব ছোট নয়। ২০১৮ সালের ১২ই নভেম্বর প্রকাশিত United Nations High Commissioner for Refugees এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় সারা পৃথিবীতে এক কোটি কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ রয়েছেন যাদের কোনও দেশ নেই। অর্থাৎ কি না “নেই রাষ্ট্রের নাগরিক”। নাগরিক কথাটার সঙ্গে যে ভূমিখণ্ড অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত তা হল দেশ। একটি দেশই একজন মানুষকে নাগরিক বলে পরিচয় দিতে পারে। অর্থাৎ যার দেশ নেই তার নাগরিকত্ব নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে একজন মানুষ কি ভাবে নিজেকে একটি দেশের সঙ্গে যুক্ত করবেন? পৃথিবী বিভিন্ন দেশে মূলত দুই ভাবে বিষয়টি হয়ে থাকে। এক, শিশু যে দেশে জন্ম নেয় জন্ম সূত্রে সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করে। আর দুই, পিতা মাতা যে দেশের নাগরিক, শিশুও জন্ম সূত্রে সেই দেশের নাগরিকত্ব পায়। তবে, কোন নিয়ম কোথায় কিভাবে কার্যকর হবে সেটা ঠিক করে দেবে সেই দেশের আইন। যেমন ধরা যাক আমেরিকা, এই দেশের কোন অংশে যদি কোন শিশু জন্ম নেয় তবে সে আমেরিকার নাগরিক। শিশুর পিতা-মাতার নাগরিকত্ব এখানে বিবেচ্য নয়। আবার ভারতের নিয়ম অনুসারে যদি কোন ভারতীয় পুরুষ কিংবা নারী কোন শিশুর জন্ম দেয় তবে সে শিশু যে দেশেই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন সে ভারতীয় হতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভারতীয় দম্পতি যদি আমেরিকায় তাদের সন্তানের জন্ম দেন, তবে এই নিয়ম অনুসারে শিশুটি তো দুটি দেশেরই নাগরিক হতে পারবে! এই শিশু ভাগ্যবান। কেননা দুটি দেশই তাকে নাগরিকত্ব দিতে আইনত রাজি। তবে আমাদের এই আলোচনা এমন ভাগ্যবান মানুষদের নিয়ে নয়। বরং সেই সব হতভাগ্যদের নিয়ে যাদের কোন দেশই নাগরিকত্ব দিতে রাজি নয়।


নাগরিকত্ব একটি আইনি বিষয়। তাই আইনের মারপ্যাঁচে মানুষ এটা হারিয়ে ফেলতে পারেন। বিষয়টা অনেক ভাবেই হতে পারে। যেমন, কানাডার নাগরিকত্ব আইন নিয়েই ভাবা যাক। কানাডার নিয়ম অনুসারে নাগরিক দম্পতি যদি দেশের বাইরে সন্তানের জন্ম দেন তবে সেই সন্তানও কানাডার নাগরিক হবে। এখন দেশের বাইরে জন্ম নেওয়া কানাডার নাগরিক নারী ও পুরুষ যদি দেশের বাইরে তাদের সন্তানের জন্ম দেয় তবে সেই সন্তান কানাডার নাগরিক হতে পারবে না। অর্থাৎ দেশের বাইরে জন্মেও নাগরিক হওয়ার অধিকার একটি প্রজন্মের জন্য দেওয়া হয়েছে। এখন এমন এক কানাডার দম্পতির কথা ধরা যাক যারা দুজনেই জন্মেছেন কানাডার বাইরে। ঘটনাচক্রে যদি তারা তাদের সন্তানের জন্ম ভারতের কোথাও দেন তবে সেই শিশুর কোন দেশ থাকবে না। কেননা ভারতীয় নিয়ম অনুসারে বাবা ও মায়ের মধ্যে অন্তত একজনের ভারতীয় হওয়া বাধ্যতামূলক।

উদ্বাস্তু বা দেশ হীন মানুষদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হল তারা বেআইনি ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে গিয়েছেন। এই ধারণা অসত্য নয় তবে এর পাশাপাশি আইনের মারপ্যাঁচেও সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষ তাদের দেশ হারিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন সাতাশটি দেশ রয়েছে যেখানে শিশুর নাগরিকত্ব ঠিক হয় তার পিতার নাগরিকত্বের ভিত্তিতে। এই সব দেশে মাতার নাগরিকত্ব গুরুত্বহীন। এবার এই পিতা যদি একজন দেশ হীন মানুষ হয়ে থাকেন তবে শিশুটি ও দেশ হীন হয়ে পড়বে। এই রকম দেশ গুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, মরক্কো ও সেনেগাল তাদের নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করে পিতার পাশাপাশি মাতার নাগরিকত্বকেও গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশ যখন নাগরিকত্বের ভিত্তি তখন দেশ বদলে বা ভাঙে গেলেও মানুষ দেশ হীন হয়ে পড়তে পারে। যেমন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বা যুগোশ্লোভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে।


নাগরিকত্ব যেহেতু একটি আইনি বিষয় কাজেই এখানে প্রমাণপত্রই এক মাত্র বিবেচ্য। পৃথিবীর বহু দেশে এমন বহু মানুষ আছেন যাদের কাছে নাগরিকত্বের কোন প্রমাণপত্র নেই। পর্বতে, জঙ্গলে কিংবা শহরের রাস্তায় থাকা মানুষ তো বটেই এমনকি বহু যাযাবর প্রজাতি, আদিবাসী মানুষকেও এই শ্রেণীভুক্ত করা যায়। ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেন ফান্ড বা UNICEF এর ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় সারা পৃথিবীতে পাঁচ বছরের কম বয়েসই এমন প্রায় ২৩ কোটি শিশু রয়েছে যাদের জন্ম রেজিস্টার্ড হয়নি। আমাদের দেশে তো বটেই পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে জন্ম ও মৃত্যু রেজিস্টার্ড করার পদ্ধতি খুব একটা ভালো নয়। কাজেই অনেক সঠিক নাগরিকের নাম যেমন খাতায় থাকে না, তেমনই বহু এমন নাগরিকের নাম পাওয়া যায় যারা হয়তো মৃত।

এই সব কারণে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, নাগরিকত্ব কি জন্মগত নাকি জন্মের প্রমাণের উপর নির্ভরশীল? এমন প্রশ্নও উঠতেই পারে, যে মানুষটির কাছে প্রমাণপত্র নেই সে কি প্রমাণপত্র নিতে অস্বীকার করেছে কখনো? না কি রাষ্ট্র তাকে এই প্রমাণপত্র দিতে অস্বীকার করেছে? এই দুটি প্রশ্নের উত্তরই যদি ‘না’ হয় তবে রাষ্ট্র সেই মানুষটিকে কি ভাবে দেখবে! প্রসঙ্গক্রমে চীনের কথা তোলা যেতে পারে। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর চীন সরকার, ‘ওয়ান চাইল্ড পলিসি’ ঘোষণা করেন। এই আইন হিসাবে, কোন দম্পতি যদি একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দেয় তবে সেই দম্পতি আর কোন শিশুর জন্ম দিতে পারবে না। বালাই বাহুল্য মানব জন্মের মতো একটি জটিল বিষয়কে কখনোই আইন করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কাজেই শহরে এই আইন যতটা কার্যকর হয়েছিল গ্রামে ততটা হয়নি। যার ফলে চীনের গ্রাম গুলিতে বহু এমন সন্তানের জন্ম হয় যাদের নাম সরকারি খাতায় লেখা হয়নি। কেন না, আইনের চোখে মানুষ গুলোর কোন বৈধতা ছিল না। এই মানুষ গুলো বিভিন্ন রকম সরকারি সুযোগ সুবিধাও যেমন হাসপাতাল, স্কুল, চাকরি ইত্যাদি পায়নি। মূলত কৃষিকাজই ছিল এই মানুষ গুলোর জীবিকা। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এই ‘ওয়ান চাইল্ড পলিসি’ চীন সরকার ২০১৬ সালে বন্ধ করে দেন।

ভেবে দেখার বিষয় হল, দীর্ঘ ৩৬ বছর এই আইনটি সেদেশে বলবত ছিল। কাজেই এই সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়া বৈধতা হীন বহু মানুষই বিয়ে করে সংসার ও সন্তান উৎপাদন করেছেন! হয়তো একজন বৈধতা হীন পুরুষ বিবাহ করেছেন একজন বৈধতা হীন নারীকে। কাজেই তাদের সন্তানরাও বৈধ নয়! তথ্যের বিষয়ে চীন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত একটি দেশ। কাজেই বর্তমানে সেখানে বৈধতা হীন মানুষের সংখ্যা ঠিক কত; কিংবা সেই মানুষ গুলোকে স্বাভাবিক স্রোতে আনার বিষয়ে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন, বাইরের দুনিয়ার পক্ষে সেটা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়।

সারা পৃথিবীতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার বিপাকে পড়ে এই মানুষের পৃথিবীতে অনেকেই আজ আইনত দেশ হীন বা নাগরিকত্ব হীন। এমন মানুষের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়তো সম্ভব নয়। আর এদের বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মতো সংস্থার সংখ্যাও খুবই সীমিত। আমাদের খুব স্পষ্ট ভাবে মনে রাখতে হবে, নাগরিকত্ব একটি আইনি বিষয়। আর এই আইন তৈরি ও ব্যবহার করে রাষ্ট্র নিজে। কাজেই রাষ্ট্র গুলো যদি আরও খানিকটা মানবিক হয়ে ওঠেন তবেই হয়তো আগামী দিনে এই সমস্যা থেকেও আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। শুভ রাষ্ট্র গুলোর কাছে এটাই ‘নেই রাষ্ট্রের নাগরিক’দের একমাত্র আবেদন।

0 comments:

2

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




















“হয় আমাকে সুরা দাও, নতুবা একলা থাকতে দাও।” সুফি কবি জেলাল-উদ্দিন রুমির এই কথাই জানিয়ে দিচ্ছে সুরা মানুষের ভাবাবেগের সাথে কতটা জড়িয়ে আছে। নিঃসঙ্গের সঙ্গী, নির্বান্ধবের বন্ধু আবার জনসমাবেশে উৎসব। প্রকৃতি যেমন একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে চলে, মানুষের সমাজে প্রতিটা ক্ষেত্রেও রয়েছে শৃঙ্খলতা। কিন্তু ভাবাবেগ শৃঙ্খলমুক্ত। মানুষের জীবন সঙ্ঘবদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতার, তাই তাকে কিছু বিধিনিধির মধ্যে দিয়েই চলতে হয়। জীবনের সাথে একটা ধর্ম গড়ে ওঠে, ব্যকরণ তাকে সুষ্ঠুভাবে জীবনপ্রবাহে নিয়ে যায় – সে সাহিত্যের ভাষাই হোক আর সুরাপানের আসরই হোক।

সুরারসিকেরা প্রকৃতির আবহাওয়াকে মান্য করে। তাই একদিকে গরমের তাপদাহ শেষে ঝরে পড়া বৃষ্টির তারে তারে সে যখন মালহারের ঝংকার তোলে অথবা হেমন্তের হলুদ পাতা অলস হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে শীতকে আহ্বান করে মানুষের তৃষ্ণা যায় বেড়ে। সঙ্গীহীন অথবা জমাটি আসরে সুরা হয়ে ওঠে বিশেষ সাথী। কবি বোদলেয়ার বলছেন, মাতাল হতেই হবে, হয় নৈতিক উৎকর্ষে বা কবিতায়, নয়তো সুরায়। ঘরে বসে নির্জনে নিঃসঙ্গতার সাথী যখন সুরা তখন সুরাপায়ীই সব নিয়মের শাসনকর্তা কিন্তু পানের আসরে কিছু শিষ্টাচার মানাটাই সামাজিক রীতি।

শীতের নিস্তব্ধতায় বরফ পড়ার আওয়াজও শোনা যায় আর বড়দিনের উৎসব অথবা নববর্ষের প্রাক-সন্ধ্যার আসরে মদের গ্লাসে-গ্লাসে ঠোকাঠুকির টুংটাং শব্দ শোনা যাবে না তা তো হয় না। জানেন কি এই মধুর আওয়াজের ইতিহাস? এটা বহুদিনের সংস্কার। আনন্দানুষ্ঠানে অশরীরী আত্মাকে তাড়ানোর জন্যে এই সুর তোলা হয় বলে কেউ বিশ্বাস করে আবার কেউ মনে করে ঠোকাঠুকির ফলে এক গ্লাস থেকে মদ ছলকে অন্য গ্লাসে দিয়ে প্রমাণ করা যে পানীয়তে বিষ মেশানো নেই। আসলে কিন্তু এই প্রথা চালু হওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য কারণ। সাধারণত পার্টিতে মদ্যপান শুরুর আগে কোন ব্যক্তির বা কিছুর স্বাস্থ্যকামনা করা হয় এবং তাতে পঞ্চেন্দ্রিয়র শ্রবণ ছাড়া বাকি চারটে ইন্দ্রিয় স্পর্শ, স্বাদ, দৃষ্টি ও গন্ধ সক্রিয় থাকে। সমবেত সুরাপান যেমন সমমনভাবাপন্ন সম্প্রদায়কে জোটবদ্ধ করে আনন্দ দেয়, পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তাই কোন ব্যক্তির আনন্দকে সম্পূর্ণ করতে পারে। তাই মদ পানের জন্য যখন থেকে কাঁচের গ্লাস ব্যবহার শুরু হোল, তখন থেকেই সেই অভাব পুরণ করে টুংটাং আওয়াজও শোনা যেতে লাগল। আগেকার দিনে একটামাত্র পাত্র থেকেই সকলে পান করত এবং সকলে মিলে একটা পোড়া রুটি বা টোস্ট-এর টুকরো তার সাথে খেত। সেই থেকেই সুরাপানের আসরে টোস্ট কথাটা চালু। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার সাথে সুরাপাত্র আলাদা হয়ে যায়, টুংটাং শব্দের পিয়ানো বাজে কিন্তু টোস্ট উচ্চারিত হলেও খাওয়া হয় না।

পার্টিতে যাবার আগে পানের কিছু শিষ্টাচার জেনে রাখা ভাল। সুরা পানের কাঁচের গ্লাস একটা গোল চাকতির ওপর সরু ডাঁটি আর তার ওপরে চোঙা আকারের গ্লাস, নীচের দিকে অথবা মাঝ বরাবর কিছুটা স্ফীত। মনে রাখতে হবে মদের গ্লাস ঠোকাঠুকি হবে ডাঁটির ওপরে যেখানে গ্লাসটা স্ফীত এবং কখনই ওপরে মুখের কাছে নয় কারণ ওই জায়গাটা সবচেয়ে পাতলা, কাঁচ ভেঙে যেতে পারে। টেবিল থেকে ডাঁটি ধরে গ্লাস তুলে পানের সময় স্ফীত জায়গাটা ধরতে হবে। গ্লাসে অর্ধেক পানীয় ভরা হয়, সুরাকে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার অবসর দেওয়ার জন্যে। পান করার আগে গ্লাসের সুরা একটু হেলিয়ে নাকের কাছে এনে সুরার ঘ্রাণ নেওয়াটা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে সুরা পানের আদ্ধেক মজা ঘ্রাণে। আস্তে করে সিপ করে জিভে সুরা নিয়ে খেলিয়ে স্বাদ নিতে হবে এবং সুরাটার গুণাগুণ নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবুন। মুখগহ্বরে আদ্ধেকের বেশি যেন পানীয় না থাকে। কখনই একসাথে অনেকটা সুরা মুখে নিতে নেই। চেষ্টা করতে হবে গ্লাসের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই বারবার সিপ করতে নইলে ঠোঁটের ছাপ অথবা লিপস্টিকের রঙের দাগ নানা জায়গায় লেগে সৌন্দর্যহানী ঘটাবে।

চারটে বিশিষ্টতায় সুরা গুণান্বিত – আঙুরের চরিত্র, উৎপাদন স্থানের আবহাওয়া ও মাটির চরিত্র, ফসল তোলার সময় এবং উৎপাদক। পুরনো চাল ভাতে বাড়ার মতন পুরনো মদ গুণে বাড়ে। তবু উচ্চমানের সুরা পরিবেশনের সময় সুরার সঠিক তাপমাত্রা বজায় না রাখলে পুরোটাই মাটি। অত্যধিক ঠাণ্ডা মদের গন্ধ ও স্বাদ দুটোই নষ্ট হয়ে যায়, একটা তেতো স্বাদ জিভে লাগে আবার গরম বা উষ্ণ মদও বিস্বাদ এবং বেশি সুরাসিক হয়ে যায়। পরিবেশনের সময় লাল মদের তাপমাত্রা ১৮০ সেলসিয়াস হওয়া বাঞ্ছনীয়। সাদা বা গোলাপী মদ পানের তিন ঘন্টা আগে তিরিশ মিনিট রেফ্রিজারেশনের পর বের করে নিতে হবে। শ্যাম্পেনের ক্ষেত্রে অবশ্য একঘন্টা আগে বের করলেই চলবে। আর যদি একান্তই খাবার পর ডেসার্ট হিসেবে হালকা রঙের চিলড সুরা নিতে চান তবে পানের আগে ৫ থেকে ১০ মিনিট এবং শ্যাম্পেন ১০ থেকে ২০ মিনিট ফ্রিজে রাখতে পারেন। বোতল একরাতেই শেষ করাটাই নিয়ম, পরে স্বাদ ও গন্ধের হানি ঘটে।

ধীরে বৎস, ধীরে। কেলেঙ্কারির আসল জায়গাটাই তো পেরিয়ে গেছি। তার আগে বরং সুরা তৈরির সুরটা তুলে ধরা যাক। তার জন্যে ঘুরতে হবে সুরা-সরণির ইতিহাসের অলিতে-গলিতে আর ভূবিজ্ঞানের মাঠে-পাহাড়ে। পরে আবার কেলেঙ্কারি সমেত ফিরব।

বেশ কয়েক বছর আগে ইতালির রোম শহরে সারাদিন ঘোরাঘুরির শেষে ক্লান্তি ছাড়াতে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে মাঝারি দামের ওয়াইন কিনে রাজকীয় এক হোটেলের ঘরে ফিরছি, একজন বয়স্ক কর্মচারী স্যালুট ঠুকে বোতলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, কিনলেন? দেখি কি কিনলেন। বলে বোতলটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, আপনি ওয়াইন চেনেন? রেগুলার খান? আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, তবে ভাল লাগে, মাঝে মাঝে খাই। তবে আপনি যে চেনা বলছেন তা জানি না।

ওয়াইনের প্রথম স্বাদ নিই যৌবনের শুরুতে গোয়ায়, বিখ্যাত পোর্ট ওয়াইনের। তখন কোয়ার্টার লিটারের পাউচ পাওয়া যেত, জিনসের হিপ পকেটে আরামসে নিয়ে ঘোরা যেত। তারপর মাঝেমধ্যে বন্ধুদের বাড়িতে ওয়াইন খাওয়া হোত বিশেষ করে বিদেশ থেকে কেউ নিয়ে এলে। তখনই জেনেছিলাম, ড্রাই, হাফ ড্রাই কথাগুলো এবং পানের সময় ও পরে তাদের চরিত্র। কর্ক খোলার পর ওয়াইন আবার রেখে খাওয়া নীতিবিরুদ্ধ, এক রাতেই শেষ করে ফেলা হোত। আমার অনুমতি নিয়ে কর্মচারীটি বোতলের কর্ক খুলে শুঁকে হেসে বললেন, এই দামে খুব ভাল পেয়েছেন, এনজয়। আমি বললাম, কি করে বুঝলেন? উনি বললেন, ইতালিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মদের জন্য দ্রাক্ষার চাষ প্রধানত দু জায়গায় হয় – সিসিলি আর টুস্কান। আপনার এটা টুস্কানের, ভাল স্বাদ। ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে এসে অল্প অল্প করে জিভে নিয়ে স্বাদ গন্ধ বোঝার চেষ্টা করলাম।

মদ শব্দটা যে-কোন অ্যালকোহলিক বা সুরাসার পানীয়ের জন্যে বাংলায় ব্যবহার হলেও, যেমন দেশী মদ, বিলিতি মদ, বিয়ার, হুইস্কি, ব্রান্ডি ইত্যাদি, মদ-মদ্য-মদিরা আসলে ওয়াইনের বঙ্গরূপ। এর সমার্থবোধক শব্দ হল সুরা। এক বিশেষ ধরণের দ্রাক্ষা ওয়াইটিস ওয়াইনিফেরা (Vitis vinifera sub sp. sylvetris) নিঃসারিত সুরাসার তরল পানীয়কে লাতিন ভাষায় বলা হয় ওয়াইনাম (vinum) যার থেকে ইংরেজিতে ওয়াইন (wine)। ইংরেজিতে অবশ্য ভাইন (vine) মানে আঙুরগাছ। কোন রকম শর্করা, এনজাইম, অম্ল, জল বা পুষ্টিকর উপাদান না মিশিয়ে আঙুরে সঞ্চিত শর্করাকে ইথানলে পরিবর্তন করা হয় ঈস্টের সহযোগে। এর সাথে মিশে থাকে কার্বনডাইঅক্সাইড। ইথানলই হল সেই সুরাসার যা আঙুরকে মদে রূপান্তর করে। এছাড়া আরও অনেক কিছু থেকেই সুরাসার প্রস্তুত করা হয় যেমন বার্লি, চাল, মল্ট ইত্যাদি কিন্তু একমাত্র আঙুর থেকে যে মদ হয় তারই নাম ওয়াইন। ওয়াইনে অ্যালকোহলের পরিমাণ সর্বাধিক পনেরো শতাংশ।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪১০০ বছর আগে আর্মেনিয়ার Vayots Dzor গুহায় প্রাচীনতম মদ নিষ্কাষন ও পরিশ্রুতের আনুষঙ্গিক পুরা-সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তারও হাজার বছর আগে চিনে মদ পানের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে গ্রীস, রোম প্রভৃতি দেশে উত্তেজক ও নেশার পানীয় বলে মদ্যপান করা হোত। ইতিহাস বলে রোম সাম্রাজ্যের গোড়া থেকেই মদ তৈরির জন্য দ্রাক্ষা চাষের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং খ্রীস্টের জন্মের কয়েক শতক আগে থেকেই রোমের রাস্তায় মাতালদের হুজ্জুতি চোখে পড়ার মত ছিল। সে সময়ে পোড়ামাটির বড় বড় পিপে বানিয়ে তাতে মদ রাখা হোত এবং বাণিজ্যের জন্যে ভিন দেশে পাঠানোও হোত। সেই সময় থেকেই সেখানকার সুরার নামডাক খ্যাতি। মদ সাধারণত দু রঙের হয়, লাল ও সাদা। এছাড়াও গোলাপী রঙের মদও আকর্ষনীয়। কালো রঙের আঙুর থেকে লাল মদ ও সাদা বা হাল্কা পীতাভ সবুজ আঙুর থেকে সাদা মদ তৈরি হয় কিন্তু গোলাপী মদ হোল পরিশ্রুত কালো চামড়ার আঙুর থেকে তৈরি। এ ছাড়াও আপেল, বেরি ফল থেকেও মদ তৈরি হয়ে থাকে। আঙুর থেকে মদ বানানোর আগে ইওরোপে মধুর সাথে জল মিশিয়ে গাঁজিয়ে মদ তৈরি হোত। পরে এশিয়া ও আফ্রিকাতেও এভাবে মদ বানানোর ইতিহাস পাওয়া যায়।

পৃথিবীর অনেকে দেশের ধর্মীয় গ্রন্থ ও পৌরাণিক গল্পে মদের উল্লেখ আছে। বাইবেলের জেনেসিস-এ বিশাল বন্যার পর নোয়াকে তার সন্তানদের সামনে দেখা গেছিল মদ্যপ অবস্থায়। গ্রিক পুরাণে কাল্পনিক নাইকা পাহাড়ে মদ বানানোর জন্য আঙুরখেত আবিষ্কারের উল্লেখ আছে। এর জন্যে আবিষ্কারক ডায়োনিসাসকে সুরা-দেবতা বলা হয়। পারস্য দেশের কাহিনী ও কবিতায় মদ-এর উপস্থিতি হাজার বছরেরও প্রাচীন। একটা গল্পে আছে রাজা জামসিদ তার হারেম থেকে এক নারীকে বের করে দেয়। সে তখন আত্মহত্যার জন্য বিষের সন্ধানে এক পরিত্যক্ত গুদামে ঢুকে একটা বাতিল বোতল পায় যার ভেতর গাঁজলা ধরা আঙুরের রস ছিল। বিষ মনে করে সে পান করে এবং কিছু পরে মাতাল হয়ে রাজার সামনে যায়। সব জেনে রাজা তাকে ফিরিয়ে নেয় এবং আঙুর থেকে মদ বানানোর আদেশ দেয়। উৎসব-অনুষ্ঠানে মদের ব্যবহার মিশরে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। নীল নদের অববাহিকায় আঙুরখেতের প্রমাণ মেলে। তারও আগের প্রস্তর সমাধির গায়ে খোদিত ভাস্কর্য থেকে আঙুর ও মদের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। রক্তের রঙের সাথে মিল থাকায় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লাল মদ ব্যবহার হোত। ফারাওরা মদ না খেলেও তুতানখামুনের সমাধিতে সাদা মদের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। গ্রিসে হোমরের পুরাণে নির্জলা কালো মদ পরিবেশনের ব্যাখ্যা আছে। জরথুস্থ্র ও ইহুদীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক মদ্যপান চালু আছে। মুসলমান ধর্মে মদ্যপান নিষিদ্ধ হলেও অনেক কবি ও খলিফা সমাজে অথবা নিজগৃহে মদ্যপান করতেন এবং এখনও করেন। ফার্সি, উর্দু এবং আরবী কবিতা ও গজলে বহু সুরাসক্ত মুসলমান কবি বিশ্বজয় করেছেন। সাহিত্যের নানা ভাষায় ওয়াইন বা শরাব বা মদ নিয়ে অনেক কবিতা গল্প থাকলেও উর্দুতে গালিব এবং আরও কিছু কবির শায়ের বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে। শরাব, সাকী, চাঁদ, বর্ষা, গোলাপ এদের মধ্যে সম্পর্কটা খুব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

শরাব পিনে দে মসজিদ মে বৈঠকর,
ইয়া ওহ জায়গা বাতা জঁহা খুদা নহী। (গালিব)

পারস্য বণিকের হাত ধরে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ভারতে আঙুর আসে এবং আঙুরের চাষ শুরু হয়। তখন মদ তৈরির কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না তবে আঙুর ও আঙুরের রস খাওয়ার প্রচলন ছিল। সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পা সভ্যতার যুগে মদ নিষ্কাশনের কিছু প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বৈদিক যুগে আর্যদের উত্তেজক পানীয়ের অভ্যাস ছিল এবং বেদ-এ সোম বা সোমরসের উল্লেখ থাকলেও তার কাঁচা মালের কোন নাম মেলে না। সোম মানে চন্দ্র; তাই কি গলিত জ্যোৎস্না থেকে চুঁইয়ে পড়া তরলের নাম সোমরস! অবশ্য পুরাণে হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে ‘সুরা’ নামক পানীয়ের উল্লেখ আছে যা প্রধানত চালের সাথে মধু গাঁজিয়ে তৈরি। বলরাম ও কৃষ্ণ উভয়েরই সুরাসক্তি সুবিদিত তবে কৃষ্ণ শিষ্টাচার মানতেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে চরক-সংহিতায় দ্রাক্ষাসাভার যে বর্ণনা আছে তাতে দেখা যায় পাকা লাল বা কালো আঙুরের সাথে এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা, কালোমরিচ ইত্যাদি মশলা মিশিয়ে গাঁজিয়ে কোহল প্রস্তুত করা হোত। এটা অবশ্য ওষুধ হিসেবেই ব্যবহারের কথা বলা আছে। ওষুধ হিসেবে দ্রাক্ষা নিষ্কাশিত মদের ব্যবহার ন হাজার বছর আগে ককেসাস পর্বতের নিচে কৃষ্ণ সাগরের তীরে জর্জিয়ায় প্রচলিত ছিল বলেও উল্লেখ আছে। সেখান থেকে মধ্য প্রাচ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটস নদীর উপত্যকা ধরে মেসোপটেমিয়া, পার্সিয়ায় (ইরান) ঢুকে পড়ে। ভারতে আঙুর-জাত মদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চানক্যের লেখায়। সেটাকে ‘মধু’ বলেই চেনানো হয়েছে যদিও চানক্য নিজে এই মদ পানকে নিন্দা করেছেন। এর পরবর্তী কালে যে মদ তৈরি হোত তা প্রধানত গম, বার্লি বা মিলেট থেকে, আঙুরের গল্প আর পাওয়া যায় না। পর্তুগিজরা ষোড়শ শতকে যখন গোয়াতে তাদের বসবাস শুরু করে তখন আবার আঙুর-জাত মদ তৈরি হতে শুরু করল এবং সেই থেকে তাকে পোর্ট ওয়াইন বলা হয়ে থাকে। তারা ভিন্ডালু নামে আরেক ধরণের সুরা বানালো। বিখ্যাত পারসিক মদ সিরাজও এখানে শুরু হতে লাগল। ব্রিটিশ পর্যটকরা আকবর, জাহাঙ্গীর, শাজাহানের মত মুঘল সম্রাটদের খুশি করতে প্রথম দিকে দেশ থেকে মদ এনে উপহার দিত এবং পরে সম্রাটদের নির্দিষ্ট বাগানেই আঙুরের খেত বানিয়েছিল যাতে সাদা ও লাল দু ধরণেরই রাজকীয় মদের সরবরাহ সারাবছর বজায় থাকে। কোন রকম বড় শিল্পে না গিয়ে ব্রিটিশ শাষকেরা ভারতে আঙুর থেকে মদ তৈরিটা কুটির শিল্পের ভেতরেই আবদ্ধ রাখে। অবিচ্ছিন্ন যোগানের জন্যে বরামতি, কাশ্মীর এবং সুরাতে যত্ন করে আঙুরের চাষ করা হোত। দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দিতে বিলেত থেকে পিপে ভর্তি মদ জাহাজে করে এনে কোলকাতায় ব্যবসা শুরু করেন। ১৮৮৩ সালে কোলকাতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ভারতীয় মদের সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে প্রচার পায়। কিন্তু তার পরেই আঙুরের খেতে মড়ক লাগে। এরপর মদ শিল্পকে উঠে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট করতে হয়। সারা পৃথিবীতে ইসলাম ছাড়া প্রায় সব ধর্মে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মদের প্রচলন থাকলেও ভারতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামিতে এই শিল্প বার বার বাধা পায়। গত শতকের শেষ ভাগ থেকে আবার আঙুর চাষ ও মদ তৈরির শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে।

মাটি কথা বলে

আঙুরের চরিত্র অনুসারে মদের স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের পরিবর্তন হয়। সুরা রসিকের কাছে সুরার স্বাদ যতটা প্রিয় মদ প্রস্তুতকারীর কাছে ততটাই গুরুত্ব পায় আঙুরের চরিত্র, আর চাষির কাছে আঙুর ফলানোর জন্যে মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠণ ও উপাদান। মদের স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ প্রভৃতি ভৌতিক বৈশিষ্ট্য এবং রসায়ন নিয়ে অনেক গবেষণা পত্র ও বই অনেকদিন ধরে লেখা হলেও কেবলমাত্র ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে গবেষণার বয়স মাত্র অর্ধ-শতাব্দী। সেই হিসেবে ওয়াইন জিওলজি বিষয়টা অতি সাম্প্রতিক কালে উদ্ভূত। আগেরদিনের বইতে বা পত্রে আঙুর খেতের এলাকার ভূবিজ্ঞান নিয়ে কিছু মন্তব্য থাকত বটে কিন্তু সেটা যে যথেষ্ট নয় এবং ভ্রান্ত পথনির্দেশ করে তা অনুভব করেন জেক হ্যানকক (Jake Hancock), জুলিয়ন বেকার (Julian Baker) এবং আরও কিছু ভূবিজ্ঞানী। ফ্রান্স, ইতালি সহ ইওরোপ ও আমেরিকার নানা দ্রাক্ষাখেতের জমি নিয়ে ভূবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা শুরু হয়। তাঁদের মতে আঙুর চাষের ভাল-মন্দ নির্ভর করে মূলত জমির চরিত্র এবং আঞ্চলিক আবহাওয়া। আঙুর গাছ তার ফলের পুষ্টি পায় মাটির ষাট সেন্টিমিটার নিচে থেকে কিন্তু বেশির ভাগ সময় জলীয়বাষ্প গ্রহণের জন্য তাকে অন্তত দু মিটার নিচের জলস্তরের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর খরার সময় জলের স্তর তারও নিচে চলে যায়। মাটির স্তরের পুরুত্ব আঙুর চাষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাথরের ওপর মাটির স্তরের গভীরতা বেশি বা কমের ওপর আঙুরের স্বাদ অনেকাংশে নির্ভর করে। মৃৎবিজ্ঞান এখানে একটা বড় গবেষণার বিষয়। এছাড়াও ভূ-আকৃতি এবং মাটির জল-ধারণের ক্ষমতাও বিশেষ সহায়ক।

মাটির রাসায়নিক চরিত্রের ওপর নির্ভর করে গাছের ঘনত্ব, আঙুরের সাইজ বা আয়তন ও শর্করার পরিমাণ। তবে এটাও সত্যি, মাটি ভাল হলেই যে তার ফসল ভাল হবে অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভাল মদ তৈরির উপযুক্ত আঙুরের ফলন হবে তা নয়। যে সমস্ত মাটিতে আঙুর গাছের ফলন অত্যধিক বেশি সেই গাছের আঙুর সাধারণত হাল্কা রঙের, শর্করার পরিমাণ কম এবং প্রায় স্বাদহীন কারণ মাটির পুষ্টি গাছই বেশি টেনে নেয়, ফল পায় না। এইসব আঙুরকে শুকোনোর জন্য গাছে একটু বেশি সময় রাখতে হয় যাতে স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধের উন্নতি হয়।

অন্যান্য ফসলের উন্নতির জন্য খেতে যথেষ্ট জলের যোগান দিতে হয়, আঙুর চাষের বেলায় তা নয়। কম জলে গাছকে পরিশ্রম করতে হয় তার ফলনকে রক্ষা করার জন্য আর সেটা আঙুরের উৎকৃষ্ট ফলনের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে আঙুরের গায়ের চামড়া টানটান ও চকচকে হয়, শর্করার পরিমাণ যথেষ্ট থাকে আর আয়তনও ভাল হয়। এইসব মিলিত গুণ ভাল মদ তৈরিতে সাহায্য করে। গন্ধের জন্য উপযুক্ত রাসায়নিক যৌগগুলো ঘনীভূত হয়ে সুরভিযুক্ত সুরা হয়। এখানে একটা কথা বলে নিই, ড্রাই ওয়াইন প্রস্তুত করতে শর্করার ঘনত্ব বিশেষ প্রক্রিয়ায় কমিয়ে নেওয়া হয়।

তার মানে জলের জন্য এমন মাটিতে আঙুরের চাষ করতে হবে যেখানে জল দাঁড়ায় না, গড়িয়ে চলে যায় আর গাছকে কষ্ট করে সেই গড়ানে জল থেকে তার চাহিদা পুরণ করতে হয়। অর্থাৎ মাটির চরিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সব জমিতে আঙুর চাষ হয় না কারণ গাছ এবং তার মূলাধার কাণ্ড এমন এক বিশেষ ধরনের যা কেবল বিশেষ মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। তবে মাটিতে অম্ল, ক্ষার এবং লবণের পরিমাণ সামান্য কম-বেশি হলে ক্ষতি নেই। গাছকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে মাটি হতে হবে রন্ধ্রবহুল যাতে জল স্থিতাবস্থায় বেশি সময় না থাকে, সেখানেই শেকড় মাটি আঁকড়ে থাকতে সক্ষম হবে। মাটির চরিত্রের মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হোল বয়ন, গভীরতা, রঙ এবং জৈবিক উপাদান; এছাড়া মাটি-কণার আকার ও আয়তন বা সাইজ, স্তরবিন্যাস, অম্ল ও ক্ষারের আনুপাতিক মিশ্রণ; মাটির ওপরের ভাগ ও নিচের অংশের এবং তলার পাথরের খনিজ পদার্থের উপাদান, ঘনত্ব ও পুরুত্ব। চলতি কথায় পাথর ভাঙতে ভাঙতে বালি, তা গুঁড়িয়ে পলিমাটি আর তারও পরে মাটি। বালি, পলিমাটি ও মাটির বিভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণ মাটির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

বেলেমাটি রন্ধ্রযুক্ত হয় বলে জল দাঁড়াতে পারে না, নিচে বা পাশে চলে যায়। ক্লে মাটির বয়ন খুব সূক্ষ্ম তাই জল সহজে বেরোতে পারে না, একটা জলাধার তৈরি হয়। মাটিতে ক্লে-র পরিমাণ এক-চতুর্থাংশের কম থাকলে আর্দ্রতার অভাব হয় আবার চল্লিশ শতাংশের বেশি হলে মাটি অতিরিক্ত আর্দ্র হয়ে থাকে। আর এই দুয়ের মাঝে অর্থাৎ শতকরা পঁচিশ এবং চল্লিশ ভাগের মধ্যে ক্লে-মিশ্রিত মাটিতে আঙুর চাষের জন্য আদর্শ আর্দ্রতা বজায় থাকে। ক্ষারীয় মাটি থেকে তামা, দস্তা ও লৌহ যৌগ আঙুরগাছ সহজেই শোষণ করে বলে মদোপযুক্ত চাষের জন্য একেবারেই আদর্শ নয় কিন্তু ঈষদম্ল (Ph > 5-7) হলে ক্ষতি নেই আর এই মাটিতে শেকড় শক্তও হয়। তবে বালিমিশ্রিত পলিমাটিতে সবথেকে ভাল আঙুর চাষ হয়। চূনাপাথরের ওপর চূনামাটি কিছু জায়গায় চাষের উপযুক্ত যদি মাটিতে খনিজ পদার্থ যথেষ্ট থাকে। আসল কথা হোল, মাটিতে থাকা খনিজ পদার্থ যদি যথেষ্ট পরিমাণে গাছের শেকড় দিয়ে ঢুকে ফল অবধি পৌঁছয় তবে সেই আঙুর সবচেয়ে সুরাপদেয়।

এবারে দেখা যাক, মাটির স্তরের নিচে পাথর কিভাবে আঙুরের চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে। আগ্নেয়শিলা ব্যাসল্টের ওপরে পাথর-ক্ষয়িত মাটি কালো রঙের হয় তাই সেই মাটির আঙ্গুরও কালো চামড়ার আবার গ্রানিটের ওপরে পাথর-ক্ষয়িত মাটিতে হাল্কা রঙের আঙুর হয়। দুটোর স্বাদ পৃথক হলেও অতি গুণসম্পন্ন। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত আঙুর খেত এই পাথরের মাটিতে হয়। দক্ষিণ জার্মানী, হাঙ্গেরী, এবং কানারি দ্বীপপুঞ্জে ব্যাসাল্টের ওপর কালো মাটিতে আঙুর খেত থেকে উৎপন্ন সুরা উত্তম স্বাদিষ্ট। আবার গ্রানিটের ওপর সাদা মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার করনাস (Cornas) এবং স্টেলেনবশ (Stellenbosch) এলাকার মদ বিখ্যাত। বিশ্ববন্দিত অ্যালসেশিয়ান রিজলিং (Alsatian Riesling) এবং মুস্কাদেত (Muscadet) সুরাও গ্রানিট পাথরের ওপর মাটিতে জন্মানো সাদা আঙুর থেকে তৈরি। অনেকে আবার গ্রানিটের গন্ধও পেয়ে থাকেন সুরায় এবং এই গন্ধ সুরা রসিকদের আমোদিত করে।

পাললিক শিলার মধ্যে সমুদ্রজাত চূনাপাথরের মাটি আঙুর খেতের উপযুক্ত তা আগেই বলা হয়েছে। ইতালির বিশ্ববন্দিত টুস্কানির ও ফ্রান্সের বারগুণ্ডি (Burgundy) আঙুর খেত এই মাটিতে। আসলে এই মাটিতে সামুদ্রিক জীবাশ্ম মিশে থাকে বলে স্বাদ ও পুষ্টিতে পরিপূর্ণ। তবে অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণীয় সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে বলে চক-জাতীয় চূনাপাথরের মাটিতে ফলিত আঙুরের শ্যাম্পেন উৎকৃষ্ট। শ্যাম্পেনে অ্যালকোহলের পরিমাণ ওয়াইনের থেকে বেশি। এরপর যখন ভাল সুরা বা শ্যাম্পেন পান করবেন একবার অন্তত সেইসব প্রাণীদের স্মরণ করবেন যারা আপনার পানীয়কে স্বাদিষ্ট করে আপনাকে আনন্দ দিচ্ছে। মিষ্টি জলের চূনামাটিতেও আঙুরের ফলন ভাল হয়। বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু সুরার নাম চারদোন্যে (Chardonnay), ফ্রান্সের জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক চূনাপাথরের মাটিতে আঙুর খেত। তখন পৃথিবীর স্থলে, জলে অন্তরীক্ষে ডাইনোসরেরা দাপিয়ে বেরাচ্ছে। এই চূনাপাথরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কোয়ার্টারনারির প্রচণ্ড হিমবাহ, পাথর ফাটিয়ে মাটি করেছে। আঙুর ছাড়াও এই মাটিতে আরও নানা ফল হয় যাদের সুবাস এই সুরায় মিশে থাকে। খনিজ পদার্থের ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তনের জন্য কিছু রূপান্তরিত শিলার ওপর পাথর ক্ষয়িত মাটিতেও আঙুর ফলনের চাষ হয়ে থাকে এবং তা থেকে উৎপন্ন মদের বাণিজ্য ভালই হয়।

পাথর ও মাটিতে থাকা কিছু খনিজ পদার্থের উপাদান সুরার গুণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ভূস্তরে বেশিরভাগ খনিজ পদার্থই যৌগিক পদার্থ হিসেবে থাকে। আর দুটো মৌল উপাদান মূখ্য – অক্সিজেন ও সিলিকন যা সমগ্র মৌল উপাদানের যথাক্রমে শতকরা ৪৬ শতাংশ ও ২৮ শতাংশ। শুধু এই দুটো উপাদানের সাথে আরও কিছু মৌল উপাদান যুক্ত হয়ে অনেক সিলিকেট খনিজ পদার্থ হয়। আর এই মূখ্য দুই উপাদানে তৈরি কোয়ার্টজ। যে সমস্ত আগ্নেয়শিলায় আয়রন – ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত সিলিকেট অলিভিন, পাইরক্সিন এবং হর্নব্লেন্ড বেশি থাকে তার রঙ কালো হয় আর মাটিও কালো। ইতালির বহু বিখ্যাত আঙুর খেত এই মাটিতে। অভ্র দু রঙের হয় – সাদা যা মাসকোভাইট নামে পরিচিত আর কালো যাকে বায়োটাইট বলে। অভ্র মাটিতে থাকলে আঙুরের চামড়া খুব উজ্জ্বল ও চকচকে হয়, সুরাতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। পূর্বোল্লেখিত অ্যালসেশিয়ান রিজলিং সুরায় একধরনের বিশেষ ঔজ্জ্বল্যতা এই কারণে দেখা যায়।

আর শুধুমাত্র কার্বন মৌল উপাদানে হয় হীরা এবং গ্রাফাইট। গ্রাফাইট মিশ্রিত মাটির রঙ কালো হয়। স্পেন এবং অস্ট্রিয়ার কিছু জায়গায় গ্রাফাইট মিশ্রিত কালো মাটিতে আঙুরের চাষ হয়। আঙুর খেতের মাটিতে ব্যাপকভাবে সালফার মিশে থাকে যদি তা আগ্নেয়শিলা বা তার থেকে তৈরি পাললিক শিলা এবং তাদের রূপান্তরিত শিলার মাটি হয়। দক্ষিণ ইতালির ভালচার, ভিসুভিয়াস ও এটনার মত নবীন আগ্নেয়গিরির সন্নিহিত সালফার মিশ্রিত মাটিতে আঙুরের দুর্দান্ত খেত আছে।

সিলিকেট ছাড়াও অক্সাইড, সালফেট খনিজ পদার্থও হয়। অক্সাইডের মধ্যে আয়রন অক্সাইড বা হেমাটাইট মিশ্রিত লাল মাটিতে ফলিত আঙুরের থেকে উৎপন্ন মদের রঙও লাল। অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি জায়গায় এই খেত রয়েছে। এছাড়াও ফ্রান্সে বক্সাইট বা অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড মিশ্রিত মাটিতে অতি উৎকৃষ্ট ফলন ও তার মদও সুবিখ্যাত। পশ্চিম কলোরাডো এবং স্পেনে জিপসাম (সালফেট) মাটিতে ভাল আঙুরের চাষ হয়। কার্বোনেট যৌগের খনিজ ক্যালসাইট চূনাপাথরের এবং চূনামাটির প্রধান অঙ্গ। এই মাটিতে ফলন এবং তদ্ভূত সুরার কথা আগেই বলা হয়েছে। শুধুমাত্র চূনামাটি বা চূনাপাথরের মাটির জল ধারণের ক্ষমতা কম। সেক্ষেত্রে অনেক জায়গায় মাটিতে মন্টমরিলোনাইট মিশ্রিত মাটি মেশানো হয় কারণ এই ক্লে খনিজের জল শোষণের ক্ষমতা ভাল, তাই জল ধরে রাখে মাটিতে যা আঙুর ফলনের উপযুক্ত। আসলে ফ্রান্সের বারগুণ্ডির কিছু খেতে এই ধরনের চাষের জন্য উৎকৃষ্ট আঙুর উৎপাদন বেড়ে গেছে। আর একটা ক্লে খনিজ কেওলিনাইট মাটিতে আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই খনিজ পদার্থ আসে আগ্নেয়শিলার অন্যতম প্রধান খনিজ পদার্থ ফেলডসপারে রাসায়নিক ক্ষয় থেকে। কিছু গ্রানিটে গোলাপী ফেলডসপার থাকে; এই মাটি থেকে আঙুরের সুরার রঙ মায়াময় গোলাপী।

আঙুর খেতের ফলনের উৎকৃষ্ট সম্পূর্ণ নির্ভর করে জমির মাটি ও আবহাওয়ার ওপর। জমির মাটি কী উপাদান দিয়ে তৈরি, তার আর্দ্রতা কত, কোন পাথরের ওপর মাটি হয়েছে, সেই পাথরের চরিত্র, পাথরের খনিজ পদার্থ ও তার মূল যৌগিক উপাদান ইত্যাদি জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা জানতে গেলে ভূবিজ্ঞানের এবং ভূবিজ্ঞানীর সাহায্যের একান্ত প্রয়োজন। কোন জমিতে কোন উপাদানের ঘাটতি থাকলে সেই উপাদান নিকটবর্তী কোন জায়গা থেকে পাওয়া যাবে, কতটা মেশাতে হবে এসব ভূবিজ্ঞানীরাই বলতে পারে। মদ পানীয়কে আরও উন্নত, পৌষ্টিক, স্বাদিষ্ট করে তুলতে হয় সুরা শিল্প ও বাণিজ্যের খাতিরে।

ভারতে মদ-শিল্পের অবস্থান

ভূবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সব বিখ্যাত আঙুর খেতে উৎকৃষ্ট ফলন শুরু হলেও ভারতে এখনও তেমন গবেষণা হয় না। সেই প্রাচীন পদ্ধতিতে আবহাওয়া, বৃষ্টি ও ভূ-আকৃতির ওপর নির্ভর করে আঙুর চাষ করা হয়ে থাকে। তবে এটাও সত্যি, ভারতের এই সুবিশাল জমির বেশিরভাগ আঙুর ফলনের উপযুক্ত নয়। ভূ-পৃষ্ঠের পাথর, মাটি, ভূ-গর্ভস্থ জল, এবং জলবায়ুর এত বৈচিত্র অল্প এলাকার মধ্যেই যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চাষ সম্ভব নয়। ভারতীয় উপদ্বীপের সমুদ্র সংলগ্ন এলাকায় প্রবল বর্ষা, বাকি বিশাল মধ্যবর্তী অঞ্চলে ভয়াভহ গরম। মাত্র দু-তিন মাস ঠাণ্ডা থাকে। আর হিমালয়ের তরাই অঞ্চল ঠিকঠাক থাকলেও ওপরের দিকে প্রবল ঠাণ্ডা এবং বরফ জমা। প্রবল গরম আর অত্যধিক আর্দ্রতার জন্য মধ্য ও পশ্চিম ভারতে আঙুর চাষ সম্ভব হয় না তবু উপদ্বীপের পশ্চিমে যে সমস্ত পাহাড় আছে তার ঢালু জমিতে আঙুরের উপযুক্ত চাষের জায়গা বেছে নিয়ে কয়েকটা বড় খেত করা হয়েছে। এই জমিতে যেমন জল দাঁড়ায় না তেমনি পাহাড় ঠাণ্ডা হাওয়া ও দমকা বাতাস থেকে গাছকে রক্ষা করে। সাধারণত সমুদ্রতল থেকে দুশো এবং এক হাজার মিটার উচ্চতার মধ্যে এবং আট থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে আঙুর খেত করা হয়। এসব অঞ্চলে ঘোর বর্ষায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাষট্টি থেকে দেড়শো সেন্টিমিটার। প্রধান আঙুর ফলনের খেত আছে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং তেলেঙ্গানায়। মহারাষ্ট্রের নাসিক ভারতের ওয়াইন ক্যাপিটাল। নাসিক ছাড়াও বরামতি, পুণে, সাংলি ও সোলাপুরে আঙুরের খেত আছে। ফেব্রুয়ারি মাসেই আঙুর তুলে ফেলা হয়। এছাড়া দাক্ষিণাত্যের তামিলনাড়ু ও উত্তরে পাঞ্জাবেও আঙুর খেত আছে। তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের জমিতে সাধারণত বছরে দুবার ফলন হয় । গরম ও আর্দ্রতার দরুন ছত্রাকের উপদ্রব থেকে বাঁচাতে বাঁশের মাচার ওপর গাছকে তুলে দেওয়া হয় যাতে আঙুরগুলো মাটি থেকে অনেক ওপরে থাকে। প্রায় তিন লক্ষ একর জমিতে দেশী আঙুরের পাশাপাশি বিদেশী আঙুরের চাষও হয়। তবে সব আঙুরই যে মদ তৈরিতে কাজে লাগে তা নয়। মদ তৈরির উপযুক্ত ভারতে বিখ্যাত কিছু আঙুর খেত আছে মহারাষ্ট্রের নাসিক (সুলা এবং যাম্পা), নারায়নগাঁও, আক্লুজ (ফ্রাতেলি) এলাকায়, কর্নাটকের নন্দী পাহাড় (গ্রোভার) এবং মধ্যপ্রদেশের দিনদোরিতে।

সারা পৃথিবীতে সাড়ে সাত মিলিয়ন হেক্টর বা সাড়ে আঠেরো মিলিয়ন একর জমিতে আঙুরের চাষ করা হয়। ২০১৫ সালের হিসেব অনুসার ঐ বছরে ২৭৫.৭ মিলিয়ন হেক্টোলিটার মদ উৎপন্ন হয়েছে এবং ২৪০ মিলিয়ন হেক্টোলিটার মদ পানের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। উৎপাদনের হার ও চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় প্রতি বছরে দুই শতাংশের বেশি। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও আমেরিকা উৎপাদন তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। সেই তুলনায় ভারতে উৎপাদন ও ব্যবহারের মাত্রা নগন্য।

পৃথিবীর তিনটে বিখ্যাত আঙুর খেতের অবস্থান হোল ফ্রান্সের বারগুণ্ডিতে, ইতালির সিসিলি ও টুস্কানিতে। বারগুণ্ডির মাটি সিলিকা, চূনাপাথর ও ক্লে মিশ্রিত যা আঙুরের পক্ষে অতি পুষ্টিকর। সিসিলির মাটি ক্ষয়িত আগ্নেয়শিলা থেকে তৈরি বলে খনিজ উপাদানে ভরপুর এবং অতি সুস্বাদু। টুস্কানিতে মাটির চরিত্র বিচিত্র, কোথাও কোথাও ক্লের সাথে বালি বিভিন্ন আনুপাতিক হারে মিশ্রিত, কোথাও পাথুরে মাটি, যার জন্যে আঙুরের চরিত্রেও বৈচিত্র। এই তিনটে খেতের আঙুরের মদ পৃথিবীর সবচেয়ে দামী। মনে পড়ে গেল আমায় সেই হোটেলের কর্মচারী বলেছিনেন, ওয়াইনটা টুস্কানির। না, হয়ত আসল জায়গার নয়, অন্তত দামে মালুম হোল। তবু ওখানকার লোকেরা জায়গার নামেই জিনিসের গুণাগুণ ও মাহাত্ম বিচার করে। একেই বলে নাম-মাহাত্ম।

আঙুর থেকে উৎপাদিত ওয়াইন বা মদ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উন্নত মানের আঙুর ফলন অবশ্যই প্রয়োজন আর উন্নত মানের আঙুর তৈরি করতে উপযুক্ত মাটি দরকার। ভারতে অবিলম্বে এই বিষয়ে গবেষণার দরকার যদি এই শিল্পকে বাঁচাতে ও বাড়াতে হয়। আর কে না জানে শিল্প বাড়লেই শিল্পকর্মীর চাহিদা বাড়বে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। দেশের আর্থিক উন্নতিও হবে। যেহেতু ওয়াইনে অ্যালকোহলের মাত্রা কম তাই অতিরিক্ত নেশাগ্রস্থ হয়ে শরীর খারাপ করার সভাবনা কম। আর এই পানীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে পুষ্টিকরও বটে যদি সঠিক মাত্রা মেপে পান করা যায়।

পৃথিবীর সবকটা বিখ্যাত আঙুর খেতে বড় সাইন বোর্ডে লেখা থাকে ওই জায়গার ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, পাথরের নাম ও ভূতাত্ত্বিক বয়স, মাটির চরিত্র, মাটির বয়স, প্রধান খনিজ পদার্থের নাম, জীবাশ্ম মিশে থাকলে তার নাম ইত্যাদি নানা তথ্য যা পাঠ করলে আঙুরের গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। কথায় বলে, বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলেন পরিচয়তে। তেমনই, সুরা তোমার নাম কি? দ্রাক্ষাই মদের পরিচয় আর দ্রাক্ষার পরিচয় তার জন্ম-মাটি। ওয়াইন টেস্টার সেই মাটির গন্ধও পেয়ে থাকে যা গুণাগুণ নির্ণয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এবার থেকে বোতলের গায়ে পড়ে নেবেন ওয়াইনের বৈশিষ্ট্য।

শেষের কথা

এবারে সেই থমকে দেওয়া কেলেঙ্কারির গল্প বলে চমকে দেওয়া যাক।

পার্টিতে মদের বোতলের কর্কের ছিপি খুলতে গিয়ে বেইজ্জতি হতে হয়নি এরকম পাকা খেলোয়াড় খুব কমই আছে। শক্ত টেবিলে বোতল রেখে ঘাড়খানা মুঠোয় ধরে মুখ থেকে ফয়েলটা সরিয়ে ভাল করে মুছে পেঁচানো কর্কস্ক্রুটা ছিপির মাঝখানে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢোকাতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে যেন ছিপির পুরোটা ভেদ না করে। এরপর আবার খুবই আস্তে উল্টোদিকে হালকা ঘুরিয়ে টান দিলেই ছিপি বেরিয়ে আসবে। এরপর আবার বোতলের মুখ মুছে বোতলের নীচের দিকে ধরে পানীয় ঢালতে হবে। যদি কর্কের গুঁড়ো পড়ে যায় ভেতরে তবে ছেঁকে নেওয়াই ভাল আর যদি কর্কটা ভেতরে কিছুটা ঢুকে যায় তখন বের করার বৃথা চেষ্টা না করে বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়াই ভাল। তবে ওই স্ক্রু বা অন্য কিছু দিয়ে কর্কটাকে ধরে রাখলে ঢালতে সুবিধে। কর্ক আস্ত বের হয়ে থাকলে পরে বন্ধ করার জন্য ব্যবহার করাই যায়। ঢালার সময় গ্লাসের তলাটা ধরে থাকতে হবে। নিজের গ্লাসে সবশেষে ঢালাটাই শোভনীয়। সুরাপান নৈশাহারের আগে, চলাকালীন ও পরে করা যায়।

পার্টিতে টোস্টের কথা আগেই বলা হয়েছে। প্রাক-নৈশাহার টোস্ট হলে খাওয়া শুরুর আগে আহ্বায়ক সকলের মনোযোগের জন্য দাঁড়িয়ে গ্লাস তুলবে এবং অতিথিরা অবশ্য বসেই থাকতে পারেন অথবা ভদ্রতার খাতিরে তাঁকে অনুসরণ করবেন। সেইসময় টোস্টের ‘স্বাস্থ্যপানের’ উদ্দেশ্যটা বলা হয়। আহ্বায়ক নিজে যদি বাড়িতে পার্টি দেন তবে টোস্ট লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে করতে হয় অথবা কম অতিথি থাকলে খাবার টেবিলে বসেই করা যায়। আহ্বায়ক যখন অন্যের বাড়িতে টোস্ট দেন তবে সেটা ভোজনের শেষপাদে ফল-মিষ্টান্ন পরিবেশনের আগে করতে হয়। পার্টি রেস্তোঁরাতে হলে চেয়ারে বসে প্রাথমিক গল্পগুজব শেষ করে তারপর বলুন সুরার বোতল এনে আপনাদের সামনে খুলতে কিন্তু বোতল থেকে প্রথম ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগটা নিমন্ত্রণকর্তা বা সুরারসিককে দিন। ভাল হোটেলে আপনার অনুমতি নিয়েই তবে ওয়াইন পছন্দ ও বোতল খোলার প্রথা চালু আছে। সুরা ভাল লাগলে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে মনে মনে সুরা, মাটি, জীবাশ্ম, উৎপাদক, ও নিমন্ত্রণকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

সুরা পানের সাথে সুরা-সম্পর্কীয় একটা গল্প করা যাক। দ্রাক্ষাখেত বিষিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের জুলুমবাজির একটা ইতিহাস আছে। ফ্রান্সের বারগুণ্ডি খেতের রোমানী-কোন্টি ভূবনবিখ্যাত দামী লাক্সারি সুরা। এক বোতলের দাম আটশো থেকে হাজার ডলার। সেই খেতকে বিষিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে লেখা চিঠি পায় তার মালিক ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে। সেই চিঠির সাথে খেতের একটা নকশা ছিল যেখানে দেখা যাচ্ছে আংশিক খেত তখনই বিষাক্ত করা হয়ে গেছে। বাকিটা বাঁচাতে গেলে ১২৭ লক্ষ ডলার দিতে হবে বলে হুমকিও দেওয়া আছে চিঠিতে। স্যুটকেসে টাকা ভরে রাতে এক কবরখানায় কবে আসতে হবে তাও বলে দেওয়া আছে। পুলিশের সহযোগিতায় শেষরক্ষা হয় এবং আদায়কারী ধরা পড়ে। সে নাকি তার এক প্রাক্তন সহ-জেলবন্দীর আদেশমত এই কাজ করেছিল। এ ধরনের গল্প সুরার আমেজকে বাড়াতে সাহায্য করে।

কোন মদের সাথে কী ধরনের আমিষ খাবার চলে সে নিয়েও মতভেদ আছে। কারোর মতে সাদা সুরার সাথে মাছ, মুরগি, পর্ক চললেও লাল মদের সাথে বিফ অবশ্যই ফেভারিট, আরও ভাল স্টেক। যারা চিজ সহকারে পান করতে পছন্দ করেন তাদের জন্যে বলি, চিজের গন্ধ ভাল সুরার গন্ধ ও স্বাদ নষ্ট করে দেয়। তবে লাল মদের সাথে চলতে পারে। সেরকম কোন বিধি নেই তবে খানা পছন্দ যে-যার নিজের। নিমন্ত্রণকর্তার বাড়িতে খাবার বা পানীয়ের গুণমান নিয়ে বিতর্ক অশোভনীয়। অপছন্দের কিছু থাকলে খাবেন না।

সুরার সাথে রোমান্স গানে সাহিত্যে কবিতায় অনেক যেমন আছে তেমনই রোমাঞ্চকর কিছু গল্পও আছে, আর এটা দিয়ে শেষ করব।

হার্ডি রডেনস্টক নামে এক বিখ্যাত জার্মান সঙ্গীত জগতের ব্যক্তির শখ হোল পুরনো সামগ্রী সংগ্রহ করে বিক্রি করা। তার সংগ্রহে আসে ১৭৮৭ সালের চারটে পার্সিয়ান মদের বোতল যা আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্টের সেলারে পাওয়া যায় বলে সে দাবী করে। গত শতকের আশির দশকের শেষে উইলিয়াম কোষ নামে এক ধনপতিকে পাঁচ লক্ষ ডলারে ওই চারটে বোতল বিক্রি করে। প্রতিটি বোতলের গায়ে “Th.J,” খোদাই করা যার থেকে অনুমান করা হয় বোতলগুলো থমাস জেফারসনের। থমাস সুরা বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন ফরাসী সুরার বিস্তারিত বিবরণ তিনি লিখে রাখতেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে তিনি সেরা ফরাসী সুরা পাঠাতেন। কোষ ওই চারটে বোতল বস্টনে মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস-এ প্রদর্শনীর জন্য পাঠালে সন্দেহের বীজ জন্মায়। অনুসন্ধানে থমাসের লেখনী থেকে জানা যায় যে ওয়াশিংটনকে ওই চারটে বোতল বিক্রি করা হয় নি। তাহলে কি হার্ডি কোষকে ঠকিয়েছে?

তদন্ত শুরু হয়, এফবিআই-এর সাথে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও যোগ দেয়। মদের বয়স নির্ধারনের জন্য ফরাসী ভৌত-বিজ্ঞানী ফিলিপ হুবার্টকে নিয়োগ করা হয়। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ সিজিয়াম-১৩৭ বর্তমানে পৃথিবীর সব কিছুতে মিশে থাকলেও ১৯৪৫ সালে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের আগে এর অস্তিত্ব ছিল না। হুবার্ট পরীক্ষা করে জানালেন মদটিতে এই তেজস্ক্রিয় পদার্থটি নেই অর্থাৎ ১৯৪৫-এর আগের। তাহলে কত পুরনো? এবারে বোতল পরীক্ষা করা হোল। থমাসের নামের আদ্যক্ষর “Th.J,” পরীক্ষা করে দেখা গেল যে ওটা দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইলেকট্রিকের যন্ত্র দিয়ে কাঁচের বোতলের ওপর খোদাই করা হয়েছে। কোষকে ঠকানোর জন্যে আদালত হার্ডিকে ১২০ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলে।

আসর জমে উঠেছে। সুরা আপনার শীতকে, শীতের উৎসবগুলোকে আরও আনন্দময় প্রাণময় রঙিন করে তুলুক এই কামনাই করি।

2 comments:

2

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in




















বঙ্গদেশে নাকি ইদানীং কারণবারির বিক্রি অনেকগুণ বেড়ে গেছে । নিন্দুকেরা বলছে সরকারের সংসারখরচের সিংহভাগ দায় নাকি আবগারী দপ্তরই মেটায় আজকাল। সেটা ভাল লক্ষণ নাকি খারাপ সেটা অর্থনীতিবিদরাই বলতে পারবে ।
আমার চিন্তা অন্য যায়গায় । মদের বিক্রি বাড়লেও রাস্তাঘাটে তো সেই সব মাতালদের দেখা যায় না যারা আগে টলটলায়মান পায়ে, তুরীয় মেজাজে , কাউকে তোয়াক্কা না করে ,গলা খুলে বেসুরে গান গাইতে গাইতে , সদর্পে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন।
তাহলে কি অন্য সব কিছুর মত মদেও ভেজাল থাকছে আজকাল । তাই মদ্যরসিকদের কিছুতেই সেই কাঙ্ক্ষিত মৌতাতটি হচ্ছে না বলে তারা আরো বেশি বেশি করে মদ খাচ্ছে আজকাল। আর তাতেই কি মদের বিক্রিবাটা বাড়ছে কিন্তু মাতলামি কমছে ? এমনটা হওয়া নেহাত অসম্ভব নয় , কারণ শুনেছি অনেক মাতালই থাকে যারা ঠিক পেগের হিসেব রেখে মদ খায় না । নেশা ঠিক কোন লেভেল অবধি পৌঁছেছে সেটা বুঝে মদ খায় ।
তেমনি এক মাতালের গল্প বলি, যে রোজ পানশালায় পকেটে করে একটা গিনিপিগ নিয়ে আসত। টেবিলে সেটাকে রেখে মদ খেত । আর মাঝে মাঝে সেটাকে তুলে দেখত। ওয়েটার একদিন এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে বলল , আমি যতক্ষণ না চোখে দুটো গিনিপিগ দেখি ততক্ষণ খেয়ে যাই । কিছুদিন পরে গিনিপিগটা মরে যায় । তারপরেও সেই লোকটি সে পানশালাতে আসত , সাত আট পেগ মদ খেয়ে চলে যেত ।
ওয়েটার একদিন জিজ্ঞেস করে এখন কী করে বুঝতে পারেন ? লোকটি বললে এখন ঐ সামনের চেয়ারে বসা লোকটাকে দেখি । ওই লোকটাকে ডবল দেখালেই মদ খাওয়া বন্ধ করে দিই । মোটামুটি এই রকমই চলছিল । একদিন ওয়েটার দেখে লোকটি দু পেগ খেয়েই চলে যাচ্ছে । ওয়েটার বলে সে কি এত তাড়াতাড়ি ? লোকটি বলে কি জানি কেন তাড়াতাড়ি নেশা হয়ে গেল , সামনের লোকটাকে দুটো দেখছি । ওয়েটার সামনে তাকিয়ে দেখে বলল , না না আপনি ভুল করছেন , সামনের চেয়ারে দুটো লোকই আছে , ওরা যমজ ভাই , দুজনকে এক রকম দেখতে । লোকটি আবার বসে পড়ে বললে ওঃ তাই বুঝি , তাহলে আজ দু দুগুনে চারটে দেখলে তখন উঠব , নিয়ে এসো একটা পাটিয়ালা ...।
মদ বিক্রি বাড়ার আর একটা কারণ হতে পারে বঙ্গদেশে সোবার-এর সংখ্যা বেড়ে গেছে । একটু বুঝিয়ে বলি। আমরা অনেক ইংরেজী কথার মত একটা ইংরেজী কথাকেও প্রায় বাংলা বানিয়ে ফেলেছি । সেটা হল সোবার ( sober ) । আমরা যখন বলে থাকি ছেলেটিকে বেশ সোবার দেখতে, তখন আসলে বোঝাতে চাই ছেলেটি শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র, নরম এই রকম কিছু ।আমি কিন্তু ইংরেজী sober এর কথা বলছি। ডিকশনারি ঘাঁটলে দেখা যাবে sober শব্দের মানে অন্য কিছু লেখা আছে । সেখানে বলছে মদ খেয়েও যে মাতাল না হয় , সেই হচ্ছে সোবার ।
একজন প্রাজ্ঞ মাতাল, মাতাল এবং সোবারের মধ্যে তফাতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন – ‘ আমি মাতাল এবং আমি বুঝতে পারছি আমি মাতাল তখন আমি সোবার , আর আমি মাতাল কিন্তু বুঝতে পারছি না আমি মাতাল, তখন আমি মাতাল ।তাই এটাও সন্দেহ জাগছে আসলে বোধহয় বঙ্গদেশে আসলে সোবারের সংখ্যা বেড়ে গেছে , তাই এই অবস্থা ।
অবশ্য এই মাতালের সংখ্যা কমে যাবার ব্যাপারটা অনেক কাল আগে কল্লোল যুগের বিখ্যাত লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর যুগেও লক্ষ করেছিলেন । তিনি লিখেছিলেন – ‘সে যুগে অর্থাৎ আমাদের ছেলেবেলায় কলকাতার রাস্তায় বেরুলে প্রায়ই মাতাল দেখতে পাওয়া যেত। তখনকার তুলনায় এখনকার দিনে মাতালের সংখ্যা অসম্ভব রকমের বেড়ে গেলেও পথে ঘাটে মাতালের কেলেঙ্কারী আর দেখতেই পাওয়া যায় না , বলা চলে। তার একটা প্রধান কারণ এই যে ডেকো-হেঁকো মাতালের চাইতে চোরা মাতালের সংখ্যা বেড়েছে বেশি।’’
জীবনানন্দ বলেছিলেন “সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি” । তার মানে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। ঠিক তেমনিই সকল মদ্যপায়ীই কিন্তু মাতাল নয় ।কেউ কেউ মাতাল । প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মতে - “অধিকারী ভেদ বাক্যটি যে নিশ্চিত সত্য তা আমরা জীবনের নানা ক্ষেত্রেই দেখতে পাই। যারা মদ্যপানের অধিকার নিয়ে সংসারে আসে তাদের ছাড়া মদ্য পানের অধিকার আর কারুর নেই । কিন্তু মুসকিল এই যে কে যে সত্যিকারের অধিকারী তা আগে থেকে জানবার উপায় নেই । সকলেই নিজেকে অধিকারী মনে করে সুরু করে দেয় । এবং অনাধিকতরত্ব প্রমান হওয়া সত্বেও ছাড়তে পারে না । তাইতেই মদ্যপায়ীর এত দুর্নাম ।”
তবে শুধু পথে ঘাটেই নয় সিনেমা থিয়েটারেও আজকাল সেই রকম হৈ হৈ করা মাতাল চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় না । তারাও কী তাহলে এই ট্রেন্ড ফলো করছে ?
আহা কি সব খানদানি মাতালদের দেখা যেত সিনেমা থিয়েটারে ।
প্রথমেই মনে পড়ছে একদিন রাত্রে ছবিতে ছবি বিশ্বাসের কথা । গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় বেলফুলের মালা পরে ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় , সব সত্যি’ গানে লিপ দিতে দিতে তাঁর সেই ক্ল্যাসিক্যাল মাতলামি। এই সিনেমাটির যখন হিন্দি ভার্সন হল তখন ছবি বিশ্বাসের জায়গায় এলেন মোতিলাল । তিনিও এক জব্বর অভিনেতা , চুটিয়ে মাতলামি করলেন । তবে মাতালের গলায় গানটা পালটে হল – ‘জিন্দগী খোয়াব হ্যায়/ অউর খোয়াবমে ঝুট হ্যায় কেয়া অউর বলা সচ হ্যায় কেয়া/ সব সচ হ্যায় ’ । আসলে বাংলায় সলিল চৌধুরী এই গানে যে উমদা স্যাটায়ারের প্রয়োগ করেছিলেন , সেটা হিন্দিতে শৈলেন্দ্রজী আনতে পারলেন না । তাই তার মধ্যে , মাতালের চোখে সবই সত্যি এই জায়গাটা অপরিবর্তিত রেখেও , অন্য রকম একটা মাতাল-দর্শন নিয়ে এলেন ।
মনে আছে এক সময় দুজনের অভিনয় নিয়ে তুলনা হত এবং এ রকম একটা তর্ক উঠত – কে বেশী মাতাল , ছবি না মোতিলাল।
বাংলা ছবিতে মাতালেরা এসেছেন , যুগে যুগে কালে কালে । এই মুহুর্তে আরো দুটি গানের কথা মনে পড়ছে – অদ্বিতীয়া ছবিতে বিকাশ রায় মশায়ের লিপে – এই মাল নিয়ে চিরকাল যত গোলমাল আর স্বয়ং উত্তমকুমারের লিপে শুধু একটি বছর ছবিতে – যে আমার মন নিয়েছে , সেকি হায় বলতে পারে । প্রথমটি মান্না দে , আর দ্বিতীয়টি হেমন্তবাবু গেয়েছিলেন। আহা, ও রসে বঞ্চিত দুই মানুষ, তবু কী চমৎকার সুরেলা মাতলামিই যে করেছিলেন তাঁরা।
আর হিন্দিতে তো প্রায় সব সুপারস্টারই মদিরা-গানে লিপ দিয়েছেন । কাকে ছেড়ে আর কার কথা বলি । তবে দিলীপকুমারের দেবদাস তো মাতালদের চিরকালীন আইকন ।
দেবদাস বলতে মনে পড়ল বাইপাসে রুবি হাসপাতালের কাছে একটি পানশালার নাম – দেবদাস । এও এক রকম ট্রিবিউট টু শরৎবাবু ।
তবে আমার ব্যাক্তিগত পছন্দের মদিরা-সঙ্গীতটিতে লিপ দিয়েছিলেন শাম্মি কাপুর , কাশ্মীর কী কলি ছবিতে । হ্যায় দুনিয়া উসিকা হ্যায় জমানা উসিকা , মোহব্বতমে যো হো গয়া কিসিকা ...। আহা রফিসাহেব , তিনিও সুরার গুণগ্রাহী ছিলেন না , অথচ কী মধুর নেশায় আমাদের ফেলে দিয়েছিলেন ।
হিন্দি সিনেমায় মাতালদের কথা উঠবে আর কেষ্টো মুখার্জির কথা হবে না ? এতো সেই- ফুলে গন্ধ নেই , এতো ভাবতেই পারিনা ।
ওই ভদ্রলোকও নাকি বিন্দুমাত্র মদ্য পান করতেন না । অথচ কত ছবিতে যে আমাদের মাতলামির মজায় মজিয়েছেন ।
হিন্দি থেকে আবার বাংলাতেই ফিরে আসি । আমাদের নাট্য জগতের দুই দিকপাল গিরীশ ঘোষ আর শিশির ভাদুড়ী । দু জনেই ওই ঐ দ্রাক্ষারসের রসিক ছিলেন । হয়তো বা একটু বেশিই রসিক ছিলেন। শিশিরবাবুর সম্মন্ধে একটি রসিকতা চালু ছিল – সন্ধের পর শিশির ভাদুড়ী বোতলের ভাদুড়ী হয়ে যান ।
আর গিরিশ ঘোষ নিয়ে যে গল্পটি চালু আছে সেটি এই রকম- এক রাত্তিরে গিরিশ ঘোষ খুব মাতাল হয়ে গেছেন! যেখানেই যাচ্ছেন কেউ তার জন্যে দরজা খুলে দিচ্ছেন না । এমন সময় তাঁর এক সাগরেতকে বললেন, “ দক্ষিণেশ্বরের কথা মনে পড়ে গেল। আমি জানি সেখানে ঠিক একজন আছেন, তিনি কখনও দরজা বন্ধ করেন না।”
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। অমনি জুড়ি গাড়িতে লাফিয়ে উঠলেন। কদিন আগে থিয়েটারের জন্যে একটা গান বেঁধেছেন পাহাড়ি পিলু রাগে। জুড়ি গাড়িতে চেপে উচ্চৈস্বরে সে গান- ‘ছি ছি ছি ভালবেসে,/ আপন বশে কি রয়েছো’ – গাইতে গাইতে চললেন দক্ষিনেশ্বরের দিকে।
গভীর রাতে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে পৌঁছালেন দক্ষিণেশ্বরে। গাড়ি থামতেই, খোঁয়ারি জড়ানো গলায় গিরিশ্চন্দ্র চিৎকার করলেন, ‘‘ঠাকুর, ঠাকুর!’’
বেরিয়ে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব! তিনি বুঝি অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ‘‘কাতর প্রাণে, এমন করে কে ডাকে? গিরিশ না!’’
ঠাকুরের ছোঁয়ায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন গিরিশ।এবং সম্বিতে ফিরেই খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন ।
রামকৃষ্ণদেব অভয় দিয়ে বললেন , ‘‘মদ খেয়েছিস তো কি, আমিও মদ খেয়েছি। ‘সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে, মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে।’’ গান গাইতে গাইতে গিরিশের হাত ধরে নাচতে লাগলেন ঠাকুর।
শুধু সিনেমা আর থিয়েটারে তো নয় ।এই যে আমাদের বঙ্গ ভান্ডারের বিবিধ রতন । এই সব সাহিত্য-রতনের আঁতুড়ঘর একেবারে সম্পুর্ন ভাবে মাদকবর্জিত ছিল , এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না । সেই মধুসুদন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, নবীন চন্দ্র সেনের যুগ পেরিয়ে ডি এল রায়, শরৎ চাটুজ্যে, মানিক বন্দোপাধ্যায় , সমরেশ বোস, সুনীল গাঙ্গুলি অবধি বাংলা সাহিত্যের উজ্বল যাত্রাপথে কোথাও কোথাও একটু আধটু , কোথাও বেশ ভালরকম দ্রাক্ষারসের সৌরভ যে মিলে মিশে আছে তা অস্বীকার করা যায় না।
শোনা যায় বঙ্কিম বাবুর বাড়িতে এবং ডি এল রায়ের বাড়িতে যে কবি লেখকদের আড্ডা বসত সে আড্ডা শুধু চায়ের আড্ডা ছিল না ।তার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। শিশিরকুমার ভাদুড়ির নাট্যমন্দিরে একটি আড্ডা বসত । সে আড্ডার এমনই টান ছিল যে সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাজেশিবপুর থেকে ট্রামে বাসে চেপে এসে হাজির হতেন।সে আড্ডাটিও নাকি একেবারে ‘শুষ্ক’ থাকত না ।
তবে বাংলা সংস্কৃতির যে তিনজন সব চেয়ে স্পর্ধাবান মাতালকে বাঙালি চিরকাল মাথায় করে রাখতে বাধ্য হবে, তাঁদের নাম , রামকিঙ্কর বেইজ , ঋত্বিক ঘটক এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।তাঁদের নিয়ে অনেক গল্প বাঙ্গালির মুখেমুখে ফেরে ।
সেই সব গল্প আর মিথ মিলে মিশে বাঙালির অন্তরে এক রোমান্টিক মাতাল বাস করে বা করত। ‘দেবদাস’ সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকদের দু একটা পিস পাড়ায় পাড়ায় কিছুদিন আগে অবধি দেখা যেত । এদের সম্মন্ধে এদের সম্মন্ধে কানাঘুষো কিছুটা এই রকমের গল্প শোনা যেত -
ফটিকদা নাকি পড়া পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল । দেখতে শুনতেও ভাল ছিল । সেই পাড়াতেই এক ভেঙ্গে পড়া তিনতলা বাড়িতে থাকতেন প্রাক্তন জমিদার ঘনশ্যাম মিত্র। তাঁর মেয়ে পুতুলের সঙ্গে নাকি ফটিকদার কিঞ্চিৎ আশনাই হয়ে ছিল । ঐ পাথরে মুড়ে দূর থেকে দু একটা প্রেমপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি, দুপুর বেলায় ফটিকদার সাইকেলের ঘণ্টি শুনে চিলেকোঠা থেকে পুতুলের উঁকি মারা , ঐ পর্যন্ত। ফটিকদার বাবার মুদির সোকান ছিল , তাদের পদবি ছিল সাধুখাঁ ।একে ঘনশ্যাম মিত্তিরের গায়ে বইছে জমিদারী রক্ত, তার ওপরে জাতে কুলীন । অতয়েব তিনি এই প্রেমের কথা জানতে পেরেই রাতারাতি পুতুলের জন্যে নৈকষ্য কুলীন কায়স্থ পাত্র খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিলেন । ফটিকদা তারপর থেকেই মদ ধরল । শোনা যেত পুতুল নাতি নাতনি নিয়ে শান্তিপুর না কোথায় যেন সুখে ঘর সংসার করে । কিন্তু ফটিকদা এখনো রোজ মাঝরাত্তিরে - এই কী গো শেষ গা...... ন , বিরহ দিয়ে গেলে...এ......এ গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরে ।
এখন অবশ্য এ রকম গল্প ঠাম্মির কাছে নাতনিরা শুনে বলে - বলে উফ , কী অসহ্য ন্যাকামি ছিল তোমাদের সময়ে ।
একটি খাঁটি বাঙালি মাতালের গল্প বলে শেষ করি । ধরা যাক তাঁর নাম ঝন্টুদা ।
ঝন্টুদা সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানী । ঝন্টুদার বিয়ের ঠিক হল । লক্ষ্মীমন্ত বৌ ঘরে এলো । কিছুদিনের মধ্যেই বৌ টের পেয়ে গেল , ঝন্টুদা সন্ধে বেলায় বেরিয়ে একটু ঢুকুঢুকু করে ফেরে ।নতুন বৌ একদিন পুরোনো হল। প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা, তার পর মান অভিমান তারপর চেঁচামিচি ঝগড়া । কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না । ঝন্টুদা সন্ধে সন্ধেবেলায় রোজ বেরিয়ে যান এবং স্থলিত চরণে বাড়ি ফেরেন । শেষ পর্যন্ত ঝন্টুদার বৌ অন্য রাস্তার কথা ভাবল । কিছুদিন আগে ঝন্টুদা তাকে ছুটির দিনে নুন শোয়ে হিন্দি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সিনেমাটি দেখতে নিয়ে গেছলেন । সেখানে দেখেছিলেন, যে স্বামী রোজ সন্ধেবেলা বারবাড়ি চলে যায়, তাকে মীনাকুমারী ‘না যাও সাঁইয়া চুরাকে বাঁইয়া’ গানটি গেয়ে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন । ঝন্টুদার বৌ ভাবলে সেই কায়দাটি করলে কেমন হয় ।
ঝন্টুদার কাছে সে রকম ইছা প্রকাশ করতেই ঝন্টুদা নিজেই সব ব্যবস্থা করে দিলেন । মা কালি মার্কা মদের বোতল নিয়ে এলেন । সঙ্গে নিয়ে সোডা এবং বরফ। আগে থেকে বৌকে দিয়েই কয়েকটা বেগুনি ভাজিয়ে রাখলেন । তারপর বেশ ঢিলে ঢালা পাজামা পাঞ্জাবি পরে ট্রেতে গ্লাস , বোতল সজিয়ে, মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে বসলেন দুজনে । দুটি গ্লাসে পানীয় ঢেলে এক গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন বৌয়ের দিকে । বৌ খানিক ইতস্তত করে গ্লাস থেকে এক ঢোঁক দিয়েই ফেললেন । দিয়েই তো গা গুলিয়ে উঠল । ও মা কী বিচ্ছিরি খেতে , কি বিচ্ছিরি গন্ধ , বলে হিক্কা তুলতে লাগলেন । ওরে বাবা এতো সারা বুক জ্বলছে , কেমন বমি বমি লাগছে , তুমি এই বিচ্ছিরি জিনিসটা কি করে খাও ?
ঝন্টুদা বললেন তা হলেই বোঝো , তুমি ভাবো আমি মদ খেয়ে খুব আনন্দ পাই , বুঝে দেখ কত কষ্ট করে আমাকে মদ খেতে হয় !
বলা বাহুল্য এর পর ঝন্টুদা আবার সেই পুরোনো রুটিনেই ফিরে গেলেন ।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে । ঝন্টুদার চাকরিতে উন্নতি হয়েছে । তিনি দেশী ছেড়ে বিলিতি ধরেছেন ।বাইরে যান না , বাড়িতেই খান। কিন্তু রোজ মদ খাওয়া ছাড়েন নি । ইতিমধ্যে লিভারটির অবস্থা খারাপ করে ফেলেছেন । অন্যান্য উপসর্গও দেখা দিয়েছে ।একদিন পেটের ব্যথা বাড়তে ডাক্তার ডাকা হল । ডাক্তার সব দেখে শুনে বললেন । মদ একেবারে বন্ধ করতে হবে । ঝন্টুদা বললেন পারবোনা ডাক্তারবাবু চল্লিশ বছরের অভ্যেস ,মদ না খেলে পেট ফুলেই মরে যাবো। ।ডাক্তার বললেন বেশ – কিন্তু দেড় পেগের বেশি নয় । কিন্তু ঝন্টুদা বললেন দেড় পেগে তো কিছুই হবে না একটু বাড়িয়ে দিন । শেষ পর্যন্ত রোজ তিন পেগে রফা হল ।
কিছুদিন পর ঝন্টুদার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল। আবার সেই ডাক্তারবাবু এলেন । বৌকে জিজ্ঞেস ঐ তিন পেগই খায় তো । বৌ তখন বলল কী আর বলব আপনি তিন পেগ বেঁধে দিয়েছিলেন । পরের দিন সকালে আরেক ডাক্তার ডাকিয়ে আনলেন , আর তাকে দিয়ে ঠিক একই ভাবে তিন পেগের বরাদ্দ করালেন । বিকেল বেলায় আরেকজন ডাক্তার ডালালেন তাঁকে দিয়ে ঠিক একই কায়দা খাটিয়ে করে তিন পেগ বরাদ্দ করালেন । তারপর আমাকে বললেন ডাক্তার আমাকে তিন ইনটু তিন ইজ ইকুয়াল টু নাইন পেগ পথ্য করেছেন । ডাক্তারের দেওয়া পথ্য না খেলে আমি মরে যাব । তারপর থেকে রোজ এক পাঁইট করে মদ খাচ্ছেন ।
ডাক্তার রেগে মেগে মদ খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলেন ।
তারপর কয়েকদিন পরেই ঝন্টুদা মারা গেলেন । মৃত্যুর কারণ কিন্তু মদ খাওয়া নয়।
মদ খাওয়া তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন । কিন্তু কয়েকদিন পরে তাঁর কাঁধে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয় । ডাক্তার সে ব্যাথার জায়গায় একটু করে অ্যালকোহল লাগাতে বলেন । বৌ সেই অ্যালকোহল লাগিয়ে রান্না করতে গেছেন । এদিকে বহুদিন পরে অ্যালকোহলের গন্ধ নাকে গেছে , আর তিনি থাকতে পারলেন না । তিনি মাথা উলটিয়ে পিঠ চাটবার চেষ্টা করছিলেন। আর তাতেই হল তাঁর মৃত্যু। ডাক্তারবাবু ডেথ সারটিফেকেটে লিখলেন - Abnormal movement of neck bones resulting in loss of sensation, paralysis and death.।
যতই লুকাবার চেষ্টা করিনা কেন এই লেখার ফাঁকে ফোঁকরে যে শ্রী তারপদ রায় ছায়া ফেলেছেন এমনটা অনেক পাঠকের মনে হতে পারে ।
তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি আসলে বাংলা সাহিত্যে মদ্যরসিক অনেক থাকলেও তারাপদ রায়ের মত আর মাতালদরদী আর কেই বা আছেন । তবে কিনা মাতালদের গল্পের কোনো কপিরাইট ব্যাক্তিবিশেষের কাছে নেই ।
আসলে সেই সব প্রবাদ বাক্য ,বটতলার চটি গল্প , ছেলে ভুলানো ছড়া এবং লোকগানের মত এই সব মাতালদের গল্পগুলো লোকের মুখে মুখে ফিরে এক যুগ থেকে আর এক যুগে, এবং এক দেশ থেকে আর এক দেশে পৌঁছে যায় । কিন্তু এ সব গল্পের স্রষ্টাদের নাম , সোশ্যাল মেডিয়াতে ভেসে আসা ‘মিম’গুলির মত, অজানাই থেকে যায় ।
তবুও রসিকচুড়ামনি তারাপদ রায় , অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন মাতাল-সমগ্র নামক বইতে এ রকম কিছু গল্পকে দুই মলাটের মধ্যে নিয়ে আসার। তাঁর প্রতিই শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর একটি উক্তি দিয়েই শেষ করি এই লেখা ।
“ মাতালের গল্পের শেষ নেই। বত্রিশ পুতুল, চল্লিশ চোর কিম্বা সহস্র এক আরব্য রজনীর চেয়েও দীর্ঘ সেই কথামালা। এই ধুলি মলিন, পাই পয়সা, শাকচচ্চড়ির গোমড়ামুখ পৃথিবীতে এখনো দু-একটি মজার গল্প মাতালেরাই রচনা করেন। তাঁরা আমাদের নমস্য, তবে দূর থেকে। ”
কেস খাবার ভয়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণটা দিয়ে রাখলাম- মদ্যপান স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর।

*****
সব ভাষাতেই সবচেয়ে বেশিবার যে গল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে সেটি ছিল স্বয়ং লেখকের সবচেয়ে অপছেন্দের গল্প। তার নাম দেবদাস – কারণটা কী পাঠকরাই বিচার করুন। ছবিতে ১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় নির্মিত ‘দেবদাস’ ছায়াছবির নামভূমিকায় দিলীপকুমার।

2 comments: