4

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in




















বরুণেশকে কোলকাতায় চাকরি করে তবে দু-তিন মাসে কোথাও-না-কোথাও আপিসের কাজে যেতে হয়। একাই থাকে। বিয়ে-থা হয়নি – তা বয়সতো মাত্র সাতাশ, মেলা সময় আছে। ধানবাদে এসেছিলো, ট্রেনে ফিরছে।
এই চার-পাঁচ ঘন্টার ট্রেনযাত্রা বড় একঘেঁয়ে, সময় কাটে না। কাগজ পড়া হয়ে গেছে, সঙ্গে পড়ার মতো বই নেই। এসব গাড়িতে হাজার রকমের ফেরিওলা ওঠে, বরুণেশ বসে বসে তাদেরই লক্ষ করছিল। ঝালমুড়ির পরে উঠল গরম সিঙ্গারা। অনেকে নিল। মুড়ি-সিঙ্গারা নেমে গেলে এল ‘অম্বলের অব্যর্থ ওষুধ’। কলম, চিরুনি, মোবাইলের খাপ, কাঁচা ছানার সন্দেশ একে একে আসছে আর যাচ্ছে। বিক্রি ভালই হয়। কত রকম কত বয়সের লোক চলেছে – তাদের কত রকমের পছন্দ, কত রকমের প্রয়োজন। এবারে শোনা গেল –“ ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনিদের জন্য নিয়ে যান … স্পাইডার ম্যান, চিনে লাট্টু, মেশিন গান, হেলিকপ্টার …” এক খেলনাওয়ালা উঠেছে।
বরুণেশের সামনে ডানদিকের সারিতে একটা বছর চারেকের ছেলে তার বাবার সঙ্গে যাচ্ছিল, সে সীটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল খেলনার টানে। লাট্টু ঘুরছে আর চকমকে আলো জ্বলছে, মেশিন গান চলছে কটকট শব্দ করে … এতকিছু থাকতে ছেলেটার মন টানল একটা গরু। সবুজ রঙের, প্লাসটিকের। পেটে ব্যাটারি লাগানো, বোতাম টিপলেই সবুজ গরু তার শিং-ওয়ালা মাথা নাড়াচ্ছে আর হ্যমা হ্যমা করে আওয়াজ করছে। বাবা কিছুতেই কিনে দেবা না আর ছেলেও ছাড়বে না। দাম কম বলে বাবা লাট্টুটা ধরাতে চাইছিল। তা বাবার কল্পনা শক্তি দেখবার মতো – “ দেখ লাট্টু এমনিতেই ঘুরবে, কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু গরুকে রোজ খাওয়াতে হবে, তারপর গোবর সাফ করতে হবে। তুই ইস্কুলে গেলে কে অত সব করবে বল?
আজকালকার ছেলেরা অত বোকা হয় না। ছেলে বলল – “ ব্যাটারি ফুরোলে তুমি শুধু ব্যাটারি কিনে দেবে, বাকি সব আমি করব।”
হেরে গিয়ে বাবা দর করা শুরু করল। -“ গরুটা কত পড়বে?”
-“ আড়াইশো”
-“ ঠিক দাম বল, নেওয়ার মতো – খেলার জিনিস, দুদিনে খারাপ হয়ে ভেঙে যাবে …”
-“ ছেলে আপনার মত বড় হয়ে যাবে, তবু এ গরু ঠিক থাকবে .. হ্যাঁ”
-“অত দিন গরু নিয়ে ও করবেটা কি? তুমি বরং দাম কমাও”
-“ দশটা টাকা কম করে দেবেন”
দরদামের বচসা ছেলের ভালো লাগছিল না। সে একবার খেলনাওয়ালা একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে। বাবা শুরু করল পঁচাত্তর থেকে, সবুজ গরু আড়াইশ থেকে নেমে এল একশ ষাটে। বাবা ততক্ষণে একশ দশে উঠেছে, খেলনাওয়ালা শেষ দাম দিল একশ পঁয়ত্রিশ।
ছেলে যত বলে নাও, বাবা বলে অত টাকা নেই যে রে। ছেলে বলল –“ টিকিট কাটার সময় দেখেছি তোমার ব্যাগে অনেক টাকা আছে, ব্যাগটা বার করো না…” বাবার গলা ধরে ছেলে ঝুলে পড়ল। বিষয়ী বাবার তবু মন গলল না।
মাত্র একশ পঁয়ত্রিশ – বরুণেশের ইচ্ছে করল ও নিজেই ছেলেটাকে সবুজ গরু কিনে দেয়। কী মিষ্টি ছেলেটা, কত করে চাইছে। কিন্তু হঠাৎ ট্রেনে অচেনা কারুর ছেলেকে গরু কিনে দেওয়া যায় কি? লোকটি যদি না নেয়, যদি বলে আমার ব্যাপারে আপনি নাক গলাচ্ছেন যে বড়। ছেলের আবদার রাখব কি না রাখব তা আমার দেখার কথা, আপনার নয়।
খেলনাওয়ালা দরদামে রাজি করাতে না পেরে কামরার ওদিকে গেল, আবার ফিরবে।
বরুণেশের মনটা কিনে দেওয়ার জন্য অস্থির হলেও ও ঠিক করতে পারল না কাজটা উচিত না অনুচিত। একটা বুদ্ধি এল মাথায় – ছেলেটাকে গিয়ে বলবে তার জন্মদিন কবে। তারপর বলবে তোমার জন্মদিনে এটা দিলাম তোমাকে। কেমন হবে? তবে ব্যাপারটা কেমন ভাবে নেবে ওর বাবা – যদি আবার লোকটার আত্মসম্মানে আঘাত-টাঘাত লেগে যায়। আর একশ পঁয়ত্রিশ একটা খেলনা গরুর জন্য খরচ করবে! ঠিক হবে কি? বেশ কিছুক্ষণ এরকম দোনামোনা করার পর বরুণেশ দেখল খেলনাওয়ালা অন্যপ্রান্ত থেকে ফিরছে। সংকোচ কাটিয়ে সে গরুটা কিনেই ফেলল। দাম জিগেস করতে আবার সেই আড়াইশ থেকে শুরু হয়েছিল – বরুণেশ মনে করিয়ে দিল একশ পঁয়ত্রিশ তো এইমাত্র কথা হয়েছিল। খেলনাওয়ালা বলল –“তাই দিন, অনেক লোকসান হয়ে গেল …”
বরুণেশ পাঁচশোর নোট দিতে সে বলল, খুচরো নেই। এ পকেট সে পকেট ঘেঁটে দুটো একশ বেরুল। খেলনাওয়ালা পাঁচটাকা-দশটাকার পয়সায় একগাদা খুচরো ধরিয়ে দিল। পঁয়ষট্টি আছে তো? বরুণেশ গুনতে লাগল।
এতসবের ভেতর খেয়ালই হয়নি যে ট্রেন একটা স্টেশনে এসে দাঁড়াচ্ছে। বরুণেশের হাতে গরুটা দিয়ে খেলনাওয়ালা তড়িঘড়ি নেমে গেল। সে যাকগে কিন্তু এদিকে তাকিয়ে বরুণেশ দেখল – এই রে! সে বাবা আর ছেলেও তো নেমে যাচ্ছে… এই তাড়াহুড়োতে তো আর জন্মদিনের কথা পাড়া যায় না, তাছাড়া তারা এখন নাগালের প্রায় বাইরে। উঠে গিয়ে কথা বলতে গেলে জায়গা চলে যাবে। অনেক লোক ইতিমধ্যে কামরায় উঠেও পড়েছে।
এক্সপ্রেস ট্রেন। দুমিনিট দাঁড়িয়ে ছেড়ে দিল। বাবা নেই, ছেলেও নেই। খেলনাওয়ালাও নেই। শুধু সবুজ রঙা গরুটা রয়ে গেল বরুণেশের হাতে! ‘কিংকর্তব্যবিমুঢ়’ কথাটার মানেটা যে কি তা বরুণেশকে দেখলে চাক্ষুষ বোঝা যাচ্ছিল।
******

সেই থেকে তাকের ওপরে এককচ বাংলা পত্রিকা আর স্বামী বিবেকানন্দের ছবির মাঝখানে সবুজ রঙা গরু রয়ে গেছে। একেবারেই মানায় না। তবে ঘরে তো আর জায়গাও নেই। ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। পেটে তার আর ব্যাটারি নেই তাই নিজে ঘাড় ঘোরাতে পারে না। ঘাড় একদিকে বেঁকে স্থির হয়ে গেছে। জোর করলে মটকে যেতে পারে। সবুজ গরু সারাদিন বরুণেশের দিকে রাগরাগ মুখ করে তাকিয়ে থাকে। যেন বলে – ইচ্ছে হয়েছিল তো বাচ্চাটাকে দিলেই পারতে… আমিও ভালো থাকতাম, সেও খুশি হতো। এত পড়াশুনো করেছ আর এটা মাথায় এলো না!
বরুণেশ ভাবে - ভালো একটা কিছু করার ইচ্ছে হয়েছিল, করব-কি-করব-না ভাবতে ভাবতেই সময় পার হয়ে গেল! পট করে কিনে নিয়ে দিয়ে এলেই হতো। ওর বাবা কিছু বললে তখন নয় দেখা যেত। সময় চলে ট্রেনেরই মতো, কে কোন স্টেশনে কখন নেবে যাবে তা কি জানা থাকে। সামর্থ থাকা সত্তেও না করে ওঠার অস্বস্তি অনেকদিন রয়ে যায়, ঝেড়ে ফেলা যায় না। তাকে রাখা বেখাপ্পা সবুজ গরুটার মতো।


4 comments:

  1. এই অনুভব অনেকের হয়েছে। গল্পতে প্রথম পেলাম। খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেরিতে আপনার মতামত দেখলাম। গল্প যে আপনার ভালো লেগেছে তা আমার কাছে খুব ভালো খবর। ভালো থাকবেন। লেখক।

      Delete
  2. বেশ মজা পেলাম

    ReplyDelete
  3. অনেক ধন্যবাদ। লেখক।

    ReplyDelete