0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১২

কেবলমাত্র দুটো আলাদা রঙের স্তুপ তখনো সেখানে পড়ে ছিল। আচার বানানোর শসার স্তুপটা গাঢ় আর হাল্কা সবুজ রঙের, আরেকটা লালচে হলুদ অ্যাপ্রিকটের স্তুপ। বিশাল নৌকার মত দেখতে নাগরদোলাটা বাজারের ঠিক মাঝখানে আছে। বরাবর ওই জায়গাতেই ছিল নাগরদোলাটা। যদিও রঙটা আগের চেয়ে অনেক ফিকে হয়ে গেছে। নীল আর লালে রঙ করা নাগরদোলাটাকে এখন মনে হচ্ছে বন্দরের একপাশে পড়ে থাকা একটা পুরনো আমলের নৌকা, যার কাঠকুটো, লোহালক্কড় কিছুদিনের মধ্যে ভেঙ্গেচুরে রদ্দি হিসেবে নিলাম হবে ওজনদরে। নাগরদোলার দোলনাগুলো কেমন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ঝুলে ছিল; একটাও সেভাবে দুলছিল না। নাগরদোলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটা ক্যারাভান। সেটার থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।

রঙের স্তুপগুলো ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল। আচার বিক্রেতার গাঢ় এবং হাল্কা সবুজ মেশানো স্তুপটা খুব তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে আসছিল। গ্রেক দূর থেকে দেখতে পেল যে দুটো লোক তুলে রাখছে আচারের শসাগুলো। অ্যাপ্রিকটের স্তুপটা তুলনায় ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছিল। এক মহিলা, মাত্র একজন মহিলা লালচে হলুদ স্তুপ থেকে অ্যাপ্রিকট তুলে তুলে ধীরে ধীরে ঝুড়িতে সাবধানে সাজিয়ে রাখছিল। শসা সম্ভবত অ্যাপ্রিকটের মত সুখী, পেলব ফল নয়। গ্রেক খুব ধীরে ধীরে হেঁটে আসছিল। অস্বীকার করা… ব্যাপারটা ভাবছিল সে। খোলামনে একবগ্‌গা ভাবে ব্যাপারটা একদম অস্বীকার করতে চাইছিল সে। যখন কোনো সমস্যা খুব প্রকট হয়ে ওঠে, তখন এটাই একমাত্র সমাধান। একমাত্র। অস্বীকার করবার, উপেক্ষা করবার মূল্য জীবনে অপরিসীম। কিন্তু ব্যাপারটা সেভাবে অস্বীকার করতেও পারছিল না সে; কেবল অবাক হচ্ছিল এটা দেখে যে এখনও কত ইহুদী রয়ে গেছে এখানে।

ছোট ছোট গাছের সারি এবং জনপদের বাড়িঘরদোরের মাঝের ফুটপাথটা খুব এবড়োখেবড়ো, উঁচুনিচু। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে এত কিছু খেয়াল করেনি, এতটাই উত্তেজিত ছিল সে। তার মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি এই জায়গাটা থেকে দূরে যাওয়া যায়, তত মঙ্গল। তাহলে আর অস্বীকার করবার মত কিছু থাকবে না। সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে। সে এখন বাজারের চৌমাথার খুব কাছে। শসার স্তুপটা এখন অদৃশ্য। ঠেলায় করে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হল তার পাশ দিয়েই। অ্যাপ্রিকটের লালচে হলুদ স্তুপটা এখনও অর্ধেকটাও কমেনি। সেই বর্ষীয়সী মহিলা এখনও ধীরে ধীরে ফলগুলি তুলে তুলে ঝুড়িতে সাজিয়ে রাখছেন।

গ্রেক নাগরদোলাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল। সে জীবনে কোনওদিন নাগরদোলায় চড়েনি। তাকে কোনওদিন ছোটবেলা থেকে এসব চড়তে দেওয়া হত না। তার পরিবারে এসব নিষিদ্ধ। প্রথম কারণ হল, সে ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ। দ্বিতীয় কারণ হল ভরা হাটবাজারের মাঝখানে বাঁদরের মত ঝুলতে থাকার মত মুর্খামি একেবারেই সঠিক কাজ নয়। সে কোনোকালে কোনো নিষিদ্ধ কাজ করেনি। আজ প্রথমবার সে এই কাজটা করতে চায়। এই ভয়ঙ্কর, মূর্খের মত একটা কাজ, যাতে হয়তো তার প্রাণহানিও হতে পারে, এমন একটা কাজ সে করতে চায়। গ্রেক গলার কাছে একটা উত্তেজনা অনুভব করলো। সে দ্রুত টলমল করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগলো। ফাঁকা জায়গাটার মধ্য দিয়ে নাগরদোলাটার দিকে প্রখর রোদ্দুরে টলতে টলতে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। ক্যারাভানটার মধ্য থেকে ঘন ধূসর ধোঁয়া বেরিয়ে আসছিল। বোধহয় ওরা রান্নার চুলায় আঁচ ধরিয়েছে। কয়লা? না… বোধহয় কাঠের। ভাবলো গ্রেক। সে জানে না হাঙ্গেরির লোকজন ঠিক কী দিয়ে চুলার আঁচ ধরায়। অবশ্য জানতে চায়ও না। সে ক্যারাভানের দরজায় টোকা দিল। খালি গায়ে একটা লোক এসে দরজা খুললো। লোকটা ব্লন্ড, দাড়িগোঁফ আছে, চওড়া গড়ন। মুখটা অনেকটা ওলন্দাজদের মত। শুধু নাকটা অদ্ভুতধরণের সরু আর চোখের মণি গাঢ় রঙের।

‘কী ব্যাপার?’- জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

গ্রেক অনুভব করলো যে হঠাৎ সে দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। সে জিভ চেটে নিল একবার। হাতের চেটো দিয়ে মুখটা মুছে নিল একবার। তারপর বলল… ‘দোলনা… আমি দুলবো…’

লোকটার দু চোখ প্রথমে একবার কুঁচকে উঠলো, তারপর লোকটা মাথা নাড়লো। লোকটা হাঁ করে তাকিয়ে জিভ বের করলো এক দু বার। লোকটার পেছনে এক মহিলা এসে দাঁড়ালো। পরনে সেমিজ। ঘর্মাক্ত চেহারা। সেমিজের কাঁধের লাল ফিতেগুলো ঘামে ভিজে গেছে। এক হাতে রান্নার কাঠের খুন্তি, আরেক হাতে কোলের বাচ্চাকে ধরে আছে। বাচ্চাটা কেমন যেন অপরিষ্কার। মহিলার গায়ের রঙ ময়লা। সবকিছু দেখে গ্রেকের খুব সুবিধের লোকজন বলে মনে হল না। অদ্ভুত, একটু ভয়ঙ্কর গোছের মনে হতে লাগলো তার। দুলবার ইচ্ছেটাই তেমন আর নেই এখন। কিন্তু লোকটা জিভটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে।

‘এই গরমে… দুপুরে… আচ্ছা, ঠিক আছে’… ক্যারাভানের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল লোকটা। গ্রেক সরে দাঁড়ালো একটু। লোকটার পিছু পিছু কয়েক পা গেল সে নাগরদোলার দিকে।

‘কত দেবো?’ গ্রেক অসহায়ভাবে জিজ্ঞেস করল। লোকটা হয়তো আমাকে পাগল ভাবছে… সে ভাবলো। ঘাম আর গরম সত্যিই তাকে পাগল করে তুলেছে। সে জামার হাতা দিয়ে মুখটা মুছল, তারপর কাঠের মইয়ের সিঁড়িতে পা দিল। লোকটা একটা ব্রেক খুলে দিল, মাঝের একটা দোলনা হাল্কাভাবে আগুপিছু দুলে উঠল।

‘আমার মনে হয়’… লোকটা বলে উঠল… ‘আপনি খুব বেশি উঁচুতে দুলতে চান না। নাহলে আমায় এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। এটাই নিয়ম।’

লোকটার মুখে জার্মান শব্দগুলি কেমন যেন বেমানান ঠেকছিল গ্রেকের কাছে। অদ্ভুত হাল্কা ভঙ্গিতে নরমভাবে জার্মান উচ্চারণ করছে লোকটা, ঠিক যেন জার্মান শব্দ বসিয়ে বসিয়ে একটা বিদেশী ভাষা বলছে।

‘উঁচুতে নয়… না… কত দেবো?’

লোকটা কাঁধ ঝাঁকালো একবার… ‘আমাকে এক পেংগো দেবেন।’

গ্রেক তার হাতের শেষ পেংগোটি দিয়ে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে নাগরদোলায় চড়ে বসলো। নৌকাটা সে যতটা চওড়া ভেবেছিল, এটা তার চেয়েও অনেক বেশি চওড়া। বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করলো সে। একটা কায়দা এদ্দিন ধরে দেখে এসেছে সে, মানুষ নাগরদোলায় উঠে যা করে, অথচ সে নিজে কখনো প্রয়োগ করতে পারেনি। এখন সে সেই কায়দাটা ফলাবার চেষ্টা করলো। হাতলটা চেপে ধরলো প্রথমে, তারপর আঙুলগুলো আলগা দিয়ে আরেকবার ঘাম মুছে নিল, তারপর হাঁটু ভাঁজ করে সামনে নিয়ে এসে পেছনের দিকে একটা ধাক্কা দিল, যাতে নৌকাটা দুলে ওঠে আপনা থেকেই। নৌকাটা দুলে উঠল। সে আশ্চর্য হয়ে গেল। খুব সহজ ব্যাপারটা। দুলবার যে ছন্দ, তা যেন কোনোমতেই ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দোলনাটা সামনের দিকে গেলে হাঁটু ভাঁজ করে একটু পেছনের দিকে হেলে যেতে হবে, আবার নৌকাটা পেছনের দিকে দিকে গেলে একটু সামনে ঝুঁকতে হবে। কী সুন্দর এবং সহজ ব্যাপারটা। গ্রেক লক্ষ্য করলো যে লোকটা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দোলনার বাইরে। …

‘কী হয়েছে? কী হয়েছে? শান্ত হয়ে বসুন।’ লোকটা চেঁচিয়ে উঠল। লোকটা মাথা ঝাঁকালো। গ্রেক লোকটার কথায় একদম পাত্তা দিচ্ছিল না। সে হঠাৎ জেনেছে যে জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অর্থাৎ নৌকাদোলনায় চড়া থেকে সে এতদিন বঞ্চিত ছিল। ব্যাপারটা অসাধারণ। তার কপালের ঘাম শুকিয়ে গিয়েছে। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লেগে শুকিয়ে গেছে তার সারা শরীরের ঘাম। তার তরতাজা লাগছে। খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রত্যেকটা দোলায় খুশি হয়ে উঠছে সে। তাছাড়া দুনিয়াটাই যেন বদলে গেছে। প্রথমে মনে হয়েছিল যে কতগুলো বিশ্রী নোংরা গর্তওয়ালা কাঠের তক্তা, কিন্তু সেটায় বসে বসেই সে যেন আকাশ ছুঁতে পারছে।

‘সাবধানে!’ নিচ থেকে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল… ‘ধরে বসুন।’ গ্রেক টের পেল যে লোকটা ব্রেক লাগিয়ে দিচ্ছে। একটা হাল্কা ধাক্কা যেটা ধীরে ধীরে দুলুনিটা কমিয়ে দিচ্ছে।

‘আরেকটু থাকবো আমি’… গ্রেক চেঁচিয়ে উঠলো। কিন্তু লোকটা মাথা নাড়ছে। গ্রেক তাড়াতাড়ি উপর দিকে দোলা দিলো তার দোলনাটা। কী অসাধারণ ব্যাপার… মাটির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে থাকা, যখন দোলনাটা পেছনের দিকে যায়। নোংরা কাঠের তক্তাগুলো দেখতে পাওয়া মানে মাটির দিকে যাওয়া… আবার একটু পরেই আকাশের দিকে উজিয়ে ওঠা। দোলনায় বসে সে দেখতে পেল যে তার বাঁয়ে সেই মহিলা এখনও অ্যাপ্রিকট গুছিয়ে তুলে রাখছে। স্তুপটা কমছেই না। তার ডানদিকে সেই মোটা ব্লন্‌ড লোকটা যে তাকে দোলা দিতে বারণ করছে। তার চোখে পড়ল যে নিচে কতগুলো মুরগির ছানা চড়ে বেড়াচ্ছে। পেছন দিকে রাস্তা। তার মাথার টুপিটা হাওয়ায় উড়ে গেল।

অস্বীকার করা, সবকিছু অস্বীকার করা… এটাই একমাত্র উপায়। চারপাশে কেউ বিশ্বাস করবে না, যে আমি এভাবে অস্বীকার করি। কেউ ভাবতেও পারবে না। আমার একটা সামাজিক পরিচিতি আছে। যদিও অনেকেই আমাকে সেভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, কারণ আমি অসুস্থ… আমার সেই পেটের ব্যথাটা, পুরনো অসুখ আছে একটা… তবুও সবাই নিজের নিজের মত আমাকে পছন্দ করে, এবং কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি এত অদ্ভুত ভাবনা পুষে রাখতে পারি… সে ভাবছিল। সে একইসঙ্গে গর্ববোধ করছিল এবং ভয় পাচ্ছিল। সে ভাবছিল যে একটা অসাধারণ ব্যাপার হয়েছে আজ। অবশেষে সে সাহস করে নৌকাদোলনায় দুলতে পেরেছে। সে এই ব্যাপারটা মা’কে চিঠিতে লিখবে। লিখবে? না, দরকার নেই। মা বুঝবে না। সবসময় নিজের মর্যাদা বজায় রেখে গম্ভীরভাবে থাকা… এটাই মায়ের মূলমন্ত্র। মায়ের কোনো ধারণা নেই যে তার পুত্র ওবারলেফটেন্যান্ট ডঃ গ্রেক হাঙ্গেরির একটা নোংরা বাজারের মাঝে দুপুর রোদ্দুরে নৌকাদোলনায় দুলতে পারে। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখেছে… ছি, ছি করেছে… মাথা নেড়ে মা বলবেন এই কথা। চোখ বুজে সে দেখতে পেল মায়ের অসন্তুষ্ট মাথা নাড়া। না, এই বেরসিক ভদ্রমহিলার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। তাছাড়া আরেকটা কথা… এটাও সে ভুলতে চায়… ঈশ্বরের দোহাই, ভুলতে চায় সে… ওই ইহুদী দর্জির দোকানের পেছনের ঘরে পোশাক বদলানোর ব্যাপারটা। যদিও সে চায় নি, ভুলতে চেয়েছিল ব্যাপারটা… অস্বীকার করতে চায় সে… অপরিসর নোংরা ঘরে চারদিকে ছাঁট কাপড় ছড়ানো, অসমাপ্ত স্যুট-প্যান্ট ঝুলছে… তার উপরে বিশাল একটা বাটিতে শশার স্যালাড রাখা, তার উপরে মাছি ভনভন করছে… বিশ্রী একটা অবস্থা। মনে হচ্ছিল তার মুখে কে যেন জল ঢেলে দিচ্ছে, স্যাঁতসেঁতে একটা ঘর। তার মধ্যে সে উপরের ট্রাউজারটা খুলেছিল। নিচে দ্বিতীয় আরেকটা পরা ছিল, কারণ ওটা বেচেই দুটো পয়সা… ভুলে যেতে চায় সে সব কিছু। ফোকলা বুড়ো দর্জিটা অদ্ভুত হাসছিল। দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে সেখান থেকে। সব দৃশ্য এখন তাকে ঘিরে ঘুরতে লাগলো। ‘থামাও’… চেঁচিয়ে উঠলো সে… ‘থামিয়ে দাও’।



(চলবে)

0 comments: