2

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




















“হয় আমাকে সুরা দাও, নতুবা একলা থাকতে দাও।” সুফি কবি জেলাল-উদ্দিন রুমির এই কথাই জানিয়ে দিচ্ছে সুরা মানুষের ভাবাবেগের সাথে কতটা জড়িয়ে আছে। নিঃসঙ্গের সঙ্গী, নির্বান্ধবের বন্ধু আবার জনসমাবেশে উৎসব। প্রকৃতি যেমন একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে চলে, মানুষের সমাজে প্রতিটা ক্ষেত্রেও রয়েছে শৃঙ্খলতা। কিন্তু ভাবাবেগ শৃঙ্খলমুক্ত। মানুষের জীবন সঙ্ঘবদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতার, তাই তাকে কিছু বিধিনিধির মধ্যে দিয়েই চলতে হয়। জীবনের সাথে একটা ধর্ম গড়ে ওঠে, ব্যকরণ তাকে সুষ্ঠুভাবে জীবনপ্রবাহে নিয়ে যায় – সে সাহিত্যের ভাষাই হোক আর সুরাপানের আসরই হোক।

সুরারসিকেরা প্রকৃতির আবহাওয়াকে মান্য করে। তাই একদিকে গরমের তাপদাহ শেষে ঝরে পড়া বৃষ্টির তারে তারে সে যখন মালহারের ঝংকার তোলে অথবা হেমন্তের হলুদ পাতা অলস হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে শীতকে আহ্বান করে মানুষের তৃষ্ণা যায় বেড়ে। সঙ্গীহীন অথবা জমাটি আসরে সুরা হয়ে ওঠে বিশেষ সাথী। কবি বোদলেয়ার বলছেন, মাতাল হতেই হবে, হয় নৈতিক উৎকর্ষে বা কবিতায়, নয়তো সুরায়। ঘরে বসে নির্জনে নিঃসঙ্গতার সাথী যখন সুরা তখন সুরাপায়ীই সব নিয়মের শাসনকর্তা কিন্তু পানের আসরে কিছু শিষ্টাচার মানাটাই সামাজিক রীতি।

শীতের নিস্তব্ধতায় বরফ পড়ার আওয়াজও শোনা যায় আর বড়দিনের উৎসব অথবা নববর্ষের প্রাক-সন্ধ্যার আসরে মদের গ্লাসে-গ্লাসে ঠোকাঠুকির টুংটাং শব্দ শোনা যাবে না তা তো হয় না। জানেন কি এই মধুর আওয়াজের ইতিহাস? এটা বহুদিনের সংস্কার। আনন্দানুষ্ঠানে অশরীরী আত্মাকে তাড়ানোর জন্যে এই সুর তোলা হয় বলে কেউ বিশ্বাস করে আবার কেউ মনে করে ঠোকাঠুকির ফলে এক গ্লাস থেকে মদ ছলকে অন্য গ্লাসে দিয়ে প্রমাণ করা যে পানীয়তে বিষ মেশানো নেই। আসলে কিন্তু এই প্রথা চালু হওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য কারণ। সাধারণত পার্টিতে মদ্যপান শুরুর আগে কোন ব্যক্তির বা কিছুর স্বাস্থ্যকামনা করা হয় এবং তাতে পঞ্চেন্দ্রিয়র শ্রবণ ছাড়া বাকি চারটে ইন্দ্রিয় স্পর্শ, স্বাদ, দৃষ্টি ও গন্ধ সক্রিয় থাকে। সমবেত সুরাপান যেমন সমমনভাবাপন্ন সম্প্রদায়কে জোটবদ্ধ করে আনন্দ দেয়, পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তাই কোন ব্যক্তির আনন্দকে সম্পূর্ণ করতে পারে। তাই মদ পানের জন্য যখন থেকে কাঁচের গ্লাস ব্যবহার শুরু হোল, তখন থেকেই সেই অভাব পুরণ করে টুংটাং আওয়াজও শোনা যেতে লাগল। আগেকার দিনে একটামাত্র পাত্র থেকেই সকলে পান করত এবং সকলে মিলে একটা পোড়া রুটি বা টোস্ট-এর টুকরো তার সাথে খেত। সেই থেকেই সুরাপানের আসরে টোস্ট কথাটা চালু। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার সাথে সুরাপাত্র আলাদা হয়ে যায়, টুংটাং শব্দের পিয়ানো বাজে কিন্তু টোস্ট উচ্চারিত হলেও খাওয়া হয় না।

পার্টিতে যাবার আগে পানের কিছু শিষ্টাচার জেনে রাখা ভাল। সুরা পানের কাঁচের গ্লাস একটা গোল চাকতির ওপর সরু ডাঁটি আর তার ওপরে চোঙা আকারের গ্লাস, নীচের দিকে অথবা মাঝ বরাবর কিছুটা স্ফীত। মনে রাখতে হবে মদের গ্লাস ঠোকাঠুকি হবে ডাঁটির ওপরে যেখানে গ্লাসটা স্ফীত এবং কখনই ওপরে মুখের কাছে নয় কারণ ওই জায়গাটা সবচেয়ে পাতলা, কাঁচ ভেঙে যেতে পারে। টেবিল থেকে ডাঁটি ধরে গ্লাস তুলে পানের সময় স্ফীত জায়গাটা ধরতে হবে। গ্লাসে অর্ধেক পানীয় ভরা হয়, সুরাকে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার অবসর দেওয়ার জন্যে। পান করার আগে গ্লাসের সুরা একটু হেলিয়ে নাকের কাছে এনে সুরার ঘ্রাণ নেওয়াটা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে সুরা পানের আদ্ধেক মজা ঘ্রাণে। আস্তে করে সিপ করে জিভে সুরা নিয়ে খেলিয়ে স্বাদ নিতে হবে এবং সুরাটার গুণাগুণ নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবুন। মুখগহ্বরে আদ্ধেকের বেশি যেন পানীয় না থাকে। কখনই একসাথে অনেকটা সুরা মুখে নিতে নেই। চেষ্টা করতে হবে গ্লাসের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই বারবার সিপ করতে নইলে ঠোঁটের ছাপ অথবা লিপস্টিকের রঙের দাগ নানা জায়গায় লেগে সৌন্দর্যহানী ঘটাবে।

চারটে বিশিষ্টতায় সুরা গুণান্বিত – আঙুরের চরিত্র, উৎপাদন স্থানের আবহাওয়া ও মাটির চরিত্র, ফসল তোলার সময় এবং উৎপাদক। পুরনো চাল ভাতে বাড়ার মতন পুরনো মদ গুণে বাড়ে। তবু উচ্চমানের সুরা পরিবেশনের সময় সুরার সঠিক তাপমাত্রা বজায় না রাখলে পুরোটাই মাটি। অত্যধিক ঠাণ্ডা মদের গন্ধ ও স্বাদ দুটোই নষ্ট হয়ে যায়, একটা তেতো স্বাদ জিভে লাগে আবার গরম বা উষ্ণ মদও বিস্বাদ এবং বেশি সুরাসিক হয়ে যায়। পরিবেশনের সময় লাল মদের তাপমাত্রা ১৮০ সেলসিয়াস হওয়া বাঞ্ছনীয়। সাদা বা গোলাপী মদ পানের তিন ঘন্টা আগে তিরিশ মিনিট রেফ্রিজারেশনের পর বের করে নিতে হবে। শ্যাম্পেনের ক্ষেত্রে অবশ্য একঘন্টা আগে বের করলেই চলবে। আর যদি একান্তই খাবার পর ডেসার্ট হিসেবে হালকা রঙের চিলড সুরা নিতে চান তবে পানের আগে ৫ থেকে ১০ মিনিট এবং শ্যাম্পেন ১০ থেকে ২০ মিনিট ফ্রিজে রাখতে পারেন। বোতল একরাতেই শেষ করাটাই নিয়ম, পরে স্বাদ ও গন্ধের হানি ঘটে।

ধীরে বৎস, ধীরে। কেলেঙ্কারির আসল জায়গাটাই তো পেরিয়ে গেছি। তার আগে বরং সুরা তৈরির সুরটা তুলে ধরা যাক। তার জন্যে ঘুরতে হবে সুরা-সরণির ইতিহাসের অলিতে-গলিতে আর ভূবিজ্ঞানের মাঠে-পাহাড়ে। পরে আবার কেলেঙ্কারি সমেত ফিরব।

বেশ কয়েক বছর আগে ইতালির রোম শহরে সারাদিন ঘোরাঘুরির শেষে ক্লান্তি ছাড়াতে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে মাঝারি দামের ওয়াইন কিনে রাজকীয় এক হোটেলের ঘরে ফিরছি, একজন বয়স্ক কর্মচারী স্যালুট ঠুকে বোতলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, কিনলেন? দেখি কি কিনলেন। বলে বোতলটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, আপনি ওয়াইন চেনেন? রেগুলার খান? আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, তবে ভাল লাগে, মাঝে মাঝে খাই। তবে আপনি যে চেনা বলছেন তা জানি না।

ওয়াইনের প্রথম স্বাদ নিই যৌবনের শুরুতে গোয়ায়, বিখ্যাত পোর্ট ওয়াইনের। তখন কোয়ার্টার লিটারের পাউচ পাওয়া যেত, জিনসের হিপ পকেটে আরামসে নিয়ে ঘোরা যেত। তারপর মাঝেমধ্যে বন্ধুদের বাড়িতে ওয়াইন খাওয়া হোত বিশেষ করে বিদেশ থেকে কেউ নিয়ে এলে। তখনই জেনেছিলাম, ড্রাই, হাফ ড্রাই কথাগুলো এবং পানের সময় ও পরে তাদের চরিত্র। কর্ক খোলার পর ওয়াইন আবার রেখে খাওয়া নীতিবিরুদ্ধ, এক রাতেই শেষ করে ফেলা হোত। আমার অনুমতি নিয়ে কর্মচারীটি বোতলের কর্ক খুলে শুঁকে হেসে বললেন, এই দামে খুব ভাল পেয়েছেন, এনজয়। আমি বললাম, কি করে বুঝলেন? উনি বললেন, ইতালিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মদের জন্য দ্রাক্ষার চাষ প্রধানত দু জায়গায় হয় – সিসিলি আর টুস্কান। আপনার এটা টুস্কানের, ভাল স্বাদ। ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে এসে অল্প অল্প করে জিভে নিয়ে স্বাদ গন্ধ বোঝার চেষ্টা করলাম।

মদ শব্দটা যে-কোন অ্যালকোহলিক বা সুরাসার পানীয়ের জন্যে বাংলায় ব্যবহার হলেও, যেমন দেশী মদ, বিলিতি মদ, বিয়ার, হুইস্কি, ব্রান্ডি ইত্যাদি, মদ-মদ্য-মদিরা আসলে ওয়াইনের বঙ্গরূপ। এর সমার্থবোধক শব্দ হল সুরা। এক বিশেষ ধরণের দ্রাক্ষা ওয়াইটিস ওয়াইনিফেরা (Vitis vinifera sub sp. sylvetris) নিঃসারিত সুরাসার তরল পানীয়কে লাতিন ভাষায় বলা হয় ওয়াইনাম (vinum) যার থেকে ইংরেজিতে ওয়াইন (wine)। ইংরেজিতে অবশ্য ভাইন (vine) মানে আঙুরগাছ। কোন রকম শর্করা, এনজাইম, অম্ল, জল বা পুষ্টিকর উপাদান না মিশিয়ে আঙুরে সঞ্চিত শর্করাকে ইথানলে পরিবর্তন করা হয় ঈস্টের সহযোগে। এর সাথে মিশে থাকে কার্বনডাইঅক্সাইড। ইথানলই হল সেই সুরাসার যা আঙুরকে মদে রূপান্তর করে। এছাড়া আরও অনেক কিছু থেকেই সুরাসার প্রস্তুত করা হয় যেমন বার্লি, চাল, মল্ট ইত্যাদি কিন্তু একমাত্র আঙুর থেকে যে মদ হয় তারই নাম ওয়াইন। ওয়াইনে অ্যালকোহলের পরিমাণ সর্বাধিক পনেরো শতাংশ।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪১০০ বছর আগে আর্মেনিয়ার Vayots Dzor গুহায় প্রাচীনতম মদ নিষ্কাষন ও পরিশ্রুতের আনুষঙ্গিক পুরা-সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তারও হাজার বছর আগে চিনে মদ পানের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে গ্রীস, রোম প্রভৃতি দেশে উত্তেজক ও নেশার পানীয় বলে মদ্যপান করা হোত। ইতিহাস বলে রোম সাম্রাজ্যের গোড়া থেকেই মদ তৈরির জন্য দ্রাক্ষা চাষের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং খ্রীস্টের জন্মের কয়েক শতক আগে থেকেই রোমের রাস্তায় মাতালদের হুজ্জুতি চোখে পড়ার মত ছিল। সে সময়ে পোড়ামাটির বড় বড় পিপে বানিয়ে তাতে মদ রাখা হোত এবং বাণিজ্যের জন্যে ভিন দেশে পাঠানোও হোত। সেই সময় থেকেই সেখানকার সুরার নামডাক খ্যাতি। মদ সাধারণত দু রঙের হয়, লাল ও সাদা। এছাড়াও গোলাপী রঙের মদও আকর্ষনীয়। কালো রঙের আঙুর থেকে লাল মদ ও সাদা বা হাল্কা পীতাভ সবুজ আঙুর থেকে সাদা মদ তৈরি হয় কিন্তু গোলাপী মদ হোল পরিশ্রুত কালো চামড়ার আঙুর থেকে তৈরি। এ ছাড়াও আপেল, বেরি ফল থেকেও মদ তৈরি হয়ে থাকে। আঙুর থেকে মদ বানানোর আগে ইওরোপে মধুর সাথে জল মিশিয়ে গাঁজিয়ে মদ তৈরি হোত। পরে এশিয়া ও আফ্রিকাতেও এভাবে মদ বানানোর ইতিহাস পাওয়া যায়।

পৃথিবীর অনেকে দেশের ধর্মীয় গ্রন্থ ও পৌরাণিক গল্পে মদের উল্লেখ আছে। বাইবেলের জেনেসিস-এ বিশাল বন্যার পর নোয়াকে তার সন্তানদের সামনে দেখা গেছিল মদ্যপ অবস্থায়। গ্রিক পুরাণে কাল্পনিক নাইকা পাহাড়ে মদ বানানোর জন্য আঙুরখেত আবিষ্কারের উল্লেখ আছে। এর জন্যে আবিষ্কারক ডায়োনিসাসকে সুরা-দেবতা বলা হয়। পারস্য দেশের কাহিনী ও কবিতায় মদ-এর উপস্থিতি হাজার বছরেরও প্রাচীন। একটা গল্পে আছে রাজা জামসিদ তার হারেম থেকে এক নারীকে বের করে দেয়। সে তখন আত্মহত্যার জন্য বিষের সন্ধানে এক পরিত্যক্ত গুদামে ঢুকে একটা বাতিল বোতল পায় যার ভেতর গাঁজলা ধরা আঙুরের রস ছিল। বিষ মনে করে সে পান করে এবং কিছু পরে মাতাল হয়ে রাজার সামনে যায়। সব জেনে রাজা তাকে ফিরিয়ে নেয় এবং আঙুর থেকে মদ বানানোর আদেশ দেয়। উৎসব-অনুষ্ঠানে মদের ব্যবহার মিশরে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। নীল নদের অববাহিকায় আঙুরখেতের প্রমাণ মেলে। তারও আগের প্রস্তর সমাধির গায়ে খোদিত ভাস্কর্য থেকে আঙুর ও মদের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। রক্তের রঙের সাথে মিল থাকায় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লাল মদ ব্যবহার হোত। ফারাওরা মদ না খেলেও তুতানখামুনের সমাধিতে সাদা মদের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। গ্রিসে হোমরের পুরাণে নির্জলা কালো মদ পরিবেশনের ব্যাখ্যা আছে। জরথুস্থ্র ও ইহুদীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক মদ্যপান চালু আছে। মুসলমান ধর্মে মদ্যপান নিষিদ্ধ হলেও অনেক কবি ও খলিফা সমাজে অথবা নিজগৃহে মদ্যপান করতেন এবং এখনও করেন। ফার্সি, উর্দু এবং আরবী কবিতা ও গজলে বহু সুরাসক্ত মুসলমান কবি বিশ্বজয় করেছেন। সাহিত্যের নানা ভাষায় ওয়াইন বা শরাব বা মদ নিয়ে অনেক কবিতা গল্প থাকলেও উর্দুতে গালিব এবং আরও কিছু কবির শায়ের বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে। শরাব, সাকী, চাঁদ, বর্ষা, গোলাপ এদের মধ্যে সম্পর্কটা খুব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

শরাব পিনে দে মসজিদ মে বৈঠকর,
ইয়া ওহ জায়গা বাতা জঁহা খুদা নহী। (গালিব)

পারস্য বণিকের হাত ধরে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ভারতে আঙুর আসে এবং আঙুরের চাষ শুরু হয়। তখন মদ তৈরির কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না তবে আঙুর ও আঙুরের রস খাওয়ার প্রচলন ছিল। সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পা সভ্যতার যুগে মদ নিষ্কাশনের কিছু প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বৈদিক যুগে আর্যদের উত্তেজক পানীয়ের অভ্যাস ছিল এবং বেদ-এ সোম বা সোমরসের উল্লেখ থাকলেও তার কাঁচা মালের কোন নাম মেলে না। সোম মানে চন্দ্র; তাই কি গলিত জ্যোৎস্না থেকে চুঁইয়ে পড়া তরলের নাম সোমরস! অবশ্য পুরাণে হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে ‘সুরা’ নামক পানীয়ের উল্লেখ আছে যা প্রধানত চালের সাথে মধু গাঁজিয়ে তৈরি। বলরাম ও কৃষ্ণ উভয়েরই সুরাসক্তি সুবিদিত তবে কৃষ্ণ শিষ্টাচার মানতেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে চরক-সংহিতায় দ্রাক্ষাসাভার যে বর্ণনা আছে তাতে দেখা যায় পাকা লাল বা কালো আঙুরের সাথে এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা, কালোমরিচ ইত্যাদি মশলা মিশিয়ে গাঁজিয়ে কোহল প্রস্তুত করা হোত। এটা অবশ্য ওষুধ হিসেবেই ব্যবহারের কথা বলা আছে। ওষুধ হিসেবে দ্রাক্ষা নিষ্কাশিত মদের ব্যবহার ন হাজার বছর আগে ককেসাস পর্বতের নিচে কৃষ্ণ সাগরের তীরে জর্জিয়ায় প্রচলিত ছিল বলেও উল্লেখ আছে। সেখান থেকে মধ্য প্রাচ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটস নদীর উপত্যকা ধরে মেসোপটেমিয়া, পার্সিয়ায় (ইরান) ঢুকে পড়ে। ভারতে আঙুর-জাত মদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চানক্যের লেখায়। সেটাকে ‘মধু’ বলেই চেনানো হয়েছে যদিও চানক্য নিজে এই মদ পানকে নিন্দা করেছেন। এর পরবর্তী কালে যে মদ তৈরি হোত তা প্রধানত গম, বার্লি বা মিলেট থেকে, আঙুরের গল্প আর পাওয়া যায় না। পর্তুগিজরা ষোড়শ শতকে যখন গোয়াতে তাদের বসবাস শুরু করে তখন আবার আঙুর-জাত মদ তৈরি হতে শুরু করল এবং সেই থেকে তাকে পোর্ট ওয়াইন বলা হয়ে থাকে। তারা ভিন্ডালু নামে আরেক ধরণের সুরা বানালো। বিখ্যাত পারসিক মদ সিরাজও এখানে শুরু হতে লাগল। ব্রিটিশ পর্যটকরা আকবর, জাহাঙ্গীর, শাজাহানের মত মুঘল সম্রাটদের খুশি করতে প্রথম দিকে দেশ থেকে মদ এনে উপহার দিত এবং পরে সম্রাটদের নির্দিষ্ট বাগানেই আঙুরের খেত বানিয়েছিল যাতে সাদা ও লাল দু ধরণেরই রাজকীয় মদের সরবরাহ সারাবছর বজায় থাকে। কোন রকম বড় শিল্পে না গিয়ে ব্রিটিশ শাষকেরা ভারতে আঙুর থেকে মদ তৈরিটা কুটির শিল্পের ভেতরেই আবদ্ধ রাখে। অবিচ্ছিন্ন যোগানের জন্যে বরামতি, কাশ্মীর এবং সুরাতে যত্ন করে আঙুরের চাষ করা হোত। দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দিতে বিলেত থেকে পিপে ভর্তি মদ জাহাজে করে এনে কোলকাতায় ব্যবসা শুরু করেন। ১৮৮৩ সালে কোলকাতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ভারতীয় মদের সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে প্রচার পায়। কিন্তু তার পরেই আঙুরের খেতে মড়ক লাগে। এরপর মদ শিল্পকে উঠে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট করতে হয়। সারা পৃথিবীতে ইসলাম ছাড়া প্রায় সব ধর্মে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মদের প্রচলন থাকলেও ভারতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামিতে এই শিল্প বার বার বাধা পায়। গত শতকের শেষ ভাগ থেকে আবার আঙুর চাষ ও মদ তৈরির শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে।

মাটি কথা বলে

আঙুরের চরিত্র অনুসারে মদের স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের পরিবর্তন হয়। সুরা রসিকের কাছে সুরার স্বাদ যতটা প্রিয় মদ প্রস্তুতকারীর কাছে ততটাই গুরুত্ব পায় আঙুরের চরিত্র, আর চাষির কাছে আঙুর ফলানোর জন্যে মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠণ ও উপাদান। মদের স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ প্রভৃতি ভৌতিক বৈশিষ্ট্য এবং রসায়ন নিয়ে অনেক গবেষণা পত্র ও বই অনেকদিন ধরে লেখা হলেও কেবলমাত্র ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে গবেষণার বয়স মাত্র অর্ধ-শতাব্দী। সেই হিসেবে ওয়াইন জিওলজি বিষয়টা অতি সাম্প্রতিক কালে উদ্ভূত। আগেরদিনের বইতে বা পত্রে আঙুর খেতের এলাকার ভূবিজ্ঞান নিয়ে কিছু মন্তব্য থাকত বটে কিন্তু সেটা যে যথেষ্ট নয় এবং ভ্রান্ত পথনির্দেশ করে তা অনুভব করেন জেক হ্যানকক (Jake Hancock), জুলিয়ন বেকার (Julian Baker) এবং আরও কিছু ভূবিজ্ঞানী। ফ্রান্স, ইতালি সহ ইওরোপ ও আমেরিকার নানা দ্রাক্ষাখেতের জমি নিয়ে ভূবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা শুরু হয়। তাঁদের মতে আঙুর চাষের ভাল-মন্দ নির্ভর করে মূলত জমির চরিত্র এবং আঞ্চলিক আবহাওয়া। আঙুর গাছ তার ফলের পুষ্টি পায় মাটির ষাট সেন্টিমিটার নিচে থেকে কিন্তু বেশির ভাগ সময় জলীয়বাষ্প গ্রহণের জন্য তাকে অন্তত দু মিটার নিচের জলস্তরের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর খরার সময় জলের স্তর তারও নিচে চলে যায়। মাটির স্তরের পুরুত্ব আঙুর চাষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাথরের ওপর মাটির স্তরের গভীরতা বেশি বা কমের ওপর আঙুরের স্বাদ অনেকাংশে নির্ভর করে। মৃৎবিজ্ঞান এখানে একটা বড় গবেষণার বিষয়। এছাড়াও ভূ-আকৃতি এবং মাটির জল-ধারণের ক্ষমতাও বিশেষ সহায়ক।

মাটির রাসায়নিক চরিত্রের ওপর নির্ভর করে গাছের ঘনত্ব, আঙুরের সাইজ বা আয়তন ও শর্করার পরিমাণ। তবে এটাও সত্যি, মাটি ভাল হলেই যে তার ফসল ভাল হবে অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভাল মদ তৈরির উপযুক্ত আঙুরের ফলন হবে তা নয়। যে সমস্ত মাটিতে আঙুর গাছের ফলন অত্যধিক বেশি সেই গাছের আঙুর সাধারণত হাল্কা রঙের, শর্করার পরিমাণ কম এবং প্রায় স্বাদহীন কারণ মাটির পুষ্টি গাছই বেশি টেনে নেয়, ফল পায় না। এইসব আঙুরকে শুকোনোর জন্য গাছে একটু বেশি সময় রাখতে হয় যাতে স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধের উন্নতি হয়।

অন্যান্য ফসলের উন্নতির জন্য খেতে যথেষ্ট জলের যোগান দিতে হয়, আঙুর চাষের বেলায় তা নয়। কম জলে গাছকে পরিশ্রম করতে হয় তার ফলনকে রক্ষা করার জন্য আর সেটা আঙুরের উৎকৃষ্ট ফলনের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে আঙুরের গায়ের চামড়া টানটান ও চকচকে হয়, শর্করার পরিমাণ যথেষ্ট থাকে আর আয়তনও ভাল হয়। এইসব মিলিত গুণ ভাল মদ তৈরিতে সাহায্য করে। গন্ধের জন্য উপযুক্ত রাসায়নিক যৌগগুলো ঘনীভূত হয়ে সুরভিযুক্ত সুরা হয়। এখানে একটা কথা বলে নিই, ড্রাই ওয়াইন প্রস্তুত করতে শর্করার ঘনত্ব বিশেষ প্রক্রিয়ায় কমিয়ে নেওয়া হয়।

তার মানে জলের জন্য এমন মাটিতে আঙুরের চাষ করতে হবে যেখানে জল দাঁড়ায় না, গড়িয়ে চলে যায় আর গাছকে কষ্ট করে সেই গড়ানে জল থেকে তার চাহিদা পুরণ করতে হয়। অর্থাৎ মাটির চরিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সব জমিতে আঙুর চাষ হয় না কারণ গাছ এবং তার মূলাধার কাণ্ড এমন এক বিশেষ ধরনের যা কেবল বিশেষ মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। তবে মাটিতে অম্ল, ক্ষার এবং লবণের পরিমাণ সামান্য কম-বেশি হলে ক্ষতি নেই। গাছকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে মাটি হতে হবে রন্ধ্রবহুল যাতে জল স্থিতাবস্থায় বেশি সময় না থাকে, সেখানেই শেকড় মাটি আঁকড়ে থাকতে সক্ষম হবে। মাটির চরিত্রের মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হোল বয়ন, গভীরতা, রঙ এবং জৈবিক উপাদান; এছাড়া মাটি-কণার আকার ও আয়তন বা সাইজ, স্তরবিন্যাস, অম্ল ও ক্ষারের আনুপাতিক মিশ্রণ; মাটির ওপরের ভাগ ও নিচের অংশের এবং তলার পাথরের খনিজ পদার্থের উপাদান, ঘনত্ব ও পুরুত্ব। চলতি কথায় পাথর ভাঙতে ভাঙতে বালি, তা গুঁড়িয়ে পলিমাটি আর তারও পরে মাটি। বালি, পলিমাটি ও মাটির বিভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণ মাটির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

বেলেমাটি রন্ধ্রযুক্ত হয় বলে জল দাঁড়াতে পারে না, নিচে বা পাশে চলে যায়। ক্লে মাটির বয়ন খুব সূক্ষ্ম তাই জল সহজে বেরোতে পারে না, একটা জলাধার তৈরি হয়। মাটিতে ক্লে-র পরিমাণ এক-চতুর্থাংশের কম থাকলে আর্দ্রতার অভাব হয় আবার চল্লিশ শতাংশের বেশি হলে মাটি অতিরিক্ত আর্দ্র হয়ে থাকে। আর এই দুয়ের মাঝে অর্থাৎ শতকরা পঁচিশ এবং চল্লিশ ভাগের মধ্যে ক্লে-মিশ্রিত মাটিতে আঙুর চাষের জন্য আদর্শ আর্দ্রতা বজায় থাকে। ক্ষারীয় মাটি থেকে তামা, দস্তা ও লৌহ যৌগ আঙুরগাছ সহজেই শোষণ করে বলে মদোপযুক্ত চাষের জন্য একেবারেই আদর্শ নয় কিন্তু ঈষদম্ল (Ph > 5-7) হলে ক্ষতি নেই আর এই মাটিতে শেকড় শক্তও হয়। তবে বালিমিশ্রিত পলিমাটিতে সবথেকে ভাল আঙুর চাষ হয়। চূনাপাথরের ওপর চূনামাটি কিছু জায়গায় চাষের উপযুক্ত যদি মাটিতে খনিজ পদার্থ যথেষ্ট থাকে। আসল কথা হোল, মাটিতে থাকা খনিজ পদার্থ যদি যথেষ্ট পরিমাণে গাছের শেকড় দিয়ে ঢুকে ফল অবধি পৌঁছয় তবে সেই আঙুর সবচেয়ে সুরাপদেয়।

এবারে দেখা যাক, মাটির স্তরের নিচে পাথর কিভাবে আঙুরের চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে। আগ্নেয়শিলা ব্যাসল্টের ওপরে পাথর-ক্ষয়িত মাটি কালো রঙের হয় তাই সেই মাটির আঙ্গুরও কালো চামড়ার আবার গ্রানিটের ওপরে পাথর-ক্ষয়িত মাটিতে হাল্কা রঙের আঙুর হয়। দুটোর স্বাদ পৃথক হলেও অতি গুণসম্পন্ন। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত আঙুর খেত এই পাথরের মাটিতে হয়। দক্ষিণ জার্মানী, হাঙ্গেরী, এবং কানারি দ্বীপপুঞ্জে ব্যাসাল্টের ওপর কালো মাটিতে আঙুর খেত থেকে উৎপন্ন সুরা উত্তম স্বাদিষ্ট। আবার গ্রানিটের ওপর সাদা মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার করনাস (Cornas) এবং স্টেলেনবশ (Stellenbosch) এলাকার মদ বিখ্যাত। বিশ্ববন্দিত অ্যালসেশিয়ান রিজলিং (Alsatian Riesling) এবং মুস্কাদেত (Muscadet) সুরাও গ্রানিট পাথরের ওপর মাটিতে জন্মানো সাদা আঙুর থেকে তৈরি। অনেকে আবার গ্রানিটের গন্ধও পেয়ে থাকেন সুরায় এবং এই গন্ধ সুরা রসিকদের আমোদিত করে।

পাললিক শিলার মধ্যে সমুদ্রজাত চূনাপাথরের মাটি আঙুর খেতের উপযুক্ত তা আগেই বলা হয়েছে। ইতালির বিশ্ববন্দিত টুস্কানির ও ফ্রান্সের বারগুণ্ডি (Burgundy) আঙুর খেত এই মাটিতে। আসলে এই মাটিতে সামুদ্রিক জীবাশ্ম মিশে থাকে বলে স্বাদ ও পুষ্টিতে পরিপূর্ণ। তবে অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণীয় সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে বলে চক-জাতীয় চূনাপাথরের মাটিতে ফলিত আঙুরের শ্যাম্পেন উৎকৃষ্ট। শ্যাম্পেনে অ্যালকোহলের পরিমাণ ওয়াইনের থেকে বেশি। এরপর যখন ভাল সুরা বা শ্যাম্পেন পান করবেন একবার অন্তত সেইসব প্রাণীদের স্মরণ করবেন যারা আপনার পানীয়কে স্বাদিষ্ট করে আপনাকে আনন্দ দিচ্ছে। মিষ্টি জলের চূনামাটিতেও আঙুরের ফলন ভাল হয়। বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু সুরার নাম চারদোন্যে (Chardonnay), ফ্রান্সের জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক চূনাপাথরের মাটিতে আঙুর খেত। তখন পৃথিবীর স্থলে, জলে অন্তরীক্ষে ডাইনোসরেরা দাপিয়ে বেরাচ্ছে। এই চূনাপাথরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কোয়ার্টারনারির প্রচণ্ড হিমবাহ, পাথর ফাটিয়ে মাটি করেছে। আঙুর ছাড়াও এই মাটিতে আরও নানা ফল হয় যাদের সুবাস এই সুরায় মিশে থাকে। খনিজ পদার্থের ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তনের জন্য কিছু রূপান্তরিত শিলার ওপর পাথর ক্ষয়িত মাটিতেও আঙুর ফলনের চাষ হয়ে থাকে এবং তা থেকে উৎপন্ন মদের বাণিজ্য ভালই হয়।

পাথর ও মাটিতে থাকা কিছু খনিজ পদার্থের উপাদান সুরার গুণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ভূস্তরে বেশিরভাগ খনিজ পদার্থই যৌগিক পদার্থ হিসেবে থাকে। আর দুটো মৌল উপাদান মূখ্য – অক্সিজেন ও সিলিকন যা সমগ্র মৌল উপাদানের যথাক্রমে শতকরা ৪৬ শতাংশ ও ২৮ শতাংশ। শুধু এই দুটো উপাদানের সাথে আরও কিছু মৌল উপাদান যুক্ত হয়ে অনেক সিলিকেট খনিজ পদার্থ হয়। আর এই মূখ্য দুই উপাদানে তৈরি কোয়ার্টজ। যে সমস্ত আগ্নেয়শিলায় আয়রন – ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত সিলিকেট অলিভিন, পাইরক্সিন এবং হর্নব্লেন্ড বেশি থাকে তার রঙ কালো হয় আর মাটিও কালো। ইতালির বহু বিখ্যাত আঙুর খেত এই মাটিতে। অভ্র দু রঙের হয় – সাদা যা মাসকোভাইট নামে পরিচিত আর কালো যাকে বায়োটাইট বলে। অভ্র মাটিতে থাকলে আঙুরের চামড়া খুব উজ্জ্বল ও চকচকে হয়, সুরাতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। পূর্বোল্লেখিত অ্যালসেশিয়ান রিজলিং সুরায় একধরনের বিশেষ ঔজ্জ্বল্যতা এই কারণে দেখা যায়।

আর শুধুমাত্র কার্বন মৌল উপাদানে হয় হীরা এবং গ্রাফাইট। গ্রাফাইট মিশ্রিত মাটির রঙ কালো হয়। স্পেন এবং অস্ট্রিয়ার কিছু জায়গায় গ্রাফাইট মিশ্রিত কালো মাটিতে আঙুরের চাষ হয়। আঙুর খেতের মাটিতে ব্যাপকভাবে সালফার মিশে থাকে যদি তা আগ্নেয়শিলা বা তার থেকে তৈরি পাললিক শিলা এবং তাদের রূপান্তরিত শিলার মাটি হয়। দক্ষিণ ইতালির ভালচার, ভিসুভিয়াস ও এটনার মত নবীন আগ্নেয়গিরির সন্নিহিত সালফার মিশ্রিত মাটিতে আঙুরের দুর্দান্ত খেত আছে।

সিলিকেট ছাড়াও অক্সাইড, সালফেট খনিজ পদার্থও হয়। অক্সাইডের মধ্যে আয়রন অক্সাইড বা হেমাটাইট মিশ্রিত লাল মাটিতে ফলিত আঙুরের থেকে উৎপন্ন মদের রঙও লাল। অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি জায়গায় এই খেত রয়েছে। এছাড়াও ফ্রান্সে বক্সাইট বা অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড মিশ্রিত মাটিতে অতি উৎকৃষ্ট ফলন ও তার মদও সুবিখ্যাত। পশ্চিম কলোরাডো এবং স্পেনে জিপসাম (সালফেট) মাটিতে ভাল আঙুরের চাষ হয়। কার্বোনেট যৌগের খনিজ ক্যালসাইট চূনাপাথরের এবং চূনামাটির প্রধান অঙ্গ। এই মাটিতে ফলন এবং তদ্ভূত সুরার কথা আগেই বলা হয়েছে। শুধুমাত্র চূনামাটি বা চূনাপাথরের মাটির জল ধারণের ক্ষমতা কম। সেক্ষেত্রে অনেক জায়গায় মাটিতে মন্টমরিলোনাইট মিশ্রিত মাটি মেশানো হয় কারণ এই ক্লে খনিজের জল শোষণের ক্ষমতা ভাল, তাই জল ধরে রাখে মাটিতে যা আঙুর ফলনের উপযুক্ত। আসলে ফ্রান্সের বারগুণ্ডির কিছু খেতে এই ধরনের চাষের জন্য উৎকৃষ্ট আঙুর উৎপাদন বেড়ে গেছে। আর একটা ক্লে খনিজ কেওলিনাইট মাটিতে আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই খনিজ পদার্থ আসে আগ্নেয়শিলার অন্যতম প্রধান খনিজ পদার্থ ফেলডসপারে রাসায়নিক ক্ষয় থেকে। কিছু গ্রানিটে গোলাপী ফেলডসপার থাকে; এই মাটি থেকে আঙুরের সুরার রঙ মায়াময় গোলাপী।

আঙুর খেতের ফলনের উৎকৃষ্ট সম্পূর্ণ নির্ভর করে জমির মাটি ও আবহাওয়ার ওপর। জমির মাটি কী উপাদান দিয়ে তৈরি, তার আর্দ্রতা কত, কোন পাথরের ওপর মাটি হয়েছে, সেই পাথরের চরিত্র, পাথরের খনিজ পদার্থ ও তার মূল যৌগিক উপাদান ইত্যাদি জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা জানতে গেলে ভূবিজ্ঞানের এবং ভূবিজ্ঞানীর সাহায্যের একান্ত প্রয়োজন। কোন জমিতে কোন উপাদানের ঘাটতি থাকলে সেই উপাদান নিকটবর্তী কোন জায়গা থেকে পাওয়া যাবে, কতটা মেশাতে হবে এসব ভূবিজ্ঞানীরাই বলতে পারে। মদ পানীয়কে আরও উন্নত, পৌষ্টিক, স্বাদিষ্ট করে তুলতে হয় সুরা শিল্প ও বাণিজ্যের খাতিরে।

ভারতে মদ-শিল্পের অবস্থান

ভূবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সব বিখ্যাত আঙুর খেতে উৎকৃষ্ট ফলন শুরু হলেও ভারতে এখনও তেমন গবেষণা হয় না। সেই প্রাচীন পদ্ধতিতে আবহাওয়া, বৃষ্টি ও ভূ-আকৃতির ওপর নির্ভর করে আঙুর চাষ করা হয়ে থাকে। তবে এটাও সত্যি, ভারতের এই সুবিশাল জমির বেশিরভাগ আঙুর ফলনের উপযুক্ত নয়। ভূ-পৃষ্ঠের পাথর, মাটি, ভূ-গর্ভস্থ জল, এবং জলবায়ুর এত বৈচিত্র অল্প এলাকার মধ্যেই যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চাষ সম্ভব নয়। ভারতীয় উপদ্বীপের সমুদ্র সংলগ্ন এলাকায় প্রবল বর্ষা, বাকি বিশাল মধ্যবর্তী অঞ্চলে ভয়াভহ গরম। মাত্র দু-তিন মাস ঠাণ্ডা থাকে। আর হিমালয়ের তরাই অঞ্চল ঠিকঠাক থাকলেও ওপরের দিকে প্রবল ঠাণ্ডা এবং বরফ জমা। প্রবল গরম আর অত্যধিক আর্দ্রতার জন্য মধ্য ও পশ্চিম ভারতে আঙুর চাষ সম্ভব হয় না তবু উপদ্বীপের পশ্চিমে যে সমস্ত পাহাড় আছে তার ঢালু জমিতে আঙুরের উপযুক্ত চাষের জায়গা বেছে নিয়ে কয়েকটা বড় খেত করা হয়েছে। এই জমিতে যেমন জল দাঁড়ায় না তেমনি পাহাড় ঠাণ্ডা হাওয়া ও দমকা বাতাস থেকে গাছকে রক্ষা করে। সাধারণত সমুদ্রতল থেকে দুশো এবং এক হাজার মিটার উচ্চতার মধ্যে এবং আট থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে আঙুর খেত করা হয়। এসব অঞ্চলে ঘোর বর্ষায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাষট্টি থেকে দেড়শো সেন্টিমিটার। প্রধান আঙুর ফলনের খেত আছে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং তেলেঙ্গানায়। মহারাষ্ট্রের নাসিক ভারতের ওয়াইন ক্যাপিটাল। নাসিক ছাড়াও বরামতি, পুণে, সাংলি ও সোলাপুরে আঙুরের খেত আছে। ফেব্রুয়ারি মাসেই আঙুর তুলে ফেলা হয়। এছাড়া দাক্ষিণাত্যের তামিলনাড়ু ও উত্তরে পাঞ্জাবেও আঙুর খেত আছে। তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের জমিতে সাধারণত বছরে দুবার ফলন হয় । গরম ও আর্দ্রতার দরুন ছত্রাকের উপদ্রব থেকে বাঁচাতে বাঁশের মাচার ওপর গাছকে তুলে দেওয়া হয় যাতে আঙুরগুলো মাটি থেকে অনেক ওপরে থাকে। প্রায় তিন লক্ষ একর জমিতে দেশী আঙুরের পাশাপাশি বিদেশী আঙুরের চাষও হয়। তবে সব আঙুরই যে মদ তৈরিতে কাজে লাগে তা নয়। মদ তৈরির উপযুক্ত ভারতে বিখ্যাত কিছু আঙুর খেত আছে মহারাষ্ট্রের নাসিক (সুলা এবং যাম্পা), নারায়নগাঁও, আক্লুজ (ফ্রাতেলি) এলাকায়, কর্নাটকের নন্দী পাহাড় (গ্রোভার) এবং মধ্যপ্রদেশের দিনদোরিতে।

সারা পৃথিবীতে সাড়ে সাত মিলিয়ন হেক্টর বা সাড়ে আঠেরো মিলিয়ন একর জমিতে আঙুরের চাষ করা হয়। ২০১৫ সালের হিসেব অনুসার ঐ বছরে ২৭৫.৭ মিলিয়ন হেক্টোলিটার মদ উৎপন্ন হয়েছে এবং ২৪০ মিলিয়ন হেক্টোলিটার মদ পানের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। উৎপাদনের হার ও চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় প্রতি বছরে দুই শতাংশের বেশি। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও আমেরিকা উৎপাদন তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। সেই তুলনায় ভারতে উৎপাদন ও ব্যবহারের মাত্রা নগন্য।

পৃথিবীর তিনটে বিখ্যাত আঙুর খেতের অবস্থান হোল ফ্রান্সের বারগুণ্ডিতে, ইতালির সিসিলি ও টুস্কানিতে। বারগুণ্ডির মাটি সিলিকা, চূনাপাথর ও ক্লে মিশ্রিত যা আঙুরের পক্ষে অতি পুষ্টিকর। সিসিলির মাটি ক্ষয়িত আগ্নেয়শিলা থেকে তৈরি বলে খনিজ উপাদানে ভরপুর এবং অতি সুস্বাদু। টুস্কানিতে মাটির চরিত্র বিচিত্র, কোথাও কোথাও ক্লের সাথে বালি বিভিন্ন আনুপাতিক হারে মিশ্রিত, কোথাও পাথুরে মাটি, যার জন্যে আঙুরের চরিত্রেও বৈচিত্র। এই তিনটে খেতের আঙুরের মদ পৃথিবীর সবচেয়ে দামী। মনে পড়ে গেল আমায় সেই হোটেলের কর্মচারী বলেছিনেন, ওয়াইনটা টুস্কানির। না, হয়ত আসল জায়গার নয়, অন্তত দামে মালুম হোল। তবু ওখানকার লোকেরা জায়গার নামেই জিনিসের গুণাগুণ ও মাহাত্ম বিচার করে। একেই বলে নাম-মাহাত্ম।

আঙুর থেকে উৎপাদিত ওয়াইন বা মদ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উন্নত মানের আঙুর ফলন অবশ্যই প্রয়োজন আর উন্নত মানের আঙুর তৈরি করতে উপযুক্ত মাটি দরকার। ভারতে অবিলম্বে এই বিষয়ে গবেষণার দরকার যদি এই শিল্পকে বাঁচাতে ও বাড়াতে হয়। আর কে না জানে শিল্প বাড়লেই শিল্পকর্মীর চাহিদা বাড়বে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। দেশের আর্থিক উন্নতিও হবে। যেহেতু ওয়াইনে অ্যালকোহলের মাত্রা কম তাই অতিরিক্ত নেশাগ্রস্থ হয়ে শরীর খারাপ করার সভাবনা কম। আর এই পানীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে পুষ্টিকরও বটে যদি সঠিক মাত্রা মেপে পান করা যায়।

পৃথিবীর সবকটা বিখ্যাত আঙুর খেতে বড় সাইন বোর্ডে লেখা থাকে ওই জায়গার ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, পাথরের নাম ও ভূতাত্ত্বিক বয়স, মাটির চরিত্র, মাটির বয়স, প্রধান খনিজ পদার্থের নাম, জীবাশ্ম মিশে থাকলে তার নাম ইত্যাদি নানা তথ্য যা পাঠ করলে আঙুরের গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। কথায় বলে, বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলেন পরিচয়তে। তেমনই, সুরা তোমার নাম কি? দ্রাক্ষাই মদের পরিচয় আর দ্রাক্ষার পরিচয় তার জন্ম-মাটি। ওয়াইন টেস্টার সেই মাটির গন্ধও পেয়ে থাকে যা গুণাগুণ নির্ণয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এবার থেকে বোতলের গায়ে পড়ে নেবেন ওয়াইনের বৈশিষ্ট্য।

শেষের কথা

এবারে সেই থমকে দেওয়া কেলেঙ্কারির গল্প বলে চমকে দেওয়া যাক।

পার্টিতে মদের বোতলের কর্কের ছিপি খুলতে গিয়ে বেইজ্জতি হতে হয়নি এরকম পাকা খেলোয়াড় খুব কমই আছে। শক্ত টেবিলে বোতল রেখে ঘাড়খানা মুঠোয় ধরে মুখ থেকে ফয়েলটা সরিয়ে ভাল করে মুছে পেঁচানো কর্কস্ক্রুটা ছিপির মাঝখানে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢোকাতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে যেন ছিপির পুরোটা ভেদ না করে। এরপর আবার খুবই আস্তে উল্টোদিকে হালকা ঘুরিয়ে টান দিলেই ছিপি বেরিয়ে আসবে। এরপর আবার বোতলের মুখ মুছে বোতলের নীচের দিকে ধরে পানীয় ঢালতে হবে। যদি কর্কের গুঁড়ো পড়ে যায় ভেতরে তবে ছেঁকে নেওয়াই ভাল আর যদি কর্কটা ভেতরে কিছুটা ঢুকে যায় তখন বের করার বৃথা চেষ্টা না করে বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়াই ভাল। তবে ওই স্ক্রু বা অন্য কিছু দিয়ে কর্কটাকে ধরে রাখলে ঢালতে সুবিধে। কর্ক আস্ত বের হয়ে থাকলে পরে বন্ধ করার জন্য ব্যবহার করাই যায়। ঢালার সময় গ্লাসের তলাটা ধরে থাকতে হবে। নিজের গ্লাসে সবশেষে ঢালাটাই শোভনীয়। সুরাপান নৈশাহারের আগে, চলাকালীন ও পরে করা যায়।

পার্টিতে টোস্টের কথা আগেই বলা হয়েছে। প্রাক-নৈশাহার টোস্ট হলে খাওয়া শুরুর আগে আহ্বায়ক সকলের মনোযোগের জন্য দাঁড়িয়ে গ্লাস তুলবে এবং অতিথিরা অবশ্য বসেই থাকতে পারেন অথবা ভদ্রতার খাতিরে তাঁকে অনুসরণ করবেন। সেইসময় টোস্টের ‘স্বাস্থ্যপানের’ উদ্দেশ্যটা বলা হয়। আহ্বায়ক নিজে যদি বাড়িতে পার্টি দেন তবে টোস্ট লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে করতে হয় অথবা কম অতিথি থাকলে খাবার টেবিলে বসেই করা যায়। আহ্বায়ক যখন অন্যের বাড়িতে টোস্ট দেন তবে সেটা ভোজনের শেষপাদে ফল-মিষ্টান্ন পরিবেশনের আগে করতে হয়। পার্টি রেস্তোঁরাতে হলে চেয়ারে বসে প্রাথমিক গল্পগুজব শেষ করে তারপর বলুন সুরার বোতল এনে আপনাদের সামনে খুলতে কিন্তু বোতল থেকে প্রথম ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগটা নিমন্ত্রণকর্তা বা সুরারসিককে দিন। ভাল হোটেলে আপনার অনুমতি নিয়েই তবে ওয়াইন পছন্দ ও বোতল খোলার প্রথা চালু আছে। সুরা ভাল লাগলে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে মনে মনে সুরা, মাটি, জীবাশ্ম, উৎপাদক, ও নিমন্ত্রণকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

সুরা পানের সাথে সুরা-সম্পর্কীয় একটা গল্প করা যাক। দ্রাক্ষাখেত বিষিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের জুলুমবাজির একটা ইতিহাস আছে। ফ্রান্সের বারগুণ্ডি খেতের রোমানী-কোন্টি ভূবনবিখ্যাত দামী লাক্সারি সুরা। এক বোতলের দাম আটশো থেকে হাজার ডলার। সেই খেতকে বিষিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে লেখা চিঠি পায় তার মালিক ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে। সেই চিঠির সাথে খেতের একটা নকশা ছিল যেখানে দেখা যাচ্ছে আংশিক খেত তখনই বিষাক্ত করা হয়ে গেছে। বাকিটা বাঁচাতে গেলে ১২৭ লক্ষ ডলার দিতে হবে বলে হুমকিও দেওয়া আছে চিঠিতে। স্যুটকেসে টাকা ভরে রাতে এক কবরখানায় কবে আসতে হবে তাও বলে দেওয়া আছে। পুলিশের সহযোগিতায় শেষরক্ষা হয় এবং আদায়কারী ধরা পড়ে। সে নাকি তার এক প্রাক্তন সহ-জেলবন্দীর আদেশমত এই কাজ করেছিল। এ ধরনের গল্প সুরার আমেজকে বাড়াতে সাহায্য করে।

কোন মদের সাথে কী ধরনের আমিষ খাবার চলে সে নিয়েও মতভেদ আছে। কারোর মতে সাদা সুরার সাথে মাছ, মুরগি, পর্ক চললেও লাল মদের সাথে বিফ অবশ্যই ফেভারিট, আরও ভাল স্টেক। যারা চিজ সহকারে পান করতে পছন্দ করেন তাদের জন্যে বলি, চিজের গন্ধ ভাল সুরার গন্ধ ও স্বাদ নষ্ট করে দেয়। তবে লাল মদের সাথে চলতে পারে। সেরকম কোন বিধি নেই তবে খানা পছন্দ যে-যার নিজের। নিমন্ত্রণকর্তার বাড়িতে খাবার বা পানীয়ের গুণমান নিয়ে বিতর্ক অশোভনীয়। অপছন্দের কিছু থাকলে খাবেন না।

সুরার সাথে রোমান্স গানে সাহিত্যে কবিতায় অনেক যেমন আছে তেমনই রোমাঞ্চকর কিছু গল্পও আছে, আর এটা দিয়ে শেষ করব।

হার্ডি রডেনস্টক নামে এক বিখ্যাত জার্মান সঙ্গীত জগতের ব্যক্তির শখ হোল পুরনো সামগ্রী সংগ্রহ করে বিক্রি করা। তার সংগ্রহে আসে ১৭৮৭ সালের চারটে পার্সিয়ান মদের বোতল যা আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্টের সেলারে পাওয়া যায় বলে সে দাবী করে। গত শতকের আশির দশকের শেষে উইলিয়াম কোষ নামে এক ধনপতিকে পাঁচ লক্ষ ডলারে ওই চারটে বোতল বিক্রি করে। প্রতিটি বোতলের গায়ে “Th.J,” খোদাই করা যার থেকে অনুমান করা হয় বোতলগুলো থমাস জেফারসনের। থমাস সুরা বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন ফরাসী সুরার বিস্তারিত বিবরণ তিনি লিখে রাখতেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে তিনি সেরা ফরাসী সুরা পাঠাতেন। কোষ ওই চারটে বোতল বস্টনে মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস-এ প্রদর্শনীর জন্য পাঠালে সন্দেহের বীজ জন্মায়। অনুসন্ধানে থমাসের লেখনী থেকে জানা যায় যে ওয়াশিংটনকে ওই চারটে বোতল বিক্রি করা হয় নি। তাহলে কি হার্ডি কোষকে ঠকিয়েছে?

তদন্ত শুরু হয়, এফবিআই-এর সাথে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও যোগ দেয়। মদের বয়স নির্ধারনের জন্য ফরাসী ভৌত-বিজ্ঞানী ফিলিপ হুবার্টকে নিয়োগ করা হয়। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ সিজিয়াম-১৩৭ বর্তমানে পৃথিবীর সব কিছুতে মিশে থাকলেও ১৯৪৫ সালে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের আগে এর অস্তিত্ব ছিল না। হুবার্ট পরীক্ষা করে জানালেন মদটিতে এই তেজস্ক্রিয় পদার্থটি নেই অর্থাৎ ১৯৪৫-এর আগের। তাহলে কত পুরনো? এবারে বোতল পরীক্ষা করা হোল। থমাসের নামের আদ্যক্ষর “Th.J,” পরীক্ষা করে দেখা গেল যে ওটা দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইলেকট্রিকের যন্ত্র দিয়ে কাঁচের বোতলের ওপর খোদাই করা হয়েছে। কোষকে ঠকানোর জন্যে আদালত হার্ডিকে ১২০ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলে।

আসর জমে উঠেছে। সুরা আপনার শীতকে, শীতের উৎসবগুলোকে আরও আনন্দময় প্রাণময় রঙিন করে তুলুক এই কামনাই করি।

2 comments:

  1. খুব ভালো তথ্যবহুল, উপভোগ্য লেখা। "পরিবেশনের সময় লাল মদের তাপমাত্রা ১৮০ সেলসিয়াস হওয়া বাঞ্ছনীয়।" এই জায়গাটা একটু দেখে নিলে ভাল হয়।

    ReplyDelete
  2. আসুন শীত পড়েছে৷ একটু সসেজ নিদেন আলু পোড়া নিন। তারপর স্বর্গীয় মদের ফেনা আর আপনি।

    ReplyDelete