3

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয় 



মহা অষ্টমী। প্রকাশিত হলো ঋতবাক ২য় বর্ষ, ১৫তম সংখ্যা। বাঙ্গলার প্রাণের উৎসবে বাঙ্গালী মাতোয়ারা। এই তো দু-দিন আগেই, পঞ্চমীর দিন শোনা গেলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্গা দেখতে গিয়ে উপচে পড়া ভীড়, হতাহত, শহর জুড়ে বিশৃঙ্খলা। তবুও বাঙ্গালী নিজস্ব ছন্দে। এতো সত্বেও কিন্তু বলতেই হবে উৎসব পালনের রীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আজকাল শহুরে বাঙ্গালী পুজোর এই তিন-চার দিন যেন একটু বেশীই অন্তর্মখী। ভীড়ভাট্টার বাইরে নিজস্ব বৃত্তে স্বেচ্ছাবন্দী। নিভৃতে, একেবারে একান্ত অন্তরঙ্গ পরিমণ্ডলে টানা তিন-চার দিন একাধারে অবসর যাপন ও নাগরিক ক্লান্তি অপনোদনের এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করছেন না অনেকেই। যাই হোক, যে যেমন ভাবে সুখে-শান্তিতে থাকে, তাকে সেই ভাবে থাকতে দেওয়াই ভালো। সকলেই নিজের মতন করে আনন্দে থাকুক, এটাই কাম্য। 

ওদিকে আশু প্রকাশিতব্য ঋতবাক সংকলনের খবরও তো বেশ ভালোই। আর দিন কয়েকের মধ্যেই মুদ্রিত সংস্করণের নির্বাচিত লেখা-সহ বেশ কিছু নতুন লেখা চললো মুদ্রকের ঘরে। প্রকাশিত আরো অনেক লেখাই হয়তো নেওয়া যেতো, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিরোধ যে চিরকালীন!! 

এদিকে ঋতবাক-এর এবারের সংখ্যায় বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ আকর্ষণ এই সংখ্যার ধারাবাহিকগুলি। প্রতিটিই এখন টান টান চমকের চরম মুহূর্তে। প্রাচীন কথা বিভাগে শুরু হলো কৃষ্ণদেব রায়-এর নতুন ধারাবাহিক ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন’, শিরোনামেই বিষয়বস্তু সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করা যায়। আর সৌরেন চট্টোপাধ্যায়-এর ‘উত্তরাপথের পথে’ তো চমকের পর চমক দিয়ে এখন একেবারে উত্তেজনার উত্তুঙ্গে! এবারের স্মৃতির সরণী বিভাগে রয়েছে প্রায় তিরিশ বছর আগে দেখা হিমালয়ের স্মৃতি, লিখছেন শীলা পাল। নিয়মিত বাকি বিভাগগুলিও আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতায় সমৃদ্ধ। 

ঋতবাক-এর পক্ষ থেকে সুধী সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের জন্য রইলো শারদীয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাহচর্যই ঋতবাক-এর একমাত্র পাথেয়। 

নিরন্তর শুভ কামনা

সুস্মিতা বসু সিং



3 comments:

4

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ স্বপন দেব

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



বাঙালির দুর্গাপূজা কি নিজেদের পূর্বপুরুষ হত্যার উৎসব?
স্বপন দেব 


বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজা-----অনেকদিন ধরেই কিছু হিন্দু মৌলবাদী, বুদ্ধিজীবী আর বেশ কিছু শিক্ষিত বাঙালি এই প্রচারটা চালিয়ে আজ এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যে শুধু দুই বাংলায় নয়, বিশ্বে যেখানেই বাঙালিদের একটা কমিউনিটি গড়ে উঠেছে, সেখানেই সাড়ম্বরে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। ইদানীং আবার রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের অংশগ্রহণে এবং কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় এখন এটা একটা মাত্রা ছাড়া হুজুগে পরিণত হয়েছে।

বাঙালির প্রায় অর্ধেক অ-হিন্দু। পশ্চিমবাংলাতেও সব বাঙালি হিন্দু নয়। এছাড়া অনেক বাঙালিই এখন যুক্তিবাদী, নিরীশ্বরবাদী এবং নাস্তিক। তাই দুর্গা পূজা কিছুতেই সামগ্রিকভাবে সমস্ত বাঙালির নয়। বরং বলা যেতে পারে কিছু আত্মবিস্মৃত হিন্দু বাঙালির পুজো। হঠাৎ এই প্রসঙ্গে, বাঙালির আত্মবিস্মরণের কথা আনলাম কেন ? আনলাম, কারণ ধর্ম ও সাংস্কৃতিকইতিহাসের গবেষণা আজ আমাদের অনেক নতুন তথ্য জানাচ্ছে। প্রাকবৈদিক ধর্ম ছিল দেবী প্রধান। নারীকে সৃজনী শক্তির আধার ভেবে উর্বরতামূলক যাদুবিশ্বাসে দেবী পূজার শুরু। বৈদিক ধর্মে কিন্তু নারী পূজিতা ছিলেননা কোনদিনই। এঁরা ছিলেন পুরুষ দেবতাদের সঙ্গিনী। ঋগ্বেদে দুর্গা নেই। দুর্গা পৌরাণিক। প্রাকবৈদিক ও বৈদিক ধর্ম সংশ্লেষে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তির চরম পর্যায়ে দুর্গার আমদানি করেন বৈদিকরা। সংশ্লেষের শুরু প্রাকবৈদিক বিষ্ণুকে ঋগবেদে অন্তর্ভুক্ত করে বৈদিক ছাপ দিয়ে। নামটা বৃষ্ণি থেকে বিষ্ণু। এরপরে শিবকে বৈদিক রুদ্রের সঙ্গে সমীকরণ করা হয়। রুদ্রও ঋগবেদে নবীন, শেষের দিকের। চরম পর্যায়ে প্রাকবৈদিক দেবীদের বৈদিকরা স্বীকৃতি দিতে থাকেন নাম, রূপ, কর্ম, ইত্যাদি নিজেদের ছক মতন পরিবর্তন করে করে সমীকরণ করে। ততদিনে ঋগবেদের অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, মিত্র, বরুণ, পর্জন্য পিছু হটে গেছে। এই অভাব পূরণে এলেন প্রাকবৈদিক দেবীরা। কারণ, জয় করতে হবে অজেয়, অগম্যভূমি, নারীপূজক পূর্ব ভারতকে। দ্বারবঙ্গ থেকে কিরাতভূমি হল বঙ্গভূমি। চলছে বৈদিক তথা হিন্দুভক্ত গুপ্তযুগের শাসন। তখন এ অঞ্চলে সমাজের সঙ্গে ধর্ম সম্পৃক্ত, জ্যোতিষে আক্রান্ত। ব্যক্তি সমাজবদ্ধ, ধর্মভীরু। আর্থসামাজিক ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া প্রবল নাস্তিক্যবাদ। তখনই দুর্গা ও তাঁর সঙ্গে সমীকরণ করে বহু দেবীর আগমন ঘটলো পুরাণে। বাসন্তী, চণ্ডী, পার্বতী, গৌরী, মহালক্ষ্মী, কালী, বিন্ধ্যবাসিনী, ইত্যাদি। আরও পরে মনসা, শীতলা, পর্ণশবরী, চণ্ডিকা, বাশুলী, ইত্যাদি এলো মঙ্গলকাব্য যুগে। এই চণ্ডীর সঙ্গে দুর্গাকে সমীকরণ করা হয়েছিল পুরাণে। মঙ্গলকাব্যযুগ একদিকে বৈদিক ও প্রাকবৈদিক সংশ্লেষের শেষ পর্যায়; যেখানে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এবং হিন্দু মুসলিম সংশ্লেষ শুরুর পর্যায়; যা যুক্তসাধনা। এইসময়েই এল ওলাবিবি, বনবিবি, কালুপীর, ধর্মগাজন, সত্যপীর, ইত্যাদি। এই সত্যপীর শেষে হল সত্যনারায়ণ। এইভাবে, ধর্মীয় সংশ্লেষের চরম পর্যায়টি হয় এই বঙ্গভূমিতেই। তখনও বঙ্গভূমি প্রাকবৈদিক ধর্ম ও নাস্তিক্যবাদে সমৃদ্ধ। মূলস্রোত নাস্তিক্যবাদ। বঙ্গের সাংস্কৃতিক মান ও ভাষাজ্ঞান দক্ষিণ এশিয়ায় সু-উন্নত ও সমৃদ্ধ। হিন্দুকুশ পেরনোর পরে প্রায় দীর্ঘ দেড় হাজার বছরে বৈদিকরা এই বঙ্গে দাঁত ফোটাতে পারেননি। বরং বঙ্গসংস্কৃতিকে এক শ্রেণীর বৈদিক শ্রদ্ধা করতেন। বাকি বৈদিকরা বঙ্গের শক্তিকে সমীহও করতেন, আবার ঘৃণাও করতেন। বৈদিক সাহিত্যে এর উদাহরণ প্রচুর। বৈদিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গুলিতে পারস্পরিক বিরোধিতা চরম।

অভিধানমতে, দুর(দুঃখ) গম(গমন করা, জানা) + অ (কর্মবাচ্যে/কারকে) = দুর্গ + আ =দুর্গা। যাঁকে দুঃখে জানা যায়, যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট থেকে ত্রাণ করেন। তন্ত্রমতে, দ‌-এ হসন্ত = দৈত্যনাশ সূচক, উ = বিঘ্ননাশ সূচক, র-এ হসন্ত = রোগনাশ সূচক, গ-এ হসন্ত = পাপঘ্ন বাচক,আ = ভয়বাচক ও শত্রুনাশ বাচক। পুরাণ মতে, দুর্গ নামক অসুর বিনাশকারী হলেন দুর্গা। মহাশক্তি মহামায়া দুর্গা।

নৃতাত্ত্বিক মতে আলপীয়রাই অসুরজাতি। এরাই বাঙালিদের অন্যতম পূর্বপুরুষ। অসুর ছাড়াও বঙ্গভূমে এসে এরা শিব-শিবানী, ষাঁড়-মহিষ পূজাও করতো। ঋগবেদে এদের অসুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ভাষাও মাগধি-প্রাকৃত-অষ্ট্রিকের সঙ্গে সংশ্লেষিত হয়ে বর্তমান বাংলা ভাষায় আছে। বাঙালির বাহন ষাঁড়, মহিষ, বলদ প্রভৃতি।

ষাঁড়-মহিষ নিয়ে এখনও উপজাতিদের মধ্যে বিখ্যাত এবং বহুল প্রচারিত বাঁধনা পরব। বাঙালির আদি দেবতা শিবের বাহন ষাঁড়। অসুরজাতির প্রতীক হিসেবে মহিষাসুরকে, অর্থাৎ ‘মহিষ পালক অসুরজাতি’কে বধের গল্প দিয়ে বৈদিক বেশ্যা “আনা”কে দুর্গা নামে বাঙালির মধ্যে প্রচার করা হয়। উদ্দেশ্য, বৈদিক তথা হিন্দুত্বে বশ্যতা স্বীকার করানো। এটা প্রাকবৈদিক-বৈদিক ধর্ম ও সামাজিক আচার সংশ্লেষের চূড়ান্ত পর্যায়। এর পরে হিন্দু ব্রাহ্মণেরা প্রচার শুরু করে। গোড়ারদিকে উপজাতিদের অসুর হিসেবে চিহ্নিত করে ও দুর্গাকে দুর্গতিনাশক হিসেবে বোঝানো শুরু হয় বাঙালিদের। পরে রাজা জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রমরম করে চলতে থাকে বঙ্গে। বাঙালি মুখস্থ করে নেয়, দুর্গতিনাশক মাতৃত্বের প্রতীক হল দেবী দুর্গা আর অসুর হল অনুন্নত, কদর্য, ঘৃণ্য জীব, যেমন ভাবতেন বৈদিকরা। অর্থাৎ বাঙালি এখন প্রতি দুর্গাপূজায় যে মহিষাসুর কে বধ করায় দেবী দুর্গাকে দিয়ে, সেই মহিষাসুরই কিন্তু বাঙালির পূর্বপুরুষ!!

কথিত আছে, মৈমনসিংহের জনৈক স্থানীয় জমিদার কংস নারায়ণ চৌধুরী এই পূজার প্রচলন করেন। কিন্তু এটা সঠিক নয়। এই পূজা বঙ্গে দশ এগারো শতকে হতো, এর প্রাচীন প্রমাণ আছে। চৌদ্দ শতকে আন্দুলে ও পনেরো শতকে রংপুরে দুর্গা পূজা হয়েছিল। কলকাতায় শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭-তে এ পূজার প্রবর্তক। হুগলির গুপ্তিপাড়ায় প্রথম বারোয়ারী পূজা হয় ১৭৬১ সালে। আর দুর্গাপূজার এই বারোয়ারীকরণের ফলে, যা ছিল একান্তভাবেই রাজা-রাজড়া, জমিদারদের বৈভব দেখানোর উৎসব, তা পরিণত হল আপামর বাঙালির সামাজিক উৎসবে। আর অদৃষ্টের পরিহাস এমনই যে বৈদিক সভ্যতা হিন্দুকুশ পেরনোর ১৫০০ বছর পরেও বঙ্গভূমি জয় করতে পারেনি, আজ তাদেরই এক কল্পিত দেবীর হাতে নিধন হচ্ছে বাঙালির পূর্বপুরুষের। বাঙালির পূর্বপুরুষ মহিষ পালক আলপীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা তাদেরই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচিত হলেন, ঘৃণ্য মহিষাসুর রূপে !! 






4 comments:

4

প্রবন্ধঃ অমৃত অধিকারী

Posted in

প্রবন্ধ



ধর্ম ও উৎসব
অমৃত অধিকারী 



ধর্ম শব্দটা যে religion-এর সমার্থক নয়, সে কথা যাঁরা প্রাচীন ভারতীয় দর্শন বিষয়ে সম্যক অবগত নন, তাঁদের বোঝানো দুষ্কর। Religion-এর আভিধানিক অর্থ a particular system of faith and worship, বা পক্ষান্তরে the belief in and worship of a superhuman controlling power, especially a personal god or gods। অর্থাৎ, ঈশ্বরোপাসনার একটি বিশেষ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী একদল মানুষের গোষ্ঠীগত পরিচয়। শতাব্দ‌-সহস্রাব্দের পথ অতিক্রম করে আসতে আসতে এই বিশেষ পদ্ধতিগুলির মধ্যে খাদ্যাভ্যাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, জাতসংস্কার, বিবাহাদি আরও বহুবিধ লোকাচার ও দেশাচার কিভাবে সন্নিবিষ্ট হয়ে গেছে, তার সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস ধর্মনিরপেক্ষ বা আজকের ধর্মোদাসীন মানুষের আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হাস্যকর হলেও সমাজতাত্ত্বিকের জন্য যথেষ্ট চিত্তগ্রাহী গবেষণার বিষয়। কিন্তু এখানে সে আলোচনার পরিসর নেই। এখানে আমাদের আলোচনা ধর্ম ও তার সংশ্লিষ্ট কিছু উৎসবকে নিয়ে।

ধর্ম বস্তুটা যদি religion না হয়, তাহলে সেটা কি? সারাক্ষণই তো হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রীস্টধর্ম, ইসলামধর্মের কথা শোনা যাচ্ছে চারদিকে। সে তো নিঃসন্দেহে ঈশ্বরোপাসনার ওই বিশেষ পদ্ধতিগুলিরই পরিচায়ক। তাহলে? আসলে সবার আগে যে কথাটা আমাদের বুঝতে হবে, সেটা হলো ‘ধর্ম’ শব্দটার, বা ধারণাটার, যখন উদ্ভব হয়, তখন religion-এর কোনও concept মানুষের ছিলো না। অর্থাৎ, ঈশ্বরবিশ্বাস বা উপাসনার বিশেষ পদ্ধতি যে গোষ্ঠীপরিচয়ের নির্ণায়ক হতে পারে, সেই বোধটাই তখন মানুষের ছিলো না। তাই বৈদিক আর্য সমাজে উদ্ভূত ‘ধর্ম’ ছিলো ‘ঔচিত্যবোধ’ বা sense of correctness-এর সমার্থক। এই ঔচিত্যবোধ আজকের রাজনৈতিক ঔচিত্যবোধ নয়। মানবিক ঔচিত্যবোধ। এবং সেই বোধ নির্দিষ্ট হতো মানুষের সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই ব্রাহ্মণের ধর্মবোধ ক্ষত্রিয়ের ধর্মবোধের থেকে পৃথক ছিলো, বা চর্মকারের ঔচিত্যবোধ পৃথক ছিলো লৌহবণিকের ঔচিত্যবোধের থেকে।

ভারতবর্ষের সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাস বলে, এ দেশের প্রাচীন উৎসবগুলির মধ্যে অধিকাংশেরই ধর্মের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিলো না প্রাথমিক পর্যায়ে। যেমন ভারতবর্ষের দুই জনপ্রিয়তম উৎসব হোলি ও দীপাবলি, দু’টিই লোকাচার সম্ভূত। হোলি বা বসন্তোৎসব ছিলো শীতের শেষে উষ্ণতার আগমনে আনন্দোৎসব। বসন্তকাল যে যৌবনের প্রতীক, সেই যৌবনের উদযাপন। এছাড়াও বসন্তাগমে যে গুটিকারোগ মহামারী হয়ে দেখা দিতো সেযুগে, তার প্রতিষেধক ছিলো ফুল থেকে প্রস্তুত আবীর ও আরও নানা জাতীয় অঙ্গরাগের অবলেপ। শীতের শুরুতে ফসল তোলার সময় দীপাবলি উৎসব পালন করা হতো আগুন জ্বালিয়ে, পাকা ফসলের গন্ধে আকৃষ্ট পশুপাখি, কীটপতঙ্গকে দূরে রাখার জন্য।

এই রকম বহু উৎসব... নবান্ন, সংক্রান্তি, টুসু, ভাদু এবং এই জাতীয় অসংখ্য ‘পরব’ ছিলো মূলত কৃষিপ্রধান প্রাচীন সমাজের লোকায়ত জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এছাড়াও ছিলো পূজা জাতীয় উৎসবগুলি, এবং সেগুলি মূলত ধর্মীয়ই। কিন্তু তবু ধর্মীয় উৎসব বলতে যে religious festival-এর কথা মনে হয়, এর সবগুলি সঠিক অর্থে তা ছিলো না। বৈদিক ধর্মে, যাকে আমরা গ্রীকদের কল্যাণে আজ ‘হিন্দুধর্ম’ (‘সিন্ধু’ শব্দের গ্রীক উচ্চারণ বিভ্রাট) বলে জানি, এবং ভারতীয় লোকসংস্কৃতিতে দেবদেবীর সংখ্যা, বৈচিত্র এবং বৈশিষ্ট বিপুল হওয়ায় এদেশের মানুষের কাছে উপাস্য দেবতাটিকে বেছে নেবার বিকল্প ছিলো প্রতুল। তাই যে যার পছন্দমতন এবং জীবিকানুসারে একেকজন দেব বা দেবীকে বরণ করে নিতো গৃহদেবতা বা কুলদেবতা রূপে। প্রতিদিনের পূজার্চনা ছাড়াও নির্দিষ্ট তিথি অনুসারে সেই দেবতার ব্রত পালন বা পূজা ছিলো কুলাচার। এই নিয়মিত কুলাচারের মাধ্যমে গৃহদেবতাটি একসময়ে গিয়ে হয়ে উঠতেন পরিবারের একজন সদস্য। বাকিদের সঙ্গে ঘরের খাবার ভাগ করে খেতে খেতে, পালা-পার্বনে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নতুন পোষাকে সাজতে সাজতে সংসারের মাযাজালে জড়িয়ে পড়তেন দেবতা। এই আবিলতাকে যদি কেউ ধর্মাচরণ বলতে চান, কারও আপত্তি হবার কথা নয়।

এছাড়াও ছিলো পরবের স্নান, তীর্থযাত্রা, ইত্যাদি... এবং সে সবকে ঘিরে মেলা। রথ, চড়ক, গঙ্গাসাগর বা কেন্দুয়ার মেলাগুলি এই জাতীয়, এবং এদের উদ্দেশ্য যতখানি ধার্মিক, তার চাইতে অনেক বেশি অর্থনৈতিক। আসলে, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে সার্বজনীন উৎসব, পালা, পার্বনের প্রধান উদ্দেশ্য ও উপজীব্য সমাজের একাংশের অর্থনৈতিক পরিপুষ্টি। সেই উৎসব বা পার্বনের সঙ্গে যা যা লোকাচার সংশ্লিষ্ট, তার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারের পুষ্টি তো বটেই, সেই সঙ্গে আরও অন্যান্য পণ্যবস্তু, যেমন খাদ্য, বস্ত্র, তৈজসপত্র, গৃহসজ্জার সামগ্রী, শিশুদের খেলনা, ইত্যাদি সবকিছুর যে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হয় বাজারে, সেই চাহিদা যে কোনও অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর। এছাড়াও আছে উৎসবের সময়ে কর্মীদের ছুটি এবং বাড়তি বেতন।

এই অর্থনৈতিক পরিপুষ্টির হাত ধরেই ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে আমাদের উৎসবগুলি। আজকের দুর্গাপুজো, নবরাত্রি, দোল‌-হোলি, দীপাবলি-কালিপুজো এবং আরও নানা পুজো-পার্বনে বাজার যে ভরে ওঠে, উপচে পড়ে বহুবিধ পণ্যে, ছোটো-বড় নির্বিশেষে বিক্রেতাদের ঘরে মুনাফা ওঠে, সেখানেই এই সব উৎসবের প্রধান সার্থকতা। ধর্ম তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও, এবং ধর্মীয় আচার পালন বহু মানুষের মনে সন্তুষ্টি উৎপাদন করলেও, উৎসবগুলি সর্বার্থে সার্থক হয়ে ওঠে, ভাস্বর হয়ে ওঠে এই আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেই।






4 comments:

1

প্রবন্ধঃ মনোজিৎ কুমার দাস

Posted in


প্রবন্ধ



বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র: কলকাতা বেতারের প্রবাদপ্রতিম অনুষ্ঠান প্রযোজক, ভাষ্যকার ও শিল্পী
মনোজিৎ কুমার দাস





বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র(১৯০৫- ১৯৯১) ছিলেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ। তাঁর পরিচয় দু’এক কথায় তুলে ধরা অসম্ভব। ১৯৩১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেবীপক্ষের শুরু মহালয়ার ভোর ৪টায় আকাশবাণী কলকাতা বেতার থেকে বাণীকুমারের রচিত ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সুললিত কন্ঠের রেকর্ডকৃত সংস্কৃত স্ত্রোত্র পাঠ ও ভাষ্য ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে জেগে উঠেছে আলোক মঞ্জির...’ এর মাধ্যমে শারদীয়া দুর্গা পূজার আগমন বার্তা ঘোষিত হয়। 

১৯৩১ সালের মহালার ভোরে ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ নামে যে অনুষ্ঠানটি প্রথম কলকাতা বেতার থেকে প্রচার হয় তার তিন মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসে তৈরি হয় কালজয়ী ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ গীতি আলেখ্য। বাণীকুমারের রচনা,পঙ্কজ মল্লিকের সুর আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভাষ্য ও চণ্ডীপাঠে ঋদ্ধ এই ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। মহালয়ার এ অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতন শুদ্ধ উচ্চারণে সুললিত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ ও ভাষ্য দিতে পেরেছেন বলে কোন প্রমাণ মেলা ভার। 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্ম ১৯০৫ সালের ৪ আগষ্ট উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায়। পিতা: কালীকৃষ্ণ ভদ্র। মাতা: সরলা দেবী। ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ওই বছরই নব প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বেসরকারী বেতারে যোগদান করেন। ১৯২৭ সালে এর ২৬ আগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। একই সময়ে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মল্লিক ও অনুষ্ঠান প্রযোজক ও অনুষ্ঠান রচয়িতা বাণীকুমার কলকাতা বেতারে যোগদান করেন। 

১৯৩১ সালের চলচ্চিত্রে সবাক যুগের যাত্রা শুরু হয়। তার আগে সিনেমা ছিল নির্বাক, যা বায়স্কোপ নামে পরিচিত ছিল। তারপর এক সময় কলের গান বা গ্রামফোন এলেও তা ছিল মূলত ধনীদের বাড়ির বিনোদনের মাধ্যম। ১৯২৭ সালে এর ২৬ আগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর যে সব অনুষ্ঠান উদ্ভাবকরা বেতারের অনুষ্ঠানকে সুরুচিসম্পন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অন্যতম। 

কলকাতা বেতারে যোগদানের পর থেকেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতারে শ্রুতি নাটক প্রচার শুরু করেন। বেতারের শ্রুতি নাটককে জনপ্রিয় করতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সম্পাদনা ও প্রযোজনায় ‘শাহজাহান’, ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘প্রফুল্ল’, ‘ তাহার নামটি রঞ্জনা’, ‘দুই পুরুষ,’ ‘ বিরিঞ্চবাবা’, ‘রামের সুমতি’ সহ অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়। তিনি তাঁর নিজের প্রযোজিত অসংথ্য বেতার নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি মঞ্চ নাটক লিখেছেন ও নাট্যরূপ দিয়েছেন, কিন্তু মঞ্চে কখনও অভিনয় করেননি। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ প্রযোজিত বেতার নাটকগুলোতে প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, ছবি বিশ্বাস, মলিনা দেবী,সরজুবালা, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখ।

একটা সময় ছিলো যখন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিলো বেতার। প্রতি শুক্রবার রাতে প্রচারিত বেতার নাটক শোনার জন্য অসংখ্য শ্রোতা অধীর আগ্রহে রেডিওর সামনে বসে থাকতেন। শ্রুতি নাটক এত জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চিন্তা, চেতনা, মেধা, মনন, পরিকল্পনা বিশেষ ভাবে কাজ করেছিলো। বেতারে শ্রুতি নাট্যধারার প্রবর্তক ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্রে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উত্তরসূরী জগন্নাথ বসু এক স্মৃতিচারণায় বলেন, “কাজ করতে করতে বীরেনদাকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল রেডিয়ো নাটকের নিজস্ব ভাষা। কেমন করে পাতা ওল্টাতে হবে, যাতে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ না শোনা যায়। সংলাপ বলার সময় চোরা দম কেমন করে নিতে হয়। শুধু কন্ঠস্বর দিয়ে রাগ, দুঃখ, ভালোবাসা, সমস্তই প্রকাশ করতে হয় কেমন করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেমন করে মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে সংলাপ বলতে হয়, সব বীরেনদা আমাদের শিখিয়েছেন। শিক্ষা দেওয়াতে ওঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। কখনও ধমকাতেন, কখনও ভালবাসতেন, কেউ ওঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারতো না।” 

রেডিও অন্ত প্রাণ ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। তিনি কলকাতার আকাশবাণী থেকে প্রচারের জন্য নতুন নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে সেগুলোর বাস্তবায়ন করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিষ্ণুশর্মা ছদ্মনামে ‘মহিলা মজলিস’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন। বিরূপাক্ষ নামে বিরূপাক্ষের আসরে গল্প শোনাতেন কলকাতা বেতার থেকে। তাঁর এ আসর খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ধারাভাষ্যকার হিসাবে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখেন ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর শোক মিছিলের ধারাভাষ্য সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে। জোড়াসাঁকো থেকে নিমতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত পুরো শোকযাত্রার ধারাভাষ্য দেওয়া হয়, এখনও তা আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় বাণীবদ্ধ করে রাখা আছে। সেই ধারাভাষ্যেও শেষ কয়েকটি পঙক্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে, “...ওপারে দূরের ওই নীলকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিলো অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারেও এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হলো এক মহাপ্রাণের পূত পবিত্র শরীর। রবি গেলো অস্তাচলে...।” একথা বলা যায়, আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাভাষ্য দেওয়ার প্রবর্তক ছিলেন তিনি।

আকাশবাণী কলকাতা বেতারের স্টাফ আর্টিস্ট পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলেও তেমন আর্থিক সুবিধা বা সম্মাননা পাননি। ১৯৯১ সালে ৮৬ বছর বয়সে এই প্রবাদ প্রতিম মানুষটি লোকান্তরিত হন। প্রতি বছর দেবী পক্ষের মহালয়ার ভোরের ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ গীতি আলেখ্যে তাঁর কন্ঠের স্ত্রোত্রপাঠ ও ভাষ্যই তাঁকে কালজয়ী করে রাখবে।



1 comments:

1

প্রবন্ধঃ ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


রামায়ণ, রাবণ এবং অস্ত্র-শস্ত্র
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



কথায় বলে রাম-রাবণের যুদ্ধ। অর্থাৎ কিনা ভয়ংকর কিছু। এ হেন যুদ্ধ করতে গিয়ে যে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিলো, কে না জানে! রামায়ণেও আছে অনেক রকমের অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহারের কথা। এমন অস্ত্রের কথাও সেখানে আছে, যা দিয়ে নাকি সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করা যেত। তার মানে অনেক আগেই পরমানু বোমা এসে গেছে হাতের মুঠোয়, এই যুগের আমরা তাকে আবার নিয়ে এসেছি খোল-নলচেটা একটু বদলে দিয়ে। শুধু পরমানু বোমা কেন, পুষ্পক রথ, আগ্নেয়াস্ত্র... এসবই তো রামায়ণ, মহাভারতের যুগের ঘটনা। কিন্তু নতুন রূপে আজও কতখানি প্রাসঙ্গিক! 

রামায়ণের সেইসব ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্রের কথা জানতে গেলে আগে জানতে হবে অস্ত্র আর শস্ত্রের মানেটা কি, তাদের মধ্যে ফারাকটাই বা কি! সাধারণ ভাবে সেই তফাৎ আমরা বুঝি না, কিন্তু তফাৎ আছে।
কাকে বলে অস্ত্র, আর কাকেই বা বলে শস্ত্র?

অস্ত্র হলো ঐশ্বরিক ক্ষমতা, দৈবিক শক্তি যা প্রাপ্ত হত কোনও দেবী অথবা দেবতার কৃপায়, এককথায় যাকে বলে বর। তার ক্ষমতা ছিলো অসীম, শুধু বিপক্ষের মানুষজন কেন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও উড়িয়ে দেওয়া যেত। রামায়ণের আলোচনা করতে গিয়ে রামের কথাই বেশি বলা হয়েছে, বলা হয়ে থাকে। যুগে যুগে দেবতা, মুনি-ঋষি, মানুষের পক্ষপাতিত্ব রামকে ঘিরেই। দেবতাদের কৃপায় রাম অনেক অস্ত্রলাভও করেছিলেন। কিন্তু তপস্যা করেছিলেন আরও অনেকেই, অস্ত্রলাভও করেছিলেন আরও অনেকে। যদিও, অস্ত্রের প্রয়োজন এবং ব্যবহার রামকেই বেশি করতে হয়েছিলো। কারণ রাবণ, মেঘনাদ দুজনেই ছিলেন অসামান্য বীর। যদিও রামের কৃতিত্বকে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে, ইন্দ্রজিৎ বা রাবণ কেউই রামের চেয়ে কোনও অংশে কম বীর ছিলেন না। মেঘনাদের অপর নাম ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রলোক বা দেবলোক জয় করেছিলেন বলে। এই দুই বীরকে পরাস্ত করতে গিয়ে অনেক সময়ই রাম এবং লক্ষ্মণ পরাস্ত, বিপর্যস্ত হয়েছেন, আবার দেবতাদের কৃপায় জীবন ফিরে পেয়েছেন। দেবতাদের কৃপা না থাকলে এই যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতেই পারতো। 

সে যুগে অস্ত্র কেমন ছিলো, একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। রামায়ণের থেকেই উদাহরণ দিই। রামায়ণ মহাভারতের অনেক গল্প-গাথা মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে কখন যে একসময় মূল রচনার মধ্যে স্থান পেয়েছে, আমরা জানি না। এই ঘটনাটিও প্রক্ষিপ্ত কিনা জানা নেই। রামের অস্ত্রের ব্যবহারের ঘটনাটি এইরকম--

একদিন রামচন্দ্র তপোবনে সীতার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে রত, কিছুক্ষণ পর রামচন্দ্র নিদ্রামগ্ন হলে সীতা রামের মস্তক নিজ কোলে ধারণ করে বসে রইলেন। এক বায়স বা কাকপক্ষী, যা কিনা আদতে রাক্ষস বা দুষ্ট ব্যক্তি, বারে বারে সীতার মস্তকে আঘাত করছে। সীতার শরীরে আঘাত লাগলেও সীতা রামের নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে তা সহ্য করছেন। হঠাৎ সীতার মস্তক থেকে রক্তক্ষরণ হলে তা গড়িয়ে পড়লো রামের শরীরে। উষ্ণ রক্তের স্পর্শে রামের নিদ্রাভঙ্গ হলে রাম একমুঠো দূর্বা ঘাস ছিঁড়ে উপরের কাকপক্ষীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। কাকপক্ষীটি নিহত হলো সেই অস্ত্রের প্রয়োগে। রামচন্দ্রের এই মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দূর্বাঘাস উৎক্ষেপণ, যা কিনা এখানে অস্ত্র, সেটি দেবতার নিকট বর পেয়েছিলেন এবং দুষ্ট কাকপক্ষী রূপী রাক্ষসকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন। 

ঘটনাটি যেন মনে করায় অনেক কিছু। সেই যে, পরশুরাম, তাঁর কথা মনে আছে? মহাভারতের কাহিনীতে আছে, কর্ণ তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করতে এলে পরশুরাম অস্বীকৃত হন, কারণ কর্ণ সূতপুত্র, ব্রাহ্মণ সন্তান ছাড়া তিনি আর কাউকে শিক্ষা দেবেন না। কর্ণের মিথ্যা ভাষণে পরশুরাম অস্ত্রশিক্ষা দানে সম্মতি প্রকাশ করলেন। একদিন কর্ণের জানুতে মস্তক রেখে পরশুরাম নিদ্রা যাচ্ছেন, শয়নকালে এক কীট কর্ণের জানুতে দংশন করলো। কর্ণ গুরুর নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে সেই দংশনের কষ্ট সহ্য করে চলেছেন। কীট দংশনের ফলে কর্ণের জানু যখন রুধির প্লাবিত, পরশুরাম কর্ণের সহ্যক্ষমতা দেখে অনুমান করলেন, কর্ণ ক্ষত্রিয় সন্তান। কারণ ক্ষত্রিয় সন্তান ছাড়া আর কারো এত সহ্য ক্ষমতা থাকা সম্ভব নয়। অস্ত্রশিক্ষার জন্য মিথ্যাভাষণ কর্ণর জীবনে অভিসম্পাত এনে দিলো। 

এ তো গেল অস্ত্রের কথা, এবার শস্ত্রের কথায় আসি। শস্ত্র হলো পদার্থ জাতীয়। যেমন গদা,ধনুক, তরবারি ইত্যাদি যা দিয়ে আঘাত করা যায় অন্য একজনের পার্থিব শরীরে। এ যুগের রাইফেল, রিভলভার, সবই ব্যাখ্যা করা যায় শস্ত্র হিসাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে যুগের অস্ত্র কি এখনও কেউ লাভ করেন? দেবতারা কি বর দেন, পাওয়া যায় অভীষ্ট সিদ্ধির অস্ত্র? আর কিছু না থাক, পুরাকালের গুপ্তঘাতকের মতন এ যুগেও সুপারি কিলাররা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের হাতেও যা থাকে, তা শস্ত্র হলেও আমরা তাকে অস্ত্র বলেই জানি। অস্ত্র আর শস্ত্রের তফাত এখন আর নেই। 

অস্ত্রধারণ করেন যিনি তাঁকে বলা হয় অস্ত্রধারী। রামায়ণ মহাভারতে রাম-রাবণের যুদ্ধে এবং কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধে নানান অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিলো। এইসব অস্ত্রের নাম, ব্যবহারের রীতিনীতি, ফলাফল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়, এমনকি অস্ত্রলাভের জন্য দেবতাদের নিকট তপস্যার কথাও। 

রামায়ণে রাম-বন্দনা অনেক হয়েছে, আজ রাবণের কথাই হোক। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণের ব্যবহৃত অস্ত্র, রাবণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রের কথা জানতে গেলে আগে রাবণের জন্ম, লঙ্কায় রাজ্যস্থাপন এবং দেবতাদের কাছে তপস্যার কথা জানতে হবে। এসব নাহলে দেবতার বর, অস্ত্রলাভ হবে কি করে! সুতরাং আগে সংক্ষেপে রাবণের জন্মবৃত্তান্ত। 

বাল্মীকি রামায়ণে বলছেন, রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। পিতা ব্রাহ্মণ ঋষি বিশ্রবা, মাতা দৈত্যকুলের রাজকুমারী কৈকেসি। রাবণের পিতামহ হলেন ব্রহ্মার মানসজাত দশ প্রজাপতির একজন ঋষি পুলস্ত্য, যিনি আবার সপ্তঋষির একজন। অর্থাৎ রাবণের জন্মকৌলীন্য অস্বীকার করার মতন নয়। দৈত্যকুলের রাজা ছিলেন সুমালী, যাঁর কন্যা হলেন রাবণের মাতা কৈকেসি। রাজা সুমালী পণ করেছিলেন কন্যার বিবাহ হবে সর্বাপেক্ষা বীর্যবান পুরুষের সঙ্গে। যার ফলে জন্ম নেবে এক তেজস্বী, বলবান সন্তান, ভবিষ্যতে যিনি হবেন অপরাজেয়। এ হেন পিতার কন্যা কৈকেসি পৃথিবীর সকল রাজাকে অগ্রাহ্য করে স্বামী হিসাবে মনোনীত করলেন স্বর্গের ধনদেবতা কুবেরের পিতা বিশ্রবাকে। 

কুবের ছিলেন রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই যিনি ছিলেন লঙ্কার রাজা। রামায়ণে আমরা রাবণ ছাড়াও পাই রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের কথা, বিভীষণের কথা। কয় ভাই ছিলেন রাজা রাবণ? রাবণের পিতা বিশ্রবার ছিলো ছয় পুত্র, দুই কন্যা। ছয় পুত্র হলেন—রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ,খর, দূষণ, অহিরাবণ এবং দুই ভগিনী সূর্পনখা ও কুম্ভিনী। ভাগবত পুরাণের মতে, বৈকুন্ঠের দ্বারপাল ছিলেন জয় ও বিজয়। পরবর্তীকালে এই দুইজন পৃথিবীতে এসে জন্মগ্রহন করেন রাবণ ও কুম্ভকর্ণ নামে। 

দেবতাদের বরে রাবণ হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় বীর। পরবর্তীকালে দেবতাদের বরে বলীয়ান রাবণের সঙ্গে কুবের যুদ্ধ না করে পিতার কথায় লঙ্কার রাজত্ব দান করেন রাবণকে। রাবণ হয়ে উঠলেন লঙ্কার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, স্বর্ণলঙ্কার অধীশ্বর। কেমন ছিলেন রাজা রাবণ?

রামায়ণে জানা যাচ্ছে, তিনি ছিলেন সুশাসক, সমস্ত লঙ্কায় ছিলো অতুল ঐশ্বর্য্য। সাধারণ নাগরিকের গৃহও ছিলো স্বর্ণ দিয়ে মোড়া। অতুল বৈভবের অধিকারী ছিলেন রাবণ। ছিলেন শিবের ও ব্রহ্মার একনিষ্ঠ ভক্ত। দেবদ্বিজে অত্যন্ত ভক্তি ছিলো রাবণের। অত্যন্ত বিদ্বান। ষড়দর্শন এবং চতুর্বেদ ছিলো তাঁর কন্ঠস্থ। ছিলেন দক্ষ বীণা বাদক, সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ছিলো। এখনও অনেক স্থানে, এমনকি রাজস্থানের প্রত্যন্ত স্থানেও ‘রাবণহাড়া’ নামে একটি বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়, যে বাদ্য যন্ত্রটির সঙ্গে রাবণের নাম জড়িত। যার দ্বারা রাবণের সঙ্গীত প্রীতির কথাই অনুমিত হয়। অর্থাৎ এক কথায় রাবণ ছিলেন একজন গুণসম্পন্ন রাজা। অমরত্ব লাভের জন্য শুরু করেন শিবের নিকট তপস্যা। শিব যতবারই তাঁকে পরীক্ষা করছেন, রাবণ নিজ মস্তক তরবারির আঘাতে কেটে গুরুর পায়ের কাছে ফেলে দিচ্ছেন। প্রতিবারই শিবের কৃপায় রাবণের মস্তক আবার যথাস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এইভাবেই রাবণ দশ মস্তকের অধিকারী হলেন। নাম হলো দশানন। আসল কথা হলো, দশানন বা দশ মস্তকের অধিকারী কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাবণের শক্তি, সামর্থ্যের কথা। সাধারণভাবে আমরা কথায় কথায় বলেই থাকি, দশ জনের মতন শক্তি অর্থাৎ রাবণ ছিলেন একাই দশজন। বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্থ, সামর্থ্য সব দিক দিয়েই রাবণ ছিলেন একাই দশজনের ক্ষমতার অধিকারী। শক্তিশালী অর্থেই কথাটির ব্যবহার। 

জৈন মতে, রাবণ ছিলেন বিদ্যাধর। তাঁর নাম ছিলো দশমুখ। রাবণের মৃত্যু হয়েছিলো রাম নয়, লক্ষ্মণের হাতে। পরবর্তী জীবনে রাবণ তীর্থঙ্কর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। 

শিবের কাছে তপস্যার পর শিব সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে রাবণ অমরত্ব ভিক্ষা করলেন। শিব অমরত্ব দিলেন না, কিন্তু রাবণের নাভির নিচে লুক্কায়িত রইল অমৃত, যার উপস্থিতিতে রাবণ হবেন অপরাজেয়। অমৃত বিনষ্ট না করে রাবণকে বধ করা যাবে না। রাবণ অমরত্ব পেলেন না, কিন্তু অমরত্বের পরিবর্তে লাভ করলেন অনন্ত শক্তি, যাতে দেবকুল, অসুরকুল ইত্যাদি যত কুল আছে, সকলেই তাঁর কাছে পরাজিত হবেন। অবধ্য, অপরাজেয় হবেন রাবণ। আর দিলেন চন্দ্রহাস তরবারি। চন্দ্রকলার মতন তার আকার, কিন্তু অযথা এই শস্ত্রের প্রয়োগে তা কার্যকরী হবে না, ফিরে আসবে দেবতার কাছে। তপস্যায় দেবতাদের নিকটে এই বর লাভ করলেন বটে, কিন্তু মানবকুলের বিরুদ্ধে জয়ের জন্য বর তিনি ভিক্ষা করলেন না। কেন? তার উত্তর জানা নেই। এছাড়াও শিব ও ব্রহ্মা দিলেন অনেক অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি লাভ করবেন সসাগরা পৃথিবীর আধিপত্য। এই সকল অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছিলো রামায়ণের যুদ্ধে। 

এত কথার পরেও কিন্তু বাকি রয়ে গেলো একটি কথা, তা হলো ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদের অপরাজেয় শক্তির কথা। মেঘনাদের নাম ইন্দ্রজিৎ কেন? কারণ তিনি ইন্দ্রলোক জয় করেছিলেন। ইন্দ্রলোক, দেবলোক জয় করা তো সামান্য বীরের কাজ নয়! এ হেন মেঘনাদকে পরাজিত এবং হত্যা করার আগে লক্ষ্মণ ও রাম পরাস্তই হয়েছিলেন তাঁর কাছে। দেবতাদের সহায়তা এবং কৌশল অবলম্বন না করলে সেই যুদ্ধে মেঘনাদকে পরাস্ত করা সহজসাধ্য ছিলো না। অস্ত্র তো লাভ হলো, কিন্তু কি সেই অস্ত্র সকল? কার বিরুদ্ধে কোন অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিলো?

আগেই বলেছি, অস্ত্র হলো দেবতাদের নিকট তপস্যার ফলে অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য বর লাভ করা। সেই বরগুলি হলো কিছু মন্ত্র যার প্রয়োগে ইপ্সিত কার্য সমাধান হয়। আবার এমন কিছু মন্ত্রও আছে, যা উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে হাজির হয় শস্ত্র হিসাবে, কখনও বা সেই শস্ত্রের আঘাতে বিপক্ষের জীবনহানিও হয়ে যায় নিমেষে। আবার কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সেই সকল অস্ত্রের দ্বারা অহেতুক ক্ষতিসাধনও হয়ে থাকে। 

রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে যে সকল অস্ত্র, বিশেষ করে রাম-লক্ষ্মণ, রাবণ, মেঘনাদ এবং কুম্ভকর্ণের পারস্পরিক যুদ্ধে, তার মধ্যে একটি অস্ত্রের কথা প্রায় সকল সময়েই শোনা গেছে, তা হলো ব্রহ্মাস্ত্র। রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধে এই অস্ত্রের নাম শোনেননি এমন কেউ নেই। কিন্তু এই অস্ত্রের ব্যবহার ছিলো একেবারে শেষ পর্যায়ে। মনে হয়, এই অস্ত্র ব্যবহারের কিছু বিধিনিষেধ ছিলো। বিপক্ষকে কোনওভাবেই পরাস্ত করতে না পারলে, বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যু আসন্ন হলে এবং সমগ্র বাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হলে তবেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা হতো। তবে কি এই অস্ত্র ছিলো একালের নিউক্লিয়ার বোমা বা পরমাণু অস্ত্র, যার প্রয়োগ সম্বন্ধে আছে অনেক বিধি নিষেধ!

রামায়ণের কথাই যখন হচ্ছে, মানব অস্ত্রের কথাটি বলি। অস্ত্রটির নামই হলো ‘মানব’, এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হয়েছিলো মারীচকে হত্যার সময়। এটি কি মানব বোমা? নাম শুনে মনে যেন কেমন ধন্দ লাগে।

ছিলো যমাস্ত্র। নাম শুনেই মনে হয় একেবারে ইহলীলা সাঙ্গ করার জন্যই এর ব্যবহার। এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হয়েছিলো বিভীষণের প্রতি, করেছিলেন মেঘনাদ। আগেই বলেছি, দেবতাদের পক্ষপাতিত্ব রামের প্রতি। বিভীষণ সংবাদ এনেছিলেন, মেঘনাদ যজ্ঞে বসেছেন, যজ্ঞ সম্পন্ন হলে তিনি অমরত্ব লাভ করবেন, কেউ আর তাঁকে পরাস্ত করতে পারবেন না। এদিকে, রাম, লক্ষ্মণ মেঘনাদের অস্ত্রপ্রয়োগে যার পর নাই বিপর্যস্ত। লক্ষ্মণকে দুবার এবং রামচন্দ্রকেও একবার পরাস্ত করেছেন ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ। সুতরাং, যজ্ঞ পণ্ড করতে পারলে মেঘনাদকে হত্যা করা যাবে, তিনি আর অমরত্ব লাভ করতে পারবেন না। সেইমতন লক্ষ্মণ ও বিভীষণ সদলবলে মেঘনাদের যজ্ঞক্ষেত্রে হানা দিলেন। তখন বিভীষণের বিরুদ্ধে যমাস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ। 

নাগপাশ অস্ত্র। আমরা জানি, মেঘনাদের কাছে রাম এবং লক্ষ্মণ বারে বারেই পরাস্ত হচ্ছিলেন। নাগপাশ অস্ত্রের ফলে রাম এবং লক্ষ্মণকে সর্পবন্ধনে বেঁধে ফেলেন মেঘনাদ। পরে গরুড়ের দয়ায় তাঁরা মুক্ত হন। বিষ্ণুর বাহন গরুড় না থাকলে সেদিন রাম-লক্ষ্মণ কি মুক্ত হতে পারতেন? সেই দেবতার দয়া। 

শক্তিঅস্ত্র। এটি প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। একপ্রকার মৃত বলেই ঘোষিত হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। হনুমান সঞ্জীবনী এনে দিলে তাঁরা সুস্থ হন, জীবন ফিরে পান। 

এছাড়া সূর্যাস্ত্র, বরুণাস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র, মহেশ্বর, এসবই একা মেঘনাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিলো। এক এক দেবতার এক একরকমের অস্ত্র। তার কার্য্যক্ষমতাও এক এক ধরণের। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় মেঘনাদের বীরত্ব। 

ইন্দ্রজিত এবং রামচন্দ্র ছিলেন একমাত্র ত্রিমূর্তি অস্ত্র বা তিনটি অস্ত্রের অস্ত্রধারী বীর। এই তিনটি অস্ত্র হলো বহ্মাস্ত্র, পাশুপত অস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র ।

এছাড়াও ছিলো গান্ধর্বাস্ত্র, যা বহু সৈন্যকে একসঙ্গে হত্যা করার মতন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ছিলো। রাম এবং রাবণ এই দু’জন শক্তিধর ব্যতিরেকে এই অস্ত্রচালনার ক্ষমতা আর কোন বীরের ছিলো না। কিন্তু রাবণের এই অস্ত্র চালনা করার শিক্ষা থাকলেও অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ার শিক্ষা ছিলো না। 

নানারকম অস্ত্রের কথা বলা হলেও আমাদের সাধারণ কৌতূহল বশতঃ জানার ইচ্ছা থাকে রাবণ কোন অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, শিবের বরে রাবণ অমরত্ব লাভ না করলেও শিব তাঁকে অমৃত দিয়েছিলেন, যা লুক্কায়িত ছিলো রাবণের নাভিতে। বিভীষণ এই কথা রামকে জানালে রামচন্দ্র প্রসাভপন (উচ্চারণ ভুল হতে পারে, Prasavapan) অস্ত্র দিয়ে রাবণের অমৃতকে বায়বীয় পদার্থরূপে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন। পরে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেন। বর্তমানের গবেষককুল নানা মাধ্যম থেকে জানাচ্ছেন, যে ব্রহ্মাস্ত্রই হলো বর্তমান কালের পরমাণু বোমা। তবে কি সর্বগুণসম্পন্ন, দেবতার বরে বলীয়ান দশরথপুত্র রঘুবীর রামচন্দ্রই প্রথম, যিনি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন বিপক্ষের বিরূদ্ধে? আগামীকাল তার উত্তর দেবে। 

আমরা শুধু জানি, রামের হাতে সুশাসক, দক্ষ বীণাবাদক, দেবদ্বিজে ভক্তিসম্পন্ন, দর্শন ও বেদবিদ্যায় পারদর্শী লঙ্কার রাজা রাবণ অবশেষে নিহত হলেন।



1 comments:

2

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in




প্রবন্ধ


বাংলার সমাজে বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব, বিকাশ ও সামাজিক প্রভাব
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



[প্রাক-কথন – ইতিহাসের কৌতুহলী ছাত্র হিসাবে ১৮ ও ১৯ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস আমার বিশেষ আগ্রহের জায়গা। সেই আগ্রহ থেকে বাংলার সামাজিক জীবনে বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব, বিকাশ ও তার প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে চেয়েছি নানা আকর গ্রন্থ ও সেকালের সংবাদপত্রের সংকলিত প্রতিবেদন ঘাঁটাঘাঁটি করে। এই লেখা বাংলার সামাজিক ইতিহাসের কিছু তথ্য মাত্র]

নগরসভ্যতা আর পতিতাবৃত্তি প্রায় সমবয়সী। মধ্যযুগে নগরসভ্যতার অন্যতম ভূষণ ছিলো বারাঙ্গনা পল্লী। বারাঙ্গনা সংসর্গ ছিলো মধ্যযুগীয় পৌরুষ ও আভিজাত্যের প্রতীক। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। আমি বুঝতে চেয়েছি এদেশে আধুনিক নগরসভ্যতার বিকাশের ধারায় বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব ও তার সামাজিক প্রভাব।

আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ হয়েছে, আর এদেশে বারাঙ্গনাবৃত্তির উদ্ভব বৃটিশ শাসনের হাত ধরেই। কলকাতার নগরায়ন শুরু হয় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে। সংবাদপত্র দূরের কথা, ছাপার যন্ত্রের কথাও তখন কল্পনায় ছিলো না। শৈশবের কলকাতায় লোকসংখ্যাই বা কত! ১৭১০ সালে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি যে তিনটি গণ্ডগ্রাম নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন হয়েছিলো, সাকুল্যে তার লোকসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। ১৭৪০-৫০ সময়কালে বাংলার গ্রামে গ্রামে মারাঠা বর্গী হামলার ফলে আতঙ্কিত বহু মানুষ নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় বসবাস শুরু করলো। ব্যবসা-বানিজ্যে ও নানা কারণে কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়তে থাকলো। কলকাতা তার গ্রামীণ রূপ থেকে শহরে পরিণত হলো। ১৭৫২তে হলওয়েল সাহেবের হিসেব মতন কলকাতার লোকসংখ্যা ছিলো চার লক্ষ নয় হাজার।

কলকাতায় বিচারালয় স্থাপনের পর অ্যাটর্নি হয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম হিকি। নভেম্বর ১৭৭৭ থেকে ১৮০৮ পর্যন্ত হিকি কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফেরার পর চার খণ্ডে তাঁর যে স্মৃতিকথা (১৭৪৯-১৮০৯) লিখেছিলেন, সেটি শৈশবের কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত। স্মৃতিকথায় হিকি মিস ডানডাস নামে মহানগরের এক ‘বহুজন পরিচিতা বারাঙ্গনা’র কথা উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে বারাঙ্গনা বৃত্তির সূচনা যে ইংরাজ আমলেই হয়েছিলো, তাতে কোনও সংশয় নেই।

হিকি যে সময়ের কথা বলেছেন, তখন নগর কলকাতার নিতান্তই শৈশবকাল। কলকাতার নগরায়ন সবে ক্ষীণ গতিতে শুরু হয়েছে। কোম্পানীর কাজ-কর্ম চালানোর জন্য ইংরাজ ভাগ্যান্বেষীরা তাদের নতুন উপনিবেশে আসতে শুরু করেছে। কলকাতার সেই শৈশবে ভাগ্যান্বেষণে যে সব ইংরাজরা এসেছিলো, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো ‘অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি’। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, উছৃঙ্খল। তাদের দোসর হলো ইংরাজ শাসনের প্রসাদলোভী বেনিয়ান, মুৎসুদ্দিরা। পালকি আর গোরুর গাড়ির যুগের সেই কলকাতায় দেশীয় খবরের কাগজ তো দূরস্থান, ছাপার অক্ষরেরও উদ্ভাবন হয়নি। কিন্তু বারবণিতা বৃত্তির প্রসার হয়েছিলো ভালোই। ১৭৯৫এ রুশ যুবক হেরাসিম লেবেদফ যখন কলকাতায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম বাংলা থিয়েটারের সূচনা করলেন, তখন সেই নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বারবণিতা পল্লীর মেয়েদের নিয়োগ করেছিলেন। অর্থাৎ, ১৭৯৫এর অনেক আগে থেকেই বারাঙ্গনা পল্লীর অস্তিত্ব ছিলো। আর শুধু কলকাতা নয়, বাংলার সমৃদ্ধ শহরগুলি, যেখানে ইংরাজরা কোর্ট-কাছারি, দপ্তর খুলেছিলো, সেখানেই সন্নিহিত অঞ্চলে বারাঙ্গনা পল্লী গড়ে উঠেছিলো। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা) আত্মচরিত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষ্ণনগরের সমকালীন সামাজিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র লিখেছেন, “...... পূর্বে কৃষ্ণনগরের কেবল আমিনবাজারে পতিতালয় ছিলো, গোয়াড়ীতে গোপ, মালো প্রভৃতি জাতির বাস ছিলো। পরে ইংরেজরা যখন এখানে বিচারালয় ইত্যাদি স্থাপন করেন, তখন গোয়াড়ীর পরিবর্তন হইতে থাকে।’’ কার্তিকেয়চন্দ্র আরো লিখেছেন, “...... বিদেশে পরিবার লইয়া যাইবার প্রথা অপ্রচলিত থাকাতে প্রায় সকল আমলা, উকিল বা মোক্তারের এক একটি উপপত্নী আবশ্যক হইত।সুতরাং তাহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল।” এই কারণেই আমরা দেখি উত্তর কলকাতায় প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত লোকবসতি কেন্দ্রের আশেপাশেই প্রাচীন গণিকাপল্লীগুলির অবস্থান।

১৭৯৩এ কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার গ্রাম-সমাজের কাঠামোটাই ভেঙ্গে দিলো। সূর্যাস্ত আইনের প্যাঁচে বনেদি জমিদাররা নিঃস্ব হলো, আর বেশি রাজস্ব দেবার অঙ্গীকারে নিলামে জমিদারি কিনে ভূমিসম্পর্কহীন এক অর্থলোলুপ মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব হলো। দুর্ণীতিগ্রস্ত, উছৃঙ্খল ইংরেজ আর শিকড়হীন নতুন মধ্যশ্রেণীটির পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নিলো এক কুৎসিত সংস্কৃতি - যাকে আমরা ‘বাবু কালচার’ বলে জেনেছি। গড়ে উঠেছিলো ইংরাজের দালালি করা এক লোভী, দুর্নীতিপরায়ন, অলস নাগরিক সমাজ। আঠেরো শতকের কলকাতা ছিলো এদেশীয় দালাল, মুৎসুদ্দি, বেনিয়াদের কলকাতা আর উনিশ শতকে ‘বাবু’ কলকাতা। আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কলকাতার সেই বাবুসমাজের বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম – “ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিছু বর্ণনা করিব? মুখে, ভ্রুপার্শ্বে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমারেখা। শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে কালোপেড়ে ধুতি। অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনোট করা উড়ানী এবং পায়ে পুরু বাগলস সমন্বিত চিনাবাড়ির জুতা। এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া বুলবুলের লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাফ আখড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া থাকিত।” ইংরেজের শাসন-সহায়ক কদর্য বাবু সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বারাঙ্গনাপল্লীগুলো ফুলে ফেঁপে উঠলো গোটা উনিশ শতক জুড়ে। রক্ষিতা পোষণ, বারাঙ্গনাগমন তখনকার সমাজ শুধু অনুমোদনই করতোনা, এইসব বেলেল্লাপনা ছিলো তাদের মর্যাদার সূচক।

ইংরাজের নতুন ভুমিব্যবস্থা গ্রাম্য সমাজকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিলো। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যেমন চোর ডাকাতের দল সৃষ্টি হয়ে শহরে আশ্রয় নিলো, তেমনই দারিদ্রের তাড়নায় শহরের বারাঙ্গনা পল্লীতে আশ্রয় নিলো মেয়েরা। ১৮৭২সালের সরকারী নথিপত্র থেকে জানা যায় যে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বারবনিতারা অধিকাংশই তাঁতি, তেলি, জেলে, কৈবর্ত, ময়রা, চামার, কামার, কুমোর, যুগী, গয়লা, নাপিত, মালি, বেদে ইত্যাদি (সূত্র – ‘অন্য কলকাতা’ / বিশ্বনাথ জোয়ারদার)। এই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বারবনিতাদের সংখ্যা কি রকম লাফে লাফে বেড়েছিলো, তা জানা যায় এই তথ্য থেকে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮৬৭র ১৬ই সেপ্টেম্বরের হিসাব মতন তিন হাজার মেয়ে এই বৃত্তিতে নিযুক্ত। ১৮৮০ সালের এক হিসাবে শহরে বারবনিতার সংখ্যা ছিলো সাত হাজার আর ১৮৯৩ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিলো ২০,১১৬। (তথ্যসূত্র ‘অন্য কলকাতা’ / বিশ্বনাথ জোয়ারদার )।

‘বাবু কলকাতার’ সেই কদর্য বেলেল্লাপনার ছবি এখন আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। শহরের যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে বারাঙ্গনা পল্লী। সম্ভ্রান্ত এলাকা বা বিদ্যালয়ের পাশেও। বিত্তশালী বাবুদের প্রশ্রয়েই এইসব বারাঙ্গনাপল্লী গজিয়ে উঠেছিলো, তাই প্রশাসনের সাধ্য ছিলো না এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার। এইসব ‘বাবু’দের আদর্শ ছিলো ইংরাজ রাজকর্মচারীরা। শ্রীপান্থ তাঁর ‘কলকাতা’ গ্রন্থে ‘রোটি আউর বেটি’ রচনায় মন্তব্য করেছেন “সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলছে বাবু বিলাস, গুরু-প্রসাদী কৌলীন্য রক্ষা। সতীর আর্তনাদে, বিধবার কান্না আর বারবনিতার কাতর আহ্বানে অষ্টাদশ শতকের কলকাতা প্রেতপুরী। পা যেন লজ্জায় জড়িয়ে আসে সেদিকে বাড়াতে।”

শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরাই নয়, কুলীন ঘরের বহু মেয়েও অবস্থার দুর্বিপাকে আশ্রয় নিতো বারাঙ্গনাপল্লীতে। সরকারী প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছিলো যে বারাঙ্গনাদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দু বিধবাদের বারাঙ্গনা পল্লীতে আশ্রয়। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না হওয়ায় লালসার শিকার বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় ছিলো বারাঙ্গনা পল্লী। সরকারী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো “হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।” সরকারী প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু বিধবারা প্রধানত হুগলী, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা থেকে আসতেন। তরুণী বিধবারা বাবুদের লালসার শিকার হতেন, কেউকেউ গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। তাঁদের আশ্রয় হত বেশ্যালয়ে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি কারণে মা, মেয়ে দুজনেই আশ্রয় নিতো গণিকাপল্লীতে।মুহূর্তের ভুলে অন্তসত্বা নারী আত্মহত্যা না করে বাঁচার উপায় খুঁজেছেন বেশ্যালয়ে আশ্রয় নিয়ে, আবার বহুবিবাহের শিকার নারী প্রেমিকের হাত ধরে কুলত্যাগিনী হয়েছেন, অবশেষে এসে জুটেছেন বারাঙ্গনাপল্লীতে। গবেষক অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত সরকারী দস্তাবেজ উদ্ধার করে লিখেছেন “সরকারী মহাফেজখানা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা কৌতূহলোদ্দীপক। দেখা যায় দশ বছরের নিচে বেশ্যাদের বাড়িতে বেশ কিছু মেয়ে রয়েছে। সরকার এদের কথা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে কিছু করে ওঠা কঠিন।” সেই হিসাব মত, গণিকাপল্লীতে বারাঙ্গনা গর্ভজাত কন্যাসন্তানের সংখ্যা ছিলো ৪০৮ জন। এইসব বারাঙ্গনা কন্যাদের পুনর্বাসন বা সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখনকার সরকার যেমন কিছু করতে পারেনি, তেমনই সমাজ সংস্কারকদেরও কোনও হেলদোল ছিলো, এমন তথ্যও জানা যায় না। তাঁরা নিজেরাই মুক্তির পথ বেছে নিলেন। এবং এই মুক্তির পথ দেখালো থিয়েটার, আর বারাঙ্গনা কন্যাদের থিয়েটারে নিযুক্তির পথ খুলে দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

বাংলা থিয়েটারের সবে শৈশবকাল। ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বর সাধারণ মানুষের জন্য রঙ্গালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ধনকুবের আশুতোষ দেবের(ছাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে থিয়েটার খুললেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁদের থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক লিখে দিতে অনুরোধ করলেন। মধুসূদন সম্মত হলেন, কিন্তু একটি শর্তে, নাটকে স্ত্রী চরিত্রের রূপায়ণ মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সেইসময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিলো। উপদেষ্টা মণ্ডলীতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ। অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় বিদ্যাসাগর বিরোধিতা করলেন থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের। উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের মত মানুষের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে বারাঙ্গনাপল্লী থেকে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন। ১৮৭২এর ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো। সে ছিলো এক যুগান্তকারী ঘটনা। মাইকেল অবশ্য এই দিনটাকে দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯শে জুন ১৮৭৩)।

মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। তাঁদের একটা তাগিদ ছিলো – মুক্তির তাগিদ। থিয়েটারকে তাই তাঁরা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী,কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী প্রভাদেবীরা। বস্তুত, নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিলো। পরবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই।

থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অতএব দেড়শো বছরের ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা বারাঙ্গনা কন্যারা। সে দিনের সমাজ যে তাদের সঙ্গে ছিলো তা নয়। এ ছিলো প্রবল শক্তিধর সমাজের সঙ্গে তাদের অসম লড়াই। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ তাদের অলোয় ফেরার সংগ্রামে সঙ্গ দিয়েছিলেন সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিলো “এই সব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কি করেছো?” পঙ্কজা থেকে মহীয়সী হয়ে ওঠা বারাঙ্গনাকন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অতুল কীর্তি রেখে গেছেন। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় নি, দিতে চায় নি।

কেমন করে সমাজের গভীর অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা এক অসহায়া নারী বিনোদিনী তাঁর তন্ময় সাধনায় দুরূহ সিদ্ধি আয়ত্ব করেছিলেন, স্থায়ী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও নীরবে মঞ্চের অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বঞ্চনার শিকার হয়ে মাত্র তেইশ বছর বয়সে, তা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের ছাব্বিশ বছর পরে, ৪৯ বছর বয়সে, বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। তার আগে এবং পরেও বিনোদিনীর লেখনিচর্চা অব্যাহত ছিলো। প্রকাশ করেছিলেন এবং‘বাসনা’ এবং ‘কনক ও নলিনী’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা কিংবা দুটি কাব্যগ্রন্থের লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী পান নি। বারারাঙ্গনা কুলোদ্ভবা যে! এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, সমাজের মানী লোকেরা, যারা তাঁর অভিনয় দেখার জন্য রাতের পর রাত প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেতেন, তাঁকে ধন্যধন্য করতেন, তাঁরা বিনোদিনীর কন্যাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে দেন নি, বাধা দিয়েছিলেন। বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে। শকুন্তলাকে বাঁচাতে পারেন নি বিনোদিনী, ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

বিনোদিনী পারেন নি। গোলাপসুন্দরী পেরেছিলেন। এক মহতী হৃদয় মানুষের, বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে। তাঁরা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন। এক কন্যার জন্মের পর গোলাপ স্বামী পরিত্যক্তা হন। গোলাপ তখন স্বনামে সুকুমারী দত্ত। মেয়েকে মানুষ করার জন্য গোলাপ থিয়েটারও ছেড়েছিলেন বেশ কয়েক বছর। সুকুমারী কিন্তু থেমে থাকেন নি। গোষ্ঠবিহারী তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুলে। কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। ন্যাশনাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন। ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অর্থকষ্ট সামাল দিতে সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক। নাটকটি অভিনীতও হয়েছিলো। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে। মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্রচুর অর্থব্যয় করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। যদিও মেয়েকে দেখার জন্য তার শ্বশুর গৃহে প্রবেশের অধিকার তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো।

অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষাবিস্তারের কাজে ও দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার কাজে। কৃষ্ণভামিনীরা ইতিহাস নির্মাণ করেন কিন্তু ঐতিহাসিকের সম্মান অর্জন করেন না, এমনই পরিহাস! বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন ‘নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ’। দেড়শো বছর পরে আজকের সমাজ অনেক আলোকপ্রাপ্ত। তথাপি সংশয় জাগে, বিনোদিনীর এই কথাটা কি আজও পুরোপুরি মিথ্যা হতে পেরেছে?



তথ্যসূত্র – ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ / বিনয় ঘোষ, ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’ / অমিত মৈত্র, সুকুমারী দত্তর ‘অপূর্ব সতী’ নাটকের ভুমিকা / ড.বিজিতকুমার দত্ত (নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২, ‘অন্য কলকাতা’ /বিশ্বনাথ জোয়ারদার, ‘কলকাতা’ / শ্রীপান্থ।

2 comments:

1

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

ষষ্ঠ পর্ব



অন্তহীন কাল ধরে কালচক্র ঘুরে চলেছে তার নির্দিষ্ট নিয়মে। জন্ম-মৃত্যু, হর্ষ-বিষাদ, সৃষ্টি-লয়, মিলন-বিরহ কোন কিছুতেই তার অবিরাম গতির এতটুকু ছন্দপতন হয় না। মুহূর্তকাল পরে কি ঘটবে তা সর্বদাই অবিদিত। অনাদি-অনন্ত মহাকাল নির্মোহ হয়েও চির-বহমান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। 

স্থান্বীশ্বরের রাজপুরীর নহবতে বাজেনি প্রহরজ্ঞাপক শানাই-মৃদঙ্গের ঐকতান ধ্বনি, রাজপুরীর প্রতিটি দাসদাসীর শঙ্কিত পদসঞ্চারে অস্বাভাবিক নীরবতা। বহুগুণীসমৃদ্ধ ঐশ্বর্যমণ্ডিত রাজসভাগৃহের প্রতিটি দ্বারে নিশ্ছিদ্র প্রহরা। কোন অমাত্য বা সভাসদের আজ সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। 

সভাকক্ষসংলগ্ন অস্তিকাগারের রাজাসনে যুবরাজকুমার রাজ্যবর্ধন দুই করতলে ললাট স্থাপন করে বিমর্ষচিত্তে বিষাদ-স্খলিত অবস্থায় অধ্যাসীন। কোথায় তাঁর সেই যৌবনতেজোদৃপ্ত ভঙ্গী! সেই হূণত্রাস পরাক্রমী কন্ঠস্বর! অবিশ্রান্ত অশ্রুপাতে তাঁর আকর্ণবিস্তৃত লোচনদ্বয় রক্তজবারাগ, সুগভীর বিষাদে ক্ষণে ক্ষণেই কুমারের কন্ঠ থেকে নির্গত হচ্ছে হতাশার ধ্বনি। রাজভ্রাতা কুমার হর্ষবর্ধন আনায়-মাঝে পতিত হর্ষক্ষের মতই ক্রোধে, ক্ষোভে কক্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অস্থিরভাবে পাদচারণা করছেন। স্থৈর্যের প্রতিমূর্তি মহামন্ত্রী ভণ্ডির প্রশস্ত ললাটে চিন্তার বলিরেখা, প্রবীণ সেনানায়ক সিংহনাদের বিশাল মুখমণ্ডল ও চক্ষুদ্বয় প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ন্যায়।

আজ প্রত্যুষেই কনৌজ থেকে ভগ্নী রাজ্যশ্রীর প্রিয় ভৃত্য সংবাদক কোনওক্রমে গোপনে রাজধানী পরিত্যাগ করে অবিরাম দৌড়ে স্থান্বীশ্বরে এসে পৌঁছেছে সাহায্যের আশায়। সেই ভগ্নদূত এক নিদারুণ দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। সংবাদক রাজসমীপে আনীত হলে সে অবনত মস্তকে দ্বারের একপাশে দঁড়িয়ে অবিরত অশ্রুপাত করতে করতে মালবরাজ কর্তৃক কনৌজ আক্রমণ ও অধিগ্রহণের যে ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়েছে, তা উপস্থিত সকলকেই মর্মাহত ও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।

সপ্তাহকাল আগে মালবরাজ দেবগুপ্ত হঠাৎই নিশীথ-শ্বাপদের মতন রাত্রির অন্ধকারে কনৌজ আক্রমণ করে কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে নিরস্ত্র অবস্থায় নির্মম ভাবে হত্যা করে রাজ্য দখল করেছেন, আর মহারাণী রাজ্যশ্রীকে কোনও গোপন কারাগারে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।

ভণ্ডিদেব কেবল রাজ্যের মহামন্ত্রীই নন, তিনি পুষ্পভূতি বংশের দুই রাজকুমারের মাতুল-পুত্র এবং প্রিয় বয়স্যও বটে। রাজ্যশ্রী তাঁরও অত্যন্ত স্নেহের ভগ্নী। তিনি রাজ্যবর্ধনকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন এই বেদনার কোন সান্ত্বনা নেই। ভণ্ডিই প্রথম নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘‘এখন আর বিলাপে কালহরণ করার সময় নেই, রাজন। আমাদের অতি প্রিয় ভগ্নীস্বামী কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে ওই রাজকুলকলঙ্ক রণনীতি অগ্রাহ্য করে অপ্রস্তুত অবস্থায় হত্যা করেছে, আর দেবীপ্রতিমা ভগ্নীকে কোন এক গোপন কারাগারে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। সম্ভবত দুর্মতি মালবরাজের পরের লক্ষ্য স্থান্বীশ্বর গ্রাস করা। এখন আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রিয়স্বসাকে উদ্ধার ও সেই সঙ্গে ওই পররাজ্যলোভী দুরাচারীর অন্যায়ের প্রতিবিধান করাই আমাদের আশুকর্তব্য। মহান মণ্ডলেশ্বর প্রভুর স্বর্গলোকে প্রয়াণের পর আপনিই এখন আমাদের ধারক ও পালক, আপনি আমাদের আজ্ঞা দিন রাজন।’’

রাজ্য-হর্ষর পিতার মিত্র সেনাপতি সিংহনাদ উঠে দাঁড়ালেন। কুরু সেনাপতি অজেয় মহাবীর ভীষ্মের মতই বীরত্বব্যঞ্জক প্রাচীন অবয়বে শুভ্র শ্মশ্রু-গুম্ফের চামর, বিশাল কবাট-বক্ষে শতেক যুদ্ধের অস্ত্রাঘাতের ব্রণাঙ্ক। সিংহনাদ সিংহনিনাদে বললেন, ‘‘হে পুষ্পভূতিকুমার, আমার এই জীবন পুষ্পভূতি বংশের শৌর্য-সম্মান রক্ষার জন্য উৎসর্গীকৃত, আর তোমরা দুই ভাই আমার এই দুই বাহুর সমান প্রিয়। তুমি তারুণ্যের তেজস্বীতার প্রতীক, বিপুল তোমার প্রজ্ঞা, তুমি নিশ্চয়ই জানো ---

উদ্যমং সাহসং ধৈর্যম্ বুদ্ধিঃ শক্তিঃ পরাক্রমঃ
ষড়তে যত্র বর্তন্তে তত্র দেবঃ সহায়কৃৎ।।

(উদ্যম, সাহস, ধৈর্য, বুদ্ধি, শক্তি এবং পরাক্রম --- এই ছয়টি যেখানে থাকে সেখানে দেবতা সহায়তা করেন।)

যে পথ তোমার পিতা-পিতামহ অনুসরণ করে খ্যাতকীর্তি হয়েছেন, তুমিও সেই স্পৃহণীয় পথ অবলম্বন করে যশঃলক্ষ্মীকে বরণ করো। ধীমান ও শক্তিমান পুরুষ কখনো শোক করে না, যৌবনদৃপ্ত কেশরীর মতন সেই ধূর্ত, ভীরু শৃগাল-সদৃশ শত্রুর উপর সদম্ভে উল্লম্ফন করো; দেবেন্দ্রর কুলিশের মতন তোমার অমোঘ শস্ত্রে পতন হোক তাদের রণদম্ভ। হে রাজন, বিলম্বে ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং শত্রুও শক্তিবৃদ্ধির অবকাশ পায়। সুতরাং উত্তিষ্ঠ, আপন ভূজবলে নিঃশত্রু করো এই আর্যাবর্ত।’’

অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের প্রবল শোকাবেগ সংহত হয়ে এক ভীষণ ক্রোধে সংহত হল। তাঁর জীবনে পরাজয়ের কালিমা লাগেনি আজও, অন্তরাত্মা বীর্যদীপ্ত নবযৌবনের অহংকারে বিদ্রোহ করে উঠল। দেবকুলোদ্ভব ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ পিতার ঔরসে ও বীরপ্রসবিনী জননীর গর্ভে যে তাঁর জন্ম! তার উপর পরম স্নেহের পুত্তলী ভগ্নী এখন চরম বিপদে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যেন শার্দূলের নিদ্রাভঙ্গ হল। অর্ধশয়ান থেকে উঠে বসলেন রাজ্য, বাম উরুর উপর লাফিয়ে উঠল তাঁর দক্ষিণ চরণ; সদ্য হূণ-সমরে আহত ক্ষতস্থানগুলি থেকে রুধিরধারা নির্গত হয়ে শোনিত-সিক্ত করল তার কুন্দশুভ্র অন্তরীয়ক; সমস্ত শরীর জুড়ে এক মহা ক্রোধ আর অলঙ্ঘ্য শপথের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর সুকুমার ব্রজকিশোর রূপ যেন মহাপ্রলয়ের ভয়ংকর-সুন্দর নটরাজ রূপে প্রতিভাত হল।

রাজ্যবর্ধন গাত্রোত্থান করে জীমূতমন্দ্রে বললেন, ‘‘হে তাত, আপনি যথার্থই জ্ঞানী ও বিচক্ষণ; আপনার ভাষণে আমার শোকাচ্ছন্ন মতি জাগ্রত হয়েছে। পরমপূজ্য পিতৃ-মাতৃদেবের আকস্মিক স্বর্গারোহণে আমি ভাই হর্ষের হাতে রাজ্যভার দিয়ে চীর-বল্কল ধারণ করে তপশ্চরণ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু সেই চিন্তা থেকে আমি সম্পূর্ণ নির্গত হয়ে এখনই যুদ্ধযাত্রা করতে চাই, প্রলয় আনবো আমি মালবরাজকুলে। মহামন্ত্রী ভণ্ডি, তুমি যত শীঘ্র সম্ভব আমার শত্রুজয়ী অযুত অশ্বসৈন্যের বাহিনীকে আসন্ন মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করো। এই যুদ্ধে তুমি আমার সঙ্গী হবে। আর আয়ুষ্মন হর্ষ, এই রাজ্য, রাজধানী, রাজকুল, বান্ধব-পরিজন, ও আমাদের ভূজপরিঘে যারা লালিত-পালিত --- এই সব কিছুই আমি তোমার হাতে সমর্পণ করে যাচ্ছি। সৈন্যাধ্যক্ষ তাত সিংহনাদ থাকবেন তোমার ও রাজধানী রক্ষার গুরুদায়িত্বে। মালবের কৃপাণ আমার প্রিয়জনের রক্তে নিবারণ করেছে রাজ্যতৃষ্ণা, পুষ্পভূতি বংশের মর্যাদাকে আঘাত করেছে, --- বাস্তবিকই এ এক নির্মম আঘাত; প্রতিবিধিৎসার এক ভীষণ ক্রোধ আজ আমাকে চালিত করবে। ধ্বনিত হোক প্রয়াণ-পটহ।’’

রাজ্যবর্ধনের ঘোষণা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কুমার হর্ষদেব। একেই তো ভগ্নীপতির নিষ্ঠুর হত্যা ও প্রাণপ্রতিমা ভগ্নীর দুর্দশার সংবাদে ক্রোধে, বেদনায় মন অশান্ত; তার উপর জ্যেষ্ঠভ্রাতার এমন আদেশে হর্ষদেব ম্রিয়মান হয়ে পড়লেন। দাদার পাশে এসে করজোড়ে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলতে লাগলেন, ‘‘আর্য, কি এমন দোষ করেছি আমি যে কুলসম্মান রক্ষার এই যুদ্ধে আপনার সঙ্গলাভ থেকে বঞ্চিত হবো? যদি আপনি এখনও আমাকে বালক এবং রক্ষণীয় ভাবেন, তাহলে আপনার অপরিমেয় শক্তিসম্পন্ন ভূজপঞ্জরই তো রয়েছে রক্ষা করার জন্য। যদি মনে করেন আমি শত্রুর সমকক্ষ হতে সক্ষম নই, তাহলে বলবো, পরীক্ষিত হলাম কোথায়? যদি ভাবেন, পথশ্রম ও যুদ্ধের ক্লেশ আমি সহ্য করতে অপারগ, তাহলে বুঝব, আমি আপনার মতন পুরুষসিংহের ভাই হবার অনুপযুক্ত। আমি তো কখনও আপনার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হইনি! প্রসন্ন হোন দেব, আমাকেও আপনার সঙ্গে যাবার অধিকার দিয়ে কৃতার্থ করুন...’’ বলতে বলতে অগ্রজের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়লেন হর্ষ।

অনুজকে ক্ষিতিতল থেকে সস্নেহে উত্থাপিত করে পাশে বসিয়ে রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘‘ভাই, মালবরাজের মতন হীনচেতা, তুচ্ছ একজন শত্রুর বিরুদ্ধে যদি বিরাট এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে অভিযান করা হয়, তাতে শত্রুর গর্ব-গরিমাই বৃদ্ধি পায় না কি! একটা শশককে ধরার জন্য যদি একপাল সিংহ পশ্চাদ্ধাবন করে, সেটা কি লজ্জাকর ব্যাপার নয়! তা ছাড়া অদূর ভবিষ্যতে তোমার বিক্রম প্রকাশের জন্য তো এই অষ্টাদশ-দ্বীপ-কঙ্কণমালিনী বসুধাই পড়ে রইল। যুগপুরুষ মান্ধাতার মতন দ্বিগ্বিজয়ের জন্য তুমি শত্রুজয়ী অজেয় কার্মুক গ্রহণ করবে; আমার বিশ্বাস একদিন তা পৃথ্বীপতিদের মাঝে দুর্নিবার ধূমকেতুর মতই প্রতীয়মান হবে। আমার অন্তরাত্মা আজ ক্ষোভে, ক্রোধে এক ভীষণ শত্রুঘ্নী ক্ষুধায় দুর্নিবার হয়ে উঠেছে, তার ক্রুদ্ধ গ্রাসটি একান্তই আমার, আমাকে সেটি নিতে দাও ভাই; অগণিত ভ্রাতৃসম প্রজাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে রাজধর্ম পালন করো তুমি।’’

মহামন্ত্রী ভণ্ডির পরিচালনায় অনতিবিলম্বে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অযুত দ্রুতগামী অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনী প্রস্তুত হল, স্কন্ধাবার নির্মানকারীরা উট ও খচ্চরের পৃষ্ঠে ইতিমধ্যেই যাত্রা করেছে; অধিরাজ রাজ্যবর্ধন স্বয়ং সৈন্যাধক্ষের ভূমিকায়।

একদা আর্যাবর্ত তথা উত্তরাপথের অন্যতম ঐশ্বর্যময় ও সমৃদ্ধশালী রাজ্য কান্যকুব্জ এখন যেন এক শ্মশান-নগরী। রাজপথে মানুষ নেই, বানিজ্য-চবুতরের বিপণিগুলির বেশিরভাগই ঝাঁপ খোলা, সেগুলি মালবের সৈন্যদের হাতে যথেচ্ছভাবে লুন্ঠিত হয়েছে। স্থানে স্থানে দগ্ধ জনবস্তি থেকে এখনও কুণ্ডলি আকারে ধুম্রের উদ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যত্রতত্র যুবা-বৃদ্ধ-শিশু-নারী নির্বিশেষে মৃতদেহ পড়ে আছে; হয়তো গৃহস্থে্রা নিজেদের সম্পদ ও সম্মান রক্ষার তাগিদে শত্রু-সৈন্যের কাছে সহজে আত্মসমর্পণ করতে চায়নি, তাদের প্রতিহত করতে গিয়েই দলে দলে মৃত্যুবরণ করেছে। যারা প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে, তারা নগরীর মধ্যেই কোথাও আত্মগোপন করে আছে সুদিনের প্রতীক্ষায়, অথবা চরম দুঃখ নিয়ে পরিত্যাগ করে গিয়েছে আপন জন্মভূমি। কনৌজের পথে ঘাট এখন শুধু মৃতজীবি গৃধ্র, শৃগাল, কুক্কুরের অবাধ বিচরণভূমি। তাদের তীক্ষ্ণ কর্কশধ্বনি একদা জনাকীর্ন নগরীর নিস্তব্ধতা আরও ভয়াবহ করে তুলছে।

প্রায় বিনা আয়াসে কনৌজ দখল করার পর মালবের সৈন্যবাহিনী রাজধানী-নগরীর সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের হত্যা বা বিতাড়িত করে তাদের সম্পদপূর্ণ গৃহগুলি করায়ত্ত করে নিজেদের বাসস্থানে পরিণত করেছে। যে সব নাগরিক বেঁচে আছে, তারা দাস-দাসীর মতন সৈনিকদের সেবা–পরিচর্যা করতে বাধ্য হচ্ছে; রূপবতী কিশোরী ও যুবতীদের নিজেদের ভোগ-লালসা চরিতার্থ করতে হত্যা না করে বন্দিনী করে রেখেছে। মাঝে মাঝে গৃহগুলির উন্মুক্ত গবাক্ষপথে সৈনিকদের নেশাতুর উল্লাসধ্বনির সঙ্গে সেই হতভাগিনীদের আর্তস্বর মিশে যাচ্ছে শত্রু-কবলিত কান্যকুব্জের বিস্তীর্ণ জনপদে।

স্থান্বীশ্বরের দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে কান্যকুব্জ থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে একটি অটবী-অধ্যুষিত নাতিউচ্চ পর্বত-সানুদেশে এসে থামল। শীতকালের অপরাহ্ণ দ্রুত শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে, সামনে দীর্ঘ হিমেল রাত্রি। পথশ্রমে ও উত্তরাপথের তীব্র শীতে সৈনিক ও তাদের বাহন উভয়েই যথেষ্ট অবসন্ন, তাদের কিঞ্চিৎ বিশ্রামের প্রয়োজন। তাছাড়া যুদ্ধের আগে শত্রুর বলাবল ও অবস্থান জানা অত্যন্ত আবশ্যক বিবেচনা করে কুমার রাজ্যবর্ধন মিত্র-অমাত্য ভণ্ডির সঙ্গে পরামর্শ করে সেখানেই শিবির সংস্থাপনের নির্দেশ দিলেন।

ছোট ছোট কয়েকটি টিলা ও সেগুলির মাঝে মাঝে বেশ কিছুটা করে মালভূমি অঞ্চল, নীচে ছোট-বড় গাছের অগভীর অরণ্যানী। ভণ্ডির নির্দেশে অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের জন্য টিলার বেশ কিছুটা উপরে একটি প্রশস্ত মালভূমিতে স্কন্ধাবার নির্মিত হয়েছে, তার শীর্ষদেশে পুষ্পভূতি বংশের ভগবান ভাস্কর-লাঞ্ছিত গৌরবময় নিশান উড্ডীন। সেখানে মাত্র দুই সহস্র সেনা রেখে বাকি বাহিনীকে তুরঙ্গ-নায়েক কুন্তলের দায়িত্বে পর্বতের নীচে ছোট ছোট টিলা ও বনান্তরালে গুপ্ত সেনানিবাসে রাখা হয়েছে।

মহামন্ত্রী ভণ্ডি ও কুমারের চির-রণসঙ্গী বৃহদশ্ববার কুন্তলের সঙ্গে সব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অধিরাজ রাজ্যবর্ধন সন্তুষ্ট চিত্তে স্কন্ধাবারের রাজ-পটাবাসে যুদ্ধকালীন অধিবেশনে বসলেন। সকলে আসন গ্রহণ করলে ভণ্ডি বললেন, ‘‘হে রাজন, কান্যকুব্জ থেকে মালবের রাজধানী অবন্তিকা বহুদূরে। এত দূর থেকে কনৌজ আক্রমণ করতে মালবরাজ দেবগুপ্ত নিশ্চয়ই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেননি, কনৌজ অধিকারের পরিকল্পনাও নিশ্চয়ই দীর্ঘদিন ধরে করা হয়েছিলো।’’ 

‘‘তোমার এমন অনুমানের কারণ?’’

‘‘দেব, সংবাদকের মুখে শুনে বুঝেছি, কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির অন্ধকারে যে ভাবে মালবরাজ দেবগুপ্ত কনৌজ অধিকার করেছেন, তা কূটঘাত ছাড়া কিছু নয়, আর এই যুদ্ধে রাজপুরীর রক্ষকদেরও অবশ্যই উৎকোচে বশীভূত করা হয়েছিলো। ঘরশত্রুর সহায়তা ছাড়া কূটঘাত কখনওই সম্ভব নয়। আপনি তো জানেন, যে কোনও রাজ্যজয়ের জন্য উপযুক্ত চতুরঙ্গ বাহিনী নিয়ে অভিযান করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি, মনে হচ্ছে ছদ্মবেশী পদাতিক সৈন্য দিয়েই ওরা কার্যোদ্ধার করেছে। সংবাদকও কনৌজ নগরীতে বিরাট কোন অশ্ব-গজবাহিনী দেখেছে বলেনি। সম্ভবত তারা প্রথমে রাজপুরী ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি এবং অমাত্য, সেনানায়কদের বাসভবন করায়ত্ত করে, তারপরে সম্পূর্ণ নগরী।’’

‘‘তোমার অনুমান যথার্থ বলেই মনে হচ্ছে।’’ রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘‘এখন তোমার পরিকল্পনা কি খুলে বলো মিত্র, আমি তো এখনি শত্রুর উপর ক্ষুধার্ত শার্দূলের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাই, আমার আর বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না।’’

‘‘ধীরে বন্ধু, ধীরে।’’ মহামাত্য শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘‘পূর্ব নিশ্চিত্য পশ্চাৎ কার্যমারভেৎ। কার্য পুরুষকারেণ লক্ষয়ং সম্পদ্যতে। কালবিৎ কার্যং সাধয়েৎ।(আগে নিশ্চিত হয়ে তারপর কাজ করা উচিত, এবং নিশ্চিত করে নিলে কার্য পূর্ণ হয়ে ওঠে আর সময়ের গুরুত্ব বোঝা ব্যক্তি নিশ্চিত রূপে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে পারেন।) এখন আপনি আমার পরিকল্পনা শুনুন।’’

এরপর মহামাত্য ভণ্ডি তাঁর স্বভাবসুলব ধীর, গম্ভীর স্বরে সুনির্দিষ্ট রণকৌশল ব্যক্ত করলেন। ‘‘আজ রাত্রেই আমাদের গুপ্তচর সংবাদক কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কনৌজে প্রবেশ করে কৌশলে মালব-সেনানীদের জানাবে যে, স্থান্বীশ্বর-রাজ রাজ্যবর্ধন ভগ্নীপতির রাজ্য আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ শুনে হূণ-যুদ্ধ অসম্পূর্ণ রেখে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ছুটে এসেছেন। তিনি ও তাঁর পরিশ্রান্ত সৈন্যরা কনৌজের বাইরে বিশ্রামরত। সম্ভবত আগামী কাল দ্বিপ্রহরে স্থান্বীশ্বরের সৈন্যবাহিনী কনৌজ আক্রমণ করে মালব-বাহিনীকে উৎখাত করে মৌখরী-রাজ্য পুনর্দখল করার চেষ্টা করবে। ভগ্নী রাজ্যশ্রীর প্রিয় ভৃত্য সংবাদক এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে। এই বুদ্ধিমান যুবকটি দ্রুতগামী, অক্লান্ত ও বিশ্বস্ত, সে কনৌজবাসী হওয়ায় নগরী এবং রাজপুরীর সমস্ত অন্ধিসন্ধির বিষয়ে বিশেষভাবে অভিজ্ঞাত। সে সহজেই মালব-সৈনিকদের বিশ্বাসভাজন হতে পারবে।’’

‘‘সে কি! যুদ্ধের আগেই আমরা আমাদের অবস্থান ও সামর্থ শত্রুপক্ষকে জানিয়ে দেবো?’’ কুন্তল বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘‘এতো আত্মহননেরই নামান্তর!’’

রাজ্যবর্ধনেরও মনে একই প্রশ্ন উত্থিত হলো।

‘‘ঠিক তাই, কুন্তল।’’ ভণ্ডির বুদ্ধিদীপ্ত চোখে কৌতুকের আভা, ‘‘আমি এই মালভূমির উপরে অবস্থিত মাত্র দুই সহস্র সৈন্যের কথা বলেছি, পর্বত-অন্তরালের তোমার অধীনস্থ অষ্ট সহস্র অশ্বারোহী সৈনিকদের কথা কিন্তু বলিনি। ওরা এই সংবাদ পেয়ে নিশ্চিত ভাবে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমস্ত বাহিনী নিয়ে নগরীর বাইরে বেরিয়ে আসবে, আর আমি ঠিক সেটাই চাই। কারণ, নগরীর ভিতরে যুদ্ধ হলে ওরা অসহায় নাগরিকদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে আত্মরক্ষার প্রয়াস পাবে, আর অকারণে বহু নিরাপরাধ মানুষের প্রাণক্ষয় হবে; তা ছাড়া, নগর-প্রান্তের উন্মুক্ত পরিবেশে আমরা সহজেই ওদের শক্তির পরিমাপ করতে পারবো।’’

প্রিয় অমাত্যের চাতুর্য ও যুক্তিপূর্ণ কথায় রাজ্যবর্ধন চমৎকৃত হলেন। ভণ্ডি বলে চললেন, ‘‘হে দেব, আমি অনেক ভেবে-চিন্তেই এই মালভূমির উপরে মূল শিবির সংস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছি। ভেবে দেখুন, কয়েক ক্রোশ দূর থেকে এই মালভুমির উপরে আমদের স্কন্ধাবার, বিশেষ করে সুউচ্চ দণ্ডের শীর্ষে উড্ডীয়মান সূর্য-প্রতীক ধ্বজা সহজেই ওদের দৃষ্টিগোচর হবে, আর তা দেখে ওরা আমাদের এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে জয় করতে পূর্ণ উদ্যমে ছুটে আসবে। এবং, এই টিলার কাছে পৌঁছানোর আগেই কুন্তলের অশ্বারোহী বাহিনী টিলার নীচের বনান্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে তিন দিক থেকে ওদের ঘিরে ফেলবে। ইত্যাবসরে কুমার ও আমি এই দুই সহস্র অশ্বারোহী নিয়ে মালভূমি পরিত্যাগ করে গঙ্গা-যমুনার দোয়াবের পথ দিয়ে ঘুরে কনৌজে প্রবেশ করে অধিকার করে নেবো। কুন্তলের তুরঙ্গসেনা এই প্রান্তরে সহজেই মালব বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস; তারপর অর্ধেক সৈন্য নগরীর তোরণদ্বার গুলি রক্ষার জন্য রেখে বাকিদের নিয়ে যোগ দেবে আমাদের সঙ্গে।’’

‘‘অত্যন্ত বিচক্ষণ পরিকল্পনা তোমার ভণ্ডি!’’ রাজ্যবর্ধন সোৎসাহে বললেন, ‘‘তুমি এখনই সংবাদককে উপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে কনৌজে প্রেরণ করো, আর কুন্তল,তুমি তুরঙ্গ-নায়কদের আমাদের রণকৌশল বুঝিয়ে দাও।’’

পরদিন মহামাত্য ভণ্ডির পরিকল্পনা অনুসারে পরবর্তী ঘটনাগুলি পরপর পটচিত্রের মতন সংঘটিত হতে লাগলো। আগের রাত্রেই সংবাদক ও তার সঙ্গীরা যথাযথ ভাবেই তাদের কার্য সমাধা করেছে। দিনের প্রথম প্রহরে কিঞ্চিদধিক তিন সহস্র মালব-অনীকিনী কান্যকুব্জ নগরী থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের বেশিরভাগই পদাতিক সৈন্য, সঙ্গে অল্প সংখ্যক কনৌজের গজ ও অশ্বারোহী সেনা। পর্বত সানুদেশে পৌঁছানোর আগেই কুন্তলের পরিচালনায় তুরগারোহী সৈন্যদল তাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললো। মাত্র দুই দণ্ডের মধ্যেই স্থান্বীশ্বরের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে তারা সম্পূর্ণ পরাস্ত হলো।

যুদ্ধ চলাকালীনই রাজ্যবর্ধন ভণ্ডির সমভিব্যাহারে কালবৈশাখীর ঝটিকার ন্যায় দুই সহস্র রণদুর্মদ তুরঙ্গসৈন্য নিয়ে কান্যকুব্জের পশ্চিমে গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চল ধরে রাজধানী-নগরীতে প্রবেশ করলেন।

কনৌজ নগরী জুড়ে অসংলগ্নভাবে ছড়িয়ে থাকা মালবের পদাতিক সৈনিকরা তাঁর দুরন্ত গতিকে বাধা দিতে অপারগ বুঝে বেশিরভাগই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করলো; সামনে যারা পড়লো, তারা অনতিবিলম্বে শমন-সদনে প্রেরিত হল। রাজ্যবর্ধন প্রথমেই কনৌজের মন্ত্রী, সেনাপতি প্রভৃতি রাজপুরুষদের গৃহবন্দীদশা থেকে মুক্ত করে বীরদর্পে রাজপুরীর দিকে অগ্রসর হলেন।

মালবরাজ দেবগুপ্ত তখনও তাঁর চিরাভ্যাস মত সুরাপান ও কনৌজের কয়েকজন সদ্যযুবতী সুন্দরী বন্দিনীর কুমারীত্বহরণের আনন্দ উপভোগ করতে ব্যস্ত। আর যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে তিনি তো একরকম নিশ্চিত! আর হবেন নাই বা কেন! গুপ্তচরের দেওয়া সংবাদে জেনেছেন, স্থান্বীশ্বরের এক অষ্টাদশবর্ষীয় সমর-অনভিজ্ঞ বালক রাজকুমার মাত্র কয়েকশত ঘোড়সওয়ার নিয়ে কনৌজ পুনরুদ্ধার করতে এসেছে। তাঁর রণনিপুণ সৈন্যার্ণবের কাছে তা নিতান্তই সাগরের সম্মুখে গোষ্পদতুল্য! দেবগুপ্ত নগর রক্ষার জন্য মাত্র এক সহস্র সৈনিককে রেখে বাকি সৈন্যদের পাঠিয়ে দিয়েছেন স্থান্বীশ্বরের আক্রমণ প্রতিহত করতে। মাত্র ক’ দিন আগেই অতি সহজেই স্বর্ণপ্রসবিনী কান্যকুব্জ তাঁর অধিকৃত হয়েছে। একদিকে মালব, অন্যদিকে কান্যকুব্জ --- আর্যাবর্তের দুটি সমৃদ্ধিশালী রাজ্য এখন তাঁর করায়ত্ত, এরপর চাই স্থান্বীশ্বর। আর্যাবর্তের সম্রাটের সিংহাসন আর খুব বেশি দূরে নেই! সেই সুখস্বপ্নে তিনি বিভোর। শুধু একটাই আক্ষেপ, কান্যকুব্জের পরমাসুন্দরী রাণীকে এখনও তিনি নিজের অঙ্কশায়িনী করতে পারেননি। বিশ্বাসী ভৃত্য দ্বারা পরিবেষ্টিত সেই বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত বন্দীগৃহটিতে কি করে যে আগুন লাগলো এখনও তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না। সেই রাত্রে যে একটু বেশিই মদিরাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি; কোন রকমে যে নিজের প্রাণরক্ষা করতে পেরেছেন সেটাই যথেষ্ট। কনৌজ-মহিষী আর কয়েকজন দাস-দাসীকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা জীবিত না সেই অগ্নিকাণ্ডে মৃত, তা কে জানে!

কান্যকুব্জের তোরণদ্বারের প্রতিহারীরা স্থ্বান্বীশ্বরের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত বা পলায়িত। উন্মুক্ত তোরণ অতিক্রম করে রাজ্যবর্ধন বীরপদভারে মেদিনী কম্পিত করে সসৈন্যে রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন। অকস্মাৎ চোখের সামনে অষ্টাদশবর্ষীয় এক লাবণ্যময় তরুণকে কালান্তক শমনের মত অনলপ্রভ মূর্তিতে কোষমুক্ত অসি হাতে দণ্ডায়মান দেখে নেশাতুর, স্খলিত-বেশ মালবরাজ প্রমাদ গুনলেন। আশেপাশে চেয়ে দেখলেন দেহরক্ষীরা কেউ নেই, তাঁর সাধের লীলাসঙ্গিনীরাও সুযোগ বুঝে অন্তর্হিত হয়েছে। দেবগুপ্ত বুঝলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন, তিনি অধিজানু হয়ে বারংবার নিজের প্রাণভিক্ষা করতে লাগলেন। মনে তাঁর ক্ষীণ আশা, মিত্র শশাঙ্ক হয়তো যথা সময়ে এসে তাঁর জীবন রক্ষা করবেন।

‘‘ওহে ক্ষত্রিয়কুলকলঙ্ক কাপুরুষ মালবাধিপ, এখন নিজের প্রাণভিক্ষা করতে তোমার লজ্জাবোধ হচ্ছে না?’’ রাজ্যবর্ধন জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘পররাজ্য লোভে রাত্রির অন্ধকারে নিশাচর উলূকের মতন কনৌজ নগরী ছারখার করে অসহায় গ্রহবর্মাকে হত্যা করতে তো তোমার ওই কলুষ হস্ত কম্পিত হয় নি! তোমার মতন পাতক এই ধরণীর ভার স্বরূপ, তোমাকে ক্ষমা করাও মহাপাপ।’’ বলতে বলতে রাজ্যবর্ধন মহাক্রোধে তাঁর তীক্ষ্ণধার অসি উত্তোলন করেও নামিয়ে নিলেন।

এরপর মহামাত্য ভণ্ডি নানাভাবে রাজ্যশ্রীর সংবাদ জানার চেষ্টা করে বিফল হয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘‘হে অধিরাজ, জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে গিয়েছেন, ঋণ, অগ্নি, ব্যাধি আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই, এখনই হত্যা করুন ক্ষমার অযোগ্য এই পাষণ্ডকে।’’

‘‘না মিত্র, আমি পুষ্পভূতি বংশের গৌরব মহাবীর প্রভাকরবর্ধনের পুত্র হয়ে নিরস্ত্র শত্রুর প্রাণনাশ করতে পারবো না, তা সে যত বড় পাতকীই হোক না কেন! একে শৃঙ্খলিত করে অন্ধকূপ কারাগারে নিক্ষেপ করো। যথা সময়ে এর বিচার হবে।’’

ভগ্নীপতি গ্রহবর্মার হত্যাকারী মালবরাজকে কনৌজের কারাগারে নিক্ষেপ করে রাজ্যবর্ধনের বিক্ষুব্ধ চিত্ত কিছুটা শান্ত হয়েছে। শত্রুপক্ষের যারা বাধা দেবার চেষ্টা করেছে, তাদের তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ড দিতে স্থান্বীশ্বর-সৈনিকরা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি। বাকিরা বন্দী দশা প্রাপ্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে কুন্তল মালব-বাহিনীকে পরাজিত করে রাজধানীতে চলে এসেছেন। রাজ্যবর্ধনের আদেশে রাজ্যশ্রীর সন্ধান করতে কুন্তলের অধীনস্থ সৈনিকরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু নগরী ও তার আশপাশের সমস্ত স্থান তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁর কোনও সন্ধান পাওয়া গেলো না।

যুদ্ধে জয় লাভ করার পর রাজ্যবর্ধন আর এক মুহূর্ত কনৌজের রাজপুরীতে থাকতে চাইলেন না। একদা যে রাজনিকেতন স্নেহের ভগ্নী রাজ্যশ্রী ও তাঁর পতি মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার সুখের সুরম্য নিবাস ছিলো, যা সতত সুখ ও আনন্দময় বৈজয়ন্তীধাম সদৃশ সম্পদ-প্রাচুর্যে ভরা ছিলো, তা এখন যেন এক প্রেতপুরীতে পর্যবসিত হয়েছে। পবিত্র গৃহমন্দির এখন এক রক্তপিপাসু লম্পট দানবের বিলাসকুঞ্জে পরিণত হয়েছে, সমস্ত মহল জুড়ে তার সহগামীরাও পুষ্পকুঞ্জে হিংস্র শ্বাপদের মতন বিচরণ করেছে।

কুমারকে চিন্তান্বিত দেখে পার্শ্বচর ভণ্ডি বললেন, ‘‘হে অধিরাজ, রণশাস্ত্র অনুসারে শত্রুর বিজিত রাজ্য পুনরাধিকার করে সেখানেই কিছুকাল যাপন করাই বিধেয়, অন্যথায় তা আবার পরহস্তগত হতে পারে বা শত্রুপক্ষ অন্য পথে আঘাত হেনে প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে পারে। তাছাড়া শত্রু-মুক্ত রাজ্যের রাজ-প্রতিনিধিদের উপযুক্ত কার্যভার অর্পণ করে প্রজাদের স্বাভাবিক নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে সহায়তা করারও বিশেষ প্রয়োজন।’’

‘‘তোমার কথার আমি সব সময়ই মর্যাদা দিই, মিত্র।’’ রাজ্যবর্ধন বিমর্ষমুখে বললেন, ‘‘কিন্ত তুমিই বলো, এই পুরীতেই প্রিয় গ্রহবর্মা গতায়ু হয়েছেন, এই ভবন থেকেই আমার একমাত্র ভগ্নী অপহৃতা হয়েছে, সে যে কোথায় কি অবস্থায় আছে, তার কোন সন্ধানও পেলাম না! আমার পরম প্রিয়জন-বিহীন এই মৃত্যুপুরীতে আমি কিভাবে রাত্রিযাপন করতে পারি? তোমার কথামতন আমি এই রাজভবন পরিত্যাগ করলেও এখনই স্থান্বীশ্বরে প্রত্যাগমন করবো না, নগরী-প্রান্তে মালভূমির সেই স্কন্ধাবারেই কিছুকাল অবস্থান করব, এবং সেখান থেকেই সমস্ত কর্তব্য-কর্ম নিরূপণ করব। তুমি সেই অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করো।’’

‘‘যথা আজ্ঞা দেব, আপনার আদেশ অবশ্যই পালিত হবে।’’



******



সংবাদকের দেওয়া সংবাদে একটি মাত্র ভুল ছিল। সে মালবরাজ দেবগুপ্তর দ্বারা কান্যকুব্জ অধিকারের সময় সন্ন্যাসীবেশী গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককে চিনতে বা তাঁর ভূমিকার কথা জানতে পারেনি। তাই স্থান্বীশ্বরের রাজপুরুষদের তাঁর কথা না বলায় কেউ তাঁর কথা জানতে পারেন নি। সুতরাং অভিযানে রণকৌশল ইত্যাদির পরিকল্পনার সময় শশাঙ্কর বিষয়ে কোনও চিন্তাই কেউ করেননি। সকলের অজান্তে ঈশান কোণের একটি অজানা মেঘ থেকে যে কি ভীষণ দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে পারে, তা ছিলো সবার কল্পনাতীত। --- (ক্রমশ প্রকাশ্য)



1 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রাচীন কথা



বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন
কৃষ্ণদেব রায়



বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মানুষের ধারণা ছিলো যে, ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটে বৈদিক যুগ থেকে। বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ এবং পুরাণ প্রভৃতিকে বলা হতো বৈদিক সাহিত্য। যদিও এই বৈদিক সাহিত্য শ্রুতি এবং স্মৃতির মাধ্যমে বংশপরম্পরায় বহুযুগ ধরে চলে এসেছে যতদিন না এটি লিপিবদ্ধ হয়। বৈদিক সাহিত্যের বৈচিত্র এবং বিশালতা এতটাই, যে কেবল মাত্র স্মৃতির সাহায্যে, কোনওও রকম লেখ্য নথি ছাড়াই বংশপরম্পরায় চলে এসেছে, এটা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টসাধ্য। অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতন অনেকটা! আরও বেশি করে এটা মনে হতো, কারণ সাধারণ ধারণা ছিলো যে আর্যরা বহিরাগত এবং পরিব্রাজক সম্প্রদায়। আচ্ছা ভাবুন তো, একদল লোক ক্রমাগত এদেশ থেকে ওদেশ হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে, হাজারও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে এমন একটা জায়গায় বা দেশে এসে পৌঁছেছে যেটা তাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত আর তারা নাকি এখানে এসেই অমন বিশাল একটা বৈচিত্র্যময় সাহিত্য রচনা করে ফেলল মাত্র এইটুকু সময়ে? নাকি এটা আগেই রচিত হয়েছিলো আর তারা ভবঘুরের মতন ঘুরতে ঘুরতে, হাজারও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে লড়তেও বংশপরম্পরায় তাদের সঙ্গেই তা রেখে দিয়েছিলো?

হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আবিষ্কৃত হলেও, ১৮৫০ সালেই প্রথম এ কানিংহাম তাঁর পাওয়া শিল্পদ্রব্যগুলির একটি তালিকা প্রকাশ করেন। কানিংহাম-এর ধারণায়, হরপ্পার শিলমোহরে যে বিশেষ ধরণের লিখন পদ্ধতি রয়েছে সেটি ‘নিশ্চিত রূপেই ভারতীয় নয়’। তাই একে তিনি ‘ভারতের ভিনদেশী’ একটি পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দয়ারাম সাহনি হরপ্পাতে একটি প্রণালীবদ্ধ খননকার্যের সূচনা করেন। তারপরে ১৯২১ সালে আর ডি ব্যানার্জি মহেঞ্জোদাড়োয় খননের কাজ শুরু করলেন। এবার আসুন, আমরা আস্তে আস্তে পরিচিত হই আমাদের প্রাচীনতম সভ্যতার সঙ্গে। আর হতবিহ্বল হয়ে যাই এর অচেনা রূপ দেখে।

সভ্যতা বা civilisation কথাটা এসেছে ল্যাটিন civitas বা ‘city’ থেকে। সুতরাং ধরেই নেওয়া যেতে পারে যে সভ্যতা কথাটির সঙ্গে শহরের একটা যোগাযোগ আছে। ১৯২০ সালে মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কারের পর থেকে সিন্ধ-এর মহেঞ্জোদাড়ো আর পাঞ্জাবের হরপ্পাকে ভারতের প্রাচীনতম শহর ও সভ্যতার আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রাচীন মানবের যে সব বসতির কথা আমরা সিন্ধু সভ্যতার আগে শুনেছি, সে সবই ছিলো কৃষি নির্ভর ও পশুপালনের জন্যে স্বল্পকালীন মেয়াদে গড়ে ওঠা কোনও শিবির বা গ্রাম। তাই শহর বা নগরের এই হঠাৎ উপস্থিতির কারণ কি? আর একটি শহর আর গ্রামের মধ্যে মূলগত কিছু পার্থক্য থাকে। প্রথম তফাৎটা হলো আয়তনের। সম্পূর্ণ রূপে কৃষি এবং পশুপালন ভিত্তিক কোনও গ্রাম আকারে সুবৃহৎ হয়না। যদি কোনও গ্রামে কৃষি ও পশুপালনের কাজে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কোনও কারণে বেড়ে যায়, তবে অনেক বাসিন্দাকেই মূল গ্রাম থেকে কোনও দূরবর্তী স্থানে গিয়ে চাষ আবাদ বা দূরের কোনও কোনও চারণ ক্ষেত্রে পশুদের নিয়ে যেতে হয়। এবং এর ফলে তাদের নতুন কৃষিক্ষেত্র বা চারণভূমির কাছাকাছি আর একটা নতুন গ্রাম গড়ে ওঠে।

কিন্তু একটি শহর গড়ে ওঠার পিছনে কিছু মৌলিক শর্ত আছে। সেগুলি ব্যতিরেকে কোনও শহর গড়ে উঠতে পারেনা। প্রথমত, অ-কৃষিজ, হস্তশিল্পীর সংখ্যার বেশ বাড়বাড়ন্ত হওয়া প্রয়োজন, যেটার জন্যে তাদের এক নতুন ক্রেতাসমষ্টি খুঁজতে হবে। এরাই সাধারণত কোনও শহরের প্রথম নাগরিক হয়। দ্বিতীয়ত, শহরে বসবাসকারী মানুষেরা নিজেদের জন্যে খাদ্যোৎপাদন করেনা। তারা গ্রামে উৎপন্ন খাদ্যের ওপরই নির্ভরশীল এবং হস্তশিল্প ছাড়াও অন্যান্য পরিষেবা দিতে পারদর্শী। এখন, এমন একটা পরিস্থিতি একমাত্র তখনই সৃষ্ট হতে পারে যখন কৃষক সমাজ তাদের প্রয়োজনের বেশ কিছুটা বাড়তি খাদ্য উৎপন্ন করতে পারে। কারণ, তাদের উৎপাদিত সেই বাড়তি ফসলই শহরে বসবাসকারী মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করবে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাছাকাছি কোনও শহর থাকলে এবং শস্যপরিবহন ব্যব্যস্থা থাকলে তবেই কৃষকেরা উৎসাহিত হবেন নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি ফসল উৎপাদন করতে শহরে বিক্রির জন্যে। কিন্তু, মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা শহর দুটি গড়ে ওঠার আগে কেনই বা একজন কৃষক তার প্রয়োজনের বাড়তি উৎপাদন করবেন? আর তা যদি না করেন, তাহলে কিসের ভরসাতেই বা একটা শহরের গোড়াপত্তন হয়?আবার অন্যদিকে, মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার নিকটস্থ এবং দূরবর্তী গ্রামগুলোতে নানা ধরণের অ-কৃষিজ হস্তশিল্প, নানা ধরণের উদ্ভাবন, যেমন মাকু ও তাঁত, কুম্ভকারের চাকা, তামাগলানোর কাজ, গোরুর গাড়ির চাকা, বাঁকা তুরপুন, পোড়ানো বা কাঁচা ইঁট তৈরি জাতীয় কাজে যুক্ত মানুষের সংখ্যা লক্ষনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেতে হবে। কারণ এরাই ভবিষ্যৎ শহরের ভবিষ্যৎ বাসিন্দা হবেন। এবং আয়তনে ছোটো, স্বল্প সংখ্যক গ্রামবাসীদের প্রয়োজনের তুলনায় এইসব জিনিসের উৎপাদন বেশি হতে হবে।

ফিরে যাই আবার প্রথম প্রশ্নে। একটা সমাজ কেন তার প্রয়োজনের চেয়ে বাড়তি ফসল উৎপাদন করবে সজ্ঞানে? আমার বাড়িতে রোজ চার জনের ভাত রান্না হয়। মাথা খারাপ না হলে কেন আমার গিন্নি একদিন সকালে উঠে কুড়ি জনের ভাত চাপাবেন? তাহলে সজ্ঞানে যেমন আমার গিন্নি চারজনের বদলে কুড়ি জনের ভাত রান্না করবেন না, একটা কৃষক সমাজও ঠিক সেই কারণেই তার প্রয়োজনাতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করবে না সজ্ঞানে। তাহলে কি ব্যাপারটা কৃষকসমাজের অজ্ঞাতসারেই ঘটে গিয়েছিলো? ঠিক তাই। আর এর জন্যে দায়ী অ-কৃষিজ শিল্পে নিযুক্ত মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতা অথবা প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। এই প্রাকৃতিক খামখেয়ালিপনা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। অবশ্য, এ যাবৎকাল মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা এবং সিন্ধু সভ্যতা নিয়েই বেশ কিছু বিতর্ক চলছে। 

সে যাই হোক, বলা হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২২৩০ (ক্যা)₁ সময়কালে আজকের তুলনায় অত্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় সে অঞ্চলে দীর্ঘকাল আর্দ্রপর্ব স্থায়ী হয়েছিলো। পরিবেশের এই সহায়তার কারণে সিন্ধু উপত্যকায় পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কালের তুলনায় সেই সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছিলো। ১৯৭০ সালে গুরদীপ সিং নামে এক গবেষক রাজস্থানের হ্রদের পলি নিয়ে পরাগরেণু সংক্রান্ত একটি গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন এবং সেটি বেশ কিছুকাল ধরে গ্রহণীয় ছিলো। কিন্তু পরে থর মরুভূমিতে পরাগরেণু সংক্রান্ত উপাত্ত (pollen data) থেকে শুষ্ক ও আর্দ্র চক্রের যে অনুমিতি পাওয়া গেছে, প্রাক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক কালপর্বে উত্তর পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তান, বিশেষত রাজস্থানের জনবসতির প্রত্নতাত্বিক ক্রমপর্ব এবং ছাঁচটি তদনুরূপ নয়। ডি এন মিশ্রের মতে, ‘হরপ্পা সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাতের বৃদ্ধি কোনও নির্ধারক কারণ নয়।’ এছাড়া, ইরফান হাবিবের মতে, মহেঞ্জোদাড়ো এবং কালিবাঙ্গানের নিকাশী ব্যবস্থার সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত মোটেই মানানসই নয়। তাহলে কি কৃষি হাতিয়ারের মৌলিক অগ্রগতির কারণেই হঠাৎ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিলো? এই ব্যাপারেও কিন্তু বিতর্ক আছে। এখনও পর্যন্ত মহেঞ্জোদোড়ো বা হরপ্পায় লাঙ্গলের সন্ধান পাওয়া না গেলেও, কালিবাঙ্গানে (উত্তর রাজস্থান) হলচিহ্ন বা সীতার রেখা দেখতে পাওয়া গেছে। পরিণত সিন্দু সভ্যতার ভগ্নসামগ্রীর নীচে এর কিয়দংশ অবস্থিত। সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা এটিকে প্রাচীন সিন্ধু সময়কালের চিহ্ন হিসাবে শনাক্ত করেছেন। (যদিও হলচিহ্নের চেহারাটা যথেষ্ট আধুনিক এবং তার উপর আড়াআড়ি ভাবে সমদূরত্বে অবস্থিত আরো এক প্রস্থ হলরেখায় দ্বিতীয় আর একটি শস্য বপনের ইঙ্গিত মেলে) 

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এখনো ধোঁয়াশামুক্ত নয়। কিন্তু বেশ কয়েকটি ব্যাপারে এখন সব গবেষকই একমত। প্রথমত, জৈবপ্রযুক্তির সাহায্যে ষাঁড়েদের নিবীর্যকরণ সম্ভব হয়েছিলো। ফলে বলদকে ভারবাহী পশু এবং কৃষিকাজে নিয়োগ করা সম্ভব হয়েছিলো আর এর ফলে মনুষ্যশ্রমের সাশ্রয় হওয়ায় বেশি পরিমাণে জমিতে চাষ করা সম্ভব হয়েছিলো। প্রাচীন সিন্ধু সংস্কৃতিতে লাঙলের ব্যবহার ছিলো কিনা এ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও, গাড়ি টানা পশু হিসেবে ষাঁড় বা বলদের ব্যবহার কৃষিতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি। হরপ্পার প্রাক সিন্ধু স্তরে গোরুর গাড়ির চাকার দাগ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে পশ্চিম পাঞ্জাবের জলিলপুরে পোড়ামাটির গাড়ির চাকা, কাঠামো এবং ষাঁড়ের প্রতিমূর্তি নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির অগ্রগতি, এবং তার ফলে বলদকে দিয়ে কৃষি এবং কৃষিজাত দ্রব্য বহনের সাক্ষ্য বহন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের আগে, যে সময়ে ইরাকে উরুক-এর চিত্রলিপিতে চাকালাগানো গাড়ির খোঁজ মিলেছে, সম্ভবত তার অল্পদিন পরেই সিন্ধু উপত্যকায় ষাঁড়ে টানা দু’চাকার গাড়ির ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। আর একবার যে মানুষ গাড়িটানার কাজে ষাঁড়কে ব্যবহার করবে, সে যে অচিরেই তাকে দিয়ে লাঙল বা হল টানার কাজেও ব্যবহার করবে, সেটা খুব একটা কষ্টসাধ্য কল্পনা নয়। আর যে কাঠমিস্ত্রি বা ছুতার গোরুর গাড়ির চাকা বানাতে পারে, তার পক্ষে একটা কাঠের হাল বা লাঙল বানানো একজন ফার্নিচার-বানানো ছুতোরের পিঁড়ি বানানোর মতনই সহজ কাজ। তাছাড়া শুধু গোরুর গাড়ির চাকাই নয়, তারা যে কাঠের নৌকা বানাতেও সক্ষম ছিলো, এরওপ্রমাণ মিলেছে।এদুটি বিরাট ব্যাপার ছাড়াও, কৃষিতে আনুষঙ্গিক জলের জন্যেও শুধুমাত্র বৃষ্টির জলের পরিবর্তে ভূমিতে সঞ্চিত জল এবং কূপের জল কাজে লাগানোর অজস্র নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এছাড়া, কৃষিতে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা গেলো যখন এক ধরণের শস্যের পরিবর্তে একাধিক শস্যের চাষ একাধিক মরসুমে শুরু হলো। কেবলমাত্র রবি শস্যের সঙ্গে যোগ হলো খারিফ শস্যের চাষও। এই সবকিছুর পরিণতিতে, কৃষক তার নিজের প্রয়োজনের জন্য চাষ করলেও দেখা গেলো যে উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ বেড়ে তিন গুণ কি চার গুণ হয়েছে!!

তাহলে নগরায়নের জন্যে যা যা প্রাথমিক শর্ত, তার সবগুলোই পূর্ণ হয়েছে এখন। প্রয়োজনাধিক খাদ্যশস্য, তার চলাচলের বা পরিবহণের ব্যবস্থা- স্থলপথে গোশকটের দ্বারা এবং জলপথে নৌকার দ্বারা, অ-কৃষিজ এবং কৃষি শিল্পের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বানানোর কারিগর বৃদ্ধি, তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের বিপণনের জায়গার বা ক্রেতার অভাব স্বাভাবিক ভাবেই নগরায়নের জন্ম দিলো। আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো সওদাগর, কাঁচা মালের যোগানদার আর বিভিন্ন গ্রাম থেকে এমন কি সুদূর বিদেশ থেকেও ক্রেতার দল। শুরু হলো মহেঞ্জোদাড়ো আর হরপ্পার পথ চলা। (চলবে)



টীকা₁: ক্যাবা kya এর অর্থ হাজার বছর আগে।


সৌজন্য— শুভজিত গাঙ্গুলী, ইরফান হাবিব, শিরিন রত্নাগর, ডি এন মিশ্র, জোনাথন মার্ক কেনোয়ার।



0 comments: