ছোটগল্পঃ পলাশ কুমার পাল
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
বানভাসি
পলাশ কুমার পাল
১
চারিপাশে জল আর জল। ভূমিভাগ এখন মেঘের আয়না। আকাশের নীল মেঘমালা ঘুরতে ফিরতে আয়নাতে মুখ দেখছে। রৌনক খালি পায়ে আলের উপর দাঁড়িয়ে, মেঘেদের স্বার্থপর ইচ্ছে-খুশি খেলার সঙ্গে দূরে জলাভূমিতে হাবুডুবু খাওয়া কিছু সবুজ উদ্ভিদ দেখছে।
অসহায় দৃষ্টিতে জমির এই করুণ অবস্থা দেখতে দেখতে চিন্তাগুলো বেগবান হচ্ছে। শ্রাবণের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভয়াল বর্ষার প্রকোপে রোয়া দেড় বিঘা জমির পাশাপাশি দশ কাঠা জমি ও বীজতলা এখন জলের তলায়। টানা চারদিন জলের তলায় এই জমিগুলো। শুধু তার জমি নয়, নারায়ণপুর গ্রামের সবার জমির একই চিত্র। রৌনক নিরুপায় হয়ে বিষণ্ণ মনে আলপথ ধরে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
এই জমি রৌনকের উপার্জনের একটা পথ। এছাড়া সে গ্রামে এবং পাশে আরামবাগ শহরে কয়েকটা টিউশন পড়ায়। বি.এ. পাশ করার পর এস.এস.সি. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। বি.এড-এ ভর্তির ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সংকটে ভর্তি হতে পারে না। বাড়িতে বাবা-মা এবং রৌনকের জীর্ণ সংসার কোনওরকমে চলে। বাবা চাষাবাদ কিছুটা দেখাশোনা করেন। বাকি দায়িত্ব রৌনকেরই। তার দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। তবু সংসারে খুব সংকট দেখা দিলে দিদি জামাইয়ের কাছ থেকে কৌশলে আদায় করে কিছুটা সাহায্য করে। তাই রক্ষে!
এবার বাদলের এই প্রকোপে ফসল সব নষ্ট হয়ে গেলে খোরাকিটুকু সংস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। রৌনকের চোখ ছলছল করে ওঠে। আবারও ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামে। রৌনক ছাতাটা খুলে মাথায় দিয়ে হাঁটতে থাকে।
"আজ শনিবার। বাতানল থেকে একটু হাট করে আনবি? আলু, পেঁয়াজ তো প্রায় শেষ!" ঘরে ঢুকতেই রৌনকের মা সোনালী বলে ওঠেন। সোনালী দেবীর বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। সর্বদা হাসিমুখ করে থাকেন। তাঁকে দেখলে বোঝা যাবে না সংসারের জীর্ণ অবস্থার কথা। নিজের সংসারটাকে তিনি মাপজোপ করে চালান।
"কই? ব্যাগ দাও! কি কি আনতে হবে?" বলে রৌনক ঘরে ঢুকে পরনের গামছাটা ছেড়ে প্যান্ট পরতে থাকে।
"পেঁয়াজ-আলুই আন। বাজারের যা দাম!" বলে আঁচলের গিঁট খুলে রৌনকের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ও একটা ব্যাগ দেন।
"আবার পেঁয়াজ! পেঁয়াজ কম করে রান্না করো! আমায় কাল থেকে আর মুড়িতে পেঁয়াজ দেবে না।" বলে রৌনক পায়ে হাওয়াই চপ্পলটা গলিয়ে বাজার চলে যায়। নিজের এই হ্যাংলা পেট না থাকলেই কি নয়? নিজের পেটকে উপবাসে রাখতে পারলে তো একজনের খাবারটা বেঁচে যেতো।
২
রৌনক রবিবার সকালে উঠেই বন্যা পরিস্থিতির খবর জানতে টিভিটা চালায়। বন্যা কবলিত গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ যে এখনও আছে, সেটাই সৌভাগ্য। বন্যার খবরটা জানা যাচ্ছে। গতকাল রাতে ডিভিসি-র জল ছাড়ার খবর শুনে সে শুয়েছিলো। তাই, সকালে কি অবস্থা সেটা জানতেই টিভিটা চালায়। বিজ্ঞাপন এবং কলকাতা শহরের জল জমা খবরের দৌরাত্মে গ্রামীণ এলাকার বন্যা-পীড়িতদের শুধুই টুকরো খবর। কেবল Breaking News-এর হেডলাইনে চোখ রেখে দেখলো, ডিভিসি সকালেও এক লক্ষ কুড়ি হাজার কিউসেক জল ছেড়েছে।এবার কি নদীর জল বন্যা হবে নাকি? এই চিন্তায় রৌনক বাইরে বার হল। কারণ নারায়ণপুর গ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোও ঢুবেছিলো কেবল বর্ষার গড়ানে জলে এবং ডিভিসি-র একটি ক্যানালের জলে। তবে নারায়ণপুরের উত্তরদিকের এলাকায় বন্যার প্রভাব পড়েনি। কিন্তু নারায়ণপুর গ্রাম থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে ফুঁসছে মুণ্ডেশ্বরী। যদিও বৃষ্টি থেমে গেছে। রৌনক বাইরে বেরিয়ে খবর নিয়ে জানলো নদীবাঁধের কিছু হয়নি। বরং একটু একটু করে এলাকার জল কমছে।
বন্যার জন্য টিউশন বন্ধ ছিলো। তাই সে মাঠে চলে গেলো। মাঠে গিয়ে দেখলো, তার বাবা জমির উপর জলে ভেসে আসা পানাগুলো ঠেলছে। রৌনক বাবাকে সাহায্য করলো।
পানা ঠেলতে ঠেলতে রৌনকের বাবা বললেন, "মনে হয় এই বছর আর ধান হবে না। বীজ তো সব নষ্ট হয়ে গেলো!"
রৌনক কিছু বলে না। পানা ঠেলতে ঠেলতে দেখে পানাদের বানভাসি অবস্থা। কেউ তাদের জমিতে আশ্রয় দেয় না। আশ্রয়হারা পানা ভেসে যায়। রৌনক চিন্তিত হয়। ক'দিন পর অন্নের জন্য হয়তো তাকেও পানার মতো এর তার জমি হয়ে নদীপথে ভেসে যেতে হবে।
৩
বিকালের দিকে মরচে ধরা জানলার পাশে বসে রৌনক একটা কবিতা লিখছিলো। ইচ্ছানুযায়ী কিছু কিছু লেখে সে। কয়েক লাইন লিখতে লিখতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো। তার চোখ আটকে গিয়ছিলো ঘরের কোণে মাকড়সার জালে আটকে পরা পিঁপড়ের দিকে। অসহায়ের মতন পিঁপড়েটা ছটপট করছে। ঐ আপ্রাণ চেষ্টা ক্ষুদ্র জীবনটাকে রক্ষা করতে পারবে কি? সে আর কিছু লিখতে পারে না। মাথাটা তার ধরে আসছে। সংসারটা ক'দিন বাদ চলবে কীভাবে? আজ সে বানভাসি হয়ে গেছে জীবন নদে।
"কি রে! কী করছিস?" বাইরে সুমন্তের গলা পেয়ে রৌনক বাইরে বার হল। সুমন্ত রৌনকের ছেলেবেলাকার বন্ধু।
"কিছুই না! এই একটু লিখছিলাম..."
"কাব্য ছেড়ে বাইরে বের হ। চল, মুণ্ডেশ্বরী নদীর জল দেখতে যাবো!" সুমন্তের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা নরেন বলে ওঠে। পাড়ার এক দাদা এই নরেন।
"মুণ্ডেশ্বরী!" রৌনক কি যেন ভেবে বললো।
"হ্যাঁ রে! চল একটা ভুটভুটি ভাড়া করে যাবো। বের হ।"
মুণ্ডেশ্বরী নদী যেতে গেলে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় প্রায় একহাঁটু জল পেরোতে হবে। এছাড়া দূরত্বও কম নয়। প্রায় সন্ধ্যার সময় করে একটা ভুটভুটি ভাড়া করে দশজন মিলে রওনা দিলো।
জল ঠেলে গাড়ি গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে এগিয়ে যায়। এই বন্যাতেও তার নিষ্কৃতি নেই। কালো কালো দৃশ্যরা দু'পাশে হেঁটে যায়। উপরে আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা নক্ষত্র অসহায়ের মতো পিছনে সরে যাচ্ছে। রৌনকও জীবনটাকে মিলিয়ে নিচ্ছে। দারিদ্রতার মাঝে স্বপ্ন, যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মুণ্ডেশ্বরীর তীরে পা রেখে সকলে নদীর আবছা রূপ দেখতে থাকে। নদীর ভয়ংকর রূপ আবছা আলোতে গর্জন করে ছুটে চলেছে। শোঁ শোঁ বাতাস চুলগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছে। রাত্রিকালীন নদীর নেশা বাতাসটাকে পাগল করে দিচ্ছে।
অন্ধকারে নদীপারে বসে থাকা একজন মাঝির কাছে নদীর বাঁধ এবং নদীজলের স্ফীতির খবর নিয়ে সকলে নদীঘাটে বাঁধা নৌকাটাতে গিয়ে উঠলো। সকলের কথাবার্তার মাঝে রৌনক নীরব। এমনি মুখচোরা স্বভাবের সে। তবে ভুটভুটিতে ওঠার আগে পর্যন্ত যতটা উৎফুল্ল ছিলো এখন সেই উৎফুল্লতা কোথায় যেন বিলীন।
নরেন রৌনককে এইভাবে বসে থাকতে দেখে মজা করে বললো, "কি রে! কবিতায় পেলো নাকি?"
রৌনক ঠোঁটের কোণায় মৃদু হেসে দিলো। রাত্রির অন্ধকারে সেইটুকু বাঁকা হাসি অদৃশ্য রয়ে গেলো সকলের কাছে। রৌনকের চোখে শুধু নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া পানার দৃশ্য। নদীরবেগে শুধু ছুটে চলেছে। পরিণামটা তাদের জানা নেই। রৌনকের বুক কেঁপে উঠলো। সে জীবনে কখনো এতটা ভয় পায়নি। সংসারে অনটনে সে আজ অসহায়। শৈশব থেকে দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে সে বড় হয়েছে। সমস্ত ইচ্ছাগুলো এক এক করে ছিঁড়েছে। কিন্তু আজও ভাগ্য সদয় হল না। বরং দুর্বোধ্য ভাগ্য-আঁধার বন্যার জলে ভেসে গেলো।
টর্চের আলো জ্বেলে স্রোতটা পরখ করতে গিয়ে দেখে একটা পানাতে একটা সাপ ভেসে যাচ্ছে। আর পানাটাতে বারবার ছোবল মারছে। বানভাসি হয়েও নিস্তার নেই পানাটার।
কিছুক্ষণ পর সবাই নৌকা থেকে নেমে যায় একমাত্র রৌনক ছাড়া। তারা নদীবাঁধে ঘুরবে। সুমন্ত রৌনককে বসে থাকতে দেখে ডাকে, "আয় রে!"
"তোরা যা! আমি যাচ্ছি একটু পর। আগে একটা বিড়িকে আগুনে ছাই করি!"
রৌনকের এই কথা সুমন্তের রহস্য ঠেকল। এমন করে তো সে কোনওদিন কথা বলেনি। একটু থেমেও সে কি মনে করে বাকিদের সঙ্গে নদীবাঁধ ধরে হাঁটতে লাগলো। তখন ঝুপ করে একটা শব্দ। সুমন্ত টর্চের আলোয় দেখলো, নৌকাটা ফাঁকা। একজোড়া জুতো পাটাতনে পড়ে আছে। সহস্র মূক পানা বুকে নিয়ে নদী ছুটে চলেছে নিরুদ্দেশে।
বেশ ভালো !!
ReplyDelete