ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আমার বারুদ-বেলা ৭
স্বপন দেব
নকশালবাড়ির গুলি চালনার পর ২৫ মে নকশালবাড়িতে কৃষক হত্যার প্রতিবাদে ২৬ মে সন্ধ্যায় শিলিগুড়িতে ছাত্রনেতারা একটি স্ট্রীট কর্নার করেন। ২৭ মে শিলিগুড়ির বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, মহিলা সমিতি, ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের সংযোগ কমিটির তরফে শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে একটি স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। ২৮ মে শিলিগুড়ি রোড স্টেশন ময়দানে এক বিরাট সভায় নকশালবাড়িতে পুলিশী তাণ্ডবের নিন্দা করা হয়। অন্যদিকে পুলিশ এই ঘটনার পর পঞ্চানন সরকার সহ ১০০ জনকে গ্রেফতার করলো। কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল সহ এই অঞ্চলের কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে রুজু করা হলো ষাটটি মামলা। এই অবস্থায়, যখন তাদের সরকারেরই পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করছে তাদেরই কৃষক সভার সদস্যদের, ঠিক এইরকম বৈপরীত্যে সি পি এম এবং তার নেতাদের ভূমিকা কি ছিলো একটু দেখে নেওয়া যাক।
দার্জিলিং থেকে ২৫ মে স্টাফ রিপোর্টার জানাচ্ছে—‘মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা ও দলের সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া আজ খোলাখুলি বলেন কেন্দ্রে কংগ্রেসকে গদিচ্যুত করার একমাত্র রাস্তা অ-কংগ্রেসি রাজ্যে রাজ্যে গণ-আন্দোলন। তিনি প্রকাশ্যেই বাম কমিউনিস্ট মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করেন। বলেন, পশ্চিম বাংলা, কেরলের মন্ত্রীসভা যেভাবে চলছে তাতে পার্টির পলিটব্যুরো আদৌ খুশি নয়। শ্রী সুন্দরাইয়া ঘেরাও নীতিকে অকুন্ঠ সমর্থন জানান। তিনি বলেন ‘ঘেরাও চলবে, চলবে অবস্থান ধর্মঘট, সাধারণ ধর্মঘটও, কারণ এটাই দলের নীতি। মন্ত্রীদের তা মেনে চলতেই হবে। যদি কোন মার্কসবাদী মন্ত্রী তা পছন্দ না করেন, তবে তিনি অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারেন। আমরা জনতার কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলবো।’ (আনন্দবাজার ২৬ মে, ১৯৬৭)। একই পত্রিকায় ৩০ মে, ১৯৬৭ তারিখের আর একটি রিপোর্ট উল্লেখ করছি---‘নকশালবাড়ির ঘটনায় পুলিশই দায়ী বলে আজ রাজ্য সি পি এম সেক্রেটারি প্রমোদ দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেছেন। সোমবার দলের রাজ্য সেক্রটারিয়েটের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় নকশালবাড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই সভায় দলের তিনজন মন্ত্রী সহ সেক্রটারিয়েটের ৯ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন পলিটব্যুরো সদস্য বি টি রণদিভে এবং সুন্দরাইয়া।’ নকশালবাড়ির ঘটনা প্রসঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদকমণ্ডলী নিম্নলিখিত প্রস্তাব নেয়---
‘নকশালবাড়িতে আদিবাসী নারী, পুরুষ ও শিশুদের নৃশংস ভাবে হত্যা করায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদকমণ্ডলী স্তম্ভিত হয়েছেন এবং এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছেন। সম্পাদকমণ্ডলীর এই দৃঢ় প্রত্যয়ই জন্মেছে যে নকশালবাড়িতে কৃষক বিক্ষোভের পিছনে নিহিত রয়েছে এক গভীর সামাজিক ব্যাধি----জমির বেআইনি হস্তান্তর, জমি থেকে উচ্ছেদ এবং জোতদারদের ও চা-বাগানের মালিকদের অন্যান্য জনস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপই সেই সামাজিক ব্যাধির মূলকথা।’ [ দেশহিতৈষী, ২ জুন,১৯৬৭]
ছাত্রফ্রন্টের radicalদের মুখপত্র ‘ছাত্রফৌজ’ তার প্রথম পাতায় বড় বড় লাল হরফে প্রকাশ করলো---‘রক্তঝরা, বুলেটদীর্ণ নকশালবাড়ির মাঠে খসে পড়ুক সমস্ত তথাকথিত প্রগতিশীলতার মুখোশ।’ যুব ছাত্রদের মধ্যে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের পাশাপাশি ধ্বনিত হলো সরকারি সি পি এম নেতৃত্বের প্রতি তীব্র ঘৃণা।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঢেউ ছাত্র সমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুললো। ২৫ টি কলেজের ছাত্র সংসদ এক যুক্ত বিবৃতিতে, নকশালবাড়ির সমর্থনে দাঁড়ানো উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর পুলিশি নির্যাতন ও ছাত্র বহিস্কারের বিরুদ্ধে সারা বাংলা ব্যাপী এক জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। গণশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট থেকেও আসতে লাগলো নকশালবাড়ি আন্দোলনের সপক্ষে বিপুল সমর্থন। শিল্পী ও অভিনেতা উৎপল দত্ত ও তাঁর গ্রুপ কে বয়কট করলো সি পি এম। এই বয়কটের বিরুদ্ধে সংযুক্ত গণশিল্পী সংস্থার কার্যকর কমিটির সভায় একটি নিন্দা প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। এই বিবৃতিতে আরও বলা হলো যে, শিল্পী হিসেবে তাঁরা নকশালবাড়ির বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামকে মনে-প্রাণে সমর্থন করেন এবং শিল্পে তাঁদের এই লড়াইকে রূপ দিয়ে কর্তব্য পালন করবেন। শিল্প-সাহিত্যে নতুন ধারার ঝোঁক তখন কলকাতা ও শহরতলীর নাট্য প্রযোজনাগুলোকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। যেমন---মিনার্ভা থিয়েটারে প্রযোজিত হলো সিরাজ চৌধুরী(শিল্পীমন)-র ‘তুফান’ (সঙ্গীত-কমল সরকার, আলো- তাপস সেন, মঞ্চ-জোছন দস্তিদার)। একই থিয়েটার হলে নকশালবাড়ির সমর্থনে গান গাইলেন—বিংশ শতাব্দী, অজিত পাণ্ডে ও ইসাক। শম্ভু ভট্টাচার্য ও শক্তি নাগ নৃত্য পরিবেশন করেন---‘অবাক পৃথিবী’ ও ‘রানার’। আঙ্গিক প্রযোজনা করলেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘ক্যারিবিয়ানের স্বপ্ন’। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপের ‘কল্লোল’ ও ‘তীর’ অনুষ্ঠিত হতে লাগল বিভিন্ন মঞ্চে ও প্রেক্ষাগৃহে।
নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ও ফাঁসিদেওয়া এলাকায় কৃষকসভার নামে এই জঙ্গি কাজকর্ম চললেও প্রকৃতপক্ষে তখন এলাকার নিয়ন্ত্রণ আর সি পি এম নেতাদের হাতে ছিলোনা। ২৯ মে এক সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি এ কথা ফাঁস করে দেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন----‘হরেকৃষ্ণ কোঙার তাঁকে যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতেও বলা হয়েছে নকশালবাড়ির কৃষকেরা আর তাঁর (হরেকৃষ্ণ কোঙার) কথা শুনছে না।’ সত্যি সত্যি সি পি এম এর অবস্থা তখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি!’ এতদিন পার্টির মিলিট্যান্ট রাজনৈতিক অংশকে সঙ্গে রাখার জন্য সি পি এম বিপ্লবের কথা বলেছে, জোতদারদের বিরূদ্ধে কথা বলেছে। তা সত্ত্বেও নকশালবাড়িতে কৃষক হত্যা হলো সে ফ্রন্টের আমলেই। অতএব এখন কোন পথ নেবেন তাঁরা? প্রসাদজোতে পুলিশের গুলি চালনার পর এ দেশে জঙ্গিপনার সমার্থক হিসেবে ‘নকশালবাড়ি’ বা ‘নকশালপন্থী’ শব্দটি রাজনীতির ভাষায় সংযোজিত হলো। মনে হয় চিন দেশে ‘ইয়েনান’ ঘটনা যেভাবে একটি নতুন শব্দের মাত্রা দিয়েছিলো, ‘নকশালবাড়ি’ বা ‘নকশালপন্থী’ শব্দটিও এ দেশে তেমনই এক নতুন মাত্রা এনেছিলো। নিজের ভৌগোলিক চৌহদ্দি পেরিয়ে ‘নকশালবাড়ি’র জয়যাত্রা শুরু হলো শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরেও। ইংরেজি শব্দকোষে Naxalite শব্দটির সংযোজনই এর বড়ো প্রমাণ। ১২ই জুন মন্ত্রিসভা এক ছয় সদস্যের সাবকমিটি গড়ে নকশালবাড়ি এলাকার সরেজমিন তদন্তের জন্যে পাঠালেন। সাবকমিটিতে থাকা ছয় জন মন্ত্রীর নাম, হরেকৃষ্ণ কোঙার(সিপিএম), বিশ্বনাথ মুখার্জি (সিপিআই), সুশীল ধাড়া (বাংলা কংগ্রেস), অমরপ্রসাদ চক্রবর্তী(এফ বি), ননী ভট্টাচার্য (আর এস পি) এবং দেও প্রকাস রাই (গোর্খা লীগ)। নকশালবাড়ি এলাকায় সরেজমিন তদন্তের পরে এই সাবকমিটির তরফ থেকে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হলো। এই প্রচারপত্রে বলা হলো---কৃষকজনতার হিংসা পরিত্যাগ করে চলা উচিত এবং বেনামী ও সিলিং বহির্ভুত জমি প্রশাসনিক মতে দখল নিতে হবে। এ বিষয়ে প্রচারপত্রে একটি আঞ্চলিক ভূমিসংস্কার কমিটি গঠনের কথাও বলা হলো। একই সঙ্গে তাঁরা নকশালবাড়ি এলাকার জনসাধারণকে এই বলে হুমকি দিলেন যে। ২২ জুনের মধ্যে যদি হিংসাত্মক ক্রিয়া-কলাপ বন্ধ না হয় তবে, ২৪ জুন থেকেই পুলিশ ও প্রশাসন এ বিষয়ে গ্রেফতার ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেবে।
সাবকমটির এই মন্ত্রী মিশন কলকাতায় ফিরে আসার পর প্রাশাসনিক ও পার্টিগতভাবে চাপ সৃষ্টির জন্যে সি পি এম রাজ্য কমিটি তাদের ২০ জুনের অধিবেশনে ১৯জন পার্টি-সদস্যকে দলবিরোধী কাজের জন্য বহিষ্কার করে। এঁরা ছিলেন---সুশীতল রায়চৌধুরী(রাজ্য কমিটির সদস্য), পরিমল দাশগুপ্ত(কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য), তারক দাশ(পার্টি সদস্য,কলকাতা), শান্তি রায়(পার্টি সদস্য, কলকাতা), অবনী রায়(পার্টি সদস্য, রাজকোটরা), অসিত সিনহা(পার্টি সদস্য, কলকাতা), নির্মল ব্রহ্মচারী(ছাত্র পার্টি সভ্য, কলকাতা), স্বপন দেব(ছাত্র পার্টি সভ্য, কলকাতা), বীরেশ ভট্টাচার্য (ছাত্র পার্টি সভ্য, কলকাতা), দিলীপ পাইন (ছাত্র পার্টি সভ্য, কলকাতা), মলিন ঘোষ(চণ্ডীতলা, হুগলী), কল্যাণ মুখার্জি(পার্টি সদস্য,হুগলী), শিবপ্রসাদ ঘোষমন্ডল(পার্টি-সদস্য, হুগলী), পরেশ মুখার্জি(পার্টি সদস্য, হুগলী), বিকাশ দত্ত(পার্টি সদস্য, হুগলী), রহিম বক্স(পার্টি সদস্য, হুগলী), গোপাল পাল(পার্টি সদস্য, হুগলী), পশুপতি হাজরা(পার্টি সদস্য, হুগলী), এবং তারাপদ ব্যানার্জি (পার্টি সদস্য, হুগলী)।এর কিছুদিন পরেই দেশহিতৈষী পত্রিকাতে [৭ই জুলাই,১৯৬৭] ‘হঠকারীদের হঠাতে হবে’---কমরেড মুজফফর আহমেদের আহ্বান---এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং এই দিনই আরও ১৩ জন পার্টি সদস্যের বহিষ্কারের তালিকা দেওয়া হয়। এই বহিষ্কৃত সদস্যরা ছিলেন—সরোজ দত্ত, নিরঞ্জন বসু, প্রবীর আচার্য, গোপাল মজুমদার, অসিত সেন, নারায়ণ দাস, অশোক দত্ত, বীরেন চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী, রঞ্জিত সাহা, পঙ্কজ চক্রবর্তী এবং মণি চ্যাটার্জি। এর পরে তৃতীয় পর্যায়ে ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭তে সি পি এম এর প্রাদেশিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে মুখপত্র গণশক্তি তে ঘোষণা করা হয়----চারু মজুমদার ও সৌরেন বসুকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই সংবাদ পরবর্তীকালে দেশব্রতী ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭-এ প্রকাশ করে।
এবারে আমরা একটু পিছিয়ে আবার চলে যাবো এপ্রিল, ১৯৬৭ তে। তখনও কৃষক বিদ্রোহ সর্বাত্মক রূপ নেয়নি। চারু মজুমদারের ইচ্ছা তাঁর দলিল সম্বন্ধে চিনা পার্টির মতামত গ্রহণ করা। এ কাজের জন্য যোগ্য মানুষের প্রয়োজন। প্লেনে চড়ে নয়, হাঁটা পথে যেতে হবে চিন-এ। চারু মজুমদার ডেকে পাঠালেন কালিম্পং এর নেপালি কমরেড কৃষ্ণভক্ত শর্মাকে। বৃদ্ধ কৃষ্ণভক্তের আজও মনে আছে সেদিনের প্রতিটি ঘটনা। তাঁর কথায় ----- ‘একদিন চারুবাবু বললেন চিন দেশে আমাদের দলিল আর ডকুমেন্টগুলো পৌঁছতে হবে। আমি কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ সাহস পাচ্ছেনা। আমি বাছাই করে তোমায় আজ এই কাজটা করতে বলছি। তুমি কি বলো? আমি বললাম, এটা ভারতের জনগণের জন্যে---ভারতের পার্টি গঠন করার ব্যাপার নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত আছি। এই ভারটা আমি লিব। কিন্তু এ রাস্তাটা হচ্ছে খুব বিপজ্জনক। একদিকে তো শাসক শ্রেণির মিলিটারি বাহিনী দিয়ে ঘেরা, অন্যদিকে বরফের পাহাড়। আবার বর্ষা কাল নেমে আসছে। নদীনালা, পাহাড়ের নদী-স্রোত খুব বেশি। এই সময় আমি যখন ডকুমেনট নিয়ে যাচ্ছি, আমি হর পদে মারা যেতে পারি। এই জন্য এই কাজ যদি সম্পূর্ণ করতে হয়, আমার পরেও অন্য কমরেডদের উদ্যোগী হতে হবে। আমি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত আছি। চারুবাবু বললেন যে তোমার খরচ কত লাগবে?আমি বললাম, আমি না কোন হোটেলে থাকি, না কোন হোটেলে খাই, না কোন গাড়ি ঘোড়া করে যাবো। আমি পয়দলে চলে যাবো। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমার রাস্তাগুলো জানা আছে কিনা? তো দিশাজ্ঞান আমার আছে। উত্তরপূর্ব কোনায় চিনদেশ আছে, আমি পাহাড় ধরে উত্তরপূর্ব কোনায় এগোব। চারুবাবু আমাকে পরের দিন তৈরি হয়ে আসতে বললেন। পরের দিন তৈরি হয়ে আসার পরে দেখছি সৌরেন বোস জিনিসটা টাইপ করতেছেন। সেদিন আমাকে শিলিগুড়িতেই থাকতে হলো। চারুবাবুর থেকে আমি পঞ্চাশ টাকা চেয়ে নিলাম খরচ বাবদে। পরেরদিন সকাল বেলা আমি ওখান থেকে কাগজপত্র নিয়ে বিদায় নেওয়ার জন্যে তৎপর হলাম। মাও সে তুং কে দেওয়ার জন্যে চারুবাবু একটা চিঠি দিয়ে দিলেন। বিদায় নেওয়ার সময়ে চারুবাবু বললেন, তুমি একা ধরা পড়লে তত ক্ষতি নাই, কিন্তু এই কাগজ যদি ধরা পড়ে তাহলে আমরা সব শেষ হয়ে যাবো। আমি শিলিগুড়ি থেকে পাঁচ কিলো চানা কিনে মিরিকে পৌঁছলাম। ওখানে এক কমরেডের বাড়িতে আমি চানা ভুট্টার ছাতু তৈয়ার করার জন্য বললাম। ওরা পনেরো কিলোর মত ছাতু তৈয়ার করে দিয়েছিলো। মিরিক থেকে যাত্রা করার ছয় সাত দিন পরে আমি তিব্বতি ডাকাত খাম্পাদের হাতে ধরা পড়ি। তাদের হাত থেকে পালিয়ে ধরা পড়লাম নেপালি পুলিশের হাতে। এমনি করে বাহাত্তর দিন পরে তিব্বতে গণমুক্তি ফৌজের হাতে ধরা পড়ে চিনা পার্টির দফতরে পৌঁছাই’। [কৃষ্ণভক্তের সাক্ষাৎকার ] এই ভাবে কমরেড কৃষ্ণভক্তের দুঃসাহসিক অভিযানের সাফল্যে চিনা পার্টির কাছে পৌঁছাল চারু মজুমদারের আন্তঃপার্টি সংগ্রামের আটটি দলিল। নকশালবাড়ির আন্দোলন মানেই আমরা বুঝি, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, চারু মজুমদার। কিন্তু, এই বারুদ বেলা লেখার জন্যে পড়াশোনা বা বই-পত্র না ঘাঁটলে আমার কাছেও অচেনা থেকে যেতেন কৃষ্ণভক্ত নামে এই বীরটি যিনি ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ বা এম পি, এম এল এ, এমন কি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হওয়ার জন্যও নয়, কেবল মাত্র একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্যে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন। তোমাকে হাজারো সেলাম কমরেড কৃষ্ণভক্ত!!
এবার দেখা যাক কৃষ্ণভক্ত যে দলিলটি এবং মাও সে তুং কে লেখা চারু মজুমদারের চিঠিটি চিনা পার্টির হাতে তুলে দিয়ে এসেছিলেন, তার পরিণতি কি হলো। দেশহিতৈষী কার্যালয় থেকে radicalদের বিতাড়ণের পরে তাদের মুখপত্র দেশব্রতী প্রথম প্রকাশিত হয় কলেজ স্ত্রীটের কাছে শ্রীমানি বাজারের দোতলায় পরিমল দাশগুপ্তদের একটি ট্রেড ইউনিয়ন অফিস থেকে।
৬ই জুলাই, ১৯৬৭তে যখন নকশালপন্থী কমিউনিস্টদের মুখপত্র হিসেবে দেশব্রতী আত্মপ্রকাশ করছে, ঠিক তার আগের দিন, অর্থাৎ ৫ জুলাই, ১৯৬৭তে ঘটলো একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘রেনমিন রিবাও’(People’s Daily) পত্রিকা প্রকাশ করলো এক দীর্ঘ প্রবন্ধ-----‘ভারতের বুকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ (Spring thunder over India)। পিকিং বেতার গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করলো সেই ভাষ্য। সেই নিবন্ধে বলা হলো—‘দার্জিলিং এ গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রামের বিকাশ ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। তারা বুঝেছে তাদের বিপর্যয় সমাসন্ন, তাই তারা আতঙ্কিত হয়ে বিলাপ শুরু করে দিয়েছে। বলছে যে, দার্জিলিং এর কৃষকদের বিপ্লব জাতীয় বিপর্যয় হয়ে উঠবে। সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীলেরা দার্জিলিং-এর এই কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম কে দমন করার জন্যে এবং অঙ্কুরেই তাকে বিনাশ করার জন্য হাজার ভাবে চেষ্টা করছে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেকার বিপ্লবীরা এবং দার্জিলিং-এর বিপ্লবী কৃষকরা বিরাট কীর্তি অর্জন করেছেন বলেই দলত্যাগী ডাঙ্গে চক্র এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী পাণ্ডারা ওই বিপ্লবীদের এবং বিপ্লবী কৃষকদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে কুৎসা রটাচ্ছে, তাদের আক্রমণ করছে।’
নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সম্পর্কে চিনা পার্টির এই সমর্থন সি পি এম এর মধ্যেকার জঙ্গি অংশকে ঐক্যবদ্ধ হতে বেশ কিছুটা সাহায্য করলো। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো এমন অনেকেও চিনা পার্টির সমর্থনের পরে নকশালবাড়ি ও কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটিতে যোগ দিলেন। কৃষক সংগ্রাম কমিটি থেকে সি পি আই এম এল গঠন পর্যন্ত এই সমস্ত পর্যায় জুড়েই পিকিং এর এই সমর্থন ১৯৭০ এর জুলাই পর্যন্ত, পিকিং বেতার সি পি আই এম এল সম্পর্কে তাদের সরব সমর্থন জানিয়েছিলো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেটি ছিলো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। (চলবে)
0 comments: