0

ছোটগল্পঃ তুষার সরদার

Posted in

ছোটগল্প


কাল-নিধন
তুষার সরদার



কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসের উচ্চপদস্থ চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে আমাকে তুলে দাঁড়-করিয়ে-দেওয়া কটাক্ষপাতে, গ্লাসভর্তি জলের পিপাসা পাইয়ে দেবার দেহভঙ্গি নিয়ে সে বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে আসতো। কাছে এসে সে অপরূপ ভাবে থমকে দাঁড়াতো। চোখ, মুখ, গলা, দেহ সবকিছুর সাহায্যে অনিবার গলায় বলতো, ‘‘আজ দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল।’’

জোরে একটা ধড়াস শব্দ হয়। শব্দটা শুধু আমি শুনতে পাই। কারণ শব্দটা হয় আমার বুকের গভীরে কোথাও। তারপর সেই ধড়াস শব্দটার শতশত প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যেতে থাকে শরীরের সবকটি কোণায় - আনাচে কানাচে। কোনওমতে বলি, ‘‘আচ্ছা। কোন বগি?’’

‘‘পাঁচের শেষে - ছয়ের প্রথমে।’’

কথাটুকু শেষ করে সুষীম ছন্দে হেঁটে সে চলে যায়। অফিসে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। সে একজন করণিক। কিন্তু নারী-পুরুষের আকর্ষণ কবেই বা এইসব বা অন্যসব বাহ্যিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে এগিয়েছে? বিশেষত যে আকষর্ণের বেশির ভাগটাই এখনও পর্যন্ত জৈবিক হয়ে যায় নি।

ছন্দার কাছেই শুনেছি তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে, এমনকী তাদের বাচ্চা-কাচ্চাও নার্সারিতে ভর্তি হয়ে গেছে। বিয়ের কথাবার্তা বা সম্বন্ধ আনাআনি চললেও বিয়ে ঠিক হয়নি। তবে কী ছন্দা তেমন সুন্দরী নয়? ঠিক জানি না। তবে ওর চোখ, অধরোষ্ঠ, কণ্ঠস্বর, হাসির শব্দ, আর বিশেষ করে ওর সামগ্রিক উদারতা আর কবিতাপ্রিয়তা খুব টানে আমাকে। ওর সাধারণ রূপ ওরই দু’একটি গুণের স্পর্শে আমার কাছে বড়ো মধুর হয়ে উঠতো।

খুব ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা আমাদের দুজনের এই সম্পর্কের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে এইভাবে বলা যায় যে, ছন্দা আমার সঙ্গে এপর্যন্ত মধ্যমপ্রকার একান্ত সময় কাটিয়ে আসছে। ছন্দার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তবুও ছন্দার সঙ্গে ওইরকম ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানোর ডাকে সাড়া দিতে আমার পাপবোধ হয় না। কেন হয় না কে জানে?

দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল। পাঁচনম্বর বগির পিছনের দিকের এক জানালার ধারের সিটে ছন্দা বসেছে। পাশে খুব ঘেঁষে আমি। একটু কম ঘেঁষে বসলেই সে বলে, ‘‘ওভাবে সাতমাইল দূরে বসে আছো কেন? আমি কী তোমার কাছে অস্পৃশ্য নাকি?’’

এইভাবে বসে আমরা একসাথে শেওড়াফুলি পর্যন্ত যাবো। এই ট্রেনেই আবার দুজনেই যে যার অফিসে ঢোকার জন্য হাওড়ায় ফিরে আসবো। এই গায়ে-গায়ে পাশাপাশি ট্রেনের সিটে বসে যাওয়া-আসাটাই হচ্ছে সেই ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানো।

শেওড়াফুলি লোক্যালের এই যাওয়া-আসার পথে খোলা জানালা দিয়ে আমরা চৈত্রের বাতাস ডেকে এনে গায়ে মাখি, লাল অথবা কমলা আগুন লেগে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া দু’জোড়া চোখ দিয়ে আমরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি, পীতভূষণ রাধাচূড়ার রূপে একসঙ্গে বিমোহিত হই। আমার গায়ে খুব ঘন হয়ে বসে থাকা ছন্দার অঙ্গগন্ধে বিভোর হয়ে ওঠা আমার উতল বুকে কত না কলরব জাগে। ছন্দা সেসব শুনতে পায় না। সেসময়ে ছন্দার নিজের ভিতরে কিছু কি হয়?

ছন্দা কমলালেবু খেতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু চৈত্রের কমলালেবু ছোট হয়। টকও হতে পারে। শেওড়াফুলি লোক্যালে কমলালেবুওলা উঠলে ছন্দা তাকে ডাকবেই। কীভাবে জানিনা, ছন্দা কমলালেবুর ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে ঠিক মিষ্টিগুলোই নেয়। কিছুতেই আমাকে দাম দিতে দেয় না। প্রতি বারেই বলে, ‘‘আমি তোমাক খাওয়াবো।’’

কমলালেবুর কোয়াগুলো ছাড়িয়ে আঁশগুলো সযত্নে ফেলে দিয়ে একট্রেন লোকের জোড়া জোড়া চোখের মধ্যে সে নিজের হাতে আমার মুখে তুলে দিয়ে দিয়ে সত্যিই খাওয়ায়, নিজেও খায়।

ছন্দার বুক দেখতে বড়ো সুন্দর। তাকিয়ে ফেলি। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছন্দা কিভাবে যেন সেটা ঠিক বুঝতে পারে। তখন ওর দিকে থাকা আমার হাতটা ছন্দা তার শাড়ির আঁচলের আড়াল করে টেনে নিয়ে ওর গাবলুগুবলু নরম বুকের নীচের দিকটাতে ছোঁয়ায়, ছুঁইয়ে ধরেই থাকে। আমার নিতান্ত বোকাটে হাত সেসময় যথাগন্তব্যে ঘুরে বেড়াবার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠার বদলে প্রায় অবশ আর সমর্পিত হয়ে পড়ে। তখনও ছন্দাকে শারীরিকভাবে পাবার কোনরকম ইচ্ছা আমায় দখল করে বসেনি। তখনও ঠিকমত বুঝে উঠতে পারি নি ছন্দার বুক শুধুই মাংসের আঁষটে গন্ধে ভরা কিনা।

বেশ কিছুদিন এইভাবে কেটে গেছে। শুধুমাত্র শেওড়াফুলি লোক্যালই ছিল আমাদের নিভৃত কূজনের জায়গা। সিনেমা হলের আবছা আঁধারে বা কোনও পার্কের একান্ত নিভৃতিতে ছন্দাকে সঙ্গী করার ইচ্ছা আমাকে কখনও হাতছানি জানায় নি। ছন্দা নিজেও সেসব প্রস্তাব কখনও দেয় নি। তবে শেওড়াফুলি লোক্যাল ছাড়া দুজনে একদিন ছন্দার দৈনিক যাওয়া-আসার পথে মালিয়া নামের এক অনাদৃত স্টেশনে নেমে একটা গাছের তলায় কিছুক্ষণ পাশপাশি বসেছিলাম।

যাত্রীবিরল সেই স্টেশনের একদিকে একটা গাছের তলায় বসে আমরা সেদিন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলাম। সেসব কথার মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। তবে ছন্দা একবার হঠাৎ একটা কথা বলেছিলো, ‘‘আমি তোমার ঘর ভাঙতে চাই না।’’ এটা কী ছন্দার উদারতা ছিল? কোনও মেয়ে শুধু ইচ্ছা করলেই কী কোনও পুরুষের ঘর ভেঙে দিতে পারে? কিংবা কোন পুরুষের কী শুধু ইচ্ছা হলেই সে কোনো মেয়ের ঘর ভেঙে দিতে পারে? আমি জানি না। হয়তো ছন্দাও জানতো না।

সেদিন উল্লেখযোগ্য কথা কিছু না হলেও একটা খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো, অন্তত আমার কাছে। সেদিন মাঝখানে খানিক ফাঁক রেখে আমরা দুজন মুখোমুখি বসেছিলাম। কথাবার্তার মাঝখানে আমার মহাভাগ্যে গাছের উপর থেকে একটা কাঠপিঁপড়ে হঠাৎ খসে পড়লো ছন্দার ডানদিকের বুকে। পড়েই সেটা ছন্দার গলার দিকে বেয়ে যেতে লাগলো। কাঠপিঁপড়ে কামড় আমি খেয়েছি। খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কোনকিছু না ভেবেই ছন্দার বুক থেকে পিঁপড়েটাকে দু’আঙুলে ধরে নিয়ে ফেলে দিলাম....ওর বুক ছুঁয়ে ফেললাম। ছন্দা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো, ‘‘থ্যাঙ্ক ইউ!’’

তার বেশ কিছুদিন পর সেইরকম এক শেওড়াফুলি লোক্যালে যাওয়া-আসার পথে ছন্দা কোনরকম ভূমিকা না করে হঠাৎই বললো, ‘‘শোনো না গো, একটা কথা বলি। মায়ের চাপে পড়ে একটা স্রেফ লোক-দেখানো বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে। তুমি তো জানোই, মা ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই। শুধু মায়ের কথার জন্য, মায়ের শান্তির জন্যই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হচ্ছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কিন্তু একদম মনখারাপ করবেই না। করবে না তো? আমাকে কথা দাও!’’

তখন বাতাসে শীতের প্রথম পরশ লেগেছে। ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে হালকা শীত আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছন্দার বিয়ে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় ছিল। সেজন্য আমার মনখারাপের কোনও কথা ওঠেই না। ছন্দা অবিবাহিত থাকুক এমনটা আমি কখনও চাইনি। শান্ত গলায় বলি, ‘‘তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে এটা আমাকে তুমি বলেছিলে।’’

‘‘বলেছিলাম বুঝি? তা হতে পারে। সে হোক গে...’’

কথা অসমাপ্ত রেখে গায়ের চাদরটা টেনে নিজেকে আরো ভালো করে ঢাকলো ছন্দা। তারপর আমার হাতটা সেইরকম ঘনিষ্ঠ ভাবে তার চাদরের তলায় টেনে নিয়ে গাঢ় গলায় বললো, ‘‘তুমি আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। প্রথম তোমাকেই আমি মনের দরজা খুলে ডেকেছি। মন্ত্র পড়ে বিয়ে না হলেও তুমিই কিন্তু আমার আসল বর! এই যে পাত্র, সে থাকে সেই জলপাইগুড়িতে। সেখানেই তার চাকরি। বিয়ের পরেই আবার সেখানেই সে ফিরে যাবে। কিন্তু আমি যাবো না। আমার চাকরি তো এখানে। তার উপর আমার মা এখানেই থাকবে। তাই বিয়ের পরও আমি মায়ের কাছেই থাকবো। এইরকম কথাবার্তা আগেভাগেই বলেকয়ে তবে বিয়েটা সেট্‌ল করা হয়েছে। বিয়ের পর আমি তোমার সঙ্গেই - মানে - আমার আসল বরের সঙ্গেই হানিমুনে যাবো। হানিমুনে আমরা কিন্তু পুরীতে যাবো না। ওখানে বড্ড বেশি ভিড়। আমরা যাবো - গোপালপুর-অন-সী! তুমি কী বলো?’’ 

বক্তব্যের আকস্মিকতায়, ওজনে এবং প্রস্তাবের অভিনবত্বে আমি ঘাবড়ে গিয়ে এই বিষয়ে যথোচিত কিছুই বলে উঠতে পারলাম না। কিন্তু জবাব একটা দিতে হয়। একটু চুপ থাকার পর তার শেষ কথাটুকুর জবাবে আস্তে আস্তে বললাম, ‘‘এ ব্যাপারে এখন কিছু না বলাই ভালো। তুমি যদি একান্তই তাই চাও সেটা পরে কোনও একসময় ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু কবে তোমার ওই বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে?’

‘‘ধুর্‌ - তার এখন বেশ দেরি আছে। কেন বলো তো? তোমার খুব তাড়া আছে বুঝি? যত তাড়াতাড়ি আমাকে সম্ভব পর করে দিতে চাও?’’

‘‘না, সে কথা নয়। এমনিই জিগ্যেস করছি।’’

তারপর বোধহয় মাসখানেক পরে ছন্দার সেই ‘বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে বিয়েটা’ হয়ে গেল। সে বিয়েতে আমি যাইনি। কারণ ছন্দা এবং আমার দুজনেরই বিশেষ আপত্তি ছিল - ছন্দার মন্তব্য অনুযায়ী - ওই ‘লোক-দেখানো বিয়েটা’তে যেতে। 

বিয়ের পর ছন্দা তার দ্বিতীয় এবং নকল বরের সঙ্গে পুরীতে লম্বা হানিমুনে গেল। বাড়ি ফিরে এসে আরো কতদিন ছুটিতে কাটালো। তারপর একদিন অফিসে জয়েন করে আসল হানিমুনের সময় তোলা অগুনতি ঘনিষ্ঠ ফোটো দেখালো সবাইকে। ইচ্ছা করলে আমিও সেসব ফোটো দেখতে পারি বলে জানালো। দিন কয়েক পর আমি নিজেই ছন্দাকে বললাম, ‘‘গোপালপুর-অন-সী আর যাবার কোন দরকার দেখছি না।’’ 

‘‘ঠিক বলেছো গো। শুধু গোপালপুর কেন, আমার তো এখন কোত্থাও যাওয়া একেবারেই বারণ! এমন কী বাড়তি ট্রেন-জার্নিও বারণ। এটা প্রথম মাস তো! খুব সাবধানে থাকা উচিত। অবশ্য গাইনির ডাক্তার বলেছে পুরো দশমাসই আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।’’

‘‘তাহলে... তুমি যেসব কথা আমাকে বলেছিলে...’’

‘‘ধুস্‌! কী যে বলো তার ঠিক নেই। তুমি নিজেই তো দেখলে আমার কত লেট-ম্যারেজ হলো। যতদিন সেটা না হচ্ছিলো ততদিন আমার টাইম-পাসটাও তো যথেষ্ট জরুরি ছিল না কী....তোমার কি ফিলিংস বলে কিছুই নেই!’’



0 comments: