প্রবন্ধঃ ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
রামায়ণ, রাবণ এবং অস্ত্র-শস্ত্র
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
কথায় বলে রাম-রাবণের যুদ্ধ। অর্থাৎ কিনা ভয়ংকর কিছু। এ হেন যুদ্ধ করতে গিয়ে যে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিলো, কে না জানে! রামায়ণেও আছে অনেক রকমের অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহারের কথা। এমন অস্ত্রের কথাও সেখানে আছে, যা দিয়ে নাকি সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করা যেত। তার মানে অনেক আগেই পরমানু বোমা এসে গেছে হাতের মুঠোয়, এই যুগের আমরা তাকে আবার নিয়ে এসেছি খোল-নলচেটা একটু বদলে দিয়ে। শুধু পরমানু বোমা কেন, পুষ্পক রথ, আগ্নেয়াস্ত্র... এসবই তো রামায়ণ, মহাভারতের যুগের ঘটনা। কিন্তু নতুন রূপে আজও কতখানি প্রাসঙ্গিক!
রামায়ণের সেইসব ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্রের কথা জানতে গেলে আগে জানতে হবে অস্ত্র আর শস্ত্রের মানেটা কি, তাদের মধ্যে ফারাকটাই বা কি! সাধারণ ভাবে সেই তফাৎ আমরা বুঝি না, কিন্তু তফাৎ আছে।
কাকে বলে অস্ত্র, আর কাকেই বা বলে শস্ত্র?
অস্ত্র হলো ঐশ্বরিক ক্ষমতা, দৈবিক শক্তি যা প্রাপ্ত হত কোনও দেবী অথবা দেবতার কৃপায়, এককথায় যাকে বলে বর। তার ক্ষমতা ছিলো অসীম, শুধু বিপক্ষের মানুষজন কেন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও উড়িয়ে দেওয়া যেত। রামায়ণের আলোচনা করতে গিয়ে রামের কথাই বেশি বলা হয়েছে, বলা হয়ে থাকে। যুগে যুগে দেবতা, মুনি-ঋষি, মানুষের পক্ষপাতিত্ব রামকে ঘিরেই। দেবতাদের কৃপায় রাম অনেক অস্ত্রলাভও করেছিলেন। কিন্তু তপস্যা করেছিলেন আরও অনেকেই, অস্ত্রলাভও করেছিলেন আরও অনেকে। যদিও, অস্ত্রের প্রয়োজন এবং ব্যবহার রামকেই বেশি করতে হয়েছিলো। কারণ রাবণ, মেঘনাদ দুজনেই ছিলেন অসামান্য বীর। যদিও রামের কৃতিত্বকে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে, ইন্দ্রজিৎ বা রাবণ কেউই রামের চেয়ে কোনও অংশে কম বীর ছিলেন না। মেঘনাদের অপর নাম ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রলোক বা দেবলোক জয় করেছিলেন বলে। এই দুই বীরকে পরাস্ত করতে গিয়ে অনেক সময়ই রাম এবং লক্ষ্মণ পরাস্ত, বিপর্যস্ত হয়েছেন, আবার দেবতাদের কৃপায় জীবন ফিরে পেয়েছেন। দেবতাদের কৃপা না থাকলে এই যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতেই পারতো।
সে যুগে অস্ত্র কেমন ছিলো, একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। রামায়ণের থেকেই উদাহরণ দিই। রামায়ণ মহাভারতের অনেক গল্প-গাথা মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে কখন যে একসময় মূল রচনার মধ্যে স্থান পেয়েছে, আমরা জানি না। এই ঘটনাটিও প্রক্ষিপ্ত কিনা জানা নেই। রামের অস্ত্রের ব্যবহারের ঘটনাটি এইরকম--
একদিন রামচন্দ্র তপোবনে সীতার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে রত, কিছুক্ষণ পর রামচন্দ্র নিদ্রামগ্ন হলে সীতা রামের মস্তক নিজ কোলে ধারণ করে বসে রইলেন। এক বায়স বা কাকপক্ষী, যা কিনা আদতে রাক্ষস বা দুষ্ট ব্যক্তি, বারে বারে সীতার মস্তকে আঘাত করছে। সীতার শরীরে আঘাত লাগলেও সীতা রামের নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে তা সহ্য করছেন। হঠাৎ সীতার মস্তক থেকে রক্তক্ষরণ হলে তা গড়িয়ে পড়লো রামের শরীরে। উষ্ণ রক্তের স্পর্শে রামের নিদ্রাভঙ্গ হলে রাম একমুঠো দূর্বা ঘাস ছিঁড়ে উপরের কাকপক্ষীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। কাকপক্ষীটি নিহত হলো সেই অস্ত্রের প্রয়োগে। রামচন্দ্রের এই মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দূর্বাঘাস উৎক্ষেপণ, যা কিনা এখানে অস্ত্র, সেটি দেবতার নিকট বর পেয়েছিলেন এবং দুষ্ট কাকপক্ষী রূপী রাক্ষসকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন।
ঘটনাটি যেন মনে করায় অনেক কিছু। সেই যে, পরশুরাম, তাঁর কথা মনে আছে? মহাভারতের কাহিনীতে আছে, কর্ণ তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করতে এলে পরশুরাম অস্বীকৃত হন, কারণ কর্ণ সূতপুত্র, ব্রাহ্মণ সন্তান ছাড়া তিনি আর কাউকে শিক্ষা দেবেন না। কর্ণের মিথ্যা ভাষণে পরশুরাম অস্ত্রশিক্ষা দানে সম্মতি প্রকাশ করলেন। একদিন কর্ণের জানুতে মস্তক রেখে পরশুরাম নিদ্রা যাচ্ছেন, শয়নকালে এক কীট কর্ণের জানুতে দংশন করলো। কর্ণ গুরুর নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে সেই দংশনের কষ্ট সহ্য করে চলেছেন। কীট দংশনের ফলে কর্ণের জানু যখন রুধির প্লাবিত, পরশুরাম কর্ণের সহ্যক্ষমতা দেখে অনুমান করলেন, কর্ণ ক্ষত্রিয় সন্তান। কারণ ক্ষত্রিয় সন্তান ছাড়া আর কারো এত সহ্য ক্ষমতা থাকা সম্ভব নয়। অস্ত্রশিক্ষার জন্য মিথ্যাভাষণ কর্ণর জীবনে অভিসম্পাত এনে দিলো।
এ তো গেল অস্ত্রের কথা, এবার শস্ত্রের কথায় আসি। শস্ত্র হলো পদার্থ জাতীয়। যেমন গদা,ধনুক, তরবারি ইত্যাদি যা দিয়ে আঘাত করা যায় অন্য একজনের পার্থিব শরীরে। এ যুগের রাইফেল, রিভলভার, সবই ব্যাখ্যা করা যায় শস্ত্র হিসাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে যুগের অস্ত্র কি এখনও কেউ লাভ করেন? দেবতারা কি বর দেন, পাওয়া যায় অভীষ্ট সিদ্ধির অস্ত্র? আর কিছু না থাক, পুরাকালের গুপ্তঘাতকের মতন এ যুগেও সুপারি কিলাররা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের হাতেও যা থাকে, তা শস্ত্র হলেও আমরা তাকে অস্ত্র বলেই জানি। অস্ত্র আর শস্ত্রের তফাত এখন আর নেই।
অস্ত্রধারণ করেন যিনি তাঁকে বলা হয় অস্ত্রধারী। রামায়ণ মহাভারতে রাম-রাবণের যুদ্ধে এবং কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধে নানান অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিলো। এইসব অস্ত্রের নাম, ব্যবহারের রীতিনীতি, ফলাফল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়, এমনকি অস্ত্রলাভের জন্য দেবতাদের নিকট তপস্যার কথাও।
রামায়ণে রাম-বন্দনা অনেক হয়েছে, আজ রাবণের কথাই হোক। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণের ব্যবহৃত অস্ত্র, রাবণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রের কথা জানতে গেলে আগে রাবণের জন্ম, লঙ্কায় রাজ্যস্থাপন এবং দেবতাদের কাছে তপস্যার কথা জানতে হবে। এসব নাহলে দেবতার বর, অস্ত্রলাভ হবে কি করে! সুতরাং আগে সংক্ষেপে রাবণের জন্মবৃত্তান্ত।
বাল্মীকি রামায়ণে বলছেন, রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। পিতা ব্রাহ্মণ ঋষি বিশ্রবা, মাতা দৈত্যকুলের রাজকুমারী কৈকেসি। রাবণের পিতামহ হলেন ব্রহ্মার মানসজাত দশ প্রজাপতির একজন ঋষি পুলস্ত্য, যিনি আবার সপ্তঋষির একজন। অর্থাৎ রাবণের জন্মকৌলীন্য অস্বীকার করার মতন নয়। দৈত্যকুলের রাজা ছিলেন সুমালী, যাঁর কন্যা হলেন রাবণের মাতা কৈকেসি। রাজা সুমালী পণ করেছিলেন কন্যার বিবাহ হবে সর্বাপেক্ষা বীর্যবান পুরুষের সঙ্গে। যার ফলে জন্ম নেবে এক তেজস্বী, বলবান সন্তান, ভবিষ্যতে যিনি হবেন অপরাজেয়। এ হেন পিতার কন্যা কৈকেসি পৃথিবীর সকল রাজাকে অগ্রাহ্য করে স্বামী হিসাবে মনোনীত করলেন স্বর্গের ধনদেবতা কুবেরের পিতা বিশ্রবাকে।
কুবের ছিলেন রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই যিনি ছিলেন লঙ্কার রাজা। রামায়ণে আমরা রাবণ ছাড়াও পাই রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের কথা, বিভীষণের কথা। কয় ভাই ছিলেন রাজা রাবণ? রাবণের পিতা বিশ্রবার ছিলো ছয় পুত্র, দুই কন্যা। ছয় পুত্র হলেন—রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ,খর, দূষণ, অহিরাবণ এবং দুই ভগিনী সূর্পনখা ও কুম্ভিনী। ভাগবত পুরাণের মতে, বৈকুন্ঠের দ্বারপাল ছিলেন জয় ও বিজয়। পরবর্তীকালে এই দুইজন পৃথিবীতে এসে জন্মগ্রহন করেন রাবণ ও কুম্ভকর্ণ নামে।
দেবতাদের বরে রাবণ হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় বীর। পরবর্তীকালে দেবতাদের বরে বলীয়ান রাবণের সঙ্গে কুবের যুদ্ধ না করে পিতার কথায় লঙ্কার রাজত্ব দান করেন রাবণকে। রাবণ হয়ে উঠলেন লঙ্কার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, স্বর্ণলঙ্কার অধীশ্বর। কেমন ছিলেন রাজা রাবণ?
রামায়ণে জানা যাচ্ছে, তিনি ছিলেন সুশাসক, সমস্ত লঙ্কায় ছিলো অতুল ঐশ্বর্য্য। সাধারণ নাগরিকের গৃহও ছিলো স্বর্ণ দিয়ে মোড়া। অতুল বৈভবের অধিকারী ছিলেন রাবণ। ছিলেন শিবের ও ব্রহ্মার একনিষ্ঠ ভক্ত। দেবদ্বিজে অত্যন্ত ভক্তি ছিলো রাবণের। অত্যন্ত বিদ্বান। ষড়দর্শন এবং চতুর্বেদ ছিলো তাঁর কন্ঠস্থ। ছিলেন দক্ষ বীণা বাদক, সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ছিলো। এখনও অনেক স্থানে, এমনকি রাজস্থানের প্রত্যন্ত স্থানেও ‘রাবণহাড়া’ নামে একটি বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়, যে বাদ্য যন্ত্রটির সঙ্গে রাবণের নাম জড়িত। যার দ্বারা রাবণের সঙ্গীত প্রীতির কথাই অনুমিত হয়। অর্থাৎ এক কথায় রাবণ ছিলেন একজন গুণসম্পন্ন রাজা। অমরত্ব লাভের জন্য শুরু করেন শিবের নিকট তপস্যা। শিব যতবারই তাঁকে পরীক্ষা করছেন, রাবণ নিজ মস্তক তরবারির আঘাতে কেটে গুরুর পায়ের কাছে ফেলে দিচ্ছেন। প্রতিবারই শিবের কৃপায় রাবণের মস্তক আবার যথাস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এইভাবেই রাবণ দশ মস্তকের অধিকারী হলেন। নাম হলো দশানন। আসল কথা হলো, দশানন বা দশ মস্তকের অধিকারী কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাবণের শক্তি, সামর্থ্যের কথা। সাধারণভাবে আমরা কথায় কথায় বলেই থাকি, দশ জনের মতন শক্তি অর্থাৎ রাবণ ছিলেন একাই দশজন। বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্থ, সামর্থ্য সব দিক দিয়েই রাবণ ছিলেন একাই দশজনের ক্ষমতার অধিকারী। শক্তিশালী অর্থেই কথাটির ব্যবহার।
জৈন মতে, রাবণ ছিলেন বিদ্যাধর। তাঁর নাম ছিলো দশমুখ। রাবণের মৃত্যু হয়েছিলো রাম নয়, লক্ষ্মণের হাতে। পরবর্তী জীবনে রাবণ তীর্থঙ্কর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
শিবের কাছে তপস্যার পর শিব সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে রাবণ অমরত্ব ভিক্ষা করলেন। শিব অমরত্ব দিলেন না, কিন্তু রাবণের নাভির নিচে লুক্কায়িত রইল অমৃত, যার উপস্থিতিতে রাবণ হবেন অপরাজেয়। অমৃত বিনষ্ট না করে রাবণকে বধ করা যাবে না। রাবণ অমরত্ব পেলেন না, কিন্তু অমরত্বের পরিবর্তে লাভ করলেন অনন্ত শক্তি, যাতে দেবকুল, অসুরকুল ইত্যাদি যত কুল আছে, সকলেই তাঁর কাছে পরাজিত হবেন। অবধ্য, অপরাজেয় হবেন রাবণ। আর দিলেন চন্দ্রহাস তরবারি। চন্দ্রকলার মতন তার আকার, কিন্তু অযথা এই শস্ত্রের প্রয়োগে তা কার্যকরী হবে না, ফিরে আসবে দেবতার কাছে। তপস্যায় দেবতাদের নিকটে এই বর লাভ করলেন বটে, কিন্তু মানবকুলের বিরুদ্ধে জয়ের জন্য বর তিনি ভিক্ষা করলেন না। কেন? তার উত্তর জানা নেই। এছাড়াও শিব ও ব্রহ্মা দিলেন অনেক অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি লাভ করবেন সসাগরা পৃথিবীর আধিপত্য। এই সকল অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছিলো রামায়ণের যুদ্ধে।
এত কথার পরেও কিন্তু বাকি রয়ে গেলো একটি কথা, তা হলো ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদের অপরাজেয় শক্তির কথা। মেঘনাদের নাম ইন্দ্রজিৎ কেন? কারণ তিনি ইন্দ্রলোক জয় করেছিলেন। ইন্দ্রলোক, দেবলোক জয় করা তো সামান্য বীরের কাজ নয়! এ হেন মেঘনাদকে পরাজিত এবং হত্যা করার আগে লক্ষ্মণ ও রাম পরাস্তই হয়েছিলেন তাঁর কাছে। দেবতাদের সহায়তা এবং কৌশল অবলম্বন না করলে সেই যুদ্ধে মেঘনাদকে পরাস্ত করা সহজসাধ্য ছিলো না। অস্ত্র তো লাভ হলো, কিন্তু কি সেই অস্ত্র সকল? কার বিরুদ্ধে কোন অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিলো?
আগেই বলেছি, অস্ত্র হলো দেবতাদের নিকট তপস্যার ফলে অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য বর লাভ করা। সেই বরগুলি হলো কিছু মন্ত্র যার প্রয়োগে ইপ্সিত কার্য সমাধান হয়। আবার এমন কিছু মন্ত্রও আছে, যা উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে হাজির হয় শস্ত্র হিসাবে, কখনও বা সেই শস্ত্রের আঘাতে বিপক্ষের জীবনহানিও হয়ে যায় নিমেষে। আবার কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সেই সকল অস্ত্রের দ্বারা অহেতুক ক্ষতিসাধনও হয়ে থাকে।
রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে যে সকল অস্ত্র, বিশেষ করে রাম-লক্ষ্মণ, রাবণ, মেঘনাদ এবং কুম্ভকর্ণের পারস্পরিক যুদ্ধে, তার মধ্যে একটি অস্ত্রের কথা প্রায় সকল সময়েই শোনা গেছে, তা হলো ব্রহ্মাস্ত্র। রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধে এই অস্ত্রের নাম শোনেননি এমন কেউ নেই। কিন্তু এই অস্ত্রের ব্যবহার ছিলো একেবারে শেষ পর্যায়ে। মনে হয়, এই অস্ত্র ব্যবহারের কিছু বিধিনিষেধ ছিলো। বিপক্ষকে কোনওভাবেই পরাস্ত করতে না পারলে, বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যু আসন্ন হলে এবং সমগ্র বাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হলে তবেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা হতো। তবে কি এই অস্ত্র ছিলো একালের নিউক্লিয়ার বোমা বা পরমাণু অস্ত্র, যার প্রয়োগ সম্বন্ধে আছে অনেক বিধি নিষেধ!
রামায়ণের কথাই যখন হচ্ছে, মানব অস্ত্রের কথাটি বলি। অস্ত্রটির নামই হলো ‘মানব’, এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হয়েছিলো মারীচকে হত্যার সময়। এটি কি মানব বোমা? নাম শুনে মনে যেন কেমন ধন্দ লাগে।
ছিলো যমাস্ত্র। নাম শুনেই মনে হয় একেবারে ইহলীলা সাঙ্গ করার জন্যই এর ব্যবহার। এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হয়েছিলো বিভীষণের প্রতি, করেছিলেন মেঘনাদ। আগেই বলেছি, দেবতাদের পক্ষপাতিত্ব রামের প্রতি। বিভীষণ সংবাদ এনেছিলেন, মেঘনাদ যজ্ঞে বসেছেন, যজ্ঞ সম্পন্ন হলে তিনি অমরত্ব লাভ করবেন, কেউ আর তাঁকে পরাস্ত করতে পারবেন না। এদিকে, রাম, লক্ষ্মণ মেঘনাদের অস্ত্রপ্রয়োগে যার পর নাই বিপর্যস্ত। লক্ষ্মণকে দুবার এবং রামচন্দ্রকেও একবার পরাস্ত করেছেন ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ। সুতরাং, যজ্ঞ পণ্ড করতে পারলে মেঘনাদকে হত্যা করা যাবে, তিনি আর অমরত্ব লাভ করতে পারবেন না। সেইমতন লক্ষ্মণ ও বিভীষণ সদলবলে মেঘনাদের যজ্ঞক্ষেত্রে হানা দিলেন। তখন বিভীষণের বিরুদ্ধে যমাস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ।
নাগপাশ অস্ত্র। আমরা জানি, মেঘনাদের কাছে রাম এবং লক্ষ্মণ বারে বারেই পরাস্ত হচ্ছিলেন। নাগপাশ অস্ত্রের ফলে রাম এবং লক্ষ্মণকে সর্পবন্ধনে বেঁধে ফেলেন মেঘনাদ। পরে গরুড়ের দয়ায় তাঁরা মুক্ত হন। বিষ্ণুর বাহন গরুড় না থাকলে সেদিন রাম-লক্ষ্মণ কি মুক্ত হতে পারতেন? সেই দেবতার দয়া।
শক্তিঅস্ত্র। এটি প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। একপ্রকার মৃত বলেই ঘোষিত হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। হনুমান সঞ্জীবনী এনে দিলে তাঁরা সুস্থ হন, জীবন ফিরে পান।
এছাড়া সূর্যাস্ত্র, বরুণাস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র, মহেশ্বর, এসবই একা মেঘনাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিলো। এক এক দেবতার এক একরকমের অস্ত্র। তার কার্য্যক্ষমতাও এক এক ধরণের। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় মেঘনাদের বীরত্ব।
ইন্দ্রজিত এবং রামচন্দ্র ছিলেন একমাত্র ত্রিমূর্তি অস্ত্র বা তিনটি অস্ত্রের অস্ত্রধারী বীর। এই তিনটি অস্ত্র হলো বহ্মাস্ত্র, পাশুপত অস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র ।
এছাড়াও ছিলো গান্ধর্বাস্ত্র, যা বহু সৈন্যকে একসঙ্গে হত্যা করার মতন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ছিলো। রাম এবং রাবণ এই দু’জন শক্তিধর ব্যতিরেকে এই অস্ত্রচালনার ক্ষমতা আর কোন বীরের ছিলো না। কিন্তু রাবণের এই অস্ত্র চালনা করার শিক্ষা থাকলেও অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ার শিক্ষা ছিলো না।
নানারকম অস্ত্রের কথা বলা হলেও আমাদের সাধারণ কৌতূহল বশতঃ জানার ইচ্ছা থাকে রাবণ কোন অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, শিবের বরে রাবণ অমরত্ব লাভ না করলেও শিব তাঁকে অমৃত দিয়েছিলেন, যা লুক্কায়িত ছিলো রাবণের নাভিতে। বিভীষণ এই কথা রামকে জানালে রামচন্দ্র প্রসাভপন (উচ্চারণ ভুল হতে পারে, Prasavapan) অস্ত্র দিয়ে রাবণের অমৃতকে বায়বীয় পদার্থরূপে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন। পরে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেন। বর্তমানের গবেষককুল নানা মাধ্যম থেকে জানাচ্ছেন, যে ব্রহ্মাস্ত্রই হলো বর্তমান কালের পরমাণু বোমা। তবে কি সর্বগুণসম্পন্ন, দেবতার বরে বলীয়ান দশরথপুত্র রঘুবীর রামচন্দ্রই প্রথম, যিনি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন বিপক্ষের বিরূদ্ধে? আগামীকাল তার উত্তর দেবে।
আমরা শুধু জানি, রামের হাতে সুশাসক, দক্ষ বীণাবাদক, দেবদ্বিজে ভক্তিসম্পন্ন, দর্শন ও বেদবিদ্যায় পারদর্শী লঙ্কার রাজা রাবণ অবশেষে নিহত হলেন।
ইদানীং যাঁরা ইতিহাস এবং পুরাণ নিয়ে লিখছেন তারা আগে সেটিকে নৃতত্ব, প্রত্নতত্ব, স্তাপত্যতত্ব, ভৌগলিক, এবং অধুনালব্ধ বিজ্ঞা্নমনস্কতায় যাচাই করে, তবেই লিখছেন। অস্ত্র আর শস্ত্রের মানে যদি আলাদা হয়, লাজ আর লজ্জার মানে বা ইঁচুটি আর পিঁচুটির ও আলাদা মানে করা যায় ! রামায়ণের সময়ে পৃথিবী ধ্বংসকারী পারমাণবিক অস্ত্র থাকা আর চন্দ্রগুপ্তের সময়ে শুক্রাভিযান এক ই ধরণের কল্পনা। গল্প হিসেবে এটি ভালো হলেও, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত।
ReplyDelete