প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বাংলার সমাজে বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব, বিকাশ ও সামাজিক প্রভাব
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
[প্রাক-কথন – ইতিহাসের কৌতুহলী ছাত্র হিসাবে ১৮ ও ১৯ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস আমার বিশেষ আগ্রহের জায়গা। সেই আগ্রহ থেকে বাংলার সামাজিক জীবনে বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব, বিকাশ ও তার প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে চেয়েছি নানা আকর গ্রন্থ ও সেকালের সংবাদপত্রের সংকলিত প্রতিবেদন ঘাঁটাঘাঁটি করে। এই লেখা বাংলার সামাজিক ইতিহাসের কিছু তথ্য মাত্র]
নগরসভ্যতা আর পতিতাবৃত্তি প্রায় সমবয়সী। মধ্যযুগে নগরসভ্যতার অন্যতম ভূষণ ছিলো বারাঙ্গনা পল্লী। বারাঙ্গনা সংসর্গ ছিলো মধ্যযুগীয় পৌরুষ ও আভিজাত্যের প্রতীক। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। আমি বুঝতে চেয়েছি এদেশে আধুনিক নগরসভ্যতার বিকাশের ধারায় বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব ও তার সামাজিক প্রভাব।
আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ হয়েছে, আর এদেশে বারাঙ্গনাবৃত্তির উদ্ভব বৃটিশ শাসনের হাত ধরেই। কলকাতার নগরায়ন শুরু হয় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে। সংবাদপত্র দূরের কথা, ছাপার যন্ত্রের কথাও তখন কল্পনায় ছিলো না। শৈশবের কলকাতায় লোকসংখ্যাই বা কত! ১৭১০ সালে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি যে তিনটি গণ্ডগ্রাম নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন হয়েছিলো, সাকুল্যে তার লোকসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। ১৭৪০-৫০ সময়কালে বাংলার গ্রামে গ্রামে মারাঠা বর্গী হামলার ফলে আতঙ্কিত বহু মানুষ নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় বসবাস শুরু করলো। ব্যবসা-বানিজ্যে ও নানা কারণে কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়তে থাকলো। কলকাতা তার গ্রামীণ রূপ থেকে শহরে পরিণত হলো। ১৭৫২তে হলওয়েল সাহেবের হিসেব মতন কলকাতার লোকসংখ্যা ছিলো চার লক্ষ নয় হাজার।
কলকাতায় বিচারালয় স্থাপনের পর অ্যাটর্নি হয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম হিকি। নভেম্বর ১৭৭৭ থেকে ১৮০৮ পর্যন্ত হিকি কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফেরার পর চার খণ্ডে তাঁর যে স্মৃতিকথা (১৭৪৯-১৮০৯) লিখেছিলেন, সেটি শৈশবের কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত। স্মৃতিকথায় হিকি মিস ডানডাস নামে মহানগরের এক ‘বহুজন পরিচিতা বারাঙ্গনা’র কথা উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে বারাঙ্গনা বৃত্তির সূচনা যে ইংরাজ আমলেই হয়েছিলো, তাতে কোনও সংশয় নেই।
হিকি যে সময়ের কথা বলেছেন, তখন নগর কলকাতার নিতান্তই শৈশবকাল। কলকাতার নগরায়ন সবে ক্ষীণ গতিতে শুরু হয়েছে। কোম্পানীর কাজ-কর্ম চালানোর জন্য ইংরাজ ভাগ্যান্বেষীরা তাদের নতুন উপনিবেশে আসতে শুরু করেছে। কলকাতার সেই শৈশবে ভাগ্যান্বেষণে যে সব ইংরাজরা এসেছিলো, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো ‘অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি’। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, উছৃঙ্খল। তাদের দোসর হলো ইংরাজ শাসনের প্রসাদলোভী বেনিয়ান, মুৎসুদ্দিরা। পালকি আর গোরুর গাড়ির যুগের সেই কলকাতায় দেশীয় খবরের কাগজ তো দূরস্থান, ছাপার অক্ষরেরও উদ্ভাবন হয়নি। কিন্তু বারবণিতা বৃত্তির প্রসার হয়েছিলো ভালোই। ১৭৯৫এ রুশ যুবক হেরাসিম লেবেদফ যখন কলকাতায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম বাংলা থিয়েটারের সূচনা করলেন, তখন সেই নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বারবণিতা পল্লীর মেয়েদের নিয়োগ করেছিলেন। অর্থাৎ, ১৭৯৫এর অনেক আগে থেকেই বারাঙ্গনা পল্লীর অস্তিত্ব ছিলো। আর শুধু কলকাতা নয়, বাংলার সমৃদ্ধ শহরগুলি, যেখানে ইংরাজরা কোর্ট-কাছারি, দপ্তর খুলেছিলো, সেখানেই সন্নিহিত অঞ্চলে বারাঙ্গনা পল্লী গড়ে উঠেছিলো। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা) আত্মচরিত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষ্ণনগরের সমকালীন সামাজিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র লিখেছেন, “...... পূর্বে কৃষ্ণনগরের কেবল আমিনবাজারে পতিতালয় ছিলো, গোয়াড়ীতে গোপ, মালো প্রভৃতি জাতির বাস ছিলো। পরে ইংরেজরা যখন এখানে বিচারালয় ইত্যাদি স্থাপন করেন, তখন গোয়াড়ীর পরিবর্তন হইতে থাকে।’’ কার্তিকেয়চন্দ্র আরো লিখেছেন, “...... বিদেশে পরিবার লইয়া যাইবার প্রথা অপ্রচলিত থাকাতে প্রায় সকল আমলা, উকিল বা মোক্তারের এক একটি উপপত্নী আবশ্যক হইত।সুতরাং তাহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল।” এই কারণেই আমরা দেখি উত্তর কলকাতায় প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত লোকবসতি কেন্দ্রের আশেপাশেই প্রাচীন গণিকাপল্লীগুলির অবস্থান।
১৭৯৩এ কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার গ্রাম-সমাজের কাঠামোটাই ভেঙ্গে দিলো। সূর্যাস্ত আইনের প্যাঁচে বনেদি জমিদাররা নিঃস্ব হলো, আর বেশি রাজস্ব দেবার অঙ্গীকারে নিলামে জমিদারি কিনে ভূমিসম্পর্কহীন এক অর্থলোলুপ মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব হলো। দুর্ণীতিগ্রস্ত, উছৃঙ্খল ইংরেজ আর শিকড়হীন নতুন মধ্যশ্রেণীটির পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নিলো এক কুৎসিত সংস্কৃতি - যাকে আমরা ‘বাবু কালচার’ বলে জেনেছি। গড়ে উঠেছিলো ইংরাজের দালালি করা এক লোভী, দুর্নীতিপরায়ন, অলস নাগরিক সমাজ। আঠেরো শতকের কলকাতা ছিলো এদেশীয় দালাল, মুৎসুদ্দি, বেনিয়াদের কলকাতা আর উনিশ শতকে ‘বাবু’ কলকাতা। আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কলকাতার সেই বাবুসমাজের বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম – “ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিছু বর্ণনা করিব? মুখে, ভ্রুপার্শ্বে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমারেখা। শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে কালোপেড়ে ধুতি। অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনোট করা উড়ানী এবং পায়ে পুরু বাগলস সমন্বিত চিনাবাড়ির জুতা। এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া বুলবুলের লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাফ আখড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া থাকিত।” ইংরেজের শাসন-সহায়ক কদর্য বাবু সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বারাঙ্গনাপল্লীগুলো ফুলে ফেঁপে উঠলো গোটা উনিশ শতক জুড়ে। রক্ষিতা পোষণ, বারাঙ্গনাগমন তখনকার সমাজ শুধু অনুমোদনই করতোনা, এইসব বেলেল্লাপনা ছিলো তাদের মর্যাদার সূচক।
ইংরাজের নতুন ভুমিব্যবস্থা গ্রাম্য সমাজকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিলো। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যেমন চোর ডাকাতের দল সৃষ্টি হয়ে শহরে আশ্রয় নিলো, তেমনই দারিদ্রের তাড়নায় শহরের বারাঙ্গনা পল্লীতে আশ্রয় নিলো মেয়েরা। ১৮৭২সালের সরকারী নথিপত্র থেকে জানা যায় যে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বারবনিতারা অধিকাংশই তাঁতি, তেলি, জেলে, কৈবর্ত, ময়রা, চামার, কামার, কুমোর, যুগী, গয়লা, নাপিত, মালি, বেদে ইত্যাদি (সূত্র – ‘অন্য কলকাতা’ / বিশ্বনাথ জোয়ারদার)। এই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বারবনিতাদের সংখ্যা কি রকম লাফে লাফে বেড়েছিলো, তা জানা যায় এই তথ্য থেকে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮৬৭র ১৬ই সেপ্টেম্বরের হিসাব মতন তিন হাজার মেয়ে এই বৃত্তিতে নিযুক্ত। ১৮৮০ সালের এক হিসাবে শহরে বারবনিতার সংখ্যা ছিলো সাত হাজার আর ১৮৯৩ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিলো ২০,১১৬। (তথ্যসূত্র ‘অন্য কলকাতা’ / বিশ্বনাথ জোয়ারদার )।
‘বাবু কলকাতার’ সেই কদর্য বেলেল্লাপনার ছবি এখন আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। শহরের যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে বারাঙ্গনা পল্লী। সম্ভ্রান্ত এলাকা বা বিদ্যালয়ের পাশেও। বিত্তশালী বাবুদের প্রশ্রয়েই এইসব বারাঙ্গনাপল্লী গজিয়ে উঠেছিলো, তাই প্রশাসনের সাধ্য ছিলো না এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার। এইসব ‘বাবু’দের আদর্শ ছিলো ইংরাজ রাজকর্মচারীরা। শ্রীপান্থ তাঁর ‘কলকাতা’ গ্রন্থে ‘রোটি আউর বেটি’ রচনায় মন্তব্য করেছেন “সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলছে বাবু বিলাস, গুরু-প্রসাদী কৌলীন্য রক্ষা। সতীর আর্তনাদে, বিধবার কান্না আর বারবনিতার কাতর আহ্বানে অষ্টাদশ শতকের কলকাতা প্রেতপুরী। পা যেন লজ্জায় জড়িয়ে আসে সেদিকে বাড়াতে।”
শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরাই নয়, কুলীন ঘরের বহু মেয়েও অবস্থার দুর্বিপাকে আশ্রয় নিতো বারাঙ্গনাপল্লীতে। সরকারী প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছিলো যে বারাঙ্গনাদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দু বিধবাদের বারাঙ্গনা পল্লীতে আশ্রয়। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না হওয়ায় লালসার শিকার বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় ছিলো বারাঙ্গনা পল্লী। সরকারী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো “হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।” সরকারী প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু বিধবারা প্রধানত হুগলী, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা থেকে আসতেন। তরুণী বিধবারা বাবুদের লালসার শিকার হতেন, কেউকেউ গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। তাঁদের আশ্রয় হত বেশ্যালয়ে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি কারণে মা, মেয়ে দুজনেই আশ্রয় নিতো গণিকাপল্লীতে।মুহূর্তের ভুলে অন্তসত্বা নারী আত্মহত্যা না করে বাঁচার উপায় খুঁজেছেন বেশ্যালয়ে আশ্রয় নিয়ে, আবার বহুবিবাহের শিকার নারী প্রেমিকের হাত ধরে কুলত্যাগিনী হয়েছেন, অবশেষে এসে জুটেছেন বারাঙ্গনাপল্লীতে। গবেষক অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত সরকারী দস্তাবেজ উদ্ধার করে লিখেছেন “সরকারী মহাফেজখানা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা কৌতূহলোদ্দীপক। দেখা যায় দশ বছরের নিচে বেশ্যাদের বাড়িতে বেশ কিছু মেয়ে রয়েছে। সরকার এদের কথা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে কিছু করে ওঠা কঠিন।” সেই হিসাব মত, গণিকাপল্লীতে বারাঙ্গনা গর্ভজাত কন্যাসন্তানের সংখ্যা ছিলো ৪০৮ জন। এইসব বারাঙ্গনা কন্যাদের পুনর্বাসন বা সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখনকার সরকার যেমন কিছু করতে পারেনি, তেমনই সমাজ সংস্কারকদেরও কোনও হেলদোল ছিলো, এমন তথ্যও জানা যায় না। তাঁরা নিজেরাই মুক্তির পথ বেছে নিলেন। এবং এই মুক্তির পথ দেখালো থিয়েটার, আর বারাঙ্গনা কন্যাদের থিয়েটারে নিযুক্তির পথ খুলে দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
বাংলা থিয়েটারের সবে শৈশবকাল। ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বর সাধারণ মানুষের জন্য রঙ্গালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ধনকুবের আশুতোষ দেবের(ছাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে থিয়েটার খুললেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁদের থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক লিখে দিতে অনুরোধ করলেন। মধুসূদন সম্মত হলেন, কিন্তু একটি শর্তে, নাটকে স্ত্রী চরিত্রের রূপায়ণ মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সেইসময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিলো। উপদেষ্টা মণ্ডলীতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ। অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় বিদ্যাসাগর বিরোধিতা করলেন থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের। উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের মত মানুষের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে বারাঙ্গনাপল্লী থেকে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন। ১৮৭২এর ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো। সে ছিলো এক যুগান্তকারী ঘটনা। মাইকেল অবশ্য এই দিনটাকে দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯শে জুন ১৮৭৩)।
মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। তাঁদের একটা তাগিদ ছিলো – মুক্তির তাগিদ। থিয়েটারকে তাই তাঁরা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী,কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী প্রভাদেবীরা। বস্তুত, নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিলো। পরবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই।
থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অতএব দেড়শো বছরের ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা বারাঙ্গনা কন্যারা। সে দিনের সমাজ যে তাদের সঙ্গে ছিলো তা নয়। এ ছিলো প্রবল শক্তিধর সমাজের সঙ্গে তাদের অসম লড়াই। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ তাদের অলোয় ফেরার সংগ্রামে সঙ্গ দিয়েছিলেন সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিলো “এই সব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কি করেছো?” পঙ্কজা থেকে মহীয়সী হয়ে ওঠা বারাঙ্গনাকন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অতুল কীর্তি রেখে গেছেন। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় নি, দিতে চায় নি।
কেমন করে সমাজের গভীর অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা এক অসহায়া নারী বিনোদিনী তাঁর তন্ময় সাধনায় দুরূহ সিদ্ধি আয়ত্ব করেছিলেন, স্থায়ী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও নীরবে মঞ্চের অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বঞ্চনার শিকার হয়ে মাত্র তেইশ বছর বয়সে, তা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের ছাব্বিশ বছর পরে, ৪৯ বছর বয়সে, বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। তার আগে এবং পরেও বিনোদিনীর লেখনিচর্চা অব্যাহত ছিলো। প্রকাশ করেছিলেন এবং‘বাসনা’ এবং ‘কনক ও নলিনী’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা কিংবা দুটি কাব্যগ্রন্থের লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী পান নি। বারারাঙ্গনা কুলোদ্ভবা যে! এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, সমাজের মানী লোকেরা, যারা তাঁর অভিনয় দেখার জন্য রাতের পর রাত প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেতেন, তাঁকে ধন্যধন্য করতেন, তাঁরা বিনোদিনীর কন্যাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে দেন নি, বাধা দিয়েছিলেন। বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে। শকুন্তলাকে বাঁচাতে পারেন নি বিনোদিনী, ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
বিনোদিনী পারেন নি। গোলাপসুন্দরী পেরেছিলেন। এক মহতী হৃদয় মানুষের, বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে। তাঁরা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন। এক কন্যার জন্মের পর গোলাপ স্বামী পরিত্যক্তা হন। গোলাপ তখন স্বনামে সুকুমারী দত্ত। মেয়েকে মানুষ করার জন্য গোলাপ থিয়েটারও ছেড়েছিলেন বেশ কয়েক বছর। সুকুমারী কিন্তু থেমে থাকেন নি। গোষ্ঠবিহারী তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুলে। কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। ন্যাশনাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন। ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অর্থকষ্ট সামাল দিতে সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক। নাটকটি অভিনীতও হয়েছিলো। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে। মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্রচুর অর্থব্যয় করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। যদিও মেয়েকে দেখার জন্য তার শ্বশুর গৃহে প্রবেশের অধিকার তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো।
অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষাবিস্তারের কাজে ও দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার কাজে। কৃষ্ণভামিনীরা ইতিহাস নির্মাণ করেন কিন্তু ঐতিহাসিকের সম্মান অর্জন করেন না, এমনই পরিহাস! বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন ‘নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ’। দেড়শো বছর পরে আজকের সমাজ অনেক আলোকপ্রাপ্ত। তথাপি সংশয় জাগে, বিনোদিনীর এই কথাটা কি আজও পুরোপুরি মিথ্যা হতে পেরেছে?
তথ্যসূত্র – ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ / বিনয় ঘোষ, ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’ / অমিত মৈত্র, সুকুমারী দত্তর ‘অপূর্ব সতী’ নাটকের ভুমিকা / ড.বিজিতকুমার দত্ত (নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২, ‘অন্য কলকাতা’ /বিশ্বনাথ জোয়ারদার, ‘কলকাতা’ / শ্রীপান্থ।
খুব তথ্যনির্ভর, অন্যরকম বিষয়বস্তুর ওপরে লেখা সুপাঠ্য প্রবন্ধ। তবে লেখাটি যেন আরও একটু বড়ো এবং বিস্তৃত হলে ভালো হত। বাবু-সংস্কৃতির যুগে এক অদ্ভুত ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিলেন রাধাকান্ত দেব। বিদ্যাসাগর ও বেথুন সাহেবের অনেক আগে থেকেই তিনি স্ত্রী-শিক্ষা এবং নারীকে স্বাবলম্বিনী হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে নিকটস্থ বারাঙ্গনা পল্লীর অনেকেই এই সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। সামাজিক কৌলীন্যে কলকাতার বারাঙ্গনাদের থেকে অনেক উচ্চাসীনা ছিলেন লখনৌএর বাইজিরা । তাই রাজা-রাজড়াদের মজলিশে ডাক পড়ত তাদের ই। আর শুধু নাট্যমঞ্চেই নয়, পরবর্তীকালে, সঙ্গীত জগতেও বিশিষ্ট আসন নিয়েছিলেন এই বারাঙ্গনারাই। মহিলা কন্ঠে বাংলা গানের প্রথম রেকর্ড সম্ভবত এক বাইজির ই। আর, আমার প্রণম্য ফাল্গুনীদার যা বয়েস, তাতে তিনি না হলেও তার বাবা-মা নিশ্চয় শুনেছেন উমাশশী দেবীর নাম। ইনিও বাংলা চলচিত্রে যুক্ত হয়েছিলেন ঐ বারাঙ্গনা পল্লী থেকেই।
ReplyDeleteঋতবাক'এর আগের একটি সংখ্যায় মার একটি প্রবন্ধ ছিল 'বাঙ্গালির বিনোদন শিল্পে বারাঙ্গনা নারীদের অবদান' । প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করেছিলেন থিয়েটারের দুজন নর্তকী - নাম ফণীবালা ও শশিমুখী , ১৯০২এ । বাঈজি নয় তারা অমরেন্দ্রনাথ দত্তর থিয়েটারে নাচ-বালিকা ছিলেন । সিনেমা তো অনেক পরে এসেছে, প্রথমে থিয়েটারের মেয়েরাই তাতে অভিনয় করতো । থিয়েটারই বারাঙ্গনা কন্যাদের প্রথম তাদের সামনে মুক্তির দরজা খুলে দিয়েছিল ।
ReplyDelete