6

অণুগল্পঃ সংযুক্তা মজুমদার

Posted in


অণুগল্প


অচ্ছেদ্যচক্র
সংযুক্তা মজুমদার


রোজকার মত আজও বাচ্চাটা ভোরের আলো না ফুটতেই চলে এসেছে। রোগা, ছোট খাটো চেহারা। মাথা ভর্তি তেল বিহীন রুক্ষ চুল, যাতে তেল পড়েছে কখনো বলে মনে হয়না। নাম কা ওয়াস্তে গায়ে একটা জামা জড়ানো আর একটা ঢলঢলে প্যান্ট, দড়ি দিয়ে কোনরকমে কোমরে বাঁধা।

এই সময়টা রাই রোজই বারান্দায় কাটায় আর হাউসিং সোসাইটির ফুল গাছে জল দেওয়া থেকে এই বাচ্চাটির ১০টা গাড়ি ধোওয়া, সব দেখে। মায়া হয়, বিরক্ত হয় রাই। ভাবে, আমাদের মত শিক্ষিত লোকেরাও যদি শিশুশ্রম বন্ধ না করে তবে আর কি উন্নতি হবে দেশের!

যেমনি ভাবনা অমনি কাজ। রাই ‘চাইল্ড রাইট অ্যাক্ট’-এর কাগজ বের করে সোজা হাউসিং সচিব মিত্র বাবুর কাছে হাজির। কাগজ দেখিয়ে রাই বোঝালো যে এমন যদি চলে, ধরা পড়লে তিন মাস থেকে ছয় মাসের জেল হতে পারে।

ব্যস! অমনি আজ সকালেই মিত্র বাবু ছেলেটিকে কাছে ডেকে বললেন, ‘‘তোকে আর কাল থেকে কাজে আসতে হবেনা। জানিস তো আইন হয়েছে যে বাচ্চারা কাজ করবে তাদের জেলে ধরে নিয়ে যাবে।’’ রাই বারান্দা থেকে দেখছিল ঘটনাটা আর খুশি হচ্ছিলো। কিন্তু বচসা হচ্ছে মনে হওয়াতে রাই নেমে গেলো।

রাইকে দেখে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। রাই আদর করে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘কি নাম তোমার?’’ অস্পষ্ট উত্তর এলো – ‘‘কানাই।’’ রাই বলল, ‘‘শোন কানাই, কাল থেকে তোমাকে আর কাজ করতে হবেনা। তুমি স্কুলে যাবে। আমি তোমায় স্কুলে ভর্তি করে দেবো।’’ রাইকে প্রচণ্ড অবাক করে ডুকরে কেঁদে উঠলো কানাই। বললো, ‘‘পায়ে পড়ি তোমাদের, আমার কাজটা নিও না। বাবা গেলবার গলায় দড়ি দিল। মা লোকের বাড়ি ঝাড়ু দেয়। দুটো ছোট বোন আছে। আমি ভোর বেলা এই ১০টা গাড়ি ধুই, দুপুরে ইস্কুল করি আর বিকেলে বস্তির পেছনে আমার বোনেদের সাথে বিড়ি বাঁধি। তবে গিয়ে কোনরকমে চারটে পেট চলে। তোমারা তো কিছুই জাননা, খালি কাজ কেড়ে নাও। কেন, তোমাদের ঘরেও তো বাচ্চারা কাজ করে গো। টিভিতে নাচ করে, গান করে, টাকা পায়না? ছবি করে, টাকা পায়না? তা তারা কি কাজ না করেই পাচ্ছে? তাদের তো কাগজে নাম ওঠে, কত ভালোভালো কথা ছাপা হয়। কই, তাদের তো পুলিশ ধরেনা? কেন? তবে আমাকে কেন ধরবে? কি চাও তোমরা? আমি ভিক্ষা করি?’’ আর কিছু না বলে চোখ মুছতে মুছতে কানাই চলে গেলো। 

রাই-এর দু চোখে প্লাবন। এ কি করলো সে? বাসুদেব ততক্ষণে নীচে নেমে এসেছে। আস্তে করে রাই এর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘‘খাতায় কলমে লেখা নিয়ম মানলেই যে সব সময় সমস্যার সমাধান হয়, তা নয় সোনা। সরকার নানা রকম নিয়ম বানিয়েছে বটে। তবে কেউ কি ভাবে, শিশুশ্রমিক কারা? তাদের এই শ্রম কেন করতে হয়? না করলে তারা খাবে কি?’’ একটু থেমে বাসুদেব বলে, ‘‘এ এক অচ্ছেদ্যচক্র, রাই, যার শেষ হয়তো কোথাও আছে। চলো, চেষ্টা করি শেষ খোঁজার।’’



6 comments:

  1. ধন্যবাদ দাদা। :)

    ReplyDelete
  2. বড্ড সত্যি কথা লিখেছেন গল্পকার! বড়ই সাচ বাত! বিশ্বাস করুন, আম্মো ঠিক এইভাবে আগে ভেবে দেখিনি.. "কেন, তোমাদের ঘরেও তো বাচ্চারা কাজ করে গো। টিভিতে নাচ করে, গান করে, টাকা পায়না? ছবি করে, টাকা পায়না? তা তারা কি কাজ না করেই পাচ্ছে? তাদের তো কাগজে নাম ওঠে, কত ভালোভালো কথা ছাপা হয়। কই, তাদের তো পুলিশ ধরেনা? কেন?"
    তাই তো!
    কথাগুলো যেন মনের মধ্যে ক্রমশই গেঁথে যাচ্ছে.. গভীরে.. আরো গভীরে..

    ReplyDelete
  3. বড্ড সত্যি কথা লিখেছেন গল্পকার! বড়ই সাচ বাত! বিশ্বাস করুন, আম্মো ঠিক এইভাবে আগে ভেবে দেখিনি.. "কেন, তোমাদের ঘরেও তো বাচ্চারা কাজ করে গো। টিভিতে নাচ করে, গান করে, টাকা পায়না? ছবি করে, টাকা পায়না? তা তারা কি কাজ না করেই পাচ্ছে? তাদের তো কাগজে নাম ওঠে, কত ভালোভালো কথা ছাপা হয়। কই, তাদের তো পুলিশ ধরেনা? কেন?"
    তাই তো!
    কথাগুলো যেন মনের মধ্যে ক্রমশই গেঁথে যাচ্ছে.. গভীরে.. আরো গভীরে..

    ReplyDelete
  4. বড্ড সত্যি কথা লিখেছেন গল্পকার! বড়ই সাচ বাত! বিশ্বাস করুন, আম্মো ঠিক এইভাবে আগে ভেবে দেখিনি.. "কেন, তোমাদের ঘরেও তো বাচ্চারা কাজ করে গো। টিভিতে নাচ করে, গান করে, টাকা পায়না? ছবি করে, টাকা পায় না? তা তারা কি কাজ না করেই পাচ্ছে? তাদের তো কাগজে নাম ওঠে, কত ভালো ভালো কথা ছাপা হয়। কই, তাদের তো পুলিশ ধরে না? কেন?"
    তাই তো!
    কথাগুলো যেন মনের মধ্যে ক্রমশই গেঁথে যাচ্ছে.. গভীরে.. আরো গভীরে..

    ReplyDelete