Next
Previous
Showing posts with label বইপোকার বইঘর. Show all posts
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




বই - স্বপ্নসম্ভবা
লেখক - মহুয়া মল্লিক
প্রকাশক - তুহিনা প্রকাশনী
মুল্য - ২৭৫/-

স্বপ্নসম্ভবা দুটি উপন্যাসের সংকলন। পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত ধারাবাহিক ‘স্বপ্নসম্ভবা’ এবং ‘মুখোশ গ্রামে স্বর্গের ফুল’ উপন্যাস দুটি বই আকারে আনলেন প্রকাশক।

‘স্বপ্নসম্ভবা’ একটি প্রায় ডিসটোপিয়ান নভেল। ডিসটোপিয়ান প্রায়, কেননা উপন্যাসের শেষে লেখক একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছেন। গোড়ার কথা বলি। আমরা যারা বিদেশে কখনও যাইনি, বসবাস করিনি, তাদের কাছে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি এক অদ্ভুত জগত। স্বপ্নময়। সেখানে মানুষ সুখের তুঙ্গে অবস্থান করে। তাদের অভাব বলে কিছু তো নেইই, উপরন্তু জীবনটা যেন হাওয়ায় ভেসে থাকার মতো। উইক এন্ড মানেই পার্টি বা ঝটিকা সফর। গাড়ির মাথায় মাল চাপিয়ে লম্বা সফর, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সুখের হাতছানিতে অনেক বাবা মা তাদের মেয়ের জন্য একটি উপযুক্ত বিদেশবাসী (পড়ুন গ্রিনকার্ড হোল্ডার) পাত্র খোঁজেন। মেয়ে চোখের সামনে না থাকলেও চলবে। সে তো সুখের স্বর্গে যাচ্ছেই, উল্টে বাবা মাও একরকম শ্লাঘা অনুভব করতে পারেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে একটা চাপা (কখনও কখনও প্রকাশ্যেই) গর্ব প্রকাশ করেন। ওদিকে যে মেয়েটি উপযুক্ত পাত্রের হাতে পড়ে বিদেশে সংসার পাততে গেল, তার হাতে কিন্তু ম্যারেজ সার্টিফিকেট ছাড়া যোগ্যতার আর কোনো সার্টিফিকেট থাকছে না। এদেশে সে হয়ত কিঞ্চিত পড়াশুনো করেছে, কিন্তু তার মুল্য ওদেশে বিন্দুমাত্র নেই। ফলে, সে এই আশাতীত সুখের সংসার গড়তে সদা সচেষ্ট। সপ্তাহ-শেষের পার্টিতে সে গুচ্ছের রান্নাবান্না করে ঘর সাজিয়ে ইকেবানা করে স্বামীর বন্ধুবান্ধবের মনোরঞ্জন করে। স্বামী এটি তার প্রাপ্য বলেই মনে করে। সে তো হাউজ ওয়াইফ বিয়ে করেছে! ফলে, পিতৃয়ার্কি, বা পিতৃতন্ত্র, বা ক্ষমতাতন্ত্র, যে নামেই ডাকি, সে তার কাজ শুরু করে দেয়। মেয়েটি বাপ মায়ের অহংকার বাড়াতে, স্বামীর কাছে গ্রহণযোগ্য থাকতে এরপর অত্যাচারিত হয়েও মুখ বন্ধ রাখে। ক্রমশ সেই অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। ফেসবুকে যে সুখী দাম্পত্যের ছবি লটকানো হয়, নিত্য নতুন পদের ছবি, বাগানের ছবি, সেসবের মধ্যে দিয়ে মেয়েটির সম্পর্কের কালশিটেগুলো দেখতে পাওয়া যায় না। ‘স্বপ্নসম্ভবা’ এমনই কয়েকটি মেয়ের গল্প। একে ডিসটোপিয়া বলব না? লেখক অবশ্য শেষে এদের প্রত্যেকের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার, কোথাও বা ফিরে আসার একটি চিত্র এঁকেছেন। সাহিত্যে যেটুকু আশ্বাস দেওয়া যায় আর কি। আমার যেন মনে হয়েছে, তিনি আসলে আমাদের এই আদেখলাপনাকেই বিদ্রুপ করেছেন। মেয়েদের বিয়ের জন্য বিদেশবাসী কৃতী পাত্র খোঁজার চেয়ে যে মেয়েটিকে স্বাবলম্বনের পথে এগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এই চেতনা হতে গেলে মোহমুক্তির প্রয়োজন। লেখক যে সত্যটা তুলে ধরেছেন সেটি সমসাময়িক ঘটনাবলীর উল্লেখযোগ্য দলিল। একেবারে শেষে তৃষার নিজেকে নিয়ে উৎসব উদযাপন মুক্তির কথা বলে। এই মুক্তিতে একটি মানুষ স্বয়ং সম্পূর্ণ। তার চেতনায় আর কারোর উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। একেবারেই নেই। এর চেয়ে বড় উত্তরণ আর কী হতে পারে।

‘মুখোশের গ্রামে স্বর্গের ফুল’ আকারে ছোট। এটি অবশ্য একটি মেয়ের আত্মানুসন্ধানের গল্প। এখানেও গার্হস্থ্য অত্যাচার পেরিয়ে উত্তরণ। তবে এই উপন্যাসের বিশেষত্ব হল, পুরুলিয়ার ঐতিহ্য, ছৌ নাচের মুখোশ সম্পর্কে লেখকের বিস্তারিত গবেষণা। কাহিনীর উৎকর্ষ ছাপিয়ে এই গবেষণা সেখানে প্রান্তিক মানুষের জীবন যাপন ও শিল্পানুরাগের চিত্র তুলে ধরেছে। এটি গোচরে আসা দরকার। একই ভাবে কিভাবে সেখানেও শিল্পীর স্বাধীনতাকে খর্ব করে তার অর্থনৈতিক দুর্গতি বজায় রেখে পুঁজির আস্ফালন চলে, সেটিও স্বল্প পরিসরে জানিয়েছেন লেখক। সমাজসচেতনতা দুটি উপন্যাসেরই মূল লক্ষ্য।
2

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




















বই - চরের মানুষ
লেখক - তৃষ্ণা বসাক
প্রকাশক - ধানসিড়ি
মুল্য - ২৫০/-

বাঙালির জীবনে যে কয়েকটি জাতীয় বিপর্যয় ঘটেছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি। প্রথম হল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। ধর্মের ভিত্তিতে সজীব শরীরকে কাটাছেঁড়া করলে যে পরিমাণ যন্ত্রণা, রক্তপাত ও মৃত্যু ঘটতে পারে তাই হয়েছে তখন। দ্বিতীয়টি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠা। সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বভাবগুণ কিন্তু বাংলাদেশকে প্রতীক্ষিত শান্তি দিতে পারেনি। অজস্র পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাত, ধর্মের নামে হানাহানি, বর্ণবিদ্বেষ, এইসব কাটাকুটির দাগ নিয়ে এই নবীন দেশ বাঁচতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশের মানুষই তো শেষ পর্যন্ত দেশ।

আমরা দেশভাগের ওপরে নানা প্রামাণ্য দলিল পাই। ইতিহাস, ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস, সিনেমা ইত্যাদি নানা মাধ্যম আমাদের চোখের সামনে এনে দেয় সেই সময় যখন ওপার থেকে হাজারে হাজারে মানুষ সব খুইয়ে শুধু ধর্মের বিভিন্নতার অপরাধে এপারে এসেছেন। সব কৌলীন্য সব সম্পদ ফেলে রিফিউজি কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছেন। রেশনের চালে ভরসা করে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চেয়েছেন। প্রথম প্রজন্মের এই শিকড়ছেঁড়া মানুষজন কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের একটি বড় অংশ। তাঁরা লড়াই করে মাথা তুলেছেন।

কিন্তু পরবর্তী সময়, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যারা চলে এলেন, পালিয়ে এলেন, পালাতে গিয়ে মারা পড়লেন, তাঁদের যুদ্ধ জটিল। তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই সেখানে থাকবেন, এমনটাই আশা ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তাঁরা বাঙালি হলেও হিন্দু হবার অপরাধে টিকতে পারছেন না। রাজাকার নামক এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও মৌলবাদী ধর্মযাজকদের সঙ্গে মিলে সেখানে নিদারুণ অবস্থার সৃষ্টি করে। এসবই আমাদের জানা ইতিহাস। গ্রাম কে গ্রাম লুঠতরাজ, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যা, এক নারকীয় বাতাবরণ তৈরি করে।

এত ইতিহাসের মধ্যে একটি কাহিনী লেখা হল না। যেসব হিন্দু পরিবার ওপার বাংলা ছেড়ে এপারে এলেন না, কোনোভাবে আশ্রয় পেয়ে গেলেন, বা ‘কেন আমি দেশ ছাড়ব?’ এই ভেবে রয়ে গেলেন, তাঁদের জীবনযাত্রা কেমন হল? তৃষ্ণা বসাকের উপন্যাস চরের মানুষ এই অন্য যাপনের কথা বলে। এই আপাতদৃশ্য কাহিনীর স্রোতের মধ্যে অন্তঃসলিলা আর একটি ধারা তাঁর লেখায় বর্তমান। সেটি হল, মেয়েদের অবস্থান। এই যে সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরন্তর বদল, সংগ্রাম, এর মধ্যে তাঁদের স্থানটি কোথায়? তাঁরা এই যুদ্ধে যুধিষ্ঠির বা শকুনি, কার হাতের পাশা? চালে জিতলে তাঁদের অবস্থা কী হল? হারলেই বা কি হল?

উপন্যাসের মূল চরিত্র টুনু। তার বাবা ডাক্তার। ডাক্তার বলে সমাজে তিনি সম্মান পান। পরোপকারী সদাশয় মানুষ। তাঁর নিজের ছেলেটি মুসলমানের হাতে খুন হয়, সেকথা জেনেও তিনি কখনও কাউকে দোষারোপ করেননি। এ কি তাঁর মহত্ত্ব? নাকি নিরাপত্তাহীনতা? মুসলমানের দেশে ভিটে আঁকড়ে থাকতে গেলে এ মেনে নিতে হবে। ফলে, দেশের অন্যান্য সংকটের সময় তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যেরা কেউই অংশ নিলেন না। মূলস্রোতে মিশলেন না। দেশের মধ্যে থেকেও যেন তাঁরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে গেলেন। নদীর ধারার মাঝে বিচ্ছিন্ন চর। তাঁরা সেই চরের মানুষ।

টুনুর মায়ের অনেকগুলি সন্তান। মেয়ের সংখ্যাই বেশি। এই টুনুর শৈশব, বাবার স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও, কেমন বদলে গেল। সে তিনবেলা এখনও ভাত খায়, মাছ খায়, কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর জীবনকে দেখার স্ফূর্তি রইল না। মনে পড়ে ঠাকুমা প্রভাসুন্দরীর কথা, “সংসারে ভাতের কষ্ট ছাড়া আরও কত কষ্ট আছে, বড় হলে বোঝবা”। যদিও দাদা স্বরাজের বন্ধুরা স্মরণসভা ডেকেছে ও তার বন্ধু ইদ্রিস, শামিম স্বরাজকে হারিয়ে কষ্ট পেয়েছে তবুও কোথাও একটা বিভেদরেখা টের পাওয়া যায়। উপন্যাসের প্রথম পর্বে এর পাশাপাশি টুনুর বন্ধু পপির মা, নুসরত খালার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মেয়েসন্তানের জননী হবার দোষে তাঁর স্বামী ইন্ডিয়া থেকে আসা একটি মেয়েকে বিয়ে করে। নুসরতখালা রাতারাতি মেয়েদের নিয়ে চলে যান। কেউ টের পায় না কোন চরে তাঁর ডিঙি ভিড়েছিল। নিরুদ্দেশে গেলে কি আর দেশ থাকে? মেয়েদের দেশ নেই, নিরুদ্দেশ আছে।

দ্বিতীয় পর্বে টুনুর বিয়ে, শ্বশুরঘরের পাশাপাশি, ময়মনসিংহ টাউনে বড় হওয়া টুনুর লৌহজঙ্গ নদীর কিনারে ধুপতারা এসে গ্রাম্য নীচতা দেখে স্তব্ধ হবার পালা। তার ডাক্তার স্বামী অমর, যে কিনা নিজের মৃত ছোট ভাইটিকে এক মুহূর্ত ভুলতে পারে না, সে পর্যন্ত নিজের চারিত্রিক স্খলনকে পুরুষের ফুর্তির স্বাধীনতা মনে করে। এ দেশের মুক্তির সংগ্রামে তার যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে সেকথা সে স্বীকার করে না। অথচ সে চাকরি পায় এমনই এক হিন্দু ভূমিপুত্রের হাসপাতালে। যিনি সেবাকে পরম ধর্ম মনে করেছিলেন, ও শেষ পর্যন্ত, পাকিস্তানের সেনারা যাকে হত্যা করে। অমরের চরিত্রের বৈপরীত্য একান্ত স্বাভাবিক। সে তাই ইন্ডিয়া চলে আসতে চায়। সরল টুনু ধীরে ধীরে শিখতে থাকে। মেয়েমানুষের জীবন এমনই হয়।

কখনও কখনও দেশ আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষের মনে ইন্ডিয়া পাকিস্তান জোড়া লাগার স্বপ্ন ভাসে। নাগরিক অধিকার স্পষ্ট হয় যে! নইলে যে নিজভূমে পরবাসী!

এই উপন্যাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় চট্টগ্রাম। জেসমিন ইমাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করছেন। বেগম সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগম ও বিশিষ্ট মহিলারা চট্টগ্রামে মিছিল করেছেন। সেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। বিদ্রোহ যে মাটির স্বভাব। ডক্টর দেব, প্রফেসর সাগিরুদ্দিন, জেসমিন ইমাম, এঁরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! সে এক বিভীষিকাময় রাতে আক্রান্ত হল বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর। খুন হলেন ডক্টর দেব। বহু বহু মেয়ে ধর্ষিত ও খুন হল। তবু সেই রাতের কথা আমার বুকের মধ্যে নিরাময়হীন ক্ষত তৈরি করল। অথচ এর মধ্যেও জেগে রইলেন জয়ন্তী, টুনুর মেজোবউদি। জ্যাঠতুতো দাদার খৃষ্টান বউ। আদিবাসী খৃষ্টান। কিন্তু শিক্ষায় সভ্যতায় সে শহুরে মেয়েদের থেকে অনেক এগিয়ে।

অসংখ্য নারীচরিত্র, কেউ সিনেমার নামকরা নায়িকা হয়ে পাকাপাকি লাহোরে প্রতিষ্ঠিত, কেউ বা খানসেনাদের হাতে ধর্ষিত ও খুন হবার আগে হাসপাতালে যুক্ত ছিলেন। কেউ গ্রামের তাঁতিবাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে শহরে সওদা করেন। কেউ পরিবারের দারিদ্র কি করে ঘোচে সেই ভেবেই দিনপাত করেন। অদ্ভুত নকশিকাঁথার মতো ভেসে ওঠে এক অলৌকিক চর। মেয়েরাই যার বাসিন্দা।

সবশেষে বলব বসাক তাঁতিদের কথা। এত গবেষণা করে লেখা যখন তখন অবশ্যই লেখিকা জেনেছেন, এখনও ঢাকিয়া বসাক বা ঢাকাই বসাকদের প্রতিপত্তি অব্যাহত। তারা ধনী। তাদের বিগ্রহ এখনও পূজা পায়। এই যে তথ্য উপন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তা পরবর্তীতে ইতিহাসের উপাদান হবে।

তৃষ্ণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বাংলাদেশের এক একটি জেলার ডায়ালেক্ট, খাদ্যের বৈচিত্র্য, জীবিকার নানা ধরণ, উৎসবের কথা তিনি নিপুণভাবে উপন্যাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। অথচ ভূমিকায় জানা যাচ্ছে, তিনি ঢাকিয়া বসাক তো ননই, তিনি শেকড়সুদ্ধু এপার বাংলার। তবু যে কত মমতায় ত্তিনি এ কাজ করেছেন ভাব্লে মুগ্ধ হই। তাঁর এ কাজটি থেকে যাবে। তবে প্রত্যাশাও থাকল, পরের পর্ব হয়ত আসবে। বাঙালি হয়ে বাঙালির এই ইতিহাসের ওপরে আরও লেখা পড়ার ইচ্ছেটা রয়ে গেল।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

এক ডজন সাম্য
সাম্য দত্ত

আলোচ্য বইটি এক নবীন লেখকের লেখা। সাহিত্যের কোনও প্রথাগত শিক্ষায় দীক্ষিত না হয়েও পাতায় পাতায় এক অদ্ভুত কল্পবিশ্ব গড়ে তুলেছেন তিনি। খুব আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে, যে লেখকের বিচরণ অতি অনায়াস এবং সাবলীলভাবে তিনি নানা কালস্তরকে ছুঁয়ে সৃষ্টি করে গেছেন একেকটি কাহিনীর। এ বইয়ের প্রথম সাতটি গল্পে পাঠক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সত্যজিৎ রায়ের কথনশৈলী ও কাহিনী বুননের আভাস পেতে পারেন। এটি বিশেষ আনন্দের। এখনও কোনও নবীন যে এমনভাবে পূর্বসূরিদের সৃষ্টিতে প্রভাবিত ও আপ্লুত তা আমাদের আশা দেয়।

লেখকের শেষ গল্পগুলিতে বিচরণ করেছেন কথামৃত প্রণেতা শ্রীম, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, সত্যজিত রায়, এবং মারাঠা রাজনীতির এক জটিল ও শোকাবহ অধ্যায়। এই সব গল্পগুলিতেই তিনি আধুনিক কালকে মিশিয়েছেন স্বচ্ছন্দে। কোনও কোনও গল্প পড়তে পড়তে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। কোনওটিতে চোখের জল ধরে রাখা দায় হয়। লেখকের সাহিত্যজীবন উজ্জ্বল।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ বছরে জন্মে ঊনবিংশ শতকের অর্ধেকের আগেই মারা যান আলেক্সাণ্ডার পুশকিন। রাশিয়ায় তখন জারের শাসন। রাজতন্ত্রের মহিমায় তথাকথিত অভিজাত সমাজ এক অদ্ভুত সমাজে বিচরণ করে। সমাজের নীচু তলার মানুষদের সঙ্গে তাদের কোনোই যোগ নেই। সংযোগের অভাবে শ্রেণীগুলির মধ্যে কাল্পনিক ধারণা গড়ে উঠছে। কেউই কাউকে জানছে না। এরকম পরিবেশে পুশকিনের আবির্ভাব। মাত্র পনেরোতে কবিতা লিখে সুনাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু তখনও মানুষ বোঝেনি তাঁর কলম ঠিক কতটা তীক্ষ্ণ। পুশকিন নব্য রাশিয়ার অগ্রণী লেখক বলে পরিচিত হবেন, তার প্রমাণ হিসেবে তাঁর প্রথম গদ্যের প্রকাশ হলো "ইভান পেট্রোভিচ বেল্কিনের বলা গল্প" নামের বইটিতে। মাত্র পাঁচটি গল্প। দ্য শট, ব্লিজার্ড, দ্য আন্ডারটেকার, দ্য পোস্টমাস্টার, লেডি ইনটু ল্যাসি।

গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট যদিও প্রাচীন রাশিয়া কিন্তু ট্রিটমেন্ট এতই আধুনিক যে সময় সময় চমকে উঠি, হয়তো এ লেখক পুরোনো কালকে নিয়ে একটু ছেলেখেলা করছেন। কি অসম্ভব রসবোধ ! প্রতিটি গল্পে একটা অন্তর্লিন স্যাটায়ার পাঠকের ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দেয়। আমরা বুঝতে পারি, সেই সময়ের রাশিয়ার অন্তঃসারশূন্য সমাজের ছবি বিপ্লবের বহু আগেই এঁকেছেন পুশকিন। আর তাই হয়তো জার প্রথম আলেক্সাণ্ডার তাঁকে নির্বাসন দিয়েছিলেন।

বইটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। আমাজনে কিনতে পাওয়া যায়।
1

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল



এ সংখ্যার বইয়ের নাম ‘জীবক’। লেখক নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী। জীবক ছিলেন মহারাজ বিম্বিসার এবং অজাতশত্রুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। ছিলেন তথাগত বুদ্ধেরও চিকিৎসক। তাঁর মনীষা সেইসময়ের ভারতবর্ষে বহুদূর বিস্তৃত ছিল। আমরা তাঁর জীবন সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি। অথচ জীবক এত প্রতিভা ধরতেন যে তক্ষশীলার আচার্য তাঁকে ভবিষ্যতের রত্ন বলে চিনে নিয়েছিলেন। রোগ নিরাময় ও নির্ণয় ছাড়াও তাঁর শল্য চিকিৎসাতেও বিশেষ নৈপুণ্য ছিল। এইটুকুই আমাদের জানা। বাকি যা ইতিহাস, লেখক তা পুনরুদ্ধার করেছেন যত্নে। জাতক ছাড়াও বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি। এবং সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছেন রক্তমাংসের একটি চরিত্র। ইতিহাসে যাকে সেভাবে রচনা করা হয়নি। যাঁরাই প্রাচীন ভারত সম্পর্কে আগ্রহী তাঁরা এই বইটি পড়তে পারেন। শুধুই জীবক নন, তথাগত বুদ্ধের কাহিনীও এখানে সুন্দর করে লেখা হয়েছে। সেই সময়ের রাজনৈতিক পটভূমি সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং ধর্মীয় অবস্থার একটি পরিপূর্ণ চিত্র আঁকা হয়েছে। অজাতশত্রু ও বিম্বিসারের কাহিনীতে যে নির্মম পরিবেশ পড়ে শিউরে উঠি, যে পরিবেশ সম্পর্কে স্বয়ং তথাগত নিস্তব্ধ থাকেন এবং আমার মনে ক্ষোভ জমতে থাকে, লেখকের কলম আমাকে সেই পরিবেশ ও তথাগতর আচরণের যৌক্তিকতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তথাগত যে পরিপার্শ্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত! নির্বাণ যে সকল রকম পার্থিব সুখ দুঃখের অতীত অবস্থা! তাঁর কাছে তাই বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। কে তাঁকে অনুসরণ করে আর কে শত্রুতা করে তা তাঁর মনে রেখাপাত করেনা। কিন্তু জীবক জানতে চাইলে তিনি বলেন বিম্বিসারের পূর্বজন্মে সঞ্চিত কর্মফলের কথা। জন্মান্তর সম্বন্ধে আমাদের মতামত যাই থাকুক, আমরা এটুকু বুঝে যাই যে মহামানব একটি যুক্তি তৈরি করছেন। যে যুক্তিতে বিম্বিসারের অর্জিত কর্মফলই তাঁর দুঃখের কারণ বলে ধরা যাবে। রাজা যে কুটিল পথেই শাসন করেন!

বইটিতে লেখক জীবকের চিকিৎসার ধরণ এবং কতগুলি বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসার বর্ণনা দিয়েছেন। এর জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটিও তথ্যের অভাব সরিয়ে দিয়ে নিপুণভাবে রচনা করেছেন।

বইটি নিয়ে একটিই অভিযোগ। এত কম শব্দে এমন দীর্ঘসময়ের বৃত্তান্ত পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, লেখক যেন কোথাও কোথাও হঠাৎ কলম থামিয়েছেন।

যাঁরা তক্ষশীলা, তথাগত, জীবক ও অজাতশত্রু সম্পর্কে জানতে ভালোবাসেন, তাঁরা এই বইটি অবশ্যই পড়বেন। ভালো লাগবে। 

প্রকাশকঃ এবং মুশায়েরা
দামঃ ২০০/-
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


শশাঙ্ক
লেখক – রাজীব মজুমদার
প্রকাশনা – আজকাল
মুল্য- ১৫০/-


ইতিহাসাশ্রিত গল্প একসময় তত বেশি লেখা হতোনা। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, যাঁরা বেশ বিদ্যেবুদ্ধি ধরতেন, তাঁরাই এ জাতীয় রচনায় হাত দিতেন। বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসনির্ভর লেখা তাই বলে কম নয়। বলতে চেয়েছি, অন্য লেখার চেয়ে অনেক কম। এটি একটি তুলনামূলক উক্তি। ইদানীংকালে ইতিহাস আমাদের প্রিয় চর্চা হয়ে উঠেছে। যে আমরা নিজেদের পঠনপাঠনে ইতিহাসকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছিলাম, সেই আমরাই জীবনের প্রিয় নেশা হিসেবে ইতিহাস চর্চায় মন দিয়েছি। কেন? কারণ ইতিহাস আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে মূল্যবান অতীত। যে অতীত নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। ইতিহাস আমাদের জানিয়েছে, কেন আমরা কোনও বিশেষ বিশেষ ঘটনা থেকে শিখে নেব জীবনের পাঠ। সত্যি বলতে,পড়ে পাশ করতে হবে, এই উদ্বেগ যদি না থাকত, তবে আমাদের ইতিহাসের জ্ঞান আরও বিস্তৃত আরও গভীর হতে পারত। ভালোবাসার বয়স বেশি হতো। শিক্ষানীতিবিদেরা এটি ভেবে দেখতে পারেন। তবে একটি কথা। কোন ঘটনাকে কোন আলোয় দেখব, সেটি যাঁরা স্থির করেন, তাঁদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা অবশ্যই আশা করব আমরা। না হলে পুরনো দিনের রাজপুষ্ট ইতিহাস রচয়িতাদের মতো একপেশে মিথ্যে ইতিহাস পড়তে হবে। পণ্ডিতেরা সহজেই ধরে ফেলবেন ও ইতিহাসে কতটা দুধ আর কতটা জল। সেটি বড় লজ্জার হবে আমাদের উত্তরপ্রজন্মের জন্য।

এ তো গেল এখনকার কথা। আমি বলি প্রাচীন ইতিহাসের পাতা উল্টে, যেখানে অন্ধকার কিংবা ছেঁড়া পাতা জলে গিয়েছে,সেই সব শূন্যস্থান পূরণের প্রয়াসও তো অব্যাহত রাখতে হবে! আর কতকাল আমরা মিথ্যে ইতিহাস পড়ব? ধান ভানতে শিবের গীত নয় ঠিক। কারণ, আলোচ্য বইটিতে লেখক রাজীব মজুমদার যত্নে ভালোবাসায় উদ্দীপ্ত হয়ে তুলে এনেছেন বাঙালির প্রিয়, বাঙালির গর্বের এক প্রাচীন পুরুষকে। আহা! শশাঙ্ক! স্বাধীন বাংলার স্থপতি! এর আগে গৌড় রাজ্যের তেমন কোনও উল্লেখ আমরা প্রাচীন ইতিহাসে বা সাহিত্যে পাইনা। পাইনা কোনও সার্বভৌম নৃপতির নাম। শশাঙ্ক আমাদের প্রথম নায়ক। এই বইটিতে আমরা সেই সময়ে ঘটে চলা গৌড় মালব কান্যকুব্জ ও উত্তরাপথস্বামী হর্ষবর্ধনের জটিল দ্বন্দের কাহিনী পাই। একই সঙ্গে জানতে পারি, রাজার নীতি কত উদার কত ক্ষমাশীল ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রের শত্রুতা যে কখনও ব্যক্তিগত শত্রুতায় পর্যবসিত হতোনা, তার প্রমাণ পাই। এই সময়ে এই বইটি তাই অতি উপযোগী এক পাঠ। আমরা যে রাজনীতিকে সর্বনিম্ন এক শিক্ষায় নিয়ে যেতে বসেছি!

ভারী সুন্দর বই! রাজীব বহু যত্নে অন্ধকার সময়ে আলো ফেলেছেন। তাঁর কল্পনা কখনও ইতিহাসের কণ্ঠরোধ করেনি। খুবই দক্ষ হাতে সেটি সামলেছেন তিনি। অথচ শশাঙ্ককে নিয়ে যে সঙ্গত আবেগ তাঁর মধ্যে কাজ করেছে তাই দিয়ে তিনি হর্ষকে নীচু করেননি। এই তো সঠিক নীতি! ভীমা লেখকের সৃষ্টি। অপূর্ব চিত্রণ! শ্রমণ পরিমলও তাঁর সৃষ্টি। সুন্দর কিন্তু সামান্য স্থান জুড়েছেন পরিমল। লেখকের কাছে একটিই অনুরোধ, ভবিষ্যতে পরবর্তী সংকলনে তিনি যদি শ্রমণকে আরেকটু বিশদ করেন! করুণায় স্নাত হতে কে না চায়? মুদ্রণ সম্পর্কে একটি খারাপ কথা বলতেই হচ্ছে। এমন নামী প্রকাশনার বইতে বানানসহ প্রুফে নানা ভুলভ্রান্তি নজরে এলো। এমনকি, শব্দের পুনরাবৃত্তিদোষও আছে। আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে প্রকাশক সেদিকে নজর দেবেন। পরিশেষে বলি, বাঙালির গর্বের এই বিশেষ অধ্যায়টি জানতে পাঠক বইটি পড়ুন। বিষয়বস্তু এর চেয়ে বিশদ করবনা।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


আদিপর্ব (অমৃতা পাতিল)

আদিপর্ব নামটির সঙ্গে আমাদের ভারতবর্ষের সেই প্রাচীন ও বিখ্যাত মহাকাব্যের নামটি জড়িয়ে আছে আদিতেমহাকাব্য মহাভারত শুরুরও আগে কেমন করে আমাদের ভূখণ্ডে সভ্যতা জন্ম নিয়েছিল তারই রূপক আধারিত কাহিনী এটি কিন্তু একে কাহিনী বলা ভুল গ্রাফিক নভেলের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে তেল রঙে আঁকা অসাধারণ সব চিত্রের মধ্যে অল্প একটি দুটি বাক্যে কাহিনী তৈরি করা হয়েছেতফাত একটাই প্রতিটি ছবি কথা বলেপড়বার সময় বাক্যের সঙ্গে চিত্রকে মিলিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে একবার সেই ভাবনার পথ ধরে নিজের মনোজগতে প্রবেশ করতে পারলে চিরন্তন সেই মহাকাব্যের নতুন এক ভাষ্য উপলব্ধি করতে পারা যায় অমৃতা পাতিল একই সঙ্গে চিত্র এঁকেছেন এবং রূপকার্থ বাক্যগুলি লিখেছেন 

বইটির প্রচ্ছদ ধরেই আলোচনা করি দেখা যাচ্ছেমৃত্যুর হিমনীল সাগরে অনন্ত নাগের একটি ফণার ছত্রতলে অনন্ত শয়ানে বিষ্ণু আমরা ভাবতে শুরু করিব্রহ্মাণ্ড জন্ম নিলে বিষ্ণু অবতরণ করবেন পালন করবেন কোন ব্রহ্মাণ্ডযা মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে সেই ব্রহ্মাণ্ড এরকম ভাবতে গিয়ে যখন চিন্তা সীমায়িত হচ্ছে তখনই চিত্রের মধ্যে একে একে ভাসছে অনন্ত নাগের অনন্ত সংখ্যক ফণার নীচে অসংখ্য বিষ্ণু শয়ানঅর্থাৎ অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড এ বড় কম নয় অমৃতা একটি মাত্র চিত্রের মধ্যে আমাদের ভূমার অনুভূতি দিয়েছেন সান্ত ছেড়ে আমরা অনন্তে পৌঁছেছিন্যাভিগেশন অফ মাল্টিভার্স অধ্যায়টিই ধরা যাক সৃষ্টি সূত্রের এমন অভিনব এবং প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা আমি আগে পড়িনি ছবির কথা না বললে এ বইয়ের কিছুই বলা হলো না উক্ত অধ্যায়টি এমন সুন্দর অনুভব করতে পারা গেছে শুধু ছবির জন্যেই 

আধুনিক কালে অনেকেই মহাকাব্যের নতুন নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন অমৃতার আদি পর্ব সেদিক দিয়ে একেবারেই অনন্য অল্প অথচ অর্থপূর্ণ বাক্যে এবং ছবিতে তিনি একটি দিশা দিয়েছেন পাঠক বা দ্রষ্টা যাতে নিজের মনোজগতে একটি ছবি আঁকতে পারে 
বইটির প্রকাশক হার্পার কলিন্স 
মূল্য ৭৯৯/- 
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in
বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


দ্য গ্রেভইয়ার্ড বুক 
লেখক – নীল গাইম্যান 

যত দিন যাচ্ছে, ততই ছেলেবেলায় পড়া রূপকথাগুলোর মধ্যে থেকে অদ্ভুত সব অন্য গল্প বেরিয়ে আসছে। রূপকথারা রূপকথা থাকছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে সমকালীন সভ্যতার কালো দিক। দেশের, সমাজের রাজনৈতিক ইতিহাস। এ নিয়ে নিত্যনতুন ডিসকোর্স তৈরি হচ্ছে। সাহিত্য ইতিহাস সমাজ বিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে সমান্তরাল তত্ত্ব ও দর্শন তুলে ধরছে। হ্যারি পটারের গল্পে যে এত ক্লাস স্ট্রাগল, এত শোষণ লুকিয়ে আছে, সেটা ভাববার কথা। তা সত্ত্বেও হ্যারি পটার কিন্তু অনবদ্য রূপকথা। 

আলোচ্য বইটি এসময়ের অন্যতম শক্তিশালী কলম থেকে বেরিয়েছে। নিজস্ব একটা পক্ষপাত কাজ করছে বই কি! 

একটি অনাথ ছেলে (আশ্চর্য সমাপতন! নয় ? হ্যারির বাবা মাও খুন হয়েছিলেন) কয়েকমাস বয়সেই আততায়ীর হাত থেকে চলে গেলো একটি কবরখানায়। সেখানে সে কবরখানার বাকি লোকজনেদের মধ্যে বড় হতে থাকল। তাদের কেউ কেউ কয়েক হাজার বছর ধরে সেখানে আছে।ছেলেটি সেখানেই জীবনের পাঠ নিলো। তার পালকপিতা ও মাতা এবং অভিভাবক তাকে তৈরি করে দিলো পৃথিবীতে লড়াই করে বাঁচবার জন্য।মৃতর শক্তি জীবিতের চেয়ে কম নয়! বরং যে দেখতে জানে, সীমা ছাড়াতে জানে, তার কাছে অন্তহীন ধরা দেয় সে। 

এরকম জাদু থাকলে দুনিয়ার কোনো শক্তিই তো একলা অনাথ শিশুকে কষ্ট দিতে পারেনা! 

এ বইটি পড়লে ফ্রিডম অফ দ্য গ্রেভইয়ার্ড লাভ করা যাবে কিনা জানিনা, তবে নিশ্চিত একটি রূপকথার আড়ালে ধ্রুব সত্যটি জানা হবে। 

জীবন রূপকথার মতোই। শুধু চোখ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও তাকে দেখতে হবে।

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর 
অনিন্দিতা মণ্ডল



সম্প্রতি পড়লাম চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনির লেখা দ্য প্যালেস অফ ইলিউশানস। যাঁরা মহাভারত পড়েছেন বা শুনেছেন এ বই তাঁদের কাছে বিষয় হিসেবে অতি পরিচিত। তাহলে কি আমরা আরেকবার মহাভারত পড়ব? না। এ কাহিনীর ভিত্তি মহাভারত। কিন্তু কাহিনীর গতি ক্রমশ হিংসা দ্বেষ ক্রোধ থেকে দুঃখ ও শোকের আবরণে কখনো একক মানবের কখনো বা সমগ্রতায় আধ্যাত্মিক উত্তরণে উন্নীত। কী অপরূপ উপলব্ধির জগৎ খুলেছেন চিত্রা! তাঁর লেখনী যেন স্বয়ং পাঞ্চালী। কিংবা, এই সময় দাঁড়িয়ে আমরাও কি সেই সব চরিত্রের অজ্ঞেয় অন্ধকারে ডুবে যাই না? এখানে দ্রৌপদী কথাকার। নিছক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং দেহের আপাতপ্রকাশ লিঙ্গবৈশিষ্ট ছাড়িয়ে তাঁর স্বপ্নচেতনায় তিনি কখনো নারী কখনো পুরুষ। কখনো বা শিখণ্ডী। স্বপ্নে তাঁর কাছে অতীত ভবিষ্যতের সীমারেখা ছাপিয়ে জেগে ওঠে কাল, মহাকাল। আর তাই টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে একরকম ধ্যানমগ্ন দ্রৌপদী দেখতে পান ও শুনতে পান কুরুক্ষেত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ। শুনতে পান অর্জুনের সেই দিব্য সারথির কণ্ঠস্বর। যা কিছু আছে সবই অনিত্য। আজ যা সত্যি কাল তা নেই। পার্থিব সম্পদ তো বটেই এমনকি স্নেহ ভালোবাসার মতো মানবিক সম্পদও অনিত্য। যা কিছু ঘটছে তা আসলে পূর্বনির্ধারিত। নিয়ন্তার অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে আমরা পুতুলের মতো নেচে চলেছি। দ্রৌপদী প্রত্যক্ষ করছেন যুদ্ধ, আর ধীরে ধীরে দিব্যপাবকসম্ভূতা নারী খোলসের মতো ত্যাগ করছেন তাঁর ঘৃণা ক্রোধ আর জিঘাংসা। উত্তরণ ঘটছে তাঁর আত্মার। আমরা জানি যে পঞ্চস্বামীকে বরণ করতে কি ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলেন দ্রৌপদী! চিরকাল কুন্তীকে দায়ী করেছেন নারীত্বের অসম্মানের কারণে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন নারীর সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত সরে গিয়ে সে স্থান নিয়েছে সহানুভূতি। সমব্যথী হয়ে অনুভব করেছেন কুন্তী নিজের প্রবৃত্তির বশে বালিকাকালে যে ভুল করেছেন তার মাশুল গুনেছেন জীবন ভরে। আহা মানুষ! প্রবৃত্তির কাছে সেও কি শক্তিহীন নয়? সমস্ত কাহিনী জুড়ে যে অনুচ্চার অস্তিত্ব আমাদের একটি প্রেমের ভুবনে নিয়ে যায় সে অস্তিত্ব কর্ণের। মানবিক প্রেমের অস্তিত্ব। আমাদের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে চিত্রা লিখেছেন, দ্রৌপদী প্রথম থেকেই কর্ণের প্রতি প্রেমাসক্ত। কর্ণও তাই। কিন্তু দুজনেই অপার সংযমের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রেমকে নিয়ে গিয়েছেন আধ্যাত্মিকতায়। অপূর্ব সে অনুভব! 
আমরা জানি যে কৃষ্ণ, মথুরার কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মানুষ এক হলেও চরিত্রে বিস্তর ফারাক। বৃন্দাবনের প্রেমিক কৃষ্ণ রাধা বিনে অসুখী। দ্রৌপদীকে আমরা এক বিষাদাচ্ছন্ন প্রবল অহংকারী নারী বলেই জানি। রাজা কৃষ্ণ যাঁর সখা। আবাল্য সখ্য তাঁকে কৃষ্ণের অতি নিকটে নিয়ে গেলেও তা কখনোই মধুর ভাবের অনুসারী হয়নি। বিপদেআপদে কৃষ্ণ শুধু কৃষ্ণাকে রক্ষা করেছেন। কখনো দৈহিকভাবে উপস্থিত থেকে, কখনো বা চেতনার গভীরে জেগে। 
এ কাহিনীর শেষে মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী জেনে দ্রৌপদী মহাপ্রস্থানে চলেছেন। সঙ্গে স্বামীরা থাকলেও প্রথা অনুযায়ী কেউই পতনোন্মুখ দ্রৌপদীর হাত ধরতে পারছেন না। তিনি দেহের সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেও শুনতে পাচ্ছেন। কারণ শ্রবণশক্তি গর্ভেই আসে আর সবশেষে যায়। (আমরা জানি শুকদেব মাতৃগর্ভে থাকাকালে বেদ শুনে শুনে বেদজ্ঞ হন। পরীক্ষিতও।) দ্রৌপদী শুনতে পাচ্ছেন যুধিষ্ঠির ও ভীমের কথা। অনুভব করছেন প্রথম পাণ্ডব সব বুঝেও কর্ণের প্রতি তাঁর প্রেমের কথা গোপন করছেন। তিনি কৃতজ্ঞ বোধ করছেন। মৃত্যুতে যদি জানা যায়, যে যাঁরা সঙ্গে ছিলেন তাঁরা আসলে তাঁকে ভালোবেসেছেন, তিনিই বুঝতে পারেননি, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি কি? 
এবং যে কৃষ্ণকে তিনি বান্ধব বলে জেনেছেন তিনি যে তাঁর স্বীয় আত্মা সেটি জেনে কি পরম নিশ্চিন্ততায় পরম প্রেমে হাত বাড়িয়ে ধরছেন তাঁকে তা জেনে কোথাও যেন দ্রৌপদীকে রাধার মতোই লাগে। 
এ কাহিনীর মধ্যে দিয়ে একক মানবের ঈশ্বরত্বে উত্তরণের প্রত্যেক স্তর উন্মোচিত হয়। পড়ে ঋদ্ধ হই। 
যাঁরা জীবনের গভীর অর্থের অনুসন্ধান করেন এ বই তাঁদের জন্য।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল



এ সংখ্যার নির্বাচিত বই A most wanted man। লেখক জঁ লে কার। জঁর থ্রিলার। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের শিকারে যখন চরম সংকটের মুখোমুখি আমরা তখন এই বইটি পড়তে পড়তে বুঝেছি কেন লে কার এই বিষয়ের সমকালীন শ্রেষ্ঠ লেখক। 
টমি ব্রু একটি বৃটিশ ব্যংকের মালিকানা পেয়েছেন। ডুবন্ত জাহাজ। কিন্তু সেই ডুবন্ত জাহাজের একটি সুরক্ষিত ভল্ট এর চাবি ঈসার হাতে। যে ঈসা একজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী এবং হামবুর্গে সে একটি বিশেষ মিশনে আছে। ব্রু একটি ফোন কল পেলেন এডভোকেট অ্যানাবেল রিখটারের কাছ থেকে। ঈসার এডভোকেট তিনি। এখান থেকে কাহিনীর পরত খুলছে। 
এ বই সম্পর্কে USA Today বলছে , an instant classic ... A provocative and incendiary ending that only le Carre, the master , can pull off . 

যাঁরা এস্পায়নেজ থ্রিলার পড়তে আগ্রহী এ বই তাদের আনন্দ দেবে , সঙ্গে দেবে এক অবসরপ্রাপ্ত সিক্রেট এজেন্টের কলমে ফুটে ওঠা রিয়েল স্টোরি। স্টোরি বিহাইণ্ড এভরি ওয়ার। 

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


মির্জা গালিব 
লেখক সঞ্চারী সেন 
প্রকাশনা ঊর্বী 
মূল্য ১৭০ টাকা 
ঊর্বী প্রকাশনী আমাদের বেশ কিছু বিষয়ভিত্তিক বই পরিবেশন
করেছে। এই বইটিও এমনই একটি বই। লেখক উর্দু ভাষার অনুবাদে স্বনামধন্য। এই বইটিতে তিনি গালিবের জীবনী লিখেছেন। কিন্তু শুধু তো জীবনী নয়! উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবির জীবনকাহিনী তো তাঁর রচনা ছাড়া অসম্পূর্ণ! তাই পাতায় পাতায় রয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে মির্জার লিখিত কবিতা। প্রসঙ্গের সঙ্গে যুগলবন্দী করে ছত্রে ছত্রে সাজানো স্তবক নিয়ে যায় গালিবের অন্তরের সেই সৃষ্টিশীল সত্ত্বার কাছে। আমাদের মাথা নেমে আসে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। বইটির ভূমিকায় প্রখ্যাত কবি নীলাঞ্জন হাজরা লিখেছেন - আমার মির্জা। পড়তে পড়তে আমারও মনে হয়েছে - আমার মির্জা। 
ব্যক্তিগত জীবনে শোকেতাপে জর্জরিত হলেও তিনি কখনও সৃষ্টি থেকে সরে যাননি। 
মির্জা গালিব সম্বন্ধে গবেষণা ও আবেগ, দুটোই এই বইয়ের প্রতি পাতায় প্রকাশ পেয়েছে। 
এবারের বইঘরে পাঠকদের এই বইটি পড়ার আবেদন রাখলাম।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


এ সংখ্যার বই বেছেছি 'ইলিউশন'। বইটি লিখেছিলেন রিচার্ড বাখ।
এঁর লেখা জোনাথান লিভিংস্টোন সীগাল বইটি অত্যন্ত সমাদৃত। সত্যি বলতে ওই বই লেখার পর লেখক অত্যন্ত শান্ত ও সন্তুষ্ট চিত্তে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর যেন আর কিছু বলার নেই। সব বলা হয়ে গিয়েছে। আপনমনে অ্যামেরিকার প্রান্তরে তাঁর প্রাচীন বাইপ্লেনটিতে যাত্রী নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একদিন হঠাৎ মনে হলো, যদি আরেকবার যীশু কিংবা বুদ্ধ জন্মাতেন! এই এখন! আমাদের সময়? তবে কেমন হতো আমাদের জীবন? আমরা কি একটুও অন্যরকম হয়ে যেতাম না? তাঁরাও সাধারণ হয়েও কিভাবে অসাধারণ হতেন? এই ভাবনার পরে পরে তিনি একদিন দেখলেন তাঁর বাই প্লেনের পাশাপাশি আরেকজন বাই প্লেন চালিয়ে যাত্রী বিনোদন করেন। তিনি যেন ঠিক আমাদের মতো নন। ক্রমে রিচার্ড তাঁর অনুভূতিগুলো লিখতে শুরু করেন। বইয়ের প্রথম কিছু পাতা রিচার্ডের হাতের লেখা ছাপা। তারপর তিনি আস্তে আস্তে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে পরিচিত হলেন। দেখলেন, কি অনায়াস কি সাবলীল তাঁর জীবনে চলার ধরণ! জীবনকে একেবারে অন্যভাবে দেখা ও সেই অনুযায়ী চলাই হয়ত মানুষটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। 
টুকরো টুকরো ঘটনা ও কথা দিয়ে রিচার্ড গড়ে তুলেছেন এক অপার্থিব মায়া। ইলিউশন। ঐশী মায়া। এ মাযাকে ছুঁতে একবার বইটি পড়া দরকার। জীবনে যদি একটিমাত্র বইও কেউ পড়তে চান তবে সেটি যেন এই বইটিই হয়। কারণ এটি এডভেঞ্চার অব আ রিলাকটেন্ট মেশায়াহ । যে অবতার জীবন সম্বন্ধে নিস্পৃহ। 
বইটি পাওয়া সোজা। কারণ বইটি বেশ বিখ্যাত। প্রকাশনা Dell Books। America।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


এবারের সংখ্যায় একটি পত্রিকার আলোচনা রাখলাম। পত্রিকাটির বিষয় ইসমত চূঘতাই। যাঁরা একটু খতিয়ে পড়েন এবং পাঠক হিসেবে একটু ভিন্ন রুচির, তাঁদের কাছে চূঘতাই একটি স্মরণযোগ্য নাম। তিনি উর্দু সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নাম। পত্রিকাতে ইসমতের লিহাফ নামের অতি বিতর্কিত ও প্রসিদ্ধ গল্পটি বাদে আরো কটি গল্প আছে। আছে তাঁকে নিয়ে লেখা উর্দু ও ইংরিজি থেকে অনূদিত প্রবন্ধ স্মৃতিচারণা ও পত্র। এছাড়া সমসময়ের প্রাবন্ধিকদের লেখা। শীর্ষেন্দু দত্ত ঊর্বী থেকে প্রকাশিত চূঘতাইয়ের বইটির আলোচনাও রেখেছেন। 

পত্রিকাটি একটি সংগ্রহযোগ্য সংকলন। যাঁরা ইসমত চূঘতাই সম্পর্কে আগ্রহী তারা এটি সংগ্রহ করুন। যেহেতু সবুজপত্র সুতরাং ধ্যানবিন্দু পাতিরাম ইত্যাদি দোকানে পেতে পারেন।
বইটির মূল্য ১২০/- 




0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


বম্বে স্টোরিজ
সাদাত হাসান মান্টো 
সাদাত হাসান মান্টো উর্দু সাহিত্যের একটি এমন নাম যা উপমহাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ও উত্তর, এবং দেশভাগের যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে থাকা অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি স্বরূপ। তাঁর দেখার চোখ আর সমাজের তথাকথিত নীতিবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়া মানবিক বোধ, মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান উপেক্ষা করে তাদের যাপনের যন্ত্রণাগুলোকে সামনে এনেছে। সাহিত্য বলে শুধু নরম পেলব স্বপ্নময়তা দিয়ে আঁকা রোম্যান্টিক কিছু কথন নয়। সাহিত্য তীব্রভাবে জীবনের সেই সব দিককেও তুলে আনে যা আমাদের চোখে পড়লেও আমরা এড়িয়ে যাই। এসব সাহিত্যের বিষয় হতে পারেনা, এমনটাই ভাবি। লেখক আমাদের বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছেন, জীবন মানে এটাও হয়। শিউরে উঠেছি। কষ্ট পেয়েছি । 
এই বইটিতে মোট চোদ্দটি গল্প আছে । নামেই যাদের পরিচয় লেখা। আমার দুর্ভাগ্য যে মূল উর্দুতে আমি লেখককে পড়তে পারিনি। উর্দু পড়তে পারিনা বলেই। উর্দুতে অডিও বুকের মাধ্যমে শুনলে আমার মনে হয় গল্পগুলোর আরো কাছে যাওয়া সম্ভব। যে কোনও রচনা তার স্থান কাল পাত্র পরিবেশের একটি দুর্লঙ্ঘ্য গন্ধ বয়ে আনে। ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্লেভার। অনূদিত গল্পের ক্ষেত্রে, যত ভালো অনুবাদ হোক না কেন, মূল গল্পের সেই ফ্লেভার কিছুটা হলেও অনুপস্থিত থাকে। এ ক্ষেত্রে ম্যাট রীক অবশ্য অত্যন্ত সুষ্ঠ ভাবে যত্নের সঙ্গে অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। উপমহাদেশের লেখক হওয়া সত্ত্বেও মান্টোকে যে প্রতীচ্য পোস্টমডার্ণ সাহিত্যিক হিসেবে এই জায়গা দিয়েছে সেটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। একথাটির কারণ এই, যে মান্টো অবিভক্ত ভারতের মানুষ বলেই নিজেকে ভাবতেন। দেশ ভাগ তাঁকে চরম দুর্ভাগ্যের দিকে টেনে নিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ অকালমৃত্যুর শিকার হন তিনি। 
এই বইয়ের চোদ্দটি গল্প মান্টোর বম্বের স্মৃতি। বেশির ভাগই লাহোরে চলে যাবার পর লেখা। তবে কিছু গল্প বম্বে থাকাকালেও লেখা। যেমন ‘বু’ গল্পটি। এই গল্পটি এবং ইসমত চুঘতাইয়ের লিহাফ গল্পটি একই সঙ্গে অশ্লীলতার দায়ে আদালতে পৌঁছেছিল । দুই লেখক ও দুই বন্ধু একই সঙ্গে কোর্টে যান। কি ছিল গল্পটিতে? রীক নামকরণ করেছেন, স্মেল । যেহেতু মান্টোর চিন্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একটি চেনা বৈশিস্ট্য, এক্ষেত্রে তা উঠে এসেছে এক যুবকের যৌনতুষ্টির সঙ্গিনী এক নিম্নবর্গীয় তরুণীকে ঘিরে। বিবাহিত যুবকটির সুন্দরী স্ত্রী নিদ্রিত। সে নিজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু আগের সেই মেয়েটির কথা মনে করছে । যার ক্লেদাক্ত শরীরের প্রতিটি রোম থেকে উঠে আসছিল এক অদ্ভুত গন্ধ, যা কখনোই সুগন্ধ নয়, অথচ যা তাকে দিয়েছিল এক অদ্ভুত তুষ্টি । তার মনে হয়েছিল এ গন্ধ তার খুব চেনা । শৈশবে দুধ খাওয়ার কালে কি সে এই গন্ধ পেয়েছিল? আজ সুন্দরী স্ত্রী তাকে সেই তুষ্টি দিতে পারছেনা যা সেই মেয়েটি তাকে দিয়েছিল। কিংবা ধরা যাক ‘দশ টাকা’ গল্পটি। চৌলে থাকা কিশোরী মেয়েটি যে ধান্দায় যায় তা সকলেই জানে। কিন্তু প্রচন্ড জীবনসংগ্রামের মধ্যে এ নিয়ে কেউই মাথা ঘামায়না। তার মায়ের মিথ্যেকথা নিয়েও কেউ প্রতিবাদ করেনা। কিশোরীটি যাই করুক না কেন , তার মধ্যে বালিকাবেলার একটি নিষ্পাপ মন রয়ে গিয়েছে। তাই সে ধান্দায় যেতে ভালোবাসে। কেননা তাহলে সে গাড়ি চড়তে পারে। এটি তার অত্যন্ত প্রিয়। এমনই একদিন সে গাড়িতে চেপে বম্বে ছাড়িয়ে এক নির্জন সমুদ্রের ধারে গেল। সঙ্গী ছিল তিন অল্পবয়সী তরুণ। কিশোরীটির নিষ্পাপ উচ্ছ্বলতা তাদেরকেও প্রভাবিত করেছিল। ফলে তারা কেউই দৈহিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে লিপ্ত হলোনা। বরং চার বন্ধু যেন একটি অমলিন বিকেলবেলা সাগরের পাড়ে কাটিয়ে ফিরল। প্রথমে একটি ছেলে কিশোরীটির বুকে একটি দশ টাকা গুঁজে দিয়েছিল। ফিরে এসে গাড়ি থেকে নামার সময় কিশোরী সেই টাকাটা ফিরিয়ে দেয়। সিটের ওপরে টাকাটা রেখে সে যখন চলে যায় তখন পাঠকেরও বুক চিনচিন করে। কি অসম্ভব অসহায়তা ! জীবন কি ছেলেখেলা করে! এমন করে লিখতে বসলে গোটা চোদ্দটি গল্প বলা হয়ে যাবে। সেটা ঠিক হবেনা। শুধু পাঠক হিসেবে নিজের কথাটি বলি। মান্টোকে যেভাবেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, আমার কাছে তিনি এক অভিমানী মানুষ বলেই প্রতিভাত হলেন । তাঁর চেতনার গভীরে তিনি যেন নিখাদ ভালোবাসাই খুঁজেছেন সারাটা জীবন। আদিম মানবের মতো তাঁর খোঁজ শরীর ছাপিয়ে চেতনায়, মস্তিষ্কের শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে গিয়েছে । তাঁর সময় ও পরিবেশ যে তাঁর ওপরে এক চূড়ান্ত বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাশদি বলেছেন মান্টো নিম্নবর্গীয় জীবনের ব্যাখ্যাতা। অবশ্যই তাই। বঞ্চিত অসহায় দুঃখী মানুষের জীবনজোড়া সুখ ও ভালোবাসার খোঁজ তাঁর এই চোদ্দটি গল্পের পরতে পরতে মিশে আছে।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল

এবারের আলোচ্য বইটির কথা ঠিক কতজন পাঠক জানেন, আমার জানা নেই। আমি নিজে পড়ে চমকিত হয়েছি। এত ভালোবেসে কেউ নিজের জন্মভূমির কথা লেখে? বিশেষ, লেখক যখন সেই হতদরিদ্র গ্রাম্য পরিবেশ থেকে উঠে এসে কৃতী হয়েছেন। বিদ্বান হয়েছেন। 
একসময় ইছামতী নদী তার দিক পরিবর্তন করেছিল। তার ছেড়ে যাওয়া খাতটি একটি অশ্বখূরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি করে। দক্ষিণ বঙ্গের ও অঞ্চলের মানুষ তাকে বাঁওড় বলে ডাকে। এই দ্বীপভূমি চারিদিকে জল আর মধ্যিখানে স্থল নিয়ে যেন জগৎবিচ্ছিন্ন। সেই দুনিয়ার বার স্থানে কতগুলো গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এক অপূর্ব ছবি এঁকেছেন লেখক। সে ছবি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাওয়া যায় কাহারদের শুয়োরের পাল। রাতের বুক ঠেলে চলেছে। অন্ধকারে সম্পন্ন মুসলমান প্রতিবেশীর উঠোনে দরিদ্র হিন্দু পড়শি সকলের অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। কারোর মুখে কথা নেই। শুধু পদ্মপাতায় সেদিনের ভোজনে ব্রাত্য পড়শি খেতে বসেছে। বাঁওড়ের বুকে জেলেদের আনাগোনা। যমুনার হাটে গরুর গাড়ি রাখার বড় মাঠ। রসে ফেলা কড়কড়ে জিলিপি। 
এসব অনেককাল হলো। তবু, আমাদের স্মৃতিতে এ ইতিহাসের প্রয়োজন আছে। 
বাংলার মাঠঘাট ফুল ভালোবেসে। 
লেখক নাকি দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর লেখায় ফিরেছেন। কেন? এ যে ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করা!
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর 
অনিন্দিতা মণ্ডল


মানুষের কল্পনাশক্তি কত দূর যায় তার কিছু কিছু উদাহরণ আমরা রূপকথার গল্পে পেয়ে থাকি। ঠাকুরমার ঝুলির মতো সেসব গল্প আমাদের শৈশবের চেতনভূমিকে এমন করে গড়ে দেয় যে বড় হয়ে বাস্তবের কঠিন সীমারেখার মধ্যে থেকেও কেউ কেউ মনের সেই দেওয়ালকে যখন তখন ভেঙে দিই সরিয়ে দিই। এখানে লক্ষ্য করার মতো কথা হলো, কেউ কেউ। সবাই নয়। 

কিন্তু সেই বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন, নিরর্থক শৈশবের কিচিরমিচির কি প্রাপ্তবয়স্কদের যাপনে বিন্দুমাত্র ছায়া ফেলে? আমরা ত বড়দের জন্য রূপকথা ভাবিনা! বড়রা বাস্তবের সঙ্গে লড়াই দিতে দিতে রূপকথার সব মায়া সব রং হারিয়ে ফেলে। সাতটা রঙের বাইরে যে কত রং! টের পাওয়া হয়না আর। 

এরকম ভাবনায় স্থির থাকি, আর তখনই হাতে আসে বইটি। Stardust। লিখেছেন Neil Gaiman। এ সময়ের একজন দিকপাল। তাঁর কল্পনার জগতে বড়রাও স্বচ্ছন্দে পা ফেলতে পারে। তাঁকে নিয়ে, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে সমসময়েই পণ্ডিতেরা আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক তিনি। 

আলোচ্য বইটি একটি রূপকথা। যেখানে তারার টুকরো নারী আর মাটির পুরুষ একে অন্যের ভালোবাসায় জড়িয়ে যায়। তাদের কত না অদ্ভুত সংলাপ! কি অবিশ্বাস্য তাদের দৈনন্দিন যাপন! অথচ পাঠক কখনো অবিশ্বাসের হাতছানিতে দৌড়ে যান না। কল্পনা ও বাস্তবের এই মিশ খাওয়া যে আমাদের মধুর স্বপ্ন! আমরাও যে চাই ওই রূপকথার টুকরো! নেমে আসুক আমাদের জীবনে। যেমন এসেছিল ত্রিস্তানের জীবনে। তার জন্য যুদ্ধ চললে ক্ষতি কি? 
এবারের পছন্দ এই বইটি।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


এবারের আলোচ্য বইটির নাম ছিরিছাঁদl লেখক ও প্রকাশক প্রীতম বসুl তিনি থাকেন ভিন দেশেl কিন্তু শেকড় রয়ে গেছে বাংলায়l শুধু যে মনে প্রাণে তিনি বাঙালি তাই নয় , তাঁর উন্মোচনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মায়াl সে মায়ায় তিনি শুধু সাংস্কৃতিক দখলদারির দুর্গে আঘাত করেননি, দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রাচীন সমাজে কি ভাবে তার ঐতিহ্য বহমান হয়েছে প্রাকৃত জনের দ্বারাl

গল্পটি একটি থ্রিলারের আঙ্গিকে লেখাl কলকাতার বিভিন্ন মূল্যবান স্থান থেকে সরছে প্রাচীন পুঁথিl সেগুলির কিছু সংশোধন হয়ে ফিরছেl এই রহস্যের পিছনে চলতে গিয়ে পানু রিপোর্টার কিভাবে খুঁজে পাচ্ছেন এক জিনিয়াসকেl যিনি অবলীলায় সংস্কৃত থেকে অসংখ্য বিস্মৃত বাংলা ছন্দকে শিখিয়ে দিচ্ছেন কবিতা রচেl কখনো তিনি ভোলা নর্তক, কখনো জাঁহাপনা, কখনো বার্নার্ড পঞ্চাশl কখনো বা তিনি প্রীতম বসু! প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ভালোবাসা মিশলে তা সত্যিই নিকষিত হেম! প্রীতম বসু তেমনই একটি আবিষ্কার! 

একটি উপমা দিইl
 
বার্নার্ড পঞ্চাশ বলছেন, ব্যালেন্স রাখাটাই মোস্ট ডিফিকাল্ট l মহাপ্রভু চৈতন্যদেব চলেছেন নদীয়ার পথে, দুই বগলে দুই পাঁড় মাতাল জগাই মাধাইকে চেপে ধরে ব্যালেন্স করে করেl জগাই আর মাধাই হলো ছন্দ আর অন্ত্যমিলl আর মাঝে মহাপ্রভু হলেন রসের সাগরl এই তিন নিয়েই তো হলো কবিতাl জগাই আর মাধাই মাল টেনে দুদিকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চায়l ছন্দের পিছনে দৌড়বে তো মিল মায়ের ভোগে, আবার বেশি মিল কপচাবে তো ছন্দ ভ্যানিশl এখানেই মহাপ্রভুর ক্যালি – ব্যালেন্সl 

কবিতার এমন সুন্দর ব্যাখ্যা শুনেছেন কেউ? আর লক্ষ্য করুন, ভালোবাসাটা! বাঙালির সবচেয়ে গর্বের মানুষটির সঙ্গে কেমন মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্যাশনকে! দিয়েছেন কতশত বাংলা ছন্দ! সেসব ছন্দের তালিকা ও উদাহরণ মোটেই দেবনাl এ বই বাঙালি মাত্রই সংগ্রহ করা উচিত! তিনি ছন্দ মক্সো করতে উৎসাহিত করছেনl এভাবেই বাঙালি ফিরে পাক তার হারিয়ে যাওয়া গৌরবl আসলে তো বাঙালি স্বভাবকবি! কোনো নাম যশ অর্থের পরোয়া না করেই সে ট্রামের চলা, বৃষ্টি ঝরা থেকে ছন্দ অনুভব করে! কুড়িয়ে আনে ! 

এ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন শঙ্খ ঘোষl খুব স্বাভাবিক! সে ভূমিকা এতই আশাব্যঞ্জক যে বইটিতে পৌঁছতে এক তিল অপেক্ষা চললনাl থ্রিলারের সমস্ত লক্ষণ বজায় রেখেও প্রীতম বসু আমাদের উপহার দিলেন বাঙালির প্রাণের বস্তু , গর্বের বস্তুl

প্রচ্ছদ সপ্তর্ষি দাশl পুঁথির ওপরে লিখতে উদ্যত একটি কলমl লিখুন প্রীতমl আরো আরো লিখুনl আমরা সমৃদ্ধ হইl 
( বইয়ের জন্য যোগাযোগ 91 8584933858)
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্য লেখেন, গল্পও লেখেন। পেশায় উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা হলেও তাঁর মনোজগৎ সমৃদ্ধ। কারণ শিক্ষার নিক্তিতে তিনি সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশ বিদেশের নানা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। জীবন ছেঁচে তিনি তুলে আনেন অমূল্য কিছু পল। তাঁর দেখার চোখ তাঁর বোধের মন, সেই সব পলকে কখনও কবিতা করে তোলে, কখনও বা গল্প। সুতরাং কোনও কঠিন সীমানা দিয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলা সম্ভব নয়। 


আলোচ্য গ্রন্থটি প্রতিভাসের প্রকাশনায় একটি কাব্যগ্রন্থ। নাম - কিছু দাহ কিছু জল। মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা আছে বইটিতে। প্রতিটি কবিতাই কবির এক স্বতন্ত্র স্বরকে জাগিয়ে দেয়। প্রথম যে কবিতাটি, নাম - ফেরা। কোথায় যে ফিরতে চাই, কেন যে চাই, তাই আমাদের কাছে অজ্ঞাত। অথচ দিনশেষে ফিরতে হয়, অভ্যাসে, কর্তব্যে, আর আপোষে। কোথাও কি নারীর বিষাদকণ্ঠ বেজে উঠছে? সন্ধ্যেবেলার শঙ্খধ্বনির মতন? কবি যে নারী ! কত কত অভিমান যে ভিড় করে! ভুল কবিতায়। "আমাকে আজন্ম তুমি পড়ে গেলে ভুল উচ্চারণে"। সত্যিই! পুরুষ কি কখনও নারীকে ঠিক উচ্চারণে পড়তে পেরেছে? না, পড়তে চায়? অথচ তার কাছে নারীর বাড়ে ঋণ। সে বলে ওঠে, "এখনই যেওনা। থাকো।/ এ জীবন, প্রতিধ্বনিহীন।/ তোমার অপ্রেম দিয়ে তবু ঘিরে রাখো।" কেন এই ঋণ? কারণ, একদিন যত জ্বালা যত দাহ গান হবে। তাই "বেদনা তোমার কাছে ঋণী"। কিন্তু শুধুই কি এমন ছবি? কবি বিজয়িনীও। কখন? মনখারাপের একলা ঘরে সে তার মুকুটখানি খুলে রাখে। দর্পহারা মানবী অন্তরালে বিজয়িনী। তার একলা ঘরের অন্ধকারে অহঙ্কার নামিয়ে রেখে সে বিজয়িনী। 
এ বইয়ের প্রতিটি কবিতা কবির স্বগত উচ্চারণ। কোথাও বৈপ্লবিক উচ্চকিত স্বর নেই। অথচ ফল্গুর ধারার মতো বয়ে যায় এক উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া অভিমান অনাদর আর বেদনার সম্পদ। নারীর যা একান্ত নিজের ধন। এই সম্পদি তাকে অন্তরে ধনী করে। চেতনায় ঊর্ধ্বমুখী করে। সে নিজের সঙ্গে অনবরত কথা বলে। নিজেকে আদর করে। নিজের অভিমানের সঙ্গে খেলে চলে কাব্যখেলা। 

শাদা কালো আর লাল, এই তিনটি প্রাথমিক রঙে আঁকা প্রচ্ছদটি সুদীপ্ত দত্তর। কালোর মধ্যে লালের উন্মোচন যেন অন্তরের অন্ধকারে নিরন্তর রক্তপাতের খবর দেয়। শাদা পাতায় তাই লিখে চলেন কবি। 

যারা নিজের মনে কবিতার সঙ্গে একলা বসত করতে ভালোবাসেন, তাদের কাছে এ বই সঙ্গী হবে। সখী হবে।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল



দে’জ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নির্জন শালিক। কবি তাপস মহাপাত্র। কবিতা প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত অনুভবে একটি বোধের বিষয়। সেই বোধ যা মন ছেয়ে থাকে। নানা ব্যাকরণ প্রকরণের কারিকুরি ছাপিয়ে যা এক মায়ায় এক অন্যতর চেতনভুমিতে মনকে স্থাপন করে। সমান্তরাল বাস্তবতা বলব একে। প্রায় আটষট্টিটি কবিতা আছে বইটিতে। তাপস মহাপাত্র আত্মমগ্ন কবি। সেরকম প্রকট উচ্চারণে তিনি প্রতিবাদ বা খারাপ লাগা জানান না। নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন মুহূর্ত। অনুভূতির রঙের সঙ্গে মিলে যায় তাঁর দীর্ঘদিনের চর্চার বৈদগ্ধ্য। পাঠককে তা মুগ্ধ করে। যেমন বইটির নাম যে কবিতার নামে, কবি লিখছেন তাতে – আমার গৃহস্থালী পর্ণমোচী মনে/ কী করে লুকাই নিজে ঝরাপাতা বনে! এক নিমেষে পাঠক পৌঁছে যান কবিমনের সেই পর্ণমোচী বনে। এবং কবি স্পষ্ট করেন যে এ তাঁর একান্ত আত্মকথন। কবিতার শেষ লাইন জানিয়ে দেয় – এখন নির্জনে কী চাওয়া খুঁজি, নিজের ভিতরে নিজে বন্দী বুঝি। বিলীন কবিতার অংশ বিশেষ। “দুবাহুতে ভাসাই আমার অসীম আমাকে। মেঘের মতো জড়িয়ে থাকে কে!” এই সেই উপলব্ধির জগত। কবি নিজের অসীম সত্ত্বার কাছে সমর্পিত। সে তাঁকে জড়িয়ে থাকে মেঘের মতন। “অবশ করে বিবশ করে...”। বিরহ এমন একটি অনুভব যা চিরস্থায়ী। সেই অনুভব বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়। কবি নিজের ভিতরে সেই অনুভব জাগ প্রদীপের মতো জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাই লিখছেন – আসিস কে রে পথে পথে ছড়াস যত ক্ষত/ কেন আমায় করল কে যে/ এমন হৃদয়-হত!(আহত)। সে যে নির্দিষ্ট কেউ নয় সে কবির উচ্চারণে স্পষ্ট। তিনি তাঁর মুখ দেখেননি। তবু কী আর্তি তাঁকে দেখার! গন্ধে বিভোর দূরের ভূমি/ অলক্ষ্যে তার আত্মীয় হোয়, বুঝতে না দেয়/ দুই অচেনার মধ্যিখানে-/ এক অন্তর, আকুল গোকুল। (ব্রজবাস)। একটি মাত্র শব্দে কবি বলে দেন অন্তরটি তাঁর আকুল গোকুল। হৃদিবৃন্দাবন। অসীমের স্পর্শ লাগা সেই অন্তর কি আর অন্য কিছু খুঁজতে পারে? তাপসের কবিতা জ্যৈষ্ঠ দিনের দুপুরবেলার শীতল জল। চারিদিকে অশান্ত পরিবেশ, চাওয়াপাওয়ার বিরক্ত ভিড়ে নির্জন শালিকের মতো পাঠকও সেই শীতল জল আকণ্ঠ পান করবেন। এক অন্য সমান্তরাল জগতে বেঁচে থাকবেন। একটিই কথা ছিল। কবি যদি প্রকাশিত কবিতার সন তারিখ সহ প্রকাশ পরিচয়টুকু জানিয়ে দিতেন তবে ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য সুবিধে হত। এটি একান্তই নিজস্ব অনুভব।


প্রচ্ছদে শাদা আকাশের তলে সবুজ ঘাসজমিতে একটি একলা শালিক। ঠিক আমাদেরই মতো। শিল্পী দেবাশিস সাহা কবির মনের কথাটি ভারী সুন্দর বুঝেছেন। সুন্দর কাগজ ও বাঁধাইয়ে বইটি দীর্ঘজীবী হবে নিশ্চয়।
0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল



উপন্যাস - ত্রিধারা 
লেখক - ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 
প্রকাশক - ধানসিঁড়ি 

লেখিকা ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের এটি দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম কলাবতী কথা। সেটি পড়ে ভালো লেগেছিল। তাই এই রচনাটি সম্বন্ধে প্রত্যাশা বেশিই ছিল। বলা বাহুল্য নিরাশ হইনি। লেখিকার প্রাচীন কাল ও সভ্যতার উন্মেষ নিয়ে অনুসন্ধিৎসা এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে। কিন্তু আধুনিক জীবনের দ্বন্দ্বও যেন আমাদের চিনিয়ে দেয় লেখিকা বর্তমান সম্পর্কেও নিস্পৃহ নন ।
উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে তিন প্রজন্মের তিন নারীকে ঘিরে। এদের জীবনে একটি আশ্চর্য সমাপতন। প্রত্যেকের মাতৃত্বকে ঘিরে এক রহস্য। অদ্ভুত ভাবে অনুষঙ্গে উঠে এসেছে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা গুহা। অনেকে অনেক অর্থ করবেন, আমার মনে হয়েছে মধ্যম পাণ্ডবের অনার্য বিবাহ এবং একটি প্রান্তিক স্রোতধারা কিভাবে যেন ভারতবর্ষের মূলস্রোতে মিলে গিয়েছিল। এখানে তার একটি সমকালের প্রতিফলন। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় যে প্রতিপাদ্য, মাতৃত্বের অধিকার একটি প্রাকৃতিক অধিকার। এর সণ্গে মিশে আছে আমাদের প্রাচীন কালের মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার বীজ। জননী যেখানে প্রকৃতির নির্বাচিত। সৃষ্টি ধারণ ও পালনের একক ক্ষমতার বাহক। 
উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। তবে আপাতসুখকে সরিয়ে গভীরতর পর্যবেক্ষণের দাবী আছে তার। পাঠক মাত্রই সেই দায় স্বীকার করবেন। 
এই ধারার উপন্যাস লেখকের মেধা ও মননের পরিচয় বহন করে। 


বইটির মুদ্রণে যত্নের ছাপ পরিস্ফুট। ভালো কাগজ ও নির্ভুল ছাপা নজর কাড়ে। প্রচ্ছদে দেখা যায় তিনটি ধারা অরণ্য বনরাজির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে কখনও মিলেছে, কখনও বা স্বতন্ত্র ধারায় বয়ে গেছে। সুন্দর প্রচ্ছদ।