বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in বইপোকার বইঘরবই - স্বপ্নসম্ভবা
লেখক - মহুয়া মল্লিক
প্রকাশক - তুহিনা প্রকাশনী
মুল্য - ২৭৫/-
স্বপ্নসম্ভবা দুটি উপন্যাসের সংকলন। পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত ধারাবাহিক ‘স্বপ্নসম্ভবা’ এবং ‘মুখোশ গ্রামে স্বর্গের ফুল’ উপন্যাস দুটি বই আকারে আনলেন প্রকাশক।
‘স্বপ্নসম্ভবা’ একটি প্রায় ডিসটোপিয়ান নভেল। ডিসটোপিয়ান প্রায়, কেননা উপন্যাসের শেষে লেখক একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছেন। গোড়ার কথা বলি। আমরা যারা বিদেশে কখনও যাইনি, বসবাস করিনি, তাদের কাছে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি এক অদ্ভুত জগত। স্বপ্নময়। সেখানে মানুষ সুখের তুঙ্গে অবস্থান করে। তাদের অভাব বলে কিছু তো নেইই, উপরন্তু জীবনটা যেন হাওয়ায় ভেসে থাকার মতো। উইক এন্ড মানেই পার্টি বা ঝটিকা সফর। গাড়ির মাথায় মাল চাপিয়ে লম্বা সফর, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সুখের হাতছানিতে অনেক বাবা মা তাদের মেয়ের জন্য একটি উপযুক্ত বিদেশবাসী (পড়ুন গ্রিনকার্ড হোল্ডার) পাত্র খোঁজেন। মেয়ে চোখের সামনে না থাকলেও চলবে। সে তো সুখের স্বর্গে যাচ্ছেই, উল্টে বাবা মাও একরকম শ্লাঘা অনুভব করতে পারেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে একটা চাপা (কখনও কখনও প্রকাশ্যেই) গর্ব প্রকাশ করেন। ওদিকে যে মেয়েটি উপযুক্ত পাত্রের হাতে পড়ে বিদেশে সংসার পাততে গেল, তার হাতে কিন্তু ম্যারেজ সার্টিফিকেট ছাড়া যোগ্যতার আর কোনো সার্টিফিকেট থাকছে না। এদেশে সে হয়ত কিঞ্চিত পড়াশুনো করেছে, কিন্তু তার মুল্য ওদেশে বিন্দুমাত্র নেই। ফলে, সে এই আশাতীত সুখের সংসার গড়তে সদা সচেষ্ট। সপ্তাহ-শেষের পার্টিতে সে গুচ্ছের রান্নাবান্না করে ঘর সাজিয়ে ইকেবানা করে স্বামীর বন্ধুবান্ধবের মনোরঞ্জন করে। স্বামী এটি তার প্রাপ্য বলেই মনে করে। সে তো হাউজ ওয়াইফ বিয়ে করেছে! ফলে, পিতৃয়ার্কি, বা পিতৃতন্ত্র, বা ক্ষমতাতন্ত্র, যে নামেই ডাকি, সে তার কাজ শুরু করে দেয়। মেয়েটি বাপ মায়ের অহংকার বাড়াতে, স্বামীর কাছে গ্রহণযোগ্য থাকতে এরপর অত্যাচারিত হয়েও মুখ বন্ধ রাখে। ক্রমশ সেই অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। ফেসবুকে যে সুখী দাম্পত্যের ছবি লটকানো হয়, নিত্য নতুন পদের ছবি, বাগানের ছবি, সেসবের মধ্যে দিয়ে মেয়েটির সম্পর্কের কালশিটেগুলো দেখতে পাওয়া যায় না। ‘স্বপ্নসম্ভবা’ এমনই কয়েকটি মেয়ের গল্প। একে ডিসটোপিয়া বলব না? লেখক অবশ্য শেষে এদের প্রত্যেকের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার, কোথাও বা ফিরে আসার একটি চিত্র এঁকেছেন। সাহিত্যে যেটুকু আশ্বাস দেওয়া যায় আর কি। আমার যেন মনে হয়েছে, তিনি আসলে আমাদের এই আদেখলাপনাকেই বিদ্রুপ করেছেন। মেয়েদের বিয়ের জন্য বিদেশবাসী কৃতী পাত্র খোঁজার চেয়ে যে মেয়েটিকে স্বাবলম্বনের পথে এগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এই চেতনা হতে গেলে মোহমুক্তির প্রয়োজন। লেখক যে সত্যটা তুলে ধরেছেন সেটি সমসাময়িক ঘটনাবলীর উল্লেখযোগ্য দলিল। একেবারে শেষে তৃষার নিজেকে নিয়ে উৎসব উদযাপন মুক্তির কথা বলে। এই মুক্তিতে একটি মানুষ স্বয়ং সম্পূর্ণ। তার চেতনায় আর কারোর উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। একেবারেই নেই। এর চেয়ে বড় উত্তরণ আর কী হতে পারে।
‘মুখোশের গ্রামে স্বর্গের ফুল’ আকারে ছোট। এটি অবশ্য একটি মেয়ের আত্মানুসন্ধানের গল্প। এখানেও গার্হস্থ্য অত্যাচার পেরিয়ে উত্তরণ। তবে এই উপন্যাসের বিশেষত্ব হল, পুরুলিয়ার ঐতিহ্য, ছৌ নাচের মুখোশ সম্পর্কে লেখকের বিস্তারিত গবেষণা। কাহিনীর উৎকর্ষ ছাপিয়ে এই গবেষণা সেখানে প্রান্তিক মানুষের জীবন যাপন ও শিল্পানুরাগের চিত্র তুলে ধরেছে। এটি গোচরে আসা দরকার। একই ভাবে কিভাবে সেখানেও শিল্পীর স্বাধীনতাকে খর্ব করে তার অর্থনৈতিক দুর্গতি বজায় রেখে পুঁজির আস্ফালন চলে, সেটিও স্বল্প পরিসরে জানিয়েছেন লেখক। সমাজসচেতনতা দুটি উপন্যাসেরই মূল লক্ষ্য।