0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















নবম পর্ব

পানু রায় অফিসে ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকে দেখলেন সুন্দরী টাইপিং-এর কাজে ব্যস্ত। মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল,’ শিবুলালের সঙ্গে দেখা হল?’ পানু রায় বল্লেন,’হ্যাঁ।‘সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ কেমন লোক, বিপজ্জনক?’ পানু রায় হাসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,’ কোনও খবর আছে?’

- বড়কালী ফোন করেছিল। বলল আধঘন্টার মধ্যে এখানে আসছে, পাঁচমিনিট আগে ফিরেছে কাঠমান্ডু থেকে।

- কখন ফোন করেছিল?

-পাঁচ মিনিট আগে।

-আমাকে মনে করিয়ে দিও যে নতুন পুত্রবধূ আসার জন্য ওনাকে অভিনন্দন জানাতে হবে।

সুন্দরী হেসে বলল,’ দাদু, ওনার গলার আওয়াজ শুনে মনে হলো যে ওনার তাড়া আছে। মনে হয় ওনার অন্য কোনও জরুরি ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলার আছে।

কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। সুন্দরী দরজা খুলতেই দেখল বড়কালী দাঁড়িয়ে আছে। পানু রায়ের হিসাব অনুসারে ওনার নথিভুক্ত বয়স বাহান্ন কিন্তু দেখে চল্লিশের বেশি মনে হয় না। ‘কেমন আছ সুন্দরী?’ জিজ্ঞাসা করল বড়কালী। উত্তর না শুনেই পানু রায়ের টেবিলের সামনে গিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। করমর্দন শেষ হলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,’ হাতে সময় খুব কম। আমাদের খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। শিবুলালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? পানু রায় বললেন,’হ্যাঁ।‘বড়কালী জিজ্ঞাসা করল,’ কত দাম দিল?’

-তোমার পনের শতাংশের জন্য ত্রিশ লক্ষ।

-আর রেবার চল্লিশ শতাংশের জন্য?

-রেবার চল্লিশ শতাংশের জন্যও ত্রিশ লক্ষ।

-সেটা কী করে হতে পারে? ও কী করে পনের শতাংশ এবং চল্লিশ শতাংশের জন্য একই দাম দিতে পারে?

- দুটোর একটা হাতে পেলেই নিয়ন্ত্রণ ওর হাতে চলে যাবে।

-তাতে কী হয়েছে? সেটা কি ঠিক? চলুন একবার রেবার সঙ্গে দেখা করে আসি। আমার ওর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। শিবুলাল লোকটাকে কী রকম বুঝলেন?

-লোকটা ঠান্ডা মাথার বদমাইশ। এক নম্বরের শয়তান। কিন্তু সামনাসামনি লড়াইতে চুপসে যাবে বলে মনে হয়।

-আমার কাছে যতদূর খবর আছে তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই লোকটাই গৌতম কৈরালা অর্থাৎ রেবার বাবার খুনী।

- তুমি পুলিশের কাছে প্রমাণ করতে পারবে তো?

- আমার মনে হয় পারব। গৌতম কৈরালা খুন হবার কয়েকঘন্টা আগে শিবুলাল ওর এক বন্ধুকে বলেছিল যে কিছুক্ষণ পরে ওর সঙ্গে গৌতম কৈরালার ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা আছে। গৌতম কৈরালার সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় যে গাড়িটা শিবুলাল নিয়ে গিয়েছিল আমি সেটার খোঁজ পেয়েছি। খুনের ঘটনার তিনদিন পর শিবুলাল ঐ গাড়িটা বিক্রী করে একটা নতুন গাড়ি কেনে। আপনার বোধহয় মনে আছে গৌতম কৈরালা যখন খুন হয় তখন সে একটা গাড়িতে করে কারও সঙ্গে যাচ্ছিল।তারপরে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে যে গাড়িটা খুব জোরে রাস্তা দিয়ে আসছিল এবং আসতে একটা দরজা খুলে যায় এবং ঐ দরজা দিয়ে একটা মানুষের দেহ অর্ধেকটা বাইরে ঝুলছিল আর বাকি অর্ধেকটা ভেতরে ছিল। তারপর গাড়ির ভেতর থেকে কেউ ধাক্কা মেরে দেহটা গাড়ির বাইরে ফেলে দেয়। গড়াতে গড়াতে বেশ খানিকটা গিয়ে দেহটা ফুটপাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। গাড়িটা ততক্ষণে তীব্র গতিতে উধাও হয়ে গেছে। ভয়ার্ত পথচারীরা দৌড়ে এসে দেখে দেহটা মৃত।শরীরে তিনটে বুলেটের চিহ্ন। তারমধ্যে একটা কপালে।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আর কী জান তুমি?’ বড়কালী বলল,’ ঐ সময়ে শিবুলাল যে গাড়িটা চালাত আমি সেটা দেখেছিলাম। গাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে বেশ যত্ন করে পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে তখনও দরজায় এবং সামনের সিটে দু-তিনটে কালো ছাপ বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছিল। দরজাটার মাঝখানে একটা ছোট গর্তের মতন দাগ ছিল। মনে হয় বুলেটের দাগ। আমি কাঠমান্ডুর একজন নামকরা ডিটেকটিভের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব বলি। উনি বললেন রক্তের দাগ পরীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষা আছে যেটি লুমিনলের সাহায্যে করা হয়। উনি গাড়িটাকে লুমিনলের সাহায্যে পরীক্ষা করেন এবং সামনের সিটের কভার ও দরজা এবং সিটের মাঝখানে রক্তের দাগ খুঁজে পান।

পানু রায় বললেন,’ খুব ইন্টারেস্টিং। কিন্তু এটা একটা সূত্র মাত্র। এটাকে প্রমাণ বলা যায় না।‘

-ঠিক আছে।আমি যখন এই সূত্র হাতে নিয়ে শিবুলালের সামনাসামনি হব তখন কথায় কথায় নিশ্চয়ই প্রমাণ পেয়ে যাব।

-তুমি এই সূত্র নিয়ে শিবুলালের মুখোমুখি কেন হবে? সেটা ঝুঁকির কাজ হয়ে যাবে। ওটা পুলিশের কাজ, পুলিশকে করতে দাও।

বড়কালী কোট তুলে ভিতরের পকেট থেকে উঁকি মারা রিভলভারটা দেখিয়ে বলল,’ আমি ঐ দু’দিনের মস্তানকে ভয় পাই ভেবেছেন? আমার দিকে আঙ্গুল তুললে কুকুরের মত গুলি করে মারব।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ওটার লাইসেন্স আছে তোমার কাছে?’

বড়কালী বলল,’আপনি কী ভাবছেন? আমার কাছে লাইসেন্সের চেয়ে বড় জিনিস আছে।আমি ডেপুটি শেরিফ। আমি আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখতেই পারি। সে ব্যাপারে আইনগত কোনও বাধা নেই। আমার একাধিক রিভলভার আছে এবং কোনও সময়েই রিভলভার ছাড়া বেরোই না। কেউ যদি আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে সে টের পেয়ে যাবে কত ধানে কত চাল।‘

-তোমার বাকি রিভলভারগুলো কোথায় রাখা থাকে?

-বিভিন্ন জায়গায়।আমার ছেলের কাছে একটা আছে। আমার অফিসের আলমারিতে আর একটা আছে। আপনি বোধহয় জানেন আমার খেলার সরঞ্জামের একটা দোকান আছে। আমি বন্দুক ছাড়া কখনও বাইরে বেরোই না। কাগজে যখন পড়ি বদমায়েশগুলো বয়স্ক মহিলাদের মেরে টাকাপয়সা গয়না লুট করে পালিয়েছে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। ওদের নিরস্ত্র পেয়ে অবলীলায় খুনখারাপি লুটপাট চালায়। আমার পাল্লায় যেদিন পড়বে সেদিন দিওয়ালি হবে। গোটাকতক আমার হাতে মরলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমাদের আইন সাধারণ নাগরিকদের নিরস্ত্র করে রেখেছে। আর সবকটা বদমায়েশের হাতে বন্দুক। আমার মনে হয় সভ্য নাগরিকদের বন্দুক রাখার অধিকার থাকলে এইসব সমাজবিরোধী কাজকর্ম অনেক কমবে।

-কিন্তু পুলিশ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তোমার সঙ্গে একমত হবে না।

- আমি জানি। কিন্তু পুলিশ কী সামলাতে পারছে?

সুন্দরী অনেকক্ষণ চেষ্টা করে এতক্ষণে পানু রায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারল। পানু রায় সুন্দরীর চোখের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বড়কালীকে বলল,’ বাড়িতে নতুন পুত্রবধূ আনার জন্য তোমাকে অভিনন্দন।‘

-আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার সঙ্গে তো তার দেখাই হয়নি এখনও পর্যন্ত। অবশ্য ফোনে আমার স্নেহাশীর্বাদ জানিয়েছি।

সুন্দরী বলল,’খুব সুন্দর দেখতে আপনার পুত্রবধূকে।‘

বড়কালী বলল,’ প্রকৃত সুন্দরী ছাড়া আমার ছেলের কারও সঙ্গে বন্ধুত্বই হয়না। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা কী জান? ওর মতিস্থির নেই। সবসময় ছটফট করে। একবার এর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তো কিছুদিন পরেই আবার অন্য কারও সঙ্গে। মেয়েদের ব্যাপারে ভীষণ আবেগতাড়িত আমার ছেলে। প্রথমে এলিনার সঙ্গে আলাপ হল।আমায় বলল এলিনাকে বিয়ে করতে চায়। কয়েকদিনের মধ্যেই মত পালটে গেল। আমার ভীষণ খারাপ লাগল এলিনার জন্য। তখন মনীষা মেটারনিটি লিভে যাচ্ছিল। আমি আমার অফিসে ওকে চাকরি দিলাম মনীষার জায়গায়। ততক্ষণে ছেলে আমার রেবার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। আর সেই সূত্রেই আমি রেবাদের সম্পত্তির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। এখন থেকে ছ’ মাস আগে ভাবলাম রেবা আমাদের পরিবারেরই একজন হতে চলেছে। বেশ ভালো, বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার ছেলের জন্য খুব ভালো হবে। সেটাও হল না। হলে সত্যিই খুব ভালো হত। সে তো আমার আর কিছু করার নেই। আশা করি এবার সংসারী হয়ে একটু স্থিতু হবে। বিয়েটা হয়েছে শেষ অবধি। যাকগে শিবুলালের ব্যাপারে কী করবে ভাবছেন ?’

পানু রায় বললেন,’ চলো একবার রেবার সঙ্গে কথা বলা যাক।‘বড়কালী বলল,’আপনার মনে হয় আমার দিক থেকে দেরি হয়ে গেল?’

-চলো, গিয়েই দেখা যাক। সুন্দরী, একবার ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করে দেখ না রেবার সঙ্গে কথা বলতে পারো কি না। তোমার বলার দরকার নেই যে কৃষ্ণকালী যাচ্ছে আমার সঙ্গে। বল আমি দেখা করতে যাচ্ছি।

সুন্দরী বলল,’ দাদু, আমিও কি আসব সঙ্গে?’ পানু রায় বললেন,’ চলো, এলে তো ভালোই হয়। মালিকানা কেনার চুক্তিগুলো একবার পড়ে দেখে নিতে পারো।‘ সুন্দরী ফোন করার জন্য পাশের ঘরে গেল। বড়কালী বললেন,’সুন্দরী বেশ চটপটে এবং দক্ষ হয়ে উঠেছে এখন। একজন ভালো নির্ভরযোগ্য সেক্রেটারি পাওয়া খুব মুস্কিল। মনীষা ঝাকে কত যে মিস করি আমি কী বলবো?’ পানু রায় হেসে বললেন,’মনীষা ঝা নয় মনীষা প্রসাদ।‘ বড়কালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ সেক্রেটারিদের বিয়ে করার বিরুদ্ধে একটা আইন থাকা উচিৎ। আপনি জানেন বিয়ের পর মনীষা একটা দিনের জন্যও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি!’ পানু রায় বললেন,’ কে বলল মনীষা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি?’

-কে আবার বলবে। আমি বলছি। একটা ফোন পর্যন্ত করেনি।

-তাহলে তোমার অবগতির জন্য জানাই মনীষা দু’বার তোমার অফিসে এসেছিল তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তোমার নতুন সেক্রেটারি তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে যে তার মনে হয়েছে ঐ অফিসে তার আর কোনও দরকার নেই।

বড়কালী অবিশ্বাসের সুরে বলল,’ কী বলছেন? এলিনা ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি।‘

-হ্যাঁ। এলিনা ওকে বলেছে যে তুমি ব্যস্ত।এমনকি তোমাকে ফোন করে দেখার জন্য মনীষার অনুরোধ মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করে বলতে পার মনীষাকে প্রায় তাড়িয়েই দিয়েছে।

-তাই নাকি? যাক, আমি এখন অনেকটা স্বস্তি অনুভব করছি।

-স্বস্তি! এলিনার এইসব কান্ড জানবার পরেও?

-হ্যাঁ। স্বস্তি। আমি এলিনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ তাড়িয়ে দিয়েছি আমি ফিরে এসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ও কেন আপনাকে বলেনি আমি কোথায় ছিলাম। ও বলল আমি নাকি ওকে বলেছিলাম কাউকে না জানাতে আমি কোথায় যাচ্ছি এবং ও কেবলমাত্র আমার নির্দেশ অনুসরণ করেছে। মেয়েটা ভীষণ নাটুকে। সিনেমার নায়িকাদের মত সব কিছু নিয়ে এত নাটক করে যে কী বলব? বিশ্বাস করুন , ও প্রত্যেকটা সিনেমা যেখানে সেক্রেটারির চরিত্র আছে সেগুলো দেখে। নায়িকাদের সাজ থেকে অঙ্গভঙ্গি , কথা বলার স্টাইল সব নকল করে। একজন খারাপ অভিনেত্রী একজন ভালো অভিনেত্রীর চরিত্র চিত্রায়ণের ক্ষমতাকে অনুকরণ করলে যা হয় তাই আর কী। নাটক দেখতে দেখতে আমি তিতিবিরিক্ত হয়ে গেছিলাম। আর পারা গেল না। আজ থেকে আসতে বারণ করে দিয়েছি।

সুন্দরী ঘরে ঢুকে বলল,’ দাদু, রেবা কৈরালা তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওর অ্যাপার্টমেন্টে অপেক্ষা করছে। ‘ পানু রায় বড়কালীর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ চল, যাওয়া যাক।‘

0 comments: