0

সম্পাদকীয়

Posted in





একে একে নিভিছে দেউটি। শিক্ষা - মেধা ও মননের যে পীঠস্থান ছিল এই বঙ্গভূমি, তার মান আজ স্পর্শ করেছে গভীর খাদের তলদেশ। এর পূর্বাভাস অবশ্য ছিল। যেকোনও ক্ষেত্রে উৎকর্ষের মেরুদন্ড হলো মূল্যবোধ। যেভাবে কিছুটা সামাজিক পরিস্থিতির চাপে আর বাকিটা রাজনৈতিক সমীকরণের ভারসাম্য বজায় রাখার দায়বদ্ধতায় মূল্যবোধগুলিকে শ্বাসরোধ করা হয়ে চলেছে দিনের পর দিন, তাতে হয়তো এমনই হওয়ার ছিল। বিষয়টি নিয়ে যাঁদের লজ্জিত হওয়ার কথা ছিল, সামান্য হলেও দায় স্বীকার করার কথা ছিল তাঁরা 'পাসিং দ্য বাক' নামক একটি জনপ্রিয় খেলায় মজে আছেন। চমৎকার! আইনের জন্ম হয়েছিল সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে। কিন্তু মূল্যবোধ? সেক্ষেত্রে আইনের ভূমিকা নিয়েও কি বিতর্ক উঠতে পারে না? থাক এসব প্রসঙ্গ। জটিলতাই বাড়ে কেবল... আমরা আসলে চোখ বুজে তাকতে শিখে গেছি।

আপাতত আমরা বরং এবছর গত বছরের তুলনায় গরম বেশি পড়েছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করি! বা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নে কার কতটা দায়, তা নির্ধারণের চেষ্টা করি!

ওদিকে গতকাল ছিল ১৯ মে। আমাদের মাতৃভাষার সম্ভ্রম রক্ষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন গুটিকয়েক মানুষ। সুখের কথা, স্বঘোষিত ভাষা ও কৃষ্টির ধ্বজাধারী রক্ষকেরা তাঁদের কথা বিস্মৃত হয়ে রেহাই দিয়েছেন তাঁদের।

তবে আশার কথা এই যে, অন্ধকার যত গভীর হয়, আলোর উৎস তত দ্রুত নিকটে আসে...

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন
শুভেচ্ছা নিরন্তর!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রণবীর পুরকায়স্থ

Posted in



ঐতিহ্য একটি বহমান ধারা, চৈতন্য একটি স্বতশ্চল প্রবাহ, যা মানবেতিহাসকে উর্বরা করে। আবার ধারাবেগ প্রবল হলে জলা’র আকার নেয়, হয় বন্যা। বহমানতা এতোল বেতোল হয়, মনে হয় সৃষ্টির বুঝি এবার লয়। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বের শ্যাম বাংলার শান্তির দ্বীপে সব বাঁধ ভেঙেছিল উনিশে মে ১৯৬১ ইংরেজি। বহু ভাষাভাষীর বাসভূমি বরাক নদীর তীরে, প্রধান ভাষা বাংলার পরিবারে সুখ ছিল, শান্তি ছিল। কী জানি, কী ছিল নবীন শাসকদের মনে, স্বাধীন দেশের ঈশান কোণ থেকে উড়িয়ে দিতে পারতেন পারাবত, শান্তির দূতকে বলতে পারতেন যাও পাখি বলো তারে—পারতেন মিল করিয়ে দিতে একই হরফে লেখা, একই ভাষা পরিবারের ‘তুতো’ ভাইদের। পাশাপাশি বেড়ে উঠতে পারত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার দুঃখহরণ মাতৃভাষা আর রবিঠাকুরের সোনার বাংলা। স্ব স্ব পরিবেশে এবং সম্মিলিত অঙ্গনে। তা না করে জারি করলেন ভাষা বিল। বললেন দারিদ্র্য নয়, শোষণ নয়, বাঙালিই একমাত্র শত্রু, তাই ‘বঙাল খেদা’। পুলিশ ও ফৌজি বন্দুকের নলে বিপ্লব এল, কেড়ে নিল এগারোটি তরতাজা ভাষা সেনানীর প্রাণ৷ মুখের ভাষা রক্ষায় বুকের রুধির ঢেলে দিল বরাক উপত্যকার বাঙালি! স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে প্রান্তিক বাঙালি গাইল গান, ‘আরও প্রাণ, আরও প্রাণ, আরও প্রাণ। ওই বেদীমূলে দিতে হবে বলিদান।’ মানুষ ভুলে গেল সব, জীবন জীবিকা তুচ্ছ করে প্রতিদিন প্রভাতফেরি, প্রতিদিন শপথ নিতে হাজির হল গান্ধিবাগ, মধুরামুখ ও অন্যান্য জমায়েত স্থানে। শহিদের চিতাভস্ম নিয়ে হল নীরব মিছিল, সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে একাদশ প্রদীপ জ্বালিয়ে গাইল ‘শোনো ডাকে ওই একাদশ শহিদেরা ভাই, গাইল, ‘হবে জয়, হবে জয়, হবে জয়।’ এরপর পাঁচ-পাঁচটে যুগ চলে গেছে, ষাট বছর ধরে, বরাক উপত্যকার বাঙালির ধমনীতে এখনও উনিশে মে-র ঐতিহ্য এবং চেতনা স্বতঃবহমান। সময় পলি ফেলেছে, স্মৃতির উর্বর জমি চাপা পড়ে গেছে হয়তো। অর্ধশতবর্ষ তো কম কথা নয়, সার্ধশতবর্ষের কবিকেই আমরা কতটুকু মনে রেখেছি। গান গেয়েছিলেন বলে হয়তো এখনও ছাড়ায়ে যেতে পারিনি। চুরি যাওয়া স্মৃতি ফিরে পাওয়ার জন্য সিবিআই কিছু করতে পারেনি ঠিক। কিন্তু ধারণার তস্করকে খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ। বলছেন, ধরে আন্ চোর। বলছেন, বিশ্বায়নকে ধরে আনো। সেই তো সব মন ভোলানোর ঘটি, সব ‘কণ্ডল’ সেই করেছে। তা, বিশ্বায়নটা কে হে, বাঙালির মন চুরি করবে এতো ক্ষমতাধর।

সে তো আর রবিঠাকুরের নোবেল নয়, এক সোনার চাকতি, যে ম্যাজিক করবে! স্মৃতি থেকে পলি সরিয়ে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যেতে হবে উত্তরাধিকারের মুখোমুখি। ষাট বছর পর নবীনের অধিকার রয়েছে তথ্য জানার। তাই মাতৃদুগ্ধসম মাতৃভাষার গরিমা রক্ষায় একাদশ শহিদের কথা নতুন করে শোনানো হোক। বারবার জানানো হোক। পথে পথে, ঘরে ঘরে, পার্কে পার্কে গড়ে উঠুক নতুন নতুন শহিদবেদী, বড়ো বড়ো করে লেখা হোক শচীন, কমলার নাম। লেখা হোক হীতেশ, সত্যেন্দ্র, চণ্ডীচরণ, সুনীল, সুকোমল, তরণী, কানাইলাল, কুমুদ, বীরেন্দ্রর নাম। লেখা হোক বাচ্চু, যিশু-জগনের নাম। কিন্তু এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা। একশো পাঁচ বছর আগে এমন ছিল না।

বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের পর থেকেই বিষময় ঝড়ের প্রতিকূলতা বইতে হয়েছে বাঙালিকে। বাঙালি জীবনে দুঃখের সেই শুরু। বাঙালি কেন যে হিন্দুও হইল, মুসলমানও হইল, শুধু বাঙালি হইল না।

ও-পারে যারা ভঙ্গ বঙ্গ নিয়ে গেলেন তারাও কি সর্বসুখে আছেন, এপারের ভঙ্গ ভারতেও বাঙালিকেই শুধু ভাষার প্রশ্নে বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এক সম্মিলিত চক্রান্তের শিকার হয়ে ভাষা জননীর বেদী বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে। অখণ্ড থাকলে এমন হত না।

ও-পারে শুরু হয়েছিল ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে, এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষের উৎপাটন হয়েছিল। ভাষাশহিদের রক্তে ধুয়েমুছে গিয়েছিল মহম্মদ আলির আস্ফালন—উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের ভাষা। বাঙালির ভাষা। এ-পারেও ভাষাবেদী অপবিত্র করার আর এক চক্রান্ত শুরু হয়েছিল গোপীনাথ বরদলৈর উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাগাড়ম্বরে, আসাম শুধু অসমিয়া ভাষীর। জাতির পিতা দূর থেকে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ভারত তবে কার। এ যেন দ্যুতসভায় দৌপদ্রীর বস্ত্রহরণ দেখে পিতামহর স্বগতোক্তি, ধর্মের গতি সূক্ষ্ম।

একুশে করে দেখিয়েছে উর্দু নয়, পাকিস্তান নয়, বাঙালির নিজস্ব ভুবনের নাম এখন ‘বাংলা’ ‘বাংলাদেশ’। একুশের আত্মত্যাগ বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গরিমা। শিখিয়েছে পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতেই যা টিকে থাকবে দৃঢ়ভাবে। একুশ তাই বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস এখন। বাঙালি না হলে মাতৃভাষার অমৃতভাণ্ডারের কথা জগতে জানাত কে। আর এ-পারে স্বাধীন ভারতবর্ষেও খণ্ড ছিন্ন বাংলা ভুবনের সংখ্যা কম নয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ছাড়া অসম প্রদেশেও বাংলা ভাষীর সংখ্যা বিপুল। স্বাধীনতার শর্তে বাঙালিকে বারবার পঙ্গু করার শপথ যে নিয়েছিলেন দেশনেতারা। হয়তো নেতারাও তখন ছিলেন অসহায়৷ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিকতা ছিল না, মনে ছিল অনেক সমীকরণের অঙ্ক। তাই, সাহেবদের কথায় দেশভাগের লাইন কেটেছেন, গণভোটের প্রহসন করেছেন। হয়তো সময়ের চাহিদা ওরকমই ছিল নেতাহীন বাঙালির ভাগ্যে। তাই পূর্বপুরুষের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ছিন্ন মূলমন্ত্রকে প্রবোধ দেয় উত্তরপুরুষ। সরল সমাধানে শান্তি খোঁজে।

সমাধান এত সরল ছিল না। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অতলে যাওয়া বাঙালি দেশ নেতার অগম্য ছিল। এমনকি অসমিয়া বা দিল্লিবাসী নায়কদেরও। তাই দোষ কারো নয় বলে অদৃষ্টের পরিহাস ধরে নিয়ে, কালস্রোতে নির্বাসিতা বরাকভূমিকে বাঙালির এক মাতৃভুবন হিসেবে গড়ে তোলার শপথ এই প্রান্তিক বাঙালিকেই নিতে হচ্ছে।

অদৃষ্ট যে নয়, নইলে কেন, সিলেট জেলার একটি মহকুমা আর সাবেক কাছাড় জেলা নিয়ে একদা সংখ্যা গরিষ্ঠজনেরা নতুন সমীকরণে সংখ্যালঘু ভূখণ্ডের আবাসিক থেকে গেলেন আসাম প্রদেশের উপনিবেশ হয়ে।

সংখ্যালঘুদের পদানত করার কথা গণতন্ত্রের সনদে না থাকলেও, বাস্তবের চাতুর্যে ঘটে। বাংলাভাষী ভূখণ্ডকে অসমিয়াকরণের প্রক্রিয়া চলছে। ভাষা বিল যেমন গৃহীত হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে প্রায় দুই শতাধিক অন-অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে। তাই বরাক উপত্যকার আপামর মানুষ গর্জে উঠে জানিয়েছিল, জান দেব জবান দেব না।

উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার পরীক্ষা ম্যাট্রিক শেষ হয়েছে আঠারোই মে। উনিশ তারিখ ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বেচ্ছাসেবকের দল সরকারি অফিস-কাছারি, রেলস্টেশনে জমায়েত হয়েছে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের জন্য। মুখের ভাষায় কথা বলা, পড়াশুনা, সরকারি কাজ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে।

নবীন গণতন্ত্রে তখন কিন্তু সুখেই ছিল দ্বিশতাধিক ভাষাগোষ্ঠীর জনপদ। কেউ একনায়ক হতে চাইল বলে, একভাষিক হতে চাইল বলে, আসাম শুধু অসমিয়াভাষীর বলে আস্ফালন করল বলে বরাক উপত্যকার মানুষ একজোট হয়ে সংগ্রামে সামিল হল। বরাক উপত্যকার বদরপুর থেকে নির্বাচিত আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা নির্বাচন ক্ষেত্রকে উপেক্ষা করলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। বরাক উপত্যকার বিধায়কদের আপত্তি উপেক্ষা করে ভাষা বিল পাশ করিয়ে নিলেন।

আলাপ-আলোচনায় যখন কাজ হল না, তখন অহিংস সংগ্রামকে হাতিয়ার করলেন বরাকবাসী এবং পরিকল্পিতভাবেই বিনা প্ররোচনায় রহস্যজনকভাবে একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। উনিশে মে-র দ্বিপ্রহরে সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। গুলিবর্ষণে এগারোটি তাজা প্রাণ চলে যায়। অসংখ্য আহতও হন।

কুম্ভীরাশ্রু নিয়ে আসা আসামের মন্ত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় সদরঘাটের ও-পার থেকে। এলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। শাস্ত্রী ফর্মুলা মেনে ছেলে-ভুলানো মোয়া দেখিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল । মানুষ মানল না, বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা স্বীকৃত হল।

কিন্তু সংখ্যাগুরু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ভাষা আগ্রাসন চলছে এখনও। পাঠ্যপুস্তকে, বিজ্ঞাপনে অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া চলছে।

প্রতিরোধ প্রক্রিয়াও চলছে। ভাষা শহিদের রক্তে তাই বারবার সিক্ত হচ্ছে পুণ্যভূমি। ১৯৭২-এ বাচ্চু চক্রবর্তী আর ১৯৮৬-তে জিসু-জগনকে শহিদ হতে হয়েছে।

১৯৬১-র উনিশে মে-র গুলিচালনায় একাদশ শহিদের মৃত্যুবরণ এবং অসংখ্য আহতদের দুর্দশার কারণ অনুসন্ধানকারী তদন্ত কমিশনের রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি ষাট বছর হয়ে গেলেও। সেদিনের কিশোর গণতন্ত্র তো এখন চৌষট্টি বছরের প্রৌঢ়। ভারতবর্ষে বাংলা ও বাঙালি এখন উপেক্ষিত। দক্ষিণ ভারতে দক্ষিণী ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা হয় না সাইনবোর্ড কিংবা বাসের গন্তব্য। সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি দোকানে দোকানে ঘুরেও বাংলায় লেখাতে পারেননি পশ্চিমবাংলার রাজধানী শহরের কোনো সাইনবোর্ড। কেন পারলেন না। এই কেন প্রশ্নের ওপারে নিশ্চয়ই আছে বাংলা ও বাঙালির দুর্দশাকামী কোনো শত্রু। চিহ্নিত করার সময় কি এখনও আসেনি। ‘পানিত ছেদ মারলে হাটুত পড়ে’, বাঙালির শত্রু তো আর বাইরের কেউ নয়। নিজের ক্ষতি নিজে না করলে, কার সে ক্ষমতা করে দেশভাগ, করে টুকরো টুকরো। যা হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে বসলে ভূগোল পাল্টাবে না। জুড়ে যাবে না আবার। মনের ভূগোল পাল্টাতে তাই বার বার কামনা করা যায়, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক এবং এক হোক বাঙালির মন।

সব শেষে যে কথা বলার, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার অর্থ কিন্তু অন্য ভাষার বৈরিতা নয়। সমৃদ্ধ অসমিয়ার মতো প্রতিবেশি পেয়ে বাংলাও চায় আরও বিকশিত হয়ে উঠতে। চায় ছোটো ছোটো ভাষাগোষ্ঠীর শ্রীবৃদ্ধি, যেন কেউ হারিয়ে না-যায় অনাদরে। বরাক উপত্যকার বহুভাষিক চরিত্রকে একবৃন্তে গেঁথে রাখার দায়িত্বও প্রধান ভাষা বাংলার। কারণ ১৯শে মে-র সংগ্রাম শুধু বাঙালির ছিল না। বাংলাভাষাকে ঘিরে আমাদের সবার সংগ্রাম ছিল। তাই সকল ভাষার অগ্রগতির মধ্যেই নিহিত আছে আবহমান বাংলা তথা অখণ্ড বাংলাভাষার চেতনা।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




প্রাণি বিবর্তনের শেষে এসে মানুষের মস্তিষ্ক হল মগজাস্ত্র। গুরুমস্তিষ্ক যাবতীয় কল্পনাপ্রসূত চিন্তা, ভাষা, ভাব-আবেগ, স্মৃতি, পরিকল্পনা, বিচার, দোষ, গুণ এবং যত জটিল কর্মক্ষমতার আঁতুড়ঘর। এর জন্যেই অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা মানুষ। প্রতিটি জীবকোষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর নির্দেশ, প্রেরণা ও ঐক্যতত্ত্ব যা অগোচরে কাজ করে যায়। প্রেরণা সমস্ত দেহের প্রতি, ঐক্য সমস্ত দেহে ব্যপ্ত। যেমন মস্তিষ্কের পেছনের অংশ সঙ্কেত গ্রহণ করে সামনের অংশকে নির্দেশ দেয় মোটর সঞ্চালনে। এই ঐক্যবদ্ধতার নির্দেশ বিনম্র এবং বাধ্য। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ বৈশিষ্ট বজায় রেখে যুথবদ্ধ হয়ে একটা দেহ চালাচ্ছে। মানুষের মধ্যেও এরকম যুথবদ্ধভাবে একটা সমাজকে চালনা করার নামই সভ্যতা। এখানেও প্রত্যেকটা মানুষ স্বতন্ত্র কিন্তু কোন এক অজানা কিছুর নির্দেশে সে সঙ্ঘবদ্ধ, ঐক্য। কী সেই নির্দেশ? একসঙ্গে থাক। কেন? আত্মরক্ষা ও শিশুসহ পরিজনদের রক্ষার্থে। কে দিল এই নির্দেশ? মস্তিষ্ক। মাথার খুলির যে অংশটা ভ্রূ-কে ঢেকে রয়েছে সেই অংশে মানুষের ন্যায়-নীতি বোধ, দূরদৃষ্টি, আধ্যাত্মিকতা, সৃষ্টিমূলক চিন্তার রান্নাঘর। এখানেই আবেগ জন্মায়।

আবেগের প্রকাশ নানাভাবে হয় যার মধ্যে একটা হল ভাষা। সাহিত্য, নৃত্য, ছবি আঁকা, ছবি তোলা বা ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যম। একই জিনিস কিন্তু প্রতিটা মানুষের আবেগ ভিন্ন হওয়ায় তার চিন্তা এবং প্রকাশ নিজস্ব হয়ে যায়। আমাদের চারিদিকে কত কি ঘটে যায় অহরহ, কিছু মনে দাগ কাটে কিছু মিলিয়ে যায়। কত কি শুনি, দেখি; ইন্দ্রিয়েরা সদাজাগ্রত, আমাদের জানিয়ে দেয় সব কিন্তু সব কি দেখি বা শুনি? মস্তিষ্ক কিন্তু সব সঙ্কেত গ্রহণ করছে ও পাঠাচ্ছে। মানুষের আবেগ তার চরিত্র অনুযায়ী বেছে নিচ্ছে স্মৃতিতে রাখার জন্যে। এই আবেগের সাথে কল্পনা মিলেমিশে শিল্পের সৃষ্টি।

আমাদের এই বাংলায় এমন দুজন শিল্পী দুই পিঠোপিঠি শতকে জন্মেছেন যাঁরা তাঁদের আপন আপন শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। একজন উনিশ ও বিশ শতকের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দ্বিতীয়জন বিশ শতকের সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে সর্বোৎকৃষ্ট সম্মান নোবেল দ্বারা পুরস্কৃত আর সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে সর্বোত্তম অস্কার বিজয়ী। রবীন্দ্রনাথের শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্র বিশাল। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠি, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নাটক, প্রহসন, বক্তৃতাসম্ভার, ছবি আঁকা আর সর্বোপরি গান যা তিনি নিজে লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও আরও নানা বিষয়ে আগ্রহ ও প্রকাশ। সত্যজিতের প্রধান শিল্পক্ষেত্র চলচ্চিত্রের বাইরে ছবি আঁকা, ক্যালিগ্রাফি, বিভিন্ন স্বাদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, বক্তৃতামালা, ফটোগ্রাফার এবং আরও অনেক কিছু। সত্যজিতের ক্ষেত্রে শুধু চলচ্চিত্র বললে সবটা বলা হয় না বরং বলা ভাল ফিল্ম ইন টোটালিটি। তিনি শুধু পরিচালকই নন, একাধারে চিত্রনাট্য, সঙ্গীতস্রষ্টা। এ দুটো তো টাইটেল কার্ডে থাকতই এছাড়া তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের সব বিভাগেই তিনি ছিলেন শেষ কথা। দুজনেই আবেগপ্রবণ এবং চিন্তাশীল কিন্তু আপন আপন গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ। তবু যখন রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ ছবি তৈরি করেন তখন এই দুই মহান শিল্পীর আবেগের মিশ্রণ নিজ সত্তায় আমাদের কাছে ধরা দেয়। সেই ধরা দেওয়াটাও আবার দর্শকদের মধ্যে স্বতন্ত্র যেমন সেই গল্প পাঠে হয়। তবু গল্পের সাথে পাঠকের আবেগের অনেক মিল থাকতেও পারে, থাকেও কিন্তু সেই গল্প নিয়ে সত্যজিৎ যেভাবে তাঁর শিল্প মাধ্যমে গল্প বলেন তার সাথে মিল থাকাটা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ নয়।

দার্শনিকদের মতে মানুষের সত্তা তিনটে লোকে বিচরণ করে। প্রথমটা আমাদের এই শস্য-শ্যামলা, সমুদ্র-নদী, পাহাড়-মরু ভরা পৃথিবী যার কোনো অংশ মানুষের কাছে আর দুর্গম নয়। দ্বিতীয় আশ্রয় মানুষের স্মৃতিলোক। একমাত্র মানুষের স্মৃতিই দীর্ঘস্থায়ী এবং সুখে-দুঃখে মানুষ স্মৃতির কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে। মানুষ শুধু নিজের স্মৃতি রোমন্থন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি, নির্বাক পৃথিবীর স্মৃতিও উন্মোচন করে তাকে সবাক করে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। পূর্বপুরুষদের কাহিনী তার প্রজন্মের স্মৃতি উদ্রেক করে বিশ্বমানবের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেছে। আর এর থেকেই উদ্রেক হয়েছে চিত্তলোক যেখানে সকল মানুষের অন্তরের আশ্রয়স্থল। একের সাথে অন্যের অন্তরের মিলন ঘটায়। আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে বেরিয়ে তাই তো মানুষ আগুনের মধ্যে ঢুকে দগ্ধ মানুষকে উদ্ধার করে। কোনো অন্যায় কাজের জন্যে অনুশোচনা করে। এই যে সর্বমানবসত্তা এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব। এর জন্যেই সে শ্রেষ্ঠ। এই মনুষ্যত্ব মানুষের আবেগ পরিচালনা করে। ফুলকে সুন্দর বলে মনে করে, চাঁদকে মায়াময় মনে হয়, হিংস্রতায় কষ্ট পায়, বিচ্ছেদে বিরহ আসে। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে বলেছেন, “আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি মানবিক ভূমা। তার বাইরে কিছু থাকা বা না-থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন।”


সত্যজিতের ফিল্ম জীবন

মানুষই প্রধান চরিত্র সত্যজিতের ছবিতে। সেখানে ফুটে ওঠে সেই চিরাচরিত দ্বন্দ্ব – জীবনের সঙ্গে শিল্পের, কর্তব্যের সাথে আবেগ, এবং মুক্ত ইচ্ছের বিপরীতে ভবিতব্য। এটাই নানা ভাবে নানা গল্পে জীবনে জীবনে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। স্বাধীনতার পর দেশের আধুনিকীকরণ গ্রামীণ সমাজে যে ধাক্কা দিয়েছিল তার একটা প্রতীকী দৃশ্য অপু তার মায়ের স্নেহকে উপেক্ষা করে, গ্রামের ওই পরিবেশে অসুস্থ মাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে তার নতুন জীবনের সন্ধানে চলে গেল। জমিদারপ্রথা বিলোপের প্রতিক্রিয়া দেখাতে চমৎকার সৃষ্টি জলসাঘর। আবার নারীর মধ্যে দেবীর রূপ আরোপিত করার প্রবণতা যখন চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছায় সেই মানসিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ দেখিয়েছেন দেবী চলচ্চিত্রে। বিজ্ঞানবিরোধী মতাদর্শে শিক্ষিত আজকের হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাষ্ট্রের অশ্লীল আস্ফালন সম্পর্কে অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন তিনি। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে অনবরত বয়ে চলেছে নানাবিধ দ্বন্দ্ব। সত্তার ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র রূপ।

প্রতিটা শিল্পেই শিল্পীর সারাজীবনের কলাকৌশলে একাধিক মোড় থাকে। থাকতেই হয়, নইলে শিল্প এগোয় না। সত্যজিতের একাধিক শিল্পসৃষ্টির অন্যতম এবং প্রধান চলচ্চিত্র শিল্পেও অন্তত তিনটে মোড় খুব স্পষ্ট। প্রথম ধাপে তিনি সমাজের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাচ্ছেন- এর শুরু ১৯৫৫-য় ‘পথের পাঁচালি’ দিয়ে এবং শেষ ১৯৬৭তে ‘চিড়িয়াখানা’-য়। এরপরেই দেখা যাচ্ছে তিনি সমাজের অন্দরে ঢুকে বিশ্লেষণে তাঁর শিল্পমাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছেন, প্রথম হাতেখড়ি ‘গুগাবাবা’ এবং তারপরে একের পর এক ছবিতে নিজের জিনকেই কাটাছেঁড়া করলেন, তৈরি হল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘অশনি সঙ্কেত’। ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে তিনি সরাসরি ঘুমন্ত দর্শককে চাবুক মেরে জাগিয়ে তোলেন। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। টাকার লোভে মধ্যবিত্ত ঘরের মা-বোনকে বৃহৎ পুঁজিপতির অঙ্কশায়িনী করে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না এই ভয়াবহ সত্য উচ্চারিত হল। নারী ও মাতৃজাতির প্রতি মধ্যবিত্তের ভক্তির পেছনে খেলা করে নারীমাংস-ব্যবসাকে আড়াল করার একটা আত্মপ্রতারণা। সিনেমা হল থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন সত্যজিৎ এবার আমাদের দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি। এই দেখা ‘নায়ক’ ছবিতেও আছে, এবং চলেছে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ এবং ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এও। ‘গুগাবাবা’র মত আপাত নিরীহ গল্পের দ্বিতীয় ভাগে ‘হীরক রাজার দেশে’-য় এসে গেল খুল্লমখুল্লা রাজনীতি, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এরপর আর লুকোছাপা নয়, বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের মুখোশ খুলতে আশ্রয় নিতে হল রবীন্দ্রনাথের, সৃষ্টি হল ‘ঘরে বাইরে’। তার আগেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। বুঝে গেছেন, সময় অল্প, বলতে হবে এবার নিজের গল্প। না, আত্মজৈবনিক গল্প নয়, সমাজ সম্পর্কে এতদিনের যত অভিজ্ঞতা তা প্রকাশ করার সময় এসেছে। দর্শক এখন সিনেমা দেখায় শিক্ষিত। এইখানেই তাঁর শেষ মোড়। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-রাজনীতিজীবী-মানবসেবী-ভদ্রসমাজের চোখের সামনে রাখলেন আয়না। একসময় ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া লোক যিনি অরণ্যে ঘুরে ঘুরে দিনরাতের গল্প বলেছেন, তিনি এখন ঘরে বসে বাইরের সমাজের গল্প বলতে শুরু করলেন। এবার আর বিশ্লেষণ নয়, সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কোথায় আমরা আছি, কী ভাবছি আর কী ভাবা উচিৎ, কী করছি আর কী করা কর্তব্য। মনমোহন মিত্রকে মনে আছে? সেই-ই যেন শেষ তিনটে ছবিতে ঘোরাফেরা করছে। মনের মধ্যে জমা বিদ্রোহ যেন ক্রোধকম্পিত হয়ে উঠছে। তার প্রথম প্রকাশ ‘গণশত্রু’। হেনরিক ইবসেনের অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল-এর ছায়া অবলম্বনে তৈরি এই ছবি, প্রবল জনপ্রিয় তারকেশ্বরের শিবের মন্দিরে দূষিত পুকুরের জলকে চরণামৃত বানিয়ে অন্ধভক্তদের চিটিং করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ডাক্তারের সাথে বিবাদে জড়ালেন জনপ্রতিনিধি। কী করুণ অবস্থা এই ধর্মীয়সংস্কারে ডুবে যাওয়া লোকজন যাদের বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে আর তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে এই জনপ্রতিনিধিরা। এর পরের দুটো ছবি সত্যজিতেরই লেখা। সুবিধেবাদী, অসৎ মধ্যবিত্তের অর্থলোভের ভয়ঙ্কর ছবি ‘শাখা-প্রশাখা’ যেখানে শিশুও জেনে যাচ্ছে দু-নম্বরি কথাটা। অসদাচরণ অহঙ্কার এবং ধর্মের চেয়ে বড় উচ্চবিত্ত হওয়ার বাসনা, কথার চাবুকে নীতিহীন সমাজকে জর্জরিত করেছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান যখন মমতামাখানো আবেগে ‘বাবা’ বলে ডাকে সেখানেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় মানবিকবোধ। প্রশ্ন জাগে, তাহলে আসলে কারা মস্তিষ্কবিকৃত?

আগন্তুক

শেষ দুটো ছবিতে সত্যজিৎ মেঘনাদের মত মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করেছেন। এবার মনমোহন মিত্র সেজে সরাসরি নেমে এসেছেন মাঠে এক ‘আগন্তুক’। ‘অতিথি’ নামে নিজেরই এক গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ। সত্যজিৎ রায়ের চেহারা উৎপল দত্তের মেকআপে। ডান চিবুকের তিলটা শুধু গালে উঠে বসেছে। দুজনের জীবনও অনেকটা একরকম। উৎপলের অভিনয়ে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের দুকলি গান সত্যজিতের গলায়। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা, বিস্ময়বোধ, নানা জায়গা ও প্রাচীন সভ্যতার মত নানা অজানাকে জানার আগ্রহ মনমোহনের এসব তো আমরা সত্যজিতের জীবনেই দেখি। আড্ডার মধ্যেই গল্পচ্ছলে চিনিয়ে দেন মানুষের প্রতি প্রতিষ্ঠিত অবিশ্বাস মানুষের পরম শত্রু। আর এই অবিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখাই রাজনীতির মূলধন। স্যাটায়ারিক ভঙ্গিতে বলেন, দুর্নীতির আশ্রয় যে নেয় না, মুদ্রাদোষ যার নেই, সে কি এই গ্রহের জীব? মেকি সভ্যতার চেয়ে আদিম সভ্যতাই শ্রেয়- এটাই সত্যজিতের শেষ কথা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শিল্পের দ্বারা নানাভাবে বৈচিত্রময় গল্পের মধ্যে দিয়ে মানবিকবোধ প্রচারের এই ভঙ্গি মানুষের মন জয় করে।

আগন্তুক মনমোহন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় বাড়িছাড়া এবং পশ্চিম গোলার্ধ ভ্রমণের শেষে পূর্বে যাওয়ার আগে ভারতে এসেছেন। সেই অবসরে কলকাতায় ভাগ্নীর বাড়ি তাঁর আগমন। ভাগ্নীর দু বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন ফলে দুজনেই পরস্পরের কাছে দৃশ্যত অপরিচিত হলেও সম্পর্ক হারায়নি। ছোটমামা আসল না নকল এই ধাঁধায় ভাগ্নী ও তার স্বামীর কথোপকথন থেকে তাদের ছেলে বলে ওঠে “জাল দাদু”। এই ধন্ধ থেকে বেরোতে সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্যের মুনশিয়ানায় সমাজ ও সভ্যতার মেকি মুখোশ পরতে পরতে খুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ প্রদত্ত ভাষণে সভ্যতার যে সংকটের কথা উল্লেখ করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন আগামী প্রজন্মের ভয়াবহতা তার পঞ্চাশ বছর পর সত্যজিৎ সেখান থেকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেই সংকট নিম্নচাপ থেকে কিভাবে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। আজকের দিনে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতিকে যেভাবে কাজে মানবতা ধ্বংসে কাজে লাগানো হচ্ছে সেটা তিনি অসুস্থ অবস্থায় তাঁর শহর কলকাতায় বসে উপলব্ধি করে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। বিশ্বখ্যাত পরিচালক ফেডেরিক ফেলিনি, যাঁর শতবর্ষ সত্যজিতের সাথেই ইটালিতে পালিত হচ্ছে, তাঁর দেশের এবং সংলগ্ন ভূমধ্যসাগর পরিবেশের উপযুক্ত চিত্রনাট্যের ওপর সিনেমা বানিয়েছিলেন যদিও তখন দেশটা নাজিদের দখলে ছিল। কিন্তু সত্যজিৎ কলকাতায় বসে উপলব্ধি করেছিলেন পৃথিবীব্যাপী সমাজের অবক্ষয়, যুদ্ধ, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক তিক্ততা, শুধু রাষ্ট্র নয় মানুষের সম্পর্কে পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের আবহ এবং আক্রমণ। সেটাই ভয়ঙ্কর ভাবে উঠে এসেছে তাঁর আগন্তুক ছবিতে। আমরাও ছবি দেখতে দেখতে ভাবি আগামী ভবিষ্যতে মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সত্যজিতের এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আকিরা কুরোসাওয়ার শেষ দুট ছবির ভাবনার মধ্যে মিল দেখা যায়। দার্শনিকদের ভাবনায় এভাবেই মিল দেখা যায়। প্রশ্ন উঠে আসে ‘সভ্য কারা?’ ব্যতিক্রমী এই চিন্তাই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় নয়তো আমরা অনেকেই সামাজিক এই ধসের সাক্ষী কিন্তু শিল্পী তার মাধ্যমে সেটাকে ‘জুম’ করেন বলেই আমাদের চিন্তার জগতকে ধাক্কা দেয়।

সভ্য, সভ্যতা ও সিভিলাইজেশনের আধুনিক রূপ দেখে তিনি রীতিমত আতঙ্কিত। তবু জনমোহিনী বিশ্বায়নের প্রকৃত রূপ ও উদ্দেশ্য দেখার সুযোগ পান নি। মানুষের নিজস্ব চিন্তাশক্তিকে কীভাবে মগজধোলাই করে একটা রাজনৈতিক বিশ্বাসের বশে এনে অকেজো করে দেওয়া যায় তা বিগত শতকে ত্রিশের দশক থেকে রাজনীতির আবহাওয়ায় প্রকট ছিল। ঠিক অনেকটা প্রাচীনকালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মত। সে সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন যার প্রতিফলন তাঁর ছবিতে আছে। বর্তমানে ডিজিটাল সমাজ এবং তার আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিন সামগ্রীর মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারিত অর্ধসত্য ও মিথ্যা আপাত-সত্যের মোড়কে যেভাবে মগজধোলাই করা হচ্ছে সেটা সমাজের প্রায় সব শ্রেণিকেই আক্রান্ত করেছে। বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরীয় পরিচয়ের আড়ালে মানুষ তার নিজের পরিচয় হারাচ্ছে। এপিডেমিক আকারে সমাজের বড় ক্ষতি করে যাচ্ছে। আমরা হতবাক হয়ে দেখে যাচ্ছি এই পতনের কিন্তু আজ রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিতের মত শিল্পী নেই যে ‘জুম’ করে দেখাবে।

সভ্যতা কাকে বলে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে মনোমোহন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কিছু উদাহরণ দিয়েছেন যার প্রকাশ মানুষের শিকার-সংগ্রহের যুগ থেকে। আমি চলে যাব তারও আগের যুগে যখন মানুষ ছিল না, মানব গণের প্রাথমিক প্রজাতি ছিল পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। এই লেখা শুরু হয়েছে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন নিয়ে। সেই সূত্র ধরে বিজ্ঞানের আবিষ্কার সেদিন আলোর মুখ দেখল যেদিন সেই প্রজাতির মানব বুঝতে পারল শিকারের জন্যে মাটি বা বালির থেকে পাথর অনেক দূর অবধি ছোঁড়া যায় এবং নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে পাথর ছুঁড়ে আক্রমণকারীকে তাড়ানো যায়। ভর বা ওজনের তারতম্য বোঝাটাই বিজ্ঞান আর তার প্রয়োগ ছুঁড়ে মারা। এবার যখন আঘাতের মাত্রা তীব্র করার জন্যে সে পাথর ঘষে ছুঁচলো করলো শুরু হয়ে গেল প্রযুক্তির যুগ। যুথবদ্ধ থাকা সভ্যতার আজও শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আর আগুনের ব্যবহার সংস্কৃতির ভিত। সেইসব ‘অশিক্ষিত’ লোকেদের এইসব ‘মৌলিক’ আবিষ্কার আজকে আমাদের পৃথিবীকে যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে সেখানে বসে আমরা ক’জন তাদের কথা স্মরণ করি। জানিই না কারণ জানানো হয় না, সেটাই আধুনিক শিক্ষা। যা করেছে সব আজকের মানুষ বড়জোর দু-তিন হাজার বছরে অথবা দু-তিনশো বছরে বা আরও সংক্ষিপ্ত করে প্রচার হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সভ্যতার সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মনমোহনকে ‘জাল’ প্রমাণ করতে আসা এক দুঁদে উকিল। আমেরিকায় বসবাসকারী উপজাতিদের সভ্যতার উচ্ছসিত প্রশংসার মুখে ছাই দিয়ে তাদের ফ্রি-সেক্স বা মুক্ত যৌনতা নিয়ে কটাক্ষ করে উকিলবাবু বলেন সেটাও কি সভ্যতা? এই সময় থমকে যান মনমোহন; সম্ভবত সত্যজিতও, চিত্রনাট্য লেখার সময়। যে কারণে ভদ্রতাবশত এই সাধারণ প্রশ্ন করার আগে উকিলবাবু তার বন্ধুজায়ার ক্ষমা প্রার্থনা করেন ঠিক সেই কারণেই মনমোহনকে থমকে দেয় এবং পরে মাথা নেড়ে ঋণাত্মক জবাব দেন। এখানেই খটকা জাগে। সামাজিক সংস্কার মেনেই হয়তো এই চিত্রনাট্য কিন্তু সত্যজিৎ নিশ্চয়ই জানতেন প্রাণিজগতে বহুগামিতা স্বাভাবিক ধর্ম, উভয়লিঙ্গেরই। অস্বীকার করার উপায় নেই যবে থেকে যৌনাঙ্গ আড়ালের ব্যবস্থা হল তখন থেকেই যৌন অত্যাচারের শুরু। শরীরাচ্ছাদনের প্রয়োজন হয়েছিল হিমবাহের কঠিন ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে, পশুর চামড়া ব্যবহার করে। তখন কিন্তু মানুষের এবং তার ঠিক আগের প্রজাতি নিয়েনডারথালের জনসংখ্যা মাত্র কয়েকহাজার করে। পরে মানুষ যখন একা, আর তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রজাতি নেই তখন জনসংখ্যা কিছুটা বাড়ে, দশ-বারো হাজারের মত। আজও উপজাতিদের মধ্যে ঊর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত দেখা যায়, তথাকথিত ‘সভ্য’ জগতের যৌন অত্যাচার সেখানে নেই, যৌন সংযম তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। এরা নাকি ‘অসভ্য’! সভ্য জগতে যৌন অত্যাচার আজও হয়ে চলেছে; পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ অনাহারে থাকে, পানীয় জল পায় না, পরিচ্ছদ নেই শিশুদের, চিকিৎসাব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনো ধারনাই নেই। অন্যদিকে মানুষ মহাকাশচারী। এই কি সভ্যতা? এই মানুষকেই বলা হয় সভ্য?

প্রকৃতির মধ্যে মানুষ জন্মেছে। প্রকৃতি থেকেই মানুষের শিক্ষা। প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে চলার বদলে তাকে ধর্ষণ করে, অসম্মান করে, লুণ্ঠিত করে এগিয়ে যাওয়াকে বলা হয় সভ্যতা। এর বিরুদ্ধে শিল্পীরা তাদের নিজ নিজ মাধ্যমে আওয়াজ তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মাধ্যমে কঠোর আঘাত হেনেছেন আর সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে। মনমোহনের লিপে সত্যজিৎ তাঁর কণ্ঠে গেয়েছেন “অন্ধজনে দেহ আলো / মৃতজনে দেহ প্রাণ”; প্রশ্ন তুলেছেন, “কে দেবে এই প্রাণ?” এর উত্তর জানা নেই আজকের সবজান্তা পাবলিকের অথবা গুগল জ্যাঠার।

মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে পশ্চিম থেকে আগত ‘আগন্তুক’এর পূর্বাচলের পথে প্রস্থানের পরের বছরেই স্রষ্টা তেইশ এপ্রিল ১৯৯২ মহাপ্রস্থানের পথে পাড়ি দেন।

0 comments:

2

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন শাস্ত্র, বেদে কালীর উল্লেখ আছে একমাত্র একটি স্থানে। যেখানে অগ্নির সাতটি শিখার নামকরণ করা হয়েছে। সেই শিখার মধ্যভাগে আছে যে শিখা, তাকেই কালী বলা হয়েছে। কিন্তু অধ্যাত্ম দর্শনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণ ও শব্দের অর্থ ও ব্যুৎপত্তি ছাড়াও একটি মর্মার্থ জানা যায়। সেই মর্মার্থ অবশ্য জানিয়ে দেন কোনো ত্রিকালদর্শী মহামানব। আমরা জেনেছি তাই, ‘কালী কে? না, যিনি মহাকালের সঙ্গে রমণ করেন’।

মহাকাল বলতে আমরা সাধারণত কিছুই বুঝিনা। যাই বলিনা কেন, সে শুধু কথার কথা। ‘কাল’ বা ‘সময়’ বলতে যে ধারণা আমরা পোষণ করি তা নিতান্তই সীমিত। এর জন্য দায়ী আমাদের মস্তিষ্কের ধারণাশক্তি। এই দেহটার একদিন জন্ম হয়। তারপর সে দেহ বেড়ে ওঠে। শেষে একদিন লয় হয়। এই দেহের সৃষ্টি স্থিতি ও লয়ই আমাদের কাছে একমাত্র স্থির সত্য। ‘কাল’কেও তাই আমরা এই সময়ের মধ্যে সীমায়িত করি। যে নিত্য বর্তমান কাল, ঘটমান মহাকাল, তাকে আমরা ধারণায় আনতে পারিনা। অথচ মহাকাল আছে। যে কালে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি ও লয় হয়। আবার এসবই এককালে হয়। যেমন, গোলোকে বসে লক্ষ্মী একটি ভারী শব্দ শুনতে পেলেন। দেখলেন, নারায়ণ উঠলেন। পরমুহূর্তে আর একটি অনুরূপ শব্দ হল। নারায়ণ ফিরে এলেন। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গেলেন? আর এত তাড়াতাড়ি ফিরলেনই বা কি করে? উত্তরে নারায়ণ বললেন, প্রথম শব্দটিতে রাবণ জন্মালেন। দ্বিতীয়টিতে তিনি বধ হলেন। গল্পটি পৌরাণিক। রূপক অর্থে, রাবণের জন্ম ও মৃত্যু গোলোকের হিসেবে মাত্র একটি লহমা। সুতরাং, গোলোক বা মহাবিশ্বের সেই বিশুদ্ধ অস্তিত্ব যেখানে, সেখানে পৃথিবীর শত বছরের হিসেব এক লহমা মাত্র।

আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা মতে, দুভাবে ব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলছে। তার মধ্যে প্রধান যেটি তা হল, আদি বিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং)। প্রাথমিক স্তরে একটি অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রাবিশিষ্ট জ্যোতিপুঞ্জ নিজের ভিতরেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলে। এবং, পার্থিব সময়ের হিসেবে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটি প্রসারিত হতে থাকে আলোকের গতিতে। লক্ষ লক্ষ বছর পরের বিশ্ব এখন এরকম রূপ নিয়েছে। সেই একমাত্র বিশুদ্ধ জ্যোতিপুঞ্জ থেকে নানা পদার্থের সৃষ্টি। নানা গ্রহ নক্ষত্র ও ছায়াপথের সৃষ্টি। এই মহাবিস্ফোরণের আগে নাকি ‘কাল’ বলে কিছু ছিলনা। অর্থাৎ ‘কাল’ গণনা করা অসম্ভব। তাহলে তার আগে কি ছিল? বিজ্ঞানীরা ফিরতে চাইছেন সৃষ্টির সেই আদিক্ষণে। আর আমাদের অধ্যাত্ম দর্শন জানিয়ে দিচ্ছে, ‘মা তখন শূন্যরূপা শশীভালী’। আমরা জানতে পারছি, ওই বিশুদ্ধ জ্যোতিপুঞ্জই ‘শূন্যরূপা আদ্যাশক্তি’ যা থেকে চক্রাকারে এই মহাবিশ্ব জন্ম নিচ্ছে আবার ‘কালে’ তা লয় পাচ্ছে। কারণ, পদার্থবিদ্যার আর একটি তত্ত্ব জানাচ্ছে, ব্রহ্মাণ্ড চিরকাল এই চক্রতে আবর্তিত হচ্ছে। সৃষ্টি স্থিতি লয় থেকে আবার সৃষ্টিতে ফিরে আসা।

সেই মহাকাল থেকে যে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয় তার কারণ প্রকৃতি, কালী বা আদিশক্তি। ‘যখন নিষ্ক্রিয় তখন ব্রহ্ম বলে কই, যখন সৃষ্টি স্থিতি লীলা করেন, তখন তাকে মা বলে কই।’ এই মহাকালের সঙ্গে লীলায় ক্রমে নিষ্ক্রিয় শক্তিপুঞ্জ প্রকৃতির বুকে পদার্থের রূপে প্রাণ রূপে জন্ম নেয়। সেই জন্মদাত্রী পরমাপ্রকৃতিই কালী।

একটি মাত্র জ্যোতিপুঞ্জ থেকে তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে নানা পদার্থের উদ্ভব। নানা গ্রহ তারার সৃষ্টি। ক্রমে এই যে অনন্ত মহাবিশ্বের রূপ প্রতিভাত হচ্ছে, এর একটি ব্যাখ্যা বেদে আছে। বেদ বলছে, উর্ণনাভ আর তার জালের কথা। বলছে, উর্ণনাভ বা মাকড়সা যেমন তার দেহ থেকে রস বের করে তাই দিয়ে জাল তৈরি করে তাতেই বাস করে ঠিক তেমনই আদ্যাশক্তি নিজদেহের থেকে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করে তাতেই বাস করছেন। এই জগতরূপী জালই তাঁর মহামায়া। যেখানে নানা পদার্থ নানা প্রাণের ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রতিভাত হয়। আমরা এই বৈচিত্রে চমকিত হই। মূলে কিন্তু আদ্যাশক্তি একটি জাদু সৃষ্টি করেন। মায়া বা ইলিউশান। ইলিউশান বা মায়া বলতে আমরা বুঝি যা সত্য নয় তাকেই সত্য বলে মনে করা। অর্থাৎ, আদ্যাশক্তি এই জগতের বিভিন্নতার জন্য দায়ী। মূলে তাঁর বিশুদ্ধ শূন্য জ্যোতিরূপ এখানে মায়ায় বহু বলে প্রতিভাত। এই মহামায়াই কালী। তাঁর মায়াকে কে ছিন্ন করতে পারে? বিশেষত আমাদের এই দেহই যখন সেই মায়ার রূপে জন্ম নিচ্ছে। দেহের এই বোধ, ‘আমি এই দেহ’ এই মহামায়া থেকে মুক্তি কিসে? একটু পরে সে আলোচনায় আসছি।

একজন জানা লোক যদি বলে দেয়, এই এই, তবে বিষয়টা সরল হয়। কেন এই রহস্য? সেই কারণ বলতে গিয়ে মহামানব বলছেন, ‘কালী কালো কেন? দূরে তাই কালো। কাছে গিয়ে দেখো। কোনো রং নাই’। তাঁর কথার অর্থ, যা কিছু অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢাকা তাই কালো। মহাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণ গহবরের মতো। অথচ সেই কৃষ্ণ গহবরের কি অনন্ত শক্তি! কী তার আকর্ষণ! যা কিছু তার প্রভাবের বৃত্তে এসে পড়ে তাই সেই গহবরে দুরন্ত গতিতে ঢুকে যায়। আলো পর্যন্ত সেই গহবরের থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে পারে না। আলোকে গিলে নেয় সেই কালো। ঠিক এমনই ভাবে কালী আমাদের অতীত ও ভবিষ্যৎকে গিলে রাখেন। জ্ঞানের আলো পর্যন্ত কালী গিলে ফেলেন। কিন্তু যার জ্ঞাননয়ন উদ্ভাসিত, তিনি সেই কালীকে জানতে পারেন। অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, কালের এই গতিই জগত। যার গতি আছে তাই জগত। গতি কথাটির মধ্যে দুটি মাত্রা লুকিয়ে। একটি স্থান ও অপরটি কাল। সুতরাং, কালে কালে দৃশ্যমান জগতকে যে মহামানব প্রকাশিত হওয়ার আগেই দেখতে পান, ধারণা করতে পারেন, তিনিই কালীর রহস্য সম্যক অবগত। তাঁর কাছে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আসলে একই কালের প্রকাশ। মহাকাল। স্থান ও কালের নাশ হয়ে জগত তার স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। তাই অজ্ঞানতা নেই। সে আর ‘কালো নয়’। কিন্তু কাছে গেলে কি রং হয়? ‘কোনো রং নাই’। অর্থাৎ, রঙের সীমায় সে আবদ্ধ নয়, কারণ ‘সে তখন এত বৃহৎ যে ধারণা করতে পারবেনা’। সেই বৃহৎ, সেই অনন্তের অনুভূতিই ঈশ্বরীর আশিস। ‘তাঁর কৃপা হলে হাজার বছরের অন্ধকার ঘর একক্ষণে আলো হয়’। এই যে অকস্মাৎ তমসা নাশ হয়ে মাথার মধ্যে সহস্রদল জ্যোতিপদ্ম উদ্ভাসিত হয়, এক মুহূর্তে এ সৃষ্টির আদি কারণ উন্মোচিত হয়, তাকেই কৃপা বলি। এ আপনা থেকে হয়। কোনো সাধনা কোনো শাস্ত্রাচার, কিছুতেই এ জ্ঞান উপলব্ধ হয়না। কেন কারো কারো হয়, সেই কারণ আমরা জানিনা। তাই কৃপা বলি। তাই বলি, বিদ্বত। আপনা থেকে হওয়া।

কৃষ্ণগহবরসদৃশ ‘কালী’ আপন অন্তরে সমস্ত জ্ঞানের আলোকে লুকিয়ে রাখেন। যে তাঁর কেন্দ্রে গিয়ে প্রবেশ করে সে সেই আলোর সন্ধান পায়। অন্যেরা পায়না। তারা এই পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে সদা ঘূর্ণায়মান। তাদের কাছে দিনরাত্রির জীবনের অতিরিক্ত কিছু নেই। অথচ মহাবিশ্ব মহাশূন্য মহাকাল বা কালী সেই মহাকারণ, যা আমাদের ধারণার বাইরে থেকে যায়।

তাহলে উপায় কি? আমাদের মনে এই পরমাপ্রকৃতি মাতৃস্বরূপিনী। মা যেমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন তেমনই ঈশ্বরী আমাদের ধারণ করেন, এবং ‘কালে’ আমরা ভূমিষ্ঠ হই। আবার ‘কালে’ লয় হয়। তিনি আমাদের গ্রাস করেন। মহামানব বলছেন, ‘মা ভয়ংকরা কালকামিনী, এই জগত প্রসব করছেন আবার গিলছেন’। এ কথায় আমরা ভীত হই। মা কেমন করে সন্তানকে গিলে ফেলবেন? এ ভয় আমাদের ওই মায়ায় আবদ্ধ বোধ।

এবার মহাবিশ্ব থেকে মুখ ফেরাই নিজের প্রতি। আমরা নিজেদেরই কি জানি? নিজের দেহ নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? কিছুই না। কারণ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান আমাদের জীবচৈতন্যকে এই জগতের আহারটুকু জুগিয়ে যায়। কখনোই তা আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রকাশ ঘটায় না। তাই প্রথমে জীবচৈতন্য থেকেই শুরু করা যাক।

মহামানব বলছেন, ‘কালী এই দেহ’। কারণ মা আমাদের জন্মদাত্রী। জন্মের আগে আমরা শূন্যে ছিলাম। শূন্য থেকে আমরা মাতৃজঠরে স্থান পেয়েছি। ভ্রুনাকারে বৃদ্ধি পেয়েছি। এই যে নির্গুণ বা শূন্য থেকে আমরা দেহ পাই তার একটি অস্তিত্ব আছে। শূন্যরূপা এই দেহ বা শ্যামামায়ের কল সৃষ্টি করেন। কেন? নিজেকে প্রকাশ করবেন বলে। অর্থাৎ শূন্য বা নির্গুণ থেকে সগুণে প্রকাশিত হবেন। ক্রমে তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে তিনি আমাদের শূন্যে ফিরিয়ে নেন। অতএব ‘দেহ’ শ্যামামায়ের কল। যে দেহ সগুণ, পদার্থের সমাবেশ। দেহে যে জীবত্ব তা ক্রমশ শিবত্বে পরিণত হবার জন্য যাত্রা করে। কোথায়? বাইরে নয়। এই দেহেই জীবত্ব শিবত্বে পরিবর্তিত হয়।

আমাদের লৌকিক জগতে আসি।

আরাধনা কেন করি? এ নিয়ে আমাদের সবার মনেই কিছু বদ্ধমূল ধারণা আছে। প্রথমত, মানুষমাত্রই নিরালম্ব জীবনে অসহায় বোধ করে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই ঈশ্বরের ধারণা। একজন আছেন, তিনি আমাদের সর্ব অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করেন, প্রধানত এমন একটি কল্পনা থেকেই এই ভাবনার উদয়। ক্রমে যুগে যুগে ঈশ্বরত্বের ধারণায় যে বৃহৎ চেতনা, যে জটিল দর্শন মিশতে থাকে তাই থেকেই আধুনিক আরাধনা ও সাধনার উদ্ভব।

ধর্মের দুটি দিককে আমরা মনে রাখি। একটি, প্রাত্যহিক প্রয়োজনে দুস্তর সংসার পারাবারে আমাদের সীমিত শক্তি অকুলান হলে একটি পরমা শক্তির কাছে আমরা নত হই। আর একটি হল, ব্যবহারিক জগতের অন্তরালে যে অসীম চেতনা অপ্রকাশিত থাকে তাকে অনুভব করা। দ্বিতীয়টি আধ্যাত্মিকতা। আর প্রথমটি কামনা। সত্যি বলতে প্রথম ধরণটিই আমাদের নিত্যকার অনুষ্ঠান। আমাদের লক্ষ দ্বিতীয়টি। জ্ঞানে অজ্ঞানে আমরা দ্বিতীয় লক্ষের দিকেই ছুটে চলি।

তাই প্রয়োজনের ধর্মকে সরিয়ে রেখে আধ্যাত্মিকতার ধারণাটি ব্যক্ত করি। কারণ, মানুষ যখন প্রাত্যহিকতা থেকে নিজেকে তুলে আনে তখন সে বৃহৎ চেতনার অঙ্গীভূত হয়। সেটিই আধ্যাত্মিকতা। দেশে দেশে তার নানা রূপ ও বিগ্রহ। আধুনিক দর্শনে তাই বিজ্ঞান চেতনাও স্থান পাচ্ছে।

যে কথাটি আগেই বলেছি, যত দিন যাচ্ছে ততই বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা পৌছতে চাইছে অসীমের মধ্যে চেতনায়। তার স্বরূপ যেন বিশ্বরূপে এমন নানা ভাবে ও প্রকারে ব্যপ্ত যে পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র লক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম সূত্রে পৌছনো।

এই যে একটি মাত্র চেতনা, যা পদার্থ ও শক্তির বিভিন্নতার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করছে, তাকে তার স্বরূপে পাওয়াই লক্ষ হয়েছে। আর এই বিভিন্নতাই বিজ্ঞানের মতে ইলিউশান, বাংলা ভাষায় যাকে বলি মায়া। এই মহৎ জগতকে যে মায়া আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে বলি মহামায়া। জগতের বিভিন্নতা সেই মহামায়ার রূপ।

আদ্যাশক্তি মহামায়ার সেই রূপ যা বিশ্বকে আছন্ন করে রেখেছে, সেই অদ্বিতীয়া রূপটি আমাদের সেই একক চেতনার একটি মূর্তি। কীভাবে এই বিশ্বচেতনাকে ধারণা করা যায় তার কোনো নির্দিষ্ট নীতি নেই। তবে কখনও কখনও এই মায়ার আবরণ সরিয়ে কোনো কোনো মহামানবের মধ্যে এর প্রকাশ ঘটে। উপনিষদ বলছে, একটি মানুষের শরীর থেকে এই চেতনা সংকলিত হয়ে সহস্রারে (মস্তিষ্কে) আসে। সেই সংকলিত শক্তিই আমাদের আত্মা। এষ আত্মেতি। সেই আত্মা পরমজ্যোতি। যে জ্যোতি তারপর তার নিজস্ব রূপে সকলকে আবৃত করে।

এবমেষ সম্প্রসাদ অস্মাত শরীরাৎ সমুত্থায় পরমং জ্যোতিঃ উপসম্পদ্য

স্বেন রূপেণ অভিনিষ্পদ্যতে। এষ আত্মেতি। (ছান্দোগ্য)

এই যে সর্বময়ী জ্যোতিসত্ত্বা এইই কালী, আদ্যাশক্তি। চেতনাময়ী বিশ্বরূপিণী। এই ঈশ্বরীই তাঁর স্বরূপে আমাদের মধ্যে জাগেন। অন্তরে জাগেন। তাঁর দাঁড়াবার স্থানটি তিনি নিজেই তৈরি করেন। আধারকে বিস্তৃত করেন। সেই স্বরূপিনী তখন জীবচেতনা বা আমাদের সীমায়িত চেতনাকে ঢেকে সর্বব্যাপী বিশ্বচেতনায় জাগরিত করেন। এক ঘটি জল যেমন সাগরে মেশে ঠিক তেমন। ঘটি এই দেহ। জল চেতনা। সাগর সেই ঈশ্বরীয় চেতনা। সেটিই মুক্তি। সেই মুক্তিদায়িনীই মা বা ঈশ্বরী।

একটি আকরগ্রন্থের উল্লেখ করি।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে পরমহংসদেব বলছেন, “মনকরীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয় জগদ্ধাত্রী উদয় হন। মনকরী অর্থ মন, মত্তহস্তী।”

মনকরীকে কে বশ করতে পারে? কেউ ইচ্ছে করলেন বা সাধন করলেন আর মন বশ হলো, তা হয়না। যমেবৈষ বৃনুতে তেন লভ্য। সেই শক্তি যাকে বরণ করে তারই হয়। মন শুদ্ধ হলে শুদ্ধ মনে বিশ্বচেতনার যে মাতৃমূর্তি প্রকাশ পায় তাকেই জগদ্ধাত্রী বলা হয়েছে। তিনি সেই এক, আদ্যাশক্তি।

মনই আমাদের কখনো ঠেলে নিবৃত্তির দিকে নিয়ে যায়, কখনো বা প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে নেয়। দুয়েরই প্রয়োজন আছে। যখন প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ি, তখন বহির্জগতে আমরা ছড়িয়ে পড়ি। নানাভাবে নিজেদের সৃষ্টি করে চলি, এবং ঠিক যেমন মাকড়সা জাল বোনে সেই ভাবে নিজেদের সৃষ্টির জালে সেই মোহ রসে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। অবশেষে সেভাবেই শরীর ছেড়ে দিতে হয় একদিন। পরমাচেতনার অনুভূতি অধরা রয়ে যায়।

প্রতিটি মানুষ তার শুদ্ধ স্বরূপে পৌছতে চায়, বা বলা ভালো, শুদ্ধ স্বরূপে ফেরাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এ হয়না কেন? ঠিক যেভাবে জ্যোতিপুঞ্জরূপা আদ্যাশক্তি মায়ার আবরণ দিয়ে তাঁর স্বরুপকে ঢেকেছেন, তেমনই মানুষ তার দেহের আবরণে নিজের স্বরূপকে আর চিহ্নিত করতে পারেনা। পরমাশক্তির কাছে যা লীলামাত্র সেটিই আমাদের কাছে আজীবনের উপাস্য। মহামানব বলছেন, ‘বুড়ি যদি চায় তবে তখনই তাকে ছোঁয়া যায়’, কিন্তু বুড়িকে ছোঁয়া তাঁর ইচ্ছের ওপরে নির্ভর। একথায় বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যুক্তি পাবেনা। তাই একটু বিজ্ঞানের আলোয় এটিকে দেখে নেবো। যে শক্তি স্বনির্ভর, অনপেক্ষ, তা আমাদের অভ্যন্তরেও বিরাজমানা, কারণ ‘তাঁর ঘরে যে কালে জন্মেছি তখন হিস্যে আছেই’। কিন্তু আবরণ ঢেকে রেখেছে। মা যদি নিজের হাতে সেই আবরণ সরান তবেই স্বরূপে ফিরতে পারি। কীভাবে সরাবেন আবরণ? ঠিক এই কথাটিরই কোনো উত্তর নেই আমাদের কাছে। তাই আমরা প্রার্থনা করি। বিজ্ঞান বলছে, এই স্বরূপে ফিরতে চাওয়াই চেতনজগতের একমাত্র উদ্দেশ্য। পদার্থের একমাত্র গতি হল চেতনে ফিরতে চাওয়া। কিন্তু তাপমাত্রার তারতম্যের মতোই শক্তির মাত্রার তারতম্য ঘটে। তাই অধরা থেকে যায় সেই দিব্যচেতনা।

মহামানব বলেছেন, ‘মন মদমত্ত করী’। মত্ত করী অর্থে মত্ত হস্তী। হাতিটি আমাদের মনের প্রতীক। সাধারণ মানুষের নানা মায়ায় জড়ানো মন, নানা বিকারে অভ্যস্ত মন। সেই মনকে বিক্রম দ্বারা বশ করতে হয়। বিক্রম এর প্রতীক সিংহ। সিংহবিক্রম বলতে আমরা পুরুষকার বুঝি। আমাদের দেশে সাধনার ধারায় এর বিশেষ প্রয়োগ আছে। নানা রকম ক্রিয়া ও কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ বিক্রম লাভ করতে চায়। কিছু শক্তি যে আহরণ হয়না তাও নয়। কিন্তু পরম প্রাপ্তি ঘটে না। ওই কিছু শক্তি বিভ্রান্তির কারণ হয়। তবু, যে মানুষটি সিংহের ন্যায় বিক্রম দিয়ে মন কে বশ করতে পারেন তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন। অর্থ, যার হৃদয় শান্ত সুস্থিত হয়েছে সেখানেই বিশ্বরূপিনীর প্রকাশ হয়।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিক্রম হল মধ্যমা শক্তি। সেই অসীম থেকে যা আসে। আমাদের প্রভাবিত করে। যেমন, এতকাল ধরে জেনে আসা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আসলে একটি মিথ, মিথ্যে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু নেই। ও শুধু মহাবিশ্বে সৃষ্টি হওয়া ঢেউ। অথচ সত্যিই আমরা দেখছি সব কিছুই কেন্দ্রাতিগ বলে আকৃষ্ট হয়। তাহলে ওটি একটি মধ্যমা প্রকাশ। তেমনই পুরুষকার বলে আসলে কিছু নেই। ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছা বলে যেমন কিছু নেই। এ শুধু সাধন জগতের সত্য নয়। বৈজ্ঞানিক সত্য। সময় সারণি আসলে কল্পনা। মহাকালের কাছে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তাই যাকে বিক্রমশীল দেখছি সে আসলে স্বভাবসিদ্ধ। ওভাবেই তার সৃষ্টি। দেহের স্বাভাবিক গঠন।

এখন বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ যে তার বিক্রম দিয়ে পুরুষকার দিয়ে নিজের মনকে বশ করে পোষ মানায়, আর তাইতে প্রবৃত্তি তার অনুগামী হয়, তা আসলে পূর্বনির্ধারিত। বা বলা ভালো, তাঁর দেহের গঠন এমন যে আপনা হতে তাঁর দেহে শক্তি উর্ধমুখী হয়। তাঁকে চেষ্টা করে করতে হয়না। ঠিক তখনই সে প্রস্তুত হতে পারে ঈশ্বরীকে অনুভব করার জন্য। মহামানব বলছেন, ‘কোথা থেকে আশ্বিনের ঝড়ের মতন একটা কি এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আগেকার কিছু আর রইল না’। এই যে কোথা থেকে কী এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল, যার কথা উনি নিজে জানেন না, তাকেই বলছি আপনা থেকে হওয়া। বিদ্বত। এই রহস্যের কারণ অবিদিত। তাই বলছি, মায়া রহস্যময়ী। মহামায়া কৃপা করে দ্বার খুলে না দিলে তাঁকে জানা যায় না। আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের এই রহস্য যেদিন উন্মোচিত হবে সেদিন আমরাও ফিরে যাবো সৃষ্টির সেই আদিতে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।

কিন্তু একক মানবের চেতনায় এই রহস্যের উন্মোচন হয়। বেদান্তের মতে, পাঁচটি স্তর। আত্মা সাক্ষাৎকার, আত্মার মধ্যে এই জগত, জগত স্বপ্নবৎ, সেই জগত তারপরে বিন্দুতে পরিবর্তিত, এবং শেষে জড়সমাধিতে অহং এর লয়। তখন মহাসমুদ্রে ভাসমান বোধমাত্র থাকে। দেহীর অন্য কোনো চেতনা থাকেনা।

একটি বিন্দুর ওপারেই যেমন অনন্ত তেমনই একটি মানব শরীরে আত্মা সাক্ষাৎকারের পরেই আত্মা যখন বিন্দু, তারপরেই অনন্ত আর তার মধ্যে জগত। যেমন মা যশোদা দেখেছিলেন কৃষ্ণের মুখগহবরের যেমন অর্জুন দেখেছিলেন কৃষ্ণের মধ্যে এই বিশ্বরূপ দেখা যায় নিজের মধ্যেই আত্মজ্ঞানই বিশ্বরূপিণী, অর্থাৎ এই বিশ্বরপের আকার।

মাটির প্রতিমায় আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে যে বিশালত্ব আরোপ করি তা আসলে সেই বিশ্বরূপের প্রতীক। আকার কেন? ঠাকুর বলছেন ‘মরা মরা শুদ্ধ মন্ত্র ঋষি দিয়েছেন বলে’। ‘ম’ মানে ঈশ্বর। ‘রা’ মানে জগত। অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যে জগত। এই জগত তাই ঈশ্বরের এক প্রতিরূপ। অথচ ঈশ্বর বা সেই পরম পুরুষ নিরাকার, ‘ম’। ম’য়ে আকার দিলে ‘মা’ হয়, অর্থাৎ আকারযুক্ত বা সাকার ঈশ্বর হলেন মা। ঈশ্বরী। তাই মহামায়া এই জগত কে ধারণ করে আছেন। কোথায়? সেই মানুষের হৃদয় যেখানে মনকরী বশ হয়েছে সিংহের মতো বিক্রমের দ্বারা।

মহাকালের বুকে বিবসনা কৃষ্ণা যে মাতৃমূর্তি সাধকের কল্পনায় যুগ যুগ ধরে রূপ পায়, তার রূপক অর্থটি পরিস্ফুট হওয়া প্রয়োজন। এ যেন এক হেঁয়ালি। অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে যাই। দেখি মহামানব কি বলেছেন। ‘নগ্নিকা মাতৃমূর্তি আসলে দেহবোধ বিলুপ্ত হয়েছে, তার প্রতীক। দেহবোধ চলে গেলে লজ্জা ঘৃণা জাতি অভিমান ইত্যাদি অষ্ট পাশ ছিন্ন হয়। এই মূর্তি সাধক নিজের দেহের মধ্যে দেখেন। সুতরাং এ তাঁর নিজেরই অবস্থার দ্যোতক। মা শিবের বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে। নীচে শিব শব হয়ে পড়ে আছেন। শিব এখানে নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক। নির্গুণ কেন বলি? কারণ তাঁর গুণের খবর আমরা জানিনা। তিনি নিষ্ক্রিয় বলে আমরা মনে করি। কারণ জগতকারণের রহস্য সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞান। বস্তুত, নিষ্ক্রিয় বলে কিছু নেই। আমরা সেটুকুই জানতে পারি যতটুকু আমাদের প্রয়োজন। জানিয়ে দেন মা। তিনি নির্গুণ ব্রহ্মের থেকে চেতনা বা শক্তি আহরণ করে তাকে সগুণ করেন। তাই তিনিই সক্রিয়া। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। শিব শুয়ে।’

আমাদের এই জানার পরিমাণ কতটুকু হবে? যতটুকু পেটে সয়। মহামানব বলছেন, ‘বাড়িতে মাছ এলে মা কাউকে কালিয়া পোলোয়া করে দ্যান, কাউকে মাছের ঝোল, বা টক, কাউকে ভাজা। যার যেমন পেটে সয়’। একথার অর্থ অনেক ব্যাপক। এখানে শুধু এটুকুই উল্লেখ করি, যার যেমন দেহ তার তেমন অনুভূতি। মা ঠিক জানেন কাকে কতটুকু দেবেন। তাই মায়ের ওপরেই নির্ভর করি।

এই পর্বে বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বিশুদ্ধ ভক্তি একাকার হয়ে যায়। মায়ের চেয়ে প্রিয় আর কে? অস্তি ভাতি প্রিয়। মা আছেন, জানি, এই অস্তি জ্ঞান। তাঁকে দেহের মধ্যে দর্শন হল, ভাতি। তাই তিনি প্রিয় হলেন। এ অবস্থায় দেহী এক মুহূর্ত মাকে ছাড়া থাকতে পারেন না।

এ অবস্থা কার হয়? সাধারণভাবে আমরা মনে করি সাধক অত্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে কঠোর সাধন করলে তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন। কিন্তু না। একমাত্র ঈশ্বরীর কৃপা ছাড়া তা হয় না। যদি তাও বলা হয় পুরুষকার, তাহলে বলতে হবে সেও তাঁর কৃপা। আধার বিশেষে সেই কৃপা সিংহের মতন বিক্রম স্বভাবে দেয়। তাই কেউ কেউ, বা বলা ভালো কোটিতে গুটিক কেউ মহামায়াকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন।

তাহলে এখন কৃপা পাই কি করে?

বিজ্ঞান বলছে, বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব মস্তিষ্কের ধারণাশক্তি বৃদ্ধি পাবে। স্বতঃস্ফূর্ত সেই উন্নত মস্তিষ্ক ধারণা করতে সক্ষম হবে সেই শূন্যরূপা মহামায়াকে। মায়ার আবরণ আপনা হতে সরে যাবে। যেমন, মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখল সেদিন আগুন বাইরে জ্বলল। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে আগুন জ্বলেছে অনেক আগেই, মানবমস্তিষ্কে। সভ্যতার সেই বিবর্তনকে মনে রাখলে বোঝা সুবিধে হবে ভবিষ্যতের সেই বিবর্তনকে।

যুগ যুগ ধরে আমরা বাইরে মূর্তি তৈরি করে পূজা আরাধনা করি, নানা শাস্ত্র পুরাণ তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে মাকে তুষ্ট করতে চাই। তা নিতান্তই বাহ্যিক আচার। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিন এসমস্তই আমাদের অন্তরে ছিল। অন্তরের সেই বিশুদ্ধ প্রকাশ যখন হারিয়ে গেল, মানুষ যখন তার দেহের সেই স্বাভাবিক গতিকে হারিয়ে ফেলল তখনই সে প্রতীকের সৃষ্টি করল। ব্রহ্মসূত্র বলছে, প্রতীকাপন্ন লোক প্রতীকই পায়। শুদ্ধ বস্তু পায়না। যদি সত্য অধরা থাকে তবে প্রতীক পূজা করি কেন? কারণ তাপমাত্রার তারতম্য যেমন মহাবিশ্বে বহুত্বের সৃষ্টি করেছে ঠিক তেমনই আমাদের দেহের স্বাভাবিক শক্তি হ্রাস পেতে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে গিয়েছে। আমরা নানারূপে জগতকে দেখছি।

অতএব বিবর্তন বিনা উপায় নেই। কিন্তু আপাতত শান্তি কিসে? মহামানব বলছেন, ‘বানর ছানা জো সো করে মাকে ধরে। তাইতে সে কখনও খানায় পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু বিড়াল ছা নিজে মাকে ধরেনা। মা তাকে যেখানে রাখে সেখানেই থাকে’। তাহলে বিড়ালের ছানার মতো নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরতাও শক্তি, যা অচেতনে ক্রিয়া করে। তাই একমাত্র পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই পথ।

আর যদি একবার তা পারা যায় তবে কোনো সাধন-ভজনের দরকার নেই। কোনো বিগ্রহ হোম যজ্ঞ কিছু প্রয়োজন নেই।

মা তুমি প্রসন্ন হও। তুমি আমার রিপুনিচয়কে শান্ত করো। তুমি আমার প্রবৃত্তিকে মোড় ফিরিয়ে দাও। সে যেন ঊর্ধ্বগামী হয়ে তোমার স্থান প্রস্তুত করতে পারে। যেন সে তোমার অনন্তরূপিণী মূর্তি ধারণ করতে পারে, সেই অসীমে তুমি আমাকে নিয়ে যাও। শেষ পর্যন্ত, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান যেমন আদি কারণকে সেই অসীমে ধরতে চায়, অধ্যাত্মবিজ্ঞানেরও সেটিই লক্ষ। দেহ নাশ হলে আমরাও আবার সেই শূন্যেই তো ফিরি! শূন্য থেকে আসি, শূন্যে লয় হই। চুরাশি লক্ষ জন্ম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতারণা। বেদ বলছে, ইহ চেদবেদীদথ, নচেদিহা মহতী বিনষ্টি। এই জন্মে হল তো হল, নচেৎ মহতী বিনষ্টি। মহামায়া তাই একটি মানবজন্মেই তাঁর সকল রহস্য প্রকাশ করতে প্রয়াস পান।

তাই প্রার্থনা করি। কিন্তু এত প্রার্থনারও প্রয়োজন হয়না। মা যেমন জগতকে প্রসব করছেন আবার পালন করছেন, তেমনই তিনি ঠিক জানেন কখন কোথায় স্বরূপ উন্মোচন করবেন। এসব তাই বিকার বৈ আর কিছু নয়। এক সের চালের ভাত খাবো রে। এক জালা জল খাবো রে। এরকম। সে বিকার থেকেও তিনিই তুলবেন। সময় না হলে পাখি ডিম ফুটোয় না। সময় হলে আপনি হবে।

তাহলে আমরা কি তাঁর আরাধনা করব না? যখনই আরাধনা করতে হবে, এই কর্তৃত্ব বোধ কাজ করবে তখনই মায়া আমাদের গ্রাস করবে। তাই বরং প্রার্থনা করি, মা তোমাতে যেন আমার প্রণাম হয়। তোমাকে যেন আমার ধারণা হয়। মা প্রসন্ন হয়ে বরদা হয়ে প্রকাশ হও, আমি দেখি। মা তোমার কৃষ্ণা রহস্যময়ী রূপ সংবরণ করো। তুমি তো সংহারিনী নও। তুমি ক্রমাগত তোমার শক্তিকে প্রয়োগ করে এই সৃষ্টির লীলাখেলায় মেতে আছো। আমাদের দৃষ্টির বিভ্রমকে অপসারিত করো। তোমার জ্যোতির্ময়ী শুদ্ধ শূন্য রূপ দেখি।



[সাহিত্য আর সংবাদ দীপাবলী ২০২০]

2 comments:

0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















আদ‍্যন্ত ফ‍্যান ফিকশন ও মূল স্রষ্টাকে প্রণাম জানাই -

প্রফেসর শঙ্কু ও ড্রিমোভিশন


উৎসর্গ: স্বয়ং ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু মহাশয় সমীপে,


(৬ই জুলাই, রাত ন'টা পাঁচ)

এযাবৎকালে আজ পর্যন্ত যে সব আবিষ্কার আমাকে ভারতীয় আবিষ্কারক হিসাবে সারা পৃথিবীতে আগামী একশো বছরের বেশী সময় ধরে মানুষের মনে বিস্ময়ের সাথে একটা স্থান দিয়ে রাখবে বলে আমি মনে করি তার একটা নামের তালিকা নিয়ে বহুবার পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞান সম্মেলনে গত তিরিশ বছর ধরে নানা প্রদর্শনীতে ডিসপ্লে ও সেসব নিয়ে এত আলোচিত হয়েছে যে প্রচারবিমুখ হওয়াসত্ত্বেও আমি যে এই কৃতিত্বের জন‍্য যে আজীবন সম্মানিত ও তারজন‍্য অবশ‍্যই কৃতজ্ঞ থাকব সেটা এখন শেষবয়সে এসে আমি নিজেও বেশ বুঝতে পারছি।

তবে আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত খ‍্যাতি বা আত্মপ্রচারের বাইরেও যে জিনিষটি নিয়ে গত পনেরদিনে আমার গিরিডির ল‍্যাবে বসে কাজ করতে করতে বুঝতে পেরেছি যে আক্ষরিকভাবে ওতে সফল হয়েও যে আমি শেষমেশ এই আবিষ্কারটিকে আমার মনে বা খাতায় কোথাও রাখতে চাইনি বলে বিশেষ মানসিক শান্তি পেয়েছি সেটাও ঠিক। তবে এটার আবিষ্কারের কিছুটা সম্মান আমার বন্ধু হ‍্যারির প্রাপ‍্য বলে এর সবটা না বললেও বিজ্ঞানের স্বার্থে কিছুটা আজ একটু বলে যেতে চাইছি, তার একটাই কারণ তা হল ভবিষ‍্যৎে এই জাতীয় কাজে সাফল‍্যের সম্ভাবনা আসলেও যাতে আগামীদিনের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই আবিষ্কার ও তার ফলাফলের ব‍্যাপারে সংযত হতে পারে।
...

(৭ই জুলাই, সকাল ন'টা পঁচিশ )

আজ ডায়েরী লিখতে বসে আমার মনে হল যে ইতিপূর্বে আমার আবিষ্কৃত সেরিব্রিলান্ট ও নার্ভিগার যা নার্ভ চাঙ্গা রাখার দুটি মোক্ষম ওষুধ হিসেবে সমাদৃত ও আর একটি নতুন অডিও - ভিস‍্যুয়াল যন্ত্র যার নাম হল "এভিলিউটন " যা আজকের মানুষকে আগামীদিনের ক্রমবিবর্তনের রাস্তায় চলবার ক্ষেত্রে একটা পথনির্দেশ করতে সাহায‍্য করলেও এগুলো কখনোই ঠিকমত কোন কারখানায় বা বাণিজ‍্যিক প্রয়োজনে বানানো যাবেনা বলেই তাই এগুলোর ভরসাতেই বিবর্তনের আগামী পৃথিবীর চেহারা সংক্রান্ত এক যন্ত্রের পূর্বাভাস নিয়ে আজ আবার একটা নতুন কাজে নামতে চলেছি ।
....
আমার বন্ধু সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনের জীব রাসায়নিক হ‍্যারি কেপমার্সন মাসছয়েক আগে একবার একটি চিঠিতে এই নবতর আবিষ্কারটির সম্ভাবনার কথা জানিয়ে আমাকে একটা লম্বা চিঠি লিখেছিল। তার সাথে ওর অনুরোধ যে এই কাজটা নিয়ে এরপর থেকে আমাকেই ভাবতে ও শেষমেশ কাজে সফল হতে একান্ত অনুরোধ জানিয়েছে। এর একটাই কারণ যে এখন হ‍্যারি তার ব্লাড ক‍্যানসারের ফাইনাল স্টেজে পৌঁছে গেছে। তাই যেহেতু তাকে কেউ আর বেশীদিন এই পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারবেনা আর সেটা জানতে পেরেই ও এখন ওর জীবনের শেষের কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবেই থাকবে তাই একজন যোগ‍্য লোকের হাতে ওর অসমাপ্ত কাজটির ভার দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়।
....
সেজন‍্যই ওর হয়ে আমাকে ওর অসমাপ্ত চিন্তাগুলির নোটস্ গুলো সব পাঠিয়ে এই কাজটা নিয়ে ভাবতে হ‍্যারি এই অদ্ভূত অনুরোধটি জানিয়েছে। আর এজন‍্যই হ‍্যারি'র পাঠানো এই বিশাল চিঠিটি ও তার সাথে সব জরুরী নোটস্ গুলো আজ সকালের ডাকে এখানে এসেছে।
....
এবার ওগুলো হাতে পেয়ে এক আগ্রহী ছাত্রের কৌতূহলে সবটা নেড়েচেড়ে দেখে ও বিশদে পড়বার পর আমারও যে বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ জন্মাল সেটা আর নাও বললে হবে।

এই যৌথ আবিষ্কারটি আদৌ ঠিক কি বস্তু ফাইন‍্যালি হবে সেটা না জেনেও আমি ঠিক করলাম যে আমার এই মরন্মুখ বিজ্ঞানী বন্ধুটির অনুরোধে এই " সিউডো- ভিশনারি এটিটিউড " যন্ত্র বা ড্রাগ সংক্রান্ত যা হোক অর্ধসমাপ্ত আবিষ্কারটির কাজে আমিও এবারে সোৎসাহে নেমে পড়ব।
....
যদিও কালকের "হেডিংটন ডেইলি" কাগজটির ভারতীয় সংস্করণে ছাপে আসা কাগজটির পাঁচের পাতার গোড়ায় এই বিশ্বখ‍্যাত জীব রাসায়নিক হ‍্যারি'র মৃত‍্যুসংবাদটিও পড়ার পর আমার মনটা আরো বিষণ্ণ হয়ে আছে। তাও ঠিক করেছি যে আমার বন্ধুর শেষ অনুরোধটি রাখার প্রাণপণ চেষ্টা আমি করব।
.............

(১৩ই জুলাই, সকাল দশটা বেজে দশ)

গত সাত দিনে একটা আশ্চর্য জিনিষ লক্ষ‍্য করেছি। আমার বেড়াল নিউটন যে বার্ধক‍্যজনিত কারণে আজকাল সারাদিনের বেশীটাই ঝিম্ মেরে বসে থাকে তাকে দেখলাম ভোরবেলা ওর নির্দিষ্ট দুধটা চেটে খেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার আগের মত সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে চেষ্টা করছে।

তাই এটা দেখে ভাবলাম যে আমাদের মতো একটা বেড়ালের আয়ূষ্কালেও কি তাহলে অন্তত আর একবারের জন‍্য অনন্তকালের জীবনীশক্তিলাভের একটা সুপ্ত বাসনা থেকে যায় কি?

তবে এখানে একটাই খটকা।যদিও আমার আগে তৈরী এক্স এবং অ্যান্টি এক্স ওষুধদুটো যেটা দিয়ে সুস্থ মানুষকে কয়েক মিনিটের মধ্যে হিংস্র দানবে পরিণত করা যায় ও অ্যান্টি এক্স দিয়ে ফের তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজটায় সফল হলেও এখন হ‍্যারি'র কথা অনুযায়ী এই নতুন "ড্রিমোভিশন " বা " স্বপ্নদর্শী " বস্তুটি যদি আমি ঠিক বানিয়েও ফেলি তাও কি ওটা পারবে আমাদের স্বপ্নকে একেবারে বাস্তবে পরিণত করতে? বা তার অদম‍্য ইচ্ছাটির ব‍্যর্থতার পরেও তাকে আমাদের আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে?
..........

(২৪শে জুলাই, বিকেল পাঁচটা সতের)

আমার কাজটা আজ অনেকটা এগিয়ে এনেছি। এখনো অবধি একটা টিউবে করে খানিকটা ব্রাহ্মী শাকের রস নিয়ে আর তাতে একটু কর্পূর আর মধু'র সহযোগে একটা মিশ্রণ তৈরী করে তারপর সেটা আমার তৈরী রিমাইন্ডার পিলের সাথে হ‍্যারি ও আমার যৌথ পরিকল্পনায় তৈরী "ড্রিমোভিশন " ট‍্যাবলেটটিকেও গুঁড়ো করে মিশিয়ে এক মগ কফির সাথে পান করেছি।

এখানে বলে রাখি ওটা একটা খাওয়ার বা ইঞ্জেক্ট করার মত উপযোগী ওষুধ হিসেবেই আমি বানিয়েছি। এছাড়া মানব শরীরে ওষুধটি প্রয়োগ করার পর তারপর আমার এই পর্যায়ে যে নতুন সংযোজনটি এরসাথে করেছি সেটা হল একধরণের বিশেষ শয‍্যাযান বা "স্লিপকার্ট "।
....
সেখানে নিজে শুয়ে একঘন্টা ধরে পরীক্ষা করে দেখেছি যে আগে থেকে ভেবে নেওয়া কোন স্বপ্নদৃশ‍‍্যের বাস্তবায়নের উদ্দেশ‍্য নিয়ে ওতে চড়ে ঘুমাতে গেলেও একটা সিনেমার মত সেগুলোকে দেখছি, অথচ অন‍্য আর সবকিছু যেমন আমার চিন্তাশক্তি বা কর্মক্ষমতার কোন বিকৃতি ঘটছে না।

যদিও আমার দেহটা এই স্লিপকার্টে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকছে তাও একটা এনার্জি রে যন্ত্রটি থেকে বেরিয়ে এসে আমার ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে একটা বাস্তবমুখী স্বপ্নের দৃশ‍্যকে দেখাচ্ছে যেটা আমিই শুতে যাবার সময় মনে মনে চেয়েছিলাম। এমনকি দেড়-দু ঘন্টা ধরে ঘুমের পরেও সেটা মনে থেকে যাচ্ছে। আর এটাই হল হ‍্যারির ফরমূলায় তৈরী ওষুধটি আর আমার এই স্বপ্নযান যন্ত্রের কারসাজিটিতেই।
.....
এখন দেখতে হবে যে জেগে উঠে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার পর ওই স্বপ্নের দৃশ‍্যটিকে অনুসরণ করলে আমার ওই স্বপ্নে দেখা ইচ্ছেটা আদৌ সত‍্যিই বাস্তবে আক্ষরিকভাবে ফলবান হচ্ছে কি না ?
.............

আমার বেড়াল নিউটনকে এই "ড্রিমোভিশন" ক‍্যাপসুলটিকে একটু পাউডারে পরিণত করে আমার মতই আর প্রয়োজনীয় সব উপাদানের সাথে একবাটি দুধের সাথে খাইয়ে দিলাম। এরপর ও ঘুমিয়ে পড়লে ওকে আলতো করে " স্লিপকার্টে" পনের-কুড়ি মিনিট শুইয়ে রাখলাম।

এটা করতে গিয়ে অবিশ‍্যি ভাবছিলাম যে বেড়ালেরও কি মানুষের মত মস্তিষ্কের ভিতরে কোনও সুপ্ত আকাঙ্খা রাখে? আর সেটা যদি থেকেও থাকে সেটা অবিশ‍্যি নিউটনের জেগে ওঠার পর ও আচরণেই বোঝা যাবে।
............

(২৫এ জুলাই, সকাল এগারোটা বেজে পাঁচ)

আজ একটা অদ্ভূত ব‍্যাপার ঘটল। এইরকম একটা কিছু যে হতে চলেছে সেটা আন্দাজ করতে পারলেও যে তার অগ্রগতির প্রভাবটিকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে একটু হলেও হিমশিম খাব তখন সেটা বুঝিনি।

তবে সেটা হল বলেই আর একবার নিজেই নিজেকে আবার ধন‍্যবাদ জানাতে খুব ইচ্ছে করছে। এটা না হলেই বরং নিজেকে বড্ড বেশী অপরাধী লাগত।
....
দেখলাম ঘুম ভেঙে ওঠার পর নিউটনকে মেঝেতে কিছুটা ঝিম্ মেরে পরে থাকতে দেখলাম।
তখন আমার একটু সন্দেহ হতেই তখন একটু ওকে কোলে তুলে নিয়ে ওর লোমশ গায়ে হাত বোলাতে গেলাম। এমনিতে নিউটন এই ধরণের প্রশ্রয়ে অন‍্যদিনে বেশ আহ্লাদে গলে যায় আর সেটাই হল ওর এতদিনকার অভ‍্যেস। কিন্তু এবারে দেখলাম ওর গায়ের রোঁয়া ফুলে উঠেছে আর চোখটায় একটা বিশ্রী রকমের জ্বলজ্বলে চাহনি।

এরপরে যেটা ও করে বসলো সেটাও গত দশবছরে একদিনের জন‍্যেও কখনো করেনি।

এমনিতে আমার ঘরে জানলা খোলা থাকে বলে দু একটা কাক, চড়ুই, শালিখ এসব বাইরে থেকে ঢুকে খানিকক্ষণ ওড়াউড়ি করে আবার পরে চলেও যায়। নিউটনকে এসবে কোনও দিন চাঞ্চল‍্য প্রকাশ করতে দেখিনি। এমনকি কর্ভাস নামের যে কাকটি আমায় পক্ষীবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজে অনেক হেল্প করেছে তাকেও দেখেছি নিউটনের অলস বিশ্রামের সময় বা পাওয়ার ন‍্যাপের টাইমে সে ওর পিঠে বেশ ভারিক্কী চালে বসে নিজে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে।
.......
এহেন নিউটন'কে দেখলাম যে তড়াক করে আমার কোল থেকে লাফিয়ে নেমে গিয়েই ঘরের মধ‍্যে উড়ে আসা একটা চড়াইকে ওর এক থাবায় নিকেশ করে তারপর সে পাখিটার টুঁটি চেপে ধরে যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দৃষ্টি আমার চেনা নয়। একটা জান্তব জিঘাংসা আর ক্ষুধিতদৃষ্টির সাথে যেটা আজ নিউটনের আচরণে ফুটে উঠছিল ওর থেকে আদৌ কাঙ্খিত নয়।

তাই বাধ‍্য হয়ে ওকে " অ্যান্টি এক্স " ইঞ্জেকশান দিতে হল আর তারপরেই ও জবুথবু হয়ে কিছুক্ষণ ঘোলাটে মুখে আমার দিকে চেয়ে রইল।
........

নিউটনের জন‍্য আমার নিজের একটু কষ্ট হলেও বুঝলাম যে এমন কিছু প্রবৃত্তিগত পরিবর্তনেই আসলে "ড্রিমোভিশন" ড্রাগ ওকে চালিত করেছে। তাই এটা হয়েছে খুব স্বাভাবিকভাবেই।
.....
পরক্ষণেই ল‍্যাবে ফিরে আমি ভাবতে বসলাম যে এটা আর একবার নিজের ওপর দুপুরে পরীক্ষা করে দেখতেই হচ্ছে। কারণ এর আগে তো আমি আমার কোন আচরণ পরিবর্তন তো সরাসরি বুঝতে পারিনি বা চোখের সামনে ঘটতে দেখিনি।

.......

(২৬এ জুলাই, বিকেল পাঁচটা )

আমার গত একটা দিন পুরোটা যেভাবে কাটল তার ফলেই ডায়েরী লেখা বন্ধ করে আমিও সেই পরীক্ষার পরে খানিক থম্ মেরে বসেছিলাম। এমনকি আজ প্রহ্লাদকেও রাতের খাবার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি।

এখন খালি ভাবছি আগামী দিনে এই যদি আধুনিক বিজ্ঞানের পরিণতি হয় তাহলে এখনি আমায় সবরকম গবেষণা করা ছেড়ে গিরিডিতে আমার বাগান পরিচর্যা করাই বোধহয় ঠিক কাজ হবে।
......
তাহলে এবার ঘটনাটার গোড়া থেকে বলছি। কাল "ড্রিমোভিশন " সহ কফি খেতেই বেশ ঘুম পেল। তারপর " স্লিপকার্টে" উঠে আমি দিব‍্যি ঘুমোতে গেলাম। তবে এসবের আগে আগামী একশো বছর পর পৃথিবীর চেহারাটা কেমন হবে সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল।

তারপর কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। হঠাৎ দেখি এক আজব দুনিয়ায় এসে পড়েছি। এটা পৃথিবীর কোনও একটা শহর হয়ত হবে তাও বুঝলাম এ শহর আমার অজানা বা অদেখা । সেখানে দেখলাম সবাই এখন খুব ব‍্যস্ত। স্রেফ হুসহুস শব্দ করে অত‍্যাধুনিক ধোঁয়াবিহীন গাড়ি ছুটে চলেছে আর রাস্তার দুপাশে অজস্র বর্ণময় মনোহারী জিনিসের দোকানপত্র, আর সময়টা হল দুপুর আর সন্ধের মাঝামাঝি।
......
তবে দেখলাম এখানকার নারী-শিশু-পুরুষ-বৃদ্ধ সব আমার দেখা সময়েরই মত সবাই রক্তমাংসের। অর্থাৎ স্বপ্নে যা দেখছি তা কিন্তু কোন রোবোটিক্সেরর এ‍্যানিম‍্যাটিক খেয়াল বা যন্ত্রের অবয়ব নয়।

তবে এও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এদের সময়টা খুব দ্রুত বদলিয়ে গেছে আর সবাই যেন নিজের কাজে ভীষণ ভীষণ ব‍্যস্ত!
....

এবারে একটু পরে দেখলাম একটা হাড় জিরেজিরে মহিলা শতচ্ছিন্ন পোশাকে কোত্থেকে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাবলাম এরকম মানুষ কি ততোদিনেও থাকবে?

এখন দেখলাম ওই মেয়েটার কোলে আবার ততোধিক কঙ্কালসার একটা শিশু। বোঝাই যাচ্ছে যে ওটা মেয়েটির সন্তান।

আমি দেখে বেশ বুঝতেই পারছি যে ওদের দুজনেরই ক'দিন ধরে পেটে খাদ‍্যদ্রব‍্য কিছুই হয়তো আর জোটেনি। এই অবস্থায় ওদের দেখে আমার খুব মায়া হল। তক্ষুণি কোটের পকেট থাবড়িয়ে যেই কিছু পয়সা বের করে ওদের দিতে যাব এমন সময় শুনতে পেলাম সামনের রাস্তায় একদল সেনা আর পুলিশ মিলে এসে খুব গোলমাল করছে আর লাঠি উঁচিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলছে।
......
এসবের কারণ হল এই যে এটা নাকি এখন একটা স্মার্টসিটি তাই সেনাবাহিনীর পোষাক পড়া ওই লোকগুলো তাই বলছিল আর মাইকিং করছিল! এবারে ওদের কথা শুনে বুঝলাম যে এখানে এখন আর এই বিশ্রী পোশাকের আদবকায়দাহীন ও জঞ্জালসদৃশ ক্ষুধিত মানুষগুলোর নাকি থাকবার কোন অধিকার নেই। একটু পরে এখানের উৎসবের কোন একজন নামী ভি.আই.পি. নাকি এই পথ দিয়ে কনভয় নিয়ে যাবেন আর তাঁর সাথে থাকবেন একজন মানী অতিথি আর তিনিও নাকি অন‍্য কোন দেশের শিল্পমন্ত্রী।
এখানে যে বিশেষ একটি শিল্পোন্নতির প্রজেক্ট পাশ হবে এই দুটি দেশের যৌথ আগ্রহে, তাই অবাঞ্ছিত সবাইকেই এখন রাস্তা থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
.....
আমাকেও তখন কে যেন ধাক্কা মেরে একটা ঘুপচি ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। যদিও এমনিতেই এসব ঝামেলা টামেলা আমার কোনওদিনই আদৌ পছন্দ নয়। তাই বাধ‍্য হয়ে নিষ্ক্রিয়ের মতন ঘরটিতে রাখা জলের বেসিনের দিকে এগিয়ে কার্যতঃ গেলাম। মনে হচ্ছিল এখন চোখে মুখে এখন জলের ঝাপটা দিলে বোধহয় একটু ঠিক লাগলেও লাগতে পারে।
....

(২৭শে জুলাই, বেলা তিনটে পনের)

চোখে জলের ঝাপটা দিতেই দেখলাম আমার সামনের তিনটে জানলায় তিনটে তিনরকমের দৃশ‍্য। ফুটে উঠেছে আর একটু আগের রাস্তাঘাট সব উধাও। এখন দেখলাম সামনে ধূ ধূ করছে একটা মরুভূমি যেখানে ইতস্ততঃ পড়ে আছে জীবজন্তু এমনকি মানুষেরও অজস্র কঙ্কাল। জায়গাটা আর একটু ভাল করে দেখতে গিয়ে দেখলাম আমার সামনে একটাও সবুজ পাতা বা কোন গাছ বা ফুল, পাখি কিছুই নেই। রাতারাতি ম‍্যাজিক করে কেউ যেন একটা মৃতের নগরীকে এনে আমার চোখের সামনে তুলে ধরেছে।
....
এইবার একটু এগিয়ে আমি দ্বিতীয় জানলাটার সামনে এসে দেখি এখন মরুভূমি ছেড়ে সবটা আবার সমুদ্রের জলে থইথই করছে। আর এদিক ওদিক ভাসছে বরফের চাঙর। দেখে একবার মনে হল এসব গ্লোবাল ওয়ার্মিং নাকি!তারপর দেখলাম ওই নীল ফেনাওয়ালা একটা আলগা ঢেউ কোত্থেকে এসে জানি অজস্র পেঙ্গুইন আর ওয়‍্যালরাসের মৃতদেহ এনে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কি আশ্চর্য!

এ দৃশ‍্যতেও সব কেমন যেন আগের ওই মরুভূমির দৃশ‍্যটির মত নির্বাক ও প্রাণহীন।
.....
এইবার তিন নম্বর জানলায় যে দৃশ‍্যটা দেখলাম আর সেটা দেখে মনে হচ্ছে যে সেটা যেন না দেখলেই বোধহয় ভাল হত। দেখলাম যে কতগুলো রোবটের হাবভাবের অল্পবয়সী ছেলে মেয়ের দল সব বসে বসে কি একটা ঢাউস স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কি সব অপারেট করছে আর যন্ত্রমানবের মত ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তা দেখে নিজেদের মধ‍্যে কেবল আলোচনা করছে। তবে এদের সবটাই যেন যন্ত্রের মত। ওদের কথাবার্তায় কোন আবেগের বহিঃপ্রকাশ কারও মধ‍্যে নেই।
...
এবারে বুঝলাম যে তাই ওদের এই অতি আধুনিক সভ‍্যতায় এখন সৃষ্টির প্রকাশ হিসেবে ফুল, পাখি অথবা এক কলি গান বা চারুশিল্প এমনকি নিছক স্পোর্টসেরও আজ আর কোন স্থান নেই।

এরা এখন সব যন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে এদের জীবনে বংশবৃদ্ধি ছাড়া আজ আর কোন বিনোদন বা অন‍্য কাজের আর স্থান নেই।

এটাই বোধহয় আগামীকালের পৃথিবী!
তবে প্রশ্ন হল এরকম হলে সেটারই বা আয়ূ আর কতদিন?

তারপর কি ওই মরুভূমি বা সমুদ্রে ভাসমান মৃতদেহগুলিই কি নিষ্প্রাণ পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চলেছে? এগুলো তারই সূচক কি?
............

(২৯শে জুলাই, সকাল এগারোটা)

আর পারছি না। অনেকক্ষণ এসব দৃশ‍্য দেখে মাথা ঝিমঝিম করতে বাধ‍্য হলাম আমার " অ্যান্টি এক্স " মুখে দিয়ে নিউটনের মত এই " ড্রিমোভিশন"এর কবল থেকে একেবারে নিস্তার পেতে।
......



(৩০ শে জুলাই, সকাল নটা)

আমাদের দুই বিজ্ঞানীর দেখা যৌথ আবিষ্কারের এই স্বপ্নদৃশ‍্য যে এরকম একটা নিষ্প্রাণ দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে সেটা আর ভাবতে পারছিলাম না।
আচ্ছা! হ‍্যারিও কি বুঝতে পারেনি যে আগামীকালের পৃথিবী কি সত‍্যিই এতটাই ভয়াবহ ও নিষ্প্রাণ হতে চলেছে?
.....

এ‍্যান্টি এক্স ইঞ্জেকশানের পর দেখছি কিছুটা সুস্থ বোধ করছে বলেই হয়ত ঠিক আগের মত আদুরে ভঙ্গিতে নিউটন এক লাফে আমার কোলে এসে মাথা ঘষতে ঘষতে বলল "মিঁয়াও"!

একটু হেসে ওকে আদর করতে করতে দেখলাম যে এমনকি প্রহ্লাদের মুখেও একটা আগেকার আনন্দের নির্মল হাসি যা কেবল আমাদের এখনকার পৃথিবীতেই এখনো দেখা যায় ও আশাকরি তা আগামীদিনেও যাবে।

এবারে দেখলাম ওর চোখে টলটল করছে জল আর সেটা সে ধুতির খুঁট দিয়ে মুছছে। এসবে কারণটা এতক্ষণে বুঝলাম যে আমার "স্লিপকার্টে" শুয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাই দেখে ও এতক্ষণ আমাকে মৃত ভেবেছিল ও তাইজন‍্য দুশ্চিন্তা করছিল।
...
অবশেষে ঠিক করলাম আমাদের এই নতুন আবিষ্কার "ড্রিমোভিশন"টির জন‍্য আর কখনোই কোন সময় ও এনার্জি কোনওটাই আর ব‍্যয় করবনা। আশা করব বিদেহী হ‍্যারিও আমার সাথে একমত হবে। আসলে এই অদ্ভূত যন্ত্র যা এমন কোনও সম্ভাবনার পরিণতি বা আশংকা দেখাক যা আমরা আর কখনোই দেখতে বা ভাবতে চাইব না।
সব ভালোমন্দ'য় মিশে থাকা এই বিচিত্র পৃথিবী নামক গ্রহটি সৌরজগতে সবার চেয়ে একেবারে আলাদা হয়েই বেঁচে থাকুক।
সবাই জানুক এখনো এখানে ফুল,পাখি, চাঁদ এসব নিয়ে প্রাণ টিকে আছে আর তার সাথে টিকে আছে মানুষে মানুষে সংযোগ ও অকৃত্রিম ভালবাসা।

এসবের সত‍্যি আজ বেশী বড় প্রয়োজন। তাই
এটাই এখন নতুন করে আগামী প্রজন্মকে বুঝতে হবে যে এগুলোর কোনটাই বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরিপন্থী নয় , আর সেটা কখনো হতেও পারবেনা।

সভ‍্যতার প্রয়োজনে সবাইকেই হাতে হাত মিলিয়ে থাকতে হবে সেটা যেমন ঠিক, তেমন আবার সবাইকে নিয়ে একসাথে চলতেও হবে।
.....

এই প্রথম কোন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রথমে আমি তাতে সাফল‍্য ও সবশেষে তার সম্পূর্ণরূপে বিস্মরণটিতেও যে অনেক বেশী আনন্দ ও স্বস্তি পেয়েছি সেটা অন্তত আজ স্বীকার করে যাওয়া উচিত বলে আমার ডায়রিতে এটুকুই আজ স্রেফ লিখে রাখলাম।

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in





   
 আমার ভারতবর্ষ
গোলকোণ্ডা: কুতুবশাহি করামত
গোলকোণ্ডা দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিলো চারশো ফুট উঁচু একটি গ্র্যানাইট পাহাড়ের উপরে। চারদিকে ধু ধু ঊষর সমভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজকীয় নির্মাণটির দৃশ্য এককথায় রোমাঞ্চকর। দুর্গটির আকার রম্বাস সদৃশ। চারদিকের ভূবলয় ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। দুর্গের বাইরের প্রাকারটির পরিধি সাত কিমি।প্রাকারটি গভীর, প্রশস্ত পরিখা দিয়ে ঘেরা। তিনটি প্রাচীরের বৃত্ত এই
দুর্গকে প্রায় দুর্ভেদ্য করে রেখেছিলো। পাহাড় থেকেই গ্র্যানাইট পাথর কেটে প্রাকার ও অন্য নির্মাণগুলি করা হয়েছিলো। ভিতরে ঢোকার পথ ছিলো মোট আটটি। তবে তার মধ্যে চারটি ছিলো প্রধান। পূর্বদিকে ফতেহ দরওয়াজা। পশ্চিমে মক্কা দরওয়াজা। উত্তরে বঞ্জারা আর উত্তর-পশ্চিমে পত্তনচেরু দরওয়াজা। হায়দরাবাদের দিক দিয়ে এলে ফতেহ দরওয়াজা দিয়েই ঢুকতে হয়। ফতেহ দরওয়াজা অর্থাৎ বিজয়দ্বার।

তিনটি প্রাকারশ্রেণীর প্রথম প্রাকারটি ঘিরে আছে সম্পূর্ণ পাহাড় এবং চারদিকের সমভূমি। দ্বিতীয় প্রাকারটি রয়েছে পাহাড়ের পদদেশে। তৃতীয়টি ঘিরে আছে Citadel বা বালা হিসার অংশটি। প্রাকারগুলি মোটামুটিভাবে সতেরো থেকে চৌঁত্রিশ ফুট চওড়া। পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট উঁচু। তিনটি প্রাকার মিলিয়ে মোট সাতাশিটি অর্ধচন্দ্র বুরুজ রয়েছে। যেখানে সান্ত্রী ও অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত থাকতো। বিশাল গ্র্যানাইটের ব্লক সাজিয়ে তাদের নির্মাণ
করা হয়েছিলো। উত্তর -পশ্চিম কোণায় রয়েছে পেটলা বুর্জ। মানে বিশাল উদর বুরুজ। অওরঙ্গজেবের কামানের গোলায় এই বুরুজটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সুলতানের কারিগররা মুঘল সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য একরাতের মধ্যে কাগজবোর্ড দিয়ে অবিকল একটি নকল বুর্জ তৈরি করে দিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি।
বহু বুরুজে তেলুগু লিপি উৎকীর্ণ থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি কুতবশাহিদের আনুকূল্য বেশ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

বাইরের প্রাকারটির আটটি দরওয়াজার নাম, ফতেহ, বাহমনি, মক্কা, পত্তনচেরু, বঞ্জারা, জামালি, নয়াকিলা আর মোতি দরওয়াজা। প্রধান দরওয়াজাটি এখন ফতেহ দরওয়াজা। কুতবশাহি পতনের পর এই প্রবেশ পথ দিয়ে বাদশা অওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ মোয়াজ্জেম গোলকোণ্ডার দখল নিতে ঢুকেছিলেন।


গোলকোণ্ডা দুর্গের যে অংশটি চলতি কথায় এখন 'গোলকোণ্ডা', সেটির আসল নাম 'বালা হিসার'(Citadel)।একটা উঁচু গ্র্যানাইট পাহাড়ের চূড়ায় এই সুরক্ষিত রাজমহলটির নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম শাহ। এই মুহূর্তে পর্যটকরা প্রবেশ করেন বালা হিসার দরওয়াজা দিয়ে। এটাই দুর্গের কেন্দ্রস্থল। ঢোকার মুখে বিশাল দরজাটি কাঠের। তার সর্বাঙ্গে পিতল বাঁধানো কীলক হাতিফৌজের আক্রমণ থেকে দুর্গকে রক্ষা করতো। বালা হিসারের স্থাপত্যের আদর্শ ছিলো বাহমনি রাজ্যের নির্মাণ কৌশল।

বালা হিসার দেউড়ির রক্ষী ছিলেন অ্যাবিসিনিয়া থেকে আসা সৈন্যদের বাহিনী। ঐ পথ দিয়ে ঢুকলেই শুরু হয়ে যেতো হাবসি সৈন্যদলের এলাকা। নাম, হাবসি কমান। ভিতরে প্রথমেই একটি খিলান দেউড়ি রয়েছে। যার নাম 'তালি ফটক' বা Clapping Pavilion। ওখানে দাঁড়িয়ে তালি দিলেই সুদূর পাহাড় শিখরে বারাদরির রক্ষীরা শুনতে পেতেন সেই শব্দ। তার সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি সেকালের কামানের নমুনা। বাঁদিকে বাদশাহি আশুরখানা। ফতেহ দরওয়াজা আর মুসা বুর্জের মাঝামাঝি যে বিশাল প্রাসাদের অবশেষ দেখা যায় সেটি দিওয়ান মহল। সেখানে মীর জুমলা মহম্মদ সয়ীদ থাকতেন। পরবর্তীকালে তা মদন্না-অক্কান্নার বাসভবন হয়ে যায়। ডানদিকে চলে গেছে গোলকোণ্ডা কিলার বিশ্বখ্যাত মিনাবাজার, নগিনাবাগ। যেখানে ছিলো এদেশের সব চেয়ে বিলাসবহুল ও মূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিপণীগুলি। নগিনাবাগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুলতানের অনুগত সেনাধ্যক্ষ আব্দুল রজ্জাক লারি'র নাম। যিনি শেষ পর্যন্ত মুঘল সৈন্যদের প্রতিরোধ করেছিলেন। তাঁকে আহত, মুমূর্ষূ অবস্থায় নগিনাবাগেই পাওয়া গিয়েছিলো। তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন। স্থানীয় লোককথার সূত্রে লারি একজন প্রবাদপ্রতিম বীর হয়ে যান। হাবসি কমান ধরে সোজা পশ্চিমদিকে গেলেই প্রথমে হাতিশালা আর অতিথিশালার টানা কাতার।

বালা হিসার দরওয়াজা পেরোলেই টানা রাস্তার বাঁদিকে রয়েছে সিলাহখানা বা অস্ত্রাগার। সিলাহখানার ডানদিকে ছিলো সেনাবাস। তৃতীয় প্রাকারটি পর্যন্ত সেটি বিস্তৃত ছিলো। অস্ত্রাগার পেরোলেই দুর্গের 'অন্দরমহল' শুরু হয়ে যেতো। সিলাহখানার বিপরীতদিকে একটি প্রাচীন মসজিদের অবশেষ পাওয়া যায়। তার পর থেকে দেখা যাবে একের পর এক বিস্তৃত অঙ্গন। রাজপ্রাসাদের পূর্বদিকে একটি সমতল স্থান রয়েছে যেখানে সুলতান সৈন্যদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন। তাকে ময়দান-এ-জিল্লুখানা -ই আলি বলা হতো। তাত্ত্বিকভাবে সৈন্যরা ঐ মসজিদের সামনে আল্লাহ তালার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতেন। কিন্তু সেখানে সুলতান নিজে উপস্থিত থাকার জন্য তিনিও একসঙ্গে অভিবাদিত হয়ে যেতেন।এর দক্ষিণদিকেই বিখ্যাত মদন্না-অক্কন্নার প্রাসাদ ও প্রশাসন ভবন। কুতুবশাহি সাম্রাজ্যের আর্থিক মেরুদণ্ডের ভিত্তি ভবনগুলি। আর ছড়ানো ঘাসজমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট্টো, কিন্তু নয়নাভিরাম প্রার্থনা ভবন, তারামতী মসজিদ। এই নির্মাণগুলো পেরিয়ে এগোলেই শুরু হয়ে যায় গোলকোণ্ডার সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থাপত্য ও জেল্লাদার অংশ। মূল রাজপ্রাসাদটির আবাসিক অংশ এখান থেকেই আরম্ভ হয়। এই অট্টালিকাগুলি দোতলা থেকে ছ'তলা পর্যন্ত উঁচু। হারেম, সরাই, ঘরের পর ঘর,অন্তঃপুর, বিশাল হলঘর, ফোয়ারা, ঝিল সব কিছু নিয়ে সেকালের স্থপতিদের শিল্প ও নির্মাণকৌশল এখনও দর্শকদের মুগ্ধ করে। সমগ্র রাজপ্রাসাদ মহার্ঘ গালিচা, বাতিদান, বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, পর্দা দিয়ে সাজানো ছিলো। গোলকোণ্ডা দুর্গ দখল করার পর অওরঙ্গজেব সেখানে বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তিনি এতো বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকতে পছন্দ করতেন না।

একটি বিশাল অঙ্গন ঘেরা রানিমহল থেকেই দুর্গের জনানামহল শুরু হয়ে যায়। অঙ্গনের ঠিক মাঝখানে একটি সুরম্য ফোয়ারা। আয়তাকার ক্ষেত্রটিকে ঘিরে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সারিসারিপ্রাসাদ আর অট্টালিকা। একের পর এক দেখা যাবে রাজসিক প্রাসাদ আর তার ভিতরের বিশাল আর্চদেওয়া ঘরদুয়ার। একের ভিতর দিয়ে অন্যটি চলে যাচ্ছে। গোলকোণ্ডা দুর্গের স্থপতিদের আরেকটি বিস্ময়কর কীর্তি এই জলসম্পদে কৃপণ প্রকৃতি থেকে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করা। পাঁচ কিমি দূরে অবস্থিত দুর্গমচেরুভু ( গোপন জলাশয়) থেকে তাঁরা জল প্রবাহিত করে আনার কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন। আরও চমকপ্রদ ছিলো নিচে থেকে চারশো ফুট উপরে জল তোলার প্রযুক্তি।

বালা হিসার ওঠার সিঁড়ি এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। পাহাড় চড়ার পাথরের ধাপগুলি ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে উপরে। মাঝামাঝি জায়গায় সম্প্রতি একটি দেবীমন্দির তৈরি হয়েছে। এটি অর্বাচীন নির্মাণ। তার দুদিকে দুটি বিশাল গ্র্যানাইট পাথরের প্রাকৃতিক স্তম্ভ অজানা রহস্যে সোজা ,সন্তুলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পরেই রয়েছে বিশাল অম্বরখানা বা শষ্যাগার। আর একটু উপরেই রাজপরিবারের প্রার্থনার জন্য ইব্রাহিমশাহের তৈরি করা মসজিদটি। এর স্থাপত্য মূলত বাহমনি মেহরাবের ধরনে হলেও পরবর্তীকালে এই নির্মাণে কুতবশাহি মিনারগুলি যোগ করা হয়েছিলো। মানে চোদ্দো শতক থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত ক্রমপর্যায়ে এর নির্মাণ হয়েছিলো। পাহাড়ের শিখরে বালা হিসারের শীর্ষ প্রাসাদ ‘বারাদারি’ দেখা যায়। এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত সমগ্র উপত্যকাটি নির্বাধ দেখা যায়। 'বারাদারি' শব্দের অর্থ বারোটি দুয়ার দেওয়া উদ্যানভবন। কিন্তু এর অর্থসম্প্রসারণ ঘটে গেছে সময়ের সঙ্গে। এই প্রাসাদটি দোতলা । এর শীর্ষে রয়েছে সুলতানের মসনদ বা সিংহাসন। সেখানে বসে তিনি আয়েশ করে পারস্যের শিরাজি সেবন করতে করতে নিজের রাজ্যদর্শন করতেন। এই সমস্ত নির্মাণের স্থাপত্যের প্রধান অবলম্বন ছিলো বিশাল মাপের, নানা আকারের গ্রানাইট পাথরের চাঁই। দুর্গের নিরাপত্তাই ছিলো প্রধান শর্ত। তাই তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নেওয়া হতোনা। বালা হিসারের এক কোণে একটি বৃহৎ সুড়ঙ্গের খোঁজ পাওয়া যায়। সংকটকালে রাজপরিবার এই সুড়ঙ্গটি দিয়ে আট কিমি দূরের গোশামহল নামে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে পারতেন। এখন সেটি বন্ধ আছে।
এদেশে ​​​​​​​মধ্যযুগে ​​​​​​​স্থানিক ​​​​​​​রাজা ​​​​​​​বা ​​​​​​​সুলতানদেরও ​​​​​​​কী ​​​​​​​পর্যায়ের ​​​​​​​সম্পদ ​​​​​​​বা ​​​​​​​সমৃদ্ধি ​​​​​​​ছিলো, ​​​​​​​গোলকোণ্ডার ​​​​​​​দুর্গ ​​​​​​​বা ​​​​​​​কুলি ​​​​​​​কুতুব ​​​​​​​শাহি ​​​​​​​রাজবংশের ​​​​​​​প্রতাপ ​​​​​​​দেখলে ​​​​​​​সেটা ​​​​​​​টের ​​​​​​​পাওয়া ​​​​​​​যায়।

0 comments:

2

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




















বই - চরের মানুষ
লেখক - তৃষ্ণা বসাক
প্রকাশক - ধানসিড়ি
মুল্য - ২৫০/-

বাঙালির জীবনে যে কয়েকটি জাতীয় বিপর্যয় ঘটেছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি। প্রথম হল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। ধর্মের ভিত্তিতে সজীব শরীরকে কাটাছেঁড়া করলে যে পরিমাণ যন্ত্রণা, রক্তপাত ও মৃত্যু ঘটতে পারে তাই হয়েছে তখন। দ্বিতীয়টি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠা। সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বভাবগুণ কিন্তু বাংলাদেশকে প্রতীক্ষিত শান্তি দিতে পারেনি। অজস্র পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাত, ধর্মের নামে হানাহানি, বর্ণবিদ্বেষ, এইসব কাটাকুটির দাগ নিয়ে এই নবীন দেশ বাঁচতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশের মানুষই তো শেষ পর্যন্ত দেশ।

আমরা দেশভাগের ওপরে নানা প্রামাণ্য দলিল পাই। ইতিহাস, ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস, সিনেমা ইত্যাদি নানা মাধ্যম আমাদের চোখের সামনে এনে দেয় সেই সময় যখন ওপার থেকে হাজারে হাজারে মানুষ সব খুইয়ে শুধু ধর্মের বিভিন্নতার অপরাধে এপারে এসেছেন। সব কৌলীন্য সব সম্পদ ফেলে রিফিউজি কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছেন। রেশনের চালে ভরসা করে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চেয়েছেন। প্রথম প্রজন্মের এই শিকড়ছেঁড়া মানুষজন কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের একটি বড় অংশ। তাঁরা লড়াই করে মাথা তুলেছেন।

কিন্তু পরবর্তী সময়, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যারা চলে এলেন, পালিয়ে এলেন, পালাতে গিয়ে মারা পড়লেন, তাঁদের যুদ্ধ জটিল। তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই সেখানে থাকবেন, এমনটাই আশা ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তাঁরা বাঙালি হলেও হিন্দু হবার অপরাধে টিকতে পারছেন না। রাজাকার নামক এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও মৌলবাদী ধর্মযাজকদের সঙ্গে মিলে সেখানে নিদারুণ অবস্থার সৃষ্টি করে। এসবই আমাদের জানা ইতিহাস। গ্রাম কে গ্রাম লুঠতরাজ, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যা, এক নারকীয় বাতাবরণ তৈরি করে।

এত ইতিহাসের মধ্যে একটি কাহিনী লেখা হল না। যেসব হিন্দু পরিবার ওপার বাংলা ছেড়ে এপারে এলেন না, কোনোভাবে আশ্রয় পেয়ে গেলেন, বা ‘কেন আমি দেশ ছাড়ব?’ এই ভেবে রয়ে গেলেন, তাঁদের জীবনযাত্রা কেমন হল? তৃষ্ণা বসাকের উপন্যাস চরের মানুষ এই অন্য যাপনের কথা বলে। এই আপাতদৃশ্য কাহিনীর স্রোতের মধ্যে অন্তঃসলিলা আর একটি ধারা তাঁর লেখায় বর্তমান। সেটি হল, মেয়েদের অবস্থান। এই যে সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরন্তর বদল, সংগ্রাম, এর মধ্যে তাঁদের স্থানটি কোথায়? তাঁরা এই যুদ্ধে যুধিষ্ঠির বা শকুনি, কার হাতের পাশা? চালে জিতলে তাঁদের অবস্থা কী হল? হারলেই বা কি হল?

উপন্যাসের মূল চরিত্র টুনু। তার বাবা ডাক্তার। ডাক্তার বলে সমাজে তিনি সম্মান পান। পরোপকারী সদাশয় মানুষ। তাঁর নিজের ছেলেটি মুসলমানের হাতে খুন হয়, সেকথা জেনেও তিনি কখনও কাউকে দোষারোপ করেননি। এ কি তাঁর মহত্ত্ব? নাকি নিরাপত্তাহীনতা? মুসলমানের দেশে ভিটে আঁকড়ে থাকতে গেলে এ মেনে নিতে হবে। ফলে, দেশের অন্যান্য সংকটের সময় তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যেরা কেউই অংশ নিলেন না। মূলস্রোতে মিশলেন না। দেশের মধ্যে থেকেও যেন তাঁরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে গেলেন। নদীর ধারার মাঝে বিচ্ছিন্ন চর। তাঁরা সেই চরের মানুষ।

টুনুর মায়ের অনেকগুলি সন্তান। মেয়ের সংখ্যাই বেশি। এই টুনুর শৈশব, বাবার স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও, কেমন বদলে গেল। সে তিনবেলা এখনও ভাত খায়, মাছ খায়, কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর জীবনকে দেখার স্ফূর্তি রইল না। মনে পড়ে ঠাকুমা প্রভাসুন্দরীর কথা, “সংসারে ভাতের কষ্ট ছাড়া আরও কত কষ্ট আছে, বড় হলে বোঝবা”। যদিও দাদা স্বরাজের বন্ধুরা স্মরণসভা ডেকেছে ও তার বন্ধু ইদ্রিস, শামিম স্বরাজকে হারিয়ে কষ্ট পেয়েছে তবুও কোথাও একটা বিভেদরেখা টের পাওয়া যায়। উপন্যাসের প্রথম পর্বে এর পাশাপাশি টুনুর বন্ধু পপির মা, নুসরত খালার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মেয়েসন্তানের জননী হবার দোষে তাঁর স্বামী ইন্ডিয়া থেকে আসা একটি মেয়েকে বিয়ে করে। নুসরতখালা রাতারাতি মেয়েদের নিয়ে চলে যান। কেউ টের পায় না কোন চরে তাঁর ডিঙি ভিড়েছিল। নিরুদ্দেশে গেলে কি আর দেশ থাকে? মেয়েদের দেশ নেই, নিরুদ্দেশ আছে।

দ্বিতীয় পর্বে টুনুর বিয়ে, শ্বশুরঘরের পাশাপাশি, ময়মনসিংহ টাউনে বড় হওয়া টুনুর লৌহজঙ্গ নদীর কিনারে ধুপতারা এসে গ্রাম্য নীচতা দেখে স্তব্ধ হবার পালা। তার ডাক্তার স্বামী অমর, যে কিনা নিজের মৃত ছোট ভাইটিকে এক মুহূর্ত ভুলতে পারে না, সে পর্যন্ত নিজের চারিত্রিক স্খলনকে পুরুষের ফুর্তির স্বাধীনতা মনে করে। এ দেশের মুক্তির সংগ্রামে তার যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে সেকথা সে স্বীকার করে না। অথচ সে চাকরি পায় এমনই এক হিন্দু ভূমিপুত্রের হাসপাতালে। যিনি সেবাকে পরম ধর্ম মনে করেছিলেন, ও শেষ পর্যন্ত, পাকিস্তানের সেনারা যাকে হত্যা করে। অমরের চরিত্রের বৈপরীত্য একান্ত স্বাভাবিক। সে তাই ইন্ডিয়া চলে আসতে চায়। সরল টুনু ধীরে ধীরে শিখতে থাকে। মেয়েমানুষের জীবন এমনই হয়।

কখনও কখনও দেশ আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষের মনে ইন্ডিয়া পাকিস্তান জোড়া লাগার স্বপ্ন ভাসে। নাগরিক অধিকার স্পষ্ট হয় যে! নইলে যে নিজভূমে পরবাসী!

এই উপন্যাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় চট্টগ্রাম। জেসমিন ইমাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করছেন। বেগম সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগম ও বিশিষ্ট মহিলারা চট্টগ্রামে মিছিল করেছেন। সেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। বিদ্রোহ যে মাটির স্বভাব। ডক্টর দেব, প্রফেসর সাগিরুদ্দিন, জেসমিন ইমাম, এঁরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! সে এক বিভীষিকাময় রাতে আক্রান্ত হল বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর। খুন হলেন ডক্টর দেব। বহু বহু মেয়ে ধর্ষিত ও খুন হল। তবু সেই রাতের কথা আমার বুকের মধ্যে নিরাময়হীন ক্ষত তৈরি করল। অথচ এর মধ্যেও জেগে রইলেন জয়ন্তী, টুনুর মেজোবউদি। জ্যাঠতুতো দাদার খৃষ্টান বউ। আদিবাসী খৃষ্টান। কিন্তু শিক্ষায় সভ্যতায় সে শহুরে মেয়েদের থেকে অনেক এগিয়ে।

অসংখ্য নারীচরিত্র, কেউ সিনেমার নামকরা নায়িকা হয়ে পাকাপাকি লাহোরে প্রতিষ্ঠিত, কেউ বা খানসেনাদের হাতে ধর্ষিত ও খুন হবার আগে হাসপাতালে যুক্ত ছিলেন। কেউ গ্রামের তাঁতিবাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে শহরে সওদা করেন। কেউ পরিবারের দারিদ্র কি করে ঘোচে সেই ভেবেই দিনপাত করেন। অদ্ভুত নকশিকাঁথার মতো ভেসে ওঠে এক অলৌকিক চর। মেয়েরাই যার বাসিন্দা।

সবশেষে বলব বসাক তাঁতিদের কথা। এত গবেষণা করে লেখা যখন তখন অবশ্যই লেখিকা জেনেছেন, এখনও ঢাকিয়া বসাক বা ঢাকাই বসাকদের প্রতিপত্তি অব্যাহত। তারা ধনী। তাদের বিগ্রহ এখনও পূজা পায়। এই যে তথ্য উপন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তা পরবর্তীতে ইতিহাসের উপাদান হবে।

তৃষ্ণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বাংলাদেশের এক একটি জেলার ডায়ালেক্ট, খাদ্যের বৈচিত্র্য, জীবিকার নানা ধরণ, উৎসবের কথা তিনি নিপুণভাবে উপন্যাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। অথচ ভূমিকায় জানা যাচ্ছে, তিনি ঢাকিয়া বসাক তো ননই, তিনি শেকড়সুদ্ধু এপার বাংলার। তবু যে কত মমতায় ত্তিনি এ কাজ করেছেন ভাব্লে মুগ্ধ হই। তাঁর এ কাজটি থেকে যাবে। তবে প্রত্যাশাও থাকল, পরের পর্ব হয়ত আসবে। বাঙালি হয়ে বাঙালির এই ইতিহাসের ওপরে আরও লেখা পড়ার ইচ্ছেটা রয়ে গেল।

2 comments: