2

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন শাস্ত্র, বেদে কালীর উল্লেখ আছে একমাত্র একটি স্থানে। যেখানে অগ্নির সাতটি শিখার নামকরণ করা হয়েছে। সেই শিখার মধ্যভাগে আছে যে শিখা, তাকেই কালী বলা হয়েছে। কিন্তু অধ্যাত্ম দর্শনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণ ও শব্দের অর্থ ও ব্যুৎপত্তি ছাড়াও একটি মর্মার্থ জানা যায়। সেই মর্মার্থ অবশ্য জানিয়ে দেন কোনো ত্রিকালদর্শী মহামানব। আমরা জেনেছি তাই, ‘কালী কে? না, যিনি মহাকালের সঙ্গে রমণ করেন’।

মহাকাল বলতে আমরা সাধারণত কিছুই বুঝিনা। যাই বলিনা কেন, সে শুধু কথার কথা। ‘কাল’ বা ‘সময়’ বলতে যে ধারণা আমরা পোষণ করি তা নিতান্তই সীমিত। এর জন্য দায়ী আমাদের মস্তিষ্কের ধারণাশক্তি। এই দেহটার একদিন জন্ম হয়। তারপর সে দেহ বেড়ে ওঠে। শেষে একদিন লয় হয়। এই দেহের সৃষ্টি স্থিতি ও লয়ই আমাদের কাছে একমাত্র স্থির সত্য। ‘কাল’কেও তাই আমরা এই সময়ের মধ্যে সীমায়িত করি। যে নিত্য বর্তমান কাল, ঘটমান মহাকাল, তাকে আমরা ধারণায় আনতে পারিনা। অথচ মহাকাল আছে। যে কালে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি ও লয় হয়। আবার এসবই এককালে হয়। যেমন, গোলোকে বসে লক্ষ্মী একটি ভারী শব্দ শুনতে পেলেন। দেখলেন, নারায়ণ উঠলেন। পরমুহূর্তে আর একটি অনুরূপ শব্দ হল। নারায়ণ ফিরে এলেন। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গেলেন? আর এত তাড়াতাড়ি ফিরলেনই বা কি করে? উত্তরে নারায়ণ বললেন, প্রথম শব্দটিতে রাবণ জন্মালেন। দ্বিতীয়টিতে তিনি বধ হলেন। গল্পটি পৌরাণিক। রূপক অর্থে, রাবণের জন্ম ও মৃত্যু গোলোকের হিসেবে মাত্র একটি লহমা। সুতরাং, গোলোক বা মহাবিশ্বের সেই বিশুদ্ধ অস্তিত্ব যেখানে, সেখানে পৃথিবীর শত বছরের হিসেব এক লহমা মাত্র।

আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা মতে, দুভাবে ব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলছে। তার মধ্যে প্রধান যেটি তা হল, আদি বিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং)। প্রাথমিক স্তরে একটি অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রাবিশিষ্ট জ্যোতিপুঞ্জ নিজের ভিতরেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলে। এবং, পার্থিব সময়ের হিসেবে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটি প্রসারিত হতে থাকে আলোকের গতিতে। লক্ষ লক্ষ বছর পরের বিশ্ব এখন এরকম রূপ নিয়েছে। সেই একমাত্র বিশুদ্ধ জ্যোতিপুঞ্জ থেকে নানা পদার্থের সৃষ্টি। নানা গ্রহ নক্ষত্র ও ছায়াপথের সৃষ্টি। এই মহাবিস্ফোরণের আগে নাকি ‘কাল’ বলে কিছু ছিলনা। অর্থাৎ ‘কাল’ গণনা করা অসম্ভব। তাহলে তার আগে কি ছিল? বিজ্ঞানীরা ফিরতে চাইছেন সৃষ্টির সেই আদিক্ষণে। আর আমাদের অধ্যাত্ম দর্শন জানিয়ে দিচ্ছে, ‘মা তখন শূন্যরূপা শশীভালী’। আমরা জানতে পারছি, ওই বিশুদ্ধ জ্যোতিপুঞ্জই ‘শূন্যরূপা আদ্যাশক্তি’ যা থেকে চক্রাকারে এই মহাবিশ্ব জন্ম নিচ্ছে আবার ‘কালে’ তা লয় পাচ্ছে। কারণ, পদার্থবিদ্যার আর একটি তত্ত্ব জানাচ্ছে, ব্রহ্মাণ্ড চিরকাল এই চক্রতে আবর্তিত হচ্ছে। সৃষ্টি স্থিতি লয় থেকে আবার সৃষ্টিতে ফিরে আসা।

সেই মহাকাল থেকে যে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয় তার কারণ প্রকৃতি, কালী বা আদিশক্তি। ‘যখন নিষ্ক্রিয় তখন ব্রহ্ম বলে কই, যখন সৃষ্টি স্থিতি লীলা করেন, তখন তাকে মা বলে কই।’ এই মহাকালের সঙ্গে লীলায় ক্রমে নিষ্ক্রিয় শক্তিপুঞ্জ প্রকৃতির বুকে পদার্থের রূপে প্রাণ রূপে জন্ম নেয়। সেই জন্মদাত্রী পরমাপ্রকৃতিই কালী।

একটি মাত্র জ্যোতিপুঞ্জ থেকে তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে নানা পদার্থের উদ্ভব। নানা গ্রহ তারার সৃষ্টি। ক্রমে এই যে অনন্ত মহাবিশ্বের রূপ প্রতিভাত হচ্ছে, এর একটি ব্যাখ্যা বেদে আছে। বেদ বলছে, উর্ণনাভ আর তার জালের কথা। বলছে, উর্ণনাভ বা মাকড়সা যেমন তার দেহ থেকে রস বের করে তাই দিয়ে জাল তৈরি করে তাতেই বাস করে ঠিক তেমনই আদ্যাশক্তি নিজদেহের থেকে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করে তাতেই বাস করছেন। এই জগতরূপী জালই তাঁর মহামায়া। যেখানে নানা পদার্থ নানা প্রাণের ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রতিভাত হয়। আমরা এই বৈচিত্রে চমকিত হই। মূলে কিন্তু আদ্যাশক্তি একটি জাদু সৃষ্টি করেন। মায়া বা ইলিউশান। ইলিউশান বা মায়া বলতে আমরা বুঝি যা সত্য নয় তাকেই সত্য বলে মনে করা। অর্থাৎ, আদ্যাশক্তি এই জগতের বিভিন্নতার জন্য দায়ী। মূলে তাঁর বিশুদ্ধ শূন্য জ্যোতিরূপ এখানে মায়ায় বহু বলে প্রতিভাত। এই মহামায়াই কালী। তাঁর মায়াকে কে ছিন্ন করতে পারে? বিশেষত আমাদের এই দেহই যখন সেই মায়ার রূপে জন্ম নিচ্ছে। দেহের এই বোধ, ‘আমি এই দেহ’ এই মহামায়া থেকে মুক্তি কিসে? একটু পরে সে আলোচনায় আসছি।

একজন জানা লোক যদি বলে দেয়, এই এই, তবে বিষয়টা সরল হয়। কেন এই রহস্য? সেই কারণ বলতে গিয়ে মহামানব বলছেন, ‘কালী কালো কেন? দূরে তাই কালো। কাছে গিয়ে দেখো। কোনো রং নাই’। তাঁর কথার অর্থ, যা কিছু অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢাকা তাই কালো। মহাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণ গহবরের মতো। অথচ সেই কৃষ্ণ গহবরের কি অনন্ত শক্তি! কী তার আকর্ষণ! যা কিছু তার প্রভাবের বৃত্তে এসে পড়ে তাই সেই গহবরে দুরন্ত গতিতে ঢুকে যায়। আলো পর্যন্ত সেই গহবরের থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে পারে না। আলোকে গিলে নেয় সেই কালো। ঠিক এমনই ভাবে কালী আমাদের অতীত ও ভবিষ্যৎকে গিলে রাখেন। জ্ঞানের আলো পর্যন্ত কালী গিলে ফেলেন। কিন্তু যার জ্ঞাননয়ন উদ্ভাসিত, তিনি সেই কালীকে জানতে পারেন। অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, কালের এই গতিই জগত। যার গতি আছে তাই জগত। গতি কথাটির মধ্যে দুটি মাত্রা লুকিয়ে। একটি স্থান ও অপরটি কাল। সুতরাং, কালে কালে দৃশ্যমান জগতকে যে মহামানব প্রকাশিত হওয়ার আগেই দেখতে পান, ধারণা করতে পারেন, তিনিই কালীর রহস্য সম্যক অবগত। তাঁর কাছে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আসলে একই কালের প্রকাশ। মহাকাল। স্থান ও কালের নাশ হয়ে জগত তার স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। তাই অজ্ঞানতা নেই। সে আর ‘কালো নয়’। কিন্তু কাছে গেলে কি রং হয়? ‘কোনো রং নাই’। অর্থাৎ, রঙের সীমায় সে আবদ্ধ নয়, কারণ ‘সে তখন এত বৃহৎ যে ধারণা করতে পারবেনা’। সেই বৃহৎ, সেই অনন্তের অনুভূতিই ঈশ্বরীর আশিস। ‘তাঁর কৃপা হলে হাজার বছরের অন্ধকার ঘর একক্ষণে আলো হয়’। এই যে অকস্মাৎ তমসা নাশ হয়ে মাথার মধ্যে সহস্রদল জ্যোতিপদ্ম উদ্ভাসিত হয়, এক মুহূর্তে এ সৃষ্টির আদি কারণ উন্মোচিত হয়, তাকেই কৃপা বলি। এ আপনা থেকে হয়। কোনো সাধনা কোনো শাস্ত্রাচার, কিছুতেই এ জ্ঞান উপলব্ধ হয়না। কেন কারো কারো হয়, সেই কারণ আমরা জানিনা। তাই কৃপা বলি। তাই বলি, বিদ্বত। আপনা থেকে হওয়া।

কৃষ্ণগহবরসদৃশ ‘কালী’ আপন অন্তরে সমস্ত জ্ঞানের আলোকে লুকিয়ে রাখেন। যে তাঁর কেন্দ্রে গিয়ে প্রবেশ করে সে সেই আলোর সন্ধান পায়। অন্যেরা পায়না। তারা এই পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে সদা ঘূর্ণায়মান। তাদের কাছে দিনরাত্রির জীবনের অতিরিক্ত কিছু নেই। অথচ মহাবিশ্ব মহাশূন্য মহাকাল বা কালী সেই মহাকারণ, যা আমাদের ধারণার বাইরে থেকে যায়।

তাহলে উপায় কি? আমাদের মনে এই পরমাপ্রকৃতি মাতৃস্বরূপিনী। মা যেমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন তেমনই ঈশ্বরী আমাদের ধারণ করেন, এবং ‘কালে’ আমরা ভূমিষ্ঠ হই। আবার ‘কালে’ লয় হয়। তিনি আমাদের গ্রাস করেন। মহামানব বলছেন, ‘মা ভয়ংকরা কালকামিনী, এই জগত প্রসব করছেন আবার গিলছেন’। এ কথায় আমরা ভীত হই। মা কেমন করে সন্তানকে গিলে ফেলবেন? এ ভয় আমাদের ওই মায়ায় আবদ্ধ বোধ।

এবার মহাবিশ্ব থেকে মুখ ফেরাই নিজের প্রতি। আমরা নিজেদেরই কি জানি? নিজের দেহ নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? কিছুই না। কারণ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান আমাদের জীবচৈতন্যকে এই জগতের আহারটুকু জুগিয়ে যায়। কখনোই তা আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রকাশ ঘটায় না। তাই প্রথমে জীবচৈতন্য থেকেই শুরু করা যাক।

মহামানব বলছেন, ‘কালী এই দেহ’। কারণ মা আমাদের জন্মদাত্রী। জন্মের আগে আমরা শূন্যে ছিলাম। শূন্য থেকে আমরা মাতৃজঠরে স্থান পেয়েছি। ভ্রুনাকারে বৃদ্ধি পেয়েছি। এই যে নির্গুণ বা শূন্য থেকে আমরা দেহ পাই তার একটি অস্তিত্ব আছে। শূন্যরূপা এই দেহ বা শ্যামামায়ের কল সৃষ্টি করেন। কেন? নিজেকে প্রকাশ করবেন বলে। অর্থাৎ শূন্য বা নির্গুণ থেকে সগুণে প্রকাশিত হবেন। ক্রমে তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে তিনি আমাদের শূন্যে ফিরিয়ে নেন। অতএব ‘দেহ’ শ্যামামায়ের কল। যে দেহ সগুণ, পদার্থের সমাবেশ। দেহে যে জীবত্ব তা ক্রমশ শিবত্বে পরিণত হবার জন্য যাত্রা করে। কোথায়? বাইরে নয়। এই দেহেই জীবত্ব শিবত্বে পরিবর্তিত হয়।

আমাদের লৌকিক জগতে আসি।

আরাধনা কেন করি? এ নিয়ে আমাদের সবার মনেই কিছু বদ্ধমূল ধারণা আছে। প্রথমত, মানুষমাত্রই নিরালম্ব জীবনে অসহায় বোধ করে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই ঈশ্বরের ধারণা। একজন আছেন, তিনি আমাদের সর্ব অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করেন, প্রধানত এমন একটি কল্পনা থেকেই এই ভাবনার উদয়। ক্রমে যুগে যুগে ঈশ্বরত্বের ধারণায় যে বৃহৎ চেতনা, যে জটিল দর্শন মিশতে থাকে তাই থেকেই আধুনিক আরাধনা ও সাধনার উদ্ভব।

ধর্মের দুটি দিককে আমরা মনে রাখি। একটি, প্রাত্যহিক প্রয়োজনে দুস্তর সংসার পারাবারে আমাদের সীমিত শক্তি অকুলান হলে একটি পরমা শক্তির কাছে আমরা নত হই। আর একটি হল, ব্যবহারিক জগতের অন্তরালে যে অসীম চেতনা অপ্রকাশিত থাকে তাকে অনুভব করা। দ্বিতীয়টি আধ্যাত্মিকতা। আর প্রথমটি কামনা। সত্যি বলতে প্রথম ধরণটিই আমাদের নিত্যকার অনুষ্ঠান। আমাদের লক্ষ দ্বিতীয়টি। জ্ঞানে অজ্ঞানে আমরা দ্বিতীয় লক্ষের দিকেই ছুটে চলি।

তাই প্রয়োজনের ধর্মকে সরিয়ে রেখে আধ্যাত্মিকতার ধারণাটি ব্যক্ত করি। কারণ, মানুষ যখন প্রাত্যহিকতা থেকে নিজেকে তুলে আনে তখন সে বৃহৎ চেতনার অঙ্গীভূত হয়। সেটিই আধ্যাত্মিকতা। দেশে দেশে তার নানা রূপ ও বিগ্রহ। আধুনিক দর্শনে তাই বিজ্ঞান চেতনাও স্থান পাচ্ছে।

যে কথাটি আগেই বলেছি, যত দিন যাচ্ছে ততই বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা পৌছতে চাইছে অসীমের মধ্যে চেতনায়। তার স্বরূপ যেন বিশ্বরূপে এমন নানা ভাবে ও প্রকারে ব্যপ্ত যে পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র লক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম সূত্রে পৌছনো।

এই যে একটি মাত্র চেতনা, যা পদার্থ ও শক্তির বিভিন্নতার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করছে, তাকে তার স্বরূপে পাওয়াই লক্ষ হয়েছে। আর এই বিভিন্নতাই বিজ্ঞানের মতে ইলিউশান, বাংলা ভাষায় যাকে বলি মায়া। এই মহৎ জগতকে যে মায়া আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে বলি মহামায়া। জগতের বিভিন্নতা সেই মহামায়ার রূপ।

আদ্যাশক্তি মহামায়ার সেই রূপ যা বিশ্বকে আছন্ন করে রেখেছে, সেই অদ্বিতীয়া রূপটি আমাদের সেই একক চেতনার একটি মূর্তি। কীভাবে এই বিশ্বচেতনাকে ধারণা করা যায় তার কোনো নির্দিষ্ট নীতি নেই। তবে কখনও কখনও এই মায়ার আবরণ সরিয়ে কোনো কোনো মহামানবের মধ্যে এর প্রকাশ ঘটে। উপনিষদ বলছে, একটি মানুষের শরীর থেকে এই চেতনা সংকলিত হয়ে সহস্রারে (মস্তিষ্কে) আসে। সেই সংকলিত শক্তিই আমাদের আত্মা। এষ আত্মেতি। সেই আত্মা পরমজ্যোতি। যে জ্যোতি তারপর তার নিজস্ব রূপে সকলকে আবৃত করে।

এবমেষ সম্প্রসাদ অস্মাত শরীরাৎ সমুত্থায় পরমং জ্যোতিঃ উপসম্পদ্য

স্বেন রূপেণ অভিনিষ্পদ্যতে। এষ আত্মেতি। (ছান্দোগ্য)

এই যে সর্বময়ী জ্যোতিসত্ত্বা এইই কালী, আদ্যাশক্তি। চেতনাময়ী বিশ্বরূপিণী। এই ঈশ্বরীই তাঁর স্বরূপে আমাদের মধ্যে জাগেন। অন্তরে জাগেন। তাঁর দাঁড়াবার স্থানটি তিনি নিজেই তৈরি করেন। আধারকে বিস্তৃত করেন। সেই স্বরূপিনী তখন জীবচেতনা বা আমাদের সীমায়িত চেতনাকে ঢেকে সর্বব্যাপী বিশ্বচেতনায় জাগরিত করেন। এক ঘটি জল যেমন সাগরে মেশে ঠিক তেমন। ঘটি এই দেহ। জল চেতনা। সাগর সেই ঈশ্বরীয় চেতনা। সেটিই মুক্তি। সেই মুক্তিদায়িনীই মা বা ঈশ্বরী।

একটি আকরগ্রন্থের উল্লেখ করি।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে পরমহংসদেব বলছেন, “মনকরীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয় জগদ্ধাত্রী উদয় হন। মনকরী অর্থ মন, মত্তহস্তী।”

মনকরীকে কে বশ করতে পারে? কেউ ইচ্ছে করলেন বা সাধন করলেন আর মন বশ হলো, তা হয়না। যমেবৈষ বৃনুতে তেন লভ্য। সেই শক্তি যাকে বরণ করে তারই হয়। মন শুদ্ধ হলে শুদ্ধ মনে বিশ্বচেতনার যে মাতৃমূর্তি প্রকাশ পায় তাকেই জগদ্ধাত্রী বলা হয়েছে। তিনি সেই এক, আদ্যাশক্তি।

মনই আমাদের কখনো ঠেলে নিবৃত্তির দিকে নিয়ে যায়, কখনো বা প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে নেয়। দুয়েরই প্রয়োজন আছে। যখন প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ি, তখন বহির্জগতে আমরা ছড়িয়ে পড়ি। নানাভাবে নিজেদের সৃষ্টি করে চলি, এবং ঠিক যেমন মাকড়সা জাল বোনে সেই ভাবে নিজেদের সৃষ্টির জালে সেই মোহ রসে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। অবশেষে সেভাবেই শরীর ছেড়ে দিতে হয় একদিন। পরমাচেতনার অনুভূতি অধরা রয়ে যায়।

প্রতিটি মানুষ তার শুদ্ধ স্বরূপে পৌছতে চায়, বা বলা ভালো, শুদ্ধ স্বরূপে ফেরাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এ হয়না কেন? ঠিক যেভাবে জ্যোতিপুঞ্জরূপা আদ্যাশক্তি মায়ার আবরণ দিয়ে তাঁর স্বরুপকে ঢেকেছেন, তেমনই মানুষ তার দেহের আবরণে নিজের স্বরূপকে আর চিহ্নিত করতে পারেনা। পরমাশক্তির কাছে যা লীলামাত্র সেটিই আমাদের কাছে আজীবনের উপাস্য। মহামানব বলছেন, ‘বুড়ি যদি চায় তবে তখনই তাকে ছোঁয়া যায়’, কিন্তু বুড়িকে ছোঁয়া তাঁর ইচ্ছের ওপরে নির্ভর। একথায় বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যুক্তি পাবেনা। তাই একটু বিজ্ঞানের আলোয় এটিকে দেখে নেবো। যে শক্তি স্বনির্ভর, অনপেক্ষ, তা আমাদের অভ্যন্তরেও বিরাজমানা, কারণ ‘তাঁর ঘরে যে কালে জন্মেছি তখন হিস্যে আছেই’। কিন্তু আবরণ ঢেকে রেখেছে। মা যদি নিজের হাতে সেই আবরণ সরান তবেই স্বরূপে ফিরতে পারি। কীভাবে সরাবেন আবরণ? ঠিক এই কথাটিরই কোনো উত্তর নেই আমাদের কাছে। তাই আমরা প্রার্থনা করি। বিজ্ঞান বলছে, এই স্বরূপে ফিরতে চাওয়াই চেতনজগতের একমাত্র উদ্দেশ্য। পদার্থের একমাত্র গতি হল চেতনে ফিরতে চাওয়া। কিন্তু তাপমাত্রার তারতম্যের মতোই শক্তির মাত্রার তারতম্য ঘটে। তাই অধরা থেকে যায় সেই দিব্যচেতনা।

মহামানব বলেছেন, ‘মন মদমত্ত করী’। মত্ত করী অর্থে মত্ত হস্তী। হাতিটি আমাদের মনের প্রতীক। সাধারণ মানুষের নানা মায়ায় জড়ানো মন, নানা বিকারে অভ্যস্ত মন। সেই মনকে বিক্রম দ্বারা বশ করতে হয়। বিক্রম এর প্রতীক সিংহ। সিংহবিক্রম বলতে আমরা পুরুষকার বুঝি। আমাদের দেশে সাধনার ধারায় এর বিশেষ প্রয়োগ আছে। নানা রকম ক্রিয়া ও কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ বিক্রম লাভ করতে চায়। কিছু শক্তি যে আহরণ হয়না তাও নয়। কিন্তু পরম প্রাপ্তি ঘটে না। ওই কিছু শক্তি বিভ্রান্তির কারণ হয়। তবু, যে মানুষটি সিংহের ন্যায় বিক্রম দিয়ে মন কে বশ করতে পারেন তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন। অর্থ, যার হৃদয় শান্ত সুস্থিত হয়েছে সেখানেই বিশ্বরূপিনীর প্রকাশ হয়।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিক্রম হল মধ্যমা শক্তি। সেই অসীম থেকে যা আসে। আমাদের প্রভাবিত করে। যেমন, এতকাল ধরে জেনে আসা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আসলে একটি মিথ, মিথ্যে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু নেই। ও শুধু মহাবিশ্বে সৃষ্টি হওয়া ঢেউ। অথচ সত্যিই আমরা দেখছি সব কিছুই কেন্দ্রাতিগ বলে আকৃষ্ট হয়। তাহলে ওটি একটি মধ্যমা প্রকাশ। তেমনই পুরুষকার বলে আসলে কিছু নেই। ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছা বলে যেমন কিছু নেই। এ শুধু সাধন জগতের সত্য নয়। বৈজ্ঞানিক সত্য। সময় সারণি আসলে কল্পনা। মহাকালের কাছে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তাই যাকে বিক্রমশীল দেখছি সে আসলে স্বভাবসিদ্ধ। ওভাবেই তার সৃষ্টি। দেহের স্বাভাবিক গঠন।

এখন বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ যে তার বিক্রম দিয়ে পুরুষকার দিয়ে নিজের মনকে বশ করে পোষ মানায়, আর তাইতে প্রবৃত্তি তার অনুগামী হয়, তা আসলে পূর্বনির্ধারিত। বা বলা ভালো, তাঁর দেহের গঠন এমন যে আপনা হতে তাঁর দেহে শক্তি উর্ধমুখী হয়। তাঁকে চেষ্টা করে করতে হয়না। ঠিক তখনই সে প্রস্তুত হতে পারে ঈশ্বরীকে অনুভব করার জন্য। মহামানব বলছেন, ‘কোথা থেকে আশ্বিনের ঝড়ের মতন একটা কি এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আগেকার কিছু আর রইল না’। এই যে কোথা থেকে কী এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল, যার কথা উনি নিজে জানেন না, তাকেই বলছি আপনা থেকে হওয়া। বিদ্বত। এই রহস্যের কারণ অবিদিত। তাই বলছি, মায়া রহস্যময়ী। মহামায়া কৃপা করে দ্বার খুলে না দিলে তাঁকে জানা যায় না। আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের এই রহস্য যেদিন উন্মোচিত হবে সেদিন আমরাও ফিরে যাবো সৃষ্টির সেই আদিতে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।

কিন্তু একক মানবের চেতনায় এই রহস্যের উন্মোচন হয়। বেদান্তের মতে, পাঁচটি স্তর। আত্মা সাক্ষাৎকার, আত্মার মধ্যে এই জগত, জগত স্বপ্নবৎ, সেই জগত তারপরে বিন্দুতে পরিবর্তিত, এবং শেষে জড়সমাধিতে অহং এর লয়। তখন মহাসমুদ্রে ভাসমান বোধমাত্র থাকে। দেহীর অন্য কোনো চেতনা থাকেনা।

একটি বিন্দুর ওপারেই যেমন অনন্ত তেমনই একটি মানব শরীরে আত্মা সাক্ষাৎকারের পরেই আত্মা যখন বিন্দু, তারপরেই অনন্ত আর তার মধ্যে জগত। যেমন মা যশোদা দেখেছিলেন কৃষ্ণের মুখগহবরের যেমন অর্জুন দেখেছিলেন কৃষ্ণের মধ্যে এই বিশ্বরূপ দেখা যায় নিজের মধ্যেই আত্মজ্ঞানই বিশ্বরূপিণী, অর্থাৎ এই বিশ্বরপের আকার।

মাটির প্রতিমায় আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে যে বিশালত্ব আরোপ করি তা আসলে সেই বিশ্বরূপের প্রতীক। আকার কেন? ঠাকুর বলছেন ‘মরা মরা শুদ্ধ মন্ত্র ঋষি দিয়েছেন বলে’। ‘ম’ মানে ঈশ্বর। ‘রা’ মানে জগত। অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যে জগত। এই জগত তাই ঈশ্বরের এক প্রতিরূপ। অথচ ঈশ্বর বা সেই পরম পুরুষ নিরাকার, ‘ম’। ম’য়ে আকার দিলে ‘মা’ হয়, অর্থাৎ আকারযুক্ত বা সাকার ঈশ্বর হলেন মা। ঈশ্বরী। তাই মহামায়া এই জগত কে ধারণ করে আছেন। কোথায়? সেই মানুষের হৃদয় যেখানে মনকরী বশ হয়েছে সিংহের মতো বিক্রমের দ্বারা।

মহাকালের বুকে বিবসনা কৃষ্ণা যে মাতৃমূর্তি সাধকের কল্পনায় যুগ যুগ ধরে রূপ পায়, তার রূপক অর্থটি পরিস্ফুট হওয়া প্রয়োজন। এ যেন এক হেঁয়ালি। অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে যাই। দেখি মহামানব কি বলেছেন। ‘নগ্নিকা মাতৃমূর্তি আসলে দেহবোধ বিলুপ্ত হয়েছে, তার প্রতীক। দেহবোধ চলে গেলে লজ্জা ঘৃণা জাতি অভিমান ইত্যাদি অষ্ট পাশ ছিন্ন হয়। এই মূর্তি সাধক নিজের দেহের মধ্যে দেখেন। সুতরাং এ তাঁর নিজেরই অবস্থার দ্যোতক। মা শিবের বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে। নীচে শিব শব হয়ে পড়ে আছেন। শিব এখানে নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক। নির্গুণ কেন বলি? কারণ তাঁর গুণের খবর আমরা জানিনা। তিনি নিষ্ক্রিয় বলে আমরা মনে করি। কারণ জগতকারণের রহস্য সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞান। বস্তুত, নিষ্ক্রিয় বলে কিছু নেই। আমরা সেটুকুই জানতে পারি যতটুকু আমাদের প্রয়োজন। জানিয়ে দেন মা। তিনি নির্গুণ ব্রহ্মের থেকে চেতনা বা শক্তি আহরণ করে তাকে সগুণ করেন। তাই তিনিই সক্রিয়া। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। শিব শুয়ে।’

আমাদের এই জানার পরিমাণ কতটুকু হবে? যতটুকু পেটে সয়। মহামানব বলছেন, ‘বাড়িতে মাছ এলে মা কাউকে কালিয়া পোলোয়া করে দ্যান, কাউকে মাছের ঝোল, বা টক, কাউকে ভাজা। যার যেমন পেটে সয়’। একথার অর্থ অনেক ব্যাপক। এখানে শুধু এটুকুই উল্লেখ করি, যার যেমন দেহ তার তেমন অনুভূতি। মা ঠিক জানেন কাকে কতটুকু দেবেন। তাই মায়ের ওপরেই নির্ভর করি।

এই পর্বে বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বিশুদ্ধ ভক্তি একাকার হয়ে যায়। মায়ের চেয়ে প্রিয় আর কে? অস্তি ভাতি প্রিয়। মা আছেন, জানি, এই অস্তি জ্ঞান। তাঁকে দেহের মধ্যে দর্শন হল, ভাতি। তাই তিনি প্রিয় হলেন। এ অবস্থায় দেহী এক মুহূর্ত মাকে ছাড়া থাকতে পারেন না।

এ অবস্থা কার হয়? সাধারণভাবে আমরা মনে করি সাধক অত্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে কঠোর সাধন করলে তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন। কিন্তু না। একমাত্র ঈশ্বরীর কৃপা ছাড়া তা হয় না। যদি তাও বলা হয় পুরুষকার, তাহলে বলতে হবে সেও তাঁর কৃপা। আধার বিশেষে সেই কৃপা সিংহের মতন বিক্রম স্বভাবে দেয়। তাই কেউ কেউ, বা বলা ভালো কোটিতে গুটিক কেউ মহামায়াকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন।

তাহলে এখন কৃপা পাই কি করে?

বিজ্ঞান বলছে, বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব মস্তিষ্কের ধারণাশক্তি বৃদ্ধি পাবে। স্বতঃস্ফূর্ত সেই উন্নত মস্তিষ্ক ধারণা করতে সক্ষম হবে সেই শূন্যরূপা মহামায়াকে। মায়ার আবরণ আপনা হতে সরে যাবে। যেমন, মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখল সেদিন আগুন বাইরে জ্বলল। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে আগুন জ্বলেছে অনেক আগেই, মানবমস্তিষ্কে। সভ্যতার সেই বিবর্তনকে মনে রাখলে বোঝা সুবিধে হবে ভবিষ্যতের সেই বিবর্তনকে।

যুগ যুগ ধরে আমরা বাইরে মূর্তি তৈরি করে পূজা আরাধনা করি, নানা শাস্ত্র পুরাণ তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে মাকে তুষ্ট করতে চাই। তা নিতান্তই বাহ্যিক আচার। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিন এসমস্তই আমাদের অন্তরে ছিল। অন্তরের সেই বিশুদ্ধ প্রকাশ যখন হারিয়ে গেল, মানুষ যখন তার দেহের সেই স্বাভাবিক গতিকে হারিয়ে ফেলল তখনই সে প্রতীকের সৃষ্টি করল। ব্রহ্মসূত্র বলছে, প্রতীকাপন্ন লোক প্রতীকই পায়। শুদ্ধ বস্তু পায়না। যদি সত্য অধরা থাকে তবে প্রতীক পূজা করি কেন? কারণ তাপমাত্রার তারতম্য যেমন মহাবিশ্বে বহুত্বের সৃষ্টি করেছে ঠিক তেমনই আমাদের দেহের স্বাভাবিক শক্তি হ্রাস পেতে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে গিয়েছে। আমরা নানারূপে জগতকে দেখছি।

অতএব বিবর্তন বিনা উপায় নেই। কিন্তু আপাতত শান্তি কিসে? মহামানব বলছেন, ‘বানর ছানা জো সো করে মাকে ধরে। তাইতে সে কখনও খানায় পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু বিড়াল ছা নিজে মাকে ধরেনা। মা তাকে যেখানে রাখে সেখানেই থাকে’। তাহলে বিড়ালের ছানার মতো নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরতাও শক্তি, যা অচেতনে ক্রিয়া করে। তাই একমাত্র পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই পথ।

আর যদি একবার তা পারা যায় তবে কোনো সাধন-ভজনের দরকার নেই। কোনো বিগ্রহ হোম যজ্ঞ কিছু প্রয়োজন নেই।

মা তুমি প্রসন্ন হও। তুমি আমার রিপুনিচয়কে শান্ত করো। তুমি আমার প্রবৃত্তিকে মোড় ফিরিয়ে দাও। সে যেন ঊর্ধ্বগামী হয়ে তোমার স্থান প্রস্তুত করতে পারে। যেন সে তোমার অনন্তরূপিণী মূর্তি ধারণ করতে পারে, সেই অসীমে তুমি আমাকে নিয়ে যাও। শেষ পর্যন্ত, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান যেমন আদি কারণকে সেই অসীমে ধরতে চায়, অধ্যাত্মবিজ্ঞানেরও সেটিই লক্ষ। দেহ নাশ হলে আমরাও আবার সেই শূন্যেই তো ফিরি! শূন্য থেকে আসি, শূন্যে লয় হই। চুরাশি লক্ষ জন্ম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতারণা। বেদ বলছে, ইহ চেদবেদীদথ, নচেদিহা মহতী বিনষ্টি। এই জন্মে হল তো হল, নচেৎ মহতী বিনষ্টি। মহামায়া তাই একটি মানবজন্মেই তাঁর সকল রহস্য প্রকাশ করতে প্রয়াস পান।

তাই প্রার্থনা করি। কিন্তু এত প্রার্থনারও প্রয়োজন হয়না। মা যেমন জগতকে প্রসব করছেন আবার পালন করছেন, তেমনই তিনি ঠিক জানেন কখন কোথায় স্বরূপ উন্মোচন করবেন। এসব তাই বিকার বৈ আর কিছু নয়। এক সের চালের ভাত খাবো রে। এক জালা জল খাবো রে। এরকম। সে বিকার থেকেও তিনিই তুলবেন। সময় না হলে পাখি ডিম ফুটোয় না। সময় হলে আপনি হবে।

তাহলে আমরা কি তাঁর আরাধনা করব না? যখনই আরাধনা করতে হবে, এই কর্তৃত্ব বোধ কাজ করবে তখনই মায়া আমাদের গ্রাস করবে। তাই বরং প্রার্থনা করি, মা তোমাতে যেন আমার প্রণাম হয়। তোমাকে যেন আমার ধারণা হয়। মা প্রসন্ন হয়ে বরদা হয়ে প্রকাশ হও, আমি দেখি। মা তোমার কৃষ্ণা রহস্যময়ী রূপ সংবরণ করো। তুমি তো সংহারিনী নও। তুমি ক্রমাগত তোমার শক্তিকে প্রয়োগ করে এই সৃষ্টির লীলাখেলায় মেতে আছো। আমাদের দৃষ্টির বিভ্রমকে অপসারিত করো। তোমার জ্যোতির্ময়ী শুদ্ধ শূন্য রূপ দেখি।



[সাহিত্য আর সংবাদ দীপাবলী ২০২০]

2 comments:

  1. হরফগুলো অন্তত দশগুণ বড় করে করে আমাকে এসব লেখা পড়তে হয়। তাই ইচ্ছে থাকলেও নিরুপায়। তবুও পড়ে ফেললাম। একটি বাক্যে একটি কথাই বলি। বিষয়বস্তুর নির্বাচন এখানে নিজস্বতার স্মারক , কিন্তু  এর পেছনে পরিশ্রমী লেখাপড়া অশেষ প্রশংসার্হ।

    ReplyDelete
  2. অপূর্ব লেখা। অনলাইন প্লাটফর্মে এত গভীর লেখা পড়তে পাওয়া সৌভাগ্যের।

    ReplyDelete