0

সম্পাদকীয়

Posted in



ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে - lull before the storm, অর্থাৎ ঝড়ের আগের থমথমে পরিবেশ। কিন্তু এই যাকে ঝড় বলছি, তা কি ঝড় না অন্য কিছু? আপাতভাবে অতিমারির তাণ্ডব এখন অনেকটাই স্তিমিত; কিন্তু এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা শুনিয়ে রেখেছেন তৃতীয় ঢেউয়ের সতর্কবার্তা, যা নাকি অনিবার্য।

বাণিজ্যমহল দেখছেন সিঁদুরে মেঘের সংকেত। গতবারের লকডাউনের পরও কয়েক মাসের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা আভাস ছিল, এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত।

এদিকে খবরে প্রকাশ, এ বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হচ্ছে না। সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই নাকি এই সিদ্ধান্ত। আর যে কারণে এই ব্যবস্থা তথা অবস্থা, তা আমরা সকলেই জানি। পর্যাপ্ত টিকাদান সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে না!

ওদিকে ইউরোপের একাধিক দেশে আশ্চর্য এক অবিশ্রান্ত বর্ষণ আর জলপ্লাবনে শতাধিক মানুষের প্রাণহানীর মর্মান্তিক খবর বাতাসকে ভারি করে তুলেছে আরও...

আচ্ছা, আমরা কোনও জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি বসে নেই তো?

এরই মধ্যে সম্প্রতি হারালাম সাংবাদিক রাজীব ঘোষ ও চলচ্চিত্রকার গৌতম বেনেগালকে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা...

সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুনীল দাশ

Posted in



















দুই

শ্যুৎস্‌ বললেন, ‘কিছুদিনের জন্যে আপাততঃ আমি থাকছি না এই কোপেনহেগেনে। তবে এই ১৬৩৪-এর অক্টোবরে যুবরাজের জন্যে অভিষেক উৎসবের সঙ্গীত আসরের জন্যে দারুণ সুর সমারোহের আয়োজন করছি নিমন্ত্রিত সঙ্গীত বিশারদদের নিয়ে।’

‘বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যে লেখালেখির অঢেল সময় তো এখন আপনার হাতে।’ গুণগ্রাহীদের মধ্যে একজন বললো। কেমন এক অস্ফুট স্বরে নিজেকে কিছু বলার মতো খানিকটা একধরনের আত্মগত স্বরে শ্যুৎস্‌ বললেন, ‘বছর চারেক আগে বাবা মারা গেলেন। ‘পণ্ডিত’ বলা হতো যাঁকে সেই জমিদার, হেস্‌-এর মরিৎস মারা গেলেন— বছর দুই আগে— ১৬৩০-এ আমার পিতৃদেব চলে যাবার আরও দু’বছর পর, ১৬৩২-এ। তারপর আরও পৃষ্ঠপোষক একজন— জনকের মৃত্যুর পর জাত সন্তান— ফেউস্‌স্‌-এর পুত্র রাজকুমার হাইনরিষ্‌— নিজের অন্ত্যেষ্টির সঙ্গীতের আয়োজন করে গেছিলেন মারা যাওয়ার আগেই।’

‘আয়োজন মানে— পুরোটা ফিউনারেল্‌ মিউজিক স্বকর্মে শুল্কে— বাজনাটা ভালোসতো উপভোগ করেছিলেন— সেটা জানিয়ে গেছিলেন।’ হাসতে হাসতে বললেন শ্যুৎসে্‌র অন্য আর একজন গুণগ্রাহী।

‘দ্য মিউজিকাল্‌ এক্সজিকুইজ, ‘জার্মান জনতা অন্ত্যেষ্টির আঙ্গিকে এক ঐকবদ্য।’ পুরাতনকে মেশানো নতুনের সঙ্গে— একাজে পারদর্শিতা শ্যুৎসে্‌র। ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ ‘ঈশ্বরের অনুধ্যানে জীবনাবসান যাদের আশীর্বাদ ধন্য তারাই,’ সমুজ্জ্বল আলোয়।

জার্মানীর সঙ্গীত জগতে শ্যুৎসে্‌র গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছিলো। একের পর এক রাজদরবার থেকে আমন্ত্রণ আসছিলো— তাঁর রচিত সুর পরিবেশনের জন্মে। তাঁর আগে কোনও জার্মান সুর বিশারদ, এমনকি তাঁর পরেও পাওয়া যায় না বললেই চলে— সরাসরি এতটা প্রভাব সারা দেশের সঙ্গীত জীবনে আর কেউ ফেলতে পারেননি।

১৬৩৬-এ যুদ্ধের ঘটনাবলীর জন্যে ড্রেসডেনে শিল্পচর্চা অসম্ভব হয়ে উঠলো। সাময়িকভাবে রাজদরবার পুরোপুরি ভেঙে গেলো। আরও একবার যুদ্ধের বিষাদঘন বাস্তবতা থেকে শ্যুৎস্‌ বেড়িয়ে পড়ে ড্রেসডেন থেকে পাড়ি দিলেন কোপেনহেগেনে। গেলেন হামবুর্গ হয়ে। ১৬৩৮-এ নতুন এক বিপর্যয় আঘাত হানলো শ্যুৎসে্‌র জীবনে— তাঁর বড়ো মেয়ে— আনা জাস্টিনের মৃত্যু।

১৬৪০ থেকে ভুগতে লাগলেন বাতের ব্যথায়। তবে তার থেকে সেরে ওঠামাত্র আসন্ন সর্বনাশ এড়াতে মেতে উঠলেন ড্রেসডেনের কোর্ট অর্কেস্ট্রা পুনর্গঠনে। ইলেক্টর তৃতীয়বার শ্যুৎস্‌কে যখন কোপেনহেগেনে পাঠাতে চাইলে শ্যুৎস্‌ সর্বশক্তি দিয়ে তা রোধ করতে চেয়েও পারলেন না। ভেনিস রাজদরবারের প্রধান অর্গান বাদকের পদের সময়টা বাদ দিয়ে শ্যুৎস্‌ ১৬৪২ থেকে ১৬৪৪ সাল অবধি কোপেনহেগেনে ছিলেন সেই যাওয়া আসায় দু’মুখী সফরে শ্যুৎস্‌কে তাঁর সমসাময়িক অনেক সুরকারের সঙ্গে সাক্ষাতের বিরতি দিতে হয়েছিলো।

১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দ শ্যুৎসে্‌র সংঘর্ষের বছর। এই সময় আর একটি বৃন্দবাজন খানিকটা বাড়ছিলো। ইলেক্টরের উত্তরাধিকারী নিজের জন্যে পেরুগিয়া থেকে আসা গিয়োভানি আন্দ্রেয়া বোনটেম্পির (১৬২৪-১৭০৫) পরিচালনায় একটি অর্কেস্ট্রা গড়েছিলেন। বোনটেম্পি ও তাঁর অর্কেস্ট্রা ছিলো পুরোপুরি ইতালিয় আঙ্গিকের— ওটা দীর্ঘকাল ধরে এবং বহু রাজদরবারেই চালু ছিলো।

অপরদিকে শ্যুৎসে্‌র খ্যাতি তখন জার্মান রাজ্যগুলোর সীমানা পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো। শ্যুৎসে্‌র ডাক আসছিলো উল্‌ফেনবাটল্‌— ভাইমার, ডানজিগ্‌, ওয়ারশ্‌, লাইপজিগ এবং প্রেসবুর্গ থেকে। তাঁর স্বস্তির জায়গা ছিলো উইসেন ফেল্‌সের বিধবা বোনের কাছে আর পরে আনন্দ পেতেন তাঁর ছোটো মেয়ের কাছে। ১৬৪৮-এ ছোটো মেয়ের বিয়ে হলো। বোনের পাঁচটি শিশু বড়ো হয়ে উঠলো সুরকারের জীবনকালে।

শ্যুৎস্‌ কিন্তু কখনও তাঁর সুরারোপে তকেমে থাকেননি। তাঁর তৃতীয়বার কোপেনহেগেন সফরের সময় তিনি স্বেচ্ছায় এমন একটি সহজ কণ্ঠ এবং বাদ্যসঙ্গীতের সুনিশ্চিত ওস্তাদির মান গড়ে দিলেন আর শৈলী বেঁধে দিলেন যা তাঁর সাধারণ কাজের মুন্সিয়ানা থেকে আলাদা এবং যা তাঁর দেশের সীমা পেরিয়ে ভবিষ্যতের সুরের ভুবনেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। সেটা হলো ‘আমাদের প্রিয় ত্রাণকর্তা এবং রক্ষাকর্তা জেসাস ক্রাইস্টের সাতটি শব্দ। পবিত্র ক্রশ থেকে কথিত।’

এই কাজে বাদ্যযন্ত্রগুলো যেভাবে বোল ফোটালো তা অভ্রান্ত, সুরকারের পরবর্তী কাজের পূর্বাভাস— যা প্রয়োজনীয় সুরারোপকে সীমিত করে সম্ভাব্যকে সমৃদ্ধশালী করে। গাব্রিয়েলের সঙ্গীতের জাঁকজমক তখন অনেক দূরে। লাতিনকে যেভাবে সম্পূর্ণ সরিয়ে দিয়েছিলো জার্মান ভাষা— সেইভাবে বয়স বাড়তে থাকা সুলৎসে্‌র সুর হয়ে আসছিলো কঠিনতর, আরও তমসাচ্ছন্ন, যদিও তা কখনওই তার ক্ষমতা হারায়নি এবং হারায়নি সুনিশ্চিত প্রকাশ ব্যঞ্জনা। যুদ্ধের শেষ কয়েকটি বছরের বিবাদের প্রেক্ষিতে এবং হায়রে, পরবর্তী সুদীর্ঘ সময়েও শ্যুৎসের কাছ থেকে এই ধরনের কিছু প্রত্যাশা করা যায়নি।

যদিও প্রায়শই তিনি চাইতেন প্রাত্যহিকতার বিরক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে, নবোদ্যমে নতুন নতুন সুর বুনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে, এই সর্বাধিক দুঃসময় পর্বে শ্যুৎস মোট ২৯টি Motels লিখেছিলেন যা ১৬৪৮ সালে তিনি সঙ্কলিত করেন Musicalin ad chorms sacum নামে। এটি আধ্যাত্মিক ঐকতান। প্রথম খণ্ড। কোনও দ্বিতীয় খণ্ড হয়নি। লাইপছিগের টাউন কাউন্সিল এবং সেন্ট টমাসের কয়ারকে তিনি এটি উপসর্গ করেছিলেন।

শ্যুৎসে্‌র সুরবিতান প্রকাশনায় সমাজসেবার মেলবন্ধন ছিলো। তিনি সচাতন ছিলেন যে ওইভাবে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সুরস্রষ্টাদের সহযোগীতা করতে পারবেন। আধ্যাত্মিক বৃন্দসঙ্গীতের মুখবন্ধে শ্যুৎস্‌ লিখেছিলেন, ‘এর সাহায্যে আমি কিছু সুরকারকে উৎসাহিত করতে পারবো এবং সম্ভবত বিশেষ করে আগামী জার্মান সুরকারদের— তারা একক গানের বা বাজনার স্বরলিপিতে ঢুকে পড়ার আগে— এই কঠিন প্রচেষ্টার প্রারম্ভে তাদের প্রেরণা দিতে পারবো।’

শ্যুৎসে্‌র সঙ্গীত বিধিবিধান, তাঁর সুরলিপি সম্পর্কিত মতবাদ লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর এক শিষ্য ক্রিস্টোপ বার্নহার্ড (১৬২৭- ১৬৯২)। ১৬৫৫ থেকে ড্রেসডেনে সহকারী অর্গান বাদক তিনি।

শ্যুৎস্‌ নিজেই দেখিয়েছেন যে বার্নহার্ড কথা বলছেন তাঁকে নিয়ে, “তাই আমি আশায় আছি এবং ইতমধ্যেই জানা হয়ে গেছে সেই কথা যে আমার খুব পরিচিত এক সঙ্গীত বিশারদ এবং তত্ত্বগতভাবে ও চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী একজন শীঘ্রই এ ব্যাপারে বিধিবদ্ধ প্রবন্ধে আলোকপাত করতে চলেছেন— বিশেষ করে আমাদের কাছে—জার্মানদের কাছে— যা হতে পারে সর্বাধিক হিতকারী এবং মঙ্গল সাধনের ক্রিস্ট্রোফ বার্নহার্ডের গ্রন্থটির নাম Tractatus compositions allgmentatus, এখন সযত্ন সম্পাদিত সংস্করণ পাওয়া যায়— Heinrich Schiitz’s Theory of composition as interpreted by his pupil Christoph Besnhard.

ইলেক্টরের সঙ্গে শ্যুৎসে্‌র ঝগড়া এমনকি ১৬৪৮-এর পরেও চলছিলো এবং ড্রেসডেনের শান্তি উদযাপিত হয়েছিলো ১৬৫০-এ। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি ড্রেসডেনকে তাঁর সুদীর্ঘ সেবার কথা নির্দেশ করেছেন। তাঁর বয়স, ক্ষীয়মান দৃষ্টিশক্তি এবং প্রস্তাবিত উপযুক্ত উত্তরসূরীয় কথা, অতিরিক্ত চাপের কথা বলে অন্তর্বর্তী সময়কালীন সমাধান— সব বৃথা হলো। বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে শ্যুৎস্‌ চেষ্টা করেছিলেন যোহান গেয়র্গকে দেখাতে তাঁর অবসরে ঘরে ফেরার— অর্থাৎ উইসেলফেল-এ ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করতেঃ প্রথম হ’লো আমার বয়স এগিয়েছে, কমে যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি এবং অন্যান্য শারিরীক ক্ষমতা। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এখনও আগের মতো আত্মবিশ্বাস সহকারে আমি আমার সুরারোপ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি— কিন্তু সবটাই করতে হচ্ছে কষ্টের সঙ্গে, অনেক মন্থরতায়— যেটা সহজেই বুঝতে পারা যায়।’

ইলেক্টর মহোদয় নীরব থাকলেন।

গানবাজনার লোকেদের এত কম টাকা-পয়সা দেওয়া হ’তো যে সেই টাকা-পয়সায় তাদের জীবনযাপন খুবই কষ্টকর ছিলো। শ্যুৎস্‌ তাঁর গানবাজনার দলের একজনের কথা জানিয়েছেন, ‘আমি জানলাম যে ধার করা কুর্তা আর কোট পরা লোকটির কোনও বিছানা নেই, খড়ের গাদায় শুয়োরের মতো থাকে— তার স্ত্রী গতকাল আমার কাছে সাহায্য ভিক্ষে করতে এসেছিলো তার দুরবস্থায়।

এর সঙ্গে আরও ছিলো উত্তরসূরীর বৃন্দবাদনের প্রতিযোগিতা আর সেই পরিস্থিতিতে পরিপূর্ণভাবে বোঝা যাচ্ছে যে ইলেক্টর যুবরাজের বৃন্দবাজনের প্রধান অর্গানবাদককে তাঁর নিজের দলের নির্দেশক পদে বদলি তিনি বাতিল করেছিলেন। যেটা তাঁর স্বস্তি হবে মনে করে আবেদন করা হয়েছিলো— দেখা গেলো সেটা গভীর ক্ষতের। আরও একটা ব্যাপার ছিলোঃ যদিও শ্যুৎস্‌ আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন— যুবরাজের অর্কেস্ট্রার খানিকটা ইতালিয় পরিগ্রহণ নিয়ে, তিনি তাঁর নিজের বৃন্দবাদনে, সুরবিতানে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা করেননি তো?’

কাহিনী কি রকম! সত্তরে পৌঁছেও তিনি তাঁর কর্তব্য কর্মের কোনওকিছুর থেকে অব্যহতি পাননি, একজন মানুষ যিনি সঙ্গীতের অগ্রগতির ইতিহাস রচনা করেছেন— তাঁকে ভাঙাচোরা অর্কেস্ট্রা নিয়ে কাটাতে হয়েছে। এতে ইলেক্টরের কোনওরকমের উদ্বেগ ছিলো না। অন্তত ৮ অক্টোবর প্রথম যোহান গেয়র্গের মৃত্যুতে শ্যুৎসে্‌র অবসর নেওয়া পর্যন্ত। ওটি ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দ।

পরবর্তী উত্তরাধিকারী এখন দ্বিতীয় যোহান গেয়র্গ (১৬১৩-১৬৮০), এই বড়ো মাপের সঙ্গীত বিশারদটির পছন্দ মতো প্রধান অর্গান বাদকের পদে বহাল থেকে উইসেনফেল্ডে সফর করেছেন। এখন আর কোনও বাধাবন্ধকতা নেই— এখন ইলেক্টরের অর্কেস্ট্রার সঙ্গে উত্তরসূরীর অর্কেস্ট্রার মিশিয়ে দেওয়াতে কিছু যায় আসে না। তিনি ক্রমশঃ তাঁর ড্রেসডেনের ক্রিয়াকর্ম সব কমাতে থাকলেন, ১৬৫৭-তে বাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। এর পুরোদস্তুত উইসেনফেল্ডে চলে এলেন। ড্রেসডেনের রাজ দরবারে মাঝেমধ্যেই ঘুরে আসা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। শ্যুৎসে্‌র শিষ্য ক্রিস্টোফ বার্নহার্ড ড্রেসডেন ত্যাগ করেছিলেন। অর্কেস্ট্রায় ইতালিয় ঘরানা ঢোকানোর একটা প্রতিবাদ স্বরূপ, তিনি হামবুর্গে চলে গিয়েছিলেন। পরে ফিরে এসেছিলেন।

শ্যুৎস্‌ কিন্তু পুরোনো এবং নতুন সুর রচনা করে চললেন। ১৬৫৭-তে প্রকাশিত হলো ‘বারোটি ভক্তিগীতি।’ শ্যুৎসে্‌র শেষ কাজ ‘ঈশ্বর ও মেরীর আনন্দময় ও করুণাঘন সন্তান— জেসাস্‌ ক্রাইস্টের জন্মের ইতিহাস।’ ১৬৬১ তে যার তিনটি সংস্করণের দোষটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৬৭১ তে।

৬ নভেম্বর, ১৬৭২-এর বিকেল চারটে।

সাতাশি বছর বয়স হাইনরিষ শ্যুৎসে্‌র। তিনি শুয়ে রয়েছেন। তাঁর প্রিয়জনেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর বিছানার চারিপাশে। তাঁরা গান গাইছেন। কোনও মৃত্যুযন্ত্রণার বেদনা নেই সুরের গুরুর। শ্রম আর সমস্যার পরিপূর্ণ এক জীবন শেষে তিনি এক সুন্দর প্রশান্ত মৃত্যুতে প্রবেশ করলেন। যদিও সঙ্গীত সমাজে তাঁর কাজের পুনরাবিষ্কার হয়েছে অনেক পরে। ঊনবিংশ শতকে বাক্‌-রেনেশাঁয় অল্প একটু হোঁচট খেয়ে— এর চিরস্থায়ী প্রভাব উঠে এসেছে— যার ফলে আজ তাঁর উপাধি ‘নতুন জার্মান সঙ্গীতের জনক।’ *

*Hans A. Neunzig- এর A New European Music অবলম্বনে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

Posted in















বাংলা সাহিত্যে নর-নারীর যৌন সম্পর্ক নিয়ে যুগান্তকারী কালোত্তীর্ণ কোনও উপন্যাস নেই। কিংবা অন্যান্য উপন্যাসেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নর-নারীর সম্পর্কের বিন্যাসে প্রেম ভালোবাসা যতই থাক। যৌনতা থাকলেই বিপদ। সাহিত্য মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের পরতে পরতে দেশ-কাল সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি শরীর এবং মনের ঘাত-প্রতিঘাতের রূপকার। বাংলা সাহিত্যে নর-নারীর জীবনের বাকি সকল দিকগুলি উপস্থিত থাকলেও। নর-নারীর যৌন সম্পর্কের গভীরে বাংলা সাহিত্য আজও সেভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। পারেনি তার অনেক কারণ রয়েছে। সামাজিক ট্যাবু। প্রকাশক সম্পাদকের বিরুদ্ধতা। যৌন সম্পর্কের গভীরে পৌঁছানোর বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব। ইত্যাদি নানান কারণেই বাংলার সাহিত্যিকরা মূলত এই বিষয়টিকে সাহিত্যের অন্যতম সামগ্রী করার পথে এগোতে পারেননি। যাঁরা এগোতে চেয়েছেন। তাঁদের অবস্থা প্রায় ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো। আরও পরিষ্কার করে বললে, বাংলা সাহিত্যের ভাষা আজও যথেষ্ট সাবালক বা প্রাপ্তবয়স্কও হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে নর-নারীর যৌন সম্পর্কের গভীরে ডুব দেওয়ার মতো ভাষার শক্তি বাংলা সাহিত্যের ভাঁড়ারে নেই। এও একটা বড়ো কারণ। বাংলার সাহিত্যিকদের এই বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার পিছনে। আমাদের সাহিত্যের আলোচনাতেও যৌনতার বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করাই আমরা শ্রেয় মনে করি। লেখকের লিখতে দ্বিধা। আলোচকের আলোচনায় দ্বিধা। পাঠকের পড়তে আগ্রহ। কিন্তু হাতের কাছে সেই সাহিত্য নেই। সেই সিনেমা নেই। সেই নাটক নেই। সেই ভাস্কর্য নেই। সেই চিত্রকলা নেই। ফলে পাঠকও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে পারে না বাংলায়। তাকে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হয় বিদেশী সাহিত্য মুখে করে। ফলে চেতনার বলয় অপুষ্টই রয়ে যায় আগাগোড়া। এটা বাংলা সাহিত্যের দূর্দৈব। বাংলার দুরবস্থা। বাঙালির দুর্দশা।

সাহিত্য মূলত সমাজের চলনের রূপকার। যে সমাজের যে চলন। সেই সমাজের সাহিত্যের স্বরূপ সেই চলনের অনুরূপ। কিংবা রকমফের। বাঙালি সাহিত্যিকের পক্ষে ইউরোপের গল্প বলা সম্ভব নয়। এমনকি যে সামাজিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন একজন সাহিত্যিক, তাঁর পক্ষে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর গল্প বলাও সহজ কথা নয়। ফলে সাহিত্যিকের জীবনযাপন ও তার সামাজিক পরিবেশ থেকেই তার কলম কীভাবে চলবে তার ধরন ও স্বরূপ রূপ নিতে থাকে। এটাকে অস্বীকার করা সম্ভব হয় না স্বভাবতই। ফলে বাঙালি সমাজের চলনই বাংলা সাহিত্যের ধারা ঠিক করে দিতে থাকে। আবার সমাজ চিরকাল একই জায়গায় থেমেও থাকে না। দাঁড়িয়ে থাকে না। সমাজও চলতে থাকে সময়ের সাথে। ফলে সমাজ যতটুকু চলে, যেভাবে চলতে থাকে, সেই সমাজের সাহিত্যও সেইভাবে চলতে থাকে। এখন আমাদের বাংলায় আমাদের সামাজিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার একটি বড়ো বিষয়। সব সমাজেই এই বিষয়টি সক্রিয় থাকে। আমাদের আজকের চলন যতই এই সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক না কেন। আমাদের চলনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে সে কখনওই অস্বীকার করতে পারে না। উল্টে তার চলনের মজ্জায় মজ্জায় সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের শিকড় ও তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে জড়িয়ে থাকে। ফলে আমাদের পোশাক হয়তো আধুনিক হতে পারে। আমাদের হাতে প্রযুক্তির নানান উদ্ভাবনী সামগ্রী আধুনিক থাকতে পারে। কারণ সেগুলি চটজলদি আমদানি করা যায়। নকল করা যায়। কিন্তু আমাদের চলনের গভীরে রয়ে যায় আমাদের ঐতিহ্যের শিকড়। আমাদের ঐতিহ্যের শতাব্দী প্রাচীন উত্তরাধিকার। তার সাথে সঙ্গতি রাখতে রাখতে অতি অতীব ধীরগতিতে আমাদের চলন অল্প-স্বল্প করে বদলাতেও থাকে। কারণ বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পড়তে থাকে। সেই প্রভাব আমাদের চলনের তাল-লয়-মাত্রায় যতটুকু নতুনত্ব নিয়ে আসে। ততটুকুই এগোতে থাকে আমাদের সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি। এই এগোনোর মূল অনুঘটক আমাদের অভ্যন্তরীন বদল ততটা নয়। যতটা বাইরের প্রভাব। মূল সমস্যা এইখানেই।

বাংলার সমাজে শরীর একটা সামাজিক ট্যাবু। শরীর নিয়ে যত কম বলা যায় ততই শোভনীয়। যত কম ভাবা যায় সেটাই কাম্য। এই যে একটি মান্ধাতার আমলের ধরন আমাদের সমাজের চলনের উপরে কর্তৃত্ব করতে থাকে, এর ভিতর থেকে আমরা কেউই বেড়িয়ে আসতে পারিনা। বিশেষ করে যার লেখাপড়ার বহর যত বেশি। আমাদের নাগরিক জীবন-যাপনের পরতে যে অর্থনৈতিক শ্রেণীগুলির ভিতরে আমাদের ওঠাবসা, চলাচল। তার বাইরের সমাজের কথা আমরা কতটুকু জানি? তাই আমাদের আলোচনা সেই শিক্ষিত নাগরিক বাঙালি সমাজকে কেন্দ্র করেই। যাদের হাতেই সচল থাকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। এই যে একটা শ্রেণী। আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী বললেও, নিজেদেরকেও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দূরবর্তীও ভাবতে পারি না কখনওই। আমাদের আলোচনার বৃত্ত এই সামাজিক পরিসরকে নিয়েই। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীরও একটা বড়ো ভূমিকা রয়ে গিয়েছে। আমাদের এই শ্রেণী চেতনার বৃত্তে। তাই আমাদের সামাজিক পরিসর থেকে ব্যক্তি পরিসরে আমরা শরীর নিয়ে সদাসর্বদা শশব্যস্ত থাকি। শরীর নিয়ে বেশি দূর আলোচনা করা যাবে না। ভাবা যাবে না মন খুলে। ভাবতে বসলে সেটিকে আমরা প্রথমেই মনের বিকার ও পরে মনোরোগ বলে ভাবতে শুরু করে দেবো। মূল গণ্ডগোলটা ঠিক এইখানেই। মানুষের জীবনে শরীরটাই যে প্রথম এবং শেষ। মন যে শরীরেরই একটা বিস্তার। গোড়ার সেই সত্যটুকু আমাদের চেতনায় অধরাই রয়ে যায়। আমাদের ভিতরে শরীর নিয়ে যে গভীর একটা লজ্জাবোধ ক্রিয়াশীল থাকে, সেই মনোবৃত্তি থেকেই যৌনতা নিয়ে আমরা মুখে কুলুপ আঁটতেই অভ্যস্থ। ফলে যে মানুষ শরীর নিয়েই সদাসর্বদা শশব্যস্ত, লজ্জিত, শঙ্কিত, সেই মানুষের পক্ষে যৌনতা নিয়ে পরিষ্কার মনে আলোচনা করা কী করে সম্ভব? মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মতো, এরপরে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ণত্বষত্ব। ফলে শরীর নিয়ে চলার ভিতরেও আবার নারী-পুরুষের জন্য আলাদা নিয়ম।

বাঙালি মেয়ে সমুদ্র স্নানে গেলে শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে ঢেউয়ে ভিজে চান করবে। নয়তো খুব আধুনিক হলে জিন্সের প্যাণ্ট-টপ। কিন্তু সমুদ্র স্নানের পোশাক বিকিনি পড়ে বঙ্গললনারা পুরী-দীঘাতে জলে লম্ফঝম্ফ করছে, আমাদের সমাজে এখনও ভাবা যায় না। এই যে বাধা। এই বাধা একেবারে মজ্জাগত। হ্যাঁ একটা পিছিয়ে থাকা সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও খুবই নড়বড়ে। কিন্তু আমাদের মন-মনন-মানসিকতায় আমরা আমাদের শরীরকে নিয়ে আজও কো‌নওভাবেই সহজ হয়ে উঠতে পারি না। ফলে যৌনতার বিষয়টা যেন এক নিষিদ্ধ এলাকা। সেই এলাকায় একজন সাহিত্যিকের কলম প্রবেশই বা করবে কী করে? তাই বলে কি বাংলা সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ নেই? আছে বইকি। অনেক সাহিত্যিক এই বিষয়ে তাঁদের নিজের মতো করে চেষ্টা করে গিয়েছেন নতুন পথকাটার। কিন্তু সেই পথ কতটা পথ আর কতটা গোলকধাঁধা প্রশ্ন তো সেখানেই। বাংলা সাহিত্যিকের কলমে যৌনতার ব্যবহার আমাদের মেয়েদের শাড়ি-সালোয়ার কামিজ পড়ে সমুদ্র স্নানের মতোই। তার বেশি কিছু নয়। এই কারণে, জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে দিক। সেই যৌনতার দিকটাই আমাদের সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আর মনে রাখা দরকার। যৌনতাকে এড়িয়ে গিয়ে নর-নারীর সম্পর্কের বয়নের গভীরে পৌঁছানো যায় না কখনওই। এবং দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্য, বাংলা-সাহিত্য আজও নর-নারীর সম্পর্কের রসায়নের অতলান্ত গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি আদৌ। অনেকেই হয়তো বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের নামধাম স্মরণে উদাহরণসহ এইকথা খণ্ডনে প্রয়াসী হবেন। কিন্তু একথা কোনওভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলা সাহিত্য আজও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলা উপন্যাস। আবার একথা বলার উদ্দেশ্যেও নয়, প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাস সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে কেবলমাত্র যৌনতা নিয়েই টানাটানি ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। একদমই সেকথা নয়। কিন্তু নর-নারীর সম্পর্কের গভীরে পৌঁছাতে গেলে সাহিত্যকেও নর-নারীর যৌনতার পরতের পর পরতে প্রবেশ করতে হবে। মুশকিল হলো এটাও যে। তার জন্য উপযুক্ত ভাষা আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষা এই বিষয়ে আমাদের উপন্যাস সাহিত্যের মতোই অপ্রাপ্তবয়স্ক রয়ে গিয়েছে আজও। আমাদের সাহিত্য কুলের কলমে ভাষার দৈন্য ঘোচেনি আজও। তার অন্যতম বড়ো কারণ, শরীর নিয়ে সেই সামাজিক ট্যাবু। এবং অতিরিক্তি পরিমাণে বিদেশী ভাষার উপরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নির্ভরতা। এই ট্যাবু ও বিদেশী ভাষার উপরে নির্ভরতা আমাদের ভাষার স্বাভাবিক অগ্রগতিকে খর্ব করে রেখে দিয়েছে। ফলে আমাদের আর বয়ঃবৃদ্ধি ঘটলোনা। যৌনতার প্রসঙ্গকে আমাদের স্বাভাবিক ভাবনা-চিন্তা আলোচনায় এড়িয়ে চলতে চলতে। আমরা বিষয়টিকে বন্ধ ঘরের দরজার ভিতরে একটা নিশিক্রিয়ার বেশি কিছু অনুভব করে উঠতেই শিখলাম না। জাতি হিসাবে, সাহিত্য হিসাবে এইখানে বাংলা আজও খোঁড়া হয়ে খোঁড়াচ্ছে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in

জনজাতি ও জনগোষ্ঠী মানুষের সংখ্যা নিরিখে ভারতবর্ষের স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়, আফ্রিকার পরেই। সারা ভারতবর্ষ জুড়েই আছে অসংখ্য জনজাতি সমাজের মানুষ যারা এখনও অবহেলিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, যারা সাধারণ সমাজের মানুষের কাছে অ-সংস্কৃত, অ-ভদ্রজন হিসাবে এখনও পরিচিত, তবু তারা আপনাতে আপনি উজ্জ্বল।

মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজ ও সমাজজীবন নিয়ে গবেষক, শিক্ষিত মানুষ, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানীদের জানার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। এই সময়েই আবিষ্কৃত হয় সারা পৃথিবী জুড়ে নানান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষগুলিও। আমাদের দেশেও আবিষ্কৃত হয় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাচীন সভ্যতা যা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। প্রাথমিক অনুমান ছিলো এগুলি নগর সভ্যতা এবং সেখানকার মানুষগুলি ছিলেন নাগরিক সভ্যতায় সুশিক্ষিত। কিন্তু পরে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে তারা নাগরিক সভ্যতায় সুশিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। বস্তুতঃ তথাকথিত ‘আর্য’ নামে কোনও উন্নত বহিরাগত সম্প্রদায় বলেও কিছু ছিলো না। মানুষের বৃত্তির যেমন বিভিন্ন স্তর থাকে, তৎকালীন ‘আর্য, নিষাদ, শবর ইত্যাদিও ছিলো সেইরূপ সভ্যতার বিভিন্ন স্তর। আর্য স্তর ছিলো তৎকালীন সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত স্তর।

কিন্তু সেই প্রাচীনকালেও ছিলো উচ্চ-নীচ ভেদ, সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের নিম্নস্তরের মানুষের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, উৎপীড়ন এবং শোষণ। আসলে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের সঙ্গে উচ্চস্তরের মানুষের সংষ্কৃতির পার্থক্য। ফলস্বরূপ সমাজের উচ্চকোটি মানুষ বা উচ্চস্তরের মানুষ যারা আর্য নামে পরিচিত, সেই তথাকথিত আর্যগণের কাছে পরাজিত, অসম্মানিত ও বিতাড়িত হয়ে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন নানান গুহা, গিরিকন্দরে, পর্বতের সানুদেশে, গভীর অরণ্যে এবং ক্রমশঃ মূল জনসমাজ থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরে এইসব মানুষেরা নানাভাগে বিভক্ত হয়ে পরিচিতি লাভ করেন জনজাতি ও জনগোষ্ঠী রূপে। এক স্থান থেকে আর এক স্থানে তারা যাযাবরের মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হন এবং নানা জায়গায় গোষ্ঠীগুলি ছড়িয়ে পড়লেও অক্ষত থাকে গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি, যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে ছড়িয়ে পড়া নানাভাগে বিভক্ত মানুষগুলিকে জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসাবে।

এই জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মধ্যে অধিক সংখ্যায় দেখা যায় সাঁওতাল জাতির মানুষ। আমাদের দেশেও জনজাতি সমাজের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যার মানুষ হ’লেন সাঁওতাল যা মূলতঃ অস্ট্রোলয়েড সমাজের অন্তর্গত। তৎকালীন সমাজ ছিলো অরণ্যসমৃদ্ধ সমাজ। অরণ্যচারী, প্রকৃতির কোলে লালিতপালিত মানুষগুলির জীবনে অরণ্যের ছিলো প্রধান ভূমিকা। শুধুমাত্র খাদ্য, বাসস্থানই নয়, জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা অর্থাৎ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ছিলো অরণ্যের একটি প্রধান ভূমিকা।

যতদূর জানা যায় অথর্ব বেদেই সর্বপ্রথম লিখিতভাবে ভারতীয় চিকিৎসাবিধি সম্বন্ধে রোগ-যন্ত্রণার মুক্তির উপায় নির্ণয় করা হয়। যে কারণে অথর্ব বেদে বৃক্ষের কাছে মানুষের করুণা ভিক্ষার শ্লোক উল্লেখিত হয়েছে—
“হে ভৈষজগুল্ম, তুমি মজ্জার সাথে মজ্জার, অঙ্গের সাথে অঙ্গ যুক্ত কর, মাংসের এবং অস্থির যে অংশ পতিত হয়েছে তা পুনরায় পুর্ববৎ হোক। অস্থি সবল হোক আর ছিন্ন ত্বক ত্বকের সাথে একাত্ম হোক। হে ভৈষজগুল্ম, তুমি শোণিত সবল কর, কেশের সাথে কেশের ভগ্নাংশ যুক্ত কর।”

এই প্রার্থনার মাধ্যমে যা জানা যায় তা হলো তখনকার সমাজে শল্যচিকিৎসা, ঔষধির সম্যক জ্ঞান ইত্যাদি চিকিৎসকদের ছিলো। যদিও তা বর্তমানের আধুনিক চিকিৎসা ছিলো না, যা ছিলো তা হলো আয়ুর্বেদের চিকিৎসা। ক্রমে ক্রমে শিক্ষা ও নাগরিক সভ্যতায় উন্নত সমাজে নানাভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হলেও জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষগুলির চিকিৎসায় অরণ্যের প্রভাব রইলো অবিচ্ছিন্ন। মনুষ্যজীবনে অরণ্যের উপকারিতা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন সর্বতোভাবে। অরণ্যের প্রতিটি গুল্ম, লতাপাতা সবই মানুষের জীবনে সুফল দান করে। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এইসব আদিম অধিবাসীরা, যাদের আমরা জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষ বলে মনে করি, গাছ-গাছড়ার পরিচয়, তার নির্যাস থেকে ঔষধ প্রস্তুত ইত্যাদিতে অনেক এগিয়ে এবং তাঁদের সমাজে কিন্তু বর্তমানেও তাঁরা এই ঔষধপত্র ব্যবহার করে থাকেন।

সাঁওতাল সমাজের মানুষদের চিকিৎসা করেন সমাজের ওঝা। সাঁওতাল সমাজের ওঝাই হলেন তাঁদের চিকিৎসক। ওঝা ও সাঁওতাল সমাজের রোগ-অসুখের চিকিৎসা নিয়ে Rev. P.O. Bodding তাঁর ‘Studies in Santal Medicine And Connected Folklore’’ বইতে (This book was first published in three volumes between 1925—1940 from The Asiatic Society of Calcutta. And was republished all three volumes in the year 1986 in one volume.) সাঁওতালদের রোগ-অসুখ ও ওঝা নিয়ে চমৎকার বর্ণনা করেছেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে তিনি জনজাতি-জনগোষ্ঠী তথা সাঁওতাল সমাজে গাছ-গাছড়া ও তার ব্যবহার নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন এই বইয়ে। আধুনিককালে এটিই প্রথম এই ধরনের গবেষণামূলক বই, যদিও ঔষধি হিসাবে গাছ-গাছড়ার ব্যবহার সম্বন্ধে এই সমাজের মানুষেরা অনেক আগে থেকেই অবহিত ছিলেন। সেই বই থেকে তাঁর কিছু নিদর্শন এখানে দেওয়া যেতে পারে। আমরা তাহলে ‘সাঁওতাল সমাজের রোগ-অসুখ ও তাঁর চিকিৎসা’ সম্বন্ধে একটি সম্যক ধারণা করতে পারবো।

সাঁওতালদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা বা বিশ্বাস আছে যে অসুস্থতা, রোগ-ব্যধি স্বাভাবিক নয়। এই বিশ্বাস থেকেই তারা নিজেদের মতো একটি ধারণা তৈরি করে নেন। সাঁওতালদের মতে, ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ দেবতার (তাঁরা যাকে বলেন Supreme God) নির্দেশেই সবকিছু চলে। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু আত্মাও আছে, যাদের তারা বলেন বোঙ্গা (Bonga). এই আত্মারা ভালো এবং মন্দ দুইই হয়ে থাকে। তাদের মতে, মানুষ সবসময় ভালো কাজ করে না, মানুষ সবসময় ভালোও হয় না। ভালো কাজ না করলে এই দুষ্ট বা মন্দ আত্মারা তাদের উপর ভর করে এবং তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করিয়ে নেয়। দুষ্ট আত্মা মানুষের উপর ভর করলে মানুষ ভালো কাজ করে না, ভালো থাকতে পারে না। দুষ্ট আত্মাদের দ্বারাই মানুষের দেহে নানারকম আধি-ব্যধির সৃষ্টি হয়, মানুষ কষ্ট পায় এবং পরিশেষে মৃত্যু বরণ করে। এগুলি হলো সরাসরি অসৎ কর্ম করার ফল। অসৎ কর্মের জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে এবং অনেকসময় দুষ্ট আত্মারা মানুষকে ‘খেয়ে’ও ফেলে।

যখন পরিবারের কেউ একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন, সাধারণভাবে আমরা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকি, বা নেওয়া উচিত বলে মনে করি যা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সাঁওতাল পরিবারের মনে ঠিক এই প্রতিক্রিয়া হয় না। তাঁরা অসুস্থ মানুষটির দিকে লক্ষ্য রাখেন, রোগ ও রোগীর অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে তা লক্ষ্য করেন। যদি রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাহলে চিকিৎসার ব্যাপারে করণীয় কিছুই থাকে না। তারা অপেক্ষা করেন কারণ তারা মনে করেন রোগ নিজেই একদিন ক্লান্ত হয়ে রোগীকে ছেড়ে যাবে। কিন্তু তা যদি না হয়, রোগীর অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে তারা তখন ঘরোয়া চিকিৎসা শুরু করেন।

আগেই বলেছি, জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষ অরণ্য-নির্ভর এবং তাদের প্রায় সকলেই গাছ-গাছড়া থেকে নির্যাস তৈরি করে গৃহেই সাধারণ চিকিৎসা করে থাকেন, সুতরাং, একজন রোগীর রোগ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তাঁরা ঘরোয়া চিকিৎসা শুরু করেন। এই চিকিৎসা হলো Root-Medicine অর্থাৎ গাছ-গাছড়া সম্বন্ধিত। প্রায় প্রতিটি পরিবারের মানুষজন, কিংবা পারিবারিক আত্মীয়জন অথবা প্রতিবেশীদের কেউ এই চিকিৎসা শুরু করেন। সাঁওতালদের মধ্যে প্রায় সকলেই ঘরোয়া চিকিৎসা সম্বন্ধে কিছু না কিছু ধারণা রাখেন। কিন্তু এরপরেও যদি রোগীর রোগ না সারে, কিংবা রোগী চিকিৎসায় সাড়া না দেন, তাহলে তখন ওঝাকে বা সাঁওতাল সমাজের চিকিৎসককে ডেকে আনা হয়। তিনি প্রথমে ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্র-মন্ত্র, ম্যাজিক ইত্যাদির সাহায্যে রোগকে বশে আনার চেষ্টা করেন। রোগী সুস্থ হয়ে না উঠলে তখন তিনি চিকিৎসক রূপে ঔষধি প্রয়োগ করেন। ওঝা হিসাবে তাঁর প্রথম কাজ হলো রোগীর দেহে বাসা বেঁধে থাকা অশুভ আত্মা বা আত্মাগুলিকে রোগীর দেহ থেকে উন্মুক্ত করা বা তাড়িয়ে দেওয়া। তারপর প্রয়োজনমতো ঔষধ দেন। ওঝাদের মধ্যে দেখা যায় এক আশ্চর্য ক্ষমতা, বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে নানাধরনের ঔষধ তৈরি করে তাঁরা রোগীর দেহে প্রলেপ দেন এবং রোগীকে সেবন করান। যেহেতু জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষগুলির অরণ্যের গাছপালা থেকে ঔষধ তৈরির এক ক্ষমতা আছে, প্রায় সব ওঝাই এই ক্ষমতা রাখেন। কারণ তাঁদের সমাজে ওঝাই চিকিৎসক এবং যেহেতু এই সমাজে অরণ্যজাত ঔষধির প্রয়োগ ও গ্রহণ বেশি, তাই একজন ওঝার পক্ষে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে বলা যেতে পারে, বর্তমানে আমরা যাঁদের ‘কবিরাজ’ বলি, আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে ওঝার ভূমিকাও অনেকটাই তাই।

একজন সাঁওতাল ওঝা এবং একজন হিন্দু সমাজের ‘ওঝা’ পদবীধারী ব্যক্তিকে সমগোত্রীয় ভাবা ভুল। সাঁওতাল সমাজের একজন ওঝা সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও আরও কিছু জ্ঞানের অধিকারী যে জ্ঞান কেবলমাত্র তারাই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন তাঁদের গুরুর কাছে।

পাতা চিকিৎসা—
সাঁওতালদের ‘পাতা চিকিৎসা’ একটি অন্যতম চিকিৎসা যা হলো মৌখিক চিকিৎসা, পরম্পরাগতভাবে দেখে বা শুনে শিখে থাকেন। কী তার পদ্ধতি?

এটি যেহেতু মৌখিক চিকিৎসা, তাই লিখিত কোনও রূপ এর নেই। Rev, Bodding তাঁর অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন, সেটিই এখানে বিবৃত করছি। সাঁওতাল সমাজে ‘পাতা-চিকিৎসা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা যার দ্বারা ওঝা রোগের মূল কারণ নির্ধারণের চেষ্টা করেন।

পাতা-চিকিৎসায় একজন ওঝার প্রয়োজন হয় কয়েকটি পাতার, যেগুলি মূলত হয় শালপাতা। আমরা জানি, সাঁওতাল সমাজে শালগাছের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাঁরা শালপাতাই ব্যবহার করেন। পাতার সঙ্গে প্রয়োজন হয় সামান্য তেল ও জলের। এগুলি সরবরাহ করেন সেই গৃহী বা সেই ব্যক্তি যিনি ওঝাকে রোগ নির্ধারণের জন্য নিযুক্ত করেন। পাতা, জল ও তেল নিয়ে ওঝা সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসেন। এরপর ওঝা তাঁর মাথাটি একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে তেলের মধ্যে ডান হাতের তর্জনী ডুবিয়ে সেটি সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে ছিটিয়ে দেন। আবার একবার তর্জনীটি তেলের মধ্যে ডুবিয়ে তা ছিটিয়ে দেন ধরতী-মায়ের উদ্দেশ্যে। যদিও সাঁওতালদের মধ্যে এঁর পূজা খুব প্রচলিত নয় কিন্তু রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁরা এটি করেন।

দেবতার উদ্দেশ্যে তেল ছিটানো হয়ে গেলে ওঝা পাতা দুটিকে ভালো করে নিরীক্ষণ করেন, তারপর দুটি পাতারই যে শিরাগুলি আছে, তার মধ্যের অংশগুলি ছিঁড়ে ফেলেন এবং ওই ছেঁড়া পাতাগুলি মুড়ে একপাশে রেখে দেন। শালপাতার শিরাগুলি খুব শক্ত হয় এবং পাতার অংশগুলি ছিঁড়ে ফেলার পর সেগুলি দেখতে জালির মতো মনে হয়। পাতাদুটি মাটিতে রাখা হয় এবং ফাঁকা অংশগুলিতে ওঝা ফোঁটায় ফোঁটায় তেল ঢালেন এবং প্রতিটি রোগের কারণ ও নিরাময়ের উপায় ব্যাখ্যা করেন।
ওঝার মতে রোগের কারণগুলি চার রকমের হতে পারে।

ক) প্রাকৃতিক কারণ
খ) মনুষ্যজনিত কারণ
গ) বোঙ্গা বা আত্মা দ্বারা সৃষ্ট কারণ
ঘ) পূর্বপুরুষ দ্বারা ঘটিত কারণ

প্রাকৃতিক কারণ বলতে সাধারণতঃ কোনও মহামারী ইত্যাদি বোঝান।

মনুষ্যজনিত কারণ হলো ডাইনী দ্বারা কোনও রোগের উৎপত্তি। সাঁওতাল সমাজে ডাইনীর প্রভাব খুব বেশি এবং মনে করা হয় নারীদের মধ্যেই এই ডাইনীদের বসবাস এমনকি প্রত্যেক নারীর মধ্যে ডাইনী বাস করে এমন ভাবনাও তাঁদের আছে। রোগীর গৃহে কোনও নারী, তার পিতার গৃহে কোনও নারী, পরিবারের বিভিন্ন নারীর মধ্যে এমনকি গ্রামের অন্য কোনও পরিবারের নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ডাইনী দ্বারাও এই রোগের সৃষ্ট হতে পারে বলে তারা মনে করেন।

বোঙ্গা অর্থাৎ আত্মার বিষয়টি খানিক আলাদা। প্রথমতঃ ওঝা মনে করেন এটি পারিবারিক কোনও আত্মার অশুভ প্রভাবের ফলে রোগের সৃষ্টি। রোগী বিবাহিত হলে তাঁর স্ত্রীর পিতার অশুভ আত্মার প্রভাবেও রোগের সৃষ্টি হতে পারে। আবার অনেক সময় ‘সীমা বোঙ্গা’ বা গৃহের সীমানার বাইরে অবস্থিত বোঙ্গা বা আত্মার দ্বারা অশুভ প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। এইভাবে সমস্ত কারণ একটি একটি করে পাতার শিরার ফাঁকে ফাঁকে তেল ঢালতে ঢালতে তিনি একটি একটি বোঙ্গা বা আত্মার নামে কিছু মনে মনে বিড়বিড় করে মন্ত্র বা ওইজাতীয় কিছু উচ্চারণ করতে থাকেন। সঙ্গে ওই জায়গাগুলিতে তেলের সাহায্যে কিছু ছবিও আঁকেন। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, প্রতিটি চিহ্ন বা ছবি কিন্তু আলাদা।

আবার কখনও জোরে জোরে শিরার ফাঁকে আঙ্গুল দিয়ে তেল ও প্রতিকৃতি আঁকার সময় কিছু মন্ত্রও বলেন, যা অনেকটা এইরকম—
‘তেল তেল, রাই তেল, মন তেল, কুসুম তেল, কড়চার তেল, ভেরান্ডার তেল, রাই রুই তেল, আই তেল, পোড়াতে কি উঠ? ডান উঠ, ভুত উঠ, যুগিন উঠ, বিষ উঠ, কে পোড়ে, গুরু পোড়ে, গুরু গিয়া মা পোড়ে, পোড়া হাসে কাহরি গিয়া, কামরু গুরু দোহারে, দোহাই পোড় হে...’

এই মন্ত্র পড়ার পর সেই পাতার উপরে জোরে জোরে ফুঁ দেন ওঝা। তারপর দুটি পাতা একটির উপর আর একটি রেখে ঘষতে থাকেন। পাতা ঘষারও মন্ত্র আছে। সেটি এইরকম—
‘পাত, পাত, শাল পাত, চিহুর পাত (অন্য এক ধরনের পাতা), ভেলার পাত, কি কি উঠে, ডান উঠে, যুগিন উঠে, ধর কার উঠে, দেবতা উঠে, কে দেখে? গুরু দেখে, দেখ সে উঠাস্‌!’

মন্ত্র শেষ হওয়ার পর পাতাগুলিকে মাটিতে রেখে দেন। হাওয়ায় যাতে উড়ে যেতে না পারে, সেজন্য পাতার উপর অল্প একটু মাটি কিংবা ছোটো মাটির ঢেলা চাপা দিয়ে রাখেন। তারপর পাতা দুটিকে নমস্কার করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে পাতা দুটির মধ্যে কী ধরনের তেলের ছবি ফুটে উঠেছে ও সেই ছবির দ্বারা কোন রোগ নির্ণয় করা গেছে তার ব্যাখ্যা করেন।

পাতা চিকিৎসার এই পদ্ধতি হলো রোগ নির্ণয়। এবং সেই অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলতে থাকে।

যে কথাটি বলার, ওঝাদের এই চিকিৎসাকে তুকতাক, মন্ত্রগুপ্তি, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির সঙ্গে মিলিত কিছু বলা যেতেই পারে। সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম্য মানুষগুলিকে একরকমের ঠকানোও হয়তো। যদিও না জেনে কিছু বলা সমীচীন নয়, তবু এই ধরনের চিকিৎসায় জটিল কোনও রোগ সারানো সম্ভব বলে মনে হয় না। আশার কথা, বর্তমানে সমাজের উন্নতির ফলে, মানুষ শহরে ডাক্তারের কাছে যেতে শুরু করেছেন এবং গ্রামেও ডাক্তারের আগমনের ফলে তাঁরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন।

আর একটি কথা না বললে হয়তো সব কথা বলা হবে না। ওঝাদের এই যে প্রতিটি নারীর মধ্যে ডাইনী বাস করা, কিংবা কোনও বিবাহিত পুরুষ অসুস্থ হলে তাঁর শ্বশুরবাড়ির কোনও নারীর আত্মা এই রোগের কারণ, এমনকি ভিন্ন পরিবারের কোনও নারীর আত্মার অশুভ প্রভাব ব্যক্তিটির রোগের কারণ এবং একজন নারীই যে তার কারণ— এটি বুঝি সেই পুরাতন নারী সম্পর্কিত ধারণা থেকেই এই রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি জন্ম নিয়েছে। আধুনিক সমাজে এই ব্যাখ্যা একেবারেই অচল। যদিও সাঁওতালদের এই রোগ-নির্ণয়, ওঝাদের চিকিৎসা পদ্ধতিও এখনকার সময় থেকে কিছু আগে যা Rev. Bodding তাঁর বইতে লিখে গেছেন।

আশা করবো, সাঁওতাল সমাজে ওঝাদের রোগ-নির্ণয় পদ্ধতির কিছু উন্নতি ঘটেছে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in


২]

মনুসংহিতায় জাতিভেদঃ


মনুসংহিতা কখনওই শূদ্রদের মানুষের মর্যাদা দেয়নি। চারবর্ণের উৎপত্তি দেখুন।

“লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং চরণ থেকে শূদ্র সৃষ্টি করলেন।” (১/৩১)

মনু বলছেন— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য— এই তিন বর্ণ হলো দ্বিজ, কারণ এদের পৈতে উপবীত হয়ে দ্বিতীয় জন্ম হয়। চতুর্থ বর্ণ শূদ্রের একই জন্ম (দ্বিজত্ব নেই); কোনও পঞ্চম বর্ণ নেই(১০/৪)।

ব্রাহ্মণের কাজ বিদ্যাচর্চা, অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ।
ক্ষত্রিয়ের লোকরক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ইত্যাদি।
বৈশ্যের কাজ পশুপালন, কৃষি, সুদে টাকা খাটানো, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন।
শূদ্রের একটি মাত্র কাজ— বাকি তিনবর্ণের সেবা। (১/৮৮ থেকে ৯১)।

আবার মুখ বা উত্তমাঙ্গ থেকে উৎপন্ন এবং বেদজ্ঞাতা বলে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ। (১/৯৩)
সৃষ্টির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বলে ১/৯৪ থেকে ১/১০৩ পর্য্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে।

এবার জন্মের পর সন্তানের নামকরণ দেখুন।

ব্রাহ্মণের নাম হবে শুভসূচক, ক্ষত্রিয়ের বলবাচক, বৈশ্যের ধনবাচক, এবং শূদ্রের নাম নিন্দাবাচক হবে। এই চারবর্ণের উপনাম হবে যথাক্রমে শর্ম, বর্ম, ভূতি ও দাস। (যেমন শুভশর্মা, বলবর্মা, বসুভূতি এবং দীনদাস প্রভৃতি)। (২/৩১ এবং ৩২)।

আজীবিকা এবং দৈনন্দিন জীবনে শূদ্রঃ দাসত্ব

শূদ্র ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যেই ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। প্রভু কর্তৃক অন্য দাসেরা মুক্ত হলেও শূদ্র দাসত্ব থেকে মুক্ত হয় না। দাসত্ব তার স্বভাবে রয়েছে (৮/৪১৩, ৪১৪)।

উচ্চ তিন বর্ণের উপনয়ন হয়ে দ্বিজ বা দ্বিতীয় জন্ম হয়। শূদ্রের উপনয়নে অধিকার নেই, সে বেদপাঠের অধিকারী নয়। দ্বিজের মতো উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদন্ড বিধেয় (৯/২২৪)।

ব্রাহ্মণের তপস্যা হল জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের তপস্যা রক্ষা করা, বৈশ্যের তপস্যা কৃষি এবং গো-পালন, শূদ্রের তপস্যা দ্বিজগণের সেবা করা (১১/২৩৫)।

কোন প্রকার সংস্কারে শূদ্রকে অধিকার দেওয়া হয়নি (১০/১২৬)। বর্ণত্রয়ের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবাই শূদ্রের একমাত্র বৃত্তি। প্রভুর ফেলে দেয়া ছেঁড়া কাপড়, ছাতা, খড়ম ও তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে। প্রভুর খাওয়া হয়ে গেলে পড়ে থাকা এঁটো খাবার তার ভক্ষ্য বা খাদ্য। (১০/১২৩,১২৫)

যজ্ঞে পাওয়া জিনিষপত্র ব্রাহ্মণ কখনও শূদ্রকে দেবেন না (৪/৮০)। (পাওয়া জিনিষপত্র)

শূদ্রের নিষিদ্ধদ্রব্য খাওয়ায় পাপ নেই, সে উপনয়নাদি সংস্কারের যোগ্য নয়, ধর্মে তার অধিকার নেই। (১০/১২৬)।

দাসবৃত্তি থেকে শূদ্রের কোনও প্রকার মুক্তি নেই। “ন স্বামিনা নিসৃষ্টোঅপি শূদ্রোদাসাদ বিমুচ্যতে” (মেধাতিথির ভাষ্য)।

মনু বলছেন যে শূদ্র সক্ষম হলেও ধনসঞ্চয় করবে না। কারণ শূদ্র ধনলাভ করলে গর্ববশে ব্রাহ্মণকে পীড়া দিতে পারে (১০/১২৯)। ব্রাহ্মণ কখনও শূদ্ররাজার রাজ্যে বাস করবেন না (৪/৬১)।

যে পথ দিয়ে উচ্চবর্ণের লোকেরা যাতায়াত করেন, সেই পথে শূদ্রের মৃতদেহ বহন করা চলবে না (৫/৯২)।

বিবাহ সম্বন্ধে মনুর বক্তব্য নিজের নিজের জাতে বিয়ে করাই ভাল, নইলে সন্তান বর্ণসংকর (বাস্টার্ড) হয়। তবে অনুলোম বিবাহ, অর্থাৎ যদি পিতা উচ্চবর্ণের মাতা নিম্নবর্ণের হয় তাহলে সিদ্ধ। তাতে সন্তানের জাত মায়ের থেকে উচ্চ কিন্তু পিতার থেকে নিম্ন হবে। সে পিতার ভাল গুণ পাবে। কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ— মাতা উচ্চবর্ণের, পিতা নিম্নবর্ণের— অসিদ্ধ। এদের সন্তানের স্থান পিতার থেকে নিচে, এরা পিতার নীচ গুণ পাবে। যেমন শূদ্র ব্রাহ্মণীকে বিয়ে করলে সন্তান ‘নরাধম চন্ডাল’ হবে (১০/১৬)।

এদেরই মনু আসল বর্ণসংকর মনে করতেন এবং বলতেন এটা বাড়লে রাজ্য ও সমাজ রসাতলে যাবে। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্রনারীর গর্ভে জাত সন্তান ‘আর্য’ হয়, কিন্তু শূদ্র থেকে ব্রাহ্মণীতে উৎপন্ন সন্তান ‘নিকৃষ্ট’ হয় (১০/৬৭)।

সুলেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আত্মজীবনীমূলক “ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন” বইটি পাঠককুলে সমাদৃত। কিন্তু চন্ডালদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার মনুর বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, দেখুন মনু কী বলছেনঃ

চন্ডালদের আশ্রয় গ্রামের বাইরে। এদের ধন বলতে কুকুর ও গাধা। এদের জলপাত্র দিতে নেই। এদের খাবার দিতে হবে চাকরের হাত দিয়ে ভাঙা বাসনে। এরা পরবে শ্মশানের মড়ার কাপড়, লোহার গয়না, বইবে অনাথ শব, কিন্তু রাত্তিরে গ্রামনগরে ঘুরে বেড়ানো মানা। রাজাদেশে দন্ডিত ব্যক্তিদের বধ করা এদের কাজ— মানে আজকালকার জেলের ফাঁসুড়ে। (১০/৫১ –৫৬)।

পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে মনু বলছেন— দ্বিজ তিনবর্ণের পুরুষ চারজাতের নারীকেই বিয়ে করতে পারেন। উত্তরাধিকারে সমস্ত সম্পত্তির দশভাগ করে ব্রাহ্মণীর পুত্র চারভাগ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিন, বৈশ্যের পুত্র দুই এবং শূদ্রার পুত্র একভাগ পাবে। যদি শূদ্রা ছাড়া অন্য স্ত্রীদের একটিও সন্তান না থাকে তবুও সেই সন্তান দশভাগের একভাগই পাবে, বেশি নয়। (৯/১৫৩, ১৫৪)। উচ্চ তিন দ্বিজ জাতির পিতার শূদ্রা স্ত্রীর-পুত্রের সম্পত্তির অধিকার নেই, পিতা নিজের ইচ্ছেয় যা দেবে তাই (৯/১৫৫) অর্থাৎ ওই দশভাগের একভাগও আসলে শূদ্র-স্ত্রীর সন্তানের অধিকার নয়, লোকব্যবহার এবং আপার লিমিট মাত্র!

এবার জাতিভেদে অপরাধের শাস্তিঃ

ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণ নারীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গের অপরাধে মনু শূদ্রের মৃত্যুদন্ডের বিধান দিয়েছেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের ‘অরক্ষিত’ ভার্যার সঙ্গে সহবাসে ‘লিঙ্গচ্ছেদ’ বিধান (৮/৩৭৪)।

কিন্তু শূদ্রানারীর সঙ্গে অনুরূপ সংযোগের অপরাধে ব্রাহ্মণকে কিছু জরিমানা দিলেই চলবে (৮/৩৮৫)।

যে অপরাধে অন্য বর্ণের প্রাণদন্ড বিধেয়, সেখানে ব্রাহ্মণের মাথা মুড়িয়ে দিলেই হবে (৮/৩৭৯)।

ব্রাহ্মণের নিন্দা করলে শূদ্রের জিহ্বা ছেদন বিধেয় (৮/২৭০); কিন্তু শূদ্রের প্রতি ব্রাহ্মণ অনুরূপ ব্যবহার করলে সামান্য জরিমানা (৮/২৬৮)।

ব্রাহ্মণকে চোর বলে গাল দিলে ক্ষত্রিয়ের সামান্য অর্থদন্ড, বৈশ্যের দেড়শ’ বা দু’শ পণ অর্থদন্ড, কিন্তু শূদ্রকে বধ করা হবে (৮/২৬৭)।

শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের গায়ে হাত তোলে তাহলে তার হাত কেটে ফেলা হবে, পদাঘাত করলে পা (৮/২৮০)। ব্রাহ্মণের সঙ্গে সমান আসনে বসলে তার কোমরে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে নির্বাসিত করা হবে, অথবা তার নিতম্ব এমন ভাবে কাটা হবে যেন তার মৃত্যু না হয় (৮/২৮১)। ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু দিলে শূদ্রের ঠোঁট কেটে ফেলা হবে। গায়ে মলমূত্র ফেললে তার লিঙ্গ কাটা হবে এবং বাতকর্ম করলে তার গুহ্যদ্বার চিরে দেওয়া হবে(৮/২৬২)।

শূদ্র তিন দ্বিজজাতিকে জাত তুলে গাল দিলে শাস্তি হবে তার মুখে দশ— আঙুল মাপের জ্বলন্ত লোহার শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া (৮/২৭১)।

আর শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে জ্ঞান বা ধর্মোপদেশ দেয় তাহলে রাজার নির্দেশে তার মুখে ও কানে গরম তেল ঢালা হবে(৮/২৭২)।

ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রহত্যা ‘উপপাতক’ মাত্র (১১/৬৬), অর্থাৎ সামান্য পাপ যা গোসাপ, প্যাঁচা, বেজি, ব্যাঙ, বিড়াল, কুকুর বা কাক বধের তুল্য (১১/১৩১)। কিন্তু শূদ্র ব্রহ্মহত্যা করলে মৃত্যু বিধেয়।

ব্রাহ্মণের ‘রক্ষিতা স্ত্রী’র সঙ্গে সঙ্গমে অন্য বর্ণের শুধু অর্থদন্ড হবে, কিন্তু শূদ্র এই অপরাধ করলে তার সর্বস্বহরণ করে মৃত্যুদন্ড বিধেয়। যদি ব্রাহ্মণ ভার্যা ‘অরক্ষিতা’ হন, তাহলে সেই নারী সঙ্গমকারী শূদ্রের খালি লিঙ্গচ্ছেদ হবে। (৮/৩৭৪)

বিচারালয়ে শপথ নেওয়ার সময় শূদ্রকে বলতে হবে যে মিথ্যা বললে সে সকল পাপের ভাগী হবে। এটা অন্য তিন বর্ণের প্রতি প্রযোজ্য নয় (৮/১১৩)। শূদ্রকে আদালতে স্ত্রী এবং সন্তানের মাথায় হাত রেখে দিব্যি গালতে হবে। এছাড়াও আছে জ্বলন্ত কয়লার উপর হাঁটানো বা জলে ডুবিয়ে রাখা। এ দুটো থেকেও যদি না পুড়ে এবং না ডুবে ভেসে ওঠে তাহলে বুঝতে হবে যে শূদ্র সত্য কথা বলছে (৮/১১৪ এবং ১১৫)।

ব্রাহ্মণের বিশিষ্ট স্থান

মহাপাতকের ক্ষেত্রে মনু শারীরিক দন্ডবিধানের দশটি স্থান নির্দেশ করেছেন। কিন্তু সেটা ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য তিন বর্ণের জন্যে প্রযোজ্য। ব্রাহ্মণ অক্ষত দেহে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন। তাঁকে অর্থদন্ড দিতে হবে না। অন্য তিনবর্ণকে দোষের হিসেবে নির্বাসিত হওয়ার আগে আর্থিক এবং শারীরিক দন্ড ভোগ করতে হবে(৮/১২৩, ১২৪)।

ব্রাহ্মণের মৃত্যুদন্ড হলে শুধু মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্য তিনবর্ণের ক্ষেত্রে শাস্তিটি প্রাণঘাতী হবে। সকল অপরাধে অপরাধী হলেও রাজা ব্রাহ্মণকে কখনও হত্যা করবেন না। তাঁকে স তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ সহ অক্ষত দেহে শুধু রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করবেন। পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধ অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম নেই। সুতরাং, রাজা তার বধ চিন্তাই করবেন না (৮/৩৭৯, ৩৮০, ৩৮১)।

ব্রাহ্মণ শূদ্রহত্যা করলে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ অন্য কোন ব্রাহ্মণকে একটি বৃষ ও দশটি শুক্লবর্ণ গাভী দান করবেন। বেড়াল, নেউল, চাতকপাখী, ব্যাঙ, কুকুর, গোসাপ, প্যাঁচা বা কাক মেরে শূদ্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করবেন (১১/১৩০, ১৩১)।

জাতিকর্ম কি গুণদোষের ভিত্তিতে শ্রম বিভাজন, না জন্মজাত বৃত্তি?
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেনঃ চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ। 3

গুণ ও কর্মের হিসেবে আমি চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি।

মনু বলছেনঃ নিজধর্ম বা নিজের জাতের যা জন্মসূত্রে নির্ধারিত কাজ তা’ ঠিকমত করতে না পারলেও ভাল, কিন্তু পরের ধর্ম সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলেও ভাল নয়, অপরের ধর্মানুসারে জীবনধারণ করলে মানুষ তৎক্ষণাৎ জাতিভ্রষ্ট হয় (১০/৯৭)।

খেয়াল করুন, ভগবদগীতাতেও ঠিক এটাই বলা হয়েছে।

“শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎস্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্মো ভয়াবহঃ।। 4

---------------------
3 ভগবদগীতা, ৪/১৩।
4 ভগবদগীতা, ৩/৩৫।

অর্থাৎ কোনও ব্যক্তির জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জাতিধর্ম যদি নিকৃষ্টও হয়, তবু অন্য জাতির উন্নত ধর্ম পালনের চেয়ে নিজের জাতিধর্ম পালনে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়।

এখানে ধর্ম মানে অবশ্যই ধর্মশাস্ত্র (মনু, পরাশর, গৌতম, আদি স্মৃতিশাস্ত্র) অনুযায়ী নির্দিষ্ট জাতিধর্ম। তখন ভারতবর্ষে অন্য কোনও ধর্ম ছিলো না।

যে অধম জাতির লোক উৎকৃষ্ট জাতির কর্মদ্বারা জীবনধারণ করে, রাজা তাকে নির্ধন করে শীঘ্র নির্বাসিত করবেন (১০/৯৬)। অর্থাৎ শূদ্র যদি শাস্ত্র পড়ে পুরুতগিরি বা টোলে পড়ায়, অথবা অস্ত্রবিদ্যা শিখে যুদ্ধ করে তাহলে রাজা তাকে দেশছাড়া করবেন।

ব্রাহ্মণের সেবাই শূদ্রের বিশিষ্ট কর্ম বলে কথিত হয়। এ ছাড়া সে যা করে তা নিষ্ফল হয় (১০/১২৩)।

এই প্রবন্ধটি লেখার সময় আমার জনৈক বন্ধু রবীন্দ্রনাথের “ব্রাহ্মণ” কবিতাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন— ব্যতিক্রমও ছিলো।

উক্ত কবিতাটির বহুপরিচিত কাহিনী অনুযায়ী মাতা ‘ভর্তৃহীনা জবালার’ গোত্রহীন পিতৃপরিচয়হীন পুত্র সত্যকাম যখন ঋষি গৌতমের কাছে অকপটে মায়ের ‘বহু-পরিচর্যার ফল’ হিসেবে নিজের জন্ম-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন তখন মহর্ষি গৌতম তাকে সত্যবাদিতার জন্যে ‘ব্রাহ্মণ’ বলে স্বীকার করে নেন। কারণ এমন সত্যভাষণ কেবল ব্রাহ্মণের পক্ষেই সম্ভব! এই “জাবাল সত্যকাম” পরে উপনিষদের ঋষির সম্মান লাভ করেন।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই “প্রাচীনত্ব বা ঐতিহ্যমুগ্ধতা”র মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি “আয়রণি”।

একই কাহিনীর সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্র কী বলছে দেখুনঃ

ব্রহ্মসূত্রের প্রথম খন্ডের তৃতীয় ভাগের নবম পরিচ্ছেদের বিষয় হলো শূদ্রের বেদপাঠে বা অন্য সংস্কারকর্মে অধিকার আছে কি নেই? তাতে তৈত্তিরীয় উপনিষদের শ্লোক (৭.১.১.৬) উদ্ধৃত করে বৈদান্তিক বলছেন “শূদ্র যজ্ঞের অধিকারী নয়”। সূত্র ৩৫ শে জানশ্রুতি ও রৈক্কের গল্প উল্লেখ করে বলা হচ্ছে জন্মসূত্রে যে শূদ্র, সে সংস্কারের অর্থাৎ শাস্ত্র অনুযায়ী দৈনন্দিন পূজোপাঠের এবং উপনয়নের অধিকারী নয়।

এবার ৩৭ নম্বর সূত্রের5 ব্যাখ্যায় ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্লোক (৪/৪/৫) উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে গৌতম জবালাপুত্র সত্যকামের ব্রাহ্মণজন্ম সম্বন্ধে নিসন্দিগ্ধ হয়ে তাকে শিষ্য বলে স্বীকার করে নিলেন। “কারণ কোন অব্রাহ্মণ এমন কঠিন সত্য উচ্চারণ করতে পারে না।” রবীন্দ্রনাথ তাই লিখলেন— “অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত, তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।”

একটা কথা; আজ দিল্লির উপকণ্ঠে লাখো কৃষক প্রায় দু’মাস ধরে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে ধর্নায় বসেছেন। এই কৃষি হলো বৈশ্যের কর্ম বা জাতিধর্ম। কিন্তু মনু কী বলছেনঃ

“কৃষিকে কেউ কেউ ভাল মনে করেন। কিন্তু ওই পেশাটির সম্বন্ধে ভদ্রজনের মুখ থেকে কোন ভাল কথা শোনা যায় না। কারণ, যে কাঠের মুখে লোহা আছে তা জমিকে, এবং জমিতে যে প্রাণী আছে তাদের নষ্ট করে।” (১০/৮৪)।

শূদ্রের পরিত্রাণ কিসে?

মনু বলছেনঃ বেদজ্ঞ গৃহস্থ কীর্তিমান ব্রাহ্মণদের সেবা শূদ্রের স্বর্গাদি শ্রেয় লাভজনক ধর্ম। এমন শূদ্র পরের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাতে পারেন। (৯/৩৩৪,৩৩৫)। অর্থাৎ শূদ্র ভাল কাজ করেও সোজা স্বর্গে যেতে পারবে না। তাকে আগে এই জন্মে পণ্ডিত ও গুণী ব্রাহ্মণের সেবা করে পরের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাতে হবে— তবে না।

বাদ সেধেছেন আর এক ব্রাহ্মণ রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘দুরাশা’ গল্পের নায়িকা এক মুসলমান নবাবপুত্রী। সে ব্রাহ্মণ হওয়ার চেষ্টায় সারাজীবন শাস্ত্র অধ্যয়নের পর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই উপলব্ধিতে পৌঁছায় যে ‘ব্রাহ্মণত্ব’ আসলে একটি অভ্যাস মাত্র। তাহলে পরিণাম?

‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে কোলে তুলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’। (রবীন্দ্রনাথ, “অপমানিত”)

জাতিভেদ ধরে রাখতে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখুনঃ

------------------------------------------------------------------------------
5 ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য অফ শ্রী শংকরাচার্য, অদ্বৈত আশ্রম, কলকাতা। ২০০৪। ( ১//৩/৯/৩৭)।


শূদ্র যে রাজার সভায় ধর্ম নিয়ে বিচার করে, তাঁর রাজ্য চোখের সামনে কাদায় বসে যাওয়া গরুর মত অবসন্ন হয়। যদি রাজ্যে শূদ্রের ও নাস্তিকের সংখ্যা খুব বেড়ে ব্রাহ্মণ গায়েব হয়ে যায়, তাহলে গোটা রাজ্যটাই দুর্ভিক্ষ ও রোগে শীঘ্র বিনষ্ট হয়। (৮/২১,২২)।লিস্টি আর লম্বা করতে চাই না। কিন্তু আজ যখন খোদ আমেরিকাতে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনে মার্কিন রাষ্ট্রের কিছু ইতিহাস পুরুষের স্ট্যাচু নিয়ে নতুন করে মূল্যায়নের প্রশ্ন উঠেছে তখন আধুনিক রিপাব্লিক ভারতে মনুর মূর্তি স্থাপন করার আগে একটু চিন্তা করলে হয় না? আমাদের সংবিধানে যে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান! কিন্তু যেভাবে এক যোগীর রাজত্বে দলিত নারীরা ধর্ষিত ও নৃশংসভাবে নিহত হচ্ছে, চারদিকে ঘৃণার বিষবাষ্প, তখন বোধহয় আমাদের সবার আগে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলা উচিত— “ক্ষমা করো”। পারবো কি?

0 comments:

1

বিশেষ ক্রোড়পত্র - গৌতম ঘোষ

Posted in
















গৌতম ঘোষ ক্রোড়পত্র – সম্পাদকীয়

গৌতম ঘোষ ক’জন? সত্তরের রাজনীতি সচেতন যুবক যিনি ‘হাংরি অটাম’ নামক আলোড়ন-সৃষ্টিকারী তথ্যচিত্রের নির্মাতা, যা তাঁকে শুরুতেই এনে দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মান নাকি ‘মা ভূমি’, ‘দখল’ থেকে ‘অন্তর্জলিযাত্রা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পাড়’ হয়ে সাম্প্রতিকতম ‘রাহ্‌গির’ পর্যন্ত বর্নিল এই যাত্রাপথে আমরা আবিষ্কার করি আশ্চর্য অনুভূতিপ্রবণ যে শিল্পী মন, যাঁর মূল প্রকাশ মাধ্যম চলচ্চিত্র হলেও অনায়াস আনাগোনা তাঁর একাধিক সৃজনশীল ক্ষেত্রে? আর বহুমাত্রিক এই শিল্পীকে পরিচালনার বাইরে আমরা কখনও খুঁজে পাই ব্যতিক্রমী কোনও চরিত্রাভিনয়ের মুনশিয়ানায়, ছবিতে সঙ্গীতের অসামান্য প্রয়োগ বা কখনও ‘দখল’ ছবির শেষ দৃশ্যে ঝড়ের প্রাবল্যে বালির সরে যাওয়ার সঙ্গে এক মনুষ্যগোষ্ঠীর স্থানান্তরকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়ার দক্ষতার মধ্যে, যা একান্তই সর্বোচ্চ মানের এক ফটোগ্রাফারেরই নিজস্ব সম্পদ। গৌতম ঘোষের ব্যাক্তিমানসের সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠ, তাঁরা জানবেন ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব তাঁর ভালোবাসার বিচরণক্ষেত্র। প্রত্যেকবার তিনি যখন ক্যামেরা হাতে তুলে নেন, বিষয় দুটির ভরকেন্দ্র তাঁকে ছুঁয়ে থাকে পরম মমতায়। তাঁর পরিচালিত প্রতিটি ছবি শেষ পর্যন্ত পরিচালিত হয় এক বিশেষ ধরনের মুল্যবোধ দ্বারা।

সম্প্রতি গৌতম ঘোষ পূর্ণ করলেন সত্তরতম জন্মবর্ষ! তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য এবারের ক্রোড়পত্রে।



সূচিপত্র

১) ‘গৌতম ঘোষ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা’ - মমতা শঙ্কর

২) অভিযাত্রিক এক চলচ্চিত্রকার-গৌতম ঘোষ— শৈবাল মিত্র

৩) গৌতম ঘোষ— সৌন্দর্যের সঙ্গে সৌন্দর্য বিরোধিতার এক আশ্চর্য সমন্বয়— সুমন মুখোপাধ্যায়

৪) Creative Ideas - Impactful Execution— S V Raman

৫) গৌতম সমগ্রের খোঁজে— অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

৬) ‘পদ্মানদীর মাঝি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছিল’— চম্পা

৭) Goutom Ghose - A birthday tribute— নন্দিতা পুরি (লেখক এবং ওম পুরি ফাউন্ডেশনের প্রধান)

৮) গৌতম ঘোষ— ফিরে দেখা— নীলাঞ্জনা ঘোষ

********************


‘গৌতম ঘোষ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা’ 
মমতা শঙ্কর

বছরটা ১৯৮১, আমার কাছে একটি ছবির প্রস্তাব এল, ছবির নাম ‘দখল’। পরিচালক গৌতম ঘোষ। তখন গৌতম ঘোষ কে, সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই ছিলো না। পেলাম মৃণালদা মানে মৃণাল সেনের কাছে, যাঁর ছবি ‘মৃগয়া’ দিয়ে আমার ছবির জগতে আসা। তাই ছবি করার কোনও প্রস্তাব এলেই আমি মৃণালদার সঙ্গে একবার আলোচনা করে নিতাম। মৃণালদা গৌতমদার নাম শুনেই বললেন, “ও গৌতম! খুব বুদ্ধিমান ছেলে। ক্যামেরাটাও খুব ভালো বোঝে। ওর ছবি তুমি অবশ্যই করতে পারো।” আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমি সাধারণতঃ স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় খুব মন দিয়ে শুনি। কিন্তু গৌতমদা যখন পড়ছিলেন; ওনার লেখা লাইনগুলোর থেকেও উনি কীভাবে বলছেন সেটা আমি দেখছি আর তখন ভাবছি, উনি ডিরেক্টর হিসেবে কীরকম আমি জানি না তবে উনি যদি অভিনয় করেন তবে দুর্দান্ত অভিনেতা হতে পারেন।

এরপর শ্যুটিং-এ যাওয়ার দিন এসে গেলো। গাড়ি এল আমাকে নিতে এবং গাড়ির ডিকিতে মালপত্র রাখতে গিয়ে দেখলাম ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম রাখা। ভাবলাম স্ক্রিপ্টে গান-বাজনার কোনও সিন আছে বলে তো শুনিনি। যিনি আমাকে নিতে এসেছিলেন তাকে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, “গৌতমের শ্যুটিং-এ অবসর সময়ে আমাদের গানবাজনা করতে হবে না?” এতে গৌতমদার চরিত্রের আরেকটি দিক আমার কাছে ধরা পড়লো।

এরপর গৌতমদাকে দেখেছি কাজের সময়, তখন গৌতমদা পুরো অন্য মানুষ। কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না; কাজের প্রতি এত প্যাশন খুব কম লোকের মধ্যে দেখেছি। গৌতমদার ছবি দেখলেই বোঝা যায় তার পেছনে কতটা পরিশ্রম রয়েছে এবং সেই পরিশ্রমটা আমাদের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। *

তবে এটাও বুঝেছি গৌতমদা খুব আরামে ছবি করার মানুষ নন। এবং এর জন্য দখলের সময় আমাদের মধ্যে মতবিরোধও ঘটে।

একটা ঘটনার কথা বলি। ছবিটার শেষদিকে একটা দৃশ্য আছে সেখানে আগুন জ্বলছে আর গোয়ালঘরের দরজার আগলটা আমায় খুলে দিতে হবে। আমার মনে হলো ব্যাপারটা সাংঘাতিক ঝুঁকির। আমি সেকথা গৌতমদাকে বলেও ফেললাম। কিন্তু গৌতমদা কিছুতেই শুনতে রাজি নন। আমার যদিও ভয়ডর তেমন নেই, কিন্তু এক্ষেত্রে মনে হলো; গরু তো আগুন দেখলে ভয় পায়। আমি দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে গরুগুলো যদি পাগলের মতো বেড়িয়ে আসে আমি তো চাপা পড়ে যাব। এই নিয়ে মতবিরোধ-মনোমালিন্য এবং কথা বন্ধ। শ্যুটিং-এর শেষে বাপীদা (চন্দ্রোদয়) আমাকে আনতে যান। কথা বন্ধের ফলে, ফেরার পথে গাড়িতে বাপীদা আর গৌতমদার মধ্যে কথা হচ্ছে কিন্তু আমাদের মধ্যে কথা নেই। তারপরেও অনেকদিন কেটে গেছে। আমি বোধহয় নিউ থিয়েটার্স বা টেকনিশিয়ানস্‌- স্টুডিওতে অন্য ছবির শ্যুটিং-এর অবসরে বসে আছি; হঠাৎ পেছন থেকে গৌতমদা এসে বললেন, “কি রে পাগলী, রাগ কমেছে?” এই হচ্ছেন গৌতমদা। আর এরপরে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যে পারিবারিক বন্ধুত্ব তৈরি হলো, তা আজও অটুট।

মনে পরে, আমরা সবাই মিলে একবার শান্তিনিকেতনের ওদিকে বেড়াতে গেছি, সেখানে একদিন রাত্রে আড্ডায় দুই দল— একদিকে গৌতমদা ও বাপীদা; অন্যদিকে খুকু আর আমি। তর্কের বিষয় নারীবাদ। বাপীদা বেগতিক দেখে কেটে পড়লেন এবং ঘুমিয়েও পড়লেন। বেচারি গৌতমদা একা আমাদের মধ্যে পরে পালিয়ে বাঁচেন আর কি। আরেকবার আড্ডা দিতে দিতে রাত কত গড়িয়েছে কারুর খেয়াল নেই।

খুকু আগে বাড়ি চলে গিয়েছিলো এবং গৌতমদাকে শেষমেশ মেন গেট টপকে বেরোতে হয়েছিলো। আজকের মতো মোবাইলের যুগ হলে এটার একটা ভিডিও করে রাখা যেত যে রাত ৩টে/ সাড়ে তিনটের সময় গৌতম ঘোষ মেন গেট টপকে রাস্তায় বেরোচ্ছেন।

মা গৌতমদাকে খুব স্নেহ করতেন এবং মাঝেমাঝেই বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে পুরনো স্মৃতির ঝুলি খুলে বসতেন এবং গৌতমদার উদ্যোগেই, আমার মায়ের চোদ্দ বছর বয়সে লেখা “সাত সাগরের পাড়ে” বইটি আবার নতুন করে ছেপে বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর জন্য গৌতমদার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।

গৌতমদা যে কি মাপের পরিচালক সেটা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে গৌতমদার ‘রাহগীর’ ছবিটি, যেটি এখনও বহু মানুষের দেখার সুযোগ হয়নি, সেই ছবিটি— আমাকে যে কি ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। সেটি বোধ হয় গৌতমদার মানবিক দিকের আরেকটি নিদর্শন এবং এই ছবিটি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম।

গৌতমদার বিষয়ে অনেকক্ষণ খুব ভালো ভালো কথা বলেছি; এবার একটু নিজেকে কৃতিত্ব না দিয়ে পারছি না। সেটা হলো প্রথমবার গৌতমদাকে সিনেমায় অভিনয় করানোর কৃতিত্ব। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তখন ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিটি করবেন। অঞ্জন দত্ত একটি চরিত্র করছেন, অন্য চরিত্রটি যার করার কথা ছিলো, তিনি শেষ মুহূর্তে কোনও কারণে করতে পারলেন না। তখন তো বুদ্ধদেবদার মাথায় হাত এবং যখন উনি আমায় একথা বললেন, আমার হঠাৎ ‘দখল’-এর স্ক্রিপ্ট শোনার সময় গৌতমদার চেহারাটা চোখে ভেসে উঠলো; এবং আমি বুদ্ধদেবদাকে বললাম, “আপনি গৌতমদা মানে গৌতম ঘোষকে বলে দেখুন।”

এবার বুদ্ধদেবদা ও আমার গৌতমদাকে রাজি করানোর পালা। গৌতমদা প্রথমে একটু দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন কিন্তু পরে আমাদের জোরাজুরিতে রাজি হয়ে যান।

তার ফল যে কি হয়েছিলো, যারা ‘গৃহযুদ্ধ’ দেখেছেন সবাই জানেন। গৌতমদার এই নতুন রূপ প্রত্যেকের মনে অসম্ভব গভীর দাগ কেটে দিয়েছিলো।

এখন আমরা একটা অদ্ভূত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। পেছনের দিকে তাকালে মনে হয় আগে আমরা অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলাম। গৌতমদা খুকু তাদের সিনেমা ও নানান কাজ নিয়ে; আমি আমার সিনেমা, আমি ও বাপীদা আমাদের নাচের দল নিয়ে দেশে-বিদেশে শো করে বেড়াচ্ছি; কিন্তু তাও যেন আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যেকের জন্য সময় ছিলো। কিন্তু এখন এই যান্ত্রিক যুগে সবকিছু হয়তো আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। কিন্তু আমরা মানুষরা মানুষের থেকে অনেক দূরে সরে গেছি।

তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, মনের টান এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যেখানে থাকে সেই সম্পর্ক কোনওদিনও নষ্ট হয় না। এবং সেরকমই আমার আর গৌতমদার সম্পর্ক।

গৌতমদা, তোমার জন্মদিনে আমার ও আমার পরিবারের প্রত্যেকের অসংখ্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তুমি সুস্থ থাকো এবং তোমার পরিবারের সব্বাইকে নিয়ে আনন্দে থাকো।

লেখক পরিচিতিঃ অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী।

********************


অভিযাত্রিক এক চলচ্চিত্রকার— গৌতম ঘোষ
শৈবাল মিত্র

গৌতম ঘোষের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা লিখতে বসে অনেক কথা মনে পড়ছে। কারণ, ‘সে তো আজকে নয়’...। সে ছিলো এমন এক সময় যখন ‘সিনেমা’ জীবিত ছিলো। আজ মৃত বা মৃতপ্রায় সিনেমা নামক শিল্পমাধ্যমটির নির্মাণ প্রক্রিয়ার গল্প হয়তো পাঠকের কাছে অলীক বলে মনে হতে পারে। তবে শুরু করার আগে কয়েকটি তথ্য পাঠকের সামনে রাখা জরুরি। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস একশো বছর পার হয়েছে। কিন্তু এই মাধ্যমটির মধ্যে শিল্পভাষার সন্ধান পেয়ে আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয় গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। এই বাংলায় যে তরুণদলটি সেই উদ্যোগের সামিল হন তাঁদের সবাইকে আমরা আজ চিনি। সে ছিলো ভারতীয় তথা বাংলার নব্য চলচ্চিত্র ধারার প্রথম তরঙ্গ বা ঢেউ ওঠার সময়। সে সময়কার তরুণদলের আড্ডাখানা ছিলো হয় হাজরা মোড়ের ‘কাফে’তে নয়তো সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউজের ‘হাউস অফ কমনস’-এ।

এরপর সাতের দশকের শেষ দিকে পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগে আরও এক তরঙ্গের উদয় হয়। যাঁদের আড্ডাখানা ছিলো কলকাতার হাজরা রোড সংলগ্ন গড়চা পাড়া। সেখানে বেশ কয়েকজন তরুণ নব্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের নেশায় মেতে উঠেছিলেন। এঁদের চূড়ামণি ছিলেন গৌতম ঘোষ। যিনি সেই প্রথম তরুণদলের পরবর্তী প্রজন্মের হয়ে বাংলা সিনেমার নবতরঙ্গের দ্বিতীয় ঢেউয়ের হাল ধরেছিলেন। তিনি যে কেবল নিজে ছবি করেছেন তাই নয়, অনেক চলচ্চিত্রকার তৈরিও করেছেন। ‘ছবি করো’, ‘ছবি করো’ যেন এক গুপ্তমন্ত্র, তিনি সমসাময়িক চলচ্চিত্র ব্রতীদের কানের কাছে বলেছেন বারবার। আজও হয়তো বলেন বলেই আমার বিশ্বাস।

তাই গৌতম ঘোষকে নিছক একজন চলচ্চিত্র পরিচালক বললে কিছুই বলা হয় না। তিনি হলেন বাংলা তথা ভারতের অধুনালুপ্ত ‘অতিয়ের’ সম্প্রদায়ভুক্ত একজন চলচ্চিত্রকার। ‘অতিয়ের’ এই ফরাসি শব্দটির বাংলা মানে করতে চাইলে লিখতে হয় ‘চলচ্চিত্র-লেখক’। আজকের বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র পরিচালকদের থেকে এঁরা সহস্র যোজন দূরের মানুষ, একজন শিল্পী। এঁদের ছবি বানানোর ধরনধারণ একেবারেই আলাদা। অন্যধারার ছবির ইউনিটে পরিচালক থেকে সমস্ত সদস্যদের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ নিজেদেরই করতে হতো। আজ ছবি বানানোর যে সব বিধি-বন্দোবস্ত দেখা যায়, সেসব তখন কিছুই ছিলো না। নানাবিধ ‘ভেনডর’ বা ‘সারভিস প্রোভাইডার’দের ভিড়ে সিনেমা ইউনিট ভারাক্রান্ত ছিলো না।


আমার সঙ্গে যে সময় গৌতমদার যোগাযোগ ঘটে সেটা ছিলো সাতের দশকের শেষ দিক। গৌতমদা ততদিনে ‘হাংরি অটম’ তথ্যচিত্রটি করে ফেলেছেন এবং তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র তেলেগু ভাষায় ‘মা ভূমি’ তৈরি করতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে তিনি, তাঁর স্ত্রী নীলাঞ্জনা (খুকুদি) ও ইউনিটের বাকি সদস্যরা কলকাতায় আসেন, কিছুদিন থাকার পর আবার ফিরে যান অন্ধ্রপ্রদেশের (আজকের তেলেঙ্গনা) লোকেশনে। সে ছবি বানানোর নানা কাহিনি তখন আমি শুনতাম আর মনে হতো এ যেন কোনও চলচ্চিত্র তৈরির কাহিনি নয়, এ সাক্ষাৎ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা সৈনিকদের কাহিনি। আশ্চর্য যেটা সেটা হলো, সে কাহিনি শুধুমাত্র কষ্টকর কোনও এক প্রয়াসের নয়। সেইসঙ্গে সে কাহিনি লড়াইয়ের, সংগ্রামের, বিরোধের, হতাশার। তেমনিই একটা সিনেমা তৈরি করতে পারার আনন্দেরও।

এটা নিশ্চয়ই সকলের জানা যে, সিনেমা তৈরি হয় একটি একটি করে ‘শট’ ক্যামেরা বন্দি করে। সেই একটি শটের জন্য প্রস্তুতি চলে একশো দিন ধরে। তার আয়োজনের ঘটা বিবিধ প্রকারের। মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর তিল তিল করে সেই আয়োজন করার পর কোনও একদিন, কোনও বিশেষ মুহূর্তে, সেই ‘একটি শট’ যখন সফলভাবে ক্যামেরা বন্দি করা সম্ভব হয়, তখন যে আনন্দ একজন চলচ্চিত্রকার ও তাঁর ইউনিটের সদস্যরা পান তা বাইরের কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়।

এই বিবিধ আয়োজন ও প্রতিটি শট একে একে ক্যামেরা বন্দি হওয়ার নিরন্তর লড়াইটাই হলো একজন চলচ্চিত্রকারের জীবন ও তার ভালোবাসা। আমার সৌভাগ্য খুব কাছ থেকে গৌতমদার সেই লড়াই আমি দেখেছি। চলচ্চিত্র নির্মাণের এই পরিসরে যখন একজন চলচ্চিত্রকার এসে দাঁড়ান, তখনই মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে তাঁর আসল পরিচয় আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। তিনি কতখানি সত্যিকারের চলচ্চিত্রকার আর কতখানি ছদ্ম তাঁর পরিচয় তা পরিষ্কার হয়ে যায়। গৌতম ঘোষ একজন পরিপূর্ণ চলচ্চিত্রকার। সিনেমা তৈরির প্রতিটি বিভাগের কাজ তাঁর করায়ত্ত। তাঁর চলচ্চিত্রের আঙ্গিক ও বিষয় তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাষার মধ্যে দিয়ে প্রতীয়মান।

চলচ্চিত্রকারের শিল্পীসত্ত্বা তাঁর ছবিগুলির মধ্যে দিয়ে যেমনভাবে প্রতিভাত হয় তার থেকে আলাদা একটি পরিচয় ফুটে ওঠে, সেই চলচ্চিত্রকারকে আমরা যখন দেখি তাঁর সৃষ্টির মুহূর্তগুলিতে। যখন তিনি তাঁর সৃষ্টিকে গড়ছেন, ভাঙছেন আবার গড়ে তুলছেন। এই ভাঙাগড়ার প্রতিটি মুহূর্তর মধ্যেই থেকে যাচ্ছে সেই চলচ্চিত্রকারের অন্য এক পরিচয় ফুটে ওঠে যা সাধারনত অজানা, অদেখা থেকে যায়। এ কথা বিশ্বের যে কোনও চলচ্চিত্রকারের ক্ষেত্রেই সত্যি।

গৌতম ঘোষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তেমনি কিছু মুহূর্তের সাক্ষী থাকার সুযোগ আমার হয়েছিলো। আমি বুঝেছিলাম গৌতমদার ছবি মানে রীতিমতো যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়া। তাঁর শ্যুটিং ফ্লোর যেন একটি যুদ্ধের প্রান্তর। তিনি তাঁর ছবির জন্য এমন কাহিনি নির্বাচন করতেন ও তার জন্য এমন লোকেশনের প্রয়োজন পড়তো যা তখনকার বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রেও দেখা যেত না। অথচ অভিযাত্রিক এই চলচ্চিত্রকার তাঁর সিনেমাকে বার বার নিয়ে গিয়েছেন শহুরে আরামদায়ক জীবনের গন্ডির বাইরে বিরাট জনসমাজের মাঝে। ফলে এমন দেখা গেছে তাঁর ছবির শ্যুটিংয়ের ধকল সহ্য করতে না পেরে কোনও টেকনিশিয়ন নিঃশব্দে লোকেশন ছেড়ে চম্পট দিয়েছে। আবার কেউ বা রাগে ফেটে পড়েছে। কেউ বা অসুস্থ হয়ে দিন কাটিয়েছে।

গৌতম ঘোষের ছবির লোকেশন মানে কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র, কখনও পদ্মার বিপুল মোহনা আবার কখনও গভীর অরণ্য। নিছক একজন ‘শহুরে চলচ্চিত্রকার’ এমন অপবাদ গৌতমদাকে কেউ কখনও দিতে পারবে না। তাঁর ছবি প্রমাণ করে তিনি অভিযাত্রিক চলচ্চিত্রকার। তিনি ‘মিথমেকার’। এই অভিযাত্রার যাবতীয় বন্দোবস্তর মূলে তিনি নিজেই প্রধান উদ্যোগকর্তা। কোনও পেশাদার প্রোডাকশন কোম্পানি তাদের কর্মীবৃন্দ নিয়ে গৌতমদার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, এমনটা আমি কখনও দেখিনি। নিজের ইউনিটের সদস্যদের এমনভাবে তিনি মাতিয়ে দিতে পারতেন যে হাজারও অসুবিধা থাকলেও ওইসব কঠিন স্থানে শ্যুটিং করা অনায়াসে হয়ে যেত।

মিথমেকারদের আমরা পেয়েছি হলিউডের চলচ্চিত্র দুনিয়ায়। তাঁদের সেই সাধ ও সাধ্য দুটোই ছিলো। কিন্তু গৌতমদার ছবি কখনওই খুব বিপুল বাজেটের ছিলো না। তিনি যে ছবির কল্পনা করেছেন তার নির্মাণ প্রক্রিয়াটির আয়োজনের বিপুলতাকে উৎরে গিয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর নিজের গভীর প্রত্যয় ও দুঃসাহসের জোরে। তিনি তাঁর সহকর্মীদেরও সেই প্রত্যয় ও দুঃসাহসের উপর ভর করতে শিখিয়েছেন। ফলে আমরা যারা তাঁর ছবির কলাকুশলী হিসেবে কাজ করেছি তারাও নিজেদের ক্ষমতার গন্ডিকে পেরিয়ে গিয়েছি কেবলমাত্র গৌতমদার ইচ্ছাশক্তির তাড়নায়। “পরিচালক যখন চেয়েছেন তখন তা হতেই হবে,” এমন একটা প্রতিজ্ঞা সেকালে টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলো। সিনেমায় কাজ করে অর্থবান হওয়ার ভাবনা তখন ছিলো না। যেটা ছিলো তা হলো, একটি ভালো ছবি তৈরি করতে পারার আনন্দ।

‘নিউ আর্থ’, ‘হাংরি অটাম’, ‘মা ভূমি’ ‘দখল’ থেকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ‘মনের মানুষ’ হয়ে ‘রহগীর’ অবধি তথ্য ও কাহিনিচিত্রগুলি মিলিয়ে আজ পর্যন্ত ৩৩টি ছবির শ্যুটিংয়ের দুঃসাহসিকতার গল্প লিখতে বসলে এক মহাভারতের চেহারা নেবে। সেই দুঃসাহস কীভাবে অসম্ভবকেও সম্ভব করেছে তা শুনলে আশ্চর্য মনে হয়।

আমি প্রথম যে ছবিতে গৌতমদার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই সেই ছবিটি ছিলো ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দখল’। ছবিটিতে মমতাশঙ্কর, সুনীল মুখার্জি, রবীন সেনগুপ্ত, বিমল দেব, সজল ও রেবা রায়চৌধুরী প্রমুখ অভিনেতারা কাজ করেছিলেন। ছবিতে ‘কাকমারা’ নামের এক যাযাবর সম্প্রদায়ের এক নারীর অস্তিত্ত্ব রক্ষার লড়াইয়ের কাহিনি বলা হয়েছিলো। ছবির শেষ দৃশ্যে ঝড়ের প্রয়োজন ছিলো। কাঁথির কাছে সমুদ্রের তীরবর্তী এক গ্রামে আমাদের শ্যুটিং হয়েছিলো। ঠিক ছিলো কাহিনির শেষে সমুদ্রের তীর ধরে কাকমারা সম্প্রদায়ের মানুষরা রওনা দেবে তাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। গৌতমদা ভেবে রেখেছেন ওই যাত্রার সময় ঝড় উঠবে আর সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে দলটি ক্রমশ চলে যাবে। ‘দখল’ ছবিটি দেখতে বসলে দৃশ্যটি দেখা যাবে। অনবদ্য সে দৃশ্য। কিন্তু শ্যুটিং করতে গিয়ে বোঝা গিয়েছিলো শ্যুটিংয়ের প্রয়োজনে ঝড় তৈরি করাটা মোটেও সহজ নয়। সিনেমায় কৃত্রিম ঝড়বৃষ্টি তৈরি করার কিছু বন্দোবস্ত আছে। সে সবের জোগান করাই ছিলো। কিন্তু স্টুডিও ফ্লোরে যা অনায়াসেই করা যায় তা উন্মুক্ত ও বিস্তীর্ণ সমুদ্রতীরে করা অসম্ভব। যন্ত্রের দ্বারা তৈরি ঝড় কোনও মতেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। এমন অবস্থায় আমরা সকলেই হতাশ। কেউ কোনও সমাধান সূত্র দিতে পারছে না। কেউ কেউ প্রস্তাব দিলো ঝড় বাদ দিয়েই দৃশ্যটি শ্যুটিং করা হোক। কিন্তু গৌতমদা তাতে রাজি নন। তিনি যেমন ভেবেছেন তেমনই হতে হবে। সমুদ্র তীরে ঝড় তুলতেই হবে। তখন আরও কিছু বাড়তি ব্যবস্থা করে চেষ্টা করা হলো। ফল সেই একই। সমুদ্র তীরের হাওয়ায় আমাদের সিনেমার যান্ত্রিক হাওয়া চোখেই পড়ছে না।

গৌতমদা রেগে আগুন। আমাদের অযোগ্যতার জন্য বকাবকি করতে লাগলেন। আমরা নিশ্চুপ। কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। রাগে, হতাশায় গৌতমদা আমাদের বকে চলেছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম রাগলেও তাঁর চোখ জলে ভরে উঠেছে। আসলে দৃশ্যটি যেভাবে ভেবেছেন তা করে ওঠা যাচ্ছে না বলে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু হারতে তিনি রাজি নন। রাগটা বাহ্যিক একটা প্রকাশমাত্র। এদিকে আমরাও বিষন্ন। কিছুই করতে পারছি না বলে অসহায় লাগছে। অগত্যা ঠিক হলো বাকি শ্যুটিং শেষ করে কলকাতায় ফিরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত। পরে দেখা যাবে কী করা যায়। শ্যুটিং যেদিন শেষ হলো সেদিন দুপুরে ইউনিটের সকলে বিশ্রাম নিচ্ছে ক্যাম্পে। পরের দিন কলকাতায় ফিরে যাব সকলে। আমাদের ক্যাম্পটি কাঁথির সেই সমুদ্রতীরের গ্রামের মধ্যেই ছিলো।

সকলে ঘুমন্ত, হঠাৎই খবর এলো সমুদ্রর ওপরের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। যে কোনও মুহূর্তে ঝড় উঠবে এবং তা কালবৈশাখী ঝড়ের মতো একটা কিছু হবে। ঘুমিয়ে থাকা মুহ্যমান ইউনিটের সকলে গৌতমদার চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠলো। নির্দেশ এল শ্যুটিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার। সময় নেই, যা করার এক্ষুনি করতে হবে। ঝড় এসে পড়ার আগেই ক্যামেরা ও শিল্পীদের নিয়ে সমুদ্রতীরে পৌঁছতেই হবে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্যাম্পের দৃশ্যটা বদলে গেলো। সকলে ক্যামেরা, কস্টিউম, মেক-আপ, খাতাপত্র যার যা ছিলো সব নিয়ে দৌড় লাগালো সমুদ্র তীরের দিকে।

ছুটতে ছুটতে ক্যামেরার ম্যাগাজিনে ফিল্ম স্টক ভরা হচ্ছে। শিল্পীরা কস্টিউম বদলাচ্ছেন। মেক-আপ নিচ্ছেন। কাকমারাদের যাবতীয় সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আর্ট ডিপার্টমেন্টের সদস্যরা তা ঝুলিয়ে দিচ্ছেন শিল্পীদের কাঁধে, মাথায় বেঁধে দিচ্ছেন গামছা। গৌতমদা আমাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছেন যেখানে ক্যামেরা বসাবেন সেই জায়গাটিতে। ক্যামেরা সেই জায়গায় যখন পৌঁছলো ততক্ষণে কাকমারাদের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য শিল্পীরাও তৈরি হয়ে পৌঁছে গিয়েছেন তাদের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে। দাঁড়িয়ে পড়েছেন সারিবদ্ধ হয়ে। নির্দেশকের আদেশ পেলেই তাঁরা হাঁটতে শুরু করবেন। আমরা ঝড় ওঠার কয়েক মুহূর্ত আগে পৌঁছতে পেরেছিলাম।

এক সময় আকাশের মেঘ আরও ঘনীভূত হয়ে জোরে হাওয়া দিতে শুরু করলো। ক্রমশ তা তীরের বালির সঙ্গে মিশে বালিঝড়ের চেহারা নিলো। সেই প্রবল বালিঝড়ের সামনে ক্যামেরা দাঁড় করিয়ে রাখাই যাচ্ছে না। আমাদের পক্ষেও চোখ খুলে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে গেছে। হাওয়ার প্রচণ্ড শব্দে কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় হাত নেড়ে শিল্পীদের ‘অ্যাকশন’ বলা হলো। শিল্পীরা সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ক্যামেরা চলতে লাগলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে দৃশ্য শ্যুটিং করাটা সেদিন সকালে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিলো সেই দৃশ্যই ক্যামেরার সামনে অভিনীত হচ্ছে অবলীলায়। কাকমারার দল হেঁটে চলেছে। গৌতমদা ক্যামেরার স্থান বদলাচ্ছেন আর শট নিচ্ছেন একের পর এক। যেন ম্যাজিক!

দখল ছবির শেষে এই দৃশ্য আজও দেখা যায়। দৃশ্যটি দেখে অনেকেই প্রশংসা করেন। কিন্তু যেভাবে ওই দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিলো তা ভাবলে মনে হয় পরিচালকের অমন চাওয়াই হয়তো কোনও এক অলৌকিক শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিলো। যার ফলে সম্ভব হয়েছিলো অমন একটি দৃশ্যের শ্যুটিং করা। গৌতম ঘোষ এইজন্যই মিথমেকার।

এমন কাণ্ড গৌতমদার ছবিতে আরও অনেকবার ঘটেছে। যদি মনে করতে চেষ্টা করি ‘পার’ ছবির শুয়োরের দল নিয়ে নদী পারাপারে দৃশ্যটি। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র বানের জলে ভেসে যাওয়া অন্তর্জলীর মঞ্চের দৃশ্য। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র পদ্মা মেঘনার বিপুল মোহনা পেরিয়ে হোসেন মিয়াঁর নৌকাযাত্রার দৃশ্য। ‘বিয়ন্ড হিমালয়াস’-এর মতো ডকুমেন্টারি। ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবির দৃশ্যকল্প। ‘শূন্য অঙ্ক’ ছবিতে মাওবাদী অধ্যুষিত গভীর জঙ্গল থেকে কাশ্মীরের বরফ ঢাকা পাহাড়। ‘রহাগীর’-এর বিস্তৃত পাথুরে প্রান্তর। এমনই আরও অনেক ছবিতে তিনি এমন সব দৃশ্য পরিকল্পনা করেছেন, যা শুনে মনে হতে পারে হলিউডের কোনও ইউনিট লাগবে সেইসব লোকেশনে শ্যুটিংয়ের বন্দোবস্ত করতে। কিন্তু একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রকার তাঁর সামান্য বাজেট আর এই কলকাতার টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের দিয়েই তা সম্ভব করেছেন বার বার। কেবল তাঁর দুঃসাহস ও প্রত্যয় দিয়ে। যা আমার মতে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অনন্য এক নজির।

লেখক পরিচিতিঃ চলচ্চিত্রকার।

********************


গৌতম ঘোষ— সৌন্দর্যের সঙ্গে সৌন্দর্য বিরোধিতার এক আশ্চর্য সমন্বয়
সুমন মুখোপাধ্যায়

গৌতম ঘোষের জন্মদিন উপলক্ষে এই লেখাটা কিছুদিন ধরেই শুরু করবো ভাবছিলাম। সম্পাদক মহাশয় মনে করিয়ে দিয়েছেন একবার। লেখা নিয়ে সবে বসেছি আর ঠিক এই সময়ে চলে গেলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বুদ্ধবাবু ও গৌতমদা সমসাময়িক, যদিও বয়সে বুদ্ধবাবুর থেকে গৌতমদা বছর ছয়েকের ছোটো। বাংলা চলচ্চিত্রের যে প্রকাণ্ড স্থাপত্য সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের কর্মযোগে নির্মিত হয়েছে ওঁরা দু’জনে একসঙ্গে সেই বিশালত্বের ভার বহন করেছিলেন। যদিও সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন তখনও কাজ করছেন। তবে তাঁদের শিল্পজীবনের একেবারে শেষের দিকে। আমার মতে ওঁদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো হয়ে গেছে। আবারও ব্যাক্তিগত মতে, সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) এবং মৃণাল সেনের ‘খন্ডহর’ (১৯৮৫) ওঁদের শেষ বড়ো কাজ। কিন্তু বিষয়টা হলো, ওঁরা যে বিস্তীর্ণ চালচিত্র নির্মাণ করেছেন, উৎকর্ষের যে মান সৃষ্টি করেছেন ঠিক তাঁদের পরে দাঁড়িয়ে গৌতমদা বা বুদ্ধবাবুর কাছে বড়ো কঠিন কাজ ছিলো সেই উত্তরাধিকারের চাপ ঘাড়ে নেওয়া। কিন্তু ওঁরা পেরেছিলেন একটা অন্য স্বর জাগিয়ে তুলতে। সমসাময়িক হলেও বুদ্ধবাবু এবং গৌতমদার চলচ্চিত্রের ভাষা ছিলো স্বতন্ত্র। যদিও প্রথমদিকটা দু’জনের ভাষার একটা সাযুজ্য পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীতে দু’জনের চলচ্চিত্রের ভাষ্য আমূল বদলে যায়। আমি গৌতম ঘোষকে বা গৌতমদাকে প্রথম চিনি অভিনেতা হিসেবে ‘গৃহযুদ্ধ’ (১৯৮২) ছবিতে। তার আগে আমি গৌতমদার ছবি দেখিনি। গৌতমদার প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম ‘মা ভূমি’(১৯৭৯)। আশ্চর্যের বিষয় সেই ছবির ভাষা ছিলো তেলেগু। বাঙালি পরিচালক বম্বেতে গিয়ে হিন্দি ছবি করেছেন সেরকম হয়তো অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু জীবনের প্রথম ছবি মাতৃভাষায় করেননি এরকম দৃষ্টান্ত হয়তো বিরল। এই সূত্র থেকেই শিল্পী এবং মানুষ গৌতম ঘোষ সম্পর্কে একধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময় ‘মা ভূমি’ দেখার সুযোগ মেলেনি। গৌতমদার প্রথম বাংলা ছবি ‘দখল’ (১৯৮২)। সেটা ‘গৃহযুদ্ধ’-এর বছর। তাই অভিনেতা গৌতম ঘোষের সঙ্গে আমার আগে পরিচয় হয়েছে। ‘দখল’ আমি ‘গৃহযুদ্ধ’র পরে দেখেছি। এখন থেকে প্রায় ৪০ বছর আগেকার স্মৃতি নিয়ে কথা হচ্ছে। ‘দখল’-এর পর গৌতমদার ছবিগুলি হলো— ‘পার’, ‘অন্তর্জলি যাত্রা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। আমার কাছে এই ছবিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ছবিগুলো হচ্ছে ১৯৮২ থেকে ১৯৯৩-এর মধ্যে। এই দশ-এগারো বছরে ব্যাক্তিগতভাবে আমার একটা হয়ে ওঠা আছে। স্কুল পেরিয়ে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ হয়ে আমার বিদেশে নাট্য শিক্ষা এবং পাশাপাশি নাট্যপরিচালক হিসেবে হাতেখড়ি। আরও একটা ব্যাপার— সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে সরাসরি একটা সিলেবাসের পাঠ্যবস্তুর চলচ্চিত্ররূপ দেখার অবকাশ। যদিও কমলকুমার মজুমদার বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দুটি উপন্যাস নির্দিষ্টভাবে সিলেবাসে ছিলো না, তবে অন্য লেখা ছিলো। কিন্তু এই দুই লেখকের বিশিষ্ট লেখনী ভঙ্গি এবং মনন বুঝতে সিলেবাসের বাইরেও পড়তে হয়েছিলো। আর উপন্যাস দুটি আধুনিক বাংলা গদ্যের অন্যতম নিদর্শন। আবার এমনও নয় যে সাহিত্যের চলচ্চিত্ররূপ আগে দেখিনি। কিন্তু সেসব তো ঘটেছে আগে। কিন্তু আমার সময়ে দাঁড়িয়ে এই কাজ হচ্ছে। এক নতুন চিহ্ন স্থাপিত হচ্ছে বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের মানচিত্রে। এটাও প্রাসঙ্গিক যে সমসাময়িক তিনজন চলচ্চিত্রকার কমল কুমারের সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত— ‘নিম অন্নপূর্ণা’ এবং ‘তাহাদের কথা’, গৌতম ঘোষ— ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ এবং অপর্ণা সেন— ‘সতী’। সাহিত্য অবলম্বনে সিনেমা— এই বিষয়ে সত্যজিৎ পরবর্তী চলচ্চিত্রকাররা খুব একটা আলাদা পথে হাঁটেনি। কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলে রাখা প্রয়োজন যে বাঙালি চলচ্চিত্রকাররা বার বার ফিরে গেছেন সাহিত্যের কাছে, কিন্তু তা বলে বাংলা চলচ্চিত্র কখনও সাহিত্যের দাস হয়নি। চলচ্চিত্র তার স্বতন্ত্র ভাষাতেই কথা বলেছে পরিচালকদের দক্ষতায়। 

আবার সমাজ-রাজনীতির অনুষঙ্গে এই এক দশক বেশ তাৎপর্যপূর্ণ নানা কারণে। একদিকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন আর আশির দশকের শেষে ১৯৭৯ বার্লিন ওয়াল আর ৯১-তে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। আসলে যে কোনও চলচ্চিত্রকারের ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর সময়টাকে একটু বুঝে নেওয়া দরকার। শুধুই বা চলচ্চিত্রকার বলি কেন যে কোনও শিল্পমাধ্যম এবং শিল্পীর ক্ষেত্রে এ কথা বলতে হবে। কারণ একটা বিশেষ সময়ের ছাপ চলচ্চিত্র শিল্পীর দৃশ্যবয়ানে থেকে যায়। অন্তত যে সমস্ত ফিল্ম মেকার সমাজ, রাজনীতি ও সময় সচেতন সেই সব চলচ্চিত্রকারদের কাজে নিজের সময়ের দ্বন্দ্ব, সংশয়, আনন্দ, ক্লেদ, হতাশা, আশা সব কিছু এক সচল চিত্রআলেখ্যে প্রোথিত হয়ে থাকে। শ্রেণী চেতনার অনুষঙ্গে কোন মানুষের মুখ, শরীর প্রাধান্য পাচ্ছে? কোন শ্রেণীর ইতিহাস, কোন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চিহ্ন খোদাই হয়ে থাকছে সেলুলয়েডের রসায়নে? গৌতম ঘোষের সারা জীবনের কাজে এক গূঢ় রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা আছে। কখনওই তিনি ইতিহাসের এক বিশেষ মাত্রা থেকে সরে যাননি। যখন সাম্প্রতিক ইতিহাস, রাজনীতি বা অর্থনীতি নানা ফন্দিফিকিরে গড়ে তুলতে চেয়েছে সভ্যতা, উন্নয়ন, সমাজতত্ত্বের একমুখী বয়ান তখন গৌতমদা তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে কখনও চিৎকার করে বা কখনও ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে গেছেন এক অন্তর্ঘাত-মন্ত্র। প্রান্তিক কাক মারার দল, অন্ত্যজ দেহাতি দম্পতি, শ্মশানের অচ্ছুৎ ডোম, অপাঙক্তেয় মাঝি গোষ্ঠী— গৌতমদার প্রায় প্রতিটা ছবিতে এঁরাই লেন্সের অনন্ত ভূমির সামনে রেখে দিয়ে গেছে শ্রেণীগত সংঘাতের এক অনিবার্য সংকেত। এই অন্তেবাসীদের ইতিহাস বারবার ফিরে এসেছে ওঁর ছবিতে। গৌতমদার গোটা ফিল্মোগ্রাফিতে মাঝখানে কয়েকটা মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের বয়ান থাকলেও আবার উনি ফিরে গেছেন লালনের ‘গভীর নির্জন পথে’র সন্ধানে। সুলুকসন্ধানে হাজির হয়েছেন দেহতত্ত্বের আখড়ায়। নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাস বারংবার ধরা পড়েছে ওঁর চিত্র আখ্যানে। পাশাপাশি গৌতমদার ছবির এক অনন্য মাত্রা হলো তাঁর বিশিষ্ট ‘চিত্রভাষ’ বা ‘ইমেজ’। গৌতমদা নিজে সিনেমাটোগ্রাফার বলেই চিত্রকৈল্পিক বিস্তারে ওঁর প্রত্যেকটি ছবি এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য পায়। আমি শুধুমাত্র সুন্দর, মসৃণ ‘ভিসুয়াল’-এর কথা বলছি না। বরং উল্টোটাই বলছি। গৌতমদার ইমেজের ভেতরে একটা অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য-বিরোধিতা আছে, একটা অন্তর্ঘাত চিহ্ন। মনে পড়ে যায় মনোহারী আকাশের সিলুয়েটে শ্যুট করা ‘পার’-এর সেই হত্যা দৃশ্য। আমার সঙ্গে ব্যাক্তিগতভাবে যে গৌতমদার বিশেষ যোগাযোগ ছিলো বলবো না। মাঝেমাঝে নানা সভা, সমিতি, অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেছে। কিছু বিষয়ে হয়তো ফোনে কথা হয়েছে বা আমার ছবি দেখে উনি ওঁর খোলামেলা মতামত জানিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ মহলে ঢুকে পড়ার সুযোগ থাকলেও আমি দূর থেকেই ওঁর কাজকে অনুসরণ করেছি। সম্প্রতি, এত বছর পর, গৌতমদাকে খুব কাছ থেকে দেখার একটা অবকাশ হয়ে গেলো। ওঁর একটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিতে আমি অভিনয় করলাম। ছবিটা মূলত লকডাউনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গৌতমদার একটা স্মৃতিচিত্র। এই কাজের সূত্রে পাশে থেকে দেখলাম একজন প্রবীণ চলচ্চিত্রকারকে তাঁর সারা জীবনের লব্ধ নৈপুণ্য নিয়ে নবীনতার উৎসাহে মেতে উঠতে। কোথাও নেই এক টুকরো দীর্ঘ প্রাপ্তির শ্লাঘা বা বয়সকালীন এক ফোঁটা ক্লান্তির ছাপ। সৃষ্টিতে মাতোয়ারা প্রাণ। আমাদের শ্যুটিং ছিলো কলকাতা এবং পুরুলিয়ায়। একটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির জন্যে ছিলো বিপুল ভাবনা। আবার এমনও নয় যে বাজেটের অঙ্ক বিশাল। আসলে বাজেট নয়, মননের চাহিদাই প্রধান। যেটা ছবির জন্যে প্রয়োজন সেটা কি করে নিয়ন্ত্রিত আয়োজনের মধ্যেই চলচ্চিত্রের ভাষার মুনশিয়ানায় আয়ত্ত করতে হয় তার এক নয়াপাঠ আমার হলো। এই ছবিতেও গৌতমদার রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস ছোটো পরিসরের মধ্যেই নানা স্তরে বিন্যস্ত হয়ে আছে। শৈল্পিক উৎকর্ষ এবং শিল্পমানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার একটাই উপায় যে নিরলস পরিশ্রম সেটা আর একবার হাতেনাতে যাচাই করে নিলাম গৌতমদাকে কাছ থেকে দেখে।

লেখক পরিচিতিঃ নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক।

********************


Creative Ideas - Impactful Execution
S V Raman

Flashback to the early 1970s: Jadavpur University gradually limping back to normal after a few turbulent years of student unrest triggered by political developments during which the university had to be closed sine die for six months, a vice-chancellor was assassinated on campus, examinations and graduation of entire batches across faculties had to be pushed back to the next calendar year. Sounds almost like a storyline for a film thriller, doesn’t it? Just as all the heat and dust was settling down, more precisely in 1973/74, a lean and lanky young man in his early twenties was occasionally spotted visiting the campus, apparently to meet up with some friends in the Arts Faculty and the Ladies’ Hostel. He was introduced to some of us, who were yet to rid ourselves of the hangover of campus life even after graduation, as Goutam Ghose, an aspiring filmmaker. During conversations one discovered that his interests were manifold – art, music (Indian as well as western classical), photography, history, politics etc. One even learnt that he was working on some ideas for a couple of documentaries.

I then temporarily lost track of this young man. A few years later, when I had already discarded civil engineering, the stream I had graduated in, as a profession and opted for pursuing my passion for art and culture as a profession at the German Cultural Centre, Goethe-Institut / Max Mueller Bhavan Calcutta, one got the news that Goutam Ghose’s documentary Hungry Autumn had won the Grand Prix at the Kurzfilmtage Oberhausen (Oberhausen Short and Documentary Film Festival) in Germany. Having been initiated into world cinema by then, thanks to the film society movement, I realized the importance and significance of this award. The Oberhausen Manifesto, a signed declaration by 26 young German filmmakers on 28 February 1962, spurred by the slogan ‘Papa’s cinema is dead. Long live cinema!’ ushered in a new approach to filmmaking and the genre of ‘authors’ cinema’. Since then Oberhausen had become a sort of Mecca for short and documentary filmmakers from all over the world. Therefore, Goutam Ghose had certainly made a mark as a budding filmmaker in the international arena.

Goutam’s foray into feature films started with his association with the Hyderabad based writer and producer B Narsing Rao and culminated in his first feature film Ma Bhoomi made in Telegu language and depicting the Telengana rebellion in the Hyderabad State. Today, four decades later, when Telengana has got its own statehood, the film merits re-viewing for historical reasons. Rampant exploitation of underprivileged and impoverished sections of society and suppression of progressive forces taking up their cause, by the privileged and moneyed class has been a recurring theme in quite a few of his subsequent films. Paar based on a Bengali story by Samaresh Basu, which was made in Hindi with a star studded cast of Naseeruddin Shah, Shabana Azmi and Om Puri depicts such a scenario in rural Bihar. The unforgettable scene that still lingers in one’s memory, where Naseeruddin and Shabana cross the river with a herd of pigs against all odds, brought Goutam’s excellence as a cinematographer to the fore. After winning wide acclaim at the Venice International Film Festival and prior to its theatrical release, the director and the producer were looking for a befitting premiere. The Seagull Film Society, of which I happened to be the General Secretary at that time, came forward and organised a gala premiere show of the film followed by a Q&A session with the director in the cinema hall Society.

This was followed by Antarjali Yatra based on a novel by Kamal Kumar Majumdar, highlighting the institution of Kulin Brahmin polygamy in nineteenth century Bengal. With Hindi film star Shatrughan Sinha cast in a totally unfamiliar lead role, the film not only bagged the National Award for the best Bengali film in the year 1988, but was also screened the same year and lauded in the Un Certain Regard section at the Cannes Film Festival, and went on to win the Grand Prix at the Tashkent Film Festival. Goutam Ghose had certainly arrived as a filmmaker to reckon with and look out for in the national and international festival circuits.

Goutam Ghose’s greatest forte in the films he has made over four decades has been the cinematic trans-creation of thought-provoking themes with impactful execution. This has largely been possible due to the excellent command that he has attained over the years in the various aspects of filmmaking – right from the choice of material and locations to screenplay, cinematography, music and even post-production. In fact, he is held in such high esteem as a cinematographer that Aparna Sen had assigned that task to him in her feature film Mr and Mrs Iyer. Let us come to his acting prowess. Fellow filmmaker Buddhadeb Dasgupta had introduced him as an actor in his film Grihajuddha. Goutam gave such an impressive performance that other acting offers started coming his way. Of course he had to decline many of them in order to be able to concentrate on his own film projects. Even then, one can watch him essaying stellar roles in Baishe Shrabon and Chotushkone by Srijit Mukherjee, Beyond the Clouds by Iranian director Majid Majidi and Guptodhoner Sandhane by Dhrubo Banerjee.

In the year 1992 I moved in with my family to a small rented flat in Gol Park, adjacent to the South City College. There I learned that the very same living room had been witness to regular intellectual exchanges in the 1970s, where my predecessor tenant, a professor of Jadavpur University, would hold fort to a captive audience comprising young Goutam Ghose and some of his friends. The discussions would apparently veer around history, politics, rich art traditions et al. Some of this must have lingered on as troubling concerns in the ideologically left inclined minds. These concerns were bound to manifest themselves later in some form. Goutam Ghose’s 2009 film Kaalbela (called ‘Calcutta My Love’ in English), based on a novel of the 1980s by Samaresh Majumda, set against the background of the Naxalite movement, relives the anxieties of that period. One more film that stands out in my memory is Patang (1993) set in a small railway station near Gaya and depicting the lives of people who have taken refuge in illegal slums. Goutam Ghose draws a clear distinction between criminals and operators. Even criminals, small-time or big-time, are at the mercy of big-time operators. These ‘operators’ are the malignant bane holding society at large to ransom. Today, even nearly three decades after this film was made, nothing seems to have changed. In fact, these operators, whether under the guise of corporate or syndicates, have tightened their stranglehold to such an extent that it will be difficult for the system to extricate itself from their control. Goutam’s latest film Raahgir (The Wayfarers), which recently bagged the best film and best actress (Tilottama Shome) awards at a film festival in London, however hints at a silver lining in the human bonding even among strangers, against all odds and obstacles.

This piece started with the mention of Goutam’s first documentary. One needs to dwell a little more on that. Like in the case of several leading filmmakers of the world, Goutam’s oeuvre of feature films is also frequently interspersed with documentaries. Apart from a biopic like Meeting a Milestone (1989) immortalised also by its ebullient protagonist and shehnai exponent Ustad Bismillah Khan with his clarity of thought and life’s philosophy, or commissioned works like Rivers of Knowledge on the Asiatic Society or the most recent one on The Calcutta High Court, there have been quite a few giving insights into and creating awareness regarding social issues and problems. Special mention has to be made of the five hour long saga in five parts titled Beyond the Himalayas (1996) tracing the original Silk Route through a several months-long adventurous expedition through many countries, which one had the occasion to watch in one go in the Max Mueller Bhavan auditorium at the beginning of this millennium. Later Goutam shared his experiences of this adventurous expedition, illustrated with his own photographs, in a publication of the same name. A retrospective of a dozen of his documentaries was screened at the ICCR auditorium in May 2019 under the aegis of the Forum for Film Studies and Allied Arts and Kalpanirjhar Foundation. Indeed a veritable feast for real cine-lovers!

At least 18 National Awards, several international awards and accolades bear testimony to his class as a filmmaker and his acumen for mirroring society on celluloid in a thought-provoking manner. He is till date the only Indian filmmaker to be bestowed with the prestigious “Vittorio di Sica” Award of Italy. Through his Italian connections he had facilitated a collaboration with the Roopkala Kendra set up by the West Bengal government. As erstwhile Chairman of the Satyajit Ray Film and Television Institute and Chairman of the Kolkata International Film Festival, his contribution to the enhancement of awareness and taste for good cinema has been quite significant. In the year 2001 Goutam Ghose was invited to Capalbio, a small town in Italy, as a jury member for their annual short fiction film festival. He came back all excited and asked some of us why we couldn’t organise such a niche film festival here. Thus under his Chairmanship of the Kalpanirjhar Foundation began the journey of the annual Kalpanirjhar International Short Fiction Film Festival in the year 2003. We have successfully completed 18 consecutive editions and are eagerly gearing up for the 19th edition in December 2021.

লেখক পরিচিতিঃ কলকাতার ম্যাক্স ম্যুলার ভবনের অবসরপ্রাপ্ত প্রোগ্রাম আধিকারিক।

********************


গৌতম সমগ্রের খোঁজে
অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

•সূচনার ভাষা

উত্তমকুমারকে নিয়ে প্রথম ফিচার ফিল্ম করার কথা ভেবেছিলেন গৌতম ঘোষ।
এই কথাটা প্রথমজন, সত্যি কথা বলতে কি, প্রবল বিস্মিত হয়েছিলাম।

‘হাংরি অটাম’-এর মতো গভীর তথ্যচিত্র পেরিয়ে যিনি প্রথম ফিচার ফিল্ম করেন ‘মা ভূমি’, তিনি প্রথম ছবি করতে চেয়েছিলেন উত্তমকুমারকে নিয়ে। প্রায় অবিশ্বাস্য লেগেছিলো শুনে। কিন্তু শতকরা একশো ভাগ বিশ্বাস না করে উপায়ও ছিলো না। কারণ, কথাটা জানিয়েছিলেন গৌতমদা। স্বয়ং গৌতম ঘোষ।

হ্যাঁ ‘হাংরি অটাম’ তখন প্রবল আলোচ্য এক তথ্যচিত্র। শুধু আলোচিত এবং পুরষ্কৃতই নয়। এ ছবির পরিচালককে দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিচ্ছেন মৃণাল ঘোষ, ঋত্বিক ঘটক। তাই ঘটনাচক্রে হলেও ‘হাংরি অটাম’-এর পর ‘মা ভূমি’ যেন অবধারিতই ছিলো গৌতম ঘোষের ক্ষেত্রে। তবুও, সত্যিটা এমনই যে, ‘হাংরি অটাম’-এর পরিচালক তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্মের প্রধান চরিত্র হিসেবে ভেবেছিলেন উত্তমকুমারকে।

সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফে’-র চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলো তিনি। এবং একদিন সমরেশ বসুই তাঁকে নিয়ে গেলেন উত্তমকুমারের কাছে। স্বপ্ন দেখা, আত্মবিশ্বাসী নবীন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে খুবই ভালো লেগেছিলো উত্তমকুমারের। তিনি তো চাইতেন, অন্যরকম ছবিতে অন্যরকম চরিত্রে নিজেকে আবিষ্কার করতে। কিন্তু তেমন পরিচালক, তেমন চিত্রনাট্য তখন কোথায় টালিগঞ্জে? সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’, ‘চিড়িয়াখানা’-র পরে পার্থপ্রতিম চৌধুরী উত্তমকুমারকে নিয়ে করলেন ‘যদুবংশ’। এক অন্যরকম উত্তমকুমার এলেন দর্শকদের সামনে।

উত্তমকুমার খুবই আগ্রহ নিয়ে গৌতম ঘোষকে বলেছিলেন, ‘আমি করবো তোমার ছবি। তোমাদের মতো নতুনরাই তো বাংলা ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

সে ছবি হয়নি। যদি হতো, সন্দেহ নেই। গৌতম ঘোষের ছবিতে আবার এক অন্যরকম উত্তমকুমারকে পেতাম আমরা।

আসলে, যা অবধারিত ছিলো, সেটাই হলো। নির্ধারিত হলো গৌতম ঘোষের সূচনার ভাগ। ‘হাংরি অটাম’ থেকে তিনি চললেন ‘মা ভূমি’-র দিকে। এক আন্দোলন থেকে আর এক আন্দোলনে। মানুষের আন্দোলন, মানুষের প্রতিবাদ, মানুষের লড়াইয়ের উত্তাপ বুকে নিয়েই নিজের যাত্রাপথ তৈরি করতে চেয়েছিলেন গৌতম ঘোষ। জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীকে কালো পতাকা দেখানো গৌতম ঘোষকে তো এই পথটাই মানায়। সেই পথে তাঁর সঙ্গী হলো তাঁর ক্যামেরা।


•সিনেমার ভাষা

খোদ কলকাতার যুবক গৌতম ঘোষ প্রথম ছবি করছেন তেলেগুতে। এটা বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার। ‘হাংরি অটাম’ নিয়ে তখন উচ্ছ্বাসিত মৃণাল সেন। তখন কলকাতায় এসেছেন তাঁর ‘মৃগয়া’ ছবির প্রযোজক। মৃণাল সেন সেই প্রযোজকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন গৌতম ঘোষের। মৃণালবাবুর উচ্ছ্বাস সেই প্রযোজককে অনেক বেশি আগ্রহী করে তোলে গৌতম ঘোষ বিষয়ে। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব, ছবি করুন। ফিচার ফিল্ম। সেই ছবি হায়দরাবাদে শ্যুটিং করার প্রস্তাব এবং ছবির ভাষা হবে তেলেগু।

চ্যালেঞ্জ নিতে সেই শুরু থেকেই তৈরি গৌতম ঘোষ। ‘হাংরি অটাম’-এর পরিচালক বেছে নিলেন কিষণ চন্দরের গল্প ‘যত ক্ষেত জাগে’। তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন উঠে এল পর্দায়। তৈরি হলো— ‘মা ভূমি’, যা দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কারে সম্মানিত। কোনও নামকরা তারকা না নিয়ে। থিয়েটারের অভিনেতা ও জীবন্ত কিছু চরিত্রকে নিয়ে তৈরি ‘মা ভূমি’ তৎকালীন হায়দরাবাদের সিনেমা হলে হাউসফুল বোর্ডও টাঙিয়ে দিলো।

কিন্তু, কোন সাহসে প্রথম ফিচার ফিল্ম বাংলায় না করে তেলেগুতে করলেন? গৌতম ঘোষ বলেছিলেন, “সিনেমার ভাষা তো আন্তর্জাতিক। কোনও সীমানা নেই। সিনেমায় এক্সপ্রেশনটা এতটা স্ট্রং, এতটা শক্তিশালী যে, মুখের ভাষাটা অনেক ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। মানুষের অভিব্যক্তি তো দেশে দেশে পরিবর্তিত হয় না। মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ, বন্ধুপ্রীতি— দেশে দেশে খুব একটা কি পরিবর্তিত হয়?”

এই প্রশ্নটা গৌতমদা যখন আমাকে করেন, তখন, বলাই বাহুল্য, উত্তর দেওয়াটা নিষ্প্রয়োজন। তাঁর প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত আছে উত্তরটা।

সেই সিনেমার ভাষাকেই তিনি খুঁজছেন, স্পষ্ট করতে চেয়েছেন ‘মা ভূমি’, ‘দখল’-এর পর ‘পার’-এ, ‘অন্তর্জলীযাত্রা’য়, ‘পদ্মানদীর মাঝি’-তে যেমন, ‘দেখা’, ‘মনের মানুষ’, ‘শঙ্খচিল’, ‘রাহনীর’-এও।

এবং সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের উত্তরাধিকারী হয়েও গৌতম ঘোষ শুরু থেকেই চেষ্টা করেছেন নিজস্ব পথ আবিষ্কারের, নিজস্ব সিনেমার ভাষা খুঁজে নিতে।

দেশে, বিদেশের কোন পরিচালকের কোন প্রভাব তাঁর কোন ছবিতে কোথায় কোথায় পড়েছে। এইসব হাটল তত্ত্ব ও তথ্য খুঁজে বের করবেন বিদগ্ধ গবেষকরা। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র-সফর দেখে, শুনে একটা কথাই আমার মনে হয়, পূর্বসূরী কারও ছায়ায় তিনি ঢাকা পড়েননি। গৌতম ঘোষের নিজেরই একটা ছায়া আছে, যা মাটিতে পড়ে।


•মানুষের ভাষা

সিনেমার নিজস্ব ভাষা আছে, এটা তো সত্যি। কিন্তু সেই সিনেমার ভাষার কাছে পৌঁছনোর জন্য গৌতম ঘোষ আগে পৌঁছেছেন মানুষের ভাষার কাছে। না হলে শুরুতেই ‘হাংরি অটাম’ হয় না। হয় না ‘মা ভূমি’, ‘দখল’, ‘পার’।

পরপর তিনটে ছবিতেই মানুষের ক্রোধ, উত্তেজনা, আন্দোলনের আঁচ এসে লাগে আমাদের লয়ে। কোথাও সমাজগত, কোথাও ব্যক্তিগত মানুষ এইসব ছবিতে সর্বজনীন হয়ে ওঠে।

এবং স্পষ্ট হয়ে ওঠে গৌতম ঘোষের রাজনৈতিক সচেতনতা। সামাজিক সচেতনতা। তাই শুরুতেই ক্যাপচা ফর্মুলাকে সমূলে অগ্রাহ্য করেছেন তিনি।

এবং কখনও আঞ্চলিক সমাজ, কখনও ব্যক্তি-সমাজ তাঁর ছবিতে এতটাই প্রাসঙ্গিক এবং জীবন্ত হয়ে ওঠে, যে, শেষ পর্যন্ত সেই ছবি হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। এবং সম্মান পেয়েছেন দেশে-বিদেশে। কান, ভেনিসে সম্মানিত হয়েছে তাঁর ছবি।

কিন্তু এইসব পুরস্কার, সম্মান গৌতম ঘোষকে তাঁর শেকড় থেকে একটুও বিচ্যুত করেনি। মানুষের ভাষা শোনার জন্যে কান পেতে থাকেন তিনি। তাই এতটা পথ পেরিয়ে এলেও, তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘রাহনীর’-ও মানুষের ভাষাকেই খুঁজছে। সেই মানুষ, যার কাছে একসময় নিজের ভাতকাপড়ের ক্ষিদেও তুচ্ছ হয়ে যায়, মিলেমিশে বাঁচার তাগিদে। এই থাকলেও স্বপ্ন দেখান গৌতম ঘোষ, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। আশ্বাস দেন, মানুষ অপরাজেয়।

আমরাও একটু শ্বাস নিই, এই দুঃসহ করোনাকালকে অগ্রাহ্য করে।


•সাহিত্যের ভাষা

সিনেমার ভাষা যে খুব শক্তিশালী, সিনেমার ভাষা যে আন্তর্জাতিক, মানছি গৌতমদা। কিন্তু কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ তো আপনার আগে কেউ সিনেমায় আনার কথা ভাবেননি? কেন? কমলকুমার মজুমদার পড়তে পরিচালকরা ভয় পান?

প্রশ্ন শুনে হেসে খেলে গৌতম ঘোষ। বলেন, কে ভয় পায় না পায়, আমি বলতে পারবো না। তবে বাংলা ভাষা না জানলে আমি ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ করতে পারতাম না।

একথাটাও পরে গৌতম ঘোষ স্বীকার করেন, সাহিত্য পাঠেরও অনেক স্তর আছে। কমলকুমারকে পড়ার জন্যে একটা স্তরে তো পৌঁছতে হবে!

সাহিত্যের কাছ থেকে নিজের ভাবনার উপাদান খুঁজে নিয়েছেন গৌতম ঘোষ। এ নিয়ে কোনও লুকোছাপা করেননি তিনি। সাহিত্যের মধ্যে মানুষের ভেতরের উত্তাপ, উদ্দীপনা, লড়াই, বেঁচে থাকার তীব্র যাত্রাপথকে বারবার খুঁজে নিয়েছেন তিনি। ‘মা ভূমি’ থেকে ‘রাহানীর’-এর যাত্রাপথে তার অনেক চিহ্ন রয়েছে। ‘পার’, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ পেরিয়ে তা বহমান ‘রাহনীর’ পর্যন্ত আপাতত। এই স্রোত অন্তত সেই অনন্ত সাহিত্যের ভাষায় কান পেতে রাখেন গৌতম ঘোষ। রত্নের খোঁজে নয়। রত্নের আলোয় পথ দেখাবেন বলে।


•জীবনের ভাষা

টুকরো টুকরো ভাষায় গৌতম ঘোষকে একটু ছোঁওয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র। আমি আসলে আঁচ পেতে চেয়েছি গৌতম-সমগ্রের।

হ্যাঁ, সেই গৌতম ঘোষ, যিনি উথাল-পাথাল পদ্মানদীকে ক্যামেরায় ধরার পর হিমালয়ের নৈঃশব্দে চলে যেতে পারেন অনায়াসে। আমরাও তার ‘বিয়ন্ড দ্য হিমালয়াস’-এর স্পর্শ পাই।

এভাবেই তৈরি হয়ে ওঠে আমার গৌতম-সমগ্র।

তাঁর সমকালীন আর এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বুদ্ধদেব ছিলেন তাঁর বন্ধু এবং সবচেয়ে বড়ো প্রতিযোগী। হ্যাঁ প্রতিযোগী। একথা মানতে কোনও অসুবিধা নেই গৌতম ঘোষের। সেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মারা যাওয়ার পর গৌতমদাকে ফোন করি, সংবাদপত্রের বাধ্যতামূলক প্রয়োজনে। ফোনেই তাঁর স্মৃতিচারণ অনুলিখন করি। ‘আজকাল’-এ সেই লেখার শিরোনাম ছিলো ‘আমাদের সময়ের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পরিচালক বুদ্ধদেব।’

জীবনের ভাষা কতটা গভীর হলে এভাবে সমসময়ের এক পরিচালককে শ্রদ্ধা জানানো যায়। এই লেখা এবং শিরোনামতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো।

গৌতমদা একা বাঁচেন, সমাজে বাঁচেন, সংসারে বাঁচেন।

মেয়ে আনন্দীকে দেখেছি তাঁর ক্যামেরার মাঝে। ছেলে ঈশান তো ক্যামেরার পিছনেই এখন। তাঁর স্ত্রী নীলাঞ্জনা ঘোষ ‘হাংরি অটাম’-এর যুগ থেকেই গৌতমদার সব কাজের সঙ্গী।

কয়েকদিন আগে, এই করোনাকালে গৌতমদার গোলপার্কের বাড়িতে একটা জরুরী কাজেই গেছি। কাজের আড্ডা চলছে। চা শেষ।

আমি একটু দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করি, সিগারেট খাবেন গৌতমদা?

গৌতমদা এই প্রশ্নটারই অপেক্ষা করছিলেন মনে হলো।

সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘তুমি ধরাও’। তারপরেই ‘খুকু’, ‘খুকু’ বলে ডাক দিলেন।

খুকুদি তথা বৌদি তথা নীলাঞ্জনা ঘোষ এসে দাঁড়ান।

ভালোমানুষী মুখ করে গৌতমদা বলেন, খুকু একটা সিগারেট দেবে?

বৌদি তৈরি হয়েই এসেছিলেন। একটা কিং সাইজ গোল্ডফ্লেক লাইট দান করলেন গৌতমদাকে। ধন্য গৌতমদা। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বৌদির প্রদান।

এমন একটা মহার্ঘ্য দৃশ্যও আমার জন্যে জরুরী, আমার গৌতম-সমগ্রের জন্য। এই সবটা মিলিয়ে গৌতমদা। আমার গৌতম ঘোষ।

আমি তাঁকে টুকরো টুকরো ভাষায় এবং কিছুটা সমগ্রে আবিষ্কার করতে করতেই এগিয়ে চলবো। ভালোবাসবো তাঁকে। আরও।

লেখক পরিচিতিঃ সাংবাদিক।

********************


‘পদ্মানদীর মাঝি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছিল’— চম্পা

২৪ জুলাই চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের শুভ জন্মদিন। এই দিনে তাকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কামনা করছি তার দীর্ঘায়ু। এই ক্ষণজন্মা মানুষটির কারণে একেবারে আমূল পাল্টে গেছে আমার জীবন দর্শন। আগে আমি চলচ্চিত্রে কাজ করতাম বাণিজ্যিক তারকা হিসেবে এবং বাংলাদেশের দর্শক আমাকে সেভাবেই জানতো। কিন্তু প্রত্যেক শিল্পীর মনের মধ্যে একটা ক্ষুধা থাকে, আরও উল্লেখযোগ্য এবং গভীর কিছু করার। বাণিজ্যিক তারকা হিসেবে সারভাইভ করার সন্ধিক্ষণে আমার মনে হলো আমি বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ করি, দর্শক সিনেমা হলে যায় আনন্দ করে, হাততালি দেয়। কিন্তু সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে তো তারা সবকিছু ভুলে যায়। তাতে কি আমার শিল্পী জীবনে পরিপূর্ণতা আসছে? আসছে না। এছাড়া দর্শকের মনে রাখার মতো কোনও চরিত্র আমি পাইওনি, করিওনি। পদ্মানদীর মাঝি ছবিটা আমার সেই ক্ষুধা পূরণ করে দিয়েছে। আমার মনের মধ্যে ভালো ও শিল্পসম্মত ছবিতে কাজ করার যে স্বপ্ন ছিলো, পদ্মানদীর মাঝি সেই স্বপ্ন পূরণ করে দিয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ছে— পদ্মানদীর মাঝি ছবিটি করার অনেকদিন পর বিমানে আমি আমেরিকা যাচ্ছিলাম। আমার পাশের কাছাকাছি আসনে ছিলেন স্বনামধন্য এক ব্যক্তিত্ব, তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এমনই এক ব্যক্তি যার সঙ্গে কথা বলার জন্য পূর্বানুমতির প্রয়োজন হতো। আমি লক্ষ্য করলাম তিনি তার আসনটি ছেড়ে আমার দিকেই আসছেন। কাছে এসে সহাস্যে বললেন, আমি একটা ছবিতে আপনার কাজ দেখেছি। খুবই অভিভূত হয়েছি আপনার কাজ দেখে। ছবিটা হলো পদ্মানদীর মাঝি। আপনি মালা চরিত্রটি করেছেন। সত্যি অপূর্ব, অপূর্ব আপনার কাজ। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে ছবিটির আরও অনেক কিছু বর্ণনা করলেন। তার বর্ণনা শুনে ভিতরে ভিতরে আমার মনটা ভরে উঠলো। আমিতো এটাই চেয়েছিলাম। শিল্পী হিসেবে আমি মানুষের মনের মধ্যে থাকতে চাই। সব ছবি দিয়ে সে আশা পূরণ হয় না। সেজন্য ছবির মতো ছবি করতে হয়। আমার জীবনে সেই কাঙ্খিত ছবিটি হলো গৌতমদার পদ্মানদীর মাঝি। সেদিন লোকটির প্রশংসা শুনে আমার জীবনটা আমার কাছে সার্থক মনে হয়েছিলো। কিন্তু আজ এত বছর পরও মানুষ পদ্মানদীর মাঝির রেফারেন্স টেনে টেনে আমার প্রশংসা করে। এটা আমার জীবনে অনেক বড়ো পাওয়া।

আমি যখন পদ্মানদীর মাঝি করি আমার তখন তেমন একটা অভিজ্ঞতা ছিলো না। বাণিজ্যিক তারকা হিসেবে এই ধরনের ছবি করার অভিজ্ঞতা একেবারেই ছিলো না। গৌতমদার ছবির মালা চরিত্রটি যে কত কঠিন ছিলো সেটাতে কীভাবে অভিনয় করতে হবে সত্যিকার অর্থে সেটা আমি বুঝিনি। এজন্য মনে মনে চরিত্র নিয়ে খুব ভয় পেতাম। গৌতমদা এত চুজি মানুষ, এত নিখুঁত মানুষ, এত যত্ন করে কাজটা করছেন, এটার মধ্যে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। তার কাজ যতই এগুচ্ছে আমি ততই ঘাবড়ে যেতাম। গৌতমদা তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মালাকে যেভাবে দেখেন আমি হয়তো সেটা করতে পারবো না। আমি হয়তো তার সন্তুষ্টি মাফিক কাজটা করতে পারবো না। আমি হয়তো ফেল করবো। আমি সারাক্ষণ এই ভয় ও আতঙ্কে থাকতাম। কিন্তু এসব তাকে আমি কখনও বলিনি। আমি সব সময় খেয়াল করতাম তিনি কী বলছেন। তাকে আমি বুঝার চেষ্টা করতাম। ছবিটিতে একটি দৃশ্য আছে। এটা সবারই মনে থাকার কথা। আমি ঝগড়া করবো মাঝির সঙ্গে (স্বামী কুবের মাঝি)। ঝগড়ার বিষয়টা ছিলো আমি কেন বাইরে গিয়েছিলাম। আমি একজনকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। তার নামটা মনে নেই। কেন গেলাম সেটাই ছিলো মাঝির জিজ্ঞাস্য। আমি গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে, আমার ল্যাংড়া পা-টা ভালো হবে কিনা। এই নিয়ে মাঝি আমার ওপর খুব ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। এই নিয়েই মাঝির সঙ্গে ঝগড়া। এ শটের সময় গৌতমদা ক্রেনে করে উপরে উঠে গিয়েছিলেন। ঝগড়ার এক পর্যায়ে এক লাথি মেরে আমাকে উঠান থেকে বাইরে ফেলে দিয়েছিলো মাঝি। আমি লক্ষ্য করলাম শট শেষ হওয়ার পর গৌতমদা ক্রেন থেকে নেমে এসে আমাকে খুব এ্যাপ্রিশিয়েট করলেন এবং মাথায় হাত রেখে আমাকে আশীর্বাদ করলেন। ঘটনাটা এজন্য বললাম, সেদিন রাতে আমি যখন একা হলাম এবং সারাদিনের কাজ নিয়ে ভাবতে বসলাম তখন প্রথমেই মানসপটে ভেসে উঠলো, শট শেষে গৌতমদার চোখে মুখে আমি যে সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি দেখেছি, সেই দৃশ্যটি। আর সেটা ভাবতে গিয়ে আনন্দে আমার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এই ঘটনাটি সব সময় আমার মনে পড়তো। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেলো। তখনই আমার মনে হলো মালা চরিত্রটি আমি সফল করে তুলতে পারবো। এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়। আমার ক্যারিয়ারে আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি এবং আমার পুরস্কার পাওয়া শুরুই হয় এই পদ্মানদীর মাঝি ছবি দিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় আমি পাঁচ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। পেয়েছি আরও অনেক পুরস্কার। কিন্তু পদ্মানদীর মাঝি ছবিটি আমার সাধারণ অভিনেত্রী সত্তাটিকে পরিশীলিত করে…

আমাদেরকে অনেক কিছু আড়াল করতে হয়। মনে দুঃখ থাকলেও আমাদেরকে হেসে কথা বলতে হয়। আবার মনের মধ্যে সুখ থাকলেও ক্যামেরার সামনে গিয়ে দুঃখের দৃশ্য করতে হয়। এভাবে সাতরঙা মন নিয়েই আমাদের শিল্পীদের জীবন নির্বাহ করতে হয়। একটা বৈপরিত্য নিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের একটা সত্তা তৈরি হয়। তার নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত আমাদের হাতে থাকে না। এমন সব জীবন দর্শন নিয়েও গৌতমদা আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু আমি মালা থেকে আজও বের হতে পারিনি। চরিত্রটি নিয়ে বরাবরই একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। দাদার সঙ্গে দেখা হলে আমি এখনও সেই মালাতেই ফিরে যাই। আমার জীবনে মালা চরিত্রটি একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। এখানে উল্লেখ করা যায় আমার বড়ো বোন ববিতার কথা। তিনি চলচ্চিত্রের কবি হিসেবে পরিচিত সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত ছবিতে অনঙ্গ বৌ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি চরিত্রটির প্রাণপ্রতিষ্ঠায় এতটাই নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, দর্শকের কাছে ববিতা নামটি ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অনঙ্গ বৌ। এই চরিত্রটির কারণে তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক। তার এই খ্যাতি শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয়, দেশ ও জাতির জন্যও গৌরবের। ববিতা হয়েছেন অনঙ্গ বৌ আর আমি হয়ে উঠেছি গৌতমদার পদ্মানদীর মাঝির মালা। আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় আমাদের দুই বোনকে গণমাধ্যমকর্মীরা এভাবেই চিহ্নিত করে থাকেন। প্রসঙ্গত বলতে চাই আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় গৌতমদাকে নিয়েও লেখালেখি হয়। তার অতীত ও নতুন কাজ নিয়ে সাংবাদিকরা লেখেন। বিশ্লেষণ করেন তার প্রতিভার নানা দিক। তার সৃজনশীলতার অসাধারণ সব অনুষঙ্গ সাংবাদিকদের লেখার উৎস হয়ে উঠে। সে সব লেখা যখন পড়ি তখন মনে হয় গৌতমদা যেন আমাদেরই কেউ একজন। গৌতমদা পদ্মানদীর মাঝি, মনের মানুষ ও আবারো অরণ্যে ছবির কারণে ব্যাপকভাবে আমাদের দেশে পরিচিত। তার দখল, পাড় এবং অন্তর্জলী যাত্রা নিয়ে আলোচনা হয়। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে আমি নিজেও তার এই ছবিগুলো দেখে মোহাবিষ্ট হয়েছি। মনে মনে ভেবেছি যদি এই পরিচালকের অনবদ্য সৃজনশীল কাজগুলোর মধ্যে নিজেকে সামিল করতে পারতাম। পদ্মানদীর মাঝি আমার অন্তরে নিহিত সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে। এক অসাধারণ শিল্প সৃষ্টিতে প্রয়াসী গৌতম বাবু। জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি, অনাগত কালের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি উৎসারিত। রুপক এবং রুপকের আড়ালেও গভীর জীবনঘনিষ্ঠ ছবির নির্মাতা তিনি। আত্মিক অনুভবের বিস্তৃতি, গভীরতা আর সুষম বিন্যাসে তার সৃষ্টিকে এক উচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেছেন। আমার কাছে বারবারই মনে হয়েছে, তিনি যখনই সময়চিত্র তার চলচ্চিত্র সৃষ্টিতে ছায়াচিত্র হয়ে উঠে তখনই তিনি করেন এক সূক্ষ্ম জীবনশিল্পীর কাজ। গৌতমদার ছবিতে আমার কাজ করার পরম সৌভাগ্য নিয়ে আমি অনুভব করেছি তিনি যেন বিশাল মাপের একজন শিল্পী যিনি ছবির গল্প সমাদৃত কল্পলোকে চেতনার সমগ্র জগৎ পরিভ্রমণ করেছেন। জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি অনুভবের যাত্রাপথ সর্বদাই সমৃদ্ধ। মানুষে মানুষে সাঁকো তৈরির কাজ করে চলচ্চিত্র। অগাধ কল্পনা শক্তি নিয়ে গৌতমদা সৃষ্টি করেন সময়ের অনুরণন, জীবন ভাবনা ও আত্মিক অনুভবের এক মোহনা। এখানেই চলচ্চিত্রকার গৌতমদা পূর্ণতা সৃষ্টির উল্লাসে স্বপ্ন দেখেন এক সুন্দর আগামী দিনের পৃথিবী। অসাধারণ আর বিশাল মাপের গৌতমদাকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। আবারও জানাচ্ছি জন্মদিনের অনেক শুভকামনা, গৌতমদা। আপনার দিব্যদৃষ্টি ও জ্ঞান আমার চলার পথে দিয়েছে অনুপ্রেরণা...। একজন পরামর্শদাতা, জীবনের সকল দিক দর্শনে পরিপূর্ণ যিনি। প্রার্থনা করি জীবনে যা কিছু আছে ভালো, পরিপূর্ণ করুক আপনার জীবন।

লেখক পরিচিতিঃ বাংলাদেশের নামী অভিনেত্রী।

********************


Goutom Ghose - A birthday tribute
নন্দিতা পুরি


The year was 1993. The year I got married.

My husband, Om Puri had just completed a film, Patang, with maverick filmmaker Gautam Ghose the previous year and it was all set for a release that year.

I was on one of my visits to my mother’s house in Kolkata when hubby asked me to drop in a birthday bouquet to Ghose’s. “Here’s his number (landline). Just call and find out the place. I don’t think it very farfrom your place,” said Om.

I was very excited. First to meet Gautam Ghose whose films I had seen and admired. And second, he was right round the corner from me. My maikey or baaper baari was in Golpark. After having called and fixed up a time, I landed there mid morning.

I remember the tastefully done apartment with terracotta items around. And the exquisite Kantha cushions and throws. I was to learn later that his wife, whom we affectionately call, Khukudi, was responsible for. She ran an NGO (which was started by her mother) of teaching destitute women the Bengal the legacy of Kantha stitching. Infact for a very long time, I had Khukudi’s adorable cushion covers adorn my home in Bombay.

“Esho bosho,” Ghose said. “Congratulations.”

“Thank you,” I replied.

“What will you have? Tea, coffee or something cold? You must have travelled a bit in this heat?”

“No. No. Not far. As a matter of fact, I live next door.”

“Where?”

“Here in Golpark, next to Mouchak.”

“What!” he exclaimed. “You’re from Golpark! Om Puri travelled all the way from Bombay to marry amar parar meye? Arrey, tumi to amar parar meye!”

he was extremely tickled and delighted to know that. And from then onwards he took on the onus like an older brother. And I started calling him Gautamda and his wife, Khukudi.

So the parar meye apart from being Mrs. Om Puri extended to a life long friendship. And good long adda sessions. Every trip to Kolkata would mean a chai and adda session at Gautamda’s spilling over to lunch or dinner.

Om also joined us many times. He first discovered that laoki (water gourd) can be delicious when prawns are added. He became a lifelong fan of Khukudi’s “lao chingri” and try however much we could not match upto her standards.

Many adda sessions also had the then city police commissioner Ain Rashid Khan strolling in from his apartment upstairs and participating in most things literary. Sometimes political.

Gautamda introduced me to his daughter, Oona was in school then and whom he unabashedly proclaimed named after Charlie Chaplin’s third wife, Oona O’Neil. “She also happened to be Eugine O’Neil’s daughter,” he never failed to add. Little Oona is married now and my neighbor in Bombay! He introduced me to his son, Ishaan, a total brat those days! Coincidentally, my son’s also called Ishaan.

We shared some beautiful times and meals…both in Kolkata and Bombay. Khukudi and Gautamda are excellent hosts and theirs was an open house…from filmmakers, writers, intellectuals and students….all were welcome. Khukudi’s exquisite saris and stoles still adorn many a Bombayites, though some haven’t paid for it…….taking advantage of her naivete!

Many mistake my husband Om Puri to be the lead in Paar. Many have lauded his performance in the film too! Yes he did a cameo and left an impact, but Paar belonged to Naseeruddin Shah and Shabana Azmi. It makes you wonder if people actually look at performers closely at all or promptly lump them together. Its like someone with little knowledge of cricket would easily mistake Zaheer Khan for Irfan Pathan.

But I remember Om mentioning he was very keen to work with Gautam Ghose ever since he had heard of his work. When his colleagues Naseer and Shabana were filming Paar, he was envious. Out of the blue, he got a telegram from Ghose, “Om SOS”. Despite the role being small and last minute call, Om was excited to work with Ghose. Paar won the National Award that year.

Some years later in 1992 when he was offered the lead by Ghose for Patang…this time he was overjoyed. He worked on his character including the Bhojpuri diction, as the film was based and mainly shot in Gaya. Patang won the National Award that year.

Though we didn’t meet often because of living in different cities, Om always held a fondness and respect for Gautamda. Both were the same age.

So here’s to a super seventh decade ahead and hoping to see a masterpiece once the pandemic is over. Till then stay safe and zoom addas.

Happy Birthday Gautamda.

লেখক পরিচিতিঃ লেখক এবং ওম পুরি ফাউন্ডেশনের প্রধান।

********************


গৌতম ঘোষ— ফিরে দেখা
নীলাঞ্জনা ঘোষ

‘ঋতবাক’ থেকে এই বিশেষ সংখ্যার জন্য গৌতমের বিষয়ে আমাকে লিখতে বলা হয়েছে। আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম... কিন্তু লেখা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে জীবন, সিনেমা আর সংসারের ঘূর্ণাবর্তের কোনখান থেকে শুরু করবো সেটা ঠিক করা খুবই কঠিন। মনে হচ্ছে তিনটি বিষয় নিয়েই সমান্তরালভাবে লেখা প্রয়োজন। এত বছরের স্মৃতি বিশদে একটি পত্রিকায় লেখা কি সম্ভব! চেষ্টা করবো কিছু কিছু ঘটনাকে তুলে ধরতে।

গৌতমের সঙ্গে আমার পরিচয় স্কুল জীবনের শেষে, শান্তিনিকেতনে। আমার দাদা ইন্দ্রজিতের বন্ধু। স্কুল শেষ করে আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। গৌতম সেই সময়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করছে। মাঝেমাঝে আমরা বন্ধুরা শ্যুটিং দেখতে যেতাম।

‘হাংরি অটম’ ডকুমেন্টারিতে আমার এক বন্ধুকে মৃতদেহের ভূমিকায় নির্বাচন করেছিলো। মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে পুরনো জামাকাপড় কিনে আনা হয়েছিলো। ওকে সৎকার সমিতির কর্মীরা ফুটপাথ থেকে মৃতদেহের মতো করেই ট্রেতে করে গাড়িতে ঢোকায়। আমি হলে যে কি করতাম! এই সময়ে ঐ ঘটনা সুদূর কল্পনারও বাইরে। শ্যুটিং সব সময়েই একটা উত্তেজনা তৈরি করে।

দাদার আরেক বন্ধু রাজা চট্টপাধ্যায় ঢাকুরিয়ায় ‘সায়ম’ নামে একটি দলের নাটক নির্দেশক ছিলো। গৌতম আর আমিও ঐ দলের সদস্য ছিলাম। রিহার্সালের সময়ে শাসন ছিলো, তার সঙ্গে আড্ডা আর হৈচৈও ছিলো।

আমরা বন্ধুরা তখন নানান সিনেমা দেখতাম। ফিল্ম ফেস্টিভালে বিভিন্ন দেশের ছবিও দেখতাম। তবে আন্তর্জাতিক সিনেমা সম্বন্ধে আমাদের উৎসাহিত করেছে। মনে আছে ওর উদ্যোগেই ফারনান্দো সোলানাসের ‘দ্য আওয়ার অফ দ্য ফারনেসেস’-এর মতো ফিল্ম দেখতে পেরেছিলাম। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্যে ভর্তি হই। বাবা-মা তখন কলকাতায় চলে এসেছেন। আমি তখন বাড়িতেই থাকতাম।

এই সময়ে মৃণালদার ‘ওকাউরি কথা’র প্রযোজকরা কলকাতায় আসেন মৃণালদাকে আরেকটি ছবি করার প্রস্তাব নিয়ে। মৃণালদা তখন অন্যান্য প্রতিশ্রুতি নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। উনি প্রযোজকদের ‘হাঙ্গরি অটম’ দেখতে বলেন। দেখে প্রযোজকরা গৌতমের সঙ্গে কাজ করার জন্যে খুবই উৎসাহিত হন। নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক হয় কিষাণ চন্দরের ঊর্দূ ঊপন্যাস ‘যব খেত জাগে’ অবলম্বনে অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে তেলুগু ভাষায় ছবিটি নির্মিত হবে। গৌতম এর আগে কখনও অন্ধপ্রদেশ যায়নি এবং ওদের ভাষা তেলুগুও ওর অজানা। প্রথম ছবির পক্ষে এটা অতিসাহস না দুঃসাহস আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌতম প্রথমে বাংলায় চিত্রনাট্য তৈরি করে তারপর গৌতম ইংরেজি চিত্রনাট্য তৈরি করে ও দু’জনে হায়দ্রাবাদ চলে যায় হায়দ্রাবাদে নরসিং রাও (‘মা-ভূমি’র একজন প্রযোজক) ও প্রাণ রাও-এর সহযোগে তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত চিত্রনাট্য প্রস্তুত হয়। এই বিশিষ্ট মানুষরা তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী বা সেই সময়ের রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। চিত্রনাট্য সম্পূর্ণ হওয়ার পরে আমার হায়দ্রাবাদ যাওয়ার কথা শ্যুটিং-এর প্রস্তুতিপর্বে অংশ নেওয়ার জন্যে। এই প্রথম আমার একা রেলযাত্রা। সময়টা ১৯৭৮। মাঝপথে জানতে পারলাম ধর্মীয় সংঘাতে হায়দ্রাবাদে কারফিউ! পৌঁছনোর কথা ছিলো রাত আটটায়। পৌঁছলাম আড়াইটার সময়ে। স্টেশনে তখন যাত্রীদের স্টেশনের বাইরে না বেরোনোর জন্যে ঘোষণা করা হচ্ছে। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হঠাৎ এক দীর্ঘকায় অপরিচিত মানুষ এসে জিজ্ঞেস করলেন আমার নাম খুকু কি না! উনি আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। ওঁকে অনুসরণ করা ছাড়া আমার কোনও বিকল্প ছিলো না। চারিদিক অন্ধকার। আমি স্কুটারের পেছনে সুটকেস নিয়ে বসে আছি। ক্রমাগত সাইরেনের আওয়াজ। কোথায় চলেছি জানা নেই। এক সময়ে একটা অন্ধকার বাড়ির সামনে পৌঁছে উনি বললেন ঐ বাড়িতেই গৌতমরা আছে। অন্ধকারের মধ্যেই ওদের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের সবার থাকার জন্যে চিকড়পল্লীতে একটা বাড়ি ঠিক হলো। সেখানে একদিকে ছবির প্রস্তুতি শুরু হলো, অন্যদিকে জননাট্যমন্ডলীর সদস্যদের যাতায়াত। সারারাত চারিদিক অন্ধকার ও সাইরেনের আওয়াজ। সে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা। রান্নাঘরের প্রধান দায়িত্বে ছিলাম আমি ও ভেঙ্কটেশ। সে খুবই ছোটো। কেউ কারও ভাষা বুঝি না। সব কিছু সত্ত্বেত্ত দুই অনভিজ্ঞর পরিচালনায় রান্নাঘর কিন্তু থেমে থাকেনি। এর কিছুদিন পরে আমরা পঞ্জাগুট্টায় আরেকটু বড়ো বাড়িতে যাই। সিনেমার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে বাজার, রান্না, মোটামুটি বেশ কয়েকজনের একটি সংসার চলছিলো। কলকাতা থেকে পার্থদা আগেই এসেছিলো। শ্যুটিং-এর আগে মুন্নাদা (কবি সনৎ দাশগুপ্ত), কমল নায়েক (চলচ্চিত্র গ্রাহক), শম্ভু (সব্যসাচী মুখার্জি) এবং আরও কয়েকজন কলকাতা থেকে এল। এখনকার প্রখ্যাত শিল্পী ও ‘মা-ভূমি’র শিল্প নির্দেশক টি ভৈকুন্ঠমও তখন আমাদের সঙ্গে ছিলো। এই ছবি আমাদের অনেকেরই প্রথম অভিজ্ঞতা। গৌতমের প্রথম কাহিনীচিত্র পরিচালনা। সাই চাঁদের প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয়, ভৈকুন্ঠমের প্রথম চলচ্চিত্রে শিল্প নির্দেশনা। আমি সহকারী পরিচালকের কাজ করবো ভেবেছিলাম কিন্তু পোষাক-পরিচ্ছদের দায়িত্বে কেউ ছিলো না বলে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখন অবধি সেই দায়িত্বই বহন করে চলেছি।

হায়দ্রাবাদ থেকে একটা মিনি ট্রাকে করে আমরা লোকেশনে গিয়েছিলাম। মঙ্গলপর্থি, একটি প্রত্যন্ত গ্রামে শ্যুটিং শুরু হলো৷ সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। একটা একতলা বাড়ি ও নরসিং-এর আত্মীয়র বাড়িতে ইউনিটের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো। মহিলাদের জন্যে ঐ আত্মীয়র বাড়ি। টেকনিকাল ইউনিটে আমি একমাত্র মহিলা কিন্তু অভিনয়ের জন্যে যে মহিলারা এসেছিলেন তাঁরা আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং তার সঙ্গে ভাষা সমস্যা। আমি ইউনিটের সঙ্গে স্কুলবাড়িতেই থেকে গেলাম। ‘মা-ভূমি’র শ্যুটিং-এর স্মৃতিচারণ আপাততঃ এখানেই শেষ করছি নাহলে অন্য বিষয়ে কিছু লেখার কোনও অবকাশ থাকবে না।

‘মা-ভূমি’র প্রথম শিডিউলের পরে কলকাতায় ফিরে আমাদের বৈবাহিক রেজিস্ট্রেশন হয়। শ্যুটিং শেষ হওয়ার পরে আমরা কলকাতায় ফিরে রুস্তমজী স্ট্রিটে গৌতমদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করি। আমার বাবা-মা তখন আমেদাবাদে আমার ছোটো দাদা চন্দ্রচূড়ের কাছে ছিলেন। কোনও সময়েই পারিবারিক কোনও ছন্দপতন হয়নি। গৌতমের বাবা-মা এবং ভাইদের সঙ্গে মহানন্দে জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হয়। গৌতমদের কোনও বোন নেই আমি যেন সেই শূন্যস্থান পূরণ করলাম। কোনওদিন কোনও বিরোধ হয়নি। তথাকথিত শ্বশুরবাড়ির সংজ্ঞা তাই আমি কখনও বুঝতেই পারিনি।

গৌতমদের বন্ধু জগাদার (জগন্নাথ গুহ) বাড়িতে গৌতমদের অফিস ছিলো। আমিও নিয়মিত ওদের সঙ্গে ওখানে বসে থাকতাম।

মনে আছে একদিন জগাদার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে সকালবেলায় আমি বেরিয়ে পড়ি... আমাকে কি রান্না করতে হয় না! আমি বলেছিলাম যে গৌতমের বাবা রান্না করেন। মেসোমশাই বলেছিলেন এরকম কথা উনি আগে শোনেননি!

গৌতমের বাবা রান্নার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিলেন এবং প্রতিদিন নিজে কি রান্না হবে ঠিক করে সেইমতো বাজার করে এনে রান্না করতেন। সেই সময়ে বাঙালি বাড়িতে যেটা প্রায় অভাবনীয় ছিলো।

১৯৮০-র শেষদিকে পশ্চিমবঙ্গ তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রযোজনায় সুশীল জানার ছোটো গল্প ‘আম্মা’ অবলম্বনে কাহিনীচিত্র ‘দখল’-এর প্রস্তুতি শুরু হয়। ঘুরে ঘুরে পোষাক-পরিচ্ছদ জোগাড় ও তৈরি করতে পারলেও শ্যুটিং-এ আমার যাওয়া হয়নি। খুব মন খারাপ হয়েছিলো কিন্তু উপায়ও ছিলো না। শ্যুটিং শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই আমাদের প্রথম সন্তান ঊনার জন্ম হয়। ১৩ই মার্চ নিউল্যান্ডস নার্সিংহোমে ঊনার জন্ম। শ্যুটিং-এর পরে তখন নার্সিংহোমের ঘরটাই প্রায় সিনেমার অফিস হয়ে উঠেছিলো।

তখন আমাদের সিনেমা জগতের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিলো না। ‘দখল’ তৈরি হওয়ার পরে কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই জাতীয় পুরস্কার নির্বাচনের জন্য পাঠানো হয়। একদিন সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি বাড়ির সামনে অনেক লোকজন। কিছু বুঝতে না পেরে একটু অবাকই হই। হঠাৎ একজন মাইক হাতে এগিয়ে এসে জানতে চান ‘কেমন লাগছে!’ আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। তারপর জানতে পারি ‘দখল’ শ্রেষ্ঠ কাহিনীচিত্রর পুরস্কার পেয়েছে। ওঁরা অল ইন্ডিয়া রেডিত্ত থেকে এসেছেন। উপেন তরফদারও এসেছিলেন। সেরকম কোনও যোগাযোগের উপায় না থাকায় আমরা গৌতমের বাড়ি ফেরার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। গৌতম ফেরামাত্র হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেলো। সে বছর অপর্ণা সেনের ‘থার্টি সিক্সস চৌরঙ্গী লেন’-এর জন্যে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান। শুরু হয়ে যায় আমাদের যৌথ উদযাপন। পরদিন সক্কালবেলা মৃণালদা অভিনন্দন জানাতে বাড়িতে এসেছিলেন। এই মানুষটির সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক আজীবন অক্ষুন্ন ছিলো।

১৯৭৮ সালে ‘মা-ভূমি’ তৈরির প্রস্তুতি থেকে ২০২১ সালে ‘সময়ের স্মৃতিমালা’ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির স্মৃতি এই পত্রিকায় লেখার অবকাশ নেই। কিছু অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করার চেষ্টা করছি। সময় ও সিনেমার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন ও সংসার অতিবাহিত হয়। ১৯৮৭ সালে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র শ্যুটিং-এর সময়ে ঈশানের বয়স ছিলো ৪ মাস। সন্তানরাও এই পরিবেশের মধ্যেই বড়ো হতে থাকে। নিজেদের মতো করে নিজের দেশ ও মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। সিনেমার পরিবেশে বড়ো হওয়ায় দু’জনেরই সিনেমা সম্বন্ধে প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ।

গৌতম সব সময়েই বিভিন্ন বিষয়ে, নানা স্তরের মানুষকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। আমারও তাই আমাদের দেশ ও বাংলাদেশের নানা জায়গায় কাজ করার সময়ে বিভিন্ন সামাজিক/অর্থনৈতিক স্তরের মানুষদের কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে, যা অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত মূল্যবোধকে সমৃদ্ধ করেছে।

লেখক পরিচিতিঃ পরিধেয় শিল্পী।

1 comments: