Next
Previous
Showing posts with label পথেপ্রবাসে. Show all posts
0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী- পর্ব ৬

১৮ই এপ্রিল ২০১৯ – মাচু পিচুর(MACCHU PICCHU) পথে

যখন প্রথম পেরু যাওয়ার পরিকল্পনা করি, তখন থেকেই মাথায় ছিলো যে মাচুপিচু যাবো নিজেরা- কোনো কন্ডাকটেড ট্রিপে নয়। নিজেরা যাওয়ার ঝক্কি অনেক, কিন্তু ঠিকভাবে প্রাণ ভরে দেখতে গেলে অন্য আর কোনো রাস্তাও নেই। অতএব ঝক্কিগুলো আগে থেকে জেনে বুঝে ব্যাবস্থা নেওয়াই ভালো।

প্রথম বাধা হচ্ছে মাচুপিচু ঢোকার পাস। মাচুপিচুতে রোজ মাত্র আড়াইহাজার লোক ঢোকার অনুমতি পায়। আর সেই অনুমতি পাওয়া যায় বছর খানেক আগে থেকে। শুনেছি, যেদিন থেকে শুরু হয়, তার কদিনের মধ্যেই ঐ নিদ্দিষ্ট দিনের টিকিট শেষ হয়ে যায়- এমনই এর চাহিদা। সুতরাং তক্কে তক্কে ছিলাম। অবশেষে ১৫ ই আগষ্ট রিজার্ভেশন পেলাম দুপুর বারোটায় যাওয়ার জন্য আজকের জন্য।

পরবর্তী প্রতিবন্ধক ছিলো ট্রেনের টিকিটের। সেটাও ঐ আগষ্ট মাসে পেরু রেলের ওয়েসাইটে পাওয়া গেলো। কেটে ফললাম কুজকো পোরয় স্টেশন থেকে এ্যাগুয়াস ক্যালেনটিস (Aguas Calientes) যাওয়ার টিকিট। যদিও পরে পেরু রেল জানায় যে বৃষ্টিতে ধস নামার জন্য কুজকো থেকে ট্রেন চলবে না- তার বদলে ওরা বাস দেবে ওলানটেটাম্বো পর্যন্ত এবং ওখান থেকে ট্রেন। ফেরার সময়ও একই ব্যাবস্থা। এছাড়া মাচুপিচু স্টেশন থেকে মাচুপিচু সাইট অনেকটা রাস্তা আর একটি মাত্র সংস্থা বাস চালায়। তাদের টিকিটও কাটা হয়েছিলো অনেক দিন আগে। মোট কথা, সব রকম ব্যাবস্থা তৈরী ছিলো যাতে কোনো অসুবিধা না হয়।

বাস যেহেতু ভোর ৫-৪০ তে, বাস স্টেশন যেতে হবে সকাল পাঁচটায়। তার জন্য আগে থেকে ট্যাক্সি বুক করাটা জরুরী ছিলো। আর মাচুপিচুতে গাইড ছাড়া যাওয়া আর অগাধ সমুদ্রে সাঁতার কাটা এক জিনিষ তাই একজন ইংরাজী জানা গাইডেরও ব্যাবস্থা করেছিলাম। বেঁচে থাক ওয়েব সাইট – এই সবকিছুই অন লাইনে করা।

ভোরবেলা উঠে তৈরী হতে না হতেই ট্যাক্সি চলে এল। বাস স্টেশনে এসে প্রথমেই ওরা টিকিট ও পাসপোর্ট দেখে টিকিটে স্ট্যাম্প মারলো- ওটা হলো যাওয়ার ছাড়পত্র। তারপর অন্ধকারে চাপলাম বাসে। একটা বাস নয়, অজস্র বাস- এক একটা বাসে লোক যেই ভর্তি হয়ে যাচ্ছে তখন পরের বাস এগিয়ে আসছে। আমাদের বাস ছাড়লো তখন ঠিক ৫-২০, তখনও বাইরে অন্ধকার। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না। ঘন্টাখানেক পর বাস দশ মিনিট থামলো – তখন সবে দিনের আলো ফুটছে। দু একটা পাখী ডাকা শুরু করেছে। বাস আবার তার চলা শুরু করে সকাল সাড়ে সাতটায় এল ওলানটেটাম্বো।

আমাদের ট্রেনের নাম্বার ছিলো ৩৩, ছাড়ার সময় ৮-২৯। কিন্তু স্টেশনে যেই এলাম, দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে। তড়িঘড়ি উঠতে গেলাম আমাদের নিদিষ্ট কোচ “এ” তে। প্রত্যেক কোচের সামনে টাই পরিহিত কোচ কনডাকটার দাঁড়িয়ে। এ কোচের সামনে টাই পরিহিত সুন্দরী টিকিট চেকার টিকিট দেখে বললেন ৮-১০ তে আসতে। টিকিটে লেখা ছিলো ট্রেন স্টেশনে আসবে ৮-১০ তে। ঐ ট্রেন চলে গেলো। পরক্ষণে আবার একটি ট্রেন নাম্বার ৩৩ এলো। এবার বুঝলাম যে ট্রেন ৩৩ একটা নয়, অজস্র। যার টিকিটে যখন ট্রেন আসবে সেটা মিলিয়ে উঠতে হবে। আমাদের ৮-১০ এর ট্রেনের আগে প্রায় খান পাঁচেক ট্রেন গেলো- সবাই ট্রেন ৩৩।

মাচুপিচুর ট্রেনে দু রকম ক্লাস আছে। একটার নাম ভিসটাডোম – যেখানে জলখাবার দেওয়া,বিরাট কাঁচ আছে জানালায়- দেখার জন্য। সে তুলনায় এক্সপিডিশন ক্লাস অতোটা কুলীন নয়, তবে মন্দ না। এখানে খাওয়াদাওয়ার পাট নেই আর জানালা ও সীট অতোটা বড়ো নয়। সকালে ভিসটাডোম ক্লাসের প্রথম ট্রেন সকাল নটায় , কাজেই বাধ্য হয়ে এক্সপিডিশন ক্লাস নেওয়া। তাছাড়া ভাড়ার তফাত অনেকটা। ফেরার পথে ভিসটাডোম ক্লাসে ফিরেছিলাম, সেখানে খাওয়া দাওয়ার সাথে ফ্রি পেয়েছিলাম নাচ গান আর ফ্যাশন শো।


ট্রেন ছাড়লো। আহামরি কিছু দৃশ্য পড়লো না একদম শেষদিক ছাড়া। জানালা ভালো নয়, ফলে ছবি তোলার জন্য একটু এগিয়ে দরজার কাঁচের মধ্যদিয়ে ছবি তুলে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। শেষ দিকে যখন মাচু পিচু আসবো আসবো করছে, তখন দৃশ্যপাট অপূর্ব ।

স্টেশনে নামলাম তখন সকাল পৌনে দশটা।

দেখি যে কোম্পানী থেকে গাইড নিয়েছি সেই কোম্পানীর একটি মেয়ে – নাম মারিয়া - নামের বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা পরিচয় দিতে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন যে আমাদের গাইডের নাম হচ্ছে ভিক্টর – মাচু পিচুর গেটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আমাদের একটি ফটো তুলে হোয়াটস এ্যাপে গাইডকে পাঠিয়ে দিলেন যাতে গাইড আমাদের খুঁজে নিতে পারেন। তারপর বললেন আমার সাথে এসো- বাসের লাইন দিতে হবে।

বাসে লাইন কেন? আমরা তো অবাক। ভেবেছিলাম টিকিট কাটা আছে- যাবো আর বাসে উঠবো। কিন্তু তা নয়। দেখি টিকিট সবারই আছে কিন্তু শ-শ লোক দাঁড়িয়ে লাইনে- তাদের প্রত্যেকের হাতেই টিকিট। আমাদের যেহেতু বেলা বারোটায় ঢোকার পারমিট- আমাদের আলাদা লাইন। আমরা সেই বারোটার লাইনে দাঁড়ালাম- আমরাই প্রথম। ক্রমে শ-য়ে শ –য়ে লোক দাঁডিয়ে গেলো আমাদের পিছনে। মারিয়া বলে দিয়েছিলো মাচুপিচুতে একটাই খাবার দোকান আর দাম তিনগুন - কিছু পাওয়ার সম্ভবনাও কম। অতএব খাবার এখান থেকেই নিতে হবে। কিন্তু এখানেও খাবারের দাম অনেক ওপরে আর মান অনেক নিম্ন। উপায় নেই তাই খান তিনেক ভেজ স্যান্ডউইচ নিয়ে নিলাম, যেগুলো ছিলো অখাদ্য।

অতঃপর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আর অপেক্ষা। প্রায় দেড়ঘন্টা কষ্ট ভোগ করলাম। মাঝে আবার বৃষ্টি নামলো। সঙ্গে ছাতা ছিলো। দশ মিনিটে বৃষ্টি শেষ হয়ে ঝকঝকে রোদ উঠলো- এ অঞ্চলে যা বিরল।

ঠিক বারোটায় মাচু পিচুর গেটে নামলাম। নামতেই এক গাল হেসে এক সৌম্য দর্শন ভদ্রোলোক এগিয়ে এলেন। বললেন, আমার নাম ভিক্টর, আমি তোমাদের গাইড। দেখলাম হোয়াটস এ্যাপের পাঠানো ফটো ও বাসের নাম্বার থেকে ভদ্রোলোক ঠিক বের করেছেন। আমরা টিকিট ও পাসপোর্ট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম সোয়া বারোটা।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইনকা রাজা পাচাকুয়েকের আমলে প্রথম মাচুপিচুর সৃষ্টি । তারপর শ খানেক বা তার বেশী সময় ধরে মাচুপিচু থাকলেও একসময় মাচুপিচু আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত হয়। কেউ দাবী করেন এখানে অভিজাত লোকেরা থাকতো, বিশেষ করে শেষ দিকে , ফলে যাতায়াতের রাস্তা ক্রমে অগম্য হয়ে যায়, আবার কেউ বা বলে কোনো মহামারীতে মাচুপিচু পরিত্যক্ত হয়। ঘটনা যাই হোক না গেলো মাচুপিচু হারিয়ে গিয়েছিলো আর ধীরে ধীরে জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যায় বহু বছর।

বহু পরে, বিংশ শতাব্দীতে বিখ্যাত আর্কিটেক্ট হিরাম বিংহাম( Hiram Bingham) এখানে এসে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ইনকাদের হারানো শহর – কেন না ওনার দৃঢ় ধারণা ছিলো কোথায় না কোথায় পুরানো এক শহর আছে। তখন একদিন একটি বাচ্চা ছেলে সাহেবকে বলে যে, সাহেব, তুমি যা খুঁজছো, ওরকম এক শহর আমি জানি- জঙ্গলে আমি তার কিছু নিদর্শন পেয়েছি। তমন হিরাম সাহেব ১৯১১ সালে প্রথম এই মাচু পিছু আবিষ্কার করেন।

মাচু পিচুর সৌন্দর্যর প্রধান কারণ এখানে পাহাড়গুলি খাড়াই উঠে গেছে আবার আচমকা শেষ হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে যেন বিভিন্ন পর্বত তার চূড়া মেলে দিয়েছে। সবগুলি সবুজে মোড়া আর তার মাঝে ভগ্নস্তূপ, রাস্তা, বাড়ী- সব মিলে মনোরম শোভা।

ভিক্টর প্রথমে আমাদের ওপরে নিয়ে গেলো। ওপরে উঠছি তো উঠছি-ই- খাড়াই সিঁড়ি- পাথরের ধাপ – একটু করে উঠছি আর হাঁপিয়ে যাচ্ছি। একটা সুবিধা ছিলো যে মাচুপিচু কুজকোর থেকে খানিকটা নীচে- ৮৮০০ ফুট উচ্চতায়- ফলে উচ্চতা জনিত অসুবিধা প্রায় নেই। ধাপে ধাপে ওপরে উঠছি আর ছবি তুলছি- ধ্বংসস্তূপের – বিভিন্ন দিক থাকার থেকে বিভিন্ন ভঙ্গীতে- তাও যেন মন ভরে না। একদম সর্বোচ্চ্য শিখরে ওঠার পর আবার ধাপে ধাপে নামা- এবার এক একটি জায়গায় ধ্বংসস্তূপের ভিতর দিয়ে। কোথাও ইনকাদের বাড়ী , কোথাও বা অভিজাত সম্প্রদায়ের থাকার জায়গা, কোথাও বা মন্দির, কোথাও বা ওয়ার্কশপ আবার কোথাও বা পাঠশালা। পরবর্তী তিনটে ঘন্টা শুধু উঠছি, নামছি আর দেখছি। অবশেষে যখন তিনটে বাজলো- শরীর আর চলছে না, হাঁটু দুটো বিদ্রোহ করছে আর আমাদের সাড়ে চারটেয় ট্রেন, সেটা ধরতে পারবো কিনা সে চিন্তাও ছিলো, অতএব ফেরার পালা। আবার বাসের জন্য দীর্ঘ লাইন, তারপর ট্রেন, আবার বাস ও পরে ট্যাক্সি ধরে হোটেলে যখন এলাম- রাত দশটা বেজে গিয়েছে।


















১৯শে এপ্রিল ২০১৯- কুজকো থেকে সেক্রেড ভ্যালি ও সাউথ ভ্যালি
আজ একটু সকাল সকাল বেরুতে হলো। প্রধান কারণ – আজ অনেককিছু দেখার আছে। প্রথমে দেখবো সেক্রেড ভ্যালির দুই অবশিষ্ট দ্রষ্টব্য সাকসাহুয়ামান (Sacsayhuaman)

ও পিসাক ভ্যালি। তারপর যাবো সাউথ ভ্যালি। এখানেও খান চারেক দ্রষ্টব্য আছে। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড মারকো সাড়ে সাতটায় হাজির। হোটেলের অসাধারণ ব্রেকফার্স্ট চিবুতে চিবুতে উঠে বসলাম গাড়ীতে। গাড়ী চললো সাকসাহুয়ামান। সাড়ে বারো হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের মাথায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইনকা রাজা পাচাকুয়েকের বানানো এ এক অমর সৃষ্টি । ৩০০০ হেক্টর জায়গার ওপর এই বিশাল কান্ডতে অনেক পাথরই একশো টনের বেশী ওজন। সেগুলো কারাই বা ওপরে আনলো আর কারাই বা তার ধার কেটে গ্রুভ বানিয়ে ভূমিকম্প নিরোধী ইন্টারলকিং করে পাথরগুলো সাজালো সে এক রহস্য।






সাকসাহুয়ামান এক বিরাট জায়গা। ভালো করে পুরোটা দেখতে গেলে সারাদিন লেগে যাবে। অতোটা সম্ভব নয়- এক তো সময়ের অভাব দ্বিতীয়ত পা বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। কাজেই দেড় ঘন্টা ধরে যতোটা পারলাম দেখলাম। মারকো অনেক স্কেচ এনেছিলো সেগুলো দেখে সম্যক আইডিয়া হলো। মারকো বললো এটা বানানো হয়েছিলো মন্দির হিসাবে কিন্তু স্প্যানিশরা এর বিরাট বিরাট পাথরের দেওয়াল দেখে একে দুর্গ মনে করে আক্রমণ করে। কিন্তু ঐ ভারী পাথরদের টলাতে পারেনি।

বেলা দশটা নাগাদ এলাম ত্রিশ কিলোমিটার দূর পিসকোর পথে। এটাও পাহাড়ের ওপর। মনে মনে ভাবছিলাম, হায় রে, ইনকারা সব কিছু কেন পাহাড়ের মাথায় করেছে? এক আধটা তো মাটির লেভেলে বানাতে পারতো! ১২০০০ ফুট ওপরে পিসাক বহু শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে। এখানে অজস্র টেরেস বানানো চাষ আবাদের জন্য, প্রচুর খাড়া দেওয়াল তোলা পিসাককে রক্ষার জন্য। অজস্র বাড়ী,ইনকাদের চানের জায়গা এবং সংরক্ষিত মৃতদেহ রাখার বিরাট জায়গা, টানেল- সবমিলে এক বিস্তীর্ণ জায়গ জুড়ে বিরাট যজ্ঞ। এখানেও বারংবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, পাথরের সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে পা আবার থরথর করে কাঁপছে মাঝে মাঝেই । তাই ঘন্টা খানেক ঘুরে ক্ষান্ত দিলাম। ধীরে ধীরে নেমে এলাম গাড়ীতে।










মারকো আবার যাত্রা শুরু করলো। এবার চলেছি সাউথ ভ্যালি। অনেকটা রাস্তা সেক্রেড ভ্যালি থেকে। মাঝে মাঝেই পথের দু ধারে পড়ছে কিনোয়া অথবা ভুট্টার ক্ষেত। অবশেষে বেলা একটায় এলাম আনডাহুয়ালিলাস(Andahuaylillas) চার্চ । কুজকো থেকে ৪১ কিলোমিটার দূর আর ষোড়শ শতাব্দীতে বানানো এই চার্চের ভিতরে অসাধারণ কাজ আছে। বিভিন্ন রঙ্গীন আঁকা মুর‍্যাল দেখে মন ভরে গেলো।






বেলা দুটো বাজে, ক্ষিদে পেয়েছে প্রচন্ড। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য – আজ গুড ফ্রাইডে বলে সব দোকান বন্ধ। তাই ক্ষিদে চেপে চললাম পিকিলাকটার(Piquillacta) দিকে। পিকিলাকটা হচ্ছে প্রাক ইনকা যুগে বানানো একটি ছোট শহর- ওয়ারি সম্প্রদায়ের লোকেরা ৬০০-১০০০ সালে বানিয়েছিলো। এই ধংসস্তুপের কথা আলাদা করে কিছু বলবো না কেননা এখানের সৌন্দর্য রুক্ষ- শুধু পাথরের দেওয়ালগুলি অবশিষ্ট আছে।



ক্ষিদের চোটে বেশীক্ষণ সময় দিলাম না। আড়াইটে নাগাদ চললাম সাউথ ভ্যালির শেষ গন্তব্য স্থল টিপোনের(Tipon) দিকে। 

৫০০ একর জায়গার ওপর বানানো টিপন হচ্ছে ইনকা যুগের আর এক আশ্চর্য জায়গা। টিপনে অজস্র টেরেস বানানো হয়েছিলো চাষ আবাদের জন্য আর তার জল দেওয়ার জন্য ছিলো এক অদ্ভুত ব্যাবস্থা। পাহাড়ের ওপর এক সূর্যমন্দির আর সেখানের ভূগর্ভস্ত্য জলকে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে টেরেসে পাঠানো হয়েছে যাতে জলের সুব্যবস্থা থাকে। আজ থেকে পাঁচশো বছর আগের চ্যানেলে আজও জল বয়ে যাচ্ছে। ওপরে অনেকক্ষণ বসলাম। ঠান্ডা হাওয়াতে শরীরের আরাম হচ্ছিলো। 










অবশেষে বিকাল চারটেয় ওখান থেকে ফেরার রাস্তা ধরা। কুজকোর “প্লাজা দ্য আরমাসে” এসে খানিকক্ষণ বসে চললাম কুজকোর প্রধান আকর্ষণ কোরিকাঞ্চার মন্দিরে।











কোরিকাঞ্চার মন্দির কুজকোর বুকেই - প্লাজা দ্য আরমাস থেকে দশ মিনিট হাঁটা রাস্তা। ইনকা আমলে কুজকো ছিলো রাজধানী আর তার প্রধাণ আকর্ষণ ছিলো কোরিকাঞ্চার অর্থাৎ সোনার মন্দির। সূর্য দেবতার মন্দির ছিলো সোনা দিয়ে মোড়া। “সূর্য কাঁদলে সোনা” বই তে পাতার পর পাতা কোরিকাঞ্চা মন্দিরের ওপর লেখা পড়ে মনে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে । টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। আতাহুয়ালপার মুক্তির জন্য এখানকার কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা গেছে স্প্যানিশদের গর্ভে । তাতেও শান্তি পায় নি স্প্যানিশদল। মন্দিরের অধিকাংশ অংশ ভেঙ্গে গড়ে তুলেছে গির্জা সান ডোমিনাগো। সব কিছু ভাঙলেও মন্দিরের ফাউন্ডেশন ও কিছু অংশ আপ্রাণ চেষ্টা করেও ভাঙ্গা যায় নি- এমনই মজবুত। গির্জায় খানিকক্ষণ কাটিয়ে মন্দিরের যা অবশিষ্ট-তা দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে।এককালে এর সব পাথরেরে দেওয়াল ছিলো সোনায় মোড়া। আজ তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। একটা সূর্য ঘড়ি ছিলো তার কিছুটা অংশ পড়ে আছে। ইনকা আমলে সূর্য যখন উত্তরায়নে যেতো অর্থাৎ ২৩ শে জুন, তখন কোরিকাঞ্চার পুরোহিত বিরাট শোভাযাত্রা করে যেতেন সমস্ত ধন দৌলত নিয়ে এমনকি মৃত সব ইনকাদের ও মমি থাকতো শোভাযাত্রায়। যাওয়া হতো সাকসাহুয়ামান-এর মন্দিরে। আজও এক সপ্তাহ ব্যাপী ইনকা রাইমি অনুষ্ঠান পালিত হয় কুজকোয় প্রতি বছর।


কোরিকাঞ্চার মন্দির দেখার পর গেলাম কোরিকাঞ্চা মিউজিয়ামে। এখানে কিছু প্রত্নত্মাতিক নিদর্শন রাখা আছে। খানিকক্ষণ দেখে বিকাল ছটায় ক্লান্ত শরীরটাকে আরাম দেওয়ার জন্য চলে এলাম হাঁটাপথে হোটেলে।

২০ই এপ্রিল ২০১৯- কুজকোতে

আজও সকাল আটটায় গাড়ী এসে হাজির। আজকের গন্তব্য কুজকোর কাছের তিন ইনকা যুগের নিদর্শন । তার প্রথমটি হলো টাম্বোমাচায়(Tambomachay) – এটি কুজকোর থেকে প্রায় ছ কিলোমিটার দূর। ১২৩০০ ফুট উচ্চতায় এই জায়গাটি অনেকখানি পরিসর নিয়ে তৈরী। এখানে ভু গর্ভস্ত জলকে ক্যাসকেডিং করে আনা হয়েছে। এটি প্রধানত বিশ্রাম ও চানের জায়গা বলে পরিচিতি ছিলো ইনকা আমলে যাকে আজকের দিনে আমরা বলি শাওনা বাথ।

এর থেকে বেরিয়ে অল্প দূরে একটি ভগ্নস্তুপ- যার শুধু দেওয়াল গুলি অবশিষ্ট আছে। এর নাম পুকাপুকারা (Pukapukara) অর্থাৎ লাল দুর্গ ।এই বাড়ীটি ছিলো ইনকাদের মিলিটারী বেস। এছাড়া যে সব ডাক হরকরা, যাদের চাসকি বলা হতো তারা এখানে বিশ্রামও নিতো। আজ এর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।





 পুকাপুকারার পর আমাদের শেষ গন্তব্য স্থল হলো কোয়েনকো(Qenqo) – প্রায় দু কিলোমিটার দূর। কোয়েনকো একটি পাহাড়ী গুহার মধ্য দিয়ে একটি বিরাট পাথরের বেদী। এখানে বলি দেওয়া হতো ইনকা আমলে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে। যে পাথরের ওপর এতো বলি হয়েছে, তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। এখন কিরকম নিরীহ ভাবে পড়ে আছে কিন্তু কতো বলির সাক্ষী হে পাথর- তুমি নীরব কেন?






কুজকোয় প্রায় সবকিছুই দেখা হলো। তবুও যেন মন চাইছিলো না কুজকো ছেড়ে যেতে। মন চাইছিলো আরো কদিন থাকি, ইতিহাসকে আঁকড়ে রাখি আরো কটা দিন নিজের মতো করে। কিন্তু উপায় নেই। দেখতে দেখতে লিমা যাওয়ার প্লেনের সময় হয়ে গেলো। তাই হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে চেক আউট করলাম। ট্যাকসি করে এলাম আধ ঘন্টার রাস্তা কুজকো এয়ারপোর্ট , তারপর ওখান থেকে দেড় ঘন্টার ফ্লাইটে এলাম লিমা। আশ্রয় নিলাম আগের হোটেলেই।

২১ শে এপ্রিল ২০১৯- বিদায় বেলায়

লিমায় যা দেখার, আসার পথে মোটামুটি তা দেখে ফেলেছি। বাকী ছিলো হুয়াকা পুকলানা(Huaca Pucllana), যেটা আমাদের মিরাফ্লোয়েসের হোটেল থেকে খুব একটা দূর নয় -বলা যায় হাঁটা রাস্তা। এটা প্রাক ইনকা যুগের সূর্য মন্দিরের ধংসস্তূপ। কিন্তু কি জানি কেন, শরীর আর মন দুই সায় দিলো না। কুজকো দেখার পর নতুন করে আর কিছু দেখার উৎসাহটাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। অতএব হুয়াকা পুকলানা বাদ দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম লারকোমার (Larcomer) । প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর এই তিনতলা ম্যলটি অসাধারণ। সমুদ্রর বাঁকের ওপর এই ম্যলে অনেকগুলি ব্যালকনি আছে, যেখান থেকে সমুদ্রর রূপ সামনা সামনি প্রত্যক্ষ করা যায়। 

আছে অনেকগুলি মন মাতানো খাবারের ফুড কোর্ট । অসাধারণ কফি, অজস্র দোকান- বিশেষ করে বেবী আল্পাকার সোয়টার ,চাদর, স্কার্ফ কেনার জন্য আদর্শ। ওখানে প্রচুর কেনাকাটা , খাওয়া দাওয়া করে সারাটাদিন আনন্দে কাটালাম। তারপর বিকাল বেলায় হোটেল ফেরা ও ওখান থেকে লিমা এয়ারপোর্ট। আবার সেই বারো ঘন্টার ফ্লাইটে আমস্টারডাম ও ওখান থেকে ঘন্টা খানেকের আর একটি প্লেনে লন্ডন। আর এই সাথে শেষ হলো আমাদের প্রথম লাতিন আমেরিকার পেরু ভ্রমণ। বেড়ানো শেষ কিন্তু মনে দাগ রয়ে গেলো চিরস্থায়ী।

সমাপ্ত
0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতীম মল্লিক

Posted in




পেরুতে বেড়ুবেড়ু [ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী- পর্ব ৪]
দীপ্ত প্রতীম মল্লিক

পুনো, কুজকো

পুনো হচ্ছে প্রায় ৩০০ কিমি দূর আরুকিপার থেকে। কিন্তু দূরত্ব এখানে অন্তরায় নয়, অন্তরায় হচ্ছে উচ্চতা। আরুকিপার উচ্চতা ছিলো আট হাযার ফুটের তলায়, সেখানে পুনো হচ্ছে ১২৭০০ ফুট উচ্চ্তায়। শুধু কি তাই? মাঝে পার হতে হবে ১৫০০০ ফুটের একটি পাস। অতএব চিন্তা ছিলো উচ্চতা-জনিত কোনও বিপদের সম্মুখীন না হই। পেরু হপ বাস আসার কথা ছিলো সকাল ৫-১৫তে। কিন্তু বাস এলো খানিক পরে। ফলে জলখাবার খাওয়ার যে বিরতি ছিলো সেটা হলো কাটছাঁট। দশ মিনিট একটা সুপার মার্কেটের সামনে বাস দাঁড়াতে ওখান থেকে কিছু খাবার ও জল কেনা হলো। জল নাকি এ পথে অতি প্রয়োজনীয়। উচ্চতার সঙ্গে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে জল।

বাস উঠতে শুরু করলো। উঠছে তো উঠছেই। পথের দু পাশে ন্যাড়া পাহাড়। গাছপালা প্রায় নেই। ঠাণ্ডা, বরফ পড়া ও উচ্চতা হয়ত বা এই তিন কারণে এখানে সব পাহাড় ন্যাড়া। অবশেষে বেলা দশটায় বাস থামলো একটি শৃঙ্গর কাছে। গাইড জানালেন এখানে প্রচুর লেগুন আছে। বাস থেকে নেমে এগুতে গিয়ে দেখি কি বিপদ! পা যেন এগুতেই পারছি না! বিরাট বিরাট শ্বাস নিচ্ছি, কিন্তু তাতেও যেন হচ্ছে না- কোথায় যেন অসুবিধা হচ্ছে। আমার একার নয়, সবারই এক অবস্থা। বুঝলাম এ হচ্ছে উচ্চতা-জনিত অসুবিধা। অতএব সাবধান - ধীর পদক্ষেপে চলো আর কোনও তাড়াহুড়া নয়। শ খানেক মিটার এগিয়ে ছিলো লেগুনের ভিউ পয়েন্ট। প্রায় পাঁচশো ফুট নীচে বিরাট লেক। গ্লেসিয়ার আর বৃষ্টির জল এর উৎস। অজস্র পাখী, কেউ বা লেকের জলে চক্কর কাটছে, আবার অনেকেই নিছকই উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রাণভরে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এবার ফিরে যাওয়া। ঐ একশো মিটার যেন কয়েক কিলোমিটার ! লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে বাসে ফিরে এলাম।

বাস আবার চলা শুরু করলো। ক্রমে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বারবার জল খাচ্ছি, বুঝতে পারছি অক্সিজেনের অভাব শরীর মেনে নিতে পারছে না। বাইরে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে শরীরের কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছি। এইভাবে কেটে গেলো কয়েক ঘন্টা। অবেশেষে বেলা একটায় গাইড ঘোষণা করলেন আমরা পুনোয় এসে গিয়েছি। পুনোতে বড়ো বাস ঢুকবে না, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা গাড়ী আছে।

আমাদের বুকিং ছিলো হোটেল তিয়েরা ভিভা পুনোতে। প্রচণ্ড সরু সরু পাথরে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে এলাম “প্লাজা দ্য আরমাস”। এর পিছনেই আমাদের হোটেল। চেক ইন করা গেলো। মালপত্র ওরা পৌঁছে দিলো। এখানে উচ্চতার জন্য লাগেজ হোটেলের লোকেরাই পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে। শুধু এখানে নয়, আরুকুপা থেকে কুজকো সব জায়গাতে এই নিয়ম মানতে দেখেছি। যেটা আমাদের- মানে সমতল এলাকার লোকেদের প্রভুত সাহায্য করেছে।

পুনোয় খাওয়াদাওয়ার পর ধীরে ধীরে মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো। মাথার যন্ত্রণা, শ্বাস নিয়ে মন ভরে না –প্রাণপণ শক্তিতে শ্বাস নিয়েও যেন মনে হচ্ছে কিসের অভাব। অভাবটা যে অক্সিজেনের সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছি। অতএব অলস ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকা। যেন মনে হচ্ছে প্রচণ্ড জ্বর হয়েছে - এমন কষ্ট আর যন্ত্রণা। ভেবেছিলাম, যে জন্য পুনোয় আসা – সেই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু লেক(যেখানে বোট চলে) একবার দর্শন করবো। ১২৫০০ ফুট ওপরে ১২০ মাইল লম্বা আর ৫০ মাইল চওড়া এই লেক পেরু ও বলিভিয়ার অংশ। কথিত যে প্রথম ইনকা সম্রাট মাংকো কাপাক এই লেক থেকেই উঠে আসেন। আরো কথিত যে যখন সোনার লোভে স্প্যানিশরা সোনার লোভে কুজকোর কোরিকাঞ্চা মন্দিরের সোনা লুটতে ব্যাস্ত, তখন পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যর অনেক সোনা এই হ্রদের জলে ফেলে দেওয়া হয় যাতে বিদেশীরা এর সন্ধান না পায়। মোদ্দা কথা প্রচুর রহস্যে ঘেরা এই হ্রদ দেখার প্রবল বাসনা থাকতেও শরীর করলো বিরোধিতা, অতএব আজ থাক, কাল দেখা যাবে। 

সারা রাত ছট ফট করতে করতে অবশেষে ভোরের দিকে ঘুম এলো।

১৫ই এপ্রিল ২০১৯- উরোস(UROS) ও তাকিলা(TAQUILE) দ্বীপ ভ্রমণ

সকালে উঠে বুঝলাম কষ্ট অনেক কম। এককাপ গরম চা খেয়ে মাথার কষ্টটা গেলো। আজ আমাদের সারাদিনের বোট ট্রিপ আছে- কাল ভাবছিলাম সেটা বোধহয় এ যাত্রা হলো না। কিন্তু আজ সকালে মনে হলো- হ্যাঁ ,পারবো। সকাল আটটা থেকে সারাদিনের বোট ট্রিপ। ফিরবো বিকাল পাঁচটা। আমাদের বোট ট্রিপ প্রথমে নিয়ে যাবে আধঘন্টার রাস্তা উরোস আইল্যান্ড। এক্ষেত্রে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে উরোস একটা জাতি, যারা বহু বছর আগে (হাজার বছর তো হবেই) আমাজনের দিক থেকে এখানে আসে ও লেক তিতিকাকার ধারে বসবাস শুরু করে। ৫০০ বছর আগে ইনকা রাজার আমলে এরা ধীরে ধীরে লেকের জলে দ্বীপ ভাবখানা এই যে আমরা কারুর অধীন নয়। লেকের জলে প্রচুর বড়ো বড়ো ঘাসের মতো গাছ জন্মায়, যার গোড়া খুব শক্ত ও জলে ভাসে। কয়েকটি উরোস পরিবার দিবারাত্র পরিশ্রম করে লেকের জলের ঐ ঘাসের জঙ্গল মাপমতো কাটে। ঐ রকম কয়েকটি জঙ্গল যেগুলো ৬০/৭০ ফুট লম্বা চওড়া সেগুলি একসঙ্গে জুড়ে ও তারপর তার ওপর আবার ফুট তিনেক ঐ ঘাস বিছিয়ে নিজেদের থাকার জায়গা বানায়। এক একটি দ্বীপে ঐরকম পাঁচ ছটি পরিবার যৌথভাবে থাকে। এক একটি দ্বীপের আয়ু পনেরো কুড়ি বছর। তার মধ্যে আবার নতুন দ্বীপ বানিয়ে ওরা অন্যত্র সরে যায়। এই দ্বীপ ভাসমান, তাই দ্বীপগুলো ভালোভাবে জলে খুঁটি পুঁতে আটকানো থাকে। উরোসদের যা কিছু সবই লেক তিতিকাকার থেকে। এই হলো উরোস জাতির ইতিহাস। উরোসরা এখন এখানে শ'খানেক দ্বীপ বানিয়ে থাকে- কাজেই তার একটা দেখবো- সে তো ভাগ্যের কথা।

আটটায় আমাদের বোট ছাড়লো। সব মিলে জনা ত্রিশ বিভিন্ন দেশের লোকজন। প্রধানত লাটিন আমেরিকার লোকই বেশী। আধঘন্টায় এলাম উরোসদের একটি দ্বীপে – শ খানেক ফুট লম্বা চওড়া।


এখানে শুনলাম উরোসরা কিভাবে দ্বীপ বানায়।



ওদের জীবন যাত্রা সম্বন্ধে একটা সম্যক আইডিয়া পেলাম। উরোসরা নৌকাও বানায় ঐ ঘাস দিয়ে। মিনিট কুড়ি উরোসদের বানানো নৌকায় নৌকাবিহার করা হলো। রঙ্গীন উরোস যেন আমাদের মনকেও রাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলো।





















উরোসের পর আবার আমাদের যাত্রা শুরু। এবার চলেছি তাকিলে দ্বীপে। তাকিলে এখান থেকে ৩০ কিমি। বোটের সময় লাগবে দেড়ঘন্টা। তা লাগুক, সেই ফাঁকে বরং তাকিলে সম্বন্ধে কিছু লেখা যাক।

তাকিলে আর একটি উপজাতি, যারা কুচুয়া ভাষায় কথা বলে- যে ভাষা ইনকা আমলের। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা আর দেড় কিলোমিটার চওড়া এই ছোট্ট দ্বীপে হাজার দুই উপজাতির লোক এখনো আছে। দ্বীপটি পাহাড়ী এবং ১৩৪০০ ফুট ওপরে এর সর্বোচ্চ্য অংশ।

বোটের ঠাণ্ডা হাওয়া যথেষ্ট আরাম লাগছিলো। শুনেছিলাম পুনোতে খুব ঠাণ্ডা হবে। রাত্রে ঠাণ্ডাও ছিলো, তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিলো ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। তাই এখানে এসেছিলাম সোয়টার, জ্যাকেট পরে। কিন্তু দেখা গেলো বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম লাগছে, অতএব জ্যাকেট খুলে হাতে নেওয়া।

বেলা বারোটা নাগাদ আমরা এলাম তাকিলে। গাইড বললেন মিনিট কুড়ি হেঁটে একটা আর্চ পড়বে, ওখানে দাঁড়াতে। উরোস দ্বীপে হাঁটাহাঁটি ছিলো না বলে কোনও কষ্ট অনুভব করিনি, কিন্তু এখানে কুড়ি মিনিট হাঁটা বেশ কষ্টর, বিশেষ করে যখন চড়াই উঠতে হচ্ছিলো। তবে কাল যেমন একদমই হাঁটতে পারছিলাম না, আজ দেখছি কষ্ট হলেও পারছি।





কুড়ি মিনিট হেঁটে এলাম একটা সমতল জায়গায়। এখানে তাকিলে জীবনযাপন ও ইতিহাসের সাথে পরিচিতির পর তাকিলেদের বানানো লাঞ্চ এলো। গরম কর্ন সূপ ও মাছ বা কিনোয়া অমলেট, সব্জী ও আলুভাজা।

খাওয়ার পর বসলো গান বাজনা ও নাচের আসর। তাকিলে ছেলেমেয়েরা নাচতে শুরু করার পর কেন জানি না আমায় পছন্দ করলো, ফলে ওদের সাথে হাত ধরে বেশ খানিকক্ষণ নাচতে হলো । ভালো লাগছিলো খুবই কিন্তু তেরো হাজার ফুট ওপরে নাচা সত্যিই শক্ত, নাচ শেষ হতে যেন বাঁচলাম।

এরপর গাইড নিয়ে চললেন পুরো দ্বীপ পরিভ্রমণে যারা ইচ্ছুক, তাঁদের নিয়ে। আমরা কয়েক জন ছাড়া অনেকেই গেলো। আমার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। এই তেরো হাজার ফুট ওপরে দু কিলোমিটার চড়াই ভাঙ্গার ক্ষমতা নেই। ফলে আমরা কজন ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলে এলাম বোটে।



বিকাল পাঁচটায় বোট ফিরে এলো পুনো- শরীর তখন সুস্থ আর মন রঙ্গীন।

১৬ই এপ্রিল ২০১৯ – কুজকোর পথে

পেরু হপের বাস ধরে চলেছি পুনো থেকে কুজকো। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা, বাস ছেড়েছে সকাল ১১টা। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন ভগবান উজার করে দিয়েছেন এই চারশো কিলোমিটার রাস্তায়। এখানে পাহাড় আর ন্যাড়া নয়, সবুজে সবুজ- মাঝে মাঝেই ভুট্টার ক্ষেত, রাখাল বালক বালিকারা ল্লামা চরাচ্ছে- সবমিলে বার বার মনে হচ্ছে ইনকা আমলের পেরুর কথা। একসময় এই “সোনার দেশের” সন্ধানেই স্পেন থেকে ফ্রানসিসকো পিজারো অভিযান চালিয়েছিলেন- অবশেষে তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় পিজারো পেয়েছিলেন সোনার দেশের সন্ধান। তখন ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা, সঙ্গে তাঁর হাজার হাজার অনুচর ও সৈন্য সামন্ত। কিন্তু পিজারো আতাহুয়ালপাকে নিমন্ত্রণ করে তাঁকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে, কামান দেগে আর অশ্বরোহী সৈন্যদল লাগিয়ে- দুশোর কম সৈন্য নিয়ে লাখ লাখ ইনকা সৈন্য আর প্রজাদের দিশেহারা করে একতরফা যুদ্ধ জিতে নেন। হয়তো বা আতাহুয়ালপা আর তাঁর ভাই হুইসকারের পারস্পরিক বিদ্বেষ খানিকটা সাহায্য করেছিলো পিজারোকে- না হলে কোনও প্রতিরোধ কেন এলো না ইনকা দলপতি বা প্রজাদের থেকে? শুধু তাই নয়, অজস্র সোনা( যার আজকের দাম ২০০০ লক্ষ পাউন্ড) ভেট দেওয়া সত্ত্বেও আতাহুয়ালপা মুক্তি তো পেলেনই না, উলটে তাঁকে মেরে তাঁর শরীর জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। অপরাধ? উনি ক্রীশ্চান হতে অপরাগ, তাই ওঁর মৃত্যুর পর শরীর মামি করতে দেওয়া হয়নি। যাকগে- সে সব হলো ইতিহাস- আর সেই ইতিহাস বারবার চোখে যেন জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে যত এগিয়ে চলেছি কুজকোর দিকে। একটা নদী আমাদের সঙ্গ নিয়েছে, আসছে অজস্র গাছপালা, কোথাও বা মাইলের পর মাইল ভুট্টার ক্ষেত। এভাবে তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে এসে গেলো মারাঙ্গানী- মাঝরাস্তায় একটি গ্রাম। এখানে একটি রেস্তোঁরাতে বুক করা বুফে লাঞ্চ খাওয়া হলো। মারাঙ্গানী দেখে মনে হলো এই সেই জায়গা যেখানে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া যায়। সবুজে মোড়া পাহাড়, নীল জলের হ্রদ- কি নেই?



অবশেষে আবার বাসের চলা শুরু ও সন্ধ্যা আটটায় বাস থেকে নেমে আমাদের হোটেলে প্রবেশ। হোটেলের নাম “এ্যান্টিগা সান ব্লাস”। হোটেলে বিছানার মধ্যে আবিষ্কার করলাম গরম হট ওয়াটার ব্যাগ। নরম বিছানা, গরম ঘর আর আরও গরম হট ব্যাগ নিয়ে আরামের নিদ্রা। উচ্চতা-জনিত অসুবিধা সব দূর হয়েছে কাজেই এক ঘুমে সকাল।

(চলবে)