0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


অবিন্দদ্ দিবো নিহিতিং গুহানিধিং 
বের্ ন গর্ভং পরিবীতম্ অশ্মনি --
অনন্তে অন্তর্ অশ্মনি। (ঋকবেদ)

পেয়েছিল খুঁজে গুহাতে লুকোনো কোন দ্যুলোকের ধন
বিহগগর্ভ যেন বেষ্টিত পাথরে
অননন্ত গভীর কঠিন পাথরে।

ঋতবাক এই গুহায় নিহিত মণিরত্নেরই সন্ধান করে নিয়ত। এবং খুঁজে পায়ও। 'এসো গল্প লিখি' প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে। আর ঋতবাক পেয়েছে ছটি দ্যুতিময় রত্নখণ্ড। ছটি ছোটগল্প। আপনাদের সভায় ঋতবাক সদর্পে এনে হাজির করছে ছটিকেই। ঋতবাকের জানুয়ারী সংখ্যাকে আপনারা অনায়াসে গল্প সংখ্যা বলে ডাকতে পারেন।

এই রত্নসন্ধান প্রয়াসে ঋতবাক খোঁজ পেয়েছে আরও চোদ্দটি নানারঙের মণি-মাণিক্যের। এদেরকে দু'মলাটের মধ্যে আনতেই হলো। চোদ্দটি গ্রন্থ নির্মাণ করল ঋতবাক পাবলিকেশন। এবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় এই সব রত্নের ডালি নিয়ে ৩৩৩ নম্বর স্টলে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে ঋতবাক। থাকছে ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যা (দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা)ও।জানি আপনারা আসবেনই।

আজ, ২১শে জানুয়ারী, ২০১৭। আজই বেলা সাড়ে চারটের সময় শোভাবাজার রাজবাড়ী (ছোট তরফ)তে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ লাভ করবে ঋতবাক মুদ্রিত সংখ্যা। প্রকাশ করবেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। শোভাবাজার রাজবাড়ী (ছোট তরফ) ও ঋতবাক যৌথভাবে সম্বর্ধনা জানাবে ২০১৬র সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার বিজয়ী নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ীকে। উপস্থিত থাকবেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, অমিত ভট্টাচার্য্য, বিশ্বনাথ রায়, সৈয়দ হাসমত জালাল, কালীকৃষ্ণ গুহ, অমর মিত্র, বিকাশ গায়েন প্রমুখ বুধমণ্ডলী। 

২০১৬র শেষ লগ্নে কবি শঙ্খ ঘোষ পেলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। ঋতবাকের পক্ষ থেকে একই সঙ্গে কবিকে জানাই হার্দিক অভিনন্দন ও গভীর শ্রদ্ধা। খুব ভালো থাকুন, স্যার।  

আজ এই পর্যন্তই। সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

সুস্মিতা বসু সিং

 



0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বইপত্র
চয়ন



১৯৯৭ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তমেকমেলা। প্রথম দিন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে পশ্চিমি তত্ত্ববিশ্বের এক আরাধ্য দেবতা -- জাক্ দেরিদা। তাঁর ভাষণের শেষে দেরিদা বললেন : "ভদ্রমহিলা ওমহোদয়গণ, প্লেনে আসতে আসতে মনের চোখে যে ছবি দেখেছি তার কথা আপনাদের জানাতে চাই। আমি দেখলাম বই প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। পৃথিবীতে তার যেন আজ স্থান নেই। পালিয়ে এসে সেআশ্রয় নিল এই মেলায়।" ঠিক কী বলতে চাইছিলেন অবিনির্মাণ তত্বের প্রাণপুরুষ? তিনি বলতে চাইছিলেন যে কাগজে গড়া বস্তুটা আমরা হাতে ধরি সেটা আসল বই নয়। জড় পৃষ্ঠায় অক্ষরের শিকলপড়া বন্দী শব্দ আসলে মৃতকল্প। এই কথা গ্যেটে বলিয়েছিলেন তাঁর ফাউস্টকে দিয়ে : "The word expires, in passing to the pen/And wax and sheepskin lord it over men." রবীন্দ্রনাথওদেখেছিলেন যে মানবাত্মার অমর আলোক, কালো অক্ষরের শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় কাগজের কারাগারে বন্দী। তাহলে, কোথায় সেই মুক্ত শব্দ, আনন্দোচ্ছ্বল প্রকৃত গ্রন্থ? পাঠকের চেতনায়। তারস্বচ্ছন্দবিহারী মগ্ন পাঠের আনন্দে। একথা অনস্বীকার্য যে অবয়বধারী জড়গ্রন্থও পাঠকের কাছে এক সুখানুভূতি বয়ে আনে। নতুন বইয়ের গন্ধ, তার স্পর্শ পাঠককে এক প্রকার শৃঙ্গার সুখ দেয়। কিন্তুবই পাঠককে যে ব্রহ্মস্বাদ সহোদরতুল্য পরমানন্দ দান করে তার অধিষ্ঠান নানা অনুশীলনের ফলে স্ফটিক স্বচ্ছ, সুনির্মল মনের অধিকারী সহৃদয় পাঠকের চিত্তলোকে। দেরিদা বলতে চেয়েছিলেন, কলকাতার বইমেলায় রসিক পাঠকদের সমাবেশ তাঁকে আশ্বস্ত করছে যে এঁদের মননে বই সঠিক আশ্রয় ও স্ফূর্তি লাভ করবে। সারা পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান পাঠাভ্যাস তাঁকে শঙ্কিত করেছিল বইয়েরপরমায়ু নিয়ে।

২০১৭ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা। প্রথমদিন। নানান স্বাদের, নানান বর্ণ-গন্ধের নতুন নতুন বইয়ের সম্ভার নিয়ে ৩৩৩ নম্বর স্টলে উপস্থিত ঋতবাক পাবলিকেশন। সঙ্গে রয়েছেঋতবাকের মুদ্রিত সংস্করণ -- দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা। আর, তার মনে একবিন্দু শঙ্কা বা সংশয় নেই। কারণ, মনের চোখে সেও দেখছে এক ছবি। সে দেখছে :

"অগ্নির্ ভূম্যাম্ ওষধীষু --
অগ্নিম্ অপো বিভ্রতি অগ্নির্ অশ্মসু।
অগ্নির্ অন্তঃ পুরুবেষু
গোষু --অশ্বেষু -- অগ্নয়ঃ।।"

"মাটিতে আগুন, আগুন গাছে লতায়,
পাথরে পাথরে আগুন, আগুন জ্বলে।
গোরুতে ঘোড়াতে আগুন আগুন আগুন
প্রতি মানুষের গভীরে আগুন জ্বলে" (অনুবাদ : গৌরী ধর্মপাল)।

প্রতি গ্রন্থকারের আত্মভাষা -- যা তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর মাতৃভাষার ধ্বনি স্রোত থেকে আজন্ম তিলে তিলে চয়ন করে--হলো বিশ্বভাষা পরাবাকের ঘুমন্ত বীজ। সৃজনের প্রচণ্ড উত্তাপে সেই বীজথেকে বার হয়ে আসছে এক 'নিত্যস্তোত্র বনস্পতি' (শব্দঝণ : গৌরী ধর্মপাল), এক অগ্নিগর্ভ বাণীর প্লাবন : বাক্। যা ছিল কেবল একজনের সাধারণী ভাষা, সেই উত্তাপ তাকে ভেঙে, চুরে, গলিয়ে, বিশ্লিষ্ট করে তাকে করে তুলছে অবন্ধনা। অক্ষরশৃঙ্খল ভেঙে জন্ম নিচ্ছে চির অধরা, চিরনবীনা, ধ্বনিময়ী, অদিতি রূপিণী ভাষা। ঋতবাক জানে, তার ঋতব্রতী আত্মজনদের সঙ্গে তার দেখা হবে এইমিলনমেলায়। তাঁদের হৃদমুকুরেই বিম্বিত হয় গ্রন্থের ভাবময়রূপ। যার দেখা দুইদশক আগে এখানেই পেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের প্রাজ্ঞপুরুষ।

ঋতবাক ঋত এবং বাক্ উভয়কেই তার যাপনের অংশ করতে চায়। ঋগ্ বেদের দশম মণ্ডলের জ্ঞানসুক্তে উল্লিখিত হয়েছে বাক্ এর উৎপত্তি আর তার অপরিহার্যতা। হৃদয়ের গহনে সঞ্চিত ছিলউৎকৃষ্ট ও অমলিন জ্ঞান। ছাঁকনির সাহায্যে শক্তুকে ছাঁকবার মতন করে সেই জ্ঞানকে ধীমান ব্যক্তিবর্গ সযত্নে বার করে আনলেন বাক্ এর সাহায্যে। বাক্ ভাষা দিল জ্ঞানকে। কিন্তু, এই বাক্ এরঅধিকারীভেদ আছে। ভাষা ব্যবহার ক'রে সবাই। কিন্ত, মুষ্টিমেয় কতিপয় ভাগ্যবানের সম্মুখে বাক্ স্বেচ্ছায় স্বপ্রকাশ হন ।এই বাক্ এরই সাধনা ঋতবাকের। এবং, সে ঋতকেও অর্চনা করে।

যে সঙ্গতি, সামঞ্জস্য আর সুশৃঙ্খলা মেনে চলে বহির্বিশ্ব ও যে ন্যায়বোধ, নীতিবোধ দ্বারা নির্ধারিত হয় অন্তর্বিশ্ব তারই নাম ঋত।


ঋতবাকের ধর্ম তবে বাক্ এর সহায়তায় ঋতকে প্রকাশ। এই তার সাধনা। এই সাধনায় সে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বহু ঋতব্রতীকে। সেই সব সমমর্মী, সমধর্মী সুহৃদদের সাথী ক'রে ঋতবাক পেতে চায়সেই ব্যপ্ত চেতনাকে যা সমস্ত সৃজনকে আবৃত ক'রে রয়েছে; যাত্রা করতে চায় সেই সিদ্ধলোকের উদ্দেশ্যে যেখানে বাণীর ধারা হৃদয়সমুদ্র থেকে সতত উৎসারিত হয়ে ব্যক্তি মানবের মননকে উর্বরাকরে। যে বোধ চেতনার 'সহিত' সম্পৃক্ত হয়ে বাক্ এর প্রসাদে সৎ সাহিত্যে প্রকাশলাভ করে কল্প, প্রকল্প, অণুকল্পে তাকেই অবয়ব দিতে প্রয়াসী ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যা। 

এর সঙ্গেই ঋতবাক কিছু স্বপ্নকে কায়া দানের প্রয়াসী। বস্তুত, এই প্রচেষ্টার আরম্ভ গতবছর থেকেই।



২০১৬ ২৫শে জানুয়ারী, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয় নন্দিনী সেনগুপ্তের অসাধারণ কবিতাসংকলন ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’। ঋতবাকের ব্যবস্থাপনায় নির্মিত প্রথম গ্রন্থ। ভূতত্ত্ববিদ নন্দিনীরও প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যগ্রন্থ ছিল সেটি।

ভূতাত্ত্বিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রত্যাশিত ভাবেই আদ্যন্ত প্রকৃতির সুবাসে সুরভিত। তিনপর্বে বিভক্ত গ্রন্থের প্রথম পর্বে অরণ্য, দ্বিতীয় পর্বে মেঘ-জল-নদী মনকে আবিল করে তুললেও তৃতীয় তথা শেষপর্বে কবি ছুঁয়ে গেছেন সেই প্রকৃতিরই সন্তান, ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রমী সর্বকালীন ছিন্নমূল মানুষের মর্মস্পর্শী অন্তরবেদনা... সামগ্রিকভাবে যা একজন মননশীল কাব্যপাঠকের সচেতন কাব্যতৃষ্ণাকে চূড়ান্তভাবে তৃপ্ত করে নিঃসন্দেহে। এককথায়, নন্দিনী সেনগুপ্তর 'অরণ্যমেঘবন্ধুর দল' একাধারে প্রকৃতিপ্রেমী ও সমাজসচেতন কাব্যরস-পিপাসু পাঠকের সংগ্রহে স্থান পাওয়ার দাবী রাখে প্রশ্নাতীত ভাবেই।

এবছর ঋতবাকের প্রচেষ্টা আরও সুশৃঙ্খল, আরও ব্যাপক তার কর্মযজ্ঞ। মোট চোদ্দটি গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনাজগতে পদার্পণ করেছে ঋতবাক পাবলিকেশন।

বেশী কিছু তো নয় মাত্র একটু রুটির স্বপ্ন। বেশীদূর নয় অল্প কয়েক
পা হাঁটা। বেশীক্ষণ নয় কয়েকটি খণ্ড মুহূর্ত। এর মধ্যেই হিমবাহী রাতের ঘরে নীলচে নদীর ষড়জ থেকে নিষাদ ছোঁয়া রাগমালিকা।পথের বাঁকে নদীর সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন চেনা ছায়া, চেনা হাওয়ায় ভরসা যাপন 'মুহূর্ত রাগ'এর। কলিঙ বেলে বৃষ্টি নামে, কাঙাল শরীর দুচোখ বুজে পুড়তে থাকে তবু প্রেম থাকে অপ্রেম থেকেদূরেই। চিত্রকল্পে, ব্যঞ্জনায়, ধ্বনিতে ও কবিতার যাদুতে মুহূর্তকে অনন্ত করে। যাদুকরের নাম মৈনাক সেনগুপ্ত।

বিবি বসুর 'মনগহন' নাগরিক মনের গহনে সন্ধানী আলোক রশ্মি ফেলে দেখে নিতে চায় তার অবক্ষয়িত রূপ। সম্পর্কের নানা রঙ, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের কালের বিবিধ কৃত্রিমতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, ইংরিজি ভাষা নিয়ে কাঙালপনা ---মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের নানা পরিচিত অনুষঙ্গকে নিরিখ করে কথক কন্ঠস্বর। মনগহনের মূল শক্তি তার সরস নির্মোহতা। এক বিদগ্ধ নিরাসক্তি নিয়ে কথনপ্রবাহবয়ে চলে কাহিনী থেকে কাহিনীতে। আশা, আশাভঙ্গ, যাপনের নানান জটিলতা -- এই সব কিছুকে খণ্ড খণ্ড স্ফটিকের মতো সত্যদৃষ্টির আলোর সামনে ধরে 'মনগহন'। ঠিকরে যায় নানাবর্ণের দ্যুতি।


স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দারের 'ওরে মন তোর বিজনে' মনকথার সংকলন। গদ্য ও পদ্যের কৃত্রিম ভেদাভেদকে অস্বীকার ক'রে এই বইটিতে সংকলিত রচনাগুলি কথন প্রবাহের ধারাকে স্মৃতিরেশেরঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে। কখনও রোদ, কখনও ছায়া, কখনও বা রসের ধারাবর্ষণ লেখিকার কথনবিশ্বে। বিজনে ব'সে সৃজনশীল মন যেন শুনতে পায় পরমসুন্দরের চরণধ্বনি। প্রগাঢ়জীবনবোধ, সত্য-শিব- সুন্দরের কাছে ভক্তিপ্রণত আত্মনিবেদন রচনাগুলির মধ্যে ভাবগত ঐক্যসাধন করে। রচয়িতার জীবনদর্শন, তাঁর আঁতের কথা, তাঁর মনন সব মিলিয়ে এ বই রচনার মধ্যে একজীবনমায়ার বিস্তার ঘটায়। স্বাধীন সঙ্গীতের মতো।


চয়নের 'বইঘর' এক সংলাপ। বই এবং পাঠকের সংলাপ। তাঁর বইঘরে লেখকের আলাপচারিতা পাঠকের সঙ্গে। যে আলোটুকু এসে পড়েছে এই দু'মলাটে তাতে বোঝা যায় এই কথন অন্ধকারের মধ্যেআলোর সন্ধান। আত্মদীপ হওয়ার প্রয়াস। সাহিত্যের ক্ষেত্রে শ্রেণীবিভাজন মানে না চয়নের বইঘর।শিশু,কিশোর কিংবা প্রাপ্তমনস্কতায় তার সাবলীল গতায়াত।যাতায়াত ভাষা থেকে ভাষায়,দেশ থেকেবিদেশের সাহিত্যে।কিন্তু তা কোথাও দুর্বহ নয়,সাবলীল গদ্যভাবনায়,গল্প বলার মুন্সিয়ানায় তা জটিলতা উত্তীর্ণ।জ্ঞান আছে,বোধ আছে।চেনা সাহিত্যকে আরো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার আনন্দআছে। এই আনন্দই পঠনের মূল কথা। আনন্দধারা চারিয়ে যায় পঠন থেকে মননে; মনন থেকে যাপনে। বইঘর তার সামগ্রিকতায় এক যাপন আলেখ্য রচনা করে।

ত্রিওলের জন্ম মধ্যযুগের ফ্রান্সে। ইংরিজি ভাষায় এর প্রথম ব্যবহার
হয় ত্রয়োদশ শতকে। কিন্তু, তার পরের শতকগুলিতে এ কবিতা তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়নি। রবার্ট ব্রিজেসের হাত ধরে ত্রিওলেআবার ইঙ্গভাষায় ফেরে ঊনবিংশ শতকে। জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। টমাস হার্ডি প্রমুখ অনেকেই এর ব্যবহার করেন। তবে, এ জনপ্রিয়তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

ত্রিওলে প্রধানতঃ আয়ামবিক টেট্রামিটারে লেখা আট লাইনের কবিতা। এতে প্রথম, চতুর্থ আর সপ্তম লাইন হুবহু এক এবং দ্বিতীয় আর শেষ লাইনও তাই। ত্রিওলে লেখা রীতিমত আয়াসসাধ্য আরসেইকারণেই বোধহয় তার তার তেমন প্রচার হয়নি। 
বাংলা ভাষায় প্রথম বিশুদ্ধ ত্রিওলে সংকলন পল্লববরন পালের অসাধারণ কাব্যগুণসমৃদ্ধ 'ত্রিওলে ৫০' দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখা আজকের ইতিহাস, আগামীর প্রতিস্পর্ধা।



আমেরিকান কবি বুকাওস্কির কবিতা অনুসৃষ্টিকার শুভঙ্কর দাশ আগেও অনুবাদ করেছেন। প্রথম কুড়িটা কবিতা নিয়ে গ্রাফিত্তি থেকে একটা ছোটো বই বেরিয়েছিল। তার সঙ্গে পরে আরওতিরিশটা কবিতা জুড়ে ভাষালিপি থেকে বেরোয় ‘চার্লস বুকাওস্কির কবিতা’। এই কবিতাগুলো নতুন। দৈবাৎ তাঁর হাতে আসে একটা বই। ‘বুকাওস্কি ব্যাক টু দা মেশিনগান-১’। বইটা বার করেছেনপৃথিবীর কয়েকজন বুকাওস্কি ভক্ত মিলে। একটি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকাশনা। কারণ, প্রকাশকের নামধাম ঠিকানা ওতে কিছুই নেই। ওঁরা কেন এটা করলেন? কারণ তাঁরা দেখছিলেন ১৯৯৪এ বুকাওস্কিরমৃত্যুর পর বড় বড় প্রকাশকরা বুকাওস্কির লেখা কাটা ছেঁড়া করে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে তা সম্পাদনা করে প্রকাশ করছেন। ম্যানুস্ক্রিপ্টের সাথে মেলালে যা অনেকটাই আলাদা। বুকাওস্কিরলেখার ধার কমিয়ে করা হয়েছে মোলায়েম। তাই তাঁরা সরাসরি ম্যানুস্ক্রিপ্টের সাথে মিলিয়ে তাঁর রচনা প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছেন। যদিও এর জন্য তাদের কারাবাস পর্যন্ত ঘটতে পারে। ওই বইয়ের প্রথমখণ্ড থেকে এই অনুবাদগুলো। আসলে রূপান্তরশিল্পীর কিছু করার ছিলনা ওই প্রতিবাদে গলা মেলানো ছাড়া। তাঁর এই প্রতিবাদের নাম 'অসম্পাদিত চার্লস বুকাওস্কি'।



বিষাদ ও বিপণ্ণতার মধ্যের ফারাক ও মিল দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখার প্রয়াস সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য্যের 'অনন্ত পাথর সরিয়ে'। শব্দের অলজ্জ নগ্নরূপ দেখতে চেয়ে এক বিমূর্ত র অপারগতায় আর্ত এইলিপিবন্ধন। মননঋদ্ধ রচনা শৈলীর বন্ধন মুক্তির চিরায়ত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ কয়েক বছর পর প্রস্তর প্রাচীর ভেঙে মুক্ত হলো কবির প্রতিবিম্ব। শরীরি রূপ নিল স্বপ্ন।


আত্মবিলুপ্তি নয় আধুনিক কবিতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত কবির নিজস্ব সত্তা। এই কবিতা বিশ্বাস করে কবিতা কোনও একমাত্রিক অর্থ বহন করে না; সে 'হয়ে উঠতে' থাকে কবির ক্রমপরিণতির সঙ্গেসঙ্গে। কবির সঙ্গে জায়মান কবিতার বিবর্তন ঘটে। তাই, বিকচমান প্রাতিস্বিকতার হদিশ যে কবিতায়, তাই আধুনিক কবিতা।

এই যুক্তিতেই অনুপম দত্তের 'পাপোশে রাখি আর্তনাদ' একটি আধুনিক কবিতার সংকলন। অনুপমের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হ'ল তিনি বহিঃ প্রকৃতিকে আত্মপ্রকৃতি দ্বারা অনুবিদ্ধ করেন। তাই,পাপোশে জমে দ্বিধা দ্বন্দ্বের ধুলো, ভাঙা কাপ বাতিল হওয়ার মানে জানে, শরতের আকাশে ভাসে ষড়যন্ত্রের মেঘ এবং চতুর কড়িকাঠ সুযোগ খোঁজে। যে আর্ত বিপন্নতায় দড়ি হাতে অশথের কাছেএকা একা যেতে হয় সেই একই বিপন্নতা অনুপমের কবিতার। বরং তা আরও তীব্র। কারণ, অশথের শাখা অন্তত প্রতিবাদ করেছিল; এই কবির চেতনা ইতিহাসের পাঠ নেয় ক্ষতচিহ্নের কাছ থেকে।ত্রস্ত, চকিত নাগরিক অস্তিত্ব হাসির নীচে দেখে ত্রাস। যে সময়ে কবির বাস সে সময় সত্যিই কোনও আশ্বাস আপাতভাবে বহন করে না। সেই কারণেই, "অন্ধকার মাঠে লুকিয়ে আছে জলরঙেরখড়কে ডুরে" এবং হয়তো যে এ শাড়ি পরেছিল তার লাশও।


সাফল্য নয় স্বপ্ন ধার্য ক'রে মানুষের দাম...স্মরণে সাক্ষাৎ, বিস্মরণে মুক্তি...সখ্যতা অস্তিত্বের অর্থ ...
১৯২৬ এ 'স্যাণ্ড অ্যাণ্ড ফোমে' এরকম কিছু শব্দের কুসুমমালা জীবনের কন্ঠে পরিয়েছিলেন খলিল জিব্রান। সব্যসাচী ভট্টাচার্য্যের 'গহন কুসুম' সেই মালা থেকে খসে পড়া কিছু ফুলদলের ডালি।



পার্থ দেবের 'একলা একায়' বইটিতে কবি একলা বসে কবিতাকে ভালোবাসার গল্প শোনান। খাতার সাদা পাতারা আদর করতে বলে, পুরনো আঁচড়গুলো এক তুমিকে ছুঁয়ে কবিতা হয়। ঝরাপাতাশুনিয়ে চলে সম্পর্কের নানারূপের গল্প। কবির মগ্নচেতনা এই চিহ্নময় মরজগৎ থেকেই প্রতীক খুঁজে নিয়ে যাপনকে কবিতা করে তোলেন।


সরিৎ চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'দিলনাজ' সুরের বাঁধনে প্রাণের বাঁধা পড়ার গীতিময় কাহিনী। বেহালা বাদিকা রাইমা, সঙ্গীত শিল্পী দিলনাজ এবং সারেঙ্গী বাদক সিরাজের ভিন্ন ভিন্ন জীবনচর্যা এক হয়েযায় ঠুমরির তসিরে, তিলক কামোদ, ছায়ানট, আহির ভঁয়রোর মায়াবী বুনোটে। কল্লোলিনী বরুণার প্রাণ মিশতে চায় সুরসাগরে।



সুবল দত্তের 'নিঃসঙ্গতা তার' নির্বাচিত প্রবন্ধের সংকলন। এক অভিনব বিশ্লেষণী শৈলীতে মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাগুলিকে পুরোভূমিতে স্থাপন করে গ্রন্থের বিভিন্ন রচনায় লেখক বিভিন্ন মানবিক ও সাময়িক ঘটনা পরম্পরাকে নতুন ভাবে দেখতে চেয়েছেন।





সরিৎ চট্টোপাধ্যায়ের 'শব্দকল্পদুড়ুম'কে ভ্রম-নিরসন-প্রয়াস বলা যায় অক্লেশে। লেখক সমাধা করতে চেয়েছেন বাংলা বানানবিধিতে "কি' বনাম 'কী' বিতর্কের; রচনা করতে চেয়েছেন ণত্ত্ব-ষত্ব বিধানের নতুন ভাষ্য। লেখকের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে, তাঁর প্রকল্প একান্তভাবে তাঁরই মাত্র। সেক্ষত্রে, ঋতবাক বানানবিধি বা অন্য কোনও বানানবিধির সঙ্গে লেখকের চিন্তার দ্বন্দ্ব থাকতেও পারে।


এই সব বাণীসাধনার বিবিধ উপাচার নিয়ে মনন মিলন মেলায় উপস্থিত ঋতবাক। তার একটিমাত্র চাওয়া। বাণীর সাধক এইসব রচয়িতাদের এবং আগামীর ভাষাশিল্পীদের মিলিত প্রয়াসে যেন গতানুগতিক শব্দার্থ পরম্পরাকে ছাপিয়ে ভাষা উত্তীর্ণ হয় এক সিদ্ধলোকে। বঙ্গভাষা যেন তার পরিসর আরও বিস্তৃত করতে পারে। ঋতবাক তাই প্রার্থনা করে,

"নৃ নব্যসে নবীয়সে সূক্তায় সাধয়া পথঃ।
প্রত্নবদ্ রোচয়া রুচঃ।"

"নব নবতর সূক্তের তরে দাও পথ করে দাও।
অতীতেরি মতো দীপ্তির পরে দীপ্তি ঝলমলাও।"




ঋণস্বীকার : 
১) বেদের কবিতা -- গৌরী ধর্মপাল। 
২) মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই। -- সম্পাদনায় স্বপন চক্রবর্তী।


1 comments:

5

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বাংলার গান : বাঙালির গান – ৩

গানের একাল :গানের আকাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



আগের সংখ্যায় ‘বাংলার গান : বাঙালির গান’২য় পর্বে বাংলাগানের স্বর্ণসময়ের কথা বলেছি। এই পর্বে সেই সময়কে পাশে রেখে একালের গানকে বুঝতে চেয়েছি। অতএব, বাংলা গানের সেই স্বর্ণসময়কে আর একবার ছুঁয়ে যেতে হবে। গত শতকের ত্রিশের দশকটা ছিল সেই স্বর্ণসময়ের প্রস্তুতি পর্ব আর চল্লিশ থেকে মধ্য আশি পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি যে সময়ের গানকে চিহ্নিত করেছি ‘সোনার গান :শোনার গান’ বলে। ত্রিশের দশকে শচীনদেব বর্মণ ত্রিপুরার রাজপরিবারের বিলাস-বৈভব ছেড়ে গানের ভুবনকে বেছে নিলেন, বাংলা আধুনিক গানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন, বাংলা গানের গায়কী ঠিক করে দিলেন অনেকটাই আর নিয়ে এলেন আধুনিক বাংলা গানে অনন্য আভিজাত্য। নিজের জীবনকথায় শচীনদেব লিখেছেন, “১৯৩০ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এই ৫৬ বছরে লোকসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের সংমিশ্রণে নিজস্ব ধরণের সুর রচনা করলাম, যা অন্য কারো সঙ্গে মিলল না। এইভাবে আমি নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম।” (তথ্যসূত্র : শচীন কর্তা / পান্নালাল রায়)। প্রায় সমকালেই, সামান্য পরে, এলেন এবং বাংলা গানের ভুবনকে আলোকছটায় ভরিয়ে দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, সুধীরলাল চক্রবর্তী, যুথিকা রায় প্রমুখ। তারপর চল্লিশ থেকে ষাট এই সময়কালে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মান্না দে, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর সেন, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, ইলা বসু, বাণী সরকার, তালাত মামুদ, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, গীতা দত্ত, আরতি মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, মৃণাল চক্রবর্তী, নির্মলা মিশ্র এবং আরও কত শিল্পী সুরকা্র আধুনিক বাংলাগানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গিয়েছেন।এঁদের গান আমাদের জানান দিল, শব্দের সঙ্গে সুরের সার্থক সংযোজন কি অবিস্মরণীয় মহিমার সৃষ্টি করে। আমরা অনুভব করলাম সুর ছাড়া মানব হৃদয়ের অন্ধকার অভ্যন্তরে প্রবেশের আর কোনও পথ খোলা থাকে না। বস্তুত, বাংলা সাহিত্য-শিল্প সৃজনের ক্ষেত্রে এতো বড় রোমান্টিক আন্দোলন আর হয়নি।

গানের তো তিনটি উপাদান - বাণী, সুর আর গায়কের কন্ঠ মাধুর্য। ত্রিশ দশকে আধুনিক বাংলা গানের, সঙ্গীত রচনার ও সঙ্গীত প্রশিক্ষণের অলিখিত সম্রাট ছিলেন নজরুল ইশলাম। সমকালেই এবং কিছু পরে উঠে এসেছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪), কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪), সলিল চৌধুরী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ (১৯২৫-১৯৭৬), অনিল বাগচী, সুধীন দাশগুপ্ত, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। শচীনদেব আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এবং নিয়ে এলেন এক নতুনতর গায়নশৈলী; তবে, তার পেছনে আরো দুজনের নাম সমান মর্যাদায় উল্লেখ করতে হবে।এঁরা হলেন শচীনদেবের কুমিল্লার দুই সাথী, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য। এই তিনজনের যুগলবন্দিতেই এসেছিল আধুনিক বাংলা গানের নতুন আভিজাত্য এবং আধুনিক বাংলাগানে শচীনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা। বাংলা রেকর্ড সঙ্গীতে তখন নজরুল ইশলামের প্রবল উপস্থিতি। সঙ্গীত রচনায় নজরুল প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে আধুনিক বাংলা গানের সুর রচনায় নতুন রোমান্টিক ধারার সূচনা করলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। সঙ্গীতবেত্তা ও গবেষক রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখেছেন, “শচীনকর্তাকে যথার্থ গৌরব প্রদান করেছিলেন একজন অসামান্য সুরকার, কুমিল্লার হিমাংশুকুমার দত্ত।তখনকার দিনেও গান ছিল নটীমহলে কেন্দ্রীভূত । নজরুল তাঁদের দিয়েই রেকর্ড করাতেন অধিক ক্ষেত্রে, কিন্তু হিমাংশুকুমার ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির কম্পোজার ...। যাঁদের গলায় পেশাদারি ভালগারিটি ওতপ্রোতভাবে নিহিত ছিল তাঁদের দ্বারস্থ তিনি কোনওকালেই হননি, তাঁদের প্রচুর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও। তিনি বাংলাগানকে সেই সমাজ থেকে মুক্ত করে পরিমার্জিত রুচিশীল শিল্পীমহলে প্রতিষ্ঠিত করলেন।” শচীনদেব বাংলা সিনেমার ডাক পাননি তেমনভাবে। প্রবল অভিমানে ১৯৪৪এ তিনি মুম্বাইয়ে চলে গেলেন স্থায়ীভাবে আর হিন্দি সিনেমা-সঙ্গীতকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হিমাংশুকুমারের। ফলে শচীনদেবের পরবর্তী প্রজন্ম সুরসাগরকে পেলোই না। সুধীরলাল চক্রবর্তীও চলে যান মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। তারপরে, বাংলা রোমান্টিক গানে শুরু হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-যুগ । সংশয় নেই, হেমন্তই একমাত্র শিল্পী যিনি তাঁর ঐশ্বরিক কন্ঠমাধুর্য আর অননুকরণীয় গায়কীর গুনে রবীন্দ্রগান, সিনেমার গান ও বেসিক রেকর্ডের গানে গায়ন ও সুর রচনায় অনন্য লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ।

কাব্যের লাবণ্যই বাংলাগানের আশ্রয়, আমরা জানি। আমরা একথাও জানি, বাংলা গানের স্বর্ণ সময় কারও একক প্রয়াসে আসেনি। এসেছিল গায়ক, গীতিকার ও সুরকারদের সম্মিলিত প্রয়াসে। গায়কের কন্ঠমাধুর্যে, সুরের স্নিগ্ধতায় আমরা অবগাহন করি, কিন্তু নেপথ্যে থেকে যান গীতিকার। বাংলা গানের স্বর্ণসময়ে প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের অনেক কবিতার সার্থক সঙ্গীতায়ন হয়েছে যেগুলি বাংলাগানের ভুবনে ‘লেজেণ্ড’ হয়ে আছে।সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ‘ছিপখান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা’ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র । কে ভুলবে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গীতায়ন আর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই গানটির কথা ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ / মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ (১৯৫৫), কিংবা সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে সলিল চৌধুরীর সুরে কবি বিমল ঘোষের ‘উজ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ (১৯৫৩), বাণী ঘোষালের কন্ঠে সলিল চৌধুরীরসুরে অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া ‘তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর পরে রাগ করো’ (১৯৫৫), ১৯৬০এ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ও সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীতায়নে, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিতা ‘সাগর থেকে ফেরা’ (‘সবুজের ছোঁয়া কি না তা বুঝি না’)। এবং সলিল চৌধুরী-হেমন্তর যুগলবন্দী সুকান্ত ভট্টাচার্যর রাণার, অবাক পৃথিবী, ঠিকানা আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘পালকি চলে’ – এই সব প্রবাদপ্রতিম গানগুলির কাছেই আমরা বারবার ফিরে আসি। এসব গানের বয়স বাড়ে না।

সফল কবি মাত্রেই সফল গীতিকার নন, আবার সফল গীতিকারদের গানে আধুনিক কাব্যের স্পর্শ থাকে, যদিও তাঁরা কবির মর্যাদা পান না। আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগে মোহিনী চৌধুরী, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, শৈলেন রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রবীর মজুমদার, মিন্টু ঘোষ, শ্যামল গুপ্ত, কানু ঘোষ, পবিত্র মিত্র, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়রা স্মরণীয় হয়ে আছেন । গানের ক্ষেত্রে শ্রোতাদের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি পান গায়করাকিন্তু গানের প্রাণ তার বাণী রচনা করেন যাঁরা, গানকে সুরে বাঁধেন যাঁরা তাঁরা অন্তরালেই থেকে যান। কৃষ্ণচন্দ্র দে গীত, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান’ গানটির গীতিকারের নাম মোহিনী চৌধুরীআমরা ক’জনই বা জানি? ১৯৪৫র সত্য চোধুরীর কন্ঠে প্রবাদপ্রতিম ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখোনা বেঁধে আমায় / খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর’ কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহুশ্রুত ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা / দূর নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা’ এরকম অনেক শিখরছোঁয়া গানের গীতিকার ছিলেন মোহিনী চৌধুরী। জগন্ময় মিত্রের কালজয়ী রোমান্টিকগান ‘চিঠি’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গানের গীতিকার সুবোধ পুরকায়স্থরা আড়ালেই থেকে যান।অর্থকোলীন্য তারা লাভ করেননা,ক্যাসেট বা সিডিতে তাঁদের নাম থাকেনা, গানের জলসায় তাদের তাদের নাম উচ্চারিত হয় না, তাঁরা কবে চলে যান আমরা জানতেওপারি না। উপেক্ষায়, হতাশায় মান্নাকন্ঠের অজস্র গানের গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তো ফেরি লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়ে গঙ্গার অতলেই তলিয়ে গেলেন । 

আজ ষাট-সত্তর বছর পরেও যখন ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড় / হে মনবলাকা মোর অজানার আহ্বানে চঞ্চল পাখা মেলে ধর’ (ইন্দ্রাণী), ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে’ (রবীন মজুমমদার ১৯৫৫),‘মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে’ (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ১৯৫৬),‘চাঁদের এতো আলো’ (তালাত মাহমুদ ১৯৫২), ‘ওগো মোর গীতিময়’(সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১৯৫০), ‘আমার গানের স্বলিপি লেখা রবে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৫৮), ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছো’ (দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ১৯৬৫) – এসব গান ভেসে আসে আমাদের কানে, আমরা আনমনা হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে যাই । 

কিন্তু তারপর? মধ্য-আশিতে পৌছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টির ভান্ডারের মত গানের ভুবনেও নেমে এলো চোখে পড়ার মত শূন্যতা। শচীন দেববর্মন ১৯৬৯এ তাঁর শেষ গানের রেকর্ড করে চলে গেলেন ১৯৭৫; সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর ৫৪ বছরের সঙ্গীত-সফর শেষ করে চলে গেলেন সেপ্টেম্বর ৮৯তে ৬৯ বছর বয়সে; আশির দশকেই চলে গেলেন শ্যামল মিত্র (১৯৮৭),অখিলবন্ধু ঘোষ (১৯৮৮), গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯৮৬), নচিকেতা ঘোষ (১৯৭৬), রবীন চট্টোপাধ্যায়। নব্বইএর দশকে গানের ভুবন থেকে শেষ বিদায় নিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী (১৯৯৫) মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । একুশ শতকে পা দেবার আগেই বাংলাগানের ভুবনকে শূন্য করে চলে গেলেন সোনার দিনের প্রায় সব শিল্পী, শুধু থেকে গেলেন তখন প্রায় গানহীন মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সবিতা চৌধুরী, আরতি মুখোপাধ্যায়রা,গানের আকাল দেখার যন্ত্রণা নিয়ে। এই শূন্যতা এতো শীঘ্র পূরণ হবার নয়। অতএব নব্বইএর দশকে শুরু হল বাংলাগানের ঝোঁক বদল ।

১৯৯২এ ঈর্ষনীয় কন্ঠসম্পদের অধিকারী সুমন চট্টোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা গানের জগতে এলেন, প্রকাশিত হল তাঁর গানের ক্যাসেট ‘তোমাকে চাই।’ক্যাসেট কোম্পানী ক্যাসেটের লেবেলে নাম দিলেন ‘জীবনমুখী’ গান । সুমন তার আগেই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বাংলা গানে এসেছেন। প্রায় একই সময়ে নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ প্রমুখ এক ঝাঁক নবীন শিল্পী তথাকথিত জীবনমুখী গানের জগতে হুড়মুড়িয়ে এসে গেলেন । তাঁরা আধুনিক বাংলা গানের একটা নতুন ছাঁচ তৈরি করতে চাইলেন । এঁদের কেউ কেউ বললেন তাঁদের শুনে আসা গানের ভাষা ছিল বোকা বোকা- জীবনসম্পর্কহীন। এতোদিন আধুনিক গান ছিল একটা সমবায়িক শিল্প - গীতিকার, সুরকার ও গায়কের সমবায়িক প্রয়াস আর তাঁরা নিয়ে এলেন ‘ওয়ান পার্সন মিউজিক’ বা একক ব্যক্তির সঙ্গীত। গানের কথা সুর ও গায়ন একই ব্যক্তির, এমনকি গলায় ঝোলানো তারযন্ত্রের বাদ্যসংগতও তাঁরই । এই ‘ওয়ান পার্সন মিউজিক’ কোন নতুন উদ্ভাবন নয়; আমাদের বাউল গানও একক ব্যক্তির সঙ্গীতই । তফাত এই যে সেই গানে মাটির স্পর্শ আর এঁদের গানে টুংটাং গীটারের শব্দ সহযোগে গলার শির ফুলিয়ে একটানা গেয়ে যাওয়া, গানের মুখড়া,অন্তরা, সঞ্চারীর কোন বালাই না রেখে। কাব্যের লাবণ্য সেইসব গানের আশ্রয় ছিল না। কলেজ কমনরুম ও রকের আড্ডার হালকা ভাষাতে মোড়া সেইসব গান। গানের জলসায় সুমন, নচিকেতা ছোট-খাটো ভাষণও দিতেন গান শুরুর আগে, কটু শব্দের গালি দিতেও অনীহা ছিলনা তাঁদের (এখনও কি দেন? জানি না।) তখন বোঝা দায় ছিল নচিকেতার গান না কচিনেতার ভাষণ!

আমাদের আধুনিক বাংলা গানের যে ধারণা বা কনসেপ্টে সোনার দিনের যে সব গান আমরা শুনেছি, তাতে গানের ভাষা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গানের সুরটিই কানে লেগে থাকতো বেশি । তাই রবীন্দ্রনাথের গান বা জনপ্রিয় আধুনিক গানের সুর যন্ত্রসঙ্গীতে বাজানো যায় কিন্তু জীবনমুখী গানের তকমা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি ক’রে যা চালানো হ’ল তাতে এমন হবার নয়। সে গানে এলোমেলো কথা অনেক আছে কিন্তু সুর গুরুত্বপূর্ণ নয়। গানের কথা ও সুরের যে সমন্বয় একটা গানকে কালোত্তীর্ণ করে, তথাকথিত জীবনমুখী গানে তা ছিল না। কেউ কি কখনো শুনেছেন যন্ত্রসঙ্গীতে নচিকেতা, অঞ্জন দত্তদের জীবনমুখী গানের সুর? এইসব গান প্রথম প্রথম বাজার পেলো, বলা ভালো বাজার খেলো;তাঁরা ক্যাসেট করলেন, বিক্রিও হ’ল কিন্তু তাঁদের গান মুখে মুখে ফিরলো না। যে কোনও তরুণ বা তরুণী আপন গৃহে সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘শালা স্বাধীনতা’, ‘নাভির নীচে শাড়ি ইটের নীচে ঘাস’, ‘মেয়েছেলে আর মানুষে লেগেছে খটাখটি’, ‘গড়িয়াহাট মোড়ে ডানাকাটা পরী’ এমন সব কুৎসিৎ শব্দ ঠাসা গান গাইবেন কি? ফল যা হওয়ার তাই হলো। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ, তাঁদের প্রতিভার অপচয় ঘটিয়ে হারিয়ে গেলেন।

প্রয়াত সলিল চৌধুরী একটা ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ায় লিখেছিলেন – 

‘আলু খুঁইজ্যা পাইলাম না রে তাই
খাইলাম কচুমুখী
সুর খুঁইজ্যা পাইলাম না তাই
গাইলাম জীবনমুখী’ ।

দশ বছরের মধ্যে ‘জীবনমুখী’ গান মুখ থুবড়ে পড়ল । আর ‘গানের দেখা নাই রে গানের দেখা নাই’ আমাদের এহেন হাহাকারের মধ্যে বাজারে এসে গেলো বাংলা ব্যান্ড । এও বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্যাপার। হরেক কিসিমের যন্ত্রের জগঝম্প, কোমর দোলানো গান। গান যেন শোনার নয়, দেখার । প্রথম প্রথম সে গান কানে ভেসে এলে ভ্রম হত, গান না মাতালের চীৎকার! গানের তো একটা সর্বজনীন দিক আছে; গানের সুরে মানুষ ডুবতে চায়, স্নিগ্ধতায় অবগাহন করতে চায়। গানের ভেতর দিয়ে মানুষ তার স্নায়ুকে শান্ত করতে চায়, তার কর্মের ক্লান্তি অপনোদন করতে চায়। কিন্তু, আধুনিক বাংলা গানের নামে অমার্জিত কথার ফুলঝুরি আর শিরা ফোলানো চীৎকার শ্রোতাদের ক্লান্তিনিয়ে এলো । চলচ্চিত্রের গানও আর মানুষকে টানতে পারলো না।

সু্মন যে বছর ‘তোমাকে চাই’ ক্যাসেট নিয়ে সাময়িক হৈচৈ ফেললেন, তার পরের বছর ১৯৯৩তে রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির বার্ষিক কার্যবিবরণী তে বলা হয়েছিল “আধুনিক বাংলা গানের বাণীর দুর্বলতা বিষয়ে সভা উদ্বেগ প্রকাশ করে। সুর ও বাণীর মেলবন্ধনের অভাবে বাংলা আধুনিক গান তার আসন হারাচ্ছে। এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন” । (তথ্যসূত্র : ‘অন্দরমহলের ছবি : বাংলা গান’/শোভন সোম - ‘দেশ’ পত্রিকা-এপ্রিল ২০০১)বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের জন্য একটি উপ-সমতিও নাকি হয়েছিল।তারপরও প্রায় পঁচিশ বছর হতে চললো, প্রতি বছর মহা ধুমধাম ক’রে সঙ্গীত মেলা হয়, কিন্তু বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের কোন সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না।

গত পনেরো-কুড়ি বছরে শ্রীকান্ত আচার্য, ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, চন্দ্রাবলী দত্ত রুদ্র, স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত, ইন্দ্রাণী সেন, মনোময় ভট্টাচার্য, রূপঙ্করের মত একঝাঁক সুকন্ঠ গায়ক উঠে এসেছেন সত্য, কিন্তু এদের একজনও নিজস্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানকে শাসন করতে পারেন এমন বলা যাচ্ছে না।তাঁদের কেউ কেউ ৫০/৬০ দশকের জনপ্রিয় আধুনিক গানগুলির রিমেইক বা পুনর্নির্মাণ ক’রে শিল্পীর দায় মেটাতে চাইলেন, কেউবা আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্র–দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গানে। ইন্দ্রনীল – শ্রীকান্ত - ইন্দ্রাণীরা কেন নিজস্ব সৃষ্টি করতে পারলেন না, এ বড় বিস্ময়। রেকর্ড কোম্পানী (ক্যাসেট ও সিডি) এদের নিজস্ব সৃষ্টির ওপর ভরসা না রেখে ক্রমাগত অতীত দিনের গানের পুণর্নির্মাণ করালেন,তাঁরা প্রভূত উপার্জন করলেন, কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের সৃজনভূমিতে জোয়ার আনতে পারলেন না। অতএব, গান শোনা বাঙালির হাতে রইল পেন্সিলই – মানে রবীন্দ্র-নজরুল- দ্বীজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গান আর চিরন্তন লোক জীবনের গান।

কোথায় যেন পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কথা ‘প্রত্যেক যুগের মধ্যেই একটা কান্না আছে, সে কান্নাটা হল সৃষ্টি চাই’। আশির পর থেকে তো গানপ্রিয় বাঙালি এই কান্নাই তো কেঁদে চলেছে! সৃষ্টি চাই, নবীন কালে নবীন শিল্পীর নবীন গান। একালের গানের এই সৃষ্টিহীনতাকে গানের আকাল বলবো না তো কি বলবো?

[ বলেছিলাম তিনটি পর্বে লেখাটা শেষ করবো। পারলাম না। তিনটি পর্বে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুলকে সামান্য ছুঁয়েছি বটে, লোকজীবনের চিরকালীন গান অধরাই থেকে গেছে আমার লেখায়। চতুর্থ ও শেষ পর্বে বলবো সে কথা ।]



5 comments:

0

প্রবন্ধ - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


প্রবন্ধ


অথঃ সম্পাদক সমাচার
উত্তম বিশ্বাস



“একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে-
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা,আরেকজন গাবে মনে” 

(গানভঙ্গ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

সাহিত্যের বিচারে সবার শীর্ষে যদি থাকে সহৃদয় পাঠকের হৃদয়; তবে, অবশ্যই দ্বিতীয় দাবীদার স্বয়ং লেখক। কেননা একজন লেখক তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে যেভাবে বুকের ওপর, কোলের ওপর বা শিয়রে রেখে পরম আদরে, বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে যেভাবে বারবার নিরীক্ষণ করেন, এবং তাঁর সৃষ্টির স্বাদ অনুভব করতে থাকেন; তার সঙ্গে জগতে আর কারও তুলনা চলে না। সম্পাদকের প্রসঙ্গ আসে যদিও অনেক পরে। কিন্তু, সম্পাদককে পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করলে সবই অন্ধকারে থেকে যায়। তিনি হলেন সৃষ্টি কর্মের দ্বিতীয় স্রষ্টা। সৃষ্টিকর্তার সমর্পিত সাহিত্যসম্ভারকে একত্রে সুষমামণ্ডিত করে বিশ্ববিহারী পাঠকের দরবারে পৌছে দেওয়াই তখন তাঁর একমাত্র ব্রত। তার জন্য তাঁকে বহুপাঠের অভ্যাস আয়ত্ব করতে হয়; হয়ে উঠতে হয় সংবেদী, তথাবহু ভাষায় পারঙ্গম। তিনি হয়তো লেখকের মত লেখাটিকে বুকের ওপরে রাখেন না; তবে রাখেন একান্ত পর্যবেক্ষণে, সযত্নে নজরদারিতে। সেক্ষেত্রে তিনি এতটাই সজাগ যে, ধুলো আর ছাইদানসম্ভূত অবহেলা কখনওই তাঁর সম্পাদকীয় টেবিলকে স্পর্শ করতে পারে না। আর যদি বা করে তাহলে জানতে হবে সারস্বত সাম্রাজ্যে অচিরেই বন্ধ্যা যুগের সূচনা হতে চলেছে।

বহুপাঠের অভিজ্ঞতা যদি একজন সম্পাদকের প্রধান গুণ হয়, তবে বহু মতের সমন্বয়সাধনকারী হিসাবেও তাঁকে কেন গণ্য করা যাবে না?কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকা ছাড়া গ্রাম গঞ্জের অধিকাংশ পত্রপত্রিকাই হলো সাহিত্যের আদি আঁতুড়ঘর। সেখানেও আজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানামতে, নানাদলে, নানা রঙে রঞ্জিত হয়ে উন্মোচিত হচ্ছে ছোট, বড়, মাঝারি সব পত্রপত্রিকার মোড়ক। আনুষ্ঠানিক তিথি নক্ষত্রের ক্ষেত্রেও হরেকরকমবা। কোথাও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান, কোথাও বা রাজকীয় আড়ম্বর; কোথাও বা প্রতিষ্ঠিত প্রেক্ষাগৃহ; আবার কারও ভাগ্যে ভাঙাচোরা পার্টিঅফিস, বুড়ো শিবতলা চায়ের দোকান, দুর্গাদালান কিম্বা অসহায় নিঃসন্তান দম্পতির দুঃখে ভাসা স্যাঁতসেঁতে বারান্দা! কোথাও বেলোয়ারি, আবার কোথাও বা নিভুনিভু কালি পড়া হ্যারিকেনের আলো। আড়ম্বর, আয়োজনের রকমফের যাই থাক না কেন আমীর অথবা ফকিরনন্দনের উভয়ের জন্মলগ্নের যে দ্যুতি; যে আলো, তা সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে স্বর্গীয়। এইখানে সম্পাদক হলেন সমকালের চারণকবি। তাঁর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে দুঃসাহসী বর্শা ফলক। তিনি যেন ডাকহরকরার মতো ছুটে চলেছেন আবহমানের চিঠি কাঁধে নিয়ে। পথের প্রতিবন্ধকতা বলতে তিনি কখনও হয়ে ওঠেন নিজেই নিজের কাছে অন্তরায় : আবার কখনও বা রাজনীতি, গোষ্ঠীগত মতপার্থক্য আবার কোথাও কোথাও বাদ সাধে টাকাকড়ির মতো আপাত তুচ্ছ অথচ সেকেলে সমস্যা। সম্পাদক নিজেই নিজের অন্তরায় কখন হয়ে ওঠেন? যখন কিনা তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেকে প্রমান করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। ব্যক্তিগত ভাবাবেগ, ইগো, সমকালকে মান্য করতে একান্ত অনীহা - ইত্যাদি কিছু অভ্যাস যখন সম্পাদকের কলমকে গ্রাস করে; বুঝতে হবে তাঁর চারপাশে চীনের প্রাচীর তৈরী করতে তিনি একাই যথেষ্ট! তবে সম্পাদক যে সবসময় স্বতন্ত্র হবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তাও নয়;যুদ্ধ তো আসলে একার জন্য নয়। অথচ কি নিষ্ঠুর নিয়ম; শেষমেশ পরাজয়ের ভার একমাত্র সেনাপতির কাঁধেই বর্তায়। একটু সজাগ দৃষ্টি রাখলে আজকাল আকছার দেখা যায় সরস্বতীর আঙিনায় কত ভাঙাভাঙির গল্প, কত নিত্যনতুন কীর্তিকলাপ।দল আর উপদলীয় বিভেদের প্রতি এই যে ঝোঁক, এ দায় সবই কি সম্পাদকের? তা বোধহয় কক্ষনো নয় ! 

সবই তো হলো; এবার আসা যাক লেখা সংগ্রহের কথায়। লেখা সংগ্রহই হল একজন সম্পাদকের প্রকৃত লড়াই। এখানে তিনি মৌ-ভিক্ষুক, বিন্দু বিন্দু মধু আহরণ করে তিল তিল ক’রে গড়ে তোলেন স্বপ্নের মোহরকুঞ্জ। আনুষ্ঠানিক দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যায় এভাবেই:‘আগামী বৈশাখেই আমাদের নববর্ষ সংখ্যা প্রকাশিত হবে। কালবৈশাখীর ঝটিকা ভিন্ন যেমন নববর্ষকে কল্পনা করা যায় না,তেমনই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।ঝরা পাতার দেশে,বাণিজ্য আর বিষণ্ণতার দেশে দুরন্ত এক ঝটিকা মাত্র।নিম্নোক্ত ঠিকানায় যত দ্রুত সম্ভব লেখা পাঠান। রাজনীতি এবং অতি যৌনতায় আমাদের অধিক আসক্তি না থাকলেও যুগ ও জীবনের দর্পণ দর্শনকারীর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগিতে আমাদের আপত্তিও নেই।’ একসময় আঙ্গুলের করগোনা দিন ফুরিয়ে আসে। প্রত্যাশা থাকে ছোটখাটো একটা পাহাড়ের রূপ নেবে সম্পাদকীয় দপ্তর। কিন্তু বাস্তব বলে উলটো কথা। লেখা যা দু’একটা আসে সবই প্রায় উঠতি বয়সের তরুণ ছেলেছোকরা দলের আবেগমথিত প্রেমকাতর বিহ্বলতা; অথবা গৃহকোণে আবদ্ধ কোন অবলা রমণীর নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের একান্ত করুণ আর্তি। অর্থাৎ,দিই,দিচ্ছি করেও যেসকল আপাত প্রথিতযশা স্বস্বক্ষেত্রে স্বনামধন্য, লোকনন্দিত মসিজীবীগণ প্রতিশ্রুতমান লেখাটিকে ঝিঙে মাচার ফুল করে ঝোলাতে থাকেন, তাঁদের উঠোনের ধুলোর উত্তরীয় উড়িয়ে আবারও হাজির হন সম্পাদক সন্ন্যাসী।

এরপর আসে বাছাই পর্ব। এখানেও চরম বিড়াম্বনায় ফেলে দেন বিজ্ঞাপনদাতা,পার্টিকর্মী সমাজবন্ধু,ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, আপাত দুর্বল লেখক অথবা সৌখিন সাহিত্যের পৃষ্টপোষক মহোদয়গণ। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই সনাতন পাঠক,অথবা এমন কেউ যাঁর যুগের চাহিদা অথবা সময়ের পরিবর্তনের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। এঁদের হাতগলে যে লেখাগুলো আসে, সেগুলো হয় কৃষ্ণের অষ্টত্তরোশতনাম, না হলে ফেলে আসা দেশভুঁই-এর সেদিন সুদিন,অথবা নিদেন পক্ষে মারকাটারি দলীয় ইস্তেহার। এইখানে সম্পাদকের এক্কেবারে হাড়িকাঠে গলা। ছুঁচো গিলতে গেলেই পত্রিকার কৌলীন্য হারায়, আবার উগরালেও সারস্বত নিলাম; পাকাপাকিভাবে পথের ভিখিরি। এ প্রসঙ্গে উৎসরণ পত্রিকা (নাম পরিবর্তিত) দপ্তরে আসা এক অধ্যাপক তান্ত্রিকের চিঠি উল্লেখ করা হল :‘মাননীয় সম্পাদক,আমার তন্ত্রসাধনার প্রকরণ ও দেহসন্ধি বিষয়ক লেখাখানি শুনেছি আপনি ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলেছেন। ফেলুন। আপনার পত্রিকা তার চাইতেও আরও কদর্য, আরও যৌনতাগন্ধী লেখাকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে এমন হাজারকুড়ি উদাহরণ আমি পাতার পর পাতা উল্টিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারি।যাই হোক, এতদিন যাবত আমি যে বিজ্ঞাপনটি দিতাম, তা বন্ধ হলো। আর, আমার প্রেরিত কালী মায়ের ছবিটি আমার চেম্বারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করলে কৃতার্থ হব। আর হ্যাঁ,ভবিষ্যতে বিজ্ঞাপনের জন্যে আমার চেম্বারে আসবেন না।’

ইতি,

অধ্যাপক পি. সারথি (নাম পরিবর্তিত)

গোল্ড মেডেলিস্ট 

তবে কি সেই অর্থে সাহিত্যরসসিক্ত লেখা ছোটপত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে আসে না?আসে তো হাজার বার। তবে নিতান্তই হাতে গোনা। প্রত্যন্ত বঙ্গদেশের আনাচেকানাচে অলিগলি ফুঁড়ে অগনিত ব্যাঙের ছাতার মত জন্ম নেওয়া লিটিল ম্যাগাজিনই তো আসলে সাহিত্যের আদি আস্তানা। সেখানে যদি লেখা না আসেতবে ভাষাপ্রকৃতির বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় ঘটার সমূহ সম্ভাবনা আছে যে।

লেখক লেখা জমা দিয়ে অধীর আগ্রহে দিন গুনতে থাকেন;আর সম্পাদক থাকেন গভীর উৎকণ্ঠায়।! সম্পাদকীয় কলমে তিনি চাবুক কষাবেন, নাকি প্রুফ সংশোধনের পরে হাজির হবেন পুষ্পশরে সজ্জিত হয়ে,কিম্বা সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের ভেরী বাজিয়ে প্রথম পাতাতেই ছেপে দেবেন তাঁদের আত্মম্ভরিতার আর্যগাথা? মোড়ক উন্মোচনী অনুষ্ঠানেও সেই একই টেনশানের টানাপোড়েন। মঞ্চের ভিভিআইপি আসনে উপবিষ্ট থাকবেন কোন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক অথবা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ যাঁর হাতে সাহিত্যের সমুন্নতি অথবা আদ্যশ্রাদ্ধ উভই সম্ভব। তাই হয়তো মাঝে মাঝে সম্পাদকীয় কলমে উঠে আসে এমন অগ্নিবীণার তাপ,‘আর কতদিন ঘরের স্ত্রীর গয়না বন্ধক রাখব? আর কতদিনই বা ক্ষুধার্ত শিশুপুত্রটি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়লে প্রুফের কাগজ বগলে চেপে চোরের মতো ঘরে ঢুকব? স্ত্রী আর বসতভিটার আব্রু রক্ষা করার দায় যেমন একান্ত গৃহস্বামীর; ঠিক তেমনই নবাগত ভোরের প্রত্যাশায় প্রসারিত কথাগুলোকেও আমি কিছুতেই মরে যেতে দিতে পারিনা।দীর্ঘদিনের সন্ন্যাসব্রত পরিহার ক’রে তাই বাহুবলীদের শরনাপন্ন হতে বাধ্য হলাম।’

সম্পাদক ছুটছেন। ধুলো ওড়া পথ, উসকো খুসকো চুল, আলুথালু বেশ, দূর শহরের অন্ধ গলিতে ঘিঞ্জি প্রকাশনা পাড়া -এমন দৃশ্য আজ আর কল্পনা না করাই ভাল। কেননা, সম্পাদক মহাশয়ও সপ্রভ দুটি চোখ নিয়ে বাঁচেন। তিনিও বোঝেন কৌলীন্য আর চমৎকারিত্বের অভিন্ন প্রকাশনা। খণ্ডে খণ্ডে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের পাতা। মাঝে মাঝে গুঁজে দেওয়া হয় টুকরো বিনোদনী বিজ্ঞাপন, দোকান দক্ষিণা,শোকস্মৃতি; হারানো সন্তাপ অথবা পঞ্চায়েত ও পার্টি পক্ষের দরাজহস্ত কৌশলী কারুকাজ। এভাবে হাপ পেজ, ফুল পেজ, কভার পেজের বরাত পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সম্পাদকের খেরোর খাতা।

সম্পাদকের কাছে লেখক হলেন আত্মার আত্মীয়, আর পাঠক হলেন তাঁর প্রকৃত সরকার। এ দুয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন করাই হলো তাঁর কাজ। কিন্তু, তারপরেও যখন ছোটখাটো অঙ্কুশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অমনি তিনি শরনাপন্ন হন রবিঠাকুরের ‘বড় খবর’এর কাছে। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে এই ভেবে যে, নিতান্ত চপ মুড়ি কিম্বা সৌজন্য সংখ্যার বিনিময়ে আর কতদিন এভাবে খালিপেটে সাহিত্যসাধনা করা যায়, যেখানে পেটেভাতের কোনও ব্যবস্থাই নেই? আলাদিনের আলোহীন, রাজভবনের উত্তরীয়হীন সাহিত্যসাধনা, আর লখাইকে কলার মান্দাসে শুইয়ে রেখে মনসার ভাসান শোনা বন্ধ করে বাড়ির পথে পা বাড়ানো সেই একই বীতরাগীয় ব্যথা আর কী! যার উপশম সম্পাদক সাধকেরও অজানা। তবু ইচ্ছে শক্তির নিয়মে গুচ্ছ গুচ্ছ পত্রপত্রিকার জন্ম হয় গ্রামবাংলার মাটিফুঁড়ে। দুর্ভিক্ষের দেশই বোধহয় অপুষ্টিজনিত শিশুর জন্ম দেয় সবচেয়ে বেশি। কেননা সেখানে আর কোনও খাদ্য না থাক, সমতাড়নার যৌনগন্ধী শরীর তো অন্তত মুখের কাছে মজুত থাকে! অর্থাৎ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, পুরুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকারকেই যেখানে অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনা করা হয়;সেখানে সন্তানের বাঁচা বাড়ার দায়দায়িত্বও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এসে পড়ে তারই কাঁধে। টিমটিম করে জেগে থাকা লণ্ঠনের আলোয় ঘন ঘন মিটিং ডাকেন সম্পাদক মহাশয়। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে পঞ্চাশের উদ্দীপনা থিতিয়ে আসে পাঁচে। আবার, এই পাঁচজন অতি উৎসাহীরমধ্যেও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে গোষ্ঠীগত মতবিরোধ। তাঁরাও বিভাজিত হতে হতে এসে ঠেকেন আড়াই থেকে তিনে। এ প্রসঙ্গে একটি সম্পাদকীয় দপ্তরের বার্ষিক আলোচনা চক্রের কিছুটা বক্তব্য তুলে ধরা হল, - ‘এই মর্মে আমরা একমতে উপনীত হলাম যে,প্রতি সংখ্যায় প্রচ্ছদ অঙ্কনের জন্যে নামী দামী চিত্রশিল্পীর পেছনে দৌড়তে যে পরিমাণ অর্থব্যয় এবং সময়ের অপচয় হয়, তা না ক’রে আমরা আরও কিছু গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানোর জন্য একত্রে পথে নামতে পারি (অবশ্য গমকল , ডেন্টাল , গুড়বিক্রেতা কোনওকিছু বাছবিচার না করে) এবং অন্যান্য পত্রিকাগুলো বিশেষত যারা নাচাগানা হৈ হুল্লোড় খানাপিনায় অধিক ব্যস্ত থাকছেন; আমরা তাঁদের অন্ধ অনুসরণ না করে, রাত জেগে কাহিল না হয়ে, সেই সুযোগে ভোরের ট্রেন ধ’রে যদি দ্রুত ‘পাতিরাম’ বা ‘ধ্যানবিন্দুর’ মতো নজরনন্দন টেবিলগুলোকে আমরা ক্যাপচার করতে পারি তবেই বোধহয় সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। আর যদি তা না পারি,ম্যাড়ার গোয়ালে যতই সংখ্যায় সদস্য বাড়ুক গুঁতোগুঁতিরও… ইত্যাদি ইত্যাদি!’

একালে সস্তায় লেখা পাওয়া যায় গুচ্ছগুচ্ছ। কিন্তু ভালমানের প্রচ্ছদ চিরকালই দুর্মূল্য। একজন লেখক আর চিত্রশিল্পীর মধ্যে এইখানে আজ বাদশা- গোলামের ব্যবধান। এইভাবে সম্পাদক বিপুল স্বপ্নসম্ভাবনা নিয়ে পথ চলতে চলতে কখনও হয়ে ওঠেন পথহারা লুনি;আবার কখনও বা হতাশা ও বৈরাগ্যের ধুলিজাল উড়িয়ে হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী ভিসুভিয়াস। কেননা, বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না! সামান্য ছত্রাকের মত ক্ষণজীবী অনাম্নী লিটিলম্যাগকে সম্বল ক’রে পৃথিবীতে কতজন সপমাদক ধনশালী হয়েছেন আমার জানা নেই। তবে কি শুধুমাত্র যশ খ্যাতি অথবা আত্মপ্রচারের মোহ? তাও নয়। আমার মনে হয় এসব ব্যতিক্রমীগণ জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সম্মিলিত কুসুমকুঞ্জের আত্মপ্রকাশ ঘটানোকেই তাঁদের একমাত্র নেশা ক’রে তোলেন। আর, এইখানে সম্পাদক হলেন মহাকালের আজ্ঞাবাহী এক সত্য সঞ্চালক। এও এক সুগভীর আসক্তি।

সবশেষে বলা যেতে পারে, সংসারে আপনার খেয়ালে যে যার মতো ভেসে যাচ্ছে। যাক। আত্মীয় বন্ধু সুজন চলে গেছেন এপার থেকে ওপারে -সেদিকে সম্পাদকের একদম খেয়াল নেই। যখন তাঁর বিরামবিহীন যাত্রা অন্তিমের পথে পূর্ণ অভিসারে তখনও তিনি সম্পূর্ণ সজাগ। হঠাৎ হয়ত বুনো ফুলের গন্ধে পথিমধ্যে সহযাত্রীকে থামতে বলে নিজেই উঠে গিয়ে মুঠো ভর্তি বুনো ফুল তুলে নিয়ে আবার এসে শুয়ে পড়েন নিজের বিছানায়। তারপর পথের দুধারে ছড়াতে ছড়াতে চলেন আপন খেয়ালে। তিনিই সারস্বত সাম্রাজ্যে প্রকৃত সম্পাদক অমরার অমৃতকুঞ্জে যিনি আদি চিত্রগুপ্ত।


0 comments:

0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট




বিরহ ভালোবাসা খেদ       
ঋতভাষ প্রকাশক : ধানসিড়ি
দাম : ৮০টাকা


"তোমার মৃত্যুতে ভয়,
আবার, শীতের লোভও যায় না।
অথচ দেখো,
কী প্রবল শীত আসে শরীরে,
কথা মরে যাবার পরে।"


বহু পথ পেরিয়ে এসেছেন কবি। শেষ করেছেন অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথোপকথন। আজ, ভিড়ের আড়ালে আড়ালে ঢাকা দিতে চান বিরহ, ভালোবাসা আর খেদ। বিরহ আর প্রেমকে এক করে নেন কবি। বৃষ্টির সঙ্গে চুঁইয়ে পড়ে ভাঙা প্রেমের স্বাদ। আবার, প্রেমের তুঙ্গ মুহূর্তে বালিতে গাঁথা নোঙর আর বুকে বসা নখ এক হয়। কবি বলেন, 'জলে তো সব ভেসেই যাবে,/ঝগড়া হয় হোক।' এই শেষ হয়ে যাওয়ার বোধ মাথার মধ্যে নিয়ে খেদকে সযত্নে লালন করেন কবি ঋতভাষ। সেই লালনে কীভাবে কবিতা জন্মায় তার প্রমাণ ঊদ্ধৃত কবিতাটি। কবি নিজেকে ভেঙে-চুরে খুঁড়ে আরেকটু স্পষ্ট হতে চান। তাই অস্পষ্ট খণ্ড মুহূর্তগুলির মধ্যে তাঁর নিজেকে খোঁজা। এই বইয়ের ৬৪ পাতার মধ্যে ধরা রয়েছে সেই খোঁজের নানা স্তর।


‘ঈশ্বরের আংটি’কে একটু ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করলে এক অভিজ্ঞান ছড়িয়ে যায় আংটির বৃত্তের প্রশান্তিতে। যদি আবার কখনো কবিতার জন্ম হয় ধারণ করার জন্য, চন্দনে মথিত হয়ে, তবে রজঃস্বলা জন্ম হবে সহস্র লাল গোলাপের চারার, বিস্তারিত হবে হলুদ শস্য, সবুজ প্রান্তর আর তার সাথে নীল অবিশ্বাস। কালো আখরে প্রতিফলিত হয় সাদা পাতার প্রতিবিম্বে।




এনট্রপি (কবিতা সংকলন): নীলাক্ষর প্রকাশনী
বিনিময়: ₹100.00.
আধুনিক ভাষা প্রকরণ ও অভিব্যক্তি নিয়ে ছন্দে লেখা খুব সুলভ নয়। শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যসঙ্কলন 'এনট্রপি'-র অধিকাংশ কবিতার এই বৈশিষ্ট্য কবিতাগুলির পঠন ও শ্রবণ মাধুর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বক্তব্যের তীব্রতা একটুও লঘু না করে। মধুর পেলব কবিতা অবশ্য কমই এখানে এবং সেখানেও উচ্ছ্বাসের বলদে অভিমান। ভূমিকায় ব্যাখ্যা - "তাপগতিবিদ্যায় এনট্রপি হল মহাবিশ্বে অস্থিরতার পরিমাপ....এমন শক্তি যা কাজে লাগানো যায় না।" এই অশান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে যেমন প্রাসঙ্গিক এই নামকরণ তেমনি ছত্রে ছত্রে বারুদ। তবে সেগুলো নিছক চটকদার নির্মাণ নয়, একজন সংবেদনশীল মানুষের স্বতস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। 


অণু-কল্প (অণুুগল্প সংকলন): বিনিময়: ₹100.00
বাংলা অণুগল্পের স্তম্ভ হিসেবে এখনও পরিচিত নাম নয়। কিন্তু অণুগল্প পড়ে নাড়া খেতে ও বিস্মিত হতে হলে এই বইটি পড়তে হবে। যেমন বৈচিত্র্য বিষয়বস্তু চয়নে তেমন দক্ষতা নির্মাণ শৈলিতে। ব্যঞ্জনাধর্মী রচনা থেকে ছোট-ছোট আঁচড়ে বিশাল পটভূমিকার চিত্রায়ন এককথায় মুগ্ধ করে। শ্রীপর্ণার সবচেয়ে বড় প্রহরণ তাঁর কুশলী ভাষা যা বিষয় ভেদে চমকপ্রদভাবে রূপান্তরিত হয়। পড়া শুরু করলে শেষ না করে থামা যায় না।


“তাতাকাহিনী"
সম্পাদনাঃ তারক দাস (সুকুমার রায় ক্লাব)
প্রকাশকঃ দ্য কাফে টেবল
মুল্যঃ ৩০০ টাকা

ছোট ছোট খন্ডচিত্রের এক অপূর্ব কোলাজ। ছবি ও ভাষ্যের এক অভিনব মেলবন্ধন..... বইটিকে সুদৃশ্য ও সুখপাঠ্য করেছে। কত সংক্ষেপে, টুকরো টুকরো ঘটনার সন্নিবেশ ঘটেছে—অথচ পড়লে সেই মহৎজীবনের অমৃতময় স্পর্শ যেন অনুভূত হয়,শিহরণ জাগে মনের গহীনে। বিদেশযাত্রা, সন্দেশ পত্রিকা, পরিবেশ চিন্তা, জীবন দর্শন--- থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, রোথেনস্টাইন,লর্ড কার্জন, মিস্টার নিউটন... কী নেই এই বইয়ে!!"


“একজন সাব-এডিটরের কতিপয় ছেঁড়াখোঁড়া দিন”
লেখকঃ রুবাইয়াৎ আহমেদ
প্রকাশকঃ দ্য কাফে টেবল
মুল্যঃ ১০০ টাকা

রুবাইয়াৎ আহমেদ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অন্যতম সেরা । তাঁর লেখাএই বইটি ২০১৬ সালে ওপার বাংলাতে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। উপন্যাসের চেনা ছক ভেঙে নতুন নির্মাণশৈলীতে রচিত, একজন সংবাদকর্মীর জীবন ও জীবিকার ওপর ভিত্তি করে এই অসাধারণ আখ্যানটি বিষয় ও বানান অপরিবর্তিত রেখে আমরা আমাদের পাঠকদের হাতে তুলে দিতে চলেছি এই কলকাতা বইমেলা ২০১৭.


“প্রবাসীর সাত সতেরো”
লেখিকাঃ ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
প্রকাশকঃ দ্য কাফে টেবল
মুল্যঃ ১৫০ টাকা

লেখিকার জীবনের অনেকটা অংশ কেটেছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ফিরে আর সেই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে তিনি কুড়িয়েছেন নানা কড়া, মিঠে, স্মৃতি যা তিনি সহজ, প্রাণের ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন "প্রবাসীর সাত সতেরো" বইটিতে। তাঁর দুরন্ত কৌতুকবোধ বইটির সম্পদ।


গদ্যের নিরন্তর ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্যুত না হয়ে প্রান্তিক ঝাড়খন্ড ও মানভূমের অসাধারণ জীবন কাহিনি টানটান রোমাঞ্চকর বর্ণনা ‘প্রদাহ বোধ ১১’ গল্প সংকলনের এগারোটি গল্পে। ব্লার্বে লেখা‘মহাশ্বেতা দেবীর পর এ বিষয়েলেখার দম শুধুমাত্র সুবল দত্তেরই আছে’ তার প্রথম গল্প সংকলন ‘প্ল্যাগিয়ারিষ্ট’ যাঁরা পড়েছেন তাঁরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন।‘প্রদাহবোধ ১১’য় বিকলাঙ্গদের কথা, সীতাহার, চড়ক এই সত্যতা প্রমাণ করে। কয়েকটি গল্প, যেমন বশীকরণ সেতু অরঘ এর অদ্ভুদ চরিত্রের বিশ্লেষণ করতে আর কিছুক্ষন ভাবতে পাঠককে বিবশ করে। প্রতিটি গল্পই পড়তে পড়তে চরিত্র ও ঘটনা মানস পটে বিরামহীন ভাসতে থাকে।কোনো চরিত্র প্রতিবাদী প্রতিশোধপরায়ণ। কোনো গল্প অসাধারণ জীবন চিত্রপট।বইয়ের পাতায় পাতায় অস্ত্বিত্বের সংকট ও তা থেকে মুক্ত হওয়ার অদ্ভুদ আকর্ষণীয় সব ঘটনার রচনারীতি। গল্পের ভাষাতেও এক স্পষ্ট স্বাতন্ত্র ও মার্মিকতা আছে। শুধুমাত্র কঠোর বাস্তবের অনুধ্যান করেই গল্পকার তাঁর মানসভূবনের চিত্রণ এই গল্পগুলিতে করেননি, পাঠককে তিনি গদ্যের এক নতুনধারার খোঁজ দিয়েছেন।
প্রদাহবোধ ১১ ॥ সুবল দত্ত ॥ ১৫০ টাকা


চিরন্তন নারী নির্যাতন 'বিহাইণ্ড দ্য ডার্কনেস' নামের গল্প সঙ্কলনের বিষয়বস্তু। মেয়েদের দৈহিক এবং মানসিক কোমলতাকে তাদের দুর্বলতা হিসাবে দেখিয়ে সমাজ চিরকাল তাদের শিক্ষাদীক্ষা এবং অধিকারের প্রশ্নে উদাসীন। বর্তমান সমাজেও শিক্ষা, বুদ্ধি এবং শক্তিতে সন্দেহাতীতভাবে সমপর্যায়ের মহিলারাও যে অপমান ও অবহেলার শিকার, এই গ্রন্থে তা অসাধারণভাবে চিত্রিত। আশাবাদী লেখিকা মৌসুমী ভট্টাচার্যের মর্মস্পর্শী লেখায় প্রতিটি গল্পই মন ছুঁয়ে যায়। বিশেষত ছয় নম্বর গল্পটির বাস্তবমুখিতা অনস্বীকার্য। ভাষার সাবলীলতা গল্পগুলিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলেছে। আশা রাখি লেখিকার কাছ থেকে এরকম মণিমাণিক্য আরও উপহার পাব।





0 comments:

0

বইঘর - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


বইঘর


সমর সেনের কবিতায় পৌরাণিক ইমেজ
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার
.

“To be really progressive in our time and country, where only a fraction is literate, is to preserve the integrity of what is good in our past tradition...”। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সম্মেলনে এই কথা বলেছিলেন সমর সেন। এলিয়ট ট্র্যাডিশনের ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন। সমর সেনও তাই। ভারতীয় পুরাণ গুলির মূল্য তিনি বুঝতেন। জানতেন কী অনবদ্য রূপকল্প সৃষ্টি হতে পারে সেগুলি থেকে। কিন্তু রোমান্টিক উচ্ছ্বাস তাঁর মনঃপূত ছিল না। কারণ তিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন “Poetry is not a turning loose of emotion।’’

“এ ভুজমাঝে হাজার রূপবতী
আচম্বিতে প্রসাদ হারায়েছে
অমরাবতী হতে দেবীরা সুধা এনে
গরল নিয়ে নরকে চলে গেছে। 

এ ধরণের রচনা আমার অনুরাগ আকর্ষণ করে না। প্রেমের সঙ্গে দার্শনিকতার সংমিশ্রণ সহজে ঘটে না। সেটার অতিচেষ্টা একটু হাস্যকর হয়। শেলী থেকে লরেন্স তার নিদর্শন…”।

কবিতা, পৌষ ১৩৪৮ এ প্রকাশিত কবির এই মনোভাবকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে বোধহয় সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় প্রেমের ইন্দ্রিয় বোধের তীব্র অস্তিত্বে সমর সেনের যতটা আস্থা ছিল, ইন্দ্রিয়াতীত মধুরতার অস্তিত্বে তাঁর সে বিশ্বাস ছিল না।
অল্প কটি কবিতায় বিরহ বা প্রেমের তীব্র সত্যতা বোধের উপলব্ধি সত্ত্বেও তাঁর অধিকাংশ কবিতায় বিরহ বোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের প্রতি এক বিরূপ মনোভঙ্গি।

‘উর্বশী’ তাঁর লেখার প্রেমের অন্যতম প্রতীক। পুরাণের উর্বশী স্বর্গের নর্তকী। দেহের অপরিমিত রূপ যৌবনকে ব্যবহার ক’রে তপস্বীর তপোভঙ্গ করাই তার কাজ। পৌরাণিক কাহিনীতে মাঝেমাঝে তাকে বন্দী করেছে মানুষের প্রেম। তবু সব সময় তাকে আবর্তিত করেছে এক অলৌকিক দেবদ্যুতি --- যা সাধারণ মানুষের পক্ষে করায়ত্ত করা অসম্ভব।

“যুগ যুগান্ত হতে তুমি শুধু বিশ্বের প্রেয়সী

হে অপূর্ব শোভনা উর্বশী।’’… এক প্রবল রোম্যান্টিক অনুভূতির প্রতীক রবীন্দ্রনাথের উর্বশী। কিন্তু সমর সেনের কবিতায় সেই উর্বশী সম্বন্ধে সর্বোচ্চ দাবী --- 

“তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!
কিম্বা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে
হে ক্লান্ত উর্বশী,” ...( সমর সেনের কবিতা - উর্বশী)

অথবা

“তাহলে আমার সমস্ত শরীরে কি আবার চকিতে আসবে
সমুদ্র মদির উর্বশীর স্বপ্ন?’’ ( মৃত্যু, সমর সেনের কবিতা)।

প্রাচীন সাহিত্য থেকে নেওয়া আর যে বা যাঁদের তিনি প্রেমের কবিতায় একাধিকবার ব্যবহার করেছেন তাঁরা হলেন -- ‘অগ্নিবর্ণ’, ' ‘পাণ্ডু’ এবং ‘ধৃতরাষ্ট্র’। রঘুবংশম কাব্যে আমরা রাজা অগ্নিবর্ণকে পাই। সংযত দাম্পত্যজীবন যাপনকারী দিলীপ রঘু ও রামচন্দ্রের বিখ্যাত বংশে নিষ্ফল যৌন- যথেচ্ছাচার ও আনুষঙ্গিক সুরায় লিপ্ত হয়ে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুদর্শনের পুত্র বংশের শেষ রাজা অগ্নিবর্ণ। 

“নির্জন গুহায় নিবিড় নিষিদ্ধ প্রেম,
ভিজে ফুলের মত নর্তকীর নরম শরীর,
প্রতীক্ষার স্পন্দমান কত সঙ্গীত উজ্জ্বল বুক,
তবু আজ মৃত্যু এলো আষাঢ়ের মেঘের মতো,
হে অগ্নিবর্ণ!” ( সমর সেনের কবিতা - অগ্নিবর্ণ)।

মধ্যবিত্ত জীবনের বর্ণহীনতার মধ্যে সমর সেনের কবিতায় একটি মেয়ের আবির্ভাব ঘটে এই ভাবে –

“স্বপ্নের মতো চোখ সুন্দর শুভ্র বুক
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভিক আভাস ;”
( একটি মেয়ে । সমর সেনের কবিতা)।

একই উদ্দেশ্যে সমর সেনের কবিতায় মহাভারতের রাজা পাণ্ডুর উল্লেখ -- ‘আমাদের মৃত্যু হবে পাণ্ডুর মতো’। যে সময়ে পাণ্ডু তাঁর স্ত্রীতে উপগত হবেন,সেই সময়ে ই মৃত্যুকে তাঁকে বরণ করতে হবে। মৃগরূপী ঋষিকুমারের এই শাপে পান্ডুর পুত্র‍্যোৎপাদন শক্তি প্রনষ্ট হয়। কিন্তু এক বাসন্তিক সময়ে মলয় বাতাসে যখন মানুষ যৌবন মধুপানে উদগ্রীব ঠিক তখনি অসামান্যা যৌবন লাবন্য সম্পন্না, পদ্মলোচনা মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সংযত করতে পারেন না নিজেকে। বিস্মৃত হন ঋষি অভিশাপ। মাদ্রীর নিবারণ করার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কামাতুর পাণ্ডু অনুল্লঙ্ঘনীয় ঋষিশাপ বহন করে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন। ( আদি। ১২৫)। নগরের বন্ধ্যা নিষ্ফল রতিক্রিয়া, পণ্য প্রেম, রিরংসার উত্তেজনা -- সমস্ত কিছুই অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিস্তীর্ণ তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার অবক্ষয় ও আসন্ন মৃত্যুর দিকে। অবক্ষয়িত ঘূন ধরা সভ্যতার প্রতীক হিসেবে রুক্ষ বিষণ্ণ শহর বড়ো বেশি চেনা, আমাদের হৃদিমধ্যের ভোমরা কোঠায় তার বাস। তাই সেই অবক্ষয় বা নির্বেদ বোঝাতে গিয়ে সমর সেন শুধু নাগরিক জীবনের ইমেজ ব্যবহার করেননি :সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ইমেজ ব্যবহার করেছেন একই উদ্দেশ্যে। পতিত জমি,বন্ধ্যাভূমি, ফণিমনসা, ক্যাক্টাস পূর্ণ মরুভূমির ইমেজ যখন এলিয়ট হয়ে সুধীন্দ্র নাথ পর্যন্ত সকলের কবিতায় জীবন বিমুখ সভ্যতার অনীহা প্রকাশে বারংবার ব্যবহৃত হতে দেখছিলাম তখন সার্থক উত্তরসূরী সমর সেন সেই ইমেজ গুলিকেই ঋণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মরুভূমি তার হৃদয় ভর্তি কাঁটার জ্বালা নিয়ে,শুকনো বালির অনুর্বর নিষ্ফলতা নিয়ে হয়ে উঠেছে বন্ধ্যা বিষাদিত শহরের মতোই অন্ত:সারশূন্য, অনুর্বর। বর্তমানে অবস্থানকারী কবিচিত্তের objective correlativeযেখানে ফণিনসা নেই সেখানেও তুল্য কোনও রুক্ষতার ইমেজ।

“একটি একলা বট খাপছাড়া ছায়া দেয়
প্রায় পত্রহীন সে প্রৌঢ় বট, বহুদিন মাখেনি সবুজ কলপ / কিন্তু তার শিকড়েরা ঊর্ধ্বমুখ আকাশ সন্ধানে।’’
(জোয়ার ভাঁটা ।) এখানে উপনিষদের সেই অমৃত বৃক্ষের অনুসঙ্গকে অনায়াসে আমরা চিত্রিত হতে দেখি। কেন যেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘যযাতি’ কবিতার নাগরিক একাকীত্ব শুধু নয় এই বটগাছ সামাজিক ভাঙনের মাঝে প্রতিরোধে অক্ষম এক নি:চেষ্ট, নির্লিপ্ত এক দর্শক বলে আমার মনে হয় এবং বিশুদ্ধ চৈতন্যেরও প্রতীক যেন এই যযাতি সদৃশ বট। এর আগে পৌরাণিক প্রতীক হিসেবে আমরা পেয়েছি পান্ডুকে। আর গতপত্র প্রবীণ ক্লান্ত বটের প্রসঙ্গে মনে যাঁর ছবি ফুটে ওঠে তিনি পান্ডু জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র। যার উল্লেখ সমর সেনের কবিতায় নিত্য পাচ্ছি। পাণ্ডুর অমিতাচার, ব্যর্থ যৌনাচার আর ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান অন্ধতা এই দুইয়ের মেলবন্ধনে সভ্যতা এগিয়ে চলেছে অনিবার্য ধ্বংসের পথে। যে পত্রহীন লোলুপ বট মাথা নাড়ে প্রবীণ ক্লান্তিতে সে যেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মূর্ত প্রতীক।

(১) -- “বহু পাপে সিদ্ধ এক মোক্ষহীন বৃদ্ধ
দন্তহীন কান্নায় বিলোল মাড়িতে
মৃত যৌবনের পাশে আগত চকিতে
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র!” ( ক্রান্তি) 
(২)- “শকুনি - চক্রান্ত শেষ, শঙ্কিত সঞ্জয়
বিবর্ণ প্রাসাদে ফিরে, সঞ্চিত স্বার্থের প্রতীক
লবেজান ধৃতরাষ্ট্রকে সভয়ে জানায়
পুনুরুজ্জীবনের বার্তা সাধারণ লোকের।” 
( লোকের হাটে) 

কেমন এক হিমায়িত বোধ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এসে লক্ষ্য করে এই শকুনির পাশা সমাজকে। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধতা কৌরবের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সর্বনাশের চিতা জ্বলার কারণ ও তাদের অন্ধতা। একাকী নি:স্ব বটগাছ এবং জরাগ্রস্ত কুরুরাজ যেমন সভ্যতার গড়ে ওঠা পলিজমা নদী,তেমনি প্রতীক নিরাসক্ত - অসংযমী বুদ্ধিজীবীদের। আমরা ই পাণ্ডু, আমরাই যযাতি, আমরাই একা বট, আমরাই ধৃতরাষ্ট্র ---। অক্ষম, চক্ষুহীন। নতুন সৃষ্টিতে অপারগ, বিপ্লব প্রতিরোধে অসমর্থ। ধৃতরাষ্ট্র যেমন চৈতন্যকে মৃত করে রেখে দেখছিল অলীক স্বপ্ন রাজত্ব করবে কৌরবগণ, তেমনি এই বিপরীত চিন্তাধারায় পুষ্ট কবি এই সামাজিক দায়ভাগ থেকে বারবার নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন শুদ্ধ বিষাদঘন এক কাব্যিক পরিমন্ডলে। কুরুরাজ কুরুরাজ্য শ্মশান হবার পর অনুতপ্ত হয়েছিলেন (আদৌ কি?), সুধীন্দ্র নাথ বলে উঠেছিলেন, “অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?” সেখানে নির্জন গ্রাম, সাঁওতাল পরগণার কুঁড়ে ঘর কল্পনা করার এইescapist মনোভাব তাঁকে মানায় না একি ‘নাগরিক’ আখ্যায় ভূষিত কবি জানতেন না? অবশ্যই তা তিনি বুঝেছিলেন। আর তাই সম্পূর্ণ রোম্যান্টিক হবার ভরপুর ইচ্ছে নিয়েও এই স্ববিরোধী কবি রোম্যান্টিক হতে পারেননি। সমর সেনকে জানা, বোঝা এক কঠিন যাত্রা। নিষ্ফল যৌনতার ও মধ্যবিত্তের অন্ধতার চিত্র তিনি অনেক এঁকেছেন। কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানের যে দায় আজও এই সভ্যতা ও সমাজ বহন করে চলেছে ---। মননের সংঘাতকে তুচ্ছ করে ‘ফ্রন্টিয়ারের’ সাদামাটা পৃষ্ঠা গুলির মধ্যে নিজেকে খুঁজে নিয়েছিলেন। সকলেই জানেন ১৯৪৬ এর পর কবিতা লেখা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কি ভাবে বিদায় নিলেন?নিম্নলিখিত দুটি অনবদ্য শ্লেষাত্মক পংক্তি উচ্চারণ করে। যে দুটি পংক্তির মধ্যে সমর সেনের কাব্য দর্শন সমগ্র ভাবে বিধৃত।

“যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে 
বছর দশেক পরে যাব কাশীধামে”…।।



ঋণ স্বীকার :- 
১) সমর সেনের কবিতা
২) আধুনিক কবিতার দিগ বলয় - অশ্রু কুমার সিকদার
৩) আধুনিক বাঙলা কবিতার দ্বিতীয় পর্যায় - সুমিতা চক্রবর্তী
৪) অনুষ্টুপ সমর সেন বিশেষ সংখ্যা


0 comments: