0

ছোটগল্প - সুবল দত্ত

Posted in


ছোটগল্প


এখানেই বিশের মা মরেছিল
সুবল দত্ত 


এখানটায় আগে চৌমাথা ছিল। এখন আগাছায় ঢাকা মাইলস্টোনের মতো এক শিবলিঙ্গ। তাতে কারুকাজ। অন্য দুই পথ সাহেব বাঁধের পাড়। নোংরা এক বড়সড় বিল। এই শিবলিঙ্গে মাথা ঠুকে বিশের মা আত্মহত্যা করেছিল। বিশে তখন খুব ছোটো। ভাল করে চলতেও শেখেনি। বিশের ভাই তখন মার পেটে। বিশের বাপ বলত তোর মা মাথা ঠুকছিলো, মা কালীর মতো দেখাচ্ছিল। মাথা ঠুকতে ঠুকতে একটা সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা টুপ করে মাটিতে পড়েছিলো। শিবলিঙ্গ আর বাচ্চা দুইই রক্তে মাখামাখি। বিশের ভাই ছোটো ফুটফুটে শিব। 
সন্ধের প্রদীপ জ্বললেই মাকালী ও শিবের কথা মনে পড়ে। বিশে রোজ শিবলিঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে থাকে । ছোটো টিমটিমে লণ্ঠনের বাতি। পাশে একটি গুমটি। সেখানে চপ সিঙ্গাড়া চা পান বিড়ি সিগারেট সবই বিক্রি হয়। রাত গভীর হলে বিশে দুটো থলে নিয়ে আসে। একটিতে পুরিয়া আরেকটিতে বোতল। পুরিয়াতে গুঁড়ো,কাগজে পাকিয়ে বাবুরা ধোঁয়ায় দম টানেন আর শিববাবাকে ডাকেন। তখন রক্তমাখা ভাইটি থলিতে নড়াচড়া করে। যখন বোতল খান আর জয়মাকালী বলে গেলাসে গেলাস ঠোকাঠুকি করেন তখন সে শিবলিঙ্গে মার মাথা ঠোকার আওয়াজ শুনতে পায়। 
আজ শিবরাত্রি। বিকেলে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। তারপর মুশল ধারে বৃষ্টি। গুমটি তছনছ। ক্ষুব্ধ নেশাড়ে, লোভী পুলিশ এখন আর কেউই নেই । অন্ধকারে শিবের থানে ফুল বেলপাতা নারকেল জলের মিশ্র গন্ধ। রাত গভীর। বিশে শিবলিঙ্গে ঠেস দিয়ে বসতে গিয়ে দেখে ইলেক্ট্রিকের তার ও গাছের ডালগুলি সব তার উপর পড়ে । এমন সময় অন্ধকারে এক সাধুজি বিশের কাছে এল। বিশের খুব কাছে তার মুখ। অন্ধকারে তার চোখ যেন জ্বলছে। সাধুজির ফিসফিসে আওয়াজ বিশের মাথার ভিতর দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে পিঠের ভিতরে মোচড় দেয়। 'বেটা, তোর মোচ দাঢ়ি আখুন বাইর হইছে। তুই সাবালক। হামি তোর অপেক্ষায় বানারসে দিন গুনছিলাম। তোর অধুরা কাজ এবার শেষ করতে হোবে। বেটা, এখুন আদেশ মান। বেটা...' 
-জি (বিশের গলা পুরুষালী, ভারি)
-অব যানা হোগা। 
-জি, কি....ন্তু কোথায়?
-তেরা মা কে পাস, যাবি তো?
-মা তো এখানেই আছে । 
বিশে আঙুল বাড়িয়ে বোতল রাখা থলে দেখাল। সাধুজি রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল,
-আরে বুড়বক, তেরা মা কা কুষ্ঠ হুয়া থা। দারু ভি বেচত। পরলোক সিধার গেলো। আখুন চল। 
-পরলোক কোথায় সাধুজি?
-পরলোক?(সাধুজি অধৈর্য) আরে ছোড় পরলোক, চল তেরা বাপকে পাস। 
-বাবা আর ভাই তো এখানেই। 
বিশে আঙুল বাড়িয়ে গাঁজা চরস রাখা থলে দেখাল। সাধুজি রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল,
-আরে বুড়বক, তেরা বাপ কা টি বি হুয়া থা, গাঁজা ভি বেচত, ভাঁড় মে গেলো। আখুন চল। 
-ভাঁড় কোথায় সাধুজি?
-আরে তেরি মা কী ... আবে চল্ না হামরে সাথ । খাবি দাবি হামার চেলা হবি। বঢ়িঁয়া কিসিম কা গাঁজা বিকবি। অনেক পইসা হোবে। তুই কতো মাসুম। তুই বেচবি তো জহর ভি লোগ কিনবে। ই দুনিয়ায় পইসাই সোব । 
-শিবজি?
-হা হা হা, আরে ই কোই লিঙ্গ হ্যায় রে? ই তো পত্থর। লিঙ্গ মহারাজ কো দেখনা হ্যায় তো চল বানারস । 
-কিন্তু... বাবা মা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না 
-আরে বুড়বক, ইখানে থাকবি তো টি বি হোবে, লেপার হোবে। তোর বাপ মা তো মর গিয়া! আখুন চল। 
সাধুজি একটু ঝুঁকে বিশের হাত ধরল। বিশে আজ অব্দি কখনও প্রতিবাদ করেনি, কিন্তু হঠাৎ এখন নিঃশব্দতা চিরে তার প্রবল না...আ... ধ্বনি।
-আবে তু যায়েগা, নহী যায়েগা তেরা বাপ। এক বস্তা গাঁজা দিয়েছি ঘুষ, তোকে নিয়ে যেতে। তোকে লিয়ে হামার পন্দ্রহ বাচ্চা কা টিম হোগা। পাঁচ যায়েগা ফরেন, দশঠো দশ দিশা যায়েগা বেওসা করনে কো।
বিশে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করলো না। পরিস্থিতি হঠাৎ তাকে যেন প্রাপ্তবয়স্ক করে দিয়েছে। সে বুঝে গেছে, ছেলে চোর, অবৈধ নেশার যোগান দেওয়া শয়তান সাধুটি তাকে ছাড়বেনা। এতদিন সে যে এক মোহজালে বদ্ধ হয়ে কেমন যেন বুদ্ধিহীন হয়ে বড় হয়েছে, আর এতদিন যে কী খারাপ কাজটাই না করেছে সেটা পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারলো সে। চোখ বন্ধ করে আকুল হয়ে তার রোজকার আশ্রয় আর সাথী শিবকে ডাকতে লাগলো। মনে মনে সে নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগলো আর তার সঙ্গে হাত জোড় করে এই প্রার্থনা, যেন এই শয়তানটার হাত দিয়ে আর যেন খারাপ কাজ না হয়। 
-কিস ভগওয়ান কো বুলা রহা ? আরে বোল না রে?
-শিবজি 
-কাশী বিশ্বনাথজি কো? বোম ভোলে। 
-না আমার এই বাবা শিব কে ডাকছি ।
-তোর বাপ তো মর গেলো। দুসরকা কৌন?
বিশে আঙুল বাড়িয়ে শিবলিঙ্গ দেখায়। 
-আরে হোঃ হোঃ হোঃ। ই তেরা ভগওয়ান? ই তো গন্দা আছে! ইস পর বৈঠকে লোগ লেটরিন করতা হ্যায়। ই বহুত মনহুশ ভি আছে। তেরা মা মাথা ঠোককে মরা। তেরা বাপ নে জান দে দি। ছোড় উসকো। আখুন চল। 
সাধুজির বলিষ্ঠ আকর্ষণ। রাত অন্ধকার ঘন। ঝড়ের সাঁ সাঁ রব। বিশে চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে তার পাথর সাথীকে ডেকে চলল। 
-কা বে? নহী জানে কা বিচার হ্যায়? উঠা হি লেতে হ্যায় তেরে কো। বোল আখুন তোর কী চাই?
-শিবজি 
-তেরা শিবজি মেরা...। রুক অভীই ইসকা বেবস্থা করছি। কহীঁ মত যানা। নহী তো তেরা নরেটি দাবা দেঙ্গে, মাথা ফোড় দেঙ্গে। 
সাধুজি গেরুয়া তুলে ভারী ভারী পা ফেলে এগিয়ে গেল শিবলিঙ্গের দিকে। পা তুলে সভরে এক লাথি কষাল। সঙ্গে সঙ্গে কেবল তারের চিড়চিড় আওয়াজ, অন্ধকার চিরে নীলাভ বিদ্যুৎ ও নিস্তব্ধতা খান খান করে সাধুজির আর্তনাদ।

0 comments: