undefined
undefined
undefined
ছোটগল্প - অভীক সরকার
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
একটি নীট পেগ ও মুম্বাই প্রবাসের ইতিবৃত্ত
অভীক সরকার
বছর দুয়েক হয়ে গেলো, এই হতভাগ্য অধম মুম্বাই প্রবাসী হইতে বাধ্য হইয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগের উপমা দিতে গিয়ে বড়লোক বাবুর বাড়িতে কর্মরতা ধাইদের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যাঁরা পয়সার জন্যে মালকিনের সন্তানদের মাতৃসমস্নেহে পালন করেন বটে, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামের বাড়িতে অনাদৃত, অবহেলিত নিজের নাড়িছেঁড়া ধনটির প্রতি। মুম্বাইতে আমার অবস্থাটাও ঠিক এই ধাত্রীদেবীদের মতই। যতই ভালোবেসে হরা চাটনি দিয়ে ভড়া পাও চিবাই না কেন, মনটা সদাসর্বদাই পার্ক স্ট্রীটের কাটি রোলের জন্যে আকাশবাতাস কাঁপানো হাহাকার করতে থাকে। বন্ধুদের মধ্যে মনোজ্ঞ আড্ডায় কেউ বার্সা বললেই অবধারিত ভাবে আর্সা, মানে আরসালানের কথা মনে পড়ে যায়, রিয়াল মাদ্রিদ উল্লেখমাত্রে রয়্যালের মাটন চাঁপের স্মৃতি হৃদয় আর্দ্র করে তোলে।
শ্রীরাধিকা নাকি পূর্বরাগের শেষ দিকে কালো মেঘ দর্শনমাত্রে 'হা কৃষ্ণ' বলে ভাবাবিষ্ট হতেন। আমিও ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ফ শুনেই একবার 'হা ফুচকা' বলে কেঁদে আকুল হতে যাচ্ছিলাম। নেহাত সি.ই.ও কড়া চোখে তাকাতে কান্নাটা কোঁৎ করে গিলে নিতে বাধ্য হই।
ফলতঃ প্রত্যেকবার কলকাতা ছেড়ে যাবার সময় মনটা "আভি না যাও ছোড় কর, কে দিল আভি ভরা নেহি" বলে তারসপ্তকে চেল্লাতে থাকে। কিন্তু তখন ডাক এসে গেছে, 'এয়ারপোর্ট বলেছে যাবো যাবো, জেট বলেছে যাইইইই' গাইতে গাইতে সিটবেল্ট বাঁধতেই হয়। আড়াই ঘন্টা উড়ানের শেষে একটা দেহ এরোব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে...
এতটা পড়েই যে সব মহাত্মনদের মনে এই কুটিল জিজ্ঞাসা জেগে উঠেছে যে 'এত্ত আঠা যখন, তাহলে এই ডিহি কলকেতা ছেড়ে মুম্বাই গ্যালে ক্যাঁও ক্যাঁও ক্যাঁও?' তাদের জন্যেই আসল গল্পটি খোলসা করে বলতে বাধ্য হচ্ছি।
দু হাজার চোদ্দর জুন মাস। এপ্রিল থেকেই তৎকালীন বস খুবই উদারভাবে মুম্বাই আসার ঢালাও আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন, আমিও তা না না করে এড়িয়ে যাচ্ছিলুম। একবার তো স্পষ্ট ভাষায় বলেই দিলেন, "ভাই, ইস্ট রিজিওনের যা ক্ষতি করেছিস সে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। নসুপনা না করে মুম্বাইতে এসে আমার কেবিনের বাইরে একটা টুল পেতে বস দিকিন, কি কাজকম্ম করিস তার খোঁজপত্তর নিতে হচ্ছে যে। এতগুলো টাকা মাইনে নিস, ঘি টা ভস্মে ঢালছি কিনা সেটাও তো দেখতে হবে রে বাপু!" আমিও "হেঁ হেঁ হেঁ, কি যে বলেন ছার" বলে ড্রিবল করে বেরিয়ে গেলুম।
এমন সময়ে এলো জামাইষষ্ঠী। তার আগের রাতে অনেক কেঁদেকঁকিয়ে চেষ্টাচরিত্র করে গিন্নির কাছ থেকে তিনটি পেগের অনুমতি আদায় করেছি, দিলটা তরর হয়ে আছে। কি একটা বই পড়তে পড়তে (মনু সংহিতা বা ফিফটি শেডস অফ গ্রে হবে) ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি। জীবনটা বড় সুমধুর স্বপ্নের মতন লাগছে, এমন সময় কোন একটা উত্তেজক কিছু পড়তে পড়তে... (তাহলে ফিফটি শেডস অফ গ্রে ই হবে। মানে মনুসংহিতা পড়ে তো....)
ইররক..গ্লুলুস..ঘিঁআও...খ্যাঁকখক..
বাপ্পস..ভুল করে একটা পেগ পুরো নীট মেরে দিয়েছি যে!! গলা বুক জ্বলে একশা কাণ্ড, মনে হলো একটা ছোটখাটো তরল আগ্নেয়গিরিই যেন গলা বেয়ে নেমে গেলো প্রায়! গিন্নি দৌড়ে এসে ব্যাপার বুঝেই জলের বোতল এনে হাজির, কোঁৎকোঁৎ করে খানিকটা জল গিলে, এসিটা আঠেরোতে নামিয়ে, হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছি, পঞ্চমবর্ষীয়া কন্যা দৌড়ে এসে এত কিছু দেখে, "বাবা কি মরে যাচ্ছে? হ্যাঁ মা, বাবা কি মরে যাচ্ছে" টাইপের বেহুদ্দ ঘ্যানঘ্যানে প্রশ্নে শোরগোল আরও বাড়িয়ে তুলেছে, গিন্নি 'মদ্যপানের কুফল ও সমাজের ওপর ইহার অবাঞ্ছিত প্রভাব' সম্পর্কে কুড়ি নাম্বারের রচনা শোনাবার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কি ভেবে রোষকষায়িত লোচনে শুধু বললেন "সবেতে তাড়াহুড়ো করা তোমার স্বভাব। জল ঢেলে খাওনি কেন? নীট খেতে কে বলেছিল তোমায়? সবেতে ওস্তাদি"।
হ্যা হ্যা করতে করতে একবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতে গিয়ে ভাবলুম থাক, দিন হামারা ভি একদিন আয়েগা। সেদিন দুটো কড়া কথা হামভি শুনায়গা, জরুর শুনায়গা।
পরের দিন তো কাজকম্ম সেরে, সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরে, স্নানটান করে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে মেয়ে বউকে নিয়ে রিকশা করে চল্লুম শ্বশুরবাড়ি। জামাই আদরে ঘটিরা আমাদের, মানে বাঙালদের, যে গুনে গুনে সাত গোলে হারাতে পারে, এ কথা আমি মাথা নিচু করে স্বীকার করতে বাধ্য। শ্বশুরমশাই অসুস্থ শরীরেও নিজের হাতে দোকানপাট সব করেছেন, এসব দেখে একটু অপরাধী অপরাধী লাগছিলো বটে, তবে কি না রান্নাঘর থেকে চিকেনরান্নার মনকাড়া গন্ধটা ভেসে আসতেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বেশ কম্বুকন্ঠেই বল্লুম "ইয়ে, অনেক্ষণ তো হলো, এবার বসে গেলে হয় না?"
রান্নাঘর থেকে গিন্নি বেরিয়ে এসে একটা কাঁসার বগি থালার ওপর ইয়াব্বড়বড় খান পাঁচেক ফুলকো লুচি রেখে গেলেন, সঙ্গে বড় জামবাটিতে কুচো নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল। ফলে হাসিমুখে গিয়ে বসতেই হলো, কারণ লুচি ঠাণ্ডা করে খেলে কুম্ভীপাক নরকে পার লুচি একশো বছর করে এক্সট্রা খাটতে হয় বলে শাস্ত্রে স্পষ্ট নির্দেশ আছে না? গিন্নি রান্নাঘরে চলে যাবার আগে গলদার মালাইকারির কথাটা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করাতে উনি চাপা গলায় "হ্যাংলা বাঙাল" টাইপের কিছু একটা বলে গেলেন বলে মনে হলো, তবে কি না সেটা আমার শোনার ভুলও হতে পারে। যাগগে যাক... খাওয়াদাওয়াতে, যাকে বলে অত্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে মন দিলাম।
তা ঘন্টাখানেক বাদে, যখন সেই চিংড়িচিকেনের ধ্বংসস্তূপ থেকে মুখ তুল্লুম, আমার স্নেহময়ী শাশুড়ির মুখে একটা সস্নেহ প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি, যেন রেমব্রাঁ ওনার আঁকা 'নাইটওয়াচম্যান' দেখে অভিভূত এক গুণমুগ্ধ কলারসিকের অভিবাদন প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করছেন। থালার দিকে তাকিয়ে দেখি গলদার খোসাটা, আর চিকেনের ঠ্যাঙগুলো ছাড়া থালা পুরো আয়নার মতন চকচক করছে। বেগুনভাজার খোসাটার চিহ্ন অবধি নেই। লুচির কথা ছেড়েই দিন। আড়চোখে দেখলুম গিন্নি থমথমে মুখে রান্নাঘরে ময়দা মাখতে বসেছে!
ইত্যাদির পর পরিতৃপ্তি সহকারে ড্রয়িংরুমে এসে বসেছি। শ্বশুরমশাই ভারি খুশি হয়ে আমার খাওয়াদাওয়ার প্রশংসা করছেন, "বুঝলে হে, আমরা যকন ইয়াং, ছিলুম, রোজ হেদোতে সাঁতার কেটে, বুইলে কি না, কারবালা ট্যাঙ্কের বাড়িতে ফিরে অ্যাই একধামা নুচি স্রেপ কাঁচানঙ্কা দিয়ে মেরে দিতুম, বুইলে কি না? তাপ্পর রাত্তিরে...."। শুনেই বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, শুধু হেদোর বদলে ষষ্ঠীপুকুর, কারবালা ট্যাঙ্কের বদলে শিবপুর, একধামা নুচির বদলে একথালা ভাত আর কাঁচানঙ্কার বদলে গিমা শাক ভাজা, এইটুকুই যা তফাৎ!
এমন সময়ে গিন্নি ময়দামাখা হাত ধুয়ে বড় একটা রূপোর বাটিতে পায়েস এনে হাজির। হালকা বাদামী ক্ষীর দিয়ে বানানো পায়েস, ওপরে পেস্তা আর কাজু কিশমিশ বেশ আমন্ত্রণমূলক ভাবেই শুয়ে আছে। আমার তো মনে হলো ওখানেই গিন্নিকে কোলে তুলে ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো জিঙ্গো জিঙ্গো গাই আর কি। নেহাত ব্যাপারটা শউরমশাই ততটা পছন্দ করবেন না হয়তো... বলে আনমনে ভাবতে ভাবতে এক চামচ মুখে দিয়েই...
ইররক..গ্লুলুস..ঘিঁআও...খ্যাঁকখক..
পুরো আগুনে গরম! মনে হলো একটা মিষ্টি লাভাস্রোত যেন জিভের ওপর খেলে বেড়াচ্ছে! পুরো শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা, ফেলতেও পারছি না, গিলতেও পারছি না। সবাই বিলক্ষণ শশব্যস্ত হয়ে পড়লো, হ্যা হ্যা করছি, গিন্নি একটা খবরের কাগজ নিয়ে দ্রুত হাওয়া আর দাঁত কিড়মিড় কচ্চেন, শাশুড়িমা খুবই উদ্বেগের সঙ্গে "আহা, একটু রয়েসয়ে খাবে তো" টাইপের কিছু একটা বলার চেষ্টা কচ্চেন, এমন সময়ে আমার কন্যারত্নটি ন্যায্য উদ্বেগে ফেটে পড়লেন, "সবেতে তাড়াহুড়ো করা তোমার স্বভাব। জল ঢেলে খাও নি কেন? নীট খেতে কে বলেছিল তোমায়? সবেতে ওস্তাদি"।
পরের কথা এহ বাহ্য। সেদিনই ফিরে এসে গভীর রাতে আমার বসকে মুম্বাই যাবার ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিই। জামাইষষ্ঠী চুলোয় যাক, ইজ্জতে গ্যামাক্সিন না পড়লেই হলো।
যদ্দিন না এ মেয়ের জ্ঞানগম্যি হচ্চে, তদ্দিন হেথা নয়, হেথা একদম নয়, অন্য কোথাও, অন্য যে কোনও খানে!
Outstanding Avik Da !!! শেষ লাইনের চমকটা ফাটাফাটি !! ইনফ্যাক্ট তোমার কন্যাই outstanding !!!! জানার ইচ্ছে রইলো সেইসময় বৌদি র কি রিঅ্যাকশন ছিল ??
ReplyDelete