0

বইঘর - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


বইঘর


সমর সেনের কবিতায় পৌরাণিক ইমেজ
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার
.

“To be really progressive in our time and country, where only a fraction is literate, is to preserve the integrity of what is good in our past tradition...”। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সম্মেলনে এই কথা বলেছিলেন সমর সেন। এলিয়ট ট্র্যাডিশনের ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন। সমর সেনও তাই। ভারতীয় পুরাণ গুলির মূল্য তিনি বুঝতেন। জানতেন কী অনবদ্য রূপকল্প সৃষ্টি হতে পারে সেগুলি থেকে। কিন্তু রোমান্টিক উচ্ছ্বাস তাঁর মনঃপূত ছিল না। কারণ তিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন “Poetry is not a turning loose of emotion।’’

“এ ভুজমাঝে হাজার রূপবতী
আচম্বিতে প্রসাদ হারায়েছে
অমরাবতী হতে দেবীরা সুধা এনে
গরল নিয়ে নরকে চলে গেছে। 

এ ধরণের রচনা আমার অনুরাগ আকর্ষণ করে না। প্রেমের সঙ্গে দার্শনিকতার সংমিশ্রণ সহজে ঘটে না। সেটার অতিচেষ্টা একটু হাস্যকর হয়। শেলী থেকে লরেন্স তার নিদর্শন…”।

কবিতা, পৌষ ১৩৪৮ এ প্রকাশিত কবির এই মনোভাবকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে বোধহয় সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় প্রেমের ইন্দ্রিয় বোধের তীব্র অস্তিত্বে সমর সেনের যতটা আস্থা ছিল, ইন্দ্রিয়াতীত মধুরতার অস্তিত্বে তাঁর সে বিশ্বাস ছিল না।
অল্প কটি কবিতায় বিরহ বা প্রেমের তীব্র সত্যতা বোধের উপলব্ধি সত্ত্বেও তাঁর অধিকাংশ কবিতায় বিরহ বোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের প্রতি এক বিরূপ মনোভঙ্গি।

‘উর্বশী’ তাঁর লেখার প্রেমের অন্যতম প্রতীক। পুরাণের উর্বশী স্বর্গের নর্তকী। দেহের অপরিমিত রূপ যৌবনকে ব্যবহার ক’রে তপস্বীর তপোভঙ্গ করাই তার কাজ। পৌরাণিক কাহিনীতে মাঝেমাঝে তাকে বন্দী করেছে মানুষের প্রেম। তবু সব সময় তাকে আবর্তিত করেছে এক অলৌকিক দেবদ্যুতি --- যা সাধারণ মানুষের পক্ষে করায়ত্ত করা অসম্ভব।

“যুগ যুগান্ত হতে তুমি শুধু বিশ্বের প্রেয়সী

হে অপূর্ব শোভনা উর্বশী।’’… এক প্রবল রোম্যান্টিক অনুভূতির প্রতীক রবীন্দ্রনাথের উর্বশী। কিন্তু সমর সেনের কবিতায় সেই উর্বশী সম্বন্ধে সর্বোচ্চ দাবী --- 

“তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!
কিম্বা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে
হে ক্লান্ত উর্বশী,” ...( সমর সেনের কবিতা - উর্বশী)

অথবা

“তাহলে আমার সমস্ত শরীরে কি আবার চকিতে আসবে
সমুদ্র মদির উর্বশীর স্বপ্ন?’’ ( মৃত্যু, সমর সেনের কবিতা)।

প্রাচীন সাহিত্য থেকে নেওয়া আর যে বা যাঁদের তিনি প্রেমের কবিতায় একাধিকবার ব্যবহার করেছেন তাঁরা হলেন -- ‘অগ্নিবর্ণ’, ' ‘পাণ্ডু’ এবং ‘ধৃতরাষ্ট্র’। রঘুবংশম কাব্যে আমরা রাজা অগ্নিবর্ণকে পাই। সংযত দাম্পত্যজীবন যাপনকারী দিলীপ রঘু ও রামচন্দ্রের বিখ্যাত বংশে নিষ্ফল যৌন- যথেচ্ছাচার ও আনুষঙ্গিক সুরায় লিপ্ত হয়ে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুদর্শনের পুত্র বংশের শেষ রাজা অগ্নিবর্ণ। 

“নির্জন গুহায় নিবিড় নিষিদ্ধ প্রেম,
ভিজে ফুলের মত নর্তকীর নরম শরীর,
প্রতীক্ষার স্পন্দমান কত সঙ্গীত উজ্জ্বল বুক,
তবু আজ মৃত্যু এলো আষাঢ়ের মেঘের মতো,
হে অগ্নিবর্ণ!” ( সমর সেনের কবিতা - অগ্নিবর্ণ)।

মধ্যবিত্ত জীবনের বর্ণহীনতার মধ্যে সমর সেনের কবিতায় একটি মেয়ের আবির্ভাব ঘটে এই ভাবে –

“স্বপ্নের মতো চোখ সুন্দর শুভ্র বুক
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভিক আভাস ;”
( একটি মেয়ে । সমর সেনের কবিতা)।

একই উদ্দেশ্যে সমর সেনের কবিতায় মহাভারতের রাজা পাণ্ডুর উল্লেখ -- ‘আমাদের মৃত্যু হবে পাণ্ডুর মতো’। যে সময়ে পাণ্ডু তাঁর স্ত্রীতে উপগত হবেন,সেই সময়ে ই মৃত্যুকে তাঁকে বরণ করতে হবে। মৃগরূপী ঋষিকুমারের এই শাপে পান্ডুর পুত্র‍্যোৎপাদন শক্তি প্রনষ্ট হয়। কিন্তু এক বাসন্তিক সময়ে মলয় বাতাসে যখন মানুষ যৌবন মধুপানে উদগ্রীব ঠিক তখনি অসামান্যা যৌবন লাবন্য সম্পন্না, পদ্মলোচনা মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সংযত করতে পারেন না নিজেকে। বিস্মৃত হন ঋষি অভিশাপ। মাদ্রীর নিবারণ করার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কামাতুর পাণ্ডু অনুল্লঙ্ঘনীয় ঋষিশাপ বহন করে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন। ( আদি। ১২৫)। নগরের বন্ধ্যা নিষ্ফল রতিক্রিয়া, পণ্য প্রেম, রিরংসার উত্তেজনা -- সমস্ত কিছুই অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিস্তীর্ণ তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার অবক্ষয় ও আসন্ন মৃত্যুর দিকে। অবক্ষয়িত ঘূন ধরা সভ্যতার প্রতীক হিসেবে রুক্ষ বিষণ্ণ শহর বড়ো বেশি চেনা, আমাদের হৃদিমধ্যের ভোমরা কোঠায় তার বাস। তাই সেই অবক্ষয় বা নির্বেদ বোঝাতে গিয়ে সমর সেন শুধু নাগরিক জীবনের ইমেজ ব্যবহার করেননি :সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ইমেজ ব্যবহার করেছেন একই উদ্দেশ্যে। পতিত জমি,বন্ধ্যাভূমি, ফণিমনসা, ক্যাক্টাস পূর্ণ মরুভূমির ইমেজ যখন এলিয়ট হয়ে সুধীন্দ্র নাথ পর্যন্ত সকলের কবিতায় জীবন বিমুখ সভ্যতার অনীহা প্রকাশে বারংবার ব্যবহৃত হতে দেখছিলাম তখন সার্থক উত্তরসূরী সমর সেন সেই ইমেজ গুলিকেই ঋণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মরুভূমি তার হৃদয় ভর্তি কাঁটার জ্বালা নিয়ে,শুকনো বালির অনুর্বর নিষ্ফলতা নিয়ে হয়ে উঠেছে বন্ধ্যা বিষাদিত শহরের মতোই অন্ত:সারশূন্য, অনুর্বর। বর্তমানে অবস্থানকারী কবিচিত্তের objective correlativeযেখানে ফণিনসা নেই সেখানেও তুল্য কোনও রুক্ষতার ইমেজ।

“একটি একলা বট খাপছাড়া ছায়া দেয়
প্রায় পত্রহীন সে প্রৌঢ় বট, বহুদিন মাখেনি সবুজ কলপ / কিন্তু তার শিকড়েরা ঊর্ধ্বমুখ আকাশ সন্ধানে।’’
(জোয়ার ভাঁটা ।) এখানে উপনিষদের সেই অমৃত বৃক্ষের অনুসঙ্গকে অনায়াসে আমরা চিত্রিত হতে দেখি। কেন যেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘যযাতি’ কবিতার নাগরিক একাকীত্ব শুধু নয় এই বটগাছ সামাজিক ভাঙনের মাঝে প্রতিরোধে অক্ষম এক নি:চেষ্ট, নির্লিপ্ত এক দর্শক বলে আমার মনে হয় এবং বিশুদ্ধ চৈতন্যেরও প্রতীক যেন এই যযাতি সদৃশ বট। এর আগে পৌরাণিক প্রতীক হিসেবে আমরা পেয়েছি পান্ডুকে। আর গতপত্র প্রবীণ ক্লান্ত বটের প্রসঙ্গে মনে যাঁর ছবি ফুটে ওঠে তিনি পান্ডু জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র। যার উল্লেখ সমর সেনের কবিতায় নিত্য পাচ্ছি। পাণ্ডুর অমিতাচার, ব্যর্থ যৌনাচার আর ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান অন্ধতা এই দুইয়ের মেলবন্ধনে সভ্যতা এগিয়ে চলেছে অনিবার্য ধ্বংসের পথে। যে পত্রহীন লোলুপ বট মাথা নাড়ে প্রবীণ ক্লান্তিতে সে যেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মূর্ত প্রতীক।

(১) -- “বহু পাপে সিদ্ধ এক মোক্ষহীন বৃদ্ধ
দন্তহীন কান্নায় বিলোল মাড়িতে
মৃত যৌবনের পাশে আগত চকিতে
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র!” ( ক্রান্তি) 
(২)- “শকুনি - চক্রান্ত শেষ, শঙ্কিত সঞ্জয়
বিবর্ণ প্রাসাদে ফিরে, সঞ্চিত স্বার্থের প্রতীক
লবেজান ধৃতরাষ্ট্রকে সভয়ে জানায়
পুনুরুজ্জীবনের বার্তা সাধারণ লোকের।” 
( লোকের হাটে) 

কেমন এক হিমায়িত বোধ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এসে লক্ষ্য করে এই শকুনির পাশা সমাজকে। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধতা কৌরবের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সর্বনাশের চিতা জ্বলার কারণ ও তাদের অন্ধতা। একাকী নি:স্ব বটগাছ এবং জরাগ্রস্ত কুরুরাজ যেমন সভ্যতার গড়ে ওঠা পলিজমা নদী,তেমনি প্রতীক নিরাসক্ত - অসংযমী বুদ্ধিজীবীদের। আমরা ই পাণ্ডু, আমরাই যযাতি, আমরাই একা বট, আমরাই ধৃতরাষ্ট্র ---। অক্ষম, চক্ষুহীন। নতুন সৃষ্টিতে অপারগ, বিপ্লব প্রতিরোধে অসমর্থ। ধৃতরাষ্ট্র যেমন চৈতন্যকে মৃত করে রেখে দেখছিল অলীক স্বপ্ন রাজত্ব করবে কৌরবগণ, তেমনি এই বিপরীত চিন্তাধারায় পুষ্ট কবি এই সামাজিক দায়ভাগ থেকে বারবার নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন শুদ্ধ বিষাদঘন এক কাব্যিক পরিমন্ডলে। কুরুরাজ কুরুরাজ্য শ্মশান হবার পর অনুতপ্ত হয়েছিলেন (আদৌ কি?), সুধীন্দ্র নাথ বলে উঠেছিলেন, “অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?” সেখানে নির্জন গ্রাম, সাঁওতাল পরগণার কুঁড়ে ঘর কল্পনা করার এইescapist মনোভাব তাঁকে মানায় না একি ‘নাগরিক’ আখ্যায় ভূষিত কবি জানতেন না? অবশ্যই তা তিনি বুঝেছিলেন। আর তাই সম্পূর্ণ রোম্যান্টিক হবার ভরপুর ইচ্ছে নিয়েও এই স্ববিরোধী কবি রোম্যান্টিক হতে পারেননি। সমর সেনকে জানা, বোঝা এক কঠিন যাত্রা। নিষ্ফল যৌনতার ও মধ্যবিত্তের অন্ধতার চিত্র তিনি অনেক এঁকেছেন। কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানের যে দায় আজও এই সভ্যতা ও সমাজ বহন করে চলেছে ---। মননের সংঘাতকে তুচ্ছ করে ‘ফ্রন্টিয়ারের’ সাদামাটা পৃষ্ঠা গুলির মধ্যে নিজেকে খুঁজে নিয়েছিলেন। সকলেই জানেন ১৯৪৬ এর পর কবিতা লেখা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কি ভাবে বিদায় নিলেন?নিম্নলিখিত দুটি অনবদ্য শ্লেষাত্মক পংক্তি উচ্চারণ করে। যে দুটি পংক্তির মধ্যে সমর সেনের কাব্য দর্শন সমগ্র ভাবে বিধৃত।

“যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে 
বছর দশেক পরে যাব কাশীধামে”…।।



ঋণ স্বীকার :- 
১) সমর সেনের কবিতা
২) আধুনিক কবিতার দিগ বলয় - অশ্রু কুমার সিকদার
৩) আধুনিক বাঙলা কবিতার দ্বিতীয় পর্যায় - সুমিতা চক্রবর্তী
৪) অনুষ্টুপ সমর সেন বিশেষ সংখ্যা


0 comments: