0

ছোটগল্প - সায়ন্ন্যা দত্তদাশ

Posted in

ছোটগল্প


খেলা 
সায়ন্ন্যা দত্তদাশ 


ফ্রকজামাটা কোলের কাছে গুটিয়ে তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছিল জয়া। ছোটটা অদূরে বসে একটা ভাঙা চিরুনি নিয়ে খেলা করছিল। রোদ্দুরটা এখন মিঠে ভারি। গায়ে লাগেনা। আকাশে কত্ত সুন্দর মেঘ ফর্সাফর্সা সুন্দর। সাবান ফেনায় হাতটা পিছলে যেতেই বিপদটা ঘটল। টুং করে একটা শব্দ আর ভেঙ্গে চিত্পাত ধরগিন্নির সাধের চায়ের কাপ। কাণ্ডটা ঘটা মাত্রই জয়া চোখ চালিয়ে দেখল এঘটনার আর কেউ সাক্ষী রইলো কিনা। যথারীতি মালতী বুড়ির চোখ এড়ালো না। সে গলা ফাটিয়ে শোকে বসল। 

- ও গিন্নি, দেখো না গো সব্বোনেশে মেয়েছেলেটার কাণ্ড। তোমার সখের জিনিস… ভেঙে টুকরো করলে গা! 

ধরগিন্নি সব দেখেশুনে ধুমাধুম দিয়ে দিলেন দুচার ঘা। কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবেন বলে হুমকিও দিলেন। গজগজ করতে করতে ভেতরে প্রস্থান করলেন। মারধোরের অভ্যেস আছে জয়ার। সে ফ্রকের খুঁটে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালে; দেখতে পেলে ছোটবোনের চোখ ভর্তি জল। ইঙ্গিতে দাঁড়াতে বলে সে ভেতরে গেলো বাসন গুছিয়ে রাখতে। একটু বাদেই ফেরত এলো ঝাঁটা হাতে নিয়ে। বোনের তখনও মনভার। দুয়ারগোড়াটা ঝাঁট দিতে শুরু করতেই বোন গুটিগুটি পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল।
- আমি মা কে বলে দেবো।
- কি বলবি?
- তোকে মারে! খুব মারে। কিছু বদমাশি না করলেও মারে। 
- দুর্! মারে কই?
- ওইতো মারল একটু আগেই। 
- মারল নাকি? ওটা তো একটা খেলা রে বোকা! দেখলিনা আমি কাঁদলামনা একটুও। দাঁড়া আর বকাসনি। কাজটা সেরে লিই; ঠাকুর দেখতে যাব প্যান্ডেলে। 


বেলা চড়েছে। রোদ্দুরটা ঘুরে পুকুরপাড়ে পড়েছে। দুইবোনে তাড়াতাড়ি পা চালায়। 

- দেখলি দিদি সিঙ্গটা কেমন রেগে আছে? আর কাত্তিক ঠাকুরের ময়ূরটা দেখলি? আমিও একটা ময়ূর পুষবোরে দিদি! 
- দুর্ বোকা! ওসব ঠাকুরদেবতায় পোষে। 
- কেন আমি পুষলে কি হয় ? 
- আচ্ছা, পুষিস। 

নিজের অনাগত পোষ্যের আনন্দে খানিকটা দৌড়ে নেই বিজয়া। কাঁকুরে রাস্তায় ধুলো ওড়ে। দূরে কোথায় ঢাক বাজে। জয়ার ভারি আনন্দ হয়। 
ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় দুইবোন। টিনের একচালা ঘরে কারা সব এসেছে। মা ঘোমটা মাথায় বসে আছে এককোণে। তাদেরকে দেখে ইঙ্গিতে বসতে বলে মা। জয়া লোকগুলোকে প্রণাম করে। লোকগুলো পঞ্চাশ পয়সার রসগোল্লা খায়। বিজয়া হাপুস নয়নে সেদিকে চেয়ে দেখে! তারা অনেকদিন মিষ্টি খায়না কেউ। লোকগুলো দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে সাইকেলে চেপে বাড়ি চলে যায়; জয়া জানতে পারে সাতদিন বাদে তার বিয়ে। 


আজ রাতটায় ঘুম আসেনা জয়ার। মনেমনে খুব অস্থির। মা তো গরীব। অর্ধেকবেলা খাওয়া জোটেনা তাদের। ইস্কুলে একবেলা ভরপেট খায় বিজয়া। ইস্কুল বন্ধ থাকলে তাও পায়না। বাবাকে মনে করলেই কান্না পায় তার। বাবা থাকতে সে স্কুলে যেত। পুজোয় জামা পেতো। তখন মা এত কাঁদতনা। মা রঙিন শাড়ী পরত। গোলকরে টিপ পরত। এই এত্ত সিঁদুর পরত মাথায়। তখন তারা খেতেও পেতো। তারপর কি যে হলো! বাবাকে পুলিশে মেরে ফেলল। কেন মারল ? বাবাতো বদমাশ লোক ছিলনা। বাবা মারা যাওয়ার পরেও পুলিশ আসত ঘরে। কিসব জিজ্ঞেস করত মাকে। মা কিছুই বলতে পারতনা। কাঁদত খালি। মায়ের খুব কষ্ট। পাশে ঘুমিয়ে থাকা মাকে দেখলো জয়া। গলার হাড়খানা ঠেলে বেরিয়েছে। চোখদুটোয় একপোঁচ কালি! মা খুব কাঁদত আগে। এখন আর কাঁদেনা কিন্তু আর হাসেওনা। মায়ের খুব কষ্ট; বুঝতে পারে সে। তার বিয়ে হয়ে গেলে মা ভালো থাকবে? হাসবে? বিয়ে হয়ে গেলে আর এখানে আসবেনা সে। সে থাকবে বরের সঙ্গেl বর কিকরে? ভালবাসে? বাবার মতো জামা কিনে দেয়? সাইকেলে ঘোরায়? রেগে গেলে মারে? ধরগিন্নির মতো শাস্তি দেয়? গায়ে ছ্যাঁকা দেয়? আরও রেগে গেলে দড়িতে ঝুলিয়ে দেয়? যেমন শ্যামাকে দিয়েছিল? জয়ার মনখারাপ হয়ে যায়। খুব কষ্ট হয়। অনেক কষ্ট; ধরগিন্নির মারের থেকেও বেশি। সে নিঃশব্দে উঠে পড়ে। গায়ের কাঁথাটা ভাঁজ করে রাখে। মা আর বিজয়া ঘুমিয়ে কাদা। সে আস্তে করে কপাট খোলে; বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারে। 


ঝোপের ভেতর থেকে কে যেন খপ করে হাতটা ধরে নেয় জয়ার। পুকুরে তখন রুগ্ন চাঁদের ছাপ। রাত প্রায় শেষের দিকে। কোথায় যেন একটা রাতজাগা পাখি ডানা ঝাপটায় সজোরে। 
- এখানে কি করছিস রে? রাতেরবেলা একা বেরিয়েছিস? জানিসনা দিনকাল খারাপ? 

জয়া উত্তর দিতে পারেনা। কেঁদেকেঁদে গলা শুকিয়ে কাঠ। তারওপর লোকটাকে দেখে যারপরনাই ভয়ই পায় সে। আপাদমস্তক একটা বেগুনি চাদরে ঢাকা লোক। শুধু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে নেকড়ের মতো। 

লোকটা তাকে মেরে ফেলবে কি? মরতে তার ভয় লাগে খুব। বাবা যখন মরে গেল; গুলিতে মুখটা ছেতরে গিয়েছিল। চেনা যাচ্ছিলনা। শুধু একটা কালো থেবড়ানো রক্ত জমা পিণ্ডের মতো পড়েছিল একপাশে। জয়া শুধু ঘামতে লাগলো। লোকটা কি করবে ওকে নিয়ে? 
- কিরে? বল্ এখানে কেন? 
জয়া হুহু করে কেঁদে ফেলে। কোনওমতে বলে
- আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। 
- কেন পালিয়েছিস? কোথায় যাবি? 
- জানিনা। আমি বিয়ে করবনা তাই পালিয়ে এসেছি। 
- তুই ইস্কুলে যাস? 
- লোকের বাড়ি খাটি। আমরা খুব গরীব। বাবা নেই। ইস্কুলে যাইনা। 
- বিয়ে করবিনা? তো কি করবি? 
- যেকুনো কাজ করব। ঝাঁটা, মোছা, বাসনমাজা, কাপড় কাচা সব পারি। 
- লেখাপড়া করবি? 
- কে পড়াবে? আমাদের অতো টাকা নেই। 
- টাকা লাগেনা। এমনিই পড়া যায়। ওখানে থাকবি আর লেখাপড়া করবি। 
- পয়সা ছাড়াই? 
পয়সা ছাড়া এজগতে কিছু হয় বলে ধারণা ছিলনা জয়ার। সে সাংঘাতিক অবাক হয়। অবিশ্বাসও লাগে। লোকটা মজা করছেনা তো? সে দুম করে বলে দেয় 
- এরকম হয় নাকি? 

লোকটা খলখলিয়ে হেসে ওঠে। অন্ধকারে সে হাসিটা অনেক অনেক দূরে ছড়িয়ে যায়। লোকটা জয়ার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে বাতাসে তখন ভোরের গন্ধ। গাছেগাছে পাখির সাড়া। সূর্য্য তখনও ওঠেনি ভালো। 
- হয় রে হয়। জীবন তো একটা খেলা রে। এই ভাবছিস জিতলাম …দেখলি কিচ্ছু পারিসনি! আর যখনই খেলাশেষ ভেবে বসে পড়লি, দেখবি অন্যপাশে দরজা খুলছে। যতক্ষণ ধুকপুকটা চলবে ততক্ষণই খেলবি। তুই, আমি তো এসেইছি খেলবো বলে রে বুড়ি। কোনও কিছু শক্ত ক’রে ধরবিনা। কেউ কারুর নই রে। সব একটা সাজানো খেলা। যতক্ষণ খেলবি ততক্ষণ থাকবি। একবার নেই হয়ে গেলে আর ফেরা যায়না। আমি আসি; ভোর হয়ে এল। দুপুরে তোর বাড়িতে একটা দিদি যাবে। ও তোকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে। চলে যাস ওর সাথে। আমি গেলাম। মনে রাখিস, খেলতে তোকে হবেই। অন্তত যতক্ষণ আছিস। 

কথাটা শেষ করেই লোকটা উধাও হয়ে যায় বুড়োবটের ভেতর। ওপারে ঘন জঙ্গল; চোখ চলেনা। দেপাড়ার মণ্ডপে ঢাক বাজছে মৃদুমৃদু। জয়া বুক ভরে বাতাস নিল বুকে। নিজেকে বলল খেলতে তাকে হবেই।


0 comments: