0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত

॥৭॥



যথার্থ জীবিত না মিথ্ এই ত্রয়ী/ আকাশ হতে পুষ্পবৃষ্টি সাংস্কৃতিক জয়ী 

গোরাচাঁদ 

হঠাৎ দুটো পাঁচসেলের টর্চ একসাথে চোখের উপর পড়তে গোরাচাঁদ চোখে অন্ধকার দেখলেন। তীব্র আলোয় আলোময় হয়ে উঠলো যক্ষ্মা পীড়িতের ছোট বারান্দা। টর্চের পিছনে টুকরো টুকরো ভিনদেশীয় কথোপকথনে হতবাক গোরাচাঁদ পরিবেশ পরিস্থিতি একেবারেই ভুলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরিষ্কার বোধগম্য রাশিয়ান ভাষা। গোরাচাঁদ এই ভাষা পড়তে ও বলতে পারেন। ঊনিশশো পঁচাশি সালের কথা। যদিও বা অর্থনৈতিক কাঠামো রাশিয়াতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল,তখনও সোভিয়েত মিলিটারি ফোর্স সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে রয়েছিল কম্যুনিজম বজায় রাখতে। গোর্বাচেভ তৈরি হচ্ছিলেন সোভিয়েত রাজনৈতিক পটভূমিকায় পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্ত লাগু করতে। পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ ভারতে কম্যুনিষ্ট ঘরানা। ভারত রাশিয়া মৈত্রী তখন এতই ভাল ছিল, রাশিয়া থেকে সস্তায়, একরকম ফ্রিতেই পাওয়া যাচ্ছিল সেখানের ঝাঁ চকচকে ছবিওলা বাংলা ভাষায় বড়দের ও বাচ্চাদের বই, বিজ্ঞান ও সোভিয়েত লিটারেচার বইগুলো। সেই সাম্যবাদী বই প্রকাশনীর সুত্রে গোরাচাঁদের রাশিয়া যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ঊনিশশো সত্তরের সেই খুন জখম ক্লেদজ রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে পালিয়ে এখানে আসার দীর্ঘ সময় পর গোরাচাঁদের সেই সফল ও মুক্তমনের ভ্রমণ ছিল। সেখানে তিনমাস থেকে শিখে ফেলেছিলেন রাশিয়ান ভাষা। এখন হতবাক গোরাচাঁদ বুঝতে পারলেন না রাশিয়ান ফৌজী এখানে কি করছে। 

টর্চের আলো গোরাচাঁদের মুখ থেকে সরে জেরকার শরীরে ঘুরতে লাগলো।গোরাচাঁদের তখন পরিস্থিতির আভাস হতেই সব মনে পড়ে গেল আর উনি সিঁটিয়ে উঠলেন। তিনি জানেন, পেরো উবু হয়ে বসে, তার পিঠের ওপর জেরকা। পেরো এখন মোস্ট ওয়ান্টেড। ওর মাথার দামও দু লাখ টাকা রাখা হয়েছে। ধরতে পারলে সটান গুলি করে মেরে ফেলবে ওকে। টর্চের আলো তখন জেরকার গলার কাছে স্থির। একটা দগদগে ঘা চিবুক হয়ে গাল অব্দি শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। এখন টানা হ্যাচড়াতে সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। গোরাচাঁদ ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন। ওরা এক দুবার একটা টর্চ নিজেদের হাতে রাখা একটা কাগজে ফোকাস করল। অস্পষ্ট জড়ানো উচ্চারণে পেরো আর জেরকার নামও বললো। গোরাচাঁদ এবার দৃষ্টি একটু একাগ্র করে দেখতে চাইলেন টর্চের পিছনের মানুষদের। নিশ্চয় ওদের হাতে সেই ওয়ান্টেড লিস্ট আর ছবি। আর...আর... এক ঝলক ওদের হাতে ধরা অস্ত্রও দেখা গেল। রাশিয়ান ম্যাকারভ পিস্তল আর লাইট মেশিনগান। জেরকার শরীর থেকে ওরা কিন্তু টর্চ একবারও সরাচ্ছে না। কি মতলব ওদের? জেরকার বুক জোরে জোরে উঠছে নামছে। বেশিক্ষণ আর ও বাঁচবে না।হাসপাতাল হলে অক্সিজেন আর স্যালাইন চালিয়ে দিলে হয়তো বেঁচে যেতো। ও তো মরবেই। এখন টর্চ জেরকার পিঠের নিচে একটু ফোকাস করলেই পেরো খতম। জেরকা ও পেরো তাঁর জীবনের শ্বাস প্রশ্বাস। তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে একের পর একজন ফের বদল করে আসা যাওয়া করেছে। এই প্রথম একসাথে দুজন। কিন্তু ওরা সমানে মানব কল্যাণে ব্রতী হতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। এদের কাউকে হারাতে চান না তিনি। ওদের সাথে এই মেল বন্ধন সমুর সহ্য হয় না। তার এত ঘৃণ্য আক্রোশ যে দালাল লাগিয়ে গরীব সরল কটা আদিবাসীকে কিছু টাকা খাইয়ে এখানে তার সাথে পেরোর একটা ঘৃণিত সম্পর্কের জের তুলেছে। কিন্তু এখন তো আর কোনও উপায়ই নেই। তার মানে শেষ হয়ে গেল জীবন যাপন ! তার মানে শেষ হয়ে গেল এই উপজাতিদের বাঁচার লড়াই? হা ঈশ্বর! ঈশ্বরের কথা মনে হতেই একটা অজানা অমূর্তের উপরে ক্ষোভ মাথার ভিতরে ফেটে পড়তে চাইলো। প্রচণ্ড জোরে চিত্কার করে উঠতে চাইলেন তিনি। কী ঈশ্বর? কিসের ঈশ্বর? আমি নিজের আত্ম বিশ্লেষণ করে দেখেছি। নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারবার। এই আমিই তো চাই প্রকৃতির সন্তানদের বিপন্নতা থেকে উদ্ধার করে আবার প্রকৃতির কোলে পুনর্বাসে ফিরিয়ে আনতে। তবে আমারই ঔরসের জন শোষক শ্রেণীর এক প্রতিনিধি হয়ে এমন খল কপট আচরণ কার নির্দেশে করছে? ঈশ্বরের? এই রাশিয়ান আর্মি ডেকে এনেছে কারা? ওদের হাতে সার্চ ওয়ারেন্ট ধরালো কে? বাবার উপরে আক্রোশ হিংসা হতে পারে। এমন ঘটনা অনেক হয়েছে হচ্ছেও। কিন্তু সমু এত বড় শ্রেণী শত্রু হয়ে দাঁড়াবে এটা গোরাচাঁদ স্বপনেও ভাবেননি।

এই শিমুলিয়া গ্রামের সংলগ্ন তামাখুন বলে টিলার পাশে বননীল ঝাড়ের মস্ত জঙ্গল। এই বেগুনি রঙের বননীল ফুল বেঁটে পুকুরে মিশিয়ে দিয়ে বারবার সেখানের পুকুরের সব মাছ মেরে ফেলেছিল কে বা কারা। মাছ ও ব্যাঙ মারার এক অব্যর্থ বিষ। সেখানের অধিবাসী বা আদিবাসীদের তাড়ানোর জন্য আরো কতরকম যে বিষ মারণ অস্ত্র ফসল না উত্পাদনের তুকতাক হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তার ফলে সেখান থেকে প্রায় উচ্ছেদই করে ফেলেছিল স্বার্থান্বেষী কে বা কারা।তবে দুচার বার জিওলজিক্যাল সার্ভে ওই বননীল ঝাড়ি দেখে নিশ্চিত হয়েছিল এখানে কপার মানে তামা ধাতুর অফুরন্ত ভাণ্ডার আছে। সেখানের লাল সবুজ নুড়ি পাথর দেখে গোরাচাঁদ নিশ্চিত হয়েছিলেন। নিশ্চয় সেই কারণেই কেউ সেইখান থেকে সেখানের উপজাতিকে সরাবার দীর্ঘমেয়াদী প্ল্যান করেছে। এখন গোরাচাঁদের মনে হচ্ছে, এমন তো নয় ! সমু রাশিয়ানদের ডেকে এনেছে জেরকা ও পেরোকে শেষ করিয়ে পথের কাঁটা নির্মূল করতে? এই এলাকায় তো অনেক তাবড় তাবড় মাইন্স ওনার ঘুরঘুর করছে। কী জানি ! হয়তো খনি খনন কাজে রাশিয়ানদের সাথে চুক্তি হয়েছে! সমু তাই ওয়ারেন্ট ওদের হাতেই দিয়েছে! 

গোরাচাঁদের মনে হল তার মাথা একেবারেই শূন্য, ফাঁপা। এখন কি করা উচিত কিছুই ভাবতে পারছেন না।

হঠাত্‍ তাঁর মনে হল দুটো টর্চের ফোকাস যেন দুদিকে সরে গেল। একটি তৃতীয় টর্চ মাঝখানে এসে থামল। সেই টর্চের মালিক বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে সরাসরি দক্ষ আঙুল একেবারেই জেরেকার গলার জুগুলার নাড়িতে রাখল আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত গলায় নিজের রাশিয়ান ভাষাতে অন্য দুজনকে কমান্ড করল। গোরাচাঁদ তার মানে পরিষ্কার বুঝতে পড়লেন। এই সৈনিকটি উচ্চপদস্থ অফিসার। উনি ওদের বললেন এক্ষুনি ওকে তুলে নিয়ে এমারজেন্সি ইউনিট তাবুতে নিয়ে চল। ডাক্তার সোলোকভকে খবর দাও। প্যাথো ওপেন কর। চার পাঁচ জওয়ানকে রেডি হতে বল। এর এখন দু তিন ইউনিট ব্লাড লাগবে। কুইক।

দুজন দু দিক থেকে টর্চ বগলদাবা করে এসে জাপটে ধরে তুলে নিলো জেরকাকে। গোরাচাঁদ ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। পেরো এবার এক্সপোজড। কয় মুহূর্ত ওমনি জড়বৎ ছিলেন তাঁর মনে নেই। কাঁধে ভারী একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। সামনে তাকিয়ে তিনি প্রথমে পেরোকে খুঁজতে লাগলেন। নেই। কোথাও পেরো নেই। তার সংগীটি বোকার মতন ফিকফিক করে হাসছে। তাহলে পেরো অনেক আগেই পালিয়েছে! পেরোর উপর আস্থা আর শ্রদ্ধা দুই বেড়ে গেল। রাশিয়ান অফিসারটি ইংরাজিতে বললেন –কাম মিঃ দাস। লেটস টক এবাউট। গোরাচাঁদ স্মিত হেসে রাশিয়ান ভাষাতেই জবাব দিলেন।

0 comments: