2

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ১৩
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়




Diary Entry - 10
9th. July 1942, Thursday.

প্রিয় কিটী,

শেষ পর্যন্ত আমাদের আর পুরানো জায়গায় থাকা হলো না। আমরা - আমি, বাবা, মা, প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হাঁটা শুরু করলাম। মারগট আগেই সাইকেলে গিয়েসের সাথে বেড়িয়ে গিয়েছিল। সে বেরোনোর পর আমরা অচেনা জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। সে কোথায় যাবে, সেটা যেমন জানতাম না, তেমনি আমরা কোথায় যাচ্ছি, সেটাও জানতাম না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করব তারও কোনও উপায় ছিল না। সাথে ছিল আমার স্কুল ব্যাগ, আর বড় একটা বাজারের ব্যাগ। ব্যাগগুলিতে যতটা জিনিষ নেওয়া সম্ভব, ততখানি জিনিষ ঠেসে ভরে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। ব্যাগগুলোতে এমন ভাবে প্রয়োজনীয় জিনিষ ভর্তি করতে হয়েছিল, যে যাতে ভিতরের জিনিষ রাস্তায় না পড়ে যায়, তারজন্য সেগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিতে হয়েছিল। ঠিক মতো শক্ত করে না বাঁধলে, রাস্তায় যে’ কোনও জিনিষ, যে কোন সময়, খুলে পড়ে যেত, বা পড়ে যেতে পারত। আর আমরাও ধরা পড়ে যেতাম। বুঝতেই পারছ আমাদের যাত্রা কোনও “শুভ যাত্রা” ছিল না। 

রাস্তায় আমাদের আশপাশ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা নিজেদের চোখকে আড়াল করে, আমাদের দেখার চেষ্টা করছিল। হয়তঃ সবাই বুঝতে পারছিল আমরা কারা, কোথায় যাচ্ছি বা কেন যাচ্ছি!! সহানুভূতি জানানো ত’ দূরের কথা, আমাদের দিকে সোজা চোখে তাকাতেও বোধহয় ভয় পাচ্ছিল। তাদের ভয়, যদি কেউ দেখে ফেলে!! সরকারী লোকেরা যদি তাদের সন্দেহ করে! কিংবা, দেখলে যদি জিজ্ঞাসা করতে হয়, যদি আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে, করুণায় চোখদুটো ভিজে যায়, তা’হলে ত’ সরকারী বাহিনীর সন্দেহ আরও বেড়ে যাবে। তাই সোজা হয়ে তাকানোর সাহসও তাদের ছিল না। তারাও হয়তঃ মনে মনে আমাদের সঙ্গ দিতে চাইছিল। তাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমার অন্ততঃ তাই মনে হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমাদের সঙ্গ দিতে না পারার জন্য তারা মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে দুঃখ পাচ্ছে। আর তা’ অব্যক্ত ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের চোখ দিয়ে। মুখে, মনের ভাব প্রকাশ করার অন্যতম অন্তরায় ছিল আমাদের জামায় লাগানো হলুদ রঙের তারা।সেই তারাটিই’ হয়ে উঠেছিল আমাদের সামাজিক পরিচয় আর মর্যাদার প্রতীক। হলুদ তারার জন্য আমরা আর সাধারণ মানুষ ছিলাম না, আমরা হয়ে গিয়েছিলাম শুধু ইহুদি। সবার থেকে আলাদা, সমাজ থেকে আলাদা, আমাদের পাশের মানুষ থেকেও আলাদা এক অচেনা বা ভিন্ন গ্রহের জীব। আর তাই আমাদের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস কারুর ছিল না। কারণ রাষ্ট্রের চোখ কঠোর ভাবে তাদের দিকে নজর রেখেছিল। তাকে অতিক্রম করে সহানুভূতি দেখানোর কথা তারা ভাবতেও পারে না। 

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই বাবা আর মা আমায় তাঁদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার খুঁটিনাটি বলতে শুরু করলেন। কেন বলতে শুরু করলেন জানি না। তবে, আমার শোনা ছাড়া আর কোন কাজও ছিল না।কান ছিল বাবার কথায়, আর চোখ ছিল এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। যেতে যেতেই জানতে পারলাম, গত কয়েকমাস মাস ধরে তাঁরা ( আমার বাবা আর তার ওপেক্টা হাউসের ঘনিষ্ট সহকর্মীরা ) আমাদের সংসারের প্রত্যেকদিনের যাবতীয় অস্থাবর এবং প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে, আমাদের অনির্দিষ্ট গন্তব্যকে বা বাসস্থানকে গুছিয়ে তুলাছেন। আস্তে আস্তে এমনভাবে তৈরী হয়েছেন, যাতে খুব বেশী হলে ১৬ই জুলাই-এর মধ্যে অন্য কোন ডেরায় নিশ্চিন্ত নিরাপদে সপরিবারে চলে যেতে বা আত্মগোপন করতে পারেন। কারণ তাঁরা, বিশেষ করে আমাদের বাবা, বুঝেছিলেন যে তারপর আর আমরা এখানে থাকতে পারবেন না। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বাধ্য হন তাদের পরিকল্পনা অন্ততঃ দশ দিন এগিয়ে আনতে। বিশেষ করে মারগটকে ডেকে পাঠানোর পর বাবা আর দেরী করতে চাননি। তিনি ঠিক করেন দ্রুত আমাদের নিয়ে বেরিয়ে যাবেন, এবং অন্তরালবর্তী হবেন। এর ফলে, পরিকল্পনা অনুসারে , আমারা যে জায়গায় এখন যাচ্ছি , সেই জায়গাটা তাঁরা ঠিক মতো সাজিয়ে গুছিয়ে বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন নি। তাতে হয়তঃ আমাদের একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু নাৎসির গেস্টাপোর হাতে বন্দী হওয়ার চেয়ে সেটা অনেক প্রত্যাশিত।

যে বাড়ীতে বাবার অফিস ছিল, ঠিক তার পিছনের দিকে একটা সংযুক্ত অংশ আছে। জায়গাটা সাধারণ চোখে ওপেক্টোর সামনে থেকে দেখা যায় না। ওপেক্টোর সামনের রাস্তায় দাঁড়ালেও সহজভাবে পেছনের অংশে কি আছে, তা’ বোঝা যায় না। জায়গাটা সাধারণ লোকচলাচলের জায়গা থেকে একটু আড়ালে অবস্থিত। অব্যবহার্য অবস্থায় পড়ে আছে। তাই কারুর নজর সেই দিকে চট করে পড়ে না। পড়লেও, প্রথমেই সেটাকে গো-ডাউন বলে মনে হয়। বাবা বললেন সেটাই হবে আমাদের গোপন আস্তানা। বাইরে থেকে বাড়ীর ভিতরের অবস্থান বা লোকেদের চলাফেরা বোঝা বা অনুমান করা শক্ত। কেন শক্ত, তা আমি তোমায় পরে বলব। বাবা খুব একটা বেশী লোক নিয়ে কাজ করতেন না। বাবার সঙ্গে কাজ করতেন, মিঃ ক্রেলার, কোপহিউস এবং মিয়েপ। আর ছিলেন তেইশ বছরের মহিলা টাইপিস্ট ইলি ভাসন। এঁদের সবাইকে আমাদের আসার বা সম্ভাব্য অবস্থানের কথা জানান হয়েছিল। মিঃ ভাসন (ইলির বাবা) আর তাঁর দুই ছেলে স্টোরে কাজ করতেন। এঁদেরকে কিন্তু আমাদের আসার কথা জানান হয়নি। 

বেপ ভোস্ক্যুজী ( Bep Voskuiji ) জন্মঃ ০৫-০৭-১৯১৯; মৃত্যু ঃ ০৬-০৫-১৯৮৩ । একেই অ্যানি ইলি ভাসন নামে উল্লেখ করে। ভোস্কুজী ৬৩ বছর বয়সে মারা যান। জাতিগতভাবে ভোস্কুজী ছিলেন ডাচ নাগরিক। ওপেক্টোতে তিনি সেক্রেটারির কাজ করতেন। তাঁর বাবার নাম ছিল, জোহানেস হেনড্রিক ভোস্কুজী। ১৯৩৭ সালে ভোস্কুজী সেক্রেটারি হিসাবে ওপেক্টোতে যোগ দেন, ১৯৪২ সালের মধ্যে নিজের কর্ম দক্ষতায় প্রশাসনিক ম্যানেজার হন। 


এবার তোমায় বাড়ীটার বর্ণনা দিই। একদম নীচের তলায় বাড়ীতে ঢোকার প্রধান প্রবেশ পথ। সদর দরজা দিয়ে ঢোকার পর দ্বিতীয় একটি ঢোকার পথ ছিল। যেখান দিয়েও প্রবেশ করা যেত। ওখান দিয়ে প্রবেশ করলে সোজা সিঁড়ির কাছে চলে যাওয়া যেত। আমি নিচে একটা ছবি বা স্কেচ করে দিয়েছি, ওটা দেখলে তুমি ভাল বুঝতে পারবে। এই সিঁড়ির কাছে চলে যাওয়ার জায়গাটাকে আমি “A” চিহ্ন দিয়ে মার্কা করেছি। সিঁড়ির উপর আরও একটা দরজা আছে। তাতে ঘষা কাঁচ লাগানো, আর তার ওপর কালো রঙ দিয়ে বড় বড় করে লেখা “অফিস” কথাটা। ওটাই ছিল এখানকার সবথেকে বড় প্রধান দপ্তর। ওটা শুধু বড়ই ছিল না, ওখানে আলো যেমন বেশী তেমনি ওখানে প্রচুর জিনিষপত্র ঠাসা। ইলি, মিয়েপ আর কোপহিউস দিনের বেলায় ঔ দপ্তরে বসে কাজ করত। ওটার পাশেই একটা প্রায় অন্ধকার ঘড় ছিল। তার মধ্যে একটা সিন্দুক, একটা আলমারি আর একটা অপেক্ষাকৃত বড় খাবার রাখার আলমারি ছিল। ওটাকে পার্টিশন হিসাবে ব্যবহার করে দ্বিতীয় ছোট একটা অফিস ঘড় তৈরী করা হয়েছিল। আগে মিঃ ক্রেলার এবং মিঃ ভ্যান ডান এখানে বসতেন। এখন শুধু মিঃ ক্রেলার বসেন। বড় অফিস ঘড়টা দিয়ে মি” ক্রেলারের ছোট অফিস ঘড়টাতে যাওয়া যায়। কিন্তু দুটোর মধ্যে একটা মোটা কাঁচের পাল্লা আছে। পাল্লাটা একমাত্র ভিতর থেকেই খোলা যায় , বাইরে থেকে সহজে ওটা খোলা যায় না। 

মিঃ ক্রেলারের অফিসের সামনে সরু বারান্দা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে প্রথমেই পড়বে কয়লা রাখার জায়গা। তার পাশের চারটে সিঁড়ির ধাপ উঠলেই পড়বে বাড়ীর সবথেকে সুন্দর একটি প্রদর্শনী ঘড়। এটা হল ব্যক্তিগত অফিস। স্বল্প অলোয় উদ্ভাসিত, সুদৃশ মর্যাদা পূর্ণ আসবাব পত্রে সুসজ্জিত ঘড়। মসিনাতেলের প্রলেপযুক্ত কাপড়ের ওপর সুন্দর গালিচা বিছানো মেঝে। রেডিও, সুদৃশ্য আলো ইত্যাদি সবকিছুই প্রথম শ্রেণীর জিনিষপত্র দিয়ে সাজানো। ঠিক তার পাশেই একটা দরজা, যেটা দিয়ে একটি প্রশস্ত রান্নাঘড়ে পৌছান যায়। রান্না ঘড়ে গ্যাস স্টোভ আর গরমজল বাহিত কল আছে। আর তার পাশের দরজাটা হল শৌচাগার বা বাথ্রুমে যাওয়ার দরজা। এই সব নিয়ে প্রথম তলা বিন্যস্ত। নীচে স্কেচটা দিলাম। ওটা দেখলে তুমি আমাদের ওপেক্টোর অফিস ঘরের ভিতরটা ভাল ভাবে বুঝতে পারবে। 

নীচের তলার পাশেই একটা কাঠের সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় যাওয়া যায় (ছবিতে আমি “ B” চিহ্ন দিয়ে বুঝিয়েছি )। দো’তলায় উঠেই একটা ছোট নীচু জায়গা আছে, যেখানে কয়েকটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে।এই স্বল্প নীচু জায়গার দু’প্রান্তে দুটি দরজা। বাম দিক দিয়ে ঢুকলে, ভাঁড়ার ঘড়ের মধ্যে দিয়ে বাড়ীর সামনের দিকের চিলে-ছাদের দিকে যাওয়া যায়। আর ঠিক এর পাশের রেলিং দেওয়া সিঁড়ি দিয়ে সোজা নীচে নেমে গেলে সোজাসুজি একতলার আর একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার ওপরের সদর দরজার সামনে পৌছান যায় ( ছবিতে “C” চিহ্নের দিকে তাকাও ) 


নীচের দিকে নামার যে জায়গাটা আছে, ( “B” চিহ্নের একটু ওপরে যেখানে “E” চিহ্ন দেওয়া আছে ) অর্থাৎ নামার জায়গাটার ঠিক ডান দিকের দরজাটা খুললে সোজা আমাদের গুপ্ত “সংযুক্ত” উপগৃহের অংশে চলে আসা যায়। বাইরে থেকে দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে না যে এরকম একটা অনুজ্জ্বল দরজার ওপারে অতগুলো গোপন ঘড় আছে। ডানদিকের অনুজ্জ্বল দরজায় ঢোকার জন্য কয়েকটি সিঁড়ি বা ধাপ ওপরে উঠতে হবে। ধাপ গুলো পেরোলে তবেই ভিতরের ঘড়গুলোতে প্রবেশ করা যাবে। ( নীচে এই ব্যাপারে আরও বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে – লেখক।) 

দো’তলার সিঁড়ির ঠিক বিপরীত দিকে একটা প্রবেশ পথ আছে। প্রবেশ পথের বাঁ’দিক বরাবর ছোট বারান্দা। এই বারান্দা দিয়ে এলে তুমি একটি ঘড়ের মধ্যেপ্রবেশ করবে। এই ঘড়টা হল, বর্তমানে ফ্রাঙ্ক পরিবারের শোওয়া- বসার ঘড় । এর পাশের দরজা দিয়ে অপেক্ষাকৃত একটি ছোট ঘড়ের মধ্যে যাওয়া যায়। এই ছোট ঘড়টা হল এখন ফ্রাঙ্ক পরিবারের দুই যুবতি বা কিশোরী মেয়ের পড়ার আর শোওয়ার ঘড়। ডানদিকে একটা জানালাবিহীন ঘড় আছে। সেটা এখন হাত্মুখ ধোয়া আর বাথ্রুম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এটা একটা দরজা দিয়ে আমার আর মারগটের ঘড়ের সঙ্গে যুক্ত। এবার তুমি যদি পাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠ, এবং দরজাটা খুলে দাও, তা’হলে তুমি অবাক হয়ে দেখবে খালের ধারে এ’রকম একটা পুরানো বাড়ীর মধ্যে একটা বড় এবং উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সুন্দর ঘড়। এই ঘড়ে গ্যাস স্টোভ ছিল (ভাগ্যভাল আগে এই ঘড়টা ল্যাবরেটরী হিসাবে ব্যবহৃত হত), আর ছিল একটা জলের স্রিঙ্ক বা বেসিন। বর্তমানে ভ্যান ডান দম্পতি এটাকে রান্নাঘড় হিসাবে ব্যবহার করেন। এ’ছাড়াও সাধারনভাবে বসার জায়গা , খাওয়ার জায়গা ছাড়াও একটি ছোট অংশকে বাসন পরিষ্কার করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। 

কয়েকদিনের মধ্যেই এই ছোট দরদালানটাই হয়ে উঠবে পিটার ভ্যান ডানের ছোট এপ্যারট্মেন্ট। আর এর ঠিক এর নীচেই পড়ে থাকবে একটা প্রশস্ত গৃহ। বুঝতেই পারছ, কোথায় এলাম আমরা। যাইহোক , আমি আমাদের গোপন “উপগৃহের” পরিপূর্ণ পরিচয় তোমায় দিলাম।

তোমার অ্যানি। 



অনুবাদকের বিশেষ ভাষ্য- 

অ্যানি ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারের অন্তরালবর্তী হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এই প্রসঙ্গে আলোচনা, পাঠকের নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪০ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড দখল করে। এর তাৎক্ষনিক প্রভাব পরে হল্যান্ডে বসবাসকারী ইহুদি জনজাতির উপর। নাৎসি প্রশাসনের নির্মম ইহুদি বিরোধী ‘প্রশাসনিক প্রত্যাদেশ’, এই জন-জাতির সামাজিক জীবনকে দুর্বিষহ, এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে অসহনীয় করে তোলে। নাৎসি শাসনের দুর্বিষহতার আভাস অ্যানি ফ্রাঙ্ক প্রথম দিকে খুব বেশী অনুভব করতে পারে নি। কেবল, তাকে তার স্কুল ছেড়ে, ইহুদি সেকেন্ডারি স্কুলে নতুন করে ভর্তি হতে হয়েছিল। তবে অ্যানি ফ্রাঙ্কের বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক নাৎসি অধিগ্রহণের পরই বুঝতে পেরেছিলেন, যে ইহুদিদের সামনের ভবিষ্যৎ নাৎসি শাসনে বিপর্যস্ত ও ভয়ংকর হয়ে পড়বে। তাই নাৎসি অধিগ্রহণের অনতিকাল পর থেকেই, যে কোন সময়ে, সপরিবারে কোন গোপন গৃহে বা স্থানের অন্তরালে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। তাঁর দিকে নিঃস্বার্থ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাঁর ব্যবসার সাথে যুক্ত তাঁর সহযোগীরা। 

ওটো ফ্রাঙ্ক নেদারল্যান্ডে তাঁর “ওপেক্টো” (Opekto) কোম্পানীর বোর্ড মালিকানা ভিক্টর ক্যুগল্যার ( Victor Kuglar ), জোহানেস ক্লেম্যানের ( Johannes Kleiman ) হাতে হস্তান্তর করেন। কারণ তাঁরা জাতিগত পরিচয়ে ইহুদি ছিলেন না। তারপর তাদের এবং ওপেক্টো কোম্পানীর টাইপিস্ট মিয়েপ গিয়েসের সহায়তায় অফিস বিল্ডিঙ্গের ঠিক পিছনে একটি গোপন অ্যানেক্স ভবন বা উপগৃহ তৈরী করা শুরু করেন। ডাচ ভাষায় এই ধরণের বিল্ডিংকে বলা হয় এয়াকটেরহৌস (Achterhuis)। অর্থ হল, মূল্ভবনের পিছনে অবস্থানকারী সংযুক্ত অংশ। শুধু তৈরী করাই নয়, তিনি ক্রমে ক্রমে সেটিকে বসবাসের উপযোগী করে সাজাতেও শুরু করেন। কারণ তিনি অনেক পূর্ব থেকে অনুমান করতে পেরেছিলেন, যে, অল্পকালের মধ্যেই তাঁকে সপরিবারে নাৎসি হাত থেকে বাঁচতে এখানে আত্মগোপন করতে হবে। 

উপগৃহটি ছিল ঠিক মূল ভবনের পিছনে, একটি সংযুক্ত অংশ। মূল ভবনের সর্ব নিম্নতলা বা একতলা থেকে, পিছনের একটি অপেক্ষাকৃত ছোট দরজা দিয়ে, ঢুকে, বেশকয়েকটা সিঁড়ির ধাপ উঠলে, উপগৃহ বা অ্যানেক্সের প্রথমতলে পৌঁছানো যেত। মূল ভবন থেকে উপগৃহে যাওয়ার এই পথ বা দরজাটির গায়ে বুক-কেস বানিয়ে, সাধারণের চোখে দরজাটাকে আড়াল করে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। নীচের ছবিটি দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বোঝা যায়।
ছবিতে একটি হাতের চিহ্ন দিয়ে দরজা ও তার গায়ে তৈরী করা বুক-কেসটিকে দেখানো হয়েছে। 

এই দরজা দিয়ে ঢুকলেই উপগৃহে ওঠার সিঁড়ি পাওয়া যেত। সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপগৃহের প্রথমতলটিতে ওঠা যেত। নীচে আরও একটি ছবির সাহায্যে দেখানো হয়েছে, উপগৃহে ওঠার সিঁড়ি বা ধাপগুলি। 
গোপন দরজা তথা বুক-কেসের ফাঁক দিয়ে উপগৃহে ওঠার সিঁড়িগুলি দেখা যাচ্ছে।

দরজার গায়ে বুক-কেসটাকে এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল, যে, বাইরে থেকে দেখলে সহজে বোঝা যেত না, যে ওটা একটা দরজা, বা, ওর ভিতরে একটি সিঁড়ি আছে, যেখান দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যায়। ভবনটি তৈরী করতে বা তার পরিকল্পনা করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, ভিক্টর ক্যুগলার ও জোহানেস ক্লেম্যান। নীচের ছবিতে দরজাটাকে নির্দেশ করে দাঁড়িয়ে আছেন ভিক্টর ক্যুগলার।

উপগৃহের প্রথমতলে দুটো ঘর। ঘর দুটোকে শোওয়ার ঘর বা বসবার ঘর হিসাবে ব্যবহার করা যেত। ঘরের সাথে লাগোয়া একটি স্নান ঘর ও শৌচালয় তৈরী করা হয়েছিল। ওর উপরের তলায়, বা দ্বিতলে প্রায় সম আয়তনের একটি কক্ষ এবং তার পাশে নীচের স্নান ঘর ও শৌচালয়ের সম আয়তনে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট কক্ষ ছিল। এই অপেক্ষাকৃত ছোট কক্ষের লাগোয়া একটি কাঠের সিঁড়ি ছিল, যার সাহায্যে উপগৃহ বা অ্যানেক্সের চিলে-কোঠার ছাদে যাওয়া যেত। 


এইটি ছিল প্রথমতলের দুটি ঘর। ছবির বাম দিকের ঘরটিতে ( যে ঘরে ছবি টাঙ্গানো আছে ) অ্যানি থাকত। ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে ওটো ফ্রাঙ্কের পারিবারিক বন্ধু ফ্রিটজ ফেফ্রার ( Fritz Pfeffer ) পেশায় দাঁতেরডাক্তার, উপগৃহে এসে আশ্রয় নেন। অ্যানি তার ডাইরিতে এনাকে অ্যালবারট ডাসেলস ( Albert Dussel ) নামে উল্লেখ করেছে। তিনি আসার পর, তাঁর স্থান হয়, ঐ বাম দিকের ঘরে। অ্যানির মত এক নব্য কিশোরী বা প্রায় যুবতীর পক্ষে ফেফ্রারের ন্যায় বয়স্ক পন্ডিতমনার সাথে ঘর শেয়ার করা যে কতটা বিরক্তিকর ছিল, সে কথা অ্যানি বারবার তার ডাইরিতে উল্লেখ করেছে। 

অ্যানেক্স ভবনের নক্সা বেশ গোপনীয়তার সঙ্গে তৈরী করা হয়েছিল। কারণ ওপেক্টো হাউসে অফিস খোলা রেখে, কিছু ইহুদি পরিবারকে লুকিয়ে রাখা, যথেষ্ট কঠিন ও গোপন কাজ ছিল, অন্ততঃ সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন হিটলারের নাৎসি বাহিনী শুধু ইহুদিদেরই খুঁজে বেড়াচ্ছে। সাধারণভাবে বাড়ির কাঠামো বোঝার জন্য, নীচে বাড়ির বহির কাঠামোর ছকটি দেওয়া হল। উৎসাহী পাঠক ছকটি দেখে অনুমান করতে পারবেন, কি কষ্টের মধ্যে প্রায় তিনটি পরিবার দুবছরকাল ঐ স্থানে ছিলেন। 

ছবিটি পাশ থেকে তোলা। অ্যানেক্স ভবনের অবস্থান পিছনের দিকে। মূল ভবনের পিছনের দিকে অ্যানেক্সে প্রবেশের সিঁড়ি। উপরে অ্যানেক্সের একটি স্কেচ দেওয়া হয়েছে। এই দুটি ছবি দেখে পাঠকগণ অবশ্যই অ্যানেক্স ভবনের কাঠামোর দৃশ্যকল্প করে নিতে পারবেন। 

অ্যনেক্স ভবনের আর একটা ছবিও পাওয়া যায়। সেটা দেখলে পাঠকগণ সম্ভবত আরও পরিষ্কারভাবে ভবনের কাঠামোটি হয়তঃ বুঝতে পারবেন। ছবিটা হয়তঃ বাহুল্য বলে মনে হতে পারে, তবুও উৎসাহী ও আগ্রহী পাঠকের কথা ভেবে ছবিটা দেওয়ার ইচ্ছা নিবারণ করতে পারলাম না। 

১৯৪২ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৪৪ সালের অগস্ট মাস পর্যন্ত অ্যানি, তার পরিবার ও আরও দুটি পরিবার এখানেই থাকতেন। দিনের বেলায় অ্যানেক্সের সকলকে প্রায় নিঃশব্দে চলাফেরা করতে হত। কারণ বিল্ডিঙ্গের বাইরের অংশে তখন স্বাভাবিক অফিসের কাজকর্ম চলত। লোকের আনাগোনা লেগেই থাকত। উপগৃহ থেকে কোন সন্দেহজনক আওয়াজ ভেসে এলেই, পরিবারগুলির ধরা পরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ওটো ফ্রাঙ্কের সহকর্মীরা শুধু তাদের লুকিয়ে থাকতেই সাহায্য করেননি, অতি গোপনে পরিবারগুলিকে প্রাত্যাহিক খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান দিতেন। এককথায় তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া, পরিবারদুটি দুবছর কাল সময় বেঁচে থাকতে ও নিরাপদে থাকতে পারতেন না। সাধারনমহলে সকলে জানত, ওটো ফ্রাঙ্ক তার পরিবারকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে গেছেন। কারণ বাড়ি ছাড়ার আগে তিনি গৌডস্মিথকে একটি চিঠিতে সেরকমই জানিয়ে এসেছিলেন। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই পরিবারের সকলকে নিয়ে, ওটো ফ্রাঙ্ক পায়ে হেঁটে উপগৃহে বা অ্যানেক্স ভবনে এসে ওঠেন, এবং সাধারণ জনজীবন থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্যে হারিয়ে যান।

এই উপগৃহে জুলাই মাসের ৫ ( মতান্তরে ৬ই ) তারিখে ওটো ফ্রাঙ্ক তাঁর পরিবার নিয়ে প্রথম আসেন। তারপর ১৩ বা ১৪ই জুলাই ভ্যান ড্যান তাঁর স্ত্রী ও ছেলে পিটারকে নিয়ে এসে ওঠেন। এরপর নভেম্বর মাসে আসেন ডাসেলস, ( দাঁতের ডাক্তার) । অর্থাৎ ওই ছোট অ্যানেক্স ভবনে মোট আট থেকে নয় জন বাস করতেন। এর থেকেই অনুমান করা যায়, কিভাবে প্রায় নয় জন পুরুষ মহিলা একত্রে ঐ উপগৃহে প্রায় দুই বছর কাল সময় কাটিয়েছিলেন। 

(এই বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমায় বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন মিঃ ওয়াল্টার হর্ন ( Mr. Walter Horn ) পেশায় তিনি বর্তমানে জার্মানের একটি বিদ্যালয়ে ডাচ ভাষার শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্র হল মিঃ বিজন চট্টোপাধ্যায়, জন্মসূত্রে জার্মান নাগরিক। আমার ঘনিষ্ট আত্মীয় ---- লেখক। )


2 comments:

  1. Dr. Bijon Chatterji23 January 2017 at 02:46

    I love to read the story of Anne Frank, particularly in this Blog. You have created history by transferring the Diary of a Young Girl into Bangla. It is a gift. Thank you to the owners of this blog for being open minded and critical. Only such open minds and intelligence can fight against ignorance and intolerance.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thank you Bijon. I was expecting your assessment very eagerly. I think it would be better if the writing of Anne could be linked with the context of the time and background, then her diary will get a new meaning.
      What is your observatio.

      Delete