0

ছোটগল্প - সুধাংশু চক্রবর্তী

Posted in


ছোটগল্প


একথালা গরম ভাত
সুধাংশু চক্রবর্তী 


এই গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিটির নাম আহছান আলি। তাঁর একপাল গরু- ছাগলের দেখভাল করে বছর আঠারোর যুবক কুতুবউদ্দিন। এছাড়া আহছান আলির আরও কিছু ফাইফরমাশ খাটতে হয় তাকে। গ্রামেরই শেষপ্রান্তে জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে কুতুবউদ্দিনের মা আমিনা বিবি ছেলেকে নিয়ে থাকে। ছেলে মনিবের বাড়িতে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পায়, গোটা দিন সেখানে পড়ে থেকে ফাইফরমাশ খাটার সুবাদে। অতএব আমিনা বিবির রান্নাবান্নার বিশেষ বালাই থাকার কথা নয়। ইচ্ছে হলে দুটো খুদকুঁড়ো ফুটিয়ে নেয় উঠোনের এক কোণে মাটিফুঁড়ে জেগে থাকা একচিলতে কাঠের উনোনে। তেমন ইচ্ছে না হলে গাছের ফলপাকুর পেড়ে খেয়ে পেট ভরিয়ে নেয়। একে ঠিক ইচ্ছেও বলা যাবে না। বরং বলা ভালো একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফলপাকুর পেড়ে খেতে হয় তাকে। ছেলে মাসান্তে যে সামান্য টাকাটা হাতে তুলে দেয় তাতে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটার কথা নয়।

গ্রামেরই শেষ প্রান্তে বাগালি করে খেটে খাওয়া আজিজুল সেখের ভাঙ্গা কুঁড়েঘর। সেই কুঁড়েঘরে আজিজুল ছাড়া আরও একটা প্রাণী বাস করে। সেই প্রাণীটি হলো আজিজুল সেখের বছর চোদ্দর মা-হারা মেয়ে নাজনীন সুলতানা। সেই মেয়ের কপালে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত না জুটলেও বাপ আজিজুলকে ভুলেও কখনও দোষারোপ করে না। যেন ভুলেই গিয়েছে বেঁচে থাকতে হলে দু’বেলা নিয়মিত দুটো দানাপানি দিতে হয় পেটে।

নাজনীন সুলতানা নিজেদের কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে আকাশপানে হাঁ-করে তাকিয়ে দেখে সোনালী চিল কেমন সুন্দর ডানা মেলে চক্কর কাটছে সুনীল আকাশের বুকে। কখনও দেখে একটুকরো শাদা মেঘ আপন মনে কোথায় যেন ভেসে চলেছে হেলতে দুলতে। অথবা কোনও রঙ্গিন প্রজাপতি উড়ে উড়ে জংলীফুলের মধু খাচ্ছে মনের আনন্দে। সেসব বিভোর হয়ে দেখে খিদে ভুলে থাকার জন্য। ওকে দেখলে কেউ বলবে না সুন্দরী। তবে মেয়েটা ততটা কুৎসিতও নয়। দেখলে বোঝাই যায় পেটে সঠিক মাপের এবং নিয়মিত দুটো দানাপানি পড়লে নাজনীনের চেহারা অনেকটাই খোলতাই হতো।

কথাটা আর কেউ না বুঝুক কুতুবউদ্দিন ঠিক বুঝতে পারে। মনিব আহছান আলির গরু-ছাগলের পাল নিয়ে মাঠে চরাতে যাবার পথে নাজনীনকে দেখে কুতুবউদ্দিনের চোখ যেন সরতে চায় না। যাতায়াতের পথে নাজনীনকে রোজই দেখে মুগ্ধ চোখে। সেদিন ইয়ার বন্ধু ওসমানকে বলেও ফেলেছিলো নিজের মনের কথা – “জানিস ওসমান, নাজনীনের মতো সুন্দরী মেয়ে আর দুটি দেখিনি। আহা, ওর ঐ চাঁদপানা মুখখানা দেখলে মনটা যেন জুড়িয়ে যায়।” 
ওসমান শুনে খ্যাঁক্‌ খ্যাঁক্‌ করে হাসতে হাসতে বলেছিলো – “ওকে সুন্দরী বলছিস! তোর চোখে ছানি পরেছে রে কুতুবউদ্দিন।”

ওসমানের কথার কোনও জবাব দেয়নি। তবে মনে মনে বলেছিলো, দেখার চোখ থাকা চাই রে ওসমান। তুই যে সেই চোখটাই পাসনি। মেয়েটা যদি দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পেতো তাহলে তোদের মতো অনেকেই ওকে কুকুর শিয়ালের মতো ছিঁড়ে খেতে চাইতো। ভাগ্যিস তেমন দেখার চোখ পাসনি।

কুতুবউদ্দিন গরুছাগল চরাতে যাতায়াতের মাঝেই একদিন প্রেম নিবেদন করে বসলো নাজনীন সুলতানাকে। পেটে ভাত জোটে না অথচ প্রেম জুটে গেল দেখে নাজনীন আহ্লাদে আটখানা হলো। সেই থেকে পেটের খিদে ভুলে মনের খিদে নিয়েই মেতে থাকে। কুতুবউদ্দিন রোজই এসে কিছুটা সময় গল্প করে কাটায় নাজনীনের সাথে। নাজনীন যখন কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পরে কুতুবউদ্দিন দু’চোখ ভরে উপভোগ করে সেই হাসি। ওসমান সঙ্গে থাকলেও যোগ দেয় না ওদের হাসাহাসিতে। বরং ওদের হাসাহাসিতে ব্যাঘাত ঘটাতে চেয়ে খামোখা গরুগুলোর উদ্দেশ্যে চড়া গলায় হাঁক পাড়তে থাকে – “হেই যাহ্‌।” টাকরায় জিভ দিয়ে আঘাত করে শব্দ তোলে – “আহ্, টক্‌ টক্‌ টক্‌।” কুতুবউদ্দিন সব বুঝেও না বোঝার ভান করে।

কুতুবউদ্দিনের গোটা রমযান মাসটাই কেটে গেল মনিবের ফাইফরমাইস খাটতে খাটতে। নাজনীনের সাথে দেখা করার সুযোগই পেলো না এই একমাসে। গতকাল বিকেলে সামান্য ফুরসৎ পেয়ে ছুটেছিলো বাজারে। একবছর ধরে একটু একটু করে জমিয়েছে সামান্য কয়টা টাকা। ইচ্ছে ছিলো সেই টাকায় মা’কে একটা নতুন চপ্পল কিনে দেবে। কিন্তু নাজনীনের প্রেমে পড়ে যাওয়ায় সেই ইচ্ছেটা বদলে গেল ওর নিজেরই অজান্তে। মনস্থ করেছে জমানো টাকা কয়টা দিয়ে সেমাই কিনবে নাজনীনের জন্য। সেই আশায় বাজারে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলো কুতুবউদ্দিন। বাজারে আগুন লেগেছে যে জানা ছিলো না। অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে খালি হাতে। তারপর থেকে একটাই চিন্তা ওকে কুরেকুরে খেয়েছে গোটা রাত ধরে। নাজনীনকে কি উপহার দেওয়া যায় আগামীকাল? একবার ভেবেওছে মায়ের কাছে হাত পাতবে। মন সায় দেয়নি। মাস মাহিনা বাবদ সামান্য ক’টা টাকা পায় মনিবের কাছ থেকে। সেই টাকায় মায়ের মাস খোরাকিও ঠিক মতো হয়ে ওঠে না। এসব জেনেও মায়ের কাছে হাত পাতে কেমন করে? অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে আল্লাহ্’র কাছে।

গোটা রাত নির্ঘুম চোখে কাটিয়ে ভোরবেলায় যখন ঘরের বাইরে মায়ের মুখোমুখি হলো কুতুবউদ্দিনের চোখদুটো তখন জবাফুলের মত লাল টকটকে। আমিনাবিবি ছেলের কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে বললো – “তোর কি শরীর খারাপ হয়েছে বাপ?”
কুতুবউদ্দিন মৃদু হেসে জবাব দিলো – “তা কেন? শরীর তো ভালোই আছে।”

- “তাহলে তোর চোখদুটো অমন লাল হয়েছে কেন? কি হয়েছে? সত্যি কথা বল তো বাপ।” আমিনাবিবির দুশ্চিন্তা যায় না।

অগত্যা কুতুবউদ্দিনকে বলতেই হলো সব কথা খুলে। আমিনাবিবি সবটা শুনে ছেলের মাথায় হত বুলিয়ে দিয়ে সস্নেহে বললো – “অত চিন্তা কেন রে বাপ? তুই বরং টাকা কয়টা নাজনীনের হাতে গুঁজে দিয়ে বল ওর যা মন চায় কিনে নিতে।”

কুতুবউদ্দিনের সব দুশ্চিন্তা নিমেষেই উধাও। মায়ের কথাটা খুব মনে ধরেছে। কুতুবউদ্দিন খুশী মনে ঈদের নামাজ পড়েই ছুটে গেল নাজনীনের কাছে। এখন গিয়ে সঞ্চয়ের সবটাই নাজনীনের হাতে তুলে দেবে ফিৎরা হিসেবে।

আজিজুলের কুঁড়েঘরের সামনে এসে দেখলো মেয়েটা কুঁড়ের দাওয়ায় পড়ে আছে অগোছালো ভাবে। দেখেই ছুটে এলো। তারপর নাজনীনকে পাজকোলা করে তুলে নিয়ে গেল ঘরের ভেতর। আজিজুল শেখ বাড়িতে নেই। নিশ্চয়ই ফিৎরা আদায় করতে গিয়েছে মনিবদের কাছে। কুতুবউদ্দিনের অত সময় নেই আজিজুলের খোঁজখবর নেয়। খুঁজেপেতে এক গাড়ু জল এনে চোখেমুখে জলের ছিটে দিতেই নাজনীন চোখ মেললো। দৃষ্টি ঘোলাটে। কুতুবুদ্দিন বুঝলো ঘোরের মধ্যে রয়েছে। নাজনীন সেই অবস্থাতেই একমুখ ম্লান হাসি দিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে শুধোলো, “ঈদ মোবারক মনিরুল। এনেছো?”

কুতুবউদ্দিন কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। গ্রামের বখাটে ছোকরা মনিরুল এসেছিলো নাজনীনের কাছে! কেন? কৌতূহল দমন করতে না পেরে শুধোলো – “মনিরুল এসেছিলো তোমার কাছে? কি আনতে বলেছো মনিরুলকে?”

নাজনীন সুলতানা সেই ঘোরের মধ্যে থেকেই জবাব দিলো – “কেন? তুমি আর তোমার ঐ বন্ধুটা যে বললে কাজ হয়ে যাবার পর এনে দেবে? কাজ হয়ে যাবার পর নিয়ে আসছি বলে সেই যে গেলে এতক্ষণে আসার সময় হলো? ফিৎরা এনেছো?”

কুতুবউদ্দিন অবাক হলো – “ফিৎরা দিয়ে কি করবে নাজনীন?”

- “কতকাল ভাত খাইনি গো। খুব ইচ্ছে করছে একথালা গরম ভাত খাই। বেশী কিছু চাই না। সাথে একটু নুন আর একটা কাঁচালঙ্কা হলেই খুশী। সেগুলোই কিনবো। এনেছো আমার ফিৎরা?”



ব্যাপারটা হঠাৎই চোখে পড়লো কুতুবউদ্দিনের। নাজনীনকে যেখানে পড়ে থাকতে দেখেছিলো সেই জায়গাটায় ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। নাজনীনের পরনের কাপড়েও লেগেছে রক্তের দাগ!

0 comments: