Next
Previous
Showing posts with label বিশেষ প্রবন্ধ. Show all posts
0

বিশেষ প্রবন্ধ - শুভাপ্রসন্ন

Posted in



ছেলেবেলায় ইস্কুলে পড়েছিলাম “নালক” সেই থেকেই তাঁকে জেনেছি। আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই গুরুমশাইয়ের পাঠশালা, শান্ত দুপুরে সেই কুব পাখির ডাক শুনতে পাই।

আমার প্রথম পরিচয় সূত্র যা আজও অম্লান তা তাঁর ছবি লেখা থেকে। যদি ভারতের নবজাগরণের সূত্র ধরে বিভিন্ন মনীষার কথা ভাবা যায়— তাহলে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত। সেখানকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যবসা আর আধুনিকতার শুরু তাঁর হাত ধরেই। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় সকলেই নানা প্রতিভায় ভাস্বর হয়ে আছেন। সেই ধারার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি বিশ্বকবি হিসাবে স্বীকৃত। যদিও সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়— তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তি সৃষ্টিশীলতা বহুমুখী প্রতিভা বিস্ময়ের। যার ইতিহাস কারও অজানা নয়—। তাঁকে কেন্দ্র করে অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতিভা বিকশিত হয়েছিলো। অবনীন্দ্রনাথ তাঁরই অন্যতম ভাইপো। তাঁর ছোটোকাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছোটোভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র গুণেন্দ্রনাথের পুত্র ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দশ বছরের ছোটো। জোড়াসাঁকোর বিশাল জমিদার বাড়ির বৃহৎ পরিবারের মধ্যে-বিস্তীর্ণ নানান অন্দর মহলে ছেলেবয়সে নানাধরনের বিচিত্র পরিচারক-পরিচারিকার অধীনে কোলে-পিঠে গড়ে ওঠা। তাদের বিভিন্ন চরিত্র, বর্ণ ব্যবহারের কায়দায় ভালোবাসা-রাগ-অনুরাগ, অভিমান, বচসা এসবই তাঁর মনে বাস্তব আর কল্পনা মিশিয়ে ধরা দিত। কল্প আশ্রিত সৃষ্টিশীল মন চির শৈশবের খোরাক হয়ে গাঁথা হয়ে থাকতো। বড়ো হয়ে তাঁর লেখায়, কথপোকথনে, অনুলিখনের স্মৃতি চারণায় ধরা দিয়েছে তা। অন্য ভাই বা দাদারা যখন নানা কাজে ব্যাস্ত— অবন তখন পুরনো আসবাব বা বড়ো টেবিলের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে বিস্তীর্ণ মাকড়সার জাল থেকে মায়াময় ছবি, রহস্য খুঁজে পেতেন। এভাবেই তাঁর দেখায় ধরা দিতো খুঁটিনাটি কত কিছু। কৌতূহলী জিজ্ঞাসু মনে রসদের অভাব হয় না।

বড়ো হয়ে লেখা ছবির সবচেয়ে বড়ো উৎসাহ দাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিকার প্রশংসা তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করতো। ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় যেখানে সম্পাদক থেকে লেখক-লেখিকা অলঙ্করণ সবই তাঁদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে একাধারে অবনীন্দ্রনাথ লেখক আর অলঙ্কার শিল্পী হিসাবে যোগদান এক অন্যমাত্রা পেতো।

বাড়িতে চিত্রকলার চর্চা করেছিলেন বিদেশী শিল্পী গিলড ও পামারের কাছে। ফলে, তাঁদের শিক্ষায় পাশ্চাত্য রীতিতে অসাধারণ পোট্রেট আর দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁর মনে আমাদের লোকায়ত শিক্ষা, পটচিত্র, পাঁচালীর গান, কীর্ত্তন আর কিছু কিছু মানুষের প্রেরণায় স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নিজস্ব শৈলীর রূপ দিতে লাগলেন। সেখানে প্রাধান্য পেতো

দেশীয় উপাদান দেশীয় বিষয়। এভাবেই তিনি একের পর এক চিত্রমালা রচনা করতে লাগলেন। সিস্টার নিবেদিতা, আনন্দকুমার স্বামী প্রমুখের প্রেরণায় গড়ে উঠলো বেঙ্গল স্কুল। পরবর্তীকালে সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের উৎসাহে অন্তর্মুখি অবন ঠাকুরের ছবি দিল্লীর সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারে ভূষিত হয় শাহাজাহানের মৃত্যু ও অন্যান্য ছবি।

পার্শি মিনিয়েচার আর জাপানের নানান টেকনিক থেকে নানান টেক্সচারকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ওকাকুরার সাহায্যে জাপান থেকে দুই শিল্পী ইয়াকোয়ামা টাইক্কান আর হিসিদা সুনশো জোড়াসাঁকোয় ছিলেন বেশ কিছুদিন। তাঁদের কাছ থেকে নানান টেকনিক রপ্ত করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে যে ওয়াশ পদ্ধতি আর তুলি চালনার বিশেষ পদ্ধতি তা আয়ত্ত করেছিলেন এ শিল্পীদ্বয়ের কাছ থেকে।

বেঙ্গল স্কুলের আন্দোলন তিনি ও তাঁর সুযোগ্য কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের অবদানে গড়ে উঠেছিলো। বিশেষভাবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য নন্দলাল বসুর অবদানে জীবন ও সমাজে এক রূপ ও রুচির প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। তাই দ্বিধাহীনভাবে তিনি ছিলেন শিল্প গুরু আর সাহিত্যের কাণ্ডারী। তারই সঙ্গে তিনি ছিলেন জোড়াসাঁকোর মনীষীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্ক। বিস্ময় জাগে রবিরশ্মির এত কাছে থেকেও তাঁর লেখা বা তাঁর সাহিত্যের ভাষা ছিলো সম্পূর্ণ মুক্ত। সম্পূর্ণ অন্য ছবির ভাষা। এক অনবদ্য শিশুর সারল্য, স্বপ্ন-কল্পনা দিয়ে গাঁথা। বুড়ো আংলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, রাজ কাহিনী, মহাবীরের পুঁথি প্রভৃতি অসংখ্য প্রকাশিত, অপ্রকাশিত রচনায় ভরিয়ে ছিলেন তাঁর অন্তরের শিশু মনের জগৎ।

সে সময় রাজা রবিবর্মাও ভারতীয় শিল্পী হিসাবে সর্বত্র প্রচারিত হলেও, আর্য যদিও তাঁর ছবির বিষয় ছিলো নানান ভারতীয় পুরাণ কাহিনী বা সমসাময়িক জীবনচরিত। কিন্তু উপাদান ও শৈলী ছিলো ইউরোপীয়। যেন ভেনাসের গায়ে শাড়ি পরিয়ে শকুন্তলার রূপ। তা থেকে অবনীন্দ্রনাথ কত পৃথক যা সম্পূর্ণভাবে দেশীয় স্টাইল বা ছন্দ।

পরিণত বয়সে তাঁর আঁকা ‘ভারতমাতা’ একটি অনন্য উদাহরণ। একদিকে ভারতীয় শৈলীর নিপুনণতা-অন্যদিকে নির্ভুল শারিরীক ছন্দ। তাঁর অল্প বয়সে পাঠ নেওয়া ইউরোপীয় শৈলীর মিশ্রণে এক অসাধারণ উদাহরণ। যেখানে তথাকথিত পরিপ্রেক্ষিতে অনুপস্থিত। দ্বিমাত্রিকতার আভাস অথচ বাস্তবধর্মী রেখায় আঁকা নারীরূপ।

শেষ বয়সে অনুসন্ধানী শিল্পীমন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানান টুকরো কাঠ বা শুকিয়ে যাওয়া শিকড়-বাকড় সংগ্রহ করে, কখনও তাতে কিছু সংযোজন করে বিভিন্ন আকারের মূর্তি গড়ে তুলতেন। সেগুলোর নাম দিয়েছিলেন “কাটুম কুটুম” এখানেও তাঁর শিশু মন খেলা করতো। এক অনবদ্য শিল্প অনুসন্ধান। কিন্তু সেভাবে তিনি স্বীকৃতি পাননি!

কিন্তু অবন প্রতিভা সীমাবদ্ধ থাকে আমাদের পরিসরে।

তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে এই শিল্পগুরু মহান স্রষ্টা ছবি লেখার মনীষীকে স্মরণ করি।
0

বিশেষ প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ


একটি অনালোচিত দ্বিশতবার্ষিকী:-
বাংলা পুস্তক প্রকাশনার দুশো বছর
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্মবার্ষিকী, শতবার্ষিকী বা দ্বিশতবার্ষিকী পালনের রেওয়াজ বিশ্বের সর্বত্রই আছে। কোনও কোনও বস্তুর ক্ষেত্রেও এমন উদযাপন হয়। ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন উদযাপন হয় তাদের অবদানের কারণে। আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার মধ্যেই তাদের বেঁচে থাকা। বস্তুর স্মরণের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটা নয়। নয়, কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেই বস্তুটির নিয়ত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যার ফলে তার আদি চেহারাটাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক ধ্বনিবদ্ধ কন্ঠস্বর বা গান শোনার যন্ত্র কলের গান, যা আবিষ্কার করেছিলেন টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৭ সালে। এখনকি কলের গান বা গ্রামোফোনের জন্মদিন পালন করা যায়? যায় না, কারণ দেড়শো বছরেরও কম সময়ে ধ্বনিবদ্ধ কন্ঠস্বর শোনার বন্দোবস্তটাতেই আমূল বদল ঘটে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানী এডিসনকে বিস্মৃতির অতলে রাখা যাবে না, কারণ ধ্বনিবদ্ধ কন্ঠস্বর শোনার প্রযুক্তির মূল আবিষ্কার ছিল তাঁরই।

কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, আমি এখানে একটি বস্তুর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকীর কথা বলবো। বলার আগে এই ছোট্ট ভূমিকাটুকু করলাম। মুদ্রিত ছাপা বাংলা বই ও বাংলা পুস্তক প্রকাশনার দুশো বছর। হ্যাঁ, এই ২০১৬তে বাংলা অক্ষরে ছাপা বাংলা বই এবং তার বিপণনের দুশো বছর পূর্ণ হল। অথচ কলকাতার আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা বা বাংলার জেলাশহরের কয়েকশো বইমেলার আয়োজনে কোথাও এ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়েছে এমন জানা নেই।

যে কোনও বস্তুর বা প্রতিষ্ঠানের জন্মের একটা পৃষ্ঠভূমি থাকে। আর বইয়ের জন্ম ও বিবর্তনের ইতিহাস তো মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে। সেই বৃত্তান্ত এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আমি বলছি বাংলাভাষায় ছাপা বই। দুই মলাটের ভেতর ধাতব অক্ষরে ছাপা বই, যে বই আমরা কিনে পড়ি বা পড়ার জন্য উপহার পাই। তার বয়স কিন্তু মাত্র দুশো বছর। হঠাৎ করে একদিন বই ছাপা হয়ে যায়নি। কেউ বলেনি সেই মানুষটিকে, যে ছাপাখানায় ধাতব অক্ষর সাজিয়ে ছাপাখানার যন্ত্র চালাতো। সেই মানুষটি একদিন কলকাতার এক ছাপাখানা থেকে মধ্যযুগের এক স্বনামধন্য কবির একটি সচিত্র বই ছাপিয়ে ফেললেন আজ থেকে দুশো বছর আগে। তাঁর কথা বলার আগে এদেশে ছাপাখানার প্রবর্তন, ধাতব অক্ষর আবিষ্কার, অক্ষর সাজানো বা কম্পোজ করা – এই বিষয়গুলি ছুঁয়ে যাবো।

ছাপা বইয়ের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ছ’শো বছর আগে। ১৪৫০ সনে জার্মানীতে জোহানেস গুটেনবার্গ উদ্ভাবন করলেন মুদ্রণ যন্ত্র আর ১৪৫৫ নাগাদ গুটেনবার্গের যন্ত্রে ছাপা হল বাইবেল। সেই শুরু ছাপা বইয়ের জয়যাত্রা। অন্ধকারাচ্ছন্ন সুলতানী আমলের ভারতে তখন কারো দূর কল্পনাতেও ছাপাখানা বা ছাপা বই ছিল না, থাকার কথাও নয়। এদেশে ছাপাখানা এল আরো সোয়া তিনশো বছর পরে ওপনিবেশিক ইংরেজদের হাত ধরে।

১৮শতকের দ্বিতীয়ার্ধ দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরা তখন বাংলায় জাঁকিয়ে বসেছে। কলকাতায় ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানীর কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ধর্ম প্রচারের নানান ফন্দি-ফিকির খুঁজছেন। দুটি কাজেই ছাপাখানাই যে সবচেয়ে বড় সহায়, সেকথা বুঝেছিল তারা। মিশনারিরা প্রথম ছাপাখানা বসালো ১৭৭৮এ হুগলীতে। দু’বছর পরে শ্রীরামপুরে এল ছাপাখানা ‘ব্যাপটিস্ট মিশনারি প্রেস’। ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন হুগলী জেলার খানাকুলের পল্লীতে ছয় বছরের শিশু। মিশনারিদের এই ছাপাখানা থেকেই ১৭৮৪তে ছাপা হল ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’, যাতে প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছিল। ছাপাখানা এল।তারপর বাংলা অক্ষর সাজিয়ে বই ছাপা ও বিপণনের বন্দোবস্তে লেগে গেল আরো তিনটি দশক।

এদিকে হেসটিংস তাঁর রাজ্যপাট ঠিকমত চালাতে ইংরেজ কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য বাংলায় ছাপার কাজ শুরু করার জন্য হন্যে হয়েছেন। হুগলীতে কর্মরত কোম্পানীর এক কর্মচারী চার্স উইলকিন্স কিছুটা দেশীয় ভাষা শিখেছিলেন। হেস্টিংস তাঁকে বাংলা হরফ বানানোর দায়িত্ব দিলেন। উইলকিন্স ইংল্যান্ডের কারিগরদের দিয়ে বাংলা হরফ বানানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। অবশেষে সন্ধান পেলেন ত্রিবেণীর এক লৌহজীবী পঞ্চানন কর্মকারের। জনৈক হস্তলিপিবিদ খুশমৎ মুন্সীর সুচারু হস্তলিপি থেকে ধাতব অক্ষর কেটে দিলেন পঞ্চানন কর্মকার। বাংলা ভাষা ও মুদ্রনের ইতিহাসের সে এক সন্ধিক্ষণ। পঞ্চানন ধাতব অক্ষর বানিয়ে দিলেন, শ্রীরামপুরের মিশনারি প্রেস থেকে বাংলায় ছাপা হতে শুরু করল, পাদরি উইলিয়াম কেরির ওল্ড টেস্টামেন্ট ইত্যাদি ধর্ম প্রচারের বই ছাপা হল। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য বাংলা বই ও তার বিপনন শুরু হতে লেগে গেল আরো বেশ কয়েক বছর। ইতিমধ্যে কলকাতায় ছাপাখানা এলো। কলকাতা গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়াল।

কলকাতা তখন সবেমাত্র তার শৈশব দশা অতিক্রম করেছে। তখনও বেলাগাম দুর্নীতি আর কদর্য বাবু কালচারের কলকাতায় বাদা, জঙ্গলে ঘেরা মেঠো পথ। সবে একটা মাত্র চওড়া রাস্তা হয়েছে। পালকি ভিন্ন যানবাহন নেই।ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন সবেমাত্র কলকাতায় এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য, জন্মগ্রহণ করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।তখনও কারখানার চিমনির ধোঁয়া নেই, বিদ্যুতের আলো নেই, কিন্তু বাংলা বই এসেছিল। কলকাতায় বাংলা বই নিয়ে আসা, কলকাতাকে গ্রন্থনগরী করে তোলার ভগীরথ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮১৬ সনে কলকাতা থেকে ছাপা ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ই সাধারণের কাছে বিক্রয়ের জন্য প্রথম সচিত্র বাংলা বই – প্রকাশ করেছিলেন এই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।

অথচ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এই যুগান্তকারী ঘটনা যিনি ঘটালেন সেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পর্কে তেমন কিছু লেখাজোখা ইতিহাস রেখে যায়নি। জানা যায়না তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ বা কোনও পারিবারিক বৃত্তান্ত। শুধু ১৮৩০-এর ৩০শে জানুয়ারি সংখ্যার ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত সংবাদটি ছাড়া। ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায় - "এতদ্দেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাঙ্গালা পুস্তক মুদ্রিতকরণের প্রথমোদ্যোগ কেবল ১৬ বৎসরাবধি হইতেছে ইহা দেখিয়া আমাদের আশ্চর্য্য বোধ হয় যে এত অল্প কালের মধ্যে এতদ্দেশীয় লোকেরদের ছাপার কর্ম্মের এমন উন্নতি হইয়াছে। প্রথম যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল শ্রীরামপুর ছাপাখানার এক জন কর্ম্মকারক শ্রীযুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন।" আসলে গঙ্গাকিশোররা ইতিহাসের নির্মাণ করেন কিন্তু ইতিহাস তাঁদের মনে রাখে না।

নবজাগরণকালের সেই ঊষালগ্নে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই ইতিহাস নির্মাণ বিস্ময়কর বৈকি! বাংলার বুদ্ধির জাগরণের অগ্রপথিক রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুরদের সঙ্গে সমান শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হওয়ার যোগ্য গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের নাম। কোন প্রেরণায় শ্রীরামপুর মিশনারি প্রেসের এক কম্পোজিটর বাংলার সামাজিক ইতিহাসে পুস্তক প্রকাশনায় অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করলেন সে এক বিস্ময়।

১৭৭৮-এ মিশনারি এন্ড্রুজ সাহেব হুগলীতে প্রথম ছাপাখানা খোলেন। দুবছর পরে শ্রীরামপুরে মিশনারীরা ছাপাখানা বসালেন – ‘ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস’, সে কথা বলেছি।বহড়া গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণসন্তান গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য পেটের দায়ে সেই প্রেসে কম্পোজিটারের কাজ পেলেন। ১৮০১ থেকেই বাংলা ভাষার বই ছাপা শুরু হয়েছে। সেগুলি সবই পাদরি উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের পণ্ডিতদের দ্বারা লিখিত পাঠ্যপুস্তক। ছাপা বইয়ের বিস্ময় বুকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গঙ্গাকিশোর। কলকাতায় তখন কয়েকটি ছাপাখানা বসেছে। পুস্তক প্রকাশনার স্বপ্ন নিয়ে গঙ্গাকিশোর কলকাতা চলে এলেন, আর কলকাতার ‘ফেরিস কোম্পানী প্রেস’ থেকে নিজ উদ্যোগে ছাপলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যটি ১৮১৬ সনে। শুধু বই ছেপেই থেমে থাকলেন না, তার বিপণনের ব্যবস্থাও করলেন। তাঁর বইয়ের বিক্রয়ের জন্য কলকাতায় একটি বইয়ের দোকান খুললেন। গঙ্গাকিশোরই প্রথম কলকাতা শহরে বইয়ের দোকান খোলার পথ দেখান। বই বিক্রির সাফল্যে উৎসাহিত গঙ্গাকিশোর বাংলার নানা শহরে বিক্রয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। বাংলা বইয়ের আদিপর্বে এ ছিল এক অভাবিত ব্যাপার। এখানেই থামলেন না গঙ্গাকিশোর। দু’বছর পরে ১৭১৮-তে গঙ্গাকিশোর নিজেই একটা ছাপাখানা বসালেন – ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ নামে। কলকাতায় ছাপাখানা আসার সেই আদি পর্বে বাংলা বই ছাপাতে হত শ্রীরামপুরের ‘মিশনারি প্রেস’ অথবা কলকাতায় ‘ফেরিস কোম্পানী’র প্রেস থেকে। গঙ্গাকিশোরের আগে কোন বাঙালি ছাপাখানা স্থাপনে এগিয়ে আসেননি। সুতরাং এ ব্যাপারেও গঙ্গাকিশোরই পথপ্রদর্শক। নিজের প্রেস থেকে অতঃপর গঙ্গাকিশোর ‘বাঙাল গেজেটি’ নামে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাঙ্গাল গেজেটি এক বছর চলেছিল। বাঙ্গাল গেজেটির কোনও সংখ্যা পাওয়া যায় না। গঙ্গাকিশোরের এই ‘বাঙাল গেজেটি’ই বাঙালি প্রবর্তিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। অতএব গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই একাধারে বাংলা ভাষার প্রথম ছাপাখানার স্থাপক, মুদ্রাকর, পুস্তক প্রকাশক,গ্রন্থ ব্যবসায়ী ও বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশক।

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের‘অন্নদামঙ্গল’ সম্পর্কে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন, এ নিবন্ধে সেই সুযোগও নেই। ‘অন্নদামঙ্গল’ অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত, রবীন্দ্রনাথ যে গ্রন্থটিকে বলেছেন “রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।” প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য গ্রন্থটি প্রকাশ করেন, যেটি বাংলাভাষায় প্রথম প্রকাশিত সচিত্র গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলীর ভূমিকায় সজনীকান্ত দাস লিখেছেন -‘‘ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য মুদ্রণ করিয়াই বাংলা দেশে বাঙালীর পুস্তক-প্রকাশ ব্যবসায় আরম্ভ হয়; ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ইহার একটি চমৎকার সচিত্র সংস্করণ বাহির করিয়া ‘পাবলিশিং বিজনেস’ আরম্ভ করেন; ...গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া বাংলা দেশে অন্য কোনও বাংলা পুস্তক এত অধিক প্রচারিত এবং পঠিত হয় নাই।” ‘অন্নদামঙ্গল’ ছাড়াও গঙ্গাকিশোর প্রকাশ করেন ‘গঙ্গা ভক্তি তরঙ্গিনী’, ‘লক্ষ্মী চরিত্র’ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ও ‘চাণক্যশ্লোক’।

এরপর গঙ্গাকিশোর কি করেন, কতদিন জীবিত ছিলেন, কিছুই জানা যায় না। জানা যায়, ১৮১৯ সনে তাঁর সহযোগী হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে গঙ্গাকিশোর তাঁর ছাপাখানাটি নিজ গ্রামে নিয়ে যান এবং এর কয়েক বৎসর পরে মৃত্যু হয় বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ও বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার পথিকৃত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যর।

   


তথ্যসূত্র-(১) ‘কলিকাতা শহরের ইতিবৃ০ত্ত’/ বিনয় ঘোষ,(২) ‘সাহিত্য-সাধক ‘চরিতমালা’/ব্রজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ভারতকোষ’/বঙ্গীয় সাহিত্য পরিসৎ /৩য় খণ্ড)।
2

বিশেষ প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ 




বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব
কানন দেবী : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়




দশ বছরের এক বালিকা আর তার মা । পিতা বলে যাকে আশৈশব জেনে এসেছে, মা তার বিবাহিত স্ত্রী নন, রক্ষিতা । দশ বছর বয়সে, সেই জন্মদাতার মৃত্যুতে অতল অন্ধকারে পড়ে গেলো সেই মেয়ে । বুঝে গেল শূন্য থেকে শুরু করতে হবে । মাথার ওপর একটুকরো ছাদের সন্ধান পেতে মাকে নিয়ে আশ্রিতা হ’ল এক আত্মীয়ের, দুজনের শ্রমের বিনিময়ে । মা পাচিকা, মেয়ে বাসন মাজার কাজ । সেখানে লাঞ্ছনা, অপমান, দৈহিক পীড়ন অসহনীয় হয়ে ওঠায় বাধ্য হ’ল মাকে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াতে । সেদিনের সেই বালিকা তেইশ বছর পরে টালিগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সমভ্রান্ত গুনিজনদের মধ্যে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করলেন আর উদবোধক রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কাটজুকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন । পীড়িত, নিঃসম্বল সেই কিশোরীই তার তন্ময় সাধনা, সততা আর সমাজ-মনস্কতায় হয়ে উঠলেন অতি সম্মানিত মহিয়সী নারী । অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ যাকে বলেছিলেন ‘ফার্স্ট লেডি অফ ইন্ডিয়ান স্ক্রীণ’ । এ এক বিস্ময়কর ঘটনাক্রম । অবহেলার অন্ধকার থেকে দীপ্তিময়ী ব্যক্তিত্বে উত্তরণ । তিনি কানন দেবী, বাংলা চলচ্চিত্রের নির্বাক ও সবাক যুগের সন্ধি লগ্নের সাধারণ অভিনেত্রী থেকে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিভাবিকা হয়ে ওঠা কানন দেবী । বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ‘সুপার স্টার’ কানন দেবী পা রাখলেন শত বর্ষে ।

কানন দেবীকে নিয়ে লেখা কম হয়নি, তাঁর জীবনকালে ও মৃত্যুর পরেও । যার বেশির ভাগই তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের নানান রঙ চড়ানো কাহিনী । তিনি ছিলেন ‘হার্টথ্রব’ নায়িকা, অপরূপ সুন্দরী কাননকে স্পর্শ করতে কোন এক যুবক নাকি সিনেমাগৃহের পর্দার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, কিভাবে কাননকে চিত্র পরিচালকেরা শরীর প্রদর্শন করাতেন তার নানান গল্প কথা, ইত্যাদি । এমনকি লন্ডনে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন কিংবা নজরুল ইশলামকে জড়িয়েও তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে । সেইসব গল্পকথায় রুচিশীল কারো আগ্রহ থাকার কথা নয়, আমারও নেই । আমি বুঝতে চেয়েছি একদা সমাজের চোখে অবাঞ্ছিত এক বালিকা কি অসীম নিষ্ঠা আর প্রত্যয় সম্বল করে অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ সম্ভব করেছিলেন । কি করে সম্ভব হয়েছিল ? জীবনকে চেনা, জানার আগ্রহই এটা সম্ভব করেছিল । আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে কানন সে কথা জানিয়েছেন । লিখেছেন “ চিত্রজগতের বাইরের বিরাট জগৎকে জানার,‌ দেখবার, বিভিন্ন চরিত্রের, অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসবার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছে । ভালো-মন্দ, সম্পূর্ণতা, অসম্পূর্ণতা, দোষগুণে মেশানো মানুষের সংস্পর্শ আমার জীবনে অন্তত সেটুকু প্রসারতা এনে দিয়েছে যেটুকু প্রসারতা থাকলে জীবনকে যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখবার আগ্রহ জন্মায়” । জীবনের আশ্চর্য বোধই একদা নিঃসহায় বালিকার  বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প ও সংস্কৃতিতে এক সম্ভ্রমযোগ্য ব্যক্তিত্বে উত্তরণ ঘটিয়েছিল । 

কাননবালা থেকে কাননদেবী । তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নিতান্তই শৈশব । কাননের জন্মের তিন বছর আগে সবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃত দাদা সাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’এর মুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯১৩তে । কলকাতায় পার্শি ব্যবসায়ী জে.এফ.ম্যাডান গঠন করেছেন চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক প্রদর্শনের পথিকৃত প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান থিয়েটার’ । এক সহৃদয় ব্যক্তির হাত ধরে দশ বছরের কিশোরী কানন পা রাখলেন ম্যাডান থিয়েটারের স্টুডিওতে, সংস্পর্শে এলেন পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যা-এর। সেটা ১৯২৬ সালের কথা, তখনো চলচ্চিত্র শব্দহীন। দশ বছরের কিশোরী কানন-এর প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’ এ ‘রাধা’ চরিত্রে । পারিশ্রমিক পেলেন পাঁচ টাকা । চলচ্চিত্রজীবনে কাননের প্রথম উপার্জন । এর পর ‘শঙ্করাচার্য’তে অভিনয় করলেন কানন, সেটিও নির্বাক ছবি । ১৯৩১এ বাংলা ছায়াছবি কথা বলতে শুরু করলো, ১৯৩১এ ১১ই এপ্রিল সবাক কাহিনিচিত্র অমর চৌধুরী পরিচালিত ‘জামাই ষষ্টি’ মুক্তি পেল । ঐ বছরেই কানন-এর প্রথম সবাক চিত্রে অভিনয় ম্যাডান থিয়েটারের ‘জোর বরাত’ ছবির নায়িকা চরিত্রে । মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩১এর ২৭শে জুন । ১৯৩৩এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রী গৌরাঙ্গ’ চলচ্চিত্রে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ চরিত্রে অভিনয় ও গানে কানন শিল্পীর সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পেলেন । ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ মুক্তি পাওয়ার পর কাননের গানের খ্যাতিও বিস্তৃত হল, ডাক পেলেন গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে । কাননদেবী তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন “ এই সময় স্টুডিও থেকে ক্রমশ গ্রামোফোন কোম্পানী অবধি কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হোল ...গান এসে আমার অভিনয়ের পাশে দাঁড়াতেই মনে হোল আমার জীবনের এক পরম পাওয়ার সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল । ...নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম”( ‘সবারে আমি নমি’) ।

তারপর কত ছবি, কত গান – কানন হয়ে উঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার – ‘মহা নায়িকা’ । চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাইরে গ্রামোফোন রেকর্ডে কানন দেবীর কন্ঠের কিছু গান তো ‘লিজেন্ড’ হয়ে আছে স্রোতাদের কাছে । ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে...’, ‘সাপুড়ে’ ছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’, ‘সাথী’ ছবিতে সায়গলের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়’ এখনও তন্ময় সঙ্গীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে । কাননের আর একটি গান ‘লিজেন্ডে’র মর্যাদা পেয়েছে । ১৯৪৭এর অগস্ট মাসে লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া হাউস’এ তাঁর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে । ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন তখন লন্ডনে ভারতের হাই কমিশনার । সেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কানন গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার’

১৯৩৬এ রবীন্দ্র-কাহিনী নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগ করলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে কানন দেবী গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং ‘আজ বিদায় বেলার মালাখানি’ । এই সুবাদে কানন হয়ে গেলেন শান্তিনিকেতন ঘরাণার বাইরে রবীন্দ্র-গানের প্রথম মহিলা-কন্ঠ । তারপর অজস্র ছায়াছবি ও গ্রামফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন কানন । সেকালে রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পঙ্কজকুমার মল্লিকের মত কানন দেবীরও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে । 

সংগীতপ্রধান ছবি ‘বিদ্যাপতি’(১৯৩৮)তে অভিনয় ও গায়িকা রূপে কানন খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন । চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কানন না সঙ্গীত শিল্পী কানন – কে বড় সে প্রশ্নের মীমাংশা হবার নয় । কাননের নিজের কথায় “আজ আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড় । কিন্তু আমার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশী দামী আমার গানের মহল ...” (‘সবারে আমি নমি’) । পন্ডিত আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন । গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে ।

তেইশের তরুণী কানন চেয়েছিলেন জীবনকে শুদ্ধ, সুন্দর করে গড়ে তুলতে । তখনকার সমাজ নিদারুণ আঘাত করেছিল কাননের প্রথম প্রেমকে । সেই পরম পাওয়ার আনন্দসুধা অঞ্জলি ভরে পান করতে পারেন নি তিনি । ১৯৩৯এ তেইশ বছরের তরুণী কানন বিবাহ করেন প্রখ্যাত ব্রাহ্মসমাজী শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রকে । কানন লিখেছেন “ সমাজ আমাদের মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে । কিন্তু সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ করেনি । ... আমাদের দুঃসাহসের সাক্ষী হয়েছে, কিন্তু উৎসবের আলো জ্বালিয়ে একে অভিনন্দিত করেনি ...। আজও মনে পড়ে, বারান্দায় দাঁড়াতে সাহস করতাম না, পাছে কারো কোন বিরূপ মন্তব্য কানে আসে । নানান কুরুচিপূর্ণ কদর্য ভাষার প্যামফ্লেট ছাপিয়ে উঁচু স্বরে হেঁকে বিক্রী হ’ত আমারই বাড়ির সামনে ...। নিঃসম্বল অসহায় একটা মেয়ে । কত ঝড় তুফান পেরিয়ে ছুটছে আর ছুটছে । কিন্তু তার সেই বিরামহীন চলা, গ্রন্থিহীন তপস্যার এতটুকু মূল্য কেউ কোনদিন দেয়নি । চেয়েছে তাকে ব্যর্থতার সমাধিতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে” (‘সবারে আমি নমি’) । সে বিবাহ স্থায়ী হয়নি । সেকালীন রক্ষণশীল সমাজ প্রবল নিন্দাবাদ করেছিল বংশগৌরবহীন একজন চিত্রাভিনেত্রীর সঙ্গে এক সমভ্রান্ত পরিবারের বিবাহে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁদের বিবাহে আশির্বাণী ও প্রীতি উপহার স্বরূপ একটি ছবি পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন । এক চিত্রভিনেত্রী রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরকরা ছবি পাবে কেন ! 

কাননের কাছে সর্ত ছিল বিবাহের পর চিত্রাভিনয় ত্যাগ করতে হবে । ব্যক্তিত্বময়ী কানন সম্মত হননি । ১৯৪৫এ কানন তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ নেন । বিবাহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সত্বেও প্রথম স্বামীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন, অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা তাঁকে প্রথম সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য । পরবর্তী কালে, অশোকের দিদি রানী মহলানবিশ, তাঁর স্বামী প্রখ্যাত প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কিংবা অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে কাননের অন্তরঙ্গতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলনা ।

ইতিমধ্যে দশটা বছর কেটে গেছে । ১৯৪৯এ ততকালীন রাজ্যপালের সঙ্গে আলাপের সূত্রে পরিচয় হয় রাজ্যপালের নেভাল এ.ডি.সি হরিদাস ভট্টাচার্যর সঙ্গে । পরিচয় থেকে প্রণয় এবং বিবাহ ঐ বছরেই । ১৯৪৯এই চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামেন কানন, গঠন করেন শ্রীমতী পিকচার্স । প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ । তারপর একের পর এক শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’, দর্পচূর্ণ’, নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘অন্নদা দিদি, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি, প্রযোজনা কানন দেবীর শ্রীমতী পিকচার্স আর পরিচালনায় স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য । অন্নদা দিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর কানন আর কোন ছায়াছবিতে অভিনয় করেননি । 

অভিনয় করেননি, কিন্তু সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আমৃত্যু । ১৯২৬ থেকে ১৯৯২ সুদীর্ঘ ছেষট্টি বছর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিজড়িত ছিল একটা নাম কানন দেবী । বলতে গেলে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণের একশো বছরের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা আছে তাঁর নাম । শুধু অভিনয় ও সঙ্গীত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এমন নয় প্রযোজনা, পরিচালনা, বিচারক মন্ডলী, ডিরেক্টর বোর্ড – সিনেমা শিল্পের প্রতিটি বিভাগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন সুদীর্ঘ সময় । দুঃস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে গঠন করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। যুক্ত ছিলেন সামাজিক নানান কল্যানকর সংগঠনের সঙ্গে ।

তার সময়ে পুরস্কারের ঘনঘটা ছিলনা এখনকার মত । ১৯৬৪তে ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধীতে সম্মানিত করেন। তারপর ১৯৭৬ পান চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার । ২০১১র ফেব্রুয়ারীতে ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে । আলোহীন জগৎ থেকে উঠে আসা এক নারী আপন প্রতিভা ও তন্ময় সাধনায়, অনেক অবহেলা, লাঞ্ছনা, চিত্র জগতের ক্লেদ, আর গ্লানি অতিক্রম করে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন । সে এক বিস্ময়কর আলোয় ফেরার কাহিনী । ১৯৯২এ কলকাতায় মৃত্যু হয় কানন দেবীর ছিয়াত্তর বছর বয়সে ।

আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে কানন দেবী লিখেছেন ‘মরণ পন করে যে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছি তাকে নিয়ে আর যাই হোক ছেলেখেলা করা যায় না । ... জীবনের কাছে আমি চেয়েছি মধুর শান্তিনিলয় । স্বপ্নভরা আরামকুঞ্জ, উদার আকাশ” । সংশয় নেই, জীবন বোধে উজ্বল ছিল তাঁর দীর্ঘ শিল্পী ও সামাজিক জীবন । কানন দেবীর শতবর্ষে আমাদের বিনম্র প্রণাম ।









0

বিশেষ প্রবন্ধঃ কেয়া মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ


নির্ভয় আকাশ আর আলোর খোঁজে
কেয়া মুখোপাধ্যায়



আরো একটা আন্তর্জাতিক নারীদিবস চলে গেল।

নারীর অধিকারের দাবিতে শুরু হওয়া এই সংগ্রামের বয়স দাঁড়ালো একশো পাঁচ। ১৯১১ তে জার্মান সোশালিস্ট দলের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে এর সূচনা। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে দাবি উঠল ৮ই মার্চ-কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেবার। উন্নয়ন, শান্তি ও সমতার ভিত্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নিয়ে এই দিনটিকে স্বীকৃতি দিল রাষ্ট্রসঙ্ঘ। বিশ্ব নারী আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ১৯৭৫-৮৫ এর দশকটিকে আন্তর্জাতিক নারী দশক ঘোষণা করল। প্রথম স্বীকৃতির পর থেকে আজ পর্যন্ত নানা ‘থিম’ নিয়ে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন করা হয়ে চলেছে। কখনো ক্ষুধা, দারিদ্র আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি বা লিঙ্গসমতার দাবিতে আবার কখনো বা হিংসার বিরুদ্ধে লিঙ্গসমতার দাবিতে গোটা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আহ্বান।

১৯৯৫ সালে বেজিং-এ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রকাশ করল নারী অধিকার সংক্রান্ত একটি ঘোষণাপত্র। নারীদের বিশ্বব্যাপী অধিকারহীনতার কথাই আবারো স্পষ্ট হল সেই ঘোষণাপত্রে। তার প্রতিকার হিসেবে নানা কর্মসূচীও ঘোষিত হল। কিন্তু যখন ভাবতে বসি, গত একশো পাঁচ বছর-ব্যাপী এই সুদীর্ঘ মানবিক আন্দোলনের ফল কী হয়েছে বা কতটুকু করা গেছে, তখন সত্যি চমকে উঠতে হয়। অধিকারের দাবিতে এমন চূড়ান্ত ফলাফল-হীন দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই! একুশ শতকের প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও, আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক- সবদিকেই বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় মেয়েরা আজও তীব্র বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার। নারীর ক্ষমতায়নের কথা ঘোষিত হলেও তার বাস্তব রূপায়নে তেমন উদ্যোগী নয় অধিকাংশ দেশ। এবছর বেজিং-এর সেই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কুড়ি বছর পূর্তি। এই কুড়ি বছরে কিছু কাজ হলেও, এখনো অনেক পথ চলার বাকি। সেই পথও সুগম নয়, অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। সেই ফাঁকগুলোকে ভরাতে চেয়েই এবার রাষ্ট্রসঙ্ঘের থিম:

“Empowering Women, Empowering Humanity: Picture it!” 

বলা হচ্ছে:

"Planet 50-50 by 2030. Step it up for Gender Equality"

অনেকে প্রশ্ন তোলেন, তথাকথিত আধুনিক আর প্রগতিশীল হয়েও বছরের মাত্র একটি দিনকে নারীদিবস হিসেবে চিহ্নিত করায় কিসের গৌরব! এই সংরক্ষণে তো একজন নারীর মধ্যে তীব্রভাবে বেঁচে থাকা ‘মানুষ’ সত্ত্বাটির চূড়ান্ত অবমাননা! নারীদিবস কি আজও প্রাসঙ্গিক? উত্তরে বলতে হয়, অবশ্যই! বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজের বৃহত্তর অংশ আজও নির্যাতন, বঞ্চনা আর শোষণে বিপর্যস্ত। অধিকাংশ সমাজ ব্যবস্থা পুরুষ প্রধান। সামাজিক বিধিনি‍‌ষেধই হোক কিংবা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ- সবই পুরুষদের হাতে। তাই পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হয় বেশিরভাগ নারীকে। এর ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, তবে তা সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে এতই অপ্রতুল যে তাকে গণ্য করা যায় না। অনেক সময়, মেয়ে-সন্তানের জন্ম দেওয়াটাই অপরাধ! যদি বা কষ্টেসৃষ্টে ভ্রূণ অবস্থায় আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার থেকে বেঁচে যায়, তবু সে নেহাতই ‘মেয়ে’ একজন, মানুষ নয় মোটেই। কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, ‘মেয়েদের মাথার বাইরের দিকটা নিয়েই সকলের আগ্রহ, মাথার ভিতরটা নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথা নেই।’ ছোট্ট থেকে একটি মেয়েকে শেখানো হয় সাবধান হতে, বাইরে জুজু কি হুলো বসে আছে। অসাবধান হলেই ধরে নিয়ে যাবে। বলা হয়, ঘরেই সে নিরাপদ, বাইরে ভয়৷‌ সিমোন দি বুভ্যারের কথায়,

‘মেয়েরা নারী হয়ে জন্মায় না, তাদের নারী হিসাবে গড়ে তোলা হয়।’

নিরাপত্তার আশ্বাস তাকে কেউ দেয় না- না পরিবার, না সমাজ, না রাষ্ট্র!

রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছেন আর পনেরো বছরের মধ্যেই এ বিশ্বে সমতা আনার লক্ষ্যে, লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারী-পুরুষ ৫০-৫০ করতে পদক্ষেপ নিতে।

কিন্তু কী করে দূর হবে এই লিঙ্গবৈষম্য? আন্তর্জাতিক নারীদিবসের ঠিক চারদিন আগে এক ঘন্টার তথ্যচিত্রে সমাজের ভয়ঙ্কর এক বাস্তব উঠে এল যে! লেসলি উডউইন-এর তথ্যচিত্র “ইন্ডিয়া’জ ডটার” দেখিয়ে দিল আমাদের দেশে শুধু পুরুষই নারীকে ধর্ষণ করে না, সমাজও করে, উঠতে-বসতে। দেখিয়ে দিল, পুরুষদের সাত খুন মাফ। কিন্তু সন্ধ্যে নামার আগেই হাঁস-মুরগির খোয়াঁড়ে ফেরার মতই মেয়েদের ঢুকে পড়তে হবে অন্দরে। নাহলে ওই হাঁস-মুরগির মতই ‘অন্ধকারে’ হারিয়ে যাওয়াতে অস্বাভাবিক কিচ্ছু নেই।

ঘন্টাখানেকের ওই তথ্যচিত্রটা দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখের সামনে ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২-র ভয়ানক নৃশংসতার মুহূর্তগুলোর সাজেস্টিভ অভিনয় দেখা বা ‘নির্ভয়া’ জ্যোতি সিং-এর অসহায় বাবা-মা-র অনুভূতি শোনা বড় যন্ত্রণার। সেইসঙ্গে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা তৈরি হচ্ছিল মনে, যখন শুনছিলাম মেয়েদের উচিত-অনুচিত থেকে শুরু করে তার গোটা অস্তিত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিচ্ছিলেন তথাকথিত কিছু ‘শিক্ষিত’ পুরুষ। সমাজের সামনে ধরা তথ্যচিত্রের এই আয়না দেখিয়ে দিল আমাদের চারপাশে মানুষের চেহারায় ঘুরে বেড়ায় কত বিকৃত মানসিক রোগী।

অনুতাপহীন, নির্বিকার মুখে ধর্ষক মুকেশ সিং বলেছে,

‘ধর্ষণে মেয়েদের দোষই বেশি’, ‘ভদ্রঘরের মেয়ে রাত নয়টার পরে বাড়ির বাইরে থাকে না' ‘ধর্ষণের সময় বাধা দিয়ে মেয়েটা ভুল করেছে', ‘ওর চুপচাপ থাকলে আমরা ‘কাজ সেরে’ওকে ফেলে রেখে চলে যেতাম’, ‘মেয়েটাকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল বলে শরীরের ভেতর থেকে ছিঁড়ে বের করে আনা অন্ত্রের টুকরো কাপড়ে মুড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল আমার ভাই’, ‘আমাদের যদি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তা হলে এর পর কেউ ধর্ষণ করলে মেয়েটাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে!’

আর আইনজীবীরা কী বললেন? আইনজীবী এ পি সিং বললেন,

“আমার মেয়ে বা বোন যদি বিয়ের আগে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তা হলে তাকে আমার বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সব আত্মীয়স্বজনের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেব,” “সন্ধ্যে সাতটার পর মেয়েদের রাস্তায় বেরোনো উচিত নয়। খুব দরকারে বেরোলেও বাবা, কাকা কি জ্যাঠার মত আত্মীয়েরসঙ্গে। তা নাহলে ছেলেরা ভুল করলে কিছু বলা উচিত নয়!”

আইনজীবী এম এল শর্মা জানালেন,

“lady should not be put on road like food! ‘খাদ্য’ হিসেবে নারীদের রাস্তায় ছেড়ে দিলে তো পুরুষদের উত্তেজনা হবেই।”

ড্রাইভার মুকেশ কি ‘শিক্ষিত’ আইনজীবী সিং আর শর্মা তো একা নয়। অনেক পুরুষের, অনেক তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পুরুষের মনে চেপে রাখা আসল কথাটা এরা বলে দিয়েছে। এটা দেখে ক’জন পুরুষ উপলব্ধি করবেন যে তাঁদের চিন্তাধারা ভুল, তা জানি না। তবে আশঙ্কা হয়- অনেকেই হয়তো এইসব বক্তব্যগুলোর সঙ্গে সহমত হবেন! 

আর শুধু এঁরা কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অবলীলায় বলেছিলেন, ‘‘জনসংখ্যা বেড়েছে, ধর্ষণ তো বাড়বেই''৷ আমরা কি তা ভুলে গেছি? ভারতের পুলিশ মেয়েদের রাতে ঘর থেকে না বেরোনোর উপদেশ আর ‘শোভন' পোশাক পরার পরামর্শ দিয়েছেন- তা-ও কি মনে নেই আমাদের? মনে নেই কি পুরুষ-মনে পরিবর্তন আনতে চেয়ে নরেন্দ্র মোদীকে স্বাধীনতা দিবসে বলতে হয়েছিল,

‘‘মেয়েদের বাইরে যেতে বাধা দেওয়ার বদলে বাবা-মায়েদের উচিত নিজেদের ছেলেদের উপর নজর রাখা৷”

স্বাধীন একটি দেশে মেয়েদের অবস্থা বুঝতে তারপরও কি আর কিছু বাকি থাকে?

২০১২-র ১৬ই ডিসেম্বরে দিল্লি গণধর্ষণের পরে দিল্লি আর দেশের অন্যান্য শহর দেখেছিল এক অভূতপূর্ব জনজাগরণ। দেশ জুড়ে সেই আন্দোলনকে জিইয়ে রেখে নারীসুরক্ষার দাবির পাশাপাশি ধর্ষক ও নারী-অত্যাচারীর কড়া শাস্তির দাবি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রকে যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০১৪-র ২০শে সেপ্টেম্বর আমরা দেখেছি আমাদের ছাত্রদের জাগরণ। যাদবপুরে নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়াল শুধু কলকাতা শহর নয়, সারা দেশের ছাত্ররা। আবার এটাও বাস্তব যে নির্ভয়ার নৃশংস ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের প্রবল চাপেও কামদুনির অপরাজিতা বা মধ্যমগ্রামের কিশোরীর বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু রক্ষা পায়নি৷‌ ধর্ষণের শিকার হয়ে ‘অপরাধ’ করেছিল মধ্যমগ্রামের কিশোরীটি৷‌ বাড়িওয়ালা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে, ওই ‘অপরাধ’-এর পরে আর তাকে পাড়ায় থাকতে দেওয়া যায় না৷‌ তাই আগুনে পুড়তে পুড়তে সে বলেছিল,

‘মা আর বাঁচতে চাই না৷‌ তুমিও পুড়ে মরে যাও৷‌ তুমিও তো মেয়ে!’

এ কোথায়, কোন সমাজে আছি আমরা?

প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটাও জানা। এ সেই সমাজ, যেখানে কোন নারী ধর্ষণের অভিযোগ জানালে তার কথার যাবতীয় সত্যতা প্রমাণের দায় একমাত্র সেই নারীর ওপরেই বর্তায় (যদিও সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এর বিপরীত বিন্দুতে)। সেই সমাজ, যেখানে খুব সহজে কেবল নারীটিকেই ‘খারাপ’ কিংবা ‘নষ্ট’ বিশেষণে দেগে দেওয়া যায়! এ সেই সমাজ, যেখানে ধর্ষকের চরমতম অপরাধও বড় সহজে পাল্টে গিয়ে হয়ে দাঁড়ায় ধর্ষিতার লজ্জা! সেই সমাজ, যেখানে শুধু পুরুষরাই নন, অনেক নারীও 

ধর্ষিতার পেশা, জীবনযাত্রার ধরণ, পোশাক-আশাক-এর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ইত্যাদি করে থাকেন সোৎসাহে আর শেষ অবধি ধর্ষিতা নারীটিকেই অনায়াসে দোষী সাব্যস্ত করেন। যশোধরা রায়চৌধুরি-র একটি কবিতা সেই সমাজের আয়না হয়ে উঠেছে:

“‘যাই বল, ওটা তুমি একটুও কি এনজয় করোনি?'
এরকমই ভাবে ওরা, পুরুষেরা। অথবা নারীরা?
‘যাক বাবা বেঁচে গেছি, তাছাড়া যে সেজেগুজে তুমি
বিদঘুটে পোষাক পরে চরতে গেছ আদাড়ে বাদাড়ে
কামকুক্কুরী হবে, নইলে কেউ পড়ে ঐসব
লোকের পাল্লায়? ছি ছি! পারছি না কী বেহায়া ভাবতেই!’
-------
হে ধর্ষিতা, তুমি জান, শরীর কোথায় শেষ হয়
কোথা থেকে শুরু হয় অদ্ভুত, দ্বিতীয় অপমান...”

এই সমাজকে পাল্টাতে হবে। শুধু প্রতিবাদী মিছিল আর মোমবাতির শোক-জ্ঞাপন নয়, আরো বড় আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বোধ আর চেতনা-সম্পন্ন প্রতিটি সাধারণ মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নারী-হিংসার বিরুদ্ধে, সমাজের সর্বস্তরে মেয়েদের সার্বিক অসম্মানের বিরুদ্ধে একটা অরাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা বড় দরকার এখন। আমরা যে দেবী-র পুজো করি অনেক বাহুল্যে আর আড়ম্বরে, তিনি নারী, পুরাণমতে আদি শক্তি। অথচ সেই দেবীর প্রতিমূর্তি নারীদের শ্রদ্ধা করতে পারি না। তাই লড়াইটা নিজের সঙ্গেও বটে। সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। সেইসঙ্গে ঘরে নারীর অবহেলা আর বাইরে নারীর লাঞ্ছনার নিদারুণ অবস্থাটা পাল্টাতে গেলে নারীদেরও নিজেদের অন্তরের শক্তি উপলব্ধি করতে হবে। নিজেদের অধিকার আর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে হবে, শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হতে হবে। এটা ১৪২১। আজ থেকে অনেক বছর আগে, ১৩৩৩-র প্রবাসী পত্রিকার এক সংখ্যায় লেখা হয়েছিল-

‘আত্মরক্ষার সামর্থ্য থাকা নারীদের রক্ষণের সর্বোৎকৃষ্ট ও একান্ত আবশ্যক উপায়।’

পুতুলের মতো জীবনযাপন করলে বিদ্যা-বুদ্ধির ঘাটতি এবং শারীরিক অক্ষমতা আমাদের গ্রাস করবে৷‌ ‘নারী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন-

“মেয়েদের জীবনে আজ সকল দিক থেকেই স্বতই তার তটের সীমা দূরে চলে যাচ্ছে। নদী উঠছে মহানদী হয়ে।...কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই-যে স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এই-যে মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে, এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মানের জন্যে তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা, বিদ্যার চর্চা, একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল।”

আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আর জরুরি কথাগুলো!

আমাদের সকলের মনে রাখা দরকার ভারতে আর সেইসঙ্গে গোটা বিশ্বজুড়ে একটা যুদ্ধ চলছে। নারীহিংসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দেশ আর সমাজ নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে এ যুদ্ধের বিরাম নেই। এই যুদ্ধটা জিততেই হবে। কথায় কথায় আমরা নিজেদেরকে বড় বড় তকমা দিই- আমরা প্রগতিশীল, আমরা সংবেদনশীল। সেটা অন্তত একবার সত্যি করার চেষ্টা করি! চলুন না, আন্তর্জাতিক নারীদিবসে নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার শপথ করি সবাই মিলে! ঘরের মেয়েটিকে খুঁজে দিই নির্ভয় আকাশ আর নিশ্চিন্ত আলোটুকু!
2

বিশেষ প্রবন্ধঃ স্বপন দেব

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ


ভাষা ও মাতৃভাষা 
স্বপন দেব 



১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ৪৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। প্রথমেই ভাষা শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। কথোপকথনে আমরা যে ভাষাই ব্যবহার করিনা কেন, তা কিন্তু কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টির ভাষা। ভাষা হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠেনা। কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা গড়ে ওঠে ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে এবং তা কখনই স্থায়ী একটা রূপ নিয়ে থেমে থাকেনা। ভাষা একটা চলমান এবং বহমান প্রক্রিয়া, যা ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়েই এগোতে থাকে। আর ঠিক এই কারণেই রবি ঠাকুরের মত কবি যে ভাষায় কথা বলতেন, এখন আর আমরা সেই ভাষায় কথা বলিনা; আবার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ঠিক আমাদের এখনকার ভাষায় কথা বলবেনা। 

ভাষার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা মনে আসে, তা হচ্ছে, মানুষের মুখে ভাষা ফুটলো কি করে ! ভাষা বলতে যদি গলা দিয়ে নির্দিষ্ট আওয়াজ তথা ধ্বনি ( সাউণ্ড) সৃষ্টি করে কিছু শব্দ ( ওয়ার্ড ) বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে নিজের ধারণাকে অন্যের ধারণার সাথে যুক্ত করা বোঝায়, অর্থাৎ কথা বলা বোঝায়, তাহলে সেটা এমন কিছু শব্দ হতে হবে যার অর্থ কথক এবং শ্রোতার কাছে অভিন্ন। ব্যবহৃত শব্দগুলিকে খাপছাড়া ভাবে ব্যবহার করলেও চলবেনা। ভাষার ক্ষেত্রে এই পর্বে পৌঁছতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসতে হয়েছে। শুধু ভাষা কেন, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক পর্বগুলোও, কোনদিন বা কোন সময়ে স্থাণু নয়, হতে পারেনা। প্রকৃতির গতিশীলতা থেকে কোন কিছুই মুক্ত নয়, হতে পারেনা। তাই ভাষাও সর্বদাই চলমান এবং বহমান। 

মানুষের মস্তিষ্কের অসাধারণ উন্নতি অন্য সমস্ত জীবকুল থেকে আমাদের অনেকাংশেই পৃথক করে দিয়েছে। আর মস্তিষ্কের এই উন্নতির ফলে আমাদের স্বরযন্ত্রও হয়ে উঠেছে এতটাই উন্নত যে তার ধারে কাছেও অন্য কোন প্রাণী পৌঁছতে পারেনি। অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের মূল তফাৎ কিন্তু এই স্বরযন্ত্র বা বাকযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের মৌলিক তফাৎ হচ্ছে আমাদের স্বরতন্ত্র ( ভোকাল কর্ড )। স্বরযন্ত্র বা বাকযন্ত্রের সাথে কিন্তু এই স্বরতন্ত্রের পার্থক্য অনেক। মস্তিষ্ককে কেন্দ্র করে, প্রথম সাঙ্কেতিক তন্ত্র আর স্বরযন্ত্রের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই অতি উন্নত দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র যা মননক্রিয়া পরিচালনা করে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় স্বরতন্ত্র। আমাদের নতুন নতুন ভাষা সৃষ্টির সাথে সঙ্গতি রেখে এই স্বরতন্ত্র উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে, আবার বিপরীতে এই স্বরতন্ত্রের ক্রমান্বয় উন্নতির সাথে সাথে আমাদের ভাষাও দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠছে। অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে চলেছে। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ভাষার সৃষ্টি কিন্তু চিন্তা থেকে হয়নি। মানে ভাষা আগে চিন্তা পরে। ভাষার উন্নতির সাথে সাথে কথা বলার শক্তি আয়ত্ত করার পর, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের সাহায্যে পরাবর্ত গঠন করার শক্তি অর্জনের পরেই মানুষ চিন্তা শক্তির অধিকারী হয়েছে। এই ভাষা এবং ধারণা থেকে গড়ে ওঠা চিন্তার বিষয়টি, আমাদের জীবন প্রক্রিয়ায়, জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে। পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন, ভাব-বিনিময়, আচার আচরণের সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য-কলা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উৎকর্ষতা নির্ভর করে ভাষা এবং ধারণা ও চিন্তার সম্মিলিত মেল-বন্ধনে।

ভাষা হচ্ছে ধারণার বাহক। মানুষ যখন থেকে মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তখনই দলবদ্ধ জীবনে মনের ভাব আদান প্রদানের জন্যে নানারকম স্বরবর্ণের ধ্বনি দিয়েই ভাষার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। জীবনযাত্রায় অগ্রগতির কারণে , এক অক্ষরের তথা সরল স্বরধ্বনি যখন ভাব-বিনিময়ে কুলিয়ে উঠছিলনা, তখনই নূতন নূতন দ্বি-আক্ষরিক ধ্বনি দিয়ে সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। আর তার সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে , অনুশীলনের বাস্তবতায় , স্বরবর্ণের সাথে ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার থেকে কালক্রমে , বহু অক্ষরের ব্যবহার, একাধিক শব্দ সহযোগে বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি আয়ত্ত করার অধিকারী হতে থাকলো মানুষ। 

এবার আসা যাক মাতৃভাষা প্রসঙ্গে। মাতৃভাষা বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়ে একটা সংশয় শিক্ষিত সমাজে বিদ্যমান। মাতৃভাষা কি আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের কথ্য ভাষা, নাকি আমাদের জাতীয় ভাষা অথবা যার যার ক্ল্যান বা গোত্রের ভাষা সেই প্রশ্ন এখনও পরিষ্কার নয়। একটি শিশুর পিতা যদি ফরাসী ও মা বাঙালী হয় ( যা আকছার ই হচ্ছে এখন ) আর দুজনে যদি দু’টো ভাষাতেই সন্তানের সাথে কথা বলে তাহলে শিশুটি কিন্তু ৬ বছর বয়েস হওয়ার আগেই দু’টো ভাষাই শিখে নেবে সহজেই। তখন তার মাতৃভাষা কোনটা হবে ? আবার, একজন অবাঙালি মা, নিজের প্রদেশ থেকে বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গিয়ে , একমাত্র সেই স্থানের ভাষায় যদি নিজের শিশু সন্তানের সাথে কথা বলে, তখনও কিন্তু সেই শিশুটি, সেই স্থানীয় ভাষাই শিখে যাবে। এমন টা কোলকাতায় হামেশাই দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে অন্য প্রদেশ থেকে চলে আসা বাবা মাকে কোলকাতার স্থানীয় বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে দেখা যায়। অথচ মায়ের মাতৃভাষা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তিনি যেখান থেকে এসেছেন, সেই প্রাদেশিক ভাষাই ! আবার অন্যদিকে, মাতৃভাষা বলতে বোঝাতে পারে মাতৃভূমির ভাষা। আর মাতৃভূমি বলতে বোঝায় কোন জাতির বিশেষ নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান। 

আসলে এই ধরণের বিভ্রান্তির কারণ কিন্তু শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ও মান্যতার সাথে জড়িত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা আর পারস্পরিক সামাজিক আদান-প্রদানের দ্রুততা, প্রায়শই কোনো কোনো শব্দের দ্বারা কোন কোন বিষয়কে বোঝাতে অক্ষম হয়ে ওঠে। জাতিতে জাতিতে ভাব বিনিময়ে তাই নূতন শব্দ প্রয়োগ করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের সাথে হাত মিলিয়েই উদ্ভব হয় নূতন শব্দ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই এমন অনেক অজস্র শব্দ আছে যেগুলি আর এখন মানুষের ভাবপ্রকাশে কাজে না এসে বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহারে এই বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখার মত। এই ভাবে এগোতে এগোতে মানবসমাজ দ্রুতলয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভাষার দিকে এগিয়ে যাবে। 

তাই সবদিক বিচার করে মাতৃভাষা শব্দটির যথাযথ অর্থ বুঝে ওঠা একটু মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কোন শব্দ সময়োপযোগী না হলে তার স্থানে সঠিক অর্থবহ একটি নূতন শব্দ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতেই পারে। আবার এমনও দেখা যায়, প্রয়োজন তথা পরিস্থিতির তাগিদে, নূতন নূতন শব্দ অনবরত সব ভাষাতেই স্থান করে নিচ্ছে। 

একটা জাতির পরিচয়ে যেমন ভৌগোলিক স্থান একটা শর্ত, ঠিক তেমন ই সেই জাতির নিজস্ব ভাষাও একটি শর্ত। তাই কোনও জাতির পরিচয়ের প্রশ্নে, ভাষাকে টিঁকিয়ে রাখতেই হবে। নাহলে সেই জাতি ইতিহাসের বস্তু হিসেবেই স্থান করে নিতে বাধ্য হবে। হারিয়ে যাবে তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ, হারিয়ে যাবে তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। হারিয়ে যাবে সেই জাতি। এমন ঘটনা অবিরত ঘটে চলেছে, এবং যেহেতু এটা একটা দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া তাই চট করে নজরে পড়েনা। 

এই প্রেক্ষাপটেই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেস্কো, জাতিসংঘ এমন কি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। তাহলেই এই মাতৃভাষা দিবস পালন হয়ে উঠতে পারে আক্ষরিক ভাবেই অর্থবহ। পৃথিবীর শত শত ভাষার মতো বাংলা ভাষাও আজ আসন্ন এক বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
0

বিশেষ প্রবন্ধ: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in



বিশেষ প্রবন্ধ

বই কথা-মেলার কথা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



বাঙালীর এখন বারো মাসে তেরো নয় চোদ্দ পার্বন । আর বাংলার এই চতুর্দশ পার্বন হ’ল ‘কলকাতা বইমেলা’ । দেখতে দেখতে কলকাতা বইমেলা আটত্রিশ বছর পার করে উনচল্লিশে পা দিল । পোষাকি নাম ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা’- বিশ্বের বৃহত্তম অ-বানিজ্যিক বইমেলা । অ-বানিজ্যিক – কারণ, বিশ্বখ্যাত ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা লন্ডন বইমেলায় পাঠকের কাছে বই বিক্রি হয়না, বইএর স্বত্ত বিক্রি হয় প্রকাশকদের কাছে, ওগুলো পুস্তক প্রকাশকদের মেলা । কলকাতা বইমেলার আকর্ষণ অন্যরকম । বইএর সঙ্গে পাঠকের মিলন মেলা । আর সেই কারণেই কলকাতা বইমেলা এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ তো বটেই, বইপ্রেমীদের উপস্থিতির বিচারেও কলকাতা বইমেলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ । বই বিক্রির হিসাব কোটি ছাড়িয়েছে বইমেলার দ্বিতীয় বছরেই ।

শুধু কলকাতা বইমেলাকেই বা বাঙালীর চতুর্দশ পার্বন বলি কেন ? আজ বাংলার এমন কোন জেলা নেই যেখানে বইমেলার আয়োজন হয়না । প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বইমেলার আয়োজন বাঙালির বড় আদরের বিষয় হয়ে উঠেছে । আমাদের এই ‘বইএর সমুদ্র’ অবগাহন, পাঠকের কাছে বইএর পৌঁছে যাওয়া – এসবের সূত্রপাত নিঃসংশয়ে কলকাতা বইমেলার সাফল্যের পথ বেয়েই এসেছে ।

বইকে ঘিরে এই যে উৎসব, যে উৎসবে মাতেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, সেই বই প্রকাশের উৎসমুখে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা হয় । তখনকি জানা ছিল বইএর কি অমোঘ শক্তি ! পুরাণের গল্প – সমুদ্র মন্থন করে নাকি অমৃত উঠেছিল, আর সেই অমৃত পান করে দেবলোক অমরত্ব লাভ করেছে । মানুষ দেবতা নয়, কিন্তু তার সভ্যতার ইতিহাস, তার পথচলাটাও তার সমাজ ও সভ্যতার পাঁচ হাজার বছরের মহা মন্থনের ফল । সেই মহা মন্থনের কোন এক আদীমতম কালখন্ডে মানুষ তার মেধা ও সৃজন ভাবনায় নিজেই রচনা করেছিল অমৃতের ভান্ডার – বই, পেয়েছিল অমরত্বের অধিকার । সে অন্য প্রসঙ্গ, আমি যেতে চাই ছাপা বইএর উৎসমুখে ।

সেই কবে আঠেরো শতকের শেষ ভাগে, নগর কলকাতার তারুণ্যে, কলকাতার ‘গ্রন্থনগরী’ হয়ে ওঠার সূত্রপাত । ছাপাখানার আবির্ভাব কলকাতার নবীন প্রজন্মের মানসিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল । ইংরেজরা তাদের শাসনের কাজের জন্য কলকাতায় ছাপাখানা এনেছিল, এটা একটা ঘটনা মাত্র কিন্তু ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবহারে এদেশীয়রা অনেক বেশি আগ্রহী ও তৎপর ছিল । উনিশ শতকে বাংলায় বুদ্ধির জাগরণে মুদ্রণ যন্ত্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয় । সে পথে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুররা অগ্রপথিক, কিন্তু এদের সঙ্গে দুটি নাম নিশ্চিত ভাবেই সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় তাঁরা হলেন ত্রিবেণীর এক কর্মকার পঞ্চানন এবং শ্রীরামপুরের বহরা গ্রামের এক বাঙালি ব্রাহ্মণ গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য । পঞ্চানন কর্মকার প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেন ১৭৮৪ সনে । আর গঙ্গা-কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । গঙ্গাকিশোর শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটর ছিলেন, তারপর কলকাতায় । গঙ্গা কিশোরই কলকাতায় প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । ১৮১৬তে প্রকাশিত ভরত চন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ছিল কলকাতায় ছাপা প্রথম সচিত্র বাংলা বই । বইটির কাটতি বাড়ানোর জন্য গঙ্গা কিশোর একটি দোকান খোলেন । সুতরাং গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্যই নগর কলকাতায় প্রথম বইয়ের দোকান খোলার পথ দেখিয়েছিলেন । কলকাতা যে একদিন ‘গ্রন্থ নগরী’তে পরিণত হল, তার আদি কারিগর গ্রামীণ বাংলা থেকে উঠে আসা এই দুজন – পঞ্চানন কর্মকার ও গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও আরো কয়েকজন । তখন রেলগাড়ি আসেনি, ডাক ব্যবস্থা শুরু হয়নি, কারখানার ভোঁ বাজতো না । তখন এঁরাই হয়েছিলেন কলকাতার সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রথম নেপথ্য পুরোহিত । ১৮৩০এ কলকাতা তখনও প্রাসাদ নগরী হয়ে ওঠেনি । কিন্তু ‘গ্রন্থনগরী’ হয়ে ওঠার সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল । ‘বটতলার সাহিত্য’ বলে একটা বিদ্রুপবাক্য আমাদের সাংস্কৃতিক মহলে খুব প্রচলিত । এই ‘বটতলা’র কোন ভৌগলিক সীমানা নেই । চিৎপুরের অলিগলি, গরাণহাটা, আহিরিটোলা, শোভাবাজারে ছাপাখানায় বাংলা বইএর মুদ্রণ ও বিপনন ব্যবস্থা প্রথম শুরু হয়েছিল বাংলা বই ছাপার সেই আদিপর্বে ।

অথচ আমাদের পরম বিস্ময়, সেই ‘গ্রন্থনগরী’ কলকাতার নাম বিবেচিত হয় নি, ভারতে যখন ‘জাতীয় বইমেলা’ সংগঠিত করার ভাবনাচিন্তা শুরু করে ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ।

ভারতে বইমেলা সংগঠন করার সূত্রপাত ১৯৬০এর দশকে, যখন ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট বা এন বি টি মুম্বাইএর চার্চ গেট ময়দানে প্রথম জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিল । এর পর তারা দিল্লী, মুম্বাই ও চেন্নাইতে জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিল । কিন্তু কলকাতার কথা তারা ভাবেনি । কলকাতাকে তারা জাতীয় বইমেলা করার জন্য উপযুক্ত মনে করে নি । আয়োজকদের মুর্খতাকে ধন্যি ধন্যি করতে হয় ! ১৯৭২এ নতুন দিল্লিতে বিশ্ব বইমেলা আয়োজিত হয় । কলকাতা তখনও বইমেলা সংগঠনের জন্য ব্রাত্য বিবেচিত ছিল । এর পর কলকাতার কয়েকজন উৎসাহী প্রকাশক, কলকাতা যে বইমেলা করার যোগ্য স্থান তা বোঝানোর উদ্যোগ নেয় । তাদের চেষ্টায় অবশেষে সেই চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসাকে ফুল দেবার মত অনিচ্ছুক ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ১৯৭৪এর জানুয়ারি মাসে কলকাতার একাডেমি প্রাঙ্গণে নিতান্ত ছোট আকারে একটি বইমেলার আয়োজন করেছিল । এর পরই কলকাতায় বার্ষিক বইমেলা করার চিন্তা ভাবনা শুরু হয় ।

পরের বছর ১৯৭৫এ, কলকাতার ১৪টি প্রকাশক মিলে গঠিত হয় ‘পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড’ । এদের উদ্যোগেই শুরু হয়ে গেলো ‘কলকাতাপুস্তক মেলা’ ১৯৭৬এর ৫ই মার্চ । চলেছিল ১৪ই মার্চ পর্যন্ত । এখন যেখানে ‘মোহর কুঞ্জ’, বিড়লা তারামন্ডলের ঠিক উলটো দিকের মাঠে আয়োজিত হয়েছিল কলকাতার প্রথম বইমেলা । মজার কথা, সেই প্রথম বইমেলায় কলকাতার সমস্ত প্রকাশক বইএর পসরা নিয়ে আসেন নি । তারা এর সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন । ফলে মেলার মাঠ অনেক ফাঁকাই ছিল । কিন্তু বইপ্রেমী মানুষের কাছে বইমেলা তার জন্মলগ্নেই প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করে, মেলার দিলগুলিতে যথেষ্ঠ জনসমাগম হয় । ফলে পরের বছর থেকে মেলায় পুস্তক বিপণির সংখ্যা ও জন সমাগম বাড়তে থাকে । ১৯৭৭এর দ্বিতীয় বইমেলায় বই বিক্রি হয়েছিল এক কোটি টাকারও বেশি আর মেলায় আসা বইপ্রেমীদের সংখ্যাটি ছিল প্রায় দু লক্ষ ।

কলকাতা বইমেলার উত্তরোত্তর যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তার প্রকৃত সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭৮এ আয়োজিত তৃতীয় বইমেলা থেকে । প্রসঙ্গত, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে । ১৯৭৬এর মার্চে প্রথম বইমেলার সময় ছিল জরুরি অবস্থার সামাজিক ও রাজনৈতিক কালো দিন । তামাম সত্তর দশকটা ছিল ‘মৃত্যুর দশক’। রাস্তায় ছড়ানো তরতাজা তরুণদের লাশ, কারান্তরালে হত্যা, সন্ত্রাস, গুপ্ত হত্যা, গণতান্ত্রিক শাসনের অন্তর্জলি যাত্রা, ১৯৭৫এ জরুরি অবস্থার কৃষ্ণপ্রহরে সঙ্কুচিত ব্যক্তি স্বাধীনতা আর মানুষের কন্ঠনালি তাক করা বন্দুকের নল - বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সে এক দুঃসহ কালো সময় । ১৯৭৬এর মার্চে প্রথম বইমেলা হয়েছিল এই আবহে । ১৯৭৭এর মার্চে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন, কেন্দ্রে কংগ্রেসের একচেটিয়া শাসনের অবসান, জুনে বাংলায় বামপন্থী সরকারের পত্তন । এই মুক্তির আবহেই আয়োজিত হয়েছিল তৃতীয় কলকাতা বইমেলা ১৯৭৮এ । উদ্বোধন করেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় । তৃতীয় বইমেলা হয়েছিল আরো প্রসস্ত ময়দানে, অনেক বড় আকারে । ১১২টি প্রকাশক এই মেলায় অংশ নিয়েছিল ।

তারপর কলকাতা বইমেলা শুধু বেড়েছে – আকারে, পাঠক আকর্ষণে, মর্যাদায়; যায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক বইমেলার ক্যালেন্ডারে । বইমেলা বেড়েছে তার পথচলায় নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, বাধা-বিপত্তি, অবিশ্বাস, কোন কোন মহলের বিরোধীতা ও জটিলতাকে সাক্ষ্য রেখে । ১৯৯৭এর ২২তম বইমেলায় মেলা চলাকালীন ঘটে গিয়েছিল ভয়াবহ অগ্নিকান্ড । লক্ষাধিক টাকার বই ভস্মিভূত হয়, হয়েছিল প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি । ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় মেলায় আসা এক দর্শনার্থীর । আবার তিনদিন পরে, গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির মত ভস্মস্তুপ থেকে জেগে উঠেছিল বইমেলা তার পূর্ণ দীপ্তিতে । ঐ বছর বইমেলার থিম ছিল ফ্রান্স আর উদ্বোধক ছিলেন নোবেল জয়ী ফরাসি সাহিত্যিক জাক দারিদা । ১৯৮৩তে ৮ম বইমেলায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মেলাপ্রাঙ্গণেই প্রয়াত হন আনন্দবাজার-দেশ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী অশোককুমার সরকার । পরের বছর থেকে কলকাতা বইমেলায় চালু হয় সম্মানজনক ‘অশোককুমার স্মৃতি বক্তৃতা’ । ১৯৮৩তে বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ২৮৫টি প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সংস্থা । ১৯৮৪তে কলকাতা বইমেলা জেনেভার ইন্টারন্যাশানাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলার ক্যালেন্ডারে যায়গা করে নেয় । ঐ বছর বইমেলায় ৩৬৩টি প্রকাশন সংস্থা অংশগ্রহণ করেছিল ।

১৮৮৪ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা’ নামে আর একটি বইমেলার আয়োজন করে । এই বইমেলার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলার গ্রন্থাগারগুলির বই কেনায় বিশেষ সুবিধা দান। ১৯৯৪এ এই সরকারী বইমেলা বন্ধ করে দিয়ে সরকারী উদ্যোগে শুরু হয় ‘জেলা বইমেলা’ । উদ্দেশ্য কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত জেলা শহরে বইমেলাকে ছড়িয়ে দেওয়া, মানুষকে আরো বেশি বইএর কাছে নিয়ে আসা । বস্তুত এর পর থেকেই বাংলার জেলাশহরগুলিতে বার্ষিক উৎসবের মত অসংখ্য বইমেলার আয়োজন হতে থাকে ।

১৯৭৬ থেকে ২০০৭ টানা ৩১বছর কলকাতা ময়দানে বইমেলা চলার পর সাময়িক বিপর্যয়েরও মুখোমুখি হয়েছিল বইমেলা । বলা যায় ২০০৭ এবং ২০০৮ - এই দুটো বছর কলকাতা বইমেলার ইতিহাসে সুর-তাল কেটে যাওয়া দুটি বছর । ময়দানে বইমেলা আয়োজনের বিরোধিতায় সক্রিয় হয়ে হয়ে ওঠে ‘ময়দান বাঁচাও কমিটি’ নামে একটি সংগঠন । তাদের দায়ের করা মামলায় মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট কলকাতা ময়দানে বইমেলার আয়োজন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে । অগত্যা সে’বছর যুবভারতী ক্রিড়াঙ্গণ সংলগ্ন মাঠে নিতান্ত ছোট পরিসরে কোন রকমে আয়োজিত হয়েছিল মেলা । পরের বছর মেলা আয়োজিত হবার কথা ছিল পার্কসার্কাস মাঠে । কিন্তু নির্ধারিত মেলা উদবোধনের আগের দিন কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে সেই আয়োজনও নিষিদ্ধ হয়ে যায় । সেবার অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ‘কলকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হয় নি । হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যাণ বিভাগের উদ্যোগে ‘বইমেলা ২০০৮’ এই ব্যানারে মার্চ মাসে । একত্রিশ বছর চলার পর আদালতের নির্দেশে বইমেলার ঠিকানা বদল মেনে নিতে পারেননি বাংলার বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ । উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তারা কলকাতা ময়দানে এক প্রতীকি বইমেলার আয়োজন করেছিলেন ২০০৭এর ৩১শে জানুয়ারি । পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯এ কলকাতা পুস্তকমেলা চলে যায় বিধান নগরের মিলনমেলা প্রাঙ্গণে । সে’বছর থেকেই কলকাতা বইমেলার নাম বদল হয়ে হয় ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা’ । মিলনমেলা প্রাঙ্গণই এখন বইমেলার স্থায়ী ঠিকানা ।

‘বইমেলা’ মানে তো শুধু বইএর মেলা নয় যেন সংস্কৃতির মহোৎসব । লিটল ম্যাগাজিন বিপণিতে তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যপ্রয়াসের সাক্ষর, তাদের নবতম গ্রন্থের প্রকাশ, দেশ-বিদেশের সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা । চোখে স্বপ্নমাখা কোন তরুণের উদাস ছবি আঁকা, কিংবা কোন প্রবীণ কবি কাঁধে ব্যাগ ভর্তি বই নিয়ে নিজেই পৌঁছে যাচ্ছেন পাঠকের কাছে – এ যেন বই আর পাঠকের এক মহামিলনমেলা ।

আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৭৬এ ১৪জন পুস্তক প্রকাশকের উদ্যোগে মাত্র ৫৬টি বইএর স্টল নিয়ে যে বইমেলার শুরু, সেই ‘কলকাতা বইমেলা’ গতবছর তার ৩৮তম বর্ষে আয়োজিত হয় আট লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে দেশ-বিদেশের ৭৭০টি স্টল নিয়ে, বইএর প্রতি মানুষের ভালোবাসার অনন্য শক্তি !

সেই কবে – ঔপনিবেশিক ভারতে ১৭৮৪ সনে হুগলী জেলার ত্রিবেণীর এক কর্মকার, পঞ্চানন প্রথম বই ছাপার জন্য বাংলা হরফ নির্মাণ করেছিলেন আর তার ত্রিশ বছর পরে শ্রীরামপুরের বহড়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেছিলেন, তখন কে জানতো বইএর কি অমোঘ শক্তি !
1

বিশেষ প্রবন্ধ: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ



নজরুল সংগীতের কিংবদন্তী  ‘গানের পাখি’ ফিরোজা বেগম
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



কোন কোন শিল্পী তাঁর নানান সৃষ্টির মধ্যে যে বিশিষ্টতা অর্জন করেন সেই বিশিষ্টতার মধ্যেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকেন মৃত্যুর পরেও বহুকাল । সদ্যপ্রয়াতা সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম ছিলেন তেমনই এক শিল্পী যাকে শুধু একজন সংগীত শিল্পী বলে চিহ্নিত করলে সবটুকু বলা হয় না । নজরুল-গানের শিল্পী হিসাবে নিজেকে কিংবদন্তীর উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ফিরোজা । সেই কবে, ১৯৪২এ ফিরোজা তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন, বারো বছর বয়সে প্রথম কলকাতায় রেডিওতে গান গাইলেন । ফিরোজার গান গাওয়ার পাঠ শুরু অবশ্য তার আগে থেকেই । ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ফিরোজার, ২৮শে জুলাই ১৯৩০ । এবং কি আশ্চর্য স্বামী কমল দাশগুপ্তর জন্মতারিখটাও ছিল তাঁর জন্মের ১৮বছর আগের এক ২৮শে জুলাই । পিতা মোহম্মদ ইসমাইল ছিলেন নামী আইনজীবি । মাতা বেগম কাওকাবুন্নেশা ছিলেন সংগীতানুরাগী । ছয় বছর বয়স থেকেই ফিরোজার গান গাওয়ার শুরু । কিন্তু তাঁর ‘ফিরোজা বেগম’ হয়ে ওঠা মোটেই কুসুম বিছানো পথ ছিল না ।

নিতান্ত শৈশবে পাঁচ/ছয় বছর বয়সে শোনা গানের কথা আমার কি করে মনে আছে কে জানে ! হয়তো জীবনে সেই প্রথম কলের গান শোনার বিস্ময় আজও স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে । পাড়ায় কোন এক বাড়ি থেকে গ্রামফোন রেকর্ডের একটা গান ভেসে আসছিল । ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ । তখন, নিতান্ত শৈশবে কার গান, কে গেয়েছেন – এসব জানার কথা নয় । পরে পরিনত বয়সে জেনেছিলাম গানটা ছিল ‘সাপুড়ে’ ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সংগীত পরিচালনায় কানন দেবী গেয়েছিলেন গানটি । তারপর বছর কুড়ি আগে একদিন ভোরে আমার কানের সঙ্গী এফ এম রেডিওতে শুনলাম সেই গান আবার ফিরোজা বেগমের কন্ঠে – ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ । কন্ঠস্বরের কি অনুপম ঐশ্বর্য ! আগেও তাঁর গান অনেক শুনেছি । কিন্তু সেদিন খুব কম প্রচারিত সেই গানের সুর কেন দীর্ঘদিন পরেও মনে থেকে যায়, তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই । অনেকেই নজরুলের প্রচুর গান গেয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । সেইসব শিল্পীর কোন একটি বা দুটি গান গায়নগুনে অন্যতর মর্যাদা পেয়ে যায় । সুপ্রভা সরকার গীত ‘কাবেরী নদীজলে কে গো’, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রর ‘শাওন আসিল ফিরে’ কিংবা শচীনদেব বর্মণ গীত ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ এমনই গান, যেগুলি অন্য অনেক শিল্পী গাইলেও মনে থাকে তাঁদেরই গায়নশৈলী । একই কথা বলতে হবে ফিরোজা বেগমের গান সম্পর্কে । ১৯৬০সালে পূজায়, গ্রামফোন রেকর্ডে গাওয়া দুটি গান ‘দূর দ্বীপ বাসিনী’ এবং ‘মোমের পুতুল মমির দেশে’ ফিরোজাকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে । এই গান অনেকেই হয়তো গেয়েছেন, কিন্তু সংশয় নেই যে গানদুটির জন্য ফিরোজা বেগমের কথাই মনে এসে যায় । তেমনই ‘নূরজাহান’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’, ‘আমি চিরতরে দূরে সরে যাব’, ‘ওরে নীল যমুনার জলচিল’এমনই বরষা ছিল সে দিন’, ‘মুশাফির মোছরে আখী জল’ এমন বহু কালজয়ী নজরুল গানে তাঁর কন্ঠের ইন্দ্রজাল অক্ষয় হয়ে আছে ।

৯ বছর বয়সে ফিরোজা কলকাতায় আসেন । কলকাতায় কোন এক গানের আসরে নজরুল ইসলাম তাঁর গান শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন । নজরুল তখনও সুস্থ ও পূর্ণ দীপ্তিতে এবং গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক । এই সময়েই ফিরোজা গ্রামফোন কোম্পানীতে অডিশন দেন । নজরুল ইসলামের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন এই সময়ে । তারপর ১২ বছর বয়সে ফিরোজার প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪২এ চিত্ত রায়ের সুরে । গানটির কথা ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’ । ঐ বছরই কমল দাশগুপ্তর তত্বাবধানে দুটি উর্দু গান রেকর্ড করেছিলেন । 

ফিরোজা তাঁর কৈশোরে নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন । কিন্তু বাংলা সংগীত ভুবনে তাঁর সূচনা পর্বের সময় নজরুল নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক তখন নজরুল স্নেহধন্য কমল দাশগুপ্ত । ১৯৪০এর দশক থেকে ষাটের দশকটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ । আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে তখন শচীন দেববর্মণ, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যুথিকা রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, সুপ্রভা সরকার, তালাত মাহমুদের মত গায়ক, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষের মত সুরকার – সে এক বিস্ময়কর শিল্পী সমাবেশ । ফিরোজা যুক্ত হলেন এই শিল্পী সমাবেশে । মনে রাখা দরকার যে, তখন সমভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে মেয়ের পক্ষে রেকর্ডে গান করা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না । 

নজরুল ইসলাম নীরব হয়ে গেলেন, কিন্তু বাংলা গানের ভান্ডারে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক হাজর গান । ফিরোজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি অন্য কোন গান নয়, তিনি শুধু নজরুলের গানই গাইবেন । তাঁর নজরুল গীতির কিংবদন্তী শিল্পী হয়ে ওঠায় শংসয়াতীত অবদান ছিল কমল দাসগুপ্তর । কমল দাশগুপ্ত নিজে নজরুলের বহু গানে সুর দিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর সঙ্গীত প্রশিক্ষক থাকা কালীন তিনি একের পর এক নরুলের গান গাইয়ে ছিলেন ফিরোজাকে দিয়ে । নজরুল-গানের মাধুর্যের প্রতি ফিরোজার যে টান তার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্তই । পাকা জহুরীর মত তিনি চিনেছিলেন ফিরোজা কে । যে ভাবে কমল দাশগুপ্ত ফিরোজার অগ্রজা-প্রতীম যুথীকা রায়কে মীরার ভজনের অনন্য শিল্পী করে তুলেছিলেন । নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে। এরপর থেকে আর ফিরোজাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । নজরুল সঙ্গীতের নানা রসধারায় সিক্ত হয়ে ফিরোজা বেগম গেয়েছেন, রেকর্ড করেছেন এবং শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন সুরের ইন্দ্রজালে। ফিরোজার কন্ঠ মাধুর্যে যেন নজরুল জীবন্ত হয়ে উঠতেন তাঁর গানে । ফিরোজা বেগম নজরুলের সব ধরনের গান গেয়েছেন। গজল, কীর্তন, ইসলামী গান, দাদরা-নানা ঢঙের সঙ্গীতরসে সিক্ত সঙ্গীতের মালা গেঁথে গেলেন তিনি সেই কৈশোর থেকে আমৃত্যু ।

ফিরোজা ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ এই ১৩বছর কলকাতায় ছিলেন । এই সময়েই ফিরোজার প্রতিষ্ঠা । এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন “দীর্ঘ সময় চিত্ত রায় ও কমল দাশগুপ্তের কাছে গান শিখেছি। কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে অনেক ধরনের গান শিখেছি। সেই সময় আমরা সবাই এক পরিবারের মতো ছিলাম। একসঙ্গে গান-বাজনা এবং নিয়মিত গানের চর্চা করতাম। প্রায়ই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যেও গান করেছি। পরিবারের কাছ থেকে গান-বাজনা করার জন্য বেশ উৎসাহ পেতাম। তাই হয়তো গান-বাজনা করতে আমার কোনো বাধা ছিল না” । তাঁর সংগীত প্রশিক্ষক, বয়সে তাঁর চেয় ১৮বছরের বড় কমল দাশগুপ্তর সঙ্গেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন ফিরোজা কলকাতায় ১৯৫৫তে । 

ফিরোজার পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও কাছের মানুষেরা ওদের অসম বিবাহ মেনে নেয় নি । ফলে বিবাহপরবর্তী দাম্পত্যজীবন অনেক দুঃখময় থেকেছে । কলকাতায় কমল দাশগুপ্তর কোন বাড়ী ছিলনা । সেই সময়, নানান বিপর্যয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা মোটেই ছিল না । হাতে তেমন কাজও ছিল না । একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয় ঘটে যায় । তার মধ্যেই ফিরোজা স্বামীর সঙ্গে নজরুলের গান ও স্বরলিপি সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে গেছেন । নির্বাক অসুস্থ নজরুলকে গান শোনাতেন । নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে গিয়েছেন । ফিরোজা-কমল দাশগুপ্তর অসম বিবাহ কলকাতাও খুব আদরের সঙ্গে মেনে নিয়েছিল, এমন নয় । বিস্ময়কর মনে হবে যে, কলকাতায় থাকাকালীন অজস্র নজরুলগীতি রেকর্ডে গেয়েছিলেন ফিরোজা, কিন্তু কলকাতার একটিও গানের জলসায় গান গাইবার জন্য তাঁর উপস্থিতি দেখা যায় নি । অথচ বাংলা গানের সেই স্বর্ণ যুগে কলকাতায় গানের জলসা লেগেই থাকতো । ১৯৭২এর ২৭শে অক্টবর কলকাতার রবীন্দ্র সদনে প্রথম একক সংগীতানুষ্ঠান করেন ফিরোজা । তখন তিনি ঢাকায় চলে গিয়েছেন সপরিবারে ।

১৯৬৭তে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য সপরিবারে ঢাকায় চলে গেলেন ফিরোজা । ওখানে তখন আয়ুব খানের সামরিক শাসন । শোনা যায় ফিরোজাদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা ছাড়ার ফতোয়া জারি হয়েছিল । সেই সময় তাঁর পরিবার ও অনেক মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কোন সমঝোতা করেননি ফিরোজা । তাই সেই আয়ুব খান সরকার যখন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের উদবোধনে প্রথম গানটি গাইবার জন্য ফিরোজা বেগমকে আমন্ত্রণ করেন, ফিরোজা শর্ত দিয়েছিলেন তিনি উর্দু নয় - বাংলা গান গাইতে দিতে হবে । নজরুলের ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি’ গানটি গেয়েই সূচনা করেছিলেন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের ।' নিজের ঐন্দ্রজালিক কন্ঠ নিয়ে অন্য অনেকের মতই চলচ্চিত্র বা লঘু গান করে পরিবারের আর্থিক সুরাহা করতে পারতেন । নজরুল গানে নিবেদিতা ফিরোজা সে পথে যাননি । স্বামী কমল দাশগুপ্ত পঞ্চাশের দশকে সুরকার হিসাবে যার ভারতজোড়া খ্যাতি, প্রায় আট হাজার গানের সুরকার – তাকে ঢাকায় মুদিখানার দোকান খুলতে হয়েছিল আর্থিক সংস্থানের জন্য । স্বাধীনতার পর, ১৯৭২এ বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে সে দেশে নিয়ে আসেন জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে । বাংলা দেশে নজরুল চর্চা গতি লাভ করে । গড়ে ওঠে নজরুল ইনস্টিটিউট – যার ভাবনা ফিরোজা বেগমের । সেখানে ফিরোজা বেগম নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রত্যয়ন বোর্ডেরও প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৪এর ২০শে জুলাই নিতান্ত অনাদরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় স্বামী কমল দাশগুপ্তর আর গত ৯ই সেপ্টেম্বর চলে গেলেন এক হাজার ছ’শ গান করা এই প্রবাদপ্রতীম সংগীত শিল্পী ৮৪ বছর বয়সে ।

দীর্ঘ সংগীত জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন তেমনভাবে প্রচারের আলোয় না থাকা ফিরোজা । কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান বিশ্বের অগণিত বাঙ্গালীর হৃদয়ে নজরুল-গানের কিংবদন্তী, ‘গানের পাখি’ হয়ে তাদের হৃদয়ে বিরাজ করা ।