বিশেষ প্রবন্ধঃ স্বপন দেব
Posted in বিশেষ প্রবন্ধ
বিশেষ প্রবন্ধ
ভাষা ও মাতৃভাষা
স্বপন দেব
১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ৪৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। প্রথমেই ভাষা শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। কথোপকথনে আমরা যে ভাষাই ব্যবহার করিনা কেন, তা কিন্তু কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টির ভাষা। ভাষা হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠেনা। কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা গড়ে ওঠে ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে এবং তা কখনই স্থায়ী একটা রূপ নিয়ে থেমে থাকেনা। ভাষা একটা চলমান এবং বহমান প্রক্রিয়া, যা ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়েই এগোতে থাকে। আর ঠিক এই কারণেই রবি ঠাকুরের মত কবি যে ভাষায় কথা বলতেন, এখন আর আমরা সেই ভাষায় কথা বলিনা; আবার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ঠিক আমাদের এখনকার ভাষায় কথা বলবেনা।
ভাষার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা মনে আসে, তা হচ্ছে, মানুষের মুখে ভাষা ফুটলো কি করে ! ভাষা বলতে যদি গলা দিয়ে নির্দিষ্ট আওয়াজ তথা ধ্বনি ( সাউণ্ড) সৃষ্টি করে কিছু শব্দ ( ওয়ার্ড ) বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে নিজের ধারণাকে অন্যের ধারণার সাথে যুক্ত করা বোঝায়, অর্থাৎ কথা বলা বোঝায়, তাহলে সেটা এমন কিছু শব্দ হতে হবে যার অর্থ কথক এবং শ্রোতার কাছে অভিন্ন। ব্যবহৃত শব্দগুলিকে খাপছাড়া ভাবে ব্যবহার করলেও চলবেনা। ভাষার ক্ষেত্রে এই পর্বে পৌঁছতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসতে হয়েছে। শুধু ভাষা কেন, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক পর্বগুলোও, কোনদিন বা কোন সময়ে স্থাণু নয়, হতে পারেনা। প্রকৃতির গতিশীলতা থেকে কোন কিছুই মুক্ত নয়, হতে পারেনা। তাই ভাষাও সর্বদাই চলমান এবং বহমান।
মানুষের মস্তিষ্কের অসাধারণ উন্নতি অন্য সমস্ত জীবকুল থেকে আমাদের অনেকাংশেই পৃথক করে দিয়েছে। আর মস্তিষ্কের এই উন্নতির ফলে আমাদের স্বরযন্ত্রও হয়ে উঠেছে এতটাই উন্নত যে তার ধারে কাছেও অন্য কোন প্রাণী পৌঁছতে পারেনি। অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের মূল তফাৎ কিন্তু এই স্বরযন্ত্র বা বাকযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের মৌলিক তফাৎ হচ্ছে আমাদের স্বরতন্ত্র ( ভোকাল কর্ড )। স্বরযন্ত্র বা বাকযন্ত্রের সাথে কিন্তু এই স্বরতন্ত্রের পার্থক্য অনেক। মস্তিষ্ককে কেন্দ্র করে, প্রথম সাঙ্কেতিক তন্ত্র আর স্বরযন্ত্রের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই অতি উন্নত দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র যা মননক্রিয়া পরিচালনা করে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় স্বরতন্ত্র। আমাদের নতুন নতুন ভাষা সৃষ্টির সাথে সঙ্গতি রেখে এই স্বরতন্ত্র উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে, আবার বিপরীতে এই স্বরতন্ত্রের ক্রমান্বয় উন্নতির সাথে সাথে আমাদের ভাষাও দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠছে। অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে চলেছে। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ভাষার সৃষ্টি কিন্তু চিন্তা থেকে হয়নি। মানে ভাষা আগে চিন্তা পরে। ভাষার উন্নতির সাথে সাথে কথা বলার শক্তি আয়ত্ত করার পর, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের সাহায্যে পরাবর্ত গঠন করার শক্তি অর্জনের পরেই মানুষ চিন্তা শক্তির অধিকারী হয়েছে। এই ভাষা এবং ধারণা থেকে গড়ে ওঠা চিন্তার বিষয়টি, আমাদের জীবন প্রক্রিয়ায়, জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে। পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন, ভাব-বিনিময়, আচার আচরণের সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য-কলা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উৎকর্ষতা নির্ভর করে ভাষা এবং ধারণা ও চিন্তার সম্মিলিত মেল-বন্ধনে।
ভাষা হচ্ছে ধারণার বাহক। মানুষ যখন থেকে মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তখনই দলবদ্ধ জীবনে মনের ভাব আদান প্রদানের জন্যে নানারকম স্বরবর্ণের ধ্বনি দিয়েই ভাষার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। জীবনযাত্রায় অগ্রগতির কারণে , এক অক্ষরের তথা সরল স্বরধ্বনি যখন ভাব-বিনিময়ে কুলিয়ে উঠছিলনা, তখনই নূতন নূতন দ্বি-আক্ষরিক ধ্বনি দিয়ে সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। আর তার সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে , অনুশীলনের বাস্তবতায় , স্বরবর্ণের সাথে ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার থেকে কালক্রমে , বহু অক্ষরের ব্যবহার, একাধিক শব্দ সহযোগে বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি আয়ত্ত করার অধিকারী হতে থাকলো মানুষ।
এবার আসা যাক মাতৃভাষা প্রসঙ্গে। মাতৃভাষা বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়ে একটা সংশয় শিক্ষিত সমাজে বিদ্যমান। মাতৃভাষা কি আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের কথ্য ভাষা, নাকি আমাদের জাতীয় ভাষা অথবা যার যার ক্ল্যান বা গোত্রের ভাষা সেই প্রশ্ন এখনও পরিষ্কার নয়। একটি শিশুর পিতা যদি ফরাসী ও মা বাঙালী হয় ( যা আকছার ই হচ্ছে এখন ) আর দুজনে যদি দু’টো ভাষাতেই সন্তানের সাথে কথা বলে তাহলে শিশুটি কিন্তু ৬ বছর বয়েস হওয়ার আগেই দু’টো ভাষাই শিখে নেবে সহজেই। তখন তার মাতৃভাষা কোনটা হবে ? আবার, একজন অবাঙালি মা, নিজের প্রদেশ থেকে বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গিয়ে , একমাত্র সেই স্থানের ভাষায় যদি নিজের শিশু সন্তানের সাথে কথা বলে, তখনও কিন্তু সেই শিশুটি, সেই স্থানীয় ভাষাই শিখে যাবে। এমন টা কোলকাতায় হামেশাই দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে অন্য প্রদেশ থেকে চলে আসা বাবা মাকে কোলকাতার স্থানীয় বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে দেখা যায়। অথচ মায়ের মাতৃভাষা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তিনি যেখান থেকে এসেছেন, সেই প্রাদেশিক ভাষাই ! আবার অন্যদিকে, মাতৃভাষা বলতে বোঝাতে পারে মাতৃভূমির ভাষা। আর মাতৃভূমি বলতে বোঝায় কোন জাতির বিশেষ নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান।
আসলে এই ধরণের বিভ্রান্তির কারণ কিন্তু শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ও মান্যতার সাথে জড়িত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা আর পারস্পরিক সামাজিক আদান-প্রদানের দ্রুততা, প্রায়শই কোনো কোনো শব্দের দ্বারা কোন কোন বিষয়কে বোঝাতে অক্ষম হয়ে ওঠে। জাতিতে জাতিতে ভাব বিনিময়ে তাই নূতন শব্দ প্রয়োগ করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের সাথে হাত মিলিয়েই উদ্ভব হয় নূতন শব্দ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই এমন অনেক অজস্র শব্দ আছে যেগুলি আর এখন মানুষের ভাবপ্রকাশে কাজে না এসে বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহারে এই বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখার মত। এই ভাবে এগোতে এগোতে মানবসমাজ দ্রুতলয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভাষার দিকে এগিয়ে যাবে।
তাই সবদিক বিচার করে মাতৃভাষা শব্দটির যথাযথ অর্থ বুঝে ওঠা একটু মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কোন শব্দ সময়োপযোগী না হলে তার স্থানে সঠিক অর্থবহ একটি নূতন শব্দ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতেই পারে। আবার এমনও দেখা যায়, প্রয়োজন তথা পরিস্থিতির তাগিদে, নূতন নূতন শব্দ অনবরত সব ভাষাতেই স্থান করে নিচ্ছে।
একটা জাতির পরিচয়ে যেমন ভৌগোলিক স্থান একটা শর্ত, ঠিক তেমন ই সেই জাতির নিজস্ব ভাষাও একটি শর্ত। তাই কোনও জাতির পরিচয়ের প্রশ্নে, ভাষাকে টিঁকিয়ে রাখতেই হবে। নাহলে সেই জাতি ইতিহাসের বস্তু হিসেবেই স্থান করে নিতে বাধ্য হবে। হারিয়ে যাবে তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ, হারিয়ে যাবে তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। হারিয়ে যাবে সেই জাতি। এমন ঘটনা অবিরত ঘটে চলেছে, এবং যেহেতু এটা একটা দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া তাই চট করে নজরে পড়েনা।
এই প্রেক্ষাপটেই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেস্কো, জাতিসংঘ এমন কি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। তাহলেই এই মাতৃভাষা দিবস পালন হয়ে উঠতে পারে আক্ষরিক ভাবেই অর্থবহ। পৃথিবীর শত শত ভাষার মতো বাংলা ভাষাও আজ আসন্ন এক বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteদারুন লেখা! মতামতবিহীন, তথ্যসমৃদ্ধ... ঠিক যে রকম একটি প্রবন্ধের হওয়া উচিত।
ReplyDelete