0

বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত

Posted in


বিশেষ রচনা



সুস্মিতার ভাষা ও একান্ত ছায়া 
শৌনক দত্ত


বাংলাভাষার আত্মত্যাগের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারী যেদিন বিশ্বমাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেলো বাসু আর সুস্মিতা সেদিন ঢাকায়। বাসুর বড় আক্ষেপ বাংলাভাষার জন্যই যদি এত প্রাণত্যাগ, তবে ৮ই ফাল্গুন বলতে মানা কোথায়? সুস্মিতা কিসব বুঝিয়ে ছিলো। কলিং বেলের শব্দে ঘোর কাটে, -টগবগে কিছু ছেলেমেয়ে। বাসুর অবাক চোখের চাউনিকে পলকে পাল্টে বলে উঠলো সুস্মিতা দির খবরটা পেয়েও আসতে পারিনি। ওনার একটি লেখা এবছর ভাষা সেরা পুরস্কার পাচ্ছে। দিদি তো নেই, আপনি এলে খুশি হবো। কথাটা শেষ করার আগেই একটি ছেলে একটি দুই ফর্মার বই বাড়িয়ে দিলো শহীদমিনারের পাশে সুস্মিতার ছবি, নাম - বাসুর সাথে ভাষার খোঁজে। ছবিটা বাসুই তুলেছিলো। তোমরা ভেতরে এসো? না দাদা আজ নয় বরং চলি। বাসুর সাথে ভাষার খোঁজে - নামটা পড়তে চোখটা ছলছল করে উঠলো স্মৃতির বাক্সো‌ খুলে উড়ে এলো ন্যাপথলিন স্মৃতি। ঐ বছর বাংলাদেশ, মনিপুর, আসাম কোথায় যায়নি। সেসময়ের বিরক্তি আজ বড় শূন্য করে দিচ্ছে বাসুকে। তবু বইটি খুলতেই যেন কর্পূরে স্বপ্নের ঘ্রান। কি লিখেছিলো সুস্মিতা? কত শখ ছিলো পুরষ্কার পাবে, পেলো সেই ওর কথা মতই - 'বাসু আমার ভেতরে জীবনানন্দ, আমাকেও দেরীতেই চিনবে পৃথিবী!' এ কি আক্ষেপ, নাকি আত্মদর্শন?

ভাষা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষার উদ্ভব এবং ক্রমান্বয়ে তার বিকাশ ও পরিপূর্ণতা আমাদের মানব সভ্যতাকে দিয়েছে এক বড় পরিবর্তনের আলোক সূচনা। তাই ভাষা আমাদের জন্ম ও বিকাশের সাথে প্রত্যক্ষ সংযুক্ত। শিশু এই পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলে যখন, তার কানে ধ্বনিত হয় কোন ভাষা - সেই ভাষা, সেই ধ্বনির সাথে তার ধীরে ধীরে পরিচয় হয় আর তা হয়ে ওঠে তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষাই কেন? কারণ একটি শিশু সবচেয়ে বেশি সময়, ভালবাসা আর উষ্ণতা লাভ করে তার মায়ের কাছেই, আর তাই মায়ের ভাষাই তার আপন হয়ে ওঠে অনেক বেশি। তাই মায়ের ভাষা প্রতিটি মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। শোক, ক্ষোভ, আনন্দ উচ্ছ্বলতায় মানুষ তাই তার অনুভূতি সত্যিকার অর্থে প্রকাশ করে তার মাতৃভাষাতেই। বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। তাই সে বাংলাতেই কথা বলে, কিন্তু ইতিহাসের পাতা উড়ে এলেই দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে বাঙালির প্রাণের ভাষাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে বা ষড়যন্ত্র হয়েছে বারবার। বিশ্ব ইতিহাসে এই বাংলা ভাষাকে নিয়ে যত ষড়যন্ত্র বা দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে তেমনি এই বাংলাভাষার জন্য যে এই প্রাণ বিসর্জন আর কোন ভাষার জন্য এভাবে দেখা মেলে না।

ভাষা আন্দোলন; পটভূমি থেকে মাতৃভাষা দিবস ১৭৭৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত পোষণ করেন একজন ব্রিটিশ লেখক। তার নাম ন্যাথিনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। ১৯১৮ সালে ভারতের ঐতিহ্যবাহী শান্তিনিকেতনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ভারতের সাধারণ ভাষা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রবিঠাকুর ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে মত পোষণ করেন। এ প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেন ওই সভায় অংশগ্রহণকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তার বক্তব্যে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। ওই সময়ে হিন্দি- প্রেমিকরা হিন্দিভাষাকে সমর্থন করে গান্ধীজীর দরবারে একটি পত্র লেখেন, তা হলো- the only possible national language for intercourse is hindi in India. ১৯২১ সালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী লিখিত আকারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে পেশকৃত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রবন্ধে আব্দুল হক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। ১৯৪৮ সাল নবগঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে করাচিতে। বৈঠকের শুরুতেই উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হয়। 

পূর্ব বাংলার বিরূপ প্রতিক্রিয়া: গণপরিষদ সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কুমিল্লা) সভায় একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাতে তিনি উর্দু-ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি জানান। পূর্ব বাংলার সব মুসলিম সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা এক জোটে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পূর্ববাংলায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। ‘‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’’ দাবিতে ছাত্রসমাজের বৈপ্লবিক পদক্ষেপে ঢাকার রাজপথ সরগরম হয়ে ওঠে। 

ভাষা-বিক্ষোভ ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ: বঙ্গীয় সমাজে বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যার চরম প্রকাশ ঘটে। এইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে বরকত, জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক সহ ছয়জন ছাত্র-যুবক হতাহত হন। 

রাজপথে প্রতিবাদী মিছিল: এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে সমবেত হন। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জমাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। এদিন নবাবপুর, রণখোলা ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এ দিনে শহীদ হন শফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল ও অহিদুল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তি। 

শহীদ মিনার স্থাপন ও ভাঙ্গন: ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখের রাতে ছাত্রজনতার এক বৈঠকে নেতৃবৃন্দ শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই রাতের অন্ধকারেই গুলিবর্ষণের স্থানে নিজেদের নকশা অনুযায়ী ইট দিয়ে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে পুলিশ এ শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেয়। সে জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে প্রথম শহীদ দিবস পালনের জন্য কাগজ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরের দুই বছরও ঐ স্থানে কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে শহীদ মিনারের অভাব পূরণ করা হয়। 

যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিমলীগ হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর মিলিত যুক্তফ্রন্টের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয় বিপুল ভোটে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মাঝে ২২৩ টি আসন পায়। মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ টি আসন। বাংলাদেশিদের দাঁতভাঙ্গা জবাবে পূর্ব পাকিস্তানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মুসলিম লীগ। 

বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি: অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে সরকার বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। স্বীকৃতি পেল ২১ ফেব্রুয়ারি। 

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পাওয়ার পিছনেও রয়েছে দীর্ঘ সাধনা, সংগ্রামের ইতিহাস। কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত “The mother language lover of the world” সংগঠন ১৯৮৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করে একটি চিঠি পাঠান। এ চিঠিতে সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন স্বাক্ষর করেন। এর এক বছর পর, ইউনেস্কো সদর দফতরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া রফিকুল ইসলামকে ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ সম্মতিসূচক চিঠি লেখেন, Regarding your request to declare the 21 February as International Mother Language day. The idea is indeed very interesting. 

অবশেষে Bangladesh National Commission -র পক্ষে সচিব কফিল উদ্দিন আহমদ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে প্রস্তাবটি ইউনেস্কো সদর দফতরে পেশ করেন। ইউনেস্কোর ২৮ টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাব লিখিতভাবে সমর্থন করে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে শোকার্ত দিন নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন গোটা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। রক্তের আলপনা এঁকে যে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের বাঙালি সন্তানরা, রাজকীয় ভাষা হিসেবে। তাঁদের আন্দোলনের সূত্র ধরেই ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাঁরাই আমাদের গর্বিত ধন, তাঁরাই আমাদের মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠাতা।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র আহত হয়। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান। সেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তাঁর মনে হয়, এটা যেন নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষনাৎ তাঁর মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে'ও এটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। আব্দুল লতিফ তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। গানটি গাওয়া ও লিখার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১জন ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ, যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। 

প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায়। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।

বাসু কিছুক্ষণ বসে থাকে তারপর উঠে গিয়ে কফি দুটো মগ নিয়ে এসে আবার পড়ে। তার মনের ক্যালেন্ডার উড়তে থাকে - মনে পড়ে যায় এই লেখাটার জন্য কত বই আর কত জায়গায় ছুটেছে সে, কখনো সুস্মিতা আর সে। এই লেখাটার সময় একটা নেশা পেয়ে বসেছিলো বাসুর, সুস্মিতার নিশ্চয় আরো বেশি মনে পড়ে, এই ছুটোছুটি পড়ালেখার জন্য বাসুর চাকরী গেলো। সুস্মিতা লেখা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলো, বাসু তা হতে দেয়নি। ডিপোজিট ভেঙ্গে ছুটলো আসাম, মনিপুর। এক পলক সুস্মিতা কে দেখে মগে কফির চুমুকে স্মৃতির রোদগন্ধ মিশিয়ে পড়তে লাগলো-

প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে বাংলাদেশের বাঙালীরাই একমাত্র জাতি নয় যারা আপন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং বুকের রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু এই রকম উন্নাসিক চিন্তা ও মিথ্যা বয়ানের প্রচুর নজির আমরা পাই আমাদের গল্প ও ইতিহাসের বইগুলোতে যা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে প্রকারন্তরে প্রশ্নবিদ্ধ করে, বাংলাভাষী সংগ্রামী জাতি হিসেবে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত লজ্জিত করে। বাংলার জন্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিরাই জীবন উৎসর্গ করেনি, করেছে আসামের জনগণও। এছাড়াও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ইতিহাসের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, রফিক, সফিয়ুর, বরকত ও জব্বার। বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের রাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষাশহীদ। দুঃখের বিষয় ইতিহাস তাঁদের তেমন মনে রাখেনি। আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অহমীয়া হলে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, কাছাড় এবং শিলচর হলো বাঙালীদের ঘাঁটি। দেশবিভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় । কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে । ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা করে দিলে ক্ষোভ দানা বাঁধে বাঙালীদের ভেতর । ক্রমশঃ তা রূপ নেয় আন্দোলনে। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস । 

১৯৬১ সালের ১৯ মে । আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করা হয়। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ করছিল তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলবর্ষন করলে ঘটনাস্থনে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী। আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষনা দেয়া হয়। সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ, সতের বছরের তরুনী কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ, যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন। ১৯ মের ১১ জন ভাষাশহীদদের তালিকা- ১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য ২. শহীদ শচীন্দ্র পাল ৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর ৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী ৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর ৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব ৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস ৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস ৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ ১০. শহীদ সুনীল সরকার ১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ। আসামে ১৯ মে এখনও ভাষাদিবস পালন করা হয়।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনে ১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন(১৯৫৫-১৯৯৬) শুরু হয় ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার’ ১৯৫৫ সালের দাবীর ভেতর দিয়েই, যেখানে তাদের দাবী ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে ভাষা পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষণ, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে। ১৯৬১ সনের ২৫ জুলাই আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ১৯৬৩ সনের ২২ মার্চ শ্রী ডি এন বাজপেয়ি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদের সাথে দেখা করেন। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৪ সালেরই ২৮ জুলাই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালের ২৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ স্টেট বোর্ড অব ইলিমেন্টারি এড্যুকেশন এর সেক্রেটারি শ্রী কে কে শর্মার সাথে সাক্ষৎ করেন এবং তাঁকে আসামে দ্রুত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই ‘দাবী সপ্তাহ’ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র পাবলিক সভা সমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় আদমশুমারী জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোড়দার বক্তব্য রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ভাষা পরিষদ নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে জনপরিসংখ্যান উত্থাপন করেন এবং কাছাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা দেখান ৬৬,৬২৩ জন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসেই পাবলিক সভা গুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং ১৯৬১ সনের উপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়। ১৯৬৮ সনেরই ২৫ জুলাই আসামের শিক্ষামন্ত্রী জে বি হেগজার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভাবনা তুলে ধরেন। একই সনের ৩০ আগস্ট কাছাড়ের জনগণ আবারো আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবী দাওয়া সংবলিত মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে। এর পর পরই ভাষা আন্দোলন আরো চূড়ান্ত গণ রূপ নেয় এবং ব্যাপক ধর্মঘট, ধরপাকড়, বন্ধ কর্মসূচি চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সনে পূর্ব পাকিস্থানে একদিকে যেমন চলতে থাকে গণঅভ্যুত্থান একই দিকে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন বন্ধ-ধর্মঘট- ঘেরাও-গ্রেফতারের ভেতর দিয়ে জনরূপ নেয়। 

নরসিংহপুর, রাতাবাড়ি, শালচাপড়া বন্ধ(৫-২৯ অক্টোবর,১৯৬৯)। জাপিরবন্দ বন্ধ(৩০ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এখানেই প্রথম কোনো নারী ভাষাবিপ্লবীও গ্রেফতার হন। মেহেরপুর বন্ধ (৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ৫ জন নারী আন্দোলনকারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পয়লা নভেম্বর’ ১৯৬৯ সালের পিকেটিং থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, ৩ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার হন ৩৮৫ জন, ১ থেকে ৫ নভেম্বরের ভেতর তিন জেলার ডিসি অফিসে পিকেটিং করে চেয়ার দখল করে নেয়া হয়, ৪ অ ৫ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার করা হয় ১১১ জনকে। রাষ্ট্রের ধরপাকড় ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর, ১৯৬৯ শিলচর শহরে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন হয়। শিলচর, নরসিংহপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ফেলেন ভাষাবিপ্লবীরা, এই ঘটনায় সরকার ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯ শিলচর বন্ধ থেকে ৩০০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়। হাইলাকান্দির ওএসএ মাঠে বিশাল সমাবেশ ডাকা হয় একই সনের ২১ নভেম্বর, হাইলাকান্দি বন্ধ থেকে সবচে’ ব্যাপক ধরপাকড়টি হয়, প্রায় ১৫০০ জন ভাষাবিদ্রোহীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘ডিসি অব লিংগুস্টিক মাইনরিটিস ইন ইন্ডিয়া’ শিলচর আসেন এবং মহাসভার সাথে বৈঠক করেন।

১৯৭০ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন অন্য মোড় নেয়। ১৯৭০ সালের ১৯ থেকে ৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা। ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর কাছাড়ের সর্বত্র ৪৮ ঘন্টার গণঅনশণ, ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ কাছাড়ের সর্বত্র ৭২ ঘন্টার গণঅনশণ পালন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের সর্বত্র ‘সংখ্যালঘু বাঁচাও দিবস’ পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন বাঙালির মাতৃভাষা দিবস, সেই তারিখে ১৯৭৯ সালে সমগ্র কাছাড়ে পালিত হয় অবস্থান ধর্মঘট। ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি আসামের শিল্প মন্ত্রণালয় ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের’ ভেতর একটি বৈঠক হয়। ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’ এবং ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ যৌথভাবে অবিলম্বে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে স্বীকৃতির দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার কাছে মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কেবলই সিদ্ধান্তই থেকে যায় এর কোনো বাস্তবায়ন হয় না। ১৪ নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু বিষয়ক একটি নোটিফিকেশন হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৩ তারিখে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ ঠার ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রা ও দাবীসমূহ নিয়ে প্রকাশিত দলিল (খবঃ যরংঃড়ৎু ধহফ ভধপঃং ংঢ়বধশ ধনড়ঁঃ গধহরঢ়ঁৎরং) আকারে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয় না। আবারো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৫ সালের ২ জুলাই ‘ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ দাবীদিবস পালন করে। ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় জাপিরবন্দ-সোনাপুরে জনসভা ও রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে ছাত্র ইউনিয়ন। 

আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবাদ মিছিল করে ১৯৮৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নলিনী সিংহ, নির্মল সিংহ, কৃপাময় সিংহ, সুরচন্দ্র সিংহদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ১২ ঘন্টা ‘রেল রোকো কর্মসূচি’ পালন করে। ১৯৮৯ সালের পয়লা ডিসেম্বর বিধান সভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রিলে অনশন পালিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ জুলাই তারিখে সরকার আবারো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালুর জন্য আরো একটি নোটিফিকেশন করে এবং ৬ আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে তা স্থগিত করে। ১৯৯০ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলে এল.পি স্কুলের ক্লাস বয়কট করা হয়।

শীতের এই সময় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে। বাসু উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে মনে হলে মনিপুরে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এমনই এক বৃষ্টিতে ভিজেছিলো তারা, যদিও তখন ঘোর বর্ষা। তবু আজ যদি সুস্মিতা পাশে থাকতো, কবিতা আওড়াত্‌ নয়ত গান। কি কবিতা বলতো কিংবা কি গান? ভাবতে ভাবতেই বাসু আবার পড়ায় মন দেয়।

১৯৯১ সালের সালের ২৬ জানুয়ারি রাজকুমার অনিলকৃষ্ণ মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং সুরচন্দ্র সিংহ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদের নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ৬,১০,১৯ আগস্ট শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ জেলার ডিআই অফিসে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। লড়াকু ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের ভেতর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা চালু করার দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেয়। ঐদিন শিলচর গান্ধিবাগ ময়দানে প্রায় দশহাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে এই চরমপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ঐ চরমপত্রকে কোনো গুরুত্ব না দেয়ায় ভাষা-আন্দোলন আরো দ্রোহী হয়ে উঠে এবং ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ ও কুলচন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বরাক উপত্যকার বারমুনি, কাটাখাল, কালানি, পাথাবরকান্দিতে ২৪ ঘন্টার জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। 

১৯৯২ সালের পয়লা নভেম্বর আন্দোলনকারীরা জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে। ১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর ৩৬ ঘন্টার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি আহ্বান করা হয়। ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দিসপুরে এক বৈঠক আহ্বান করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী স্তরে এটিই ছিল কোনো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। রাষ্ট্রীয় বৈঠকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আন্দোলনকারীরা পুনরায় ১৯৯৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৪৮ ঘন্টার সড়ক অবরোধ শুরু হয়। আসামে বিধানসভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ ৩৬ ঘন্টার গণঅনশণ কর্মষূচি পালিত হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১০১ ঘন্টার রেল রোকো কর্মসূচি আরম্ভ হয় ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল হতে বুরুঙ্গা, কাটাখাল, পাথারকান্দি এলাকায়। এই কর্মসূচির ফলে বরাক উপত্যকায় রেল চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। এই রেল রোকো কর্মসূচির ফলে অনেক সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির তিন জেলার ডিআই এবং ডিইইও অফিসে ১২ ঘন্টা পিকেটিং করা হয় এবং এর ফলে শিক্ষা বিভাগের অফিস পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বরও বরাক উপত্যকার অনেক সড়কে ৭২ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ২৬ মে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল গুলোতে(মূলত: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত এলাকায়) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এলাকা আসাম রাজ্যে এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকার তখনও গড়িমসি ভাবই বজায় রেখেছিল।

আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৬ মার্চ একটি রক্তক্ষয়ী দিন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভাষা আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রের নৃশংস বন্দুকের গুলিতে জান দেন বিলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। বরাক উপত্যকাতেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ শহীদ হোন বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ও প্রথম আদিবাসী নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ। ঐদিন পুলিশের গুলিতে আহত হোন সহস্রাধিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাযোদ্ধা এবং পরে হাসপাতালে প্রাণ হারান আরো একজন শহীদ সলিল সিংহ। 

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসকে আর উপক্ষা করতে পারে না আসাম রাজ্য সরকার। আসাম রাজ্যের ইলিমেন্টারি এডুকেশন এর ডেপুটি ডিরেক্টর ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত গ্রামের ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক ‘কনাক পাঠ’ তৃতীয় শ্রেণীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ শব্দটি লেখার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মৈতৈ মণিপুরী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিতর্কের একধরনের স্থিতি ঘটে। ভাষা বিদ্রোহীদের দাবী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এলাকার জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে সকল এলাকাতেই চালু করার। তাছাড়া এখনও স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষকেরা পড়ানোর দায়িত্ব পাচ্ছেন না। শহীদ সুদেষ্ণার স্মরণে ভারত ও বাংলাদেশের মণিপুরীরা ১৬ মার্চ ভাষাদিবস পালন করে থাকে।

বাসু সুস্মিতার ছবির সামনে দাঁড়ায়। তারপর চশমাটা মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে 'তুমি কি কেবলই ছবি' ...উত্তর শুনতে পায় বাসু 'না গো আমি তোমাতেই বাস করি তোমার হয়েই' -শিঞ্চন কে ডাকতে ইচ্ছে করছিলো বাসুর, বলতে ইচ্ছে করছিল - এই শোন ডাক্তার, সুস্মিতা কথা বলছে। পাশের গির্জা থেকে দুটো ঘন্টার আওয়াজ ভেসে এলো। বাসু আরেক দফা কফি এনে পাতা ওলটালো-

১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের ধারে পিষ্ট সেই কালো মানুষগুলো তাদের ভাষা সংগ্রামে কি দিয়েছিল আর কি পেয়েছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল এবং ভঙ্গ করেছিল ১৪৪ ধারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। যার ফলাফল ছিল ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, রফিক, বরকতের মতো ভাষাসৈনিকের শাহাদাত বরণ। অনেকটা তেমনভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকার সয়েটো হাইস্কুলের কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছিল। ১৯৭৬ সালে সরকার আফ্রিকান ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে স্ট্যান্ডার ও ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য। সে সময় বলা হয় ওই শ্রেণীর অংক ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে আফ্রিকান ভাষা এবং ইংরেজি ব্যবহৃত হবে সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে। তখন সরকারের এ সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে আফ্রিকান অভিভাবক, স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা পর্যন্ত। সবাই এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিল এবং অনেক শিক্ষক আফ্রিকান ভাষায় শিক্ষকতা করতে পারবেন না বলে চাকরি ছেড়ে দেন। অবস্থার অবনতি ঘটে ওই বছরেরই মাঝামাঝি সময়ে। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ যখন ছেলেমেয়েরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল এ ব্যবস্থায় লেখাপড়া করতে। সে সময় দি ওয়ার্ল্ড নিউজ নামক সংবাদপত্রে একটি ছাত্রের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছিল ‘আমাদের অভিভাবকরা প্রস্তুত আছেন শ্বেতাঙ্গদের এ অত্যাচার সহ্য করতে। তারা তাদের জীবনের অনেকটা সময়ই পার করে এসেছেন এ আইনকে মেনে নিয়ে এবং তারা আর এখন এ শাসকগোষ্ঠীর কোন কিছুতেই ভীত নন। আমরা দৃঢ়ভাবে এই রায় প্রত্যাখ্যান করে বলছি যে এ শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা মেনে নেব না। এটির উদ্দেশ্যই হবে আমাদের নিজ জন্মভূমিতে ক্রীতদাস হিসেবে তৈরি করার।’ এছাড়াও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিটি বাচ্চার পড়াশোনার পাঠ্যবই, স্টেশনারি এবং স্কুলের ভবন তৈরি বাবদ তাদের মায়েদের বাৎসরিক বেতনের অর্ধেকটাই কেটে রাখা হতো, সেখানে শেতাঙ্গ বাচ্চাদের জন্য কোনও খরচই ছিল না। ওই বছরেরই ১৩ জুন তিশীতিশ মাসিনিনি নামক ১৯ বছরের এক যুবক একটি মিটিংয়ের আহ্বান করেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। সেখানে তিনি এ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সকলকে একসঙ্গে আন্দোলন করার আহ্বান জানান এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তাদের পরিবারকে এ পরিকল্পনার কথা জানাবে না। অতঃপর ১৬ জুন, সওটনের স্কুলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশাকে উপেক্ষা করে সবাই উপস্থিত হলেন পূর্ব নির্ধারিত সময়ে। তারা সিদ্ধান্ত নেন ভিলাকাজি স্ট্রিটের অরল্যান্ডো ওয়েস্ট সেকেন্ডারি স্কুল থেকে তারা অরল্যান্ডো স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করবেন। সেসময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, সেদিন প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো স্কুলের পোশাক পরা ছাত্রছাত্রী ছিল। এ অবস্থা দেখামাত্র সেখানে পাঠানো হল একটি পুলিশ স্কোয়াড। তারা প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের বাধা দেয়। তারা তা না শুনলে পুলিশ কিছু কুকুর ছেড়ে দেয় এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্রছাত্রীরাও তার জবাব দেয় পুলিশের দিকে পাথর ও বোতল ছুঁড়ে। 

পরবর্তী সময়ে একজন সাংবাদিকের করা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সে দেখেছে একজন পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আর একজনও শুরু করল যার ফলাফল ২৩টি শিশুর মৃত্যু এবং ২০০-এরও বেশি আহত। বারো বছর বয়সী হেকটো পিটারসন গোলমালের মধ্যে মারাত্মক আহত হয়ে পড়ে আছে রাস্তায় আর তার পাশে কাঁদছে তার ছোটবোন। রাস্তার অপর পাশ থেকে ছুটে এসে পিটারসনেরই আর এক সহপাঠী তুলে নিয়ে গেল তাকে। আর এ দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করেছিল দি ওয়ার্ল্ডের ফটোগ্রাফার সাম নজিমা। পিটারসনের শেষ সময়কার সে ছবিগুলো ঘুরে বেড়িয়েছিল সারাবিশ্ব আর প্রতীক হয়েছিল জাতিগত বৈষম্যের নিষ্ঠুরতার। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়লে সয়েটো এর বাইরের শহর যেমন উইটওয়াটারেসরানও প্রিটোরিয়া, ডারবান এবং কেপটাউনসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিল। যার ফলাফল বছর শেষে মৃত্যু প্রায় ৫৭৫ জনের এবং আহত প্রায় ৩ হাজার ৯০৭ জন। সে সময় সয়েটো এর ওই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ ছিল। এর পর থেকেই তাঁরা তাদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে থাকেন বিভিন্ন সময়ে। যার ফলাফল আসে ১৯৯৪-এ তাঁদের স্বাধীনতা দিয়ে। ওই আন্দোলনের পর যে সুবিধাটি তাঁরা সবার আগে পান তাহল ছাত্রছাত্রীরা কোন মাধ্যমে পড়াশোনা করবে তা তাঁরা নিজেরাই পছন্দ করতে পারবেন। এছাড়া টিচারদের বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দিয়ে তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থাও নেয়া হয়। ওই ঘটনার পর সয়েটোতে আরও অনেক স্কুল তৈরি করা হয় নতুন করে এবং অনেক শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে পরিবর্তনটি আসে তাহল বহু পুরনো সেই আইনকে বাতিল করে কৃষ্ণাঙ্গদের শহরে আসা ও বসবাসসহ ব্যবসা করার স্থায়ী অনুমতি দেয়া হয়। যা আগে শুধু শেতাঙ্গরা পেত। এমনকি ডাক্তার, আইনজীবী ও অন্য পেশার মানুষ শহরে এসে ওই পেশা ধরে রাখতে পারবেন। সয়েটো আন্দোলনের ৩০ বছর পর ১৬ জুন ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থারো এমবেকি প্রতিষ্ঠা করেন হেক্টোর পিটারসেন মেমোরিয়াল এবং মিউজিয়াম। যার প্রবেশের মুখেই রাখা আছে সাম নজিমা এর সেই বিখ্যাত ছবিটি যার ক্যাপশনে লেখা আছে, ‘সেই যুবদের স্মরণে যারা প্রাণ দিয়েছিল মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে।’

বইটা পড়া যখন শেষ হলো তখন বাসুর মনে হলো বিনিদ্র কালের ভেলা হারাতে দেইনি, ভাষা কবিয়াল ধরেছে পাঁচালী, সুনীল সংসারে পেতে বসেছি মহাশূন্য অকালের, তুমি ক্যাডবেরী ঠোঁটে করে নিয়ে ফিরে এলে ভোরের আলোয়, ...বাজে সঙ্গীত ...বাজে ফেরারী ভাষার পান্ডুলিপি, একুশে ফেব্রুয়ারি...





তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে, মহাম্মদ শাফী, গবেষক পাভেল পার্থ, শিলচর ও ভাষা, আসামের ভাষা শহীদ, ভাষা জাদুঘরের স্মারকগ্রন্থ

0 comments: