0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ তন্ময় গুপ্ত

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য

ফল্গু - প্রথম পর্ব 
তন্ময় গুপ্ত


বেশ কিছু জিনিষ আছে, যা পুরনো হবার সাথে জমে বা মজে। দামী হয়। সে আমাদের দেশি আচার হোক বা বিলাতী মদ। অনেকে বলেন পুরানো বন্ধুত্ব। সে অবশ্য সৌভাগ্যের ব্যাপার,তবে পুরান প্রেম যে বয়সের সাথে সাথে ঘন হয়, জমে ওঠে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আজকের যুবক যুবতীরা অবশ্য সে প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্ছিত। শীতের দুপুরের কয়েতবেল মাখার স্বাদের মতোই। বর্তমান যুগে ‘অপশন’এত বেড়ে গেছে যে প্রেমেও তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই প্রেম পুরনো হওয়ার আগেই তা বদলে যাচ্ছে।

তখন আমি কলেজে পড়ি। আমার এক দঙ্গল বন্ধুবান্ধবের জীবনে তখন ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঘোর লাগা, প্রায় সবারই প্রিয় কবিতা “১৮ বছর বয়স কি দুঃসহ,স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি...”। শুধু ব্যতিক্রম-শোভন।আমাদের সবার প্রিয় খ্যাপাটে বন্ধু-শোভন পাল। বাল্যবয়সেই মাতৃহারা শোভন অতিরিক্ত আদর যত্ন পেত আমাদের বন্ধুদের বাড়ীতে।যে কোন বাড়ীতেই শোভনের প্রবেশ অবাধ। 

ভাস্করের মা শোভনকে খুব স্নেহ করতেন। মাঝেমধ্যেই ভালোমন্দ রান্না করে ওকে ডেকে এনে খাওয়াতেন। শোভনের মাকে নিজের বোনের মতোই দেখতেন ভাস্করের মা।ভাস্করের বোন মুন্নি খুব খবরদারী করতো শোভনের ওপর। শোভন খেপে যেত যথারীতি।

কোনও ছুটির দিনে যখন আমরা দল বেঁধে ফুটবল খেলতাম, সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে যখন দুপুরের দোরগোড়ায় দাঁড়াত, দেখতাম মাঠের ধারে মুন্নি এসে হাজির হতো।

-কি গো, তোমরা খেলা বন্ধ করবে এবার? কটা বাজে খেয়াল আছে?

শোভন রেগে যেত- তাতে তোর কি ?

-মা কতক্ষণ বসে থাকবে তোমার জন্য ? সকালে কিছু খাওয়া হয়েছে ?

-ভাগবি তুই? কে পাকামো করতে বলেছে তোকে?


একদিন একান্তে শোভনের সাথে গল্প করতে করতে আমি বললাম- কিরে? প্রায় সবাই তো নিজের হিল্লে করে নিলো, তোর কি খবর?

-খবর আবার কি ? ওসব আমার দ্বারা হবে না। তোরা কি করে সহ্য করিস কে জানে! 

-আরে! তুই এমন ভাবে বলছিস কেন? কেউ তোর খেয়াল রাখছে দিনরাত, এটা ভাবতে তোর ভাল লাগেনা?

শোভন একটু আনমনা।
-নাহ। আমার খেয়াল কেউ রাখে না, রাখবেও না। 

সাহস করে ওর মনের কথা জানতে আগ্রহী হই। বলি- আচ্ছা, মুন্নিকে তোর কেমন লাগে রে?

-মুন্নি-ই? তুই বলতে পারলি? একটা নোংরা মেয়ে!

আমি বিরক্ত হই- দেখ শোভন তোর ভাল না লাগতেই পারে, তা বলে তুই একটা ভাল মেয়েকে, বিশেষ করে যাকে আমরা ছোট থেকে দেখছি, আমাদের বন্ধু ভাস্করের বোন, তাকে তুই নোংরা বলতে পারিস না। কি নোংরামো দেখেছিস তুই?

-আরে ও নখ কাটে না। সাবানও মাখে না বোধহয় রোজ। বেশ করব নোংরা বলব। অম্লান বদনে বলে শোভন।

বোঝ! আমি হাসি চাপতে পারিনা। আমার সরল সাধাসিধে খ্যাপাটে বন্ধুটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।


কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। আমরা কলেজ ছাড়িয়ে কেউ কেউ তখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। শোভনও একটা কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। সেদিন ছিল সরস্বতী পুজো। আমরা বন্ধুরা রাস্তার পাশে মল্লিকদের রকে বসে আড্ডা মারছি। সকালবেলা থেকেই অনভ্যস্ত শাড়ীতে বালিকা কিশোরী তরুণী সরস্বতীদের যাতায়াত। দল বেঁধে স্কুল কলেজ থেকে ফিরছে সবাই। এমন সময় সাইকেল বাহনে শোভনের আগমন। বিপরীত দিক থেকে একটা লরি আসছিল। হঠাৎ দেখি শোভন বিপজ্জনক ভাবে রাস্তার মাঝে চলে এসেছে। লরিটা সুনিপুণ ভাবে প্রচণ্ড আওয়াজ করে ব্রেক কষলো। শোভন খুব দ্রুত রাস্তার ধারে চলে এল। সবাই হৈহৈ করে উঠল।

উত্তেজিত হয়ে শোভন আমায় বলল -দেখবি একদিন ওর জন্যই আমার প্রাণটা যাবে!

সবাই জিজ্ঞাসা করে -কে?কার জন্য?
শুধু আমি চুপ করে ওকে শান্ত করতে লাগলাম। উল্টো দিক দিয়ে বান্ধবীদের সাথে দল বেঁধে মুন্নি সুন্দর সাজে সেজে হেঁটে আসছিল, সেটা আমার চোখ এড়ায় নি। 



একটু ফাঁকা হতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম –কি হয়েছিল? এমন ভাবে না দেখে রাস্তা পার হচ্ছিলি?
খেঁকিয়ে উঠে জবাব দিল-কি করব? কোন দিকে দেখব? কে ওকে তাকাতে বলেছিল?
আমি সামাল দিলাম- ঠিক আছে ঠিক আছে।



এরপর সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজের নিজের কর্মজীবনে। অনেকেই দূরদূরান্তে পাড়ি দিলাম বদলির চাকরির জন্য। জন্মস্থান ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় জীবন যুদ্ধে যেতে হল। কেউ কেউ বৈবাহিক জীবনেও প্রবেশ করছে সে সময়। আর ঠিক সেই সময় একদিন খবর পেলাম মুন্নির নাকি বিয়ে।

ঠিক তারপরের মাসেই আমারও বদলির দিন স্থির হয়ে আছে। যেতে হবে চিত্তরঞ্জন। সেদিনই সন্ধ্যায় শোভনের সাথে হল। খুব ব্যস্ত হয়ে সাইকেল নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছিল। ওকে থামালাম,
-আরে! শোন শোন!

-হেই! কি খবর রে! তোকে তো দেখাই যায় না! কিন্তু এখন তো বসা যাবেনা রে! মেলা কাজ পড়ে আছে।

-আরে দাঁড়া না! একটু চা খাই চল। কাজের চাপে তো দেখাও হয়না, কথাও হয়না।

-ও.কে। চল, কিন্তু জাস্ট পাঁচ মিনিট।


আমি চা খেতে খেতে আসল কথায় চলে এলাম। –ব্যাপারটা কি?
-তো চললি কোথায়?
-সে অনেক কথা! অনেক কাজ।
-উফ্‌। তুই না! কিছুতেই ঝেড়ে কাসবি না।
-হ্যাঁরে, শুনলাম মুন্নির নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
-হ্যাঁ হয়েছে। তো আমি কি করব? আমার ঝামেলা বেড়ে গেছে শুধু, এই দ্যাখ! সব জোগাড়-যন্ত্র, বাজার-হাট সব আমায় সামলাতে হচ্ছে। কি করি বল, কাকিমাকে তো মা এর মতই দেখেছি। না করা যায়? যত্তো সব!
আমি বললাম-কিন্তু আমিতো ভেবেছিলাম, তোরই পছন্দ ছিল মুন্নিকে। এমন কি ভাস্করকে এ কথা বলব এমনটাও ভেবেছিলাম।
–আমার বাপের ভাগ্যি যে তুই শেষমেশ এ কথা বলিসনি। তোর মাথা খারাপ নাকি? ফুঃ 
-কেন রে? হেসে বলি- “নোংরা”?
খ্যাপাটে বন্ধুটা গুম হয়ে বলল-হুম্‌।
ওকে আর ঘাঁটাইনা।


মুন্নির বিয়ে হয়ে গেল বেশ ধুমধাম করে। শোভন প্রতিটি দিকে খেয়াল রেখে অমানুষিক খাটা খাটনি করলো।মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে বরের গাড়িতে উঠে বসল। শুধু যাওয়ার সময় ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমার কানে কানে বলে গেল- “বাপি দা, ওকে একটু দেখো”।

পরের মাসেই আমার বদলী হয়ে গেল। পরের বছরের পুজোতে বাড়ী ফিরে ভয়ানক এক দুঃসংবাদ পেলাম। মুন্নির স্বামী পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমি এতটাই শোকাহত হলাম যে ওদের সাথে দেখা করার সাহস হল না। কোন মুখে দাঁড়াব মুন্নির সামনে? বন্ধুদের কাছে শোভনের খোঁজ করলাম। সবাই বলল সে নাকি অফিসে অনুরোধ করে আসাম না কোথায় চলে গেছে। মুন্নির বিয়ের পর থেকে তাকে আর কেউ দেখেনি।

ব্যাস্‌। ধীরে ধীরে ওরা সবাই ঝাপসা হয়ে গেল আমার মনের ক্যানভাসে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আরও পাঁচজনের মতোই।

(চলবে)

0 comments: