প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
ভাষা দিবসের তাৎপর্য
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
১৯৯৯এর ১৭ই নভেম্বর বিশ্ব সংগঠন ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ পালনের আহ্বান জানানোর পর বিশ্বের নানা প্রান্তের সঙ্গে এ বাংলাতেও ‘ভাষাদিবস’ পালনের রেওয়াজ শুরু হয় । ওপার বাংলাতো বটেই এ বাংলাতেও দু একটি ভাষাসংগঠন আরো আগে থেকেই ‘ভাষা শহিদ দিবস’ পালন করে আসছে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে । এপারের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীরা বিনম্র শ্রদ্ধায় একষট্টির ভাষা আন্দোলনে হত এগারো শহিদের স্মৃতিতর্পন করেন প্রতি বছর ১৯শে মে । এটা ভাষাদিবস পালনের একটি দিক ।
একুশে পালনের তাৎপর্য শুধুমাত্র ভাষা শহিদদের স্মৃতিতর্পন নয়, আরো কিছু । একুশে যেমন ভাষা শহিদ দিবস তেমনই মাতৃভাষা দিবস । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং আমাদের জীবনচর্যায় মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দানের প্রত্যয়কে প্রসারিত করার দিনও । ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন – মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে সেদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অবশেষে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা । একুশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ওপারে বাংলার মত এক সমৃদ্ধ ভাষার সম্ভাব্য বিলুপ্তি রোধ করেছিল । ১৯৬১র ১৯শে মে’র বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন সেখানে মতৃভাষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছিল । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই । কিন্তু এই ইতিহাস চর্চার বাইরে ভাষা দিবসের তাৎপর্য নবীন প্রজন্মের কাছে কতটা পৌঁছাতে পেরেছে, সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায় ।
ভারতে বাংলা ভাষা দুটি রাজ্যের সরকারী ভাষা । কিন্তু এই যে গত ষোল বছর ধরে আমরা ঘটা করে ভাষাদিবস পালন করছি, নবীন প্রজন্মের কাছে তার আবেদন কতটুকু পৌঁছায় কিংবা ভাষা-আবেগ তাদের কতটুকু স্পর্শ করে তা বোঝার উপায় নেই । এখানে বাংলা চাকুরি পাওয়ার ভাষা নয়, উচ্চশিক্ষা লাভের ভাষা নয়, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ভাষাও নয় । কিন্তু সেটাই বাংলা ভাষার নিজভূমে দুয়োরানী হয়ে থাকার একমাত্র কারণ নয় । তবে হ্যাঁ, ক্ষীণ কন্ঠে এটা জানান দেওয়া গেছে যে বছরের ৩৬৫ দিনের একটা দিন ভাষা দিবসের নামে বরাদ্দ করা হয়েছে । অনেকে আবার ভাবতে পারেন, ভাবেনও যে, তা হোক না । নারী দিবস, প্রবীণ নাগরিক দিবস, বাবা দিবস, এমনকি হুইস্কি দিবসও তো বরাদ্দ আছে । আশঙ্কা হয়, এদেশে ভাষাদিবস ভাষা উৎসব না হয়ে যায় । কারণ উৎসবের ফন্দি-ফিকির খুঁজতে আমরা বেশ দড় । তাই ভাষাদিবসের তাৎপর্য যাদের সবচেয়ে বেশি জানা দরকার সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থেকে যায় অন্ধকারে ।
আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে ‘বিশ্বায়ন’ নামক পাঁচ অক্ষরের এক দানবীয় বন্দোবস্ত তার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের কৌশল হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ভাষাগত বহুত্ববাদ ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসাবে আমরা টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, মোবাইল ফোনের এসএমএস ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক বিকৃত ভাষা রপ্ত করে নিচ্ছে নবীন প্রজন্মের শিশুরা, গড়ে তুলছে নিজ মাতৃভাষার সঙ্গে অনাত্মিয়তা ।
বিশ্বের আদিম জনগোষ্ঠীগুলির মাতৃভাষার ক্রমবিলুপ্তি রাষ্ট্রসঙ্ঘকে বিচলিত করেছিল । বস্তুত, বিশ্বের ভাষাবিজ্ঞানীরা ধারাবাহিক গবেষণা শুরু করেছিলেন, বিশ্বায়ন কি ভাবে অনুন্নত জনগোষ্ঠীগুলির ভাষাগত ভারসাম্য এলোমেলো করে দিতে পারে সেই বিষয়ে । রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীনে এই বিষয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে, যেখান থেকে উঠে এসেছিল এক ভয়াবহ ছবি । তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘকে সতর্কিত করেছিলেন যে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের ছয় হাজার মাতৃভাষার বিলুপ্তি ঘটবে, যদি না ভাষা বিলুপ্তির এই প্রবণতাকে ঠেকানো যায় । আমরা জানি আদিম ভাষাগোষ্ঠীর ক্রমবিলুপ্তি ছিল উপনিবেশবাদের অনিবার্য ফল । আজকের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের আবহে সেই ট্রাডিশনের অন্যথা হবার কথা নয় ।
কোন ভাষার বিলুপ্তি ঘটে তখন, যখন সেই ভাষায় কথা বলার আর একটি লোকও থাকে না । আমরা জানি, গত দুশো বছরে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ বহু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে চিরতরে লোপাট করে দিয়েছে । আমেরিকার আদিম জনগোষ্ঠী বা কালো মানুষরা জানে না, তাদের মাতৃভাষা কেমন ছিল । মেক্সিকো কিংবা মরিসাসের মানুষ জানে না তাদের মাতৃভাষা কি ছিল । আমরা আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারি এই ভেবে যে, বাংলার মত এতো সাহিত্য-সম্পদ সমৃদ্ধ ভাষা, যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ আছেন, সে ভাষার মৃত্যু হতে পারে না কোন দিন । হ্যাঁ, পারে । সংস্কৃতেও তো কালিদাস, ভারবি, ভাস ছিলেন, সে ভাষাও মৃত । অহম ভাষা একসময় খুব সমৃদ্ধ ভাষা ছিল । ১৩ থেকে ১৮ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শাসন করতো অহম জনজাতি । ১২২৮ থেকে ১৮২৬ পর্যন্ত অহম গণরাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল ‘অহম’। ১৯ শতাব্দীর মধ্যে এই ভাষাটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে । বিষয়টা তো এই যে আমরা সেই ভাষায় কথা বলছি কি না, সেই ভাষাতেই আমার সৃজনশীলতা পুষ্ট হচ্ছে কি না । শিশুরা বা নবীন প্রজন্ম যদি তাদের দৈনন্দিন জীবনে, জীবনচর্যায় মাতৃভাষার উচ্চারণ থেকে বিরত থাকে তবে সেই ভাষার মৃত্যু ঠেকানো যায় না । এপারের বাঙ্গালাভাষীদের অশেষ সৌভাগ্য যে বাঙ্গালী জাতিসত্তার একটা স্থায়ী ঠিকানা আছে – বাংলা দেশ, যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা ।
ভাষা বিলুপ্তি সম্পর্কে সারা বিশ্বকে প্রথম যিনি সচেতন করেছিলেন, সেই আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপ্ মাইকেল ক্রাউস ২০০৭এ একটি তথ্য দিয়েছিলেন যে, সারা বিশ্বে সক্রিয় ভাবে চালু সাত হাজার ভাষাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায় নিরাপদ, প্রায় বিপন্ন ও বিপন্ন ভাষা । তাঁর মতে সেই ভাষাকেই নিরাপদ বলে মনে করা হয় যদি শিশুরা ও নবীন প্রজন্ম আগামী একশো বছরে সেই ভাষা ব্যবহার করে তার দৈনন্দিন জীবনে । না করলে সেই ভাষা বিপন্ন ভাষা রূপেই চিহ্নিত হবে, ক্রম বিলুপ্তিই যার অনিবার্য পরিণাম । ২০০৯এ ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ সমিতির প্রতিবেদনে একই কথা বলা হয় যে, “একটি ভাষায় কথা বলা জনগন যদি তার দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকে, সেই ভাষায় আদান প্রদান করা মানুষের সংখ্যা যদি ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং সেই ভাষায় কথা বলার ধারা যদি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত না হয় তবে তা বিপন্ন ভাষা রূপেই চিহ্নিত হবে” ।
তৃতীয় বিশ্বের ভাষাগত বহুত্ববাদ ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য তছনছ করে দেওয়াই উন্নত দেশগুলির অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের লক্ষ্য । তাঁরা চাইছেন সারা বিশ্বে মাত্র পাঁচ-ছটি ভাষায় মানুষ কথা বলবে । কারণ তাঁরা মনে করেন ভাষার কাজ শুধু সংযোগ সাধন করা বা ‘কমিউনিকেট’ করা । ভাষার নৃতাত্বিক উপযোগিতা তাঁদের কাছে গৌণ । তিন ধরনের প্রবণতা কোন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় । প্রাধান্য বিস্তারকারী কোন ভাষার চাপে নিজের মাতৃভাষার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং এই বিচ্ছিন্নতার ফলেই কয়েকটি প্রজন্ম ধরে কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা ‘ভাষামৃত্যু’র দিকে এগিয়ে যায় । আবার কোন ভাষাগোষ্ঠী নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সেই প্রাধান্য বিস্তারকারী ভাষার প্রকরণকে নিজ ভাষার সঙ্গে মিশ খাইয়ে দিয়ে । বিশ্বায়নের আড়কাঠি কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই প্রক্রিয়ায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । তাদের বিজ্ঞাপন গুলিতে ব্যবহার হচ্ছে অদ্ভুত সব খিচুড়ি ভাষা ‘এ দিল মাঙ্গে মোর’, ‘ঠান্ডার নতুন ফান্ডা’ ইত্যাদি ।
দু বছর আগে , ২০১২র অক্টবরে লখণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ভাষা সংক্রান্ত এক সেমিনার হয়েছিল । সেই সেমিনারের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদপত্র ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ জানিয়েছিল যে, ভারতে চালু ৩৮০টি আঞ্চলিক ভাষার ৯৬শতাংশ ভাষাই বিলুপ্তির পথে । ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী ভারতে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে ২৪২টি আঞ্চলিক ভাষা । এখন ভারতে মোট জনসংখ্যার ৪শতাংশ মানুষ এই মৃত্যুপথযাত্রী ভাষাগুলিতে কথা বলে, আর ৯৫শতাংশ মানুষ যে প্রধান ভারতীয় ভাষায় কথা বলে, তা ভারতে চালু ভাষা সম্মূহের ৪শতাংশ মাত্র । কি ভয়ঙ্কর ছবি উঠে আসছে ভারতকে ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’র গর্ব করা আমাদের কাছে !
এখন সারা বিশ্বে ৭৩৫৮টি ভাষা আছে, যার ৯০ শতাংশই ২০৫০এর মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ভাষা বিজ্ঞানিদের অনুমান । এর মধ্যে ৩৩০টি ভাষায় কথা বলে ১০লক্ষের বেশি মানুষ, ১৭৮টি ভাষায় কথা বলে ১০জন মানুষ, ২০০টি ভাষায় ১০জনেরও কম আর ৫১টি ভাষায় মাত্র একজন করে কথা বলার লোক আছে । সেই শেষতম মানুষটির মৃত্যুর সঙ্গেই সেই জনগোষ্ঠীটি তার ভাষাপরিচয় হারিয়ে ফেলবে । পরের প্রজন্ম জানবেও না তার পূর্বজদের মুখের ভাষা কেমন ছিল, কেমন গান তারা গাইতো, কি রকম ছড়া-গল্প-গান শুনতে শুনতে তাদের শিশুরা ঘুমিয়ে পড়তো ! ঠিক পাঁচবছর আগে ২০১০এর ২৬শে জানুয়ারি ভাষাপ্রেমিকদের সামনে এসেছিল এক বিষন্ন দিন, যেদিন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ৮৫ বছরের নিঃসন্তান বৃদ্ধা বো সিনিয়রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে আন্দামানী জনজাতিরন্যতম প্রাচিন ভাষা ‘আকা বো’ । বো সিনিয়র ছিলেন সেই ভাষায় কথা বলা শেষতম মানুষ । ১৮৫৮তে ইংরাজরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে উপনবেশ করার সময় বো জনজাতির লোকসঙ্খ্যা ছিল পাঁচ হাজার আর বো সিনিয়রের মৃত্যুর সময় সেই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫৮ জনে, যাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সেই ভাষাটি জানতেন । এই ভাবে ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠাই যেন মুছে গিয়েছিল সে দিন ।
ভাষা বিলুপ্তির এই প্রক্রিয়া তীব্রতর হচ্ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর উন্নত দেশগুলির প্রাধান্য বিস্তারের গতির সঙ্গে তাল রেখে । খোদ আমেরিকাতেই ১৯২টি জনজাতির ভাষা বিলুপ্তির পথে । ইন্দোনেশিয়ায় ১৪৭টি ও ভারতে ১৯২টি ভাষা অবলুপ্তির পথে । ভাষা বিলুপ্তির এই প্রবণতা রোখা না গেলে ভাষা বিজ্ঞানীদের অনুমান এই শতাব্দীর মধ্যেই ছ’হাজার ভাষাগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট ঘনিয়ে আসবে ।
দু’বছর আগে ২০১৩তে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে ইউনেসকো একটি উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়েছিল যে, বিশ্বে এখন কথা বলা অর্থাৎ চলতি ভাষাগুলির মধ্যে ২৫০০ ভাষাই বিপন্ন ভাষা এবং গত তিন প্রজন্মে দু’শটি ভাষার বিলুপ্তি ঘটে গেছে । এই যে আড়াই হাজার ভাষাকে বিপন্ন বলে চিহ্নিত করেছে সেগুলিকে তারা ভাগ করেছে এই ভাবে –
নিরাপদ নয় (আন-সেফ) – ৬০৭টি ভাষা
নিশ্চিত ভাবেই বিপন্ন – ৬৩২টি
মারাত্মক বিপন্ন – (সিভিয়ারলি এনডেনজার্ড)- ৫০২টি এবং
ভয়ঙ্কর বিপন্ন (ক্রিটিকালি এনডেনজার্ড) – ৫৩৮টি ভাষা ।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেছেন যে যখন তরুণ প্রজন্মএর মানুষ তার ভাষায় কথা বলে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যেমন বাড়িতে – সেও ভাষা বিপন্ন ভাষা । শিশুরা যখন তার মাতৃভাষায় কথা বলে না, তখন সে ভাষা নিশ্চিত ভাবেই বিপন্ন । আবার যে ভাষায় বৃদ্ধ বা প্রবীণ অর্থাৎ দাদু-দিদিমারা কথা বলেন, পরের প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুটির পিতা-মাতা সে ভাষা বুঝতে পারেন, কিন্তু তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ তাদের সন্তানদের সঙ্গে সেই ভাষায় আদান-প্রদান করেন না, সেই ভাষা ভাষা বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে মারাত্মক ভাবে বিপন্ন । আর একটি ভাষায় শুধুমাত্র প্রবীণরাই কথা বলেন নিজেদের মধ্যে – সে ভাষা ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন ।
স্বাধীন ভারতেও উপজাতি ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলিকে রক্ষা করার কোন অর্থবহ প্রয়াস দেখা যায় না । ভারতে অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলি কতটা বিপন্ন সে হিসাব কোন সমাজতাত্বিক করে উঠতে পেরেছেন কি না জানা নেই । কিন্তু এটা তো জানি এদেশেও অনেক প্রাধান্য বিস্তারকারী ভাষা অনেক আঞ্চলিক ভাষাকেই গিলে ফেলেছে । ১৯৯১সালের জন গণনায় স্বীকার করা হয়েছিল যে ভারতে হিন্দিভাষী মোট জনসংখ্যার ১০কোটি ৭২ লক্ষ মানুষের পৃথক ভাষা পরিচয় আছে । ভোজপুরি, বুন্দেলখন্ডি, মৈথিলী গোষ্ঠীগুলির পৃথক ভাষা পরিচয় থাকা সত্বেও সেগুলোকে হিন্দি গিলে ফেলে নিজের কলেবর মোটা করেছে । ১৯৯১ ও ২০০১এর দুটি জনগণনার প্রতিবেদন পাশাপাশি রাখলে দেখা যাবে এই দুটি জনগণনার মধ্যবর্তী সময়কালে সব প্রধান ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা কমেছে, কিন্তু হিন্দির ক্ষেত্রে বেড়েছে। ১৯৯১ তে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.২২% মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন আর ২০০১এর জনগননায় এই সংখ্যাটা হয়ে গেছে ৮.০১% অর্থাৎ দশ বছরে ০.২১% মানুষ দশ বছর আগে যারা বাংলায় কথা বলতেন তারা অন্য ভাষায় কথা বলা শুরু করেছেন ।
কোন ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য থাকা বা না থাকা সেই ভাষার বেঁচে থাকার একমাত্র শর্ত নয়, জরুরিও নয় । ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য এসেছে অনেক পরে । আমরা জানি যে, মৌখিক ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সম্পদ অনেক বেশি । এই যে আমরা শিশুতোষ ছড়া-গল্প-গান শুনে বড় হই, চিরকাল শিশুরা মায়ের মুখে যে সব ছড়া-গল্প-গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে যায়, সে তো মৌখিক সাহিত্য – আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অসামান্য সম্পদ, আমরা জানিনা, জানার প্রয়োজনও নেই, সেগুলি কার রচনা । সব আঞ্চলিক ভাষারই এই মৌখিক সাহিত্য-সম্পদ আছে । ভাষাচার্য সুকুমার সেন এই মৌখিক সাহিত্য বা শিশুতোষ ছড়া-গল্প-গান প্রসঙ্গে লিখেছেন “শিশু-বেদ বয়স্কের সাহিত্য-ভুবন ধরে আছে বাসুকীর মতো । শিশু-বেদের মধ্যে ধরা আছে সমগ্র মানবজাতির জন্মপত্রিকা” । কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্তির অর্থ সেই ভাষাগোষ্ঠীকে ঘিরে যে যে জ্ঞানভান্ডার, তারও বিলোপ । আদিম জনগোষ্ঠীর মৌখিক ভাষায় সঞ্চিত থাকে তার পরিবেশ, সংস্কৃতি, বন্য-প্রজাতি সম্পর্কিত জ্ঞানভান্ডার । সমস্ত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই একই কথা বলা যায় । কারণ মানুষের জ্ঞানভান্ডারের অতি সামান্য অংশই লিখিত ও সাহিত্য রূপে থাকে, মানুষের মৌখিক জ্ঞানসম্পদ অনেক বেশি ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ । কোন ভাষাগোষ্ঠীর বিলুপ্তির অর্থ অতয়েব সেই ভাষা অঞ্চলের নৃতাত্বিক ভারসাম্য তছনছ হয়ে যাওয়া ।
এই উদ্বেগের যায়গা থেকেই মাতৃভাষা পালনের আহবান জানিয়েছিল ইউনেসকো । মাতৃভাষায় কথা বলার পরম্পরাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তর করতে না পারলে – শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখানো আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়েই ভাষা-মৃত্যুর প্রবণতাকে রোধ করা যায় – অন্য কোন বিকল্প পন্থা নেই । এটাই ভাষাদিবস পালনের তাৎপর্য । একুশে যেমন ভাষাশহিদ স্মরণ দিবস তেমনই নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রত্যয় প্রসারিত করার দিনও ।
খুব ভালো লাগলো। তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
ReplyDelete