ছোটগল্পঃ অমৃত অধিকারী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
কবি
অমৃত অধিকারী
তখনও সূর্যোদয় হয়নি। পূর্বাকাশে রক্তিমাভার সঞ্চার হয়েছে মাত্র। হেমন্ত ঊষার শীতল বাতাস বাতায়ণ পথে কক্ষে প্রবেশ করলো।
তার স্পর্শে কবির চমক ভাঙলো। উপলব্ধি করলেন, তিনি এতক্ষণ সম্মুখের পীঠিকার উপর রাখা ভূর্জপত্রটির দিকে অনিমিখে চেয়েছিলেন। পাশের কারুকার্য খচিত রাজদত্ত রৌপ্য মসীপাত্রেশ্বেতপুঙ্খের কলমটি ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে পড়েছে। লেখণী কতক্ষণ আগে থেমেছে, কবি স্মরণ করতে পারলেন না। একবার চক্ষু বিস্ফারিত করে চাইলেন ভূর্জপত্রের উপর লিখিত পংক্তি গুলির দিকে। সমাপ্ত হয়েছে? সত্যিই সমপ্ত হয়েছে কাব্য? তাঁর এত বছরের সাধনার ধন? নিজের অজান্তেই বোধহয় কবির চক্ষু দু’টি ইষৎ বাষ্পাচ্ছ্বন্ন হলো, এবং স্মিতহাস্য দেখা দিলো তাঁর ওষ্ঠাধরের কোণে। কুমারসম্ভব সমাপ্ত করার পর এমনই অনুভূতি হয়েছিলো কি মহাকবির?
কবি ধীরে ধীরে আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নাতিদীর্ঘ মেদহীন ঋজু দেহটি যেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই একবার পেশী গুলি প্রসারিত করলো। পীঠিকার পাশেই রাখা পিত্তলের দীপদণ্ডটির দিকে চাইলেন একবার। প্রদীপশিখা নিভন্তপ্রায়। তাকে ঊষানিলের অনুকম্পায় কম্পমান রেখে কবি নিঃশব্দপদে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।
অনেক বছর পূর্বের এমনই এক হেমন্তনিশার কথা সহসা স্মরণে এলো তাঁর। এমনই নিঃশব্দ, মার্জার পদক্ষেপে নির্গমন করতে হয়েছিলো বর্দ্ধমানের কারাগার থেকে। সেই বিভীষিকাময় সময়ের থেকে বর্তমান কত পৃথক! সময় বড় খামখেয়ালি...
শয়নকক্ষের প্রবেশদ্বারে একবার উঁকি দিলেন কবি। স্ত্রী গভীর নিদ্রাচ্ছ্বন্না। ত্রিশোর্দ্ধা তিন সন্তানের জননীর দেহে মেদসঞ্চার হয়েছে। পরিবারের, গ্রামের নিষেধাজ্ঞার বিরূদ্ধে গিয়ে কিশোর কবি বিবাহ করেছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নরোত্তম আচার্যের কন্যা নওলকিশোরী সারদাকে। আচার্যের দোষ ছিলো, তিনি কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা দান করেছিলেন। গ্রাম ছাড়তে হয়েছিলো কবিকে সমাজবিধান লঙ্ঘণ করার জন্য। সেই সঙ্গে ছিলো পিতৃদেবের ভূসম্পত্তির রাজাধিগ্রহণ। সে সব কবেকার কথা... পাণ্ডুয়া-বসন্তপুরের দুর্গোৎসব, মাতুলালয় নওয়াপাড়ার মেলা, তাজপুরে নরোত্তম আচার্যের সংস্কৃত টোল... মনে হয় যেন আরেক জন্মের বিস্মৃতপ্রায় স্বপ্ন!
ধীর, নিঃশব্দ পদে গৃহ হতে নির্গত হলেন কবি। যেন তাঁর পদক্ষেপের ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠলো পূর্বাকাশ। তন্ময় কবি চললেন ঘুমন্ত নগরীর জনহীন রাজপথ ধরে। পথিপার্শ্বস্থ উদ্যান, লতাবিতান গুলি থেকে সদ্য নিদ্রোত্থিত পাখিদের প্রদোষ সম্ভাষণ ভেসে আসছে। বাতাসের শীতল স্পর্শ লাগছে শরীরে। কবি একটু শিহরিত হয়ে উত্তরীয়টি দিয়ে উর্দ্ধাঙ্গ ভালো করে আবৃত করে নিলেন।
পথ একসময় কবিকে উপনীত করলো তাঁর গন্তব্যে, নগরীর কেন্দ্রস্থলে দেবী অন্নপূর্ণার মন্দিরে। এ মন্দির রাজাদেশে দুই বৎসর পূর্বে মাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দগ্ধমৃত্তিকার মন্দিরগাত্রে অপূর্ব কারুকার্য। দেবতনু নামক যে তরুণ শিল্পী এসেছিলেন বিষ্ণুপুর থেকে মন্দিরনির্মাণের তত্ত্বাবধান কার্যে, তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো কবির। স্বল্পবাক, আত্মমগ্ন শিল্পীকে তন্ময়চিত্তে কাজ করতে দেখতে বড় ভালো লাগতো তাঁর। এসে বসে থাকতেন মন্দিরসোপানে। দেবতনুর আদলে একটি চরিত্র সৃষ্টি করার কথা মনে হতো প্রায়শই। কাব্য সমাপ্ত হয়েছে। এবার তার পরিকল্পনা আরম্ভ করা যেতে পারে।
প্রধান পুরোহিত নীলাম্বর ভট্ট প্রত্যহ সূর্যোদয়ের পূর্বে দেবীমূর্তিকে স্নান করিয়ে নিত্যপূজা সমাপণ করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পূজান্তে মন্দিরপ্রাঙ্গণে এসে কবিকে দেখে ভট্টের লোলচর্ম বিরলদন্ত মুখখানি হাস্যবিম্বিত হয়ে উঠলো। সাগ্রহে এগিয়ে এলেন।
‘‘কি কাণ্ড! কবিবর যে! এই সাতসকালে এখেনে? বেপথু হলে নাকি, ভায়া?’’ প্রাক্তন রাজপুরোহিত স্বেচ্ছায় রাজকার্য থেকে অবসরগ্রহণ করে এই নবনির্মিত মন্দিরের সেবার ভার নিয়েছেন। বয়সের প্রচুর পার্থক্য সত্ত্বেও কবির সঙ্গে তাঁর কৌতুকের সম্পর্ক।
কবির ওষ্ঠাধরেও সে কৌতুকের স্পর্শ লাগলো। ‘‘কি যে ক’ন ভট্ট! আপুনারা যেখেনে দাঁড়ায়ে আছেন দিশারী হয়ে, সেখেনে কি আমরা বেপথু হই কভু?’’
‘‘তবে এসো, অন্দরে এসো। প্রসাদ পাও।’’ হাত ধরে কবিকে দেবালয়ের অভ্যন্তরে নিয়ে চললেন ভট্ট। ‘‘মুকখানা দেকে তো মনে হচ্ছে ও চক্ষুতে নিদ্রাস্পর্শ লাগেনি কাল রেতে..?’’
কবি হাস্যবিম্বিত বদনে চাইলেন ভট্টের দিকে। ‘‘আপুনি বৃদ্ধ হয়েছেন বটেক, তথাপি আপুনার চক্ষের জ্যোতি আজিও অম্লান! নাহ! কাল রেতে দু’চক্ষু মুদিনি।’’
‘‘কেন হে ভায়া? ক্লেশ কিসের? তুমি মহারাজের স্নেহধন্য মানুষ বলে কতা!’’
‘‘ক্লেশ নয়...’’ খানিকটা আত্মগত ভাবেই শিরশ্চালন করলেন কবি। ‘‘ক্লেশ নয়। রেশ। কাব্যের রেশ।’’
নীলাম্বর ভট্ট ইষৎ চমকিত হয়ে তাকালেন কবির মুখপানে। ‘‘কাব্য কি তবে...?’’
স্মিতহাস্যে অধরোষ্ঠ বিকশিত করে ধীরে ধীরে উপর-নীচে মস্তক আন্দোলিত করলেন কবি। ‘‘সমাপ্ত হয়েছে। অবশেষে।’’
শ্রবণমাত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ভট্টের বলিরেখাঙ্কিত মুখ। নগরীর প্রত্যেক কাব্যানুরাগী বিদ্বদ্জন উন্মুখ আগ্রহে অপেক্ষমান ছিলেন, কবে রাজকবির কাব্যখানি সমাপ্ত হবে। ‘‘আজ তবে সভাস্থলে পাঠ হবে?’’ প্রশ্নখানা স্বতঃই নির্গত হলো ভট্টের কন্ঠ হতে। কোনওরূপ অভিনন্দন-সম্ভাষণের পূর্বেই।
প্রবীণ অনুরাগীর আগ্রহাতিশয্যে কবির মুখে যেন কিঞ্চিৎ অরুণাভার সঞ্চার হলো। অনুমোদনসূচক শিরশ্চালনা করে বললেন, ‘‘আপুনার উপস্থিতি সেথা অবশ্যপ্রার্থনীয়।’’
উদয়রবির স্নেহস্পর্শে তখন পূর্বাকাশেও অরুণিমা।
..................
রাজসভা নিশ্চুপ, নিস্পন্দ। কোনও সুন্দরীর কবরীচ্যূত ফুলের ভূমিতে পতনশব্দও বোধ করি শ্রূতিগোচর হতো। উপস্থিত সকল সভাসদ ও রাজপুরুষগণ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শ্বেতমর্মরের রাজসিংহাসনের বাম পাশে কাষ্ঠাসনে উপবিষ্ট কবির দিকে। স্বয়ং রাজাও উদ্গ্রীব, উৎকর্ণ।
কবি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। করধৃত ভূর্জপত্রটি চক্ষুর সম্মুখে উন্মীলিত করে ধরলেন। তারপর মন্দ্রকন্ঠে আবৃত্তি আরম্ভ করলেন...
‘‘সুন্দর বিদ্যারে লয়ে ঘরে গেলা হৃষ্ট হয়ে
বাপ মায়ে প্রণাম করিলা।
রাজা রাণী তুষ্ট হয়ে পুত্রবধূ পৌত্র লয়ে
মহোৎসবে মগন হইলা।।
রাজা গুণসিন্ধু রায় পুলকে পূর্ণিত কায়
সুন্দরেরে রাজ্যভার দিলা।
সুন্দর আনন্দচিত লয়ে গুরু পুরোহিত
নানামতে কালীরে পূজিলা।।
সুন্দরের পূজা লয়ে কালী মূর্ত্তিময়ী হয়ে
দম্পতীরে কহিতে লাগিলা।
তোরা মোর দাস দাসী শাপেতে ভূতলে আসি
আমার মঙ্গল প্রকাশিলা।।
ব্রত হৈল প্রকাশ এবে চল স্বর্গবাস
নানামতে আমারে তুষিলা।
এত বলি জ্ঞান দিয়া মায়াজাল ঘুচাইয়া
অষ্টমঙ্গলায় বুঝাইলা।।
দেবী দিলা দিব্য জ্ঞান দুহে হৈলা জ্ঞানবান
পূর্ব্ব সর্ব্ব দেখিতে পাইলা।
দেবীর চরণ ধরি বিস্তর বিনয় করি
দুই জনে অনেক কান্দিলা।।
বাপ মায়ে বুঝাইয়া পুত্রে রাজ্যভার দিয়া
দুইজনে সত্ত্বর চলিলা।
আনন্দে দেবীর সঙ্গে স্বর্গেতে চলিলা রঙ্গে
রাজা রাণী শোকেতে মোহিলা।।
বিদ্যা সুন্দরেরে লয়ে কালিকা কৌতুকী হয়ে
কৈলাশশিখরে উত্তরিলা
ইতিহাস হৈল সায় ভারত ব্রাহ্মণ গায়
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আদেশিলা।।’’
আখ্যায়িকা সমাপ্ত করে কবি কিয়ৎকাল নীরবে দণ্ডায়মান রইলেন। রাজসভা পাঠপূর্ববৎ নিশ্চুপ। তারপর সহসা বিস্ফোরণ হলো। হর্ষধ্বনি ও করতালিতে সভাগৃহ পূর্ণ হলো। প্রশংসাসূচক বাক্যগুলির মধ্যে কবির কর্ণগোচর হলো বৃদ্ধ নীলাম্বর ভট্টের উত্তেজিত কন্ঠস্বর... ‘‘আমিই সর্বপ্রথম সংবাদ প্রাপ্ত হইচি! সেই ব্রাহ্মমুহুর্তে! আমিই প্রথম...’’
ইষৎ বাষ্পাচ্ছ্বন্ন চক্ষে কবি বাকিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন, মহারাজ স্বয়ং সিংহাসন হতে অবতরণ করে তাঁর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। কৃতাঞ্জলিপুটে কবি তাঁর দিকে এগোলেন এবং সমীপে পৌঁছে অবনত হয়ে তাঁর চরণস্পর্শ করতে গেলেন। বিপুলকায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দুই হস্তে কবির স্কন্ধ ধারণ করে তাঁকে উত্তোলিত করলেন ও নিজের বিশাল বক্ষে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন।
‘‘তোমার নাম শুধু বাঙ্গালা কাব্যের নয় হে, সমগ্র বঙ্গভাষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেকা থাকবে। ধন্য তুমি, ধন্য! আমি ভাগ্যবান যে তোমারে সভাকবিরূপে লাভ করিচি।’’ নিজকন্ঠের মুক্তামালাখানি খুলে রাজা পরিয়ে দিলেন কবির কন্ঠে। সে কন্ঠ এখন এক সভাপূর্ণ গুণগ্রাহীর প্রশংসা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অবরুদ্ধ।
রাজার উদাত্ত কন্ঠস্বর শ্রবণ করে বাকিরা নিশ্চুপ হলেন। ‘‘আমি, নদে-কৃষ্ণনগরের সার্ব্বভৌম নৃপতি রায়রায়ান কৃষ্ণচন্দ্র রায়, আমার সভাকবিকে এক্ষণে রায়গুণাকর উপাধিতে ভূষিত কল্লুম। আজি হতে...’’
প্রবল হর্ষধ্বনিতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কন্ঠস্বর নিমজ্জিত হলো। সহাস্যমুখে দণ্ডায়মান মহারাজের চরণে অবনত হয়ে তাঁকে সকৃতজ্ঞ, সশ্রদ্ধচিত্তে প্রণাম করলেন বাংলা সাহিত্যের মধ্যপর্বের দিবাকরপ্রতিম শ্রেষ্ঠ কবি, অন্নদামঙ্গল ও বিদ্যাসুন্দর কাব্যের অমর স্রষ্টা, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র।
0 comments: