undefined
undefined
undefined
বিশেষ প্রতিবেদনঃ মমতা দাস (ভট্টাচার্য)
Posted in বিশেষ প্রতিবেদন
বিশেষ প্রতিবেদন
বাংলা আমার ভাষা
মমতা দাস (ভট্টাচার্য)
পর পর গুলির শব্দ ,লুটিয়ে পড়ল তরতাজা কটি প্রাণ, বয়ে গেল রক্তের নদী। বড় বেদনার, বড় প্রেরণার, বড় গর্বের সেই দিন, আজ শোনা যাক সে কাহিনী...
১৯৪৭ সালের ১৪/১৫ আগস্ট রাজনীতির পাশা খেলায় দু টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল একটা দেশ ভারতবর্ষ । জন্ম হলো পাকিস্তানের। ভারতের প্রধান মন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। পাকিস্তানের কায়েদ-এ আজম মহম্মদ আলী জিন্না গভর্নর জেনারেল । জিন্নার ঘোষণা পাকিস্তান-এর ধর্ম মুসলিম, আর রাষ্ট্র ভাষা উর্দু । আর কোনো ধর্ম বা ভাষার সরকারী স্বীকৃতি নেই। ধর্মের বিষয়টা ঠিক-ই ছিল। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হল মুসলমান, সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা এত কম যে প্রশ্ন তোলা বা দাবি করার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই ধর্ম বিষয়ে কোনো অসুবিধার কারণ ঘটল না। গোল বাঁধলো ভাষার প্রশ্নে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের কোনো অসুবিধা বা আপত্তির কারণ ছিল না। তাদের বেশির ভাগের-ই ভাষা উর্দু। এবং অন্য যারা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, জাঠ ছিল তারা প্রায় সকলেই উর্দু জানত। দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে সহজেই কথা বলতে পারত সেই ভাষায় ,তা ছাড়া তাদের সংখ্যা এত কম ছিল যে কোনরকম প্রতিবাদের কথা মাথায় আসা সম্ভব নয়, ফলে কোনরকম চিত্ত বৈকল্য ঘটল না তাদের।
বৃহত্তর পাকিস্তানের জনসংখ্যার বেশির ভাগ-ই পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ), তাদের মাতৃভাষা বাংলা । জিন্নার ঘোষণায় অসুবিধায় পড়ল তারা। উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানরা অল্প-বিস্তর উর্দু জানলেও সাধারন বাঙালিরা নিজেদের মাতৃ ভাষাতেই অভ্যস্ত । সমস্ত সরকারী কাজ, কাগজপত্র, ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে বাধ্যতা মূলক ভাবে উর্দুর ব্যবহার তাদের বিরক্ত করে তুলল। তার উপরে শিক্ষার মাধ্যম-ও করা হলো উর্দু বা ইংরাজী কে। বাঙালির বিরক্তি বাড়লো। ১৯৪৭-এর ডিসেম্বর মাসেই পূর্ব বাংলার বাঙালিরা বাংলা ভাষায় শিক্ষা এবং কাজকর্মের অধিকার চেয়ে সমাবেশ করে। সেই হলো বাংলা ভাষার জন্য প্রথম সমাবেশ ,তবে তাতে সামিল হন কেবলমাত্র শিক্ষক ও ছাত্ররা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি -তে একটি প্রতিবাদ সভা হয়। 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ 'গঠিত হয় । ইতিমধ্যে পাকিস্তান সরকার সমস্ত পোস্টাল স্ট্যাম্প, মুদ্রা, সমস্ত সরকারী কগজ-পত্র থেকে বাংলা ভাষা কে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেয়। পরিষদ তার প্রতিবাদ করে। পাকিস্তান সরকার সে প্রতিবাদে কর্ণ পাত করে না। ১৯৪৮ সালে প্রথম শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশ বিধানসভায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি তোলেন। সেই সুর ধরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি-র চত্ত্বরে ছাত্ররা জমায়েত হয় প্রতিবাদ কর্ম-সূচী নিয়ে। জারি হয় ১৪৪ ধারা, পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি ব্যবহার করে। প্রচুর ছাত্র আহত ও বন্দী হয়।
পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী এক কথায় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে এসে জিন্না ঘোষণা করে বাঙালিদের এই অনুচিত দাবি কোনমতেই মানা হবে না , এবং পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলার এই অপচেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে। বাঙালিদের সম্মানে লাগে, এবং তারা রাগে ফুটতে থাকে। বাংলা ভাষার জন্য ছাত্রদের আন্দোলন চলতে থাকে। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিধানসভা একটি প্রস্তাব আনে , তার মূল বিষয় দুটি,
১) বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের মূল ভাষা হবে, তবে সেটা সময় সাপেক্ষ। সমস্ত সরকারী দপ্তর প্রস্তুত হলে তবেই ভাবা হবে সেই ব্যাপারে।
২) স্কুল-কলেজে বাংলায় শিক্ষা দেওয়া হবে ,তবে মাধ্যমিক ও তার উপরের স্তরে উর্দু হবে Second Language .এই প্রস্তাবের পরে অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে। Dr. শহীদুল্লাহ বললেন, "পূর্ব বঙ্গে বাংলা ভাষাকে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। বাঙালি (মুসলমান,হিন্দু) একটা আলাদা জাত, তাদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। সেই ভাষাই বাংলার সর্বস্তরে (সরকারি-বেসরকারী কাজকর্ম, শিক্ষা ) ব্যবহৃত হতে হবে ",( ডিসেম্বর ১৯৪৮ ) . Dr .শহীদুল্লাহ'র কথা বাঙালির মনে ধরল, আপামর বাঙালির দ্বারা সাদরে গৃহিত হল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের বাস্তব সমস্যা না বুঝে, এই কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। তার বদলে সেখানে সংসদে প্রস্তাব গৃহিত হয় যে সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত যত শব্দ মিশেছে বাংলা ভাষায়, সেই সমস্ত শব্দ পরিহার করা হবে। সেগুলি বাদ দিয়ে ,উর্দু,আরবী, ফার্সি শব্দ ঢোকানো হবে। সেটা একরকম অসম্ভব কাজ ! হাজার বছরের ব্যবহারে এত সংস্কৃত শব্দ ভারতে ব্যবহৃত ভাষা গুলিতে ঢুকেছে যে তাদের মুছে দেওয়া অতি দুরূহ কাজ, একরকম অসম্ভব।
১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী নিহত হয়, এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয় খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ সালে মুসলিম লীগের ঢাকা সম্মেলনে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করে যে, 'উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা, অন্য কোনো ভাষা সরকারী স্বীকৃতি পাবে না।' বাঙালি রাগে, অপমানে ফুলতে থাকে। আহত হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারীতে একটি গোপন অধিবেশনে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলগুলি মিলিত ভাবে ঠিক করে ভাষা আন্দোলন শুধু ছাত্র আন্দোলন হলে সফলতার আশা কম, একে রাজনৈতিক রূপ দিতে হবে। নেতৃত্ব দেবে রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু মুখ্যত এটা থাকবে ছাত্র আন্দোলন রূপেই। সারা ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে নানারকম প্রতিবাদ সভা, ধর্না, সমাবেশ চলতে থাকে। ছাত্ররা ঢাকা ইউনিভার্সিটি-তে একটি সমাবেশের ডাক দেয়, ফেব্রুয়ারী-র ২০ তারিখ। ১৪৪ ধারা জারি করা হয় ইউনিভার্সিটি ও তার আশে-পাশে।
ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখ ,১৯৫২ সাল, বিরাট প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়। সকাল থেকে ছাত্ররা ১৪৪ ধারার পরোয়া না করে ইউনিভার্সিটি চত্ত্বরে জমা হতে থাকে । দুপুরে বিশাল জনসভায় সর্ব সম্মতি ক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, বিধানসভার সামনে প্রতিবাদ সংঘটন করা হবে। প্রতিবাদ সভা শুরু হওয়া মাত্রই শুরু হয় পুলিশী অত্যাচার। ছাত্রদের দমানো যায় না। নামল আধা সামরিক বাহিনী। শুরু হলো কাঁদানে গ্যাস আর লাঠি চার্জ। ! ছাত্ররাও ইঁট-পাথর দিয়ে প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করে। ক্রমে আন্দোলনের জোর বাড়ে, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররাও এসে যোগ দেয়। মাতৃভাষার জন্য আবেগে উত্তাল হয়ে ওঠে ছাত্র সমাজ, কার সাধ্য তাকে রোধ করে ? "এই যৌবন জল তরঙ্গ রুধিবে কে ?" ক্রমেই দুর্বার হয়ে ওঠে ছাত্ররা। আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে , অত্যাচার-ও সীমা ছাড়াতে থাকে। শত শত ছাত্র আহত হয়। কারাবরণ করে হাজারে হাজারে ছাত্র। নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চলতেই থাকে। ঐদিন বিকেলে মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশ ছাত্রদের উপরে গুলি ছোঁড়ে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি-র ৩ জন ছাত্র সমেত মোট ৫ জন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় আব্দুস সালাম,রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত ,আব্দুল জব্বর, সফিক, শফিউর রহমান। বহু ছাত্র আহত হয়। বহু ছাত্র কারা বরণ করে। প্রতিবাদে বিধানসভার অধিবেশন মুলতুবি করার দাবী তোলে বিরোধীরা, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয় । বিরোধীরা প্রতিবাদ করে সভা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ছাত্রদের মৃত্যু স্থলে একটি 'শহিদ মিনার' গড়ে তোলা হয় রাতারাতি ! পাকিস্তানী সৈন্যরা সে শহিদ মিনার ভেঙ্গে দেয়। আবার সেই স্থানেই গড়ে তোলা হয় মিনার। সিমেন্ট, বালি ইঁট জোগাড় হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে নির্ণীয়মান ভবন থেকে। এবং ধারাবাহিক আন্দোলন চলতেই থাকে।
লাগাতার আন্দোলনে জেরবার পাকিস্তান সরকার অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৪ ঠা মে বাংলা ভাষাকে সরকারী মর্যাদা দিতে সম্মত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করে, ঘোষণা করা হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা দুটি, ...উর্দু এবং বাংলা। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের 'ভাষা অন্দলন'-এর জয় হল অবশেষে। ঢাকায় জন্মলাভ করল বাংলা একাডেমি। এর পরে ভোট জিতে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। নূতন মুখ্যমন্ত্রী তত্কালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার কে ঘটনাস্থলে একটি স্থায়ী শহিদ বেদী নির্মানের পরিকল্পনার দায়িত্ব দেন। তৎকালীন সুবিখ্যাত আর্কিটেক্ট (স্থপতি) হামিদুর রহমানের উপর দায়িত্ব বর্তায় বাঙালির সফল স্বপ্নের রূপকারদের স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে তোলার। তৈরী হল কাঁচের তিনটি স্তম্ভ, মাঝখানের বড়টি মা এবং দুপাশের ছোট দুটি সন্তান, পিছনে লাল উদীয়মান সূর্য। সূর্যের আলোয় তারা জ্বলে ওঠে। শহিদ বেদির নীচে, মাটির তলায় হল বানিয়ে দেয়ালে ছবি এঁকে (ফ্রেস্কো), সমগ্র ভাষা আন্দোলনের ঘটনা অমর করে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তবে সেই প্রস্তাব পরে পরিত্যক্ত হয়। বাঙালির আবেগ প্রবণ মনে ২১ সে ফেব্রুয়ারী-র আন্দোলন আবেগ এবং সম্মানের স্থান অধিগ্রহন অধিগ্রহণ নিল। বাঙালি কবি আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী কবিতা রচনা করলেন, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারী / আমি কি ভুলিতে পারি?" বাঙালির আবেগ ভালবাসার জোয়ারে পরিণত হল, সুর বসিয়ে গানে পরিণত করা হল। প্রত্যেক বৎসর এই গানটি দিয়ে 'ভাষা আন্দোলন' স্মরন অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। প্রভাত ফেরি এবং পদযাত্রায় এই গানটা গাওয়া হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষা এবং বাঙালিদের একটি স্মরনীয় দিন হিসাবে পরিগণিত হল। এবং এই বিশেষ দিন থেকেই বাঙালিদের মনে স্বাধীনতার ক্ষীন চেতনা জাগরিত হল। বলা যেতে পারে সম্ভাবনার বীজ বপন হল। বাঙালি বুঝলো সার্বিক আন্দোলন একদিন স্বাধীনতাও এনে দিতে পারে। কাজেই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনার সূচনা বলে ধরা যেতে পারে। পরে ইউনাইটেড নেশন (United Nations )-এর পক্ষ থেকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস' (International Mother tongue day ) হিসাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারী কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের সালের নভেম্বর মাসে ফ্রান্সের প্যারিস-এ তাদের হেড কোয়ার্টার থেকে এই ঘোষনা করা হয়।
আজ বাংলা একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। তার সরকারী ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা এখন পূর্ণ সম্মানে, মর্যাদায় সেখানে প্রতিষ্ঠিত। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সুন্দর, সফল স্বীকৃতি। নমস্য সেই ছাত্র দল যারা মাতৃভাষার জন্য শহিদ হয়ে বাংলার ভাষার পথ সহজ করেছিলেন ! আমার বিনম্র শ্রদ্ধা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী সেই ভাষা শহিদ দের প্রতি।
0 comments: